আমার কবিতা: কাঠবিড়ালির লাফ ---৩৬
--------------------------------------------------------
বছরের যে কোনো সময় পুরুলিয়া জেলা থেকে অসংখ্য যুবক কাজ করতে চলে যায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে।
ছোটবেলায় শুনেছি, পুব খাটতে যাচ্ছে। পুব অর্থে পুব দেশ। সামনেই বর্ধমান জেলা পুরুষ মহিলা একইসঙ্গে ধান কাটার কাজে ধান রোয়ার কাজে, ইঁট ভাটার কাজে দলকে দল চলে যায়।
সেই কাজ সেই যাওয়া এখনো চলছে সমানে।
এই খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের পরিযায়ী শ্রমিক নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল অতিমারির কালে।
অতিমারি কতটা অতিমারি ছিল, সে বিতর্ক আপাতত থাক। এখন বলতে চাইছি, শ্রমিকদের কথা। পরিযায়ী বলে যাদের অপমান করা হয়েছিল।
এদেশের বিভিন্ন মানুষ নানা পেশাতে কাজ করতে চলে যায় নানান রাজ্যে। এবং অন্য রাজ্য থেকেও পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে আসে হরেককিসিমের পেশার মানুষ।
সবাইকে তাহলে পরিযায়ী বলতে হয়।
পাখিরাও পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে এদেশে আসে। শীতের সময়। তাদেরও পরিযায়ী বলা হয়ে থাকে। আমি আমার জায়গা থেকে, পাখিকেও পরিযায়ী বলতে চাই না। পাখির কোনো দেশ নেই সীমান্ত নেই।
মুকেশ মাহাত পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি থানার এক গ্রাম থেকে উড়িষ্যার জাজপুরে সিকিউরিটির কাজ করতে গেছে।
সে তো তার শ্রম দিয়ে সময় দিয়ে কাজ করছে। সে চাইবেও তার সম্মান। মাস শেষ হলে বেতন টুকুই তার কাছে সব নয়। যদি মালিকপক্ষের তরফ থেকে দেখা যায় কোনো রকম শোষণ শাসন তা অপমান বৈ কিছু নয়।
এই অপমান শুধু মুকেশের নয়, সমস্ত রকম শ্রমিকদের অপমান।
এ অপমান আমারও গায়ে লাগে।
যেহেতু আমরা একই দেশের মানুষ। যেকোনো শ্রমিকের কাছে অপমান এলে, আমার কাছেও তা শব্দ করে ওঠে।
আমার মুখ কালো হয়ে যায়।
এই কালো রঙ অপমানের রঙ চাপা পড়ে না। ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না কোনোভাবেই।
শুধু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে শিল্প সৃষ্টির দিকে যাওয়া। মুকেশও ফটোগ্রাফি চর্চা করে। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে নিসর্গ প্রকৃতি। যা যেকোনো রোগের মহোষৌধ। অথবা উপশম করে বলা যায়।
ক্যামেরা কেনার মত মুকেশের ক্ষমতা নেই। সে শুধু মোবাইল ক্যামেরা থেকে একটার পর একটা ছবি ধরে রাখে। নিজের জন্য। আমাদেরও জন্য।
মুকেশের শ্রম ও সৃষ্টির কাছে আমি নত হই।
-----২২ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----৯---১২---২০২২
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ ---৩৭
---------------------------------------------------------
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। আমার মনও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। অসহায় লাগছে খুব।
নিজেকে উজ্জীবিত করতে সবজি বাজারে গেলাম। কোথায় আর উজ্জীবন? আমার চেনা সবজিওয়ালা শংকরের পাশেই এক যুবক পালং শাক বিক্রি করছে। তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। এই প্রথম। সে আমার কাছে বললো----আমি যদি একটা কম্বল তাকে দিতে পারি।
কোনো কথা না বলে তাকে বললাম, আমি চেষ্টা করবো অবশ্যই। তবে আমি ভেতরে ভেতরে অসহায় হয়ে উঠেছি। গভীরভাবে।
আমার তো কোনো ক্ষমতা নেই। কার কাছেই বা চাইবো? যেটুকু কম্বল চাদর পেয়েছিলাম, শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে কোন্ বন্ধুকে বলবো---আমাকে কম্বল দাও। চাদর দাও। অসংখ্য মানুষের শীত করছে। রাস্তায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে অনেক মানুষ।
আমি ক'জনের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো শীতবস্ত্র?
