রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৩

আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৫১
---------------------------------------------------------

সামাজিক মাধ্যমগুলিতে বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে, কে কোথায় কম্বল বিলি করছে।
কে কোথায় কম্বল বিলি করবে
কবে করবে কোন্ গ্রামে , এই বিজ্ঞাপনও দেখা যাচ্ছে। অহরহ।

শোনা যাচ্ছে, রাতের শহরে রাস্তায় থাকা মানুষদের কম্বল দিয়ে গেছে কোনো কোনো সংস্থা। কোনো কোনো ব্যক্তিও মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে থাকা মানুষদের দিয়ে গেছে শীতবস্ত্র।

পুরুলিয়াতে তীব্র শীত।

উত্তুরে হাওয়া বইছে। জাঁকালো হয়ে পড়ছে ঠান্ডা। লেপ-তোষকের শীত সবার জন্য নয়।

ভালোবাসার উষ্ণতাও সকলের দিকে যায় না। কেবল হাহাকার। অভাব । অসহায়তা। দারিদ্র। প্রেম বিলাতে কে আর আছে এদেশে?

সকাল সাতটার আগে রাস্তায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে অনেকে। হাসি তামাশাও চলছে তার সঙ্গে।

আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেঁকে নিয়েছি আমার দুটো হাত। ইচ্ছে করছিল, পা দুটো সেঁকে নিই।

হু হু হাওয়া।

বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে দেয়।

ইবার জাড় যা পড়লো ----আর বাঁচবো না ভাই। ই বুড়া বয়সেও কাজ করতে ঘর থেকে বাইরে
আসতেই হলো।
একজন পথচারী আরেকজনকে বলতে বলতে চলেছে কাজের দিকে।

কোথায় কাজ?

এদেশের শীত আর বর্ষা অসহায় করে দেয় অজস্র মানুষকে। সমাধান করতে কে আর এগিয়ে আসে? ব্যক্তি মানুষের উদ্যোগ থেকেও সমাধান করা যায় না। দল থেকে নির্দল থেকেও সমাধান করবেনা কক্ষনো।

মানুষের অসহায়তা শাসক দলের কাছে শোভা। ঐশ্বর্য। যা দেখিয়ে দেখিয়ে ভোট চাইবে।

আমি চা চাইছি এই সকালে। এক কাপ চা না হলে বুকের গুরগুরানি থামবে না।

চায়ের দোকানে দু তিনজন মজুর শ্রেণীর লোক। সামনেই আলুর গোদাম। বর্ধমান ও হুগলি জেলা থেকে আলু আসবে। ট্রাক থেকে বস্তা বস্তা আলু নামাবে এই মজুররা। তাদের খালি গা। হাঁটু অব্দি জড়িয়ে আছে একটা ধুতি। পোক্ত চেহারা।

চা দোকানে এসে দাঁড়ালো উলুক ঝুলুক চেহারার একজন।

শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর চা দোকানীর দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারায় চাইছে চা।

দোকানী তরুণ এক যুবক। সে ধুর ধুর করে বলছে, সকালেই ঝামেলা বাবা। এই ক্ষ্যাপাকে আগে তো দেখি নাই! কোথা থেকে এলো রে?

ক্ষ্যাপার দিকে চেয়ে এক মজুর সবার দিকেই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়---ইয়ার কি জাড় লাগছে নাই ভাই!
তখন আরেক মজুর বলে----
তোর গায়ে তো চাদর নাই, তুই কি দিবি দে----
ই দোকানেতো চুলাও নাই যে বলবো, আগুন পুহা, টুকু আগুন পুহা-----

আমি নিঃশব্দ নীরব।

আমার গায়ের চাদরটা আমি খুলে দিতে পারলাম কই!

মনে পড়ে গেল, পাবলো নেরুদার একটা কথা, যে মানুষ তার পায়ের ছেঁড়া চটিটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে পারবে, সেই প্রকৃত মানুষ।

------২১ পৌষ ১৪২৯
-----৬---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৫২
--------------------------------------------------------

অপেক্ষা। কার জন্য অপেক্ষা?

একটা সময় ছিল যখন মহারাজ আমার কাছেই থাকতো। সে কাজে চলে যেত সকালে। ঘরে ফিরতো রাত্রিবেলা। তখন তার জন্য একটা অপেক্ষা আমার ছিল।

আজ কার জন্য অপেক্ষা?

কিছুদিন আগেও বাপি আমার কাছে ছিল। সেও পুরুলিয়া শহরের কাজ ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। এই বাপিও সকালবেলা কাজে বেরিয়ে রাত্রিবেলা ফিরতো। অপেক্ষা ছিল আমার।

আজ কার জন্য অপেক্ষা?

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হলেই, মনে হয় আমার, মহারাজ এলো বুঝি। মহারাজ না হলে, বাপি নিশ্চয়ই আসবে।

কোনো একটা কণ্ঠস্বর পেলেই , মনে হয় আমার, এই তো বাপি আসছে। এখুনি জানতে চাইবে---কী করছেন? আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বলবো---আয়। আজ এত দেরি হলো?

মহারাজ রাত্রি বেলা ঘরে এসেই, দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াতো। আমি জিজ্ঞেস করতাম, খাবার খেয়েছিস? সে বেশিরভাগ দিন বলতো----না। খেয়ে আসিনি। আমি বলতাম, টাকা নিয়ে যা হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসবি।

মহারাজ কোথায় থাকে কোন্ দেশে?

মহারাজ ও বাপি দুজনেই গ্রামের ছেলে। কর্ম সূত্রে পুরুলিয়া শহরে এসে আমার কাছে বাসা বেঁধেছিল।

মন বেঁধেছিল কি?

কত সহজেই ওরা চলে গেছে। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। মহারাজ কোনো যোগাযোগ রাখে না। অথচ ওর জন্যে মাঝেমধ্যেই মন আমার পোড়ে।

সবার মন কি পোড়ে?

বিকেলের পর থেকেই শুরু হয় আজও শুরু হয়, একটা অপেক্ষা। আমার এই অপেক্ষা কি পাহাড়ের মত? অনেকেই আসবে, চলেও যাবে?

পাহাড়কে জড়িয়ে কেউ তো থাকে না। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দু-একটা গুল্ম লতা, গাছের চারা থাকলেও কতটুকু ছায়া দেয়?

বাপিদের গ্রামে একটা পাহাড় আছে। প্রতিদিন সে দেখতে পায়। অপেক্ষা কি দেখতে পায়? নাকি অপেক্ষা দেখা যায় না?

অপেক্ষার তো অভিব্যক্তি আছে, কেউ কি দেখতে পায় না? নাকি আমার নিজের অপেক্ষা নিজেকেই দেখতে হয়? অপেক্ষার ধূসর এক রঙও আছে। কে দেখতে পায় মহারাজ না বাপি? এক সময় বাবনও ছিল আমার কাছে। সেও স্ত্রী পুত্র সংসার এবং চাকরিতে ব্যস্ত। মনে হয়, ব্যস্ত মানুষরা পাহাড় দেখতে পেলেও পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে না। পাহাড় তো আর সুগন্ধি ফুল নয়।

অথচ পাহাড়ের কাছে দাঁড়ালেই, একটা বুনো গন্ধ। স্পর্শ নিতে পারলেই টের পাওয়া যায়। এবং গন্ধটা খুব জ্যান্ত।