অঘ্রাণ শেষের হাওয়ায় ঠান্ডা লাগছে খুব। তারই সঙ্গে আকাশের মুখ ভার। এক ফোঁটা রোদ নেই কোথাও। সেই কারণে শীতটা জোরালো লাগছে।
যুবকের পাশে আরেকজন বিক্রি করছিল ফুলকপি। সেও আমার কাছে চাইলো, একটা কম্বল।
মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে হলো, আমার অসহায়তা আমি দেখাতে পারবো না আর। আমি কি তবে পালিয়ে যাব?
কোথায় পালাবো কার কাছে পালাবো? আমার সৃষ্টির কাছে গেলে আমি কি মনে জোর পাবো? আমার সৃষ্টি যদি আমাকে আরো দুর্বল করে?
কবিতাও তো কখনো কখনো অসহায়।
----বেলা ----১২--৩১
----২৪ অঘ্রাণ ১৪২৯
----১১---১২---২০২২
----নির্মল হালদার
আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ --৩৮
--------------------------------------------------------
প্রকৃতি নীরব।
আমার শুধু রব।
আমি কথা বলি। চিৎকার করি।
প্রকৃতি তার নীরবতা নিয়ে নিজেকে পরিবেশন করে। আমি নিজেকে সাজাই। নিজের আত্মপ্রচারও করে থাকি। প্রকৃতির অনেক রঙ। বৈচিত্র অনেক। ফুলে ফলে নিঃশব্দ।
আমি শব্দ করি।
প্রকৃতি আমাদের আত্মীয়। সেই আত্মীয়তা আমি কি অনুভব করি? আমি কি টান অনুভব করি, জল জঙ্গল জমির প্রতি?
আমি একা একা বাঁচতে চাই। যতই আমার আত্মীয়-স্বজন থাকুক, পরিবার থাকুক, আমি আসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা বাঁচতে চাই।
হরিতকির পাশে দাঁড়িয়ে আছে জারুল। কোনো বিরোধ নেই। কুসুম হেলে পড়ছে নিমের গায়ে। কোনো বাদ -বিবাদ নেই।
বটের শিকড় তলে তলে পলাশের শিকড়ে নিজেকে জড়ায়। আর আমি নিজের শিকড় থেকে ছিন্ন হয়ে একা একা শীর্ণ হয়ে উঠি।
এইতো আমার চরিত্র।
প্রকৃতি খোলামেলা। প্রকৃতি সজীবও। প্রকৃতির কাছে পশু পাখি কীট পতঙ্গের ঠাঁই।
পাহাড় নদী সমুদ্র আমি দেখতে যাই। আমি কি টান অনুভব করি? প্রকৃতি হলো প্রেমের জয়গান। নীরব।
আমি রব।
এই রবের কাছে প্রেমের জয়গান কখনো এসে দাঁড়ায় না। কখনো এসে দাঁড়াবে না শিকড়ের সুর।
একটা গাছের শিকড় অন্য গাছের শিকড়ের সুর শুনতে শুনতে বৃহৎ পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। আর আমি চিৎকার করি----- সব আমার। সমস্ত আমার। নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারি না। অপরের দুঃখকে নিজের দুঃখ বলতেও আমি অপারগ। কারণ, নিজের সুখ দুঃখ বেদনা নিজের কাছে বড় হয়ে ওঠে। অন্যের জন্য সংবেদনশীল হয়ে ওঠার সাধনা আমার নেই। পাহাড়ের কাছে কেমন করে দাঁড়াবো? পাহাড় তো অনেক বড় বিষয়। অনেক বড় অপেক্ষা।
নীরব।
নীরব একটি কবিতা।
-----২৫ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----১২---১২---২০২২
-----বেলা-১২--৮
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ --৩৯
--------------------------------------------------------
বিপত্তারিণীর ব্রতর দুব্বা ঘাস বাঁধা লাল সুতো আমার বন্ধুকে প্রতিবছর পাঠাতো তার বড় বৌদি। সে কিন্তু সেই ব্রতর লাল সুতো হাতে বাঁধতোনা। এক বছর দেখা গেল, ব্রতর সুতো আমার বন্ধুর কাছে পৌঁছোলো না। তারপর, বন্ধুর সঙ্গে বৌদির দেখা হতে বন্ধু জানতে চাইলো, এবছর সুতো পাঠাও নি কেন? বৌদির উত্তর ছিল--- তুমিতো পরো না। সেই উত্তরে বন্ধু বলেছিল----আমি বিশ্বাস না করলেও তুমি তো আমার কল্যান কামনা করেই পাঠাও। তোমার বিশ্বাসের সঙ্গে আমি তো কোনো তর্ক করিনি।