জ্যান্তরাই তো অপেক্ষা করে।

পাহাড়ও এক জ্যান্ত অপেক্ষা।

মহারাজ চলে যাওয়ার পর অনেকদিন কেঁদেছি। সেই কান্না শুনতে পায়নি কেউ। আর চোখের জলের ভাগ তো কাউকেই দেওয়া যায় না। বাপি তো তবু মাঝেমধ্যে আমার কাছে এসে থাকে। কিন্তু মহারাজ? তার সাড়া শব্দ আমার কাছে একদম নেই। কখনো কখনো তার নিঃশ্বাস শুনতে চেয়েছি মধ্য রাতে। সে যখন কাছে ছিল, তখন ঘুম ভাঙলেই শুনতে চেয়েছি তার শব্দ। আজও ঘুম ভাঙ্গলে ছুঁতে চাই বাপির ঘুমন্ত শরীর। পাশে আছে তো? আমার এই জিজ্ঞাসা আমাকে তোলপাড় করলেও আমাকে একাই থাকতে হয়। প্রতিদিন।

প্রতিটি দিনও শুরু হয় অপেক্ষা দিয়ে। কার অপেক্ষা?কি জন্যে অপেক্ষা? কেনই বা অপেক্ষা? আমি জানি, মহারাজ আসবে না আর। বাপি আসবে না আর। বাবন তার সংসারে।

তারপরেও এখনো সম্পর্ক করতে করতে এগিয়ে যাই।নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। ওদিক থেকে হয়তো বা আমার সঙ্গে জড়াচ্ছে না কেউ। অথচ আমি জড়িয়ে-মড়িয়ে অপেক্ষা করছি মুকেশের জন্য। সে কবে আসবে জাজপুর থেকে, পথ চেয়ে বসে আছি। কিরাতের জন্যেও অপেক্ষা থাকে আমার। অনেকদিন অনেকে আসছে না, শুরু করলাম ডাকতে----এসো এসো----এসো আমার ঘরে।

অপেক্ষা অপেক্ষা।

অপেক্ষা ছাড়া যে বাঁচাও যাবে না।

গ্রীষ্ম তো চেয়ে থাকে বৃষ্টির দিকে।
মেঘের পথের দিকে।
গ্রীষ্ম কি চেনে মহারাজ? বাপি? বাবন?

এদের মুখ মাঝেমধ্যে আবছা হয়ে গেলেও আমার চোখ আমি মুছে নিই। আমার মন আমি মুছে নিই।

অপেক্ষা, একটা কাজও। নিঃশব্দের কাজ। লোকে দেখতে পায় না। লোকে অবশ্য অনেক কিছুই দেখতে পায় না। যেমন আমাকে দেখে , আমার বাইরেটা দেখে। ভেতর অব্দি দেখতে পেলে আমার অপেক্ষাও দেখতে পেতো।

কত কতদিন সোমদত্তার খবর নেই। কী করছে কোথায় আছে কিছুই জানি না। সে কি আসবে না আমার কাছে আর? শব্দ করবে না? শব্দ পাঠাবেও না?

আজ আকাশটা নীল হয়ে আছে। শ্যাম বর্ণ রাখাল হয়ে কার জন্য অপেক্ষা করছে?

রাধা কি আসবে আজ একটি কবিতা হয়ে?

-----২২ পৌষ ১৪২৯
-----৭---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার







আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ ---৫৩
----------------------------------------------------------

শিশুদের পড়াবো। এই বাসনা থেকে ঘরের তিনটি শিশু নিয়ে আমার স্কুল খুলেছি। বেলা বারোটা থেকে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত।

প্রথাগত শিক্ষার বাইরে ওদের কিছু শেখাতে চাই। কিন্তু কী শেখাবো? মটরশুঁটির ভেতরে কটি দানা থাকে না জানলেও চলবে ওদের। শিমের ভেতরে কটি বীজ থাকে শিশুরা না জানলেও বড় হয়ে যাবে। কোন্ নক্ষত্রের পাশে কোন্ নক্ষত্র আমি তো নিজেই জানি না। আমি কী শেখাবো ওদের! মাছের সাঁতার, ঘন্টা মিনিটে কত বেগ আমার জানা নেই। পাখি কত বেগে উড়তে পারে আমার জানা নেই একটুকুও।

তাহলে আমার স্কুল কেন?

আমি সময় কাটাতে স্কুল খুলেছি?

শিশুর মন পড়তে স্কুল খুলেছি?

নিজের ধৈর্য পরীক্ষা করতে স্কুল খুলেছি? নাকি নতুন করে আরেকবার বর্ণপরিচয় ধারাপাত পড়তে চাই?

অ-এর পরে আ মনে থাকলেও মনে নেই চন্দ্রবিন্দুর আগে কোন্ অক্ষর আছে!

ওদের কী শেখাবো?

ওরা জানে আকাশের রঙ নীল। মাটির রঙ জানে না। আমাকে প্রশ্ন করলে, চুপ থাকতে হবে। একটা কিছু বানিয়ে বলে দিলে, নিজের কাছেই নিজে অপরাধ করবো। ছোট হয়ে যাব শিশু মনের কাছে। ওরা আমার কাছে ভুল শিখুক, এ আমি চাই না।

আমি স্কুল খুলেছি।

নদীর জল বহমান। নদীর জল থেকে মানুষ উপকার পেয়ে থাকে। চাষবাস থেকে শুরু করে নদীর জলে স্নান। নদীর জল পানও করে মানুষ। নদী থেকে মাছ ধরা। এবং মাছ বিক্রি করে জীবিকা, এ কথা তো অন্য পাঁচজনেও বলবেন।

আমাকে নতুন কিছু শেখাতে হবে।

কিন্তু আমি কী জানি?

সরষে ফুল হলুদ রঙের। আর কোন্ কোন্ গাছের ফুল হলুদ হয় না বললে, অসমাপ্ত থেকে যায় আমার শিক্ষাও।

তাহলে কি বলবো, আসলে শিশুদের স্কুল খুললেও আমি আমার জন্যেও স্কুল খুলেছি?

আমাকেও পড়তে হবে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান। আমাকে খুঁজতে হবে অঙ্ক। আকাশের রহস্য। মেঘের চরিত্র জেনে মাটির হালচাল জেনে নিতে হবেই।

কার কাছে?

বই বই বই। অসংখ্য বইয়ের কাছে আমার শিক্ষা। এর পরের প্রশ্ন, আমি শিক্ষিত হতে চাই কিনা নাকি বিশ্বস্ত সূত্রে সবকিছু জেনে নিলেই হবে?

পালক প-টা পরিষ্কার লিখতে পাচ্ছে না। তাকে দেখিয়ে দিতে হবে, প -টা কীভাবে টানলে বোঝা যাবে, এইটা প। ড় ঢ় এর তফাৎ কোথায় কেন , আমি জানলে ওরাও জানবে।

আমি ওদের গাছ চেনাতে চাইলে, আমাকে চিনতে হবে আগে। আমি বটপাতা চিনলেও আমি কি জবা গাছের পাতা চিনি?

বট-অশ্বত্থ নাম দুটো একসঙ্গে উচ্চারণ করলেও দুটো গাছের পাতার গড়ন যে আলাদা কেমন করে বোঝাবো?

শিশুদের নিয়ে যেতে হবে গাছের নিকটে।

গাছ কোথায় আছে? কত দূরে?

আমার শহরে গাছ আছে তো?