সত্যি সত্যি বিশ্বাসের সঙ্গে তর্ক চলেনা। তর্ক চলতে পারে তার সঙ্গেই, যে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবে, কোনটা সংস্কার কোনটা কুসংস্কার।
সবার সঙ্গে তর্কও কি চলে?
তর্ক করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ এক রকমের মৌলবাদ।
এদেশের সংস্কার কুসংস্কার অশিক্ষা অসচেতনতাকে দূর করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। কোন্ শিক্ষা? সেও ভাবনাচিন্তার বিষয়।
আমাদের এদেশের কাঠামো পুরুষতান্ত্রিক। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সমাজ পুরুষতন্ত্রের নানা শিকলে বাঁধা। তা ক ' জন মেয়ে জানে? শাঁখা-নোয়াও তো পুরুষতন্ত্রের এক একটি শিকল। যা ছিঁড়ে আমাদের মেয়েরা পারে কি নিজেকে মেলে ধরতে ?
সংস্কার যে নির্জীব কে বা কারা বোঝাবে? ঐতিহ্য যে সজীব কে বা কারা বোঝাবে? ঐতিহ্যের সজীবতার সঙ্গে সৌন্দর্য থাকে নান্দনিকতা থাকে।
একটি ঘটে আম পল্লব স্থাপিত করা হলে, সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে। প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্তির প্রকাশও।
জটিলতা এই, কোনো প্রশ্ন নেই। কেন সিঁদুর পরবো কিজন্যে পরবো----প্রশ্নটা আসে না। প্রশ্নটা এলে একটা পথ পাওয়া যায়।
যে মেয়েটি সমস্ত জেনে শুনে বুঝে নিজের সিঁথি ও কপালে সিঁদুর বিন্দু লাগায়, সে নিশ্চয়ই নান্দনিকতা বোধে ঋদ্ধ হয়েছে। যেমন, বর কনে বিদায়ের সময়
একটা রীতি আছে, কনে এক আঁচল চাল মায়ের আঁচলে দিয়ে বলবে----তোমার দুধের ঋণ শোধ করলাম।
আসলে, এওতো পুরুষতন্ত্রের রীতি। তুমি তোমার পিতৃ পুরুষের গোত্র ছেড়ে আমার ঘরে এসো। তুমি তোমার মাতৃপুরুষের বাঁধন ছিঁড়ে এসো----।
এও যে পুরুষতন্ত্রের প্রকাশ , এও যে এক শাসন শোষণ, এ বুঝতে পেরেই সেদিন দেখলাম একটি মেয়ে যে কনে হয়ে চলে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি, সে উচ্চারণ করলো না মায়ের দুধের ঋণ শোধ করলাম। বরং এই রীতির প্রতিবাদ করে উঠলো উচ্চকণ্ঠে।
সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো, আমাদের সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি সোচ্চার কবিতা।
সারাদেশের মেয়েদের পক্ষ থেকে একটি সোচ্চার কবিতা।
-----২৬ অঘ্রাণ ১৪২৯
----১৩---১২---২০২২
-----নির্মল হালদার
আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ ---৪০
---------------------------------------------------------
শীতকাল।
আমাদের ছাদ নেই, একটু উঠোন। রোদ এলেও তাড়াতাড়ি চলে যায়। সকাল সকাল তাই, রোদে দিতে হয় লেপ কাঁথা। বিছানা বালিশ। রোদ খাওয়ালে রাতের সময় গায়ে নিলেই, বেশি বেশি ওম।
আমাদের ছাদ নেই।
শীত তো আছে।
কাল বেলার দিকে আলম চাচা এসেছিল। আলম চাচা এক ধুনুরি। পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে পুরনো লেপের তুলো ধুনে দিয়ে যায়। লেপ হয়ে ওঠে নতুন।
আমাদের ঘরে কটা লেপ ছিল?