সমস্ত জানতে হবে। তারপরে স্কুল।
শিশুদের স্কুল।

আমারও স্কুল।

পাহাড় জঙ্গলে কারা থাকে? পশু পাখি তো থাকেই, মানুষও থাকে একথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায় ইতিহাস।

রাজা--রাজড়ার ইতিহাস তো পরের কথা, আগে মানুষের ইতিহাস ওদের বলবো কখনো কোনোদিন। ওরা বড় হোক।

না, বড় নয়। আগে মানুষ হোক।

বড় হওয়া মানে তো কাউকে ছোট করে বড় হওয়া। আগে মানুষ হতে হবে। প্রকৃত মানুষ।

পালক ইনো নোলক এই তিন শিশুর কাছেও আমি শিখি। ওদের কাছেই শিখতে ইস্কুল খুলেছি। ওদের সঙ্গেই যাব কাকের বাসায়। ওই বাসাতেই কোকিলের ছানা।

ওদের বলছি, হাতের লেখা অভ্যাস করো। আমাকেও অভ্যাস করতে হবে। হবে না?

বদভ্যাসও ত্যাগ করতে হবে। ওদের বলার আগেই , যত্রতত্র থুথু ফেলবো না। গাছের পাতা ছিঁড়বো না কোনোভাবেই। অযথা ঢিল ছুঁড়বো না কুকুরের দিকে।

শিশুদের যা বলবো তা যেন নিজে না করি। মনে রাখতে হবে অবশ্যই।

যোগ বিয়োগ গুন ভাগ আমার কি শেখা আছে?

কবিতাও তো একটি অঙ্ক। আমি একেবারেই জানি না। যে কারণে লিখতে পারলাম না আজও একটি কবিতা।

-----২৪ পৌষ ১৪২৯
-----৯---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৫৪
---------------------------------------------------------

পায়রা উড়ে গেলে হাওয়া ছড়িয়ে যায়। শুধু পায়রা কেন যে কোনো পাখি উড়ে গেলেই, হাওয়া ছড়িয়ে যায়। আমি তবে পায়রার কথাই বলবো, ওরা প্রতিদিন আমাদের ছাদে এসে মুড়ি খেয়ে যায়।

সকালে এবং দুপুরে।

যেদিন সকালে উঠতে আমার দেরি হয়, ওরা ডেকে ডেকে আমাকে ঘুম থেকে ওঠায়। আমি তড়িঘড়ি উঠে ওদের খাবার দিয়ে আসি। অনেক সময় খাবার দিয়ে আসবার পর কোনো কাজে ছাদে উঠলে দেখতে পাই, মুড়ি খুঁটছে পায়রার দল। আমাকে দেখতে পেয়ে উড়ে গেল। তখন আমার মনে পড়ে যায় বিনয় মজুমদার---

মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।

এইখানে "প্রকৃত "শব্দটি লক্ষ্য করার মত। "প্রকৃত" কেন? "প্রকৃত" বলতে কবি কি অর্থ বলতে চাইছেন?

আমরা তো অনেক সময় অনেক জায়গাতে "প্রকৃত মানুষ" শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে থাকি। সবাই নিজের মতো করে "প্রকৃত মানুষ" কেমন হয় কেমন হবে, আমরা জানি।

এখানে তো "প্রকৃত সারস "।

আমি চুপ করে বসে থাকি।

প্রকৃত সারসের রহস্য উন্মোচন করতে চাইলেও করে উঠতে পারি না।আমি  আমার  বন্ধু দুর্গা দত্তের কাছে আমার প্রশ্ন রাখতেই, সে বললো----প্রকৃত সারস হলো, নিহিত এক নির্জনতা। নিহিত এক আনন্দ। নিহিত এক উন্মুক্ত পৃথিবী। সেই পৃথিবীর নির্জনতা আনন্দ এবং উন্মুক্ত উড়াল ধস্ত হয়ে পড়ে মানুষ নিকটে গেলে।

পায়রা, আমার চেনা পায়রার দল, লোকালয়ে থাকলেও তাদের বসবাস নিভৃত নির্জনে। যতই তারা লোকালয়ে খাদ্যের সন্ধানে আসুক, তারাও নির্জনতা প্রিয়। মাটিতে ঘোরাফেরা করলেও তারাও আকাশের দিকে চোখ রাখে।

মুক্তির বন্ধন, বন্ধনের মুক্তি ওরাও জানে। ওরাও জানে, মানুষ বড় বাক সর্বস্ব। বাচাল। সেই বাচালতা থেকেই মানুষ ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে নির্জন নীরবতা।

নীরবতাও এক ধ্যান।

নীরবতাও এক কবিতা।

----২৫ পৌষ ১৪২৯
----১০--১--২০২৩
----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৫৫
----------------------------------------------------------

ভালোবেসে ভুল করেছি।

চারদিক থেকে হা হা হা------

আমি তো উচ্চারণ করিনি। আমি তো মনে মনে বলেছি, ভালোবেসে ভুল করেছি। তবুও শুনতে পেলো? কারা শুনতে পেলো?

চারদিক থেকে হা হা হা

সময় যে কি আমার কাছে স্পষ্ট হয় না। শুধু আমার শরীরে বিঁধছে, হা হা হা।

আমি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠি। অথচ চিৎকার করতে পাচ্ছিনা। আমি বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও কেউ আমার পা টেনে ধরছে। দম বন্ধ লাগছে আমার। মনে হচ্ছে, আমার চারপাশে কিছু নেই , শুধু হা হা হা। হা হা হা। হা হা হা।

ভয়ঙ্কর।

একটা শাল গাছ আঁকড়ে ধরলে যন্ত্রণা থেকে উপশম পাবো, এই মনে করে কল্পনা করি শাল গাছের।

ধূলি ঝড় ওঠে। 

আমাকে ঢেকে ফেলে ধুলোবালি ময়লা। অন্ধকার। আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই।

কোথায় পড়ে যাই টের পাই না। আমার কাছে এসে দাঁড়ায় না কোনো কণ্ঠস্বর। কেবলই আমার চারপাশে ঘুরপাক খায় আমার নিঃশব্দ উচ্চারণ : ভালোবেসে ভুল করেছি।

কাকে ভালোবেসেছি? কাকে ভালোবেসেছিলাম? কার রঙে রঙিণ হয়ে রঙের ফোয়ারা উড়িয়েছি?

আজ যদি বলি, ভালোবেসে ভুল করেছি? ভালবাসা থেকে আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে? 

আমার কপাল থেকে রক্ত ঝরে। রক্তের রঙ ? আমার কাছে পরিষ্কার লাগছে না। নিজের বুক চিরে দেখতে ইচ্ছে করছে, কে কে আছে ভেতরে। যদি আজও কেউ থাকে, তাকে দেখাতে হবে তার নিজের পথ।

এতই সহজ কি?

এত সরল কি?

আমার সারা শরীরে ঘাম। আমি উদ্বেগে উদ্বেগে ছটফট করি। আমার  সামনে এসে দাঁড়ায় এক নদী। আমাকে ডুব দিতে বলে। একটা নয় তিনটে ডুব।

আমি ডুব দিয়ে উঠতেই দেখতে পাই , একটি কচি পাতা আরেকটি কচি পাতার সঙ্গে জড়িয়ে ভেসে ভেসে যায়।

এও কি মিলন?

আমার মনে পড়ে গেল, বেহুলা লখিন্দর। ওরা তো ছিল যৌবন। ওরা তো ছিল সময় উত্তীর্ণ প্রেমের চুড়ান্ত এক রূপ।

আমিও যৌবন। কতটুকু?

আমার মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ও রাণুর প্রেম। আবার এও ঠিক মনে পড়লে হবেনা। কারণ একটাই, সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে হলে শোষন চাই। গাছ যেমন  মাটি থেকে শুষে নেয় সমস্ত রস।

আমি কোনো কিছুই শুষে নিতে পারিনি এ আমার দোষ। আমাকেতো বলতেই হবে-----

দোষ কারো নয় গো মা
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।

-----২৬ পৌষ ১৪২৯
-----১১---১---২০২৩
------নির্মল হালদার







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