ঘর তো ছিল একটাই। সদস্য ছিল অনেক। গরমের সময় দেখেছি, মা ও বৌদি কাঁথা বুনছে।সেই কাঁথা বোনার ছুঁচ ছিল বেশ লম্বা। ফোঁড় তুলতে তুলতে কাঁথার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত।
নানা রঙের সুতো।
ছেঁড়া শাড়ির সুতো।
সেই সমস্ত সুতোতে জড়িয়ে থাকতো সংসারের খুঁটিনাটি। হলুদের দাগ। চোখের জলের দাগ। অভিমানও লুকিয়ে থাকতো ছেঁড়া শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে।
ছেঁড়া শাড়ি জুড়ে জুড়ে এক একটা কাঁথা।
কারা কাঁথা ব্যবহার করে, কারা লেপ ব্যবহার করে, আলম চাচা টের পেতো কিনা জানিনা। তবে শীত এলেই,হাঁক পাড়তো-------লেপ ধুনবে----? তূলা ধুনবে---?
উঠোনে বসেই খোঁজখবর, কে কেমন আছে? ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল নাকি? অমুকের ছেলে স্কুলে যাচ্ছে?
আলম চাচার আন্তরিক কণ্ঠস্বর শীতের হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে আমার কাছে আজও এসে দাঁড়ায়।
আমার শীত করে।
আলম চাচা তুলো ধুনছে। উড়ে উড়ে বেড়ায় শাদা শাদা ফুলের মত তুলো। আমরা ছোটরা হৈচৈ করে তুলো ধরতে যাই। এক মজার খেলাতে মেতে উঠি।
আলম চাচা হাসে। তার শাদা দাড়িতেও লেগে আছে তুলো।
মা ও জেঠি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ছোটদের উদ্দেশ্যে বলে----তোরা চলে আয় চলে আয়। আলমকে কাজ করতে দে।
কে শোনে কার কথা!
কাজের ফাঁকে মায়ের কাছে জল খোঁজে আলম চাচা।মা দিয়ে যায় এক ঘটি জল।
সেই জলে কি দেখেছিলাম, আকাশের মত কাঁথার ছবি?
আলম চাচার কাছে জেঠি জানতে চায়, এ বছর ধান হয়েছে কেমন? বছর দিন যাবে তো? গেল বার তুমি বলেছিলে, তোমার ছেলেটা গামছা বুনছে। তোমরা কি গামছা বিক্রি করো বাজারে? তাহলে আমাদেরও দিয়ে যাবে একটা।
সেই গামছাটা কই?
শীত এসে গেছে।
আলম চাচা কই?
তুলো উড়ছে বনে জঙ্গলে। নির্জনে। স্মৃতিরাও উড়ছে। স্মৃতিরা সজীব।
পুরনো ওই জীবন আমাদেরই।
-----২৭ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----১৪ ---১২---২০২২
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন