শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৩

আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ




আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ ---২৬
---------------------------------------------------------

এক সময় চিঠিও ছিল আমার জীবনে কবিতা। প্রতিদিন চিঠি না পেলে দমবন্ধ দম বন্ধ অবস্থা।প্রতিদিন চিঠিও লিখেছি। বন্ধু , আধা বন্ধুদেরও লিখেছি চিঠি। আত্মীয়দের কাছে ছোটবেলাতে লিখলেও বড় বেলাতে আর লিখিনি।

সেই চিঠিও ছিল আমার কাছে প্রাণ বায়ু। আমার কবিতা।

খুব সাধারন চিঠি। সেই সব চিঠিতে পেয়েছি সুখ দুঃখ বেদনার মত আলো বাতাস। অন্ধকার।

আজ মনে হয়, সেইসব চিঠির ভাষাও ছিল কবিতার ভাষা।

আত্মীয় বন্ধুদের মুখও এক একটি কবিতা। আজ হারিয়ে গেছে ধুলো হাওয়ায়।

অমলিন কবিতাও হারিয়ে গেছে।

পারিবারিক কবিতা থেকে আড্ডার কবিতা, ভাব --অভাবের কবিতা । অজস্র কবিতার জন্য আমার অপেক্ষা ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি।

যেকোনো ভালোলাগা চিঠি মানেই একটি কবিতা। সেই ভালো লাগা চিঠি পোস্টম্যান দিতে এলে তাকে মনে হয়েছে, দেবদূত।

খাম পোস্ট কার্ড ইনল্যানড ছিল কবিতা লেখার কাগজ। ছবি আঁকার ক্যানভাস। মনোজ দত্ত এক সময় আমাকে পোস্ট কার্ডে পাঠিয়েছে একটার পর একটা ছবি।

সেও হারিয়ে গেছে।

অনেক বন্ধুও আজ নেই। থেকেও নেই সুশান্ত সরকার। ছোটন। তার প্রতিটি চিঠি থেকেই পেয়েছি , কবিতার জল হাওয়া।

কেমন আছে ছোটন সাত সমুদ্রের পারে?

আজকের অনেক তরুণ বন্ধুদের কাছে প্রস্তাব রেখেছি চিঠি লেখার জন্য। মোবাইলে লিখে আমাকে পাঠালে গদ্য লেখার অভ্যেসের সঙ্গে বাংলা বানান বাংলা বাক্য বাংলা শব্দ জেনে যাবে যেমন, তেমনি একজন আরেকজনের ভালো-মন্দ জানতে পারবে।

একজনও লেখেনি।

মোবাইলের আগমনের পরেও কেউ কারোর খবর রাখে না।

কেমন করে আসবে কবিতা?

কবিতার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে মানুষের সংকীর্ণতা থেকে।

আমনের সঙ্গে হাতে হাতে চিঠি বিনিময় হয়েছে এক সময়। আমি তাকে তিনটে চিঠি দিলে সে একটা প্রত্যুত্তর করতো।

তাকে তিন পাতা চিঠি লিখলে সে একপাতা লিখতো আমাকে। খুব খোলামেলা চিঠি তার কাছ থেকে পাইনি। আমি তার কাছে অকপট ছিলাম।

সর্বত্র অসাড় অনুভূতি।

কীভাবে কেমন করে জাগাবো?

কবিতাই বা কীভাবে জাগবে?

পানা ফুলও সৌন্দর্য রচনা করে পুকুরে। বাংলা কবিতায় পানা ফুল কী আছে? পানা ফুলের রঙ চিঠির খুদে খুদে অক্ষর।

কতজন কত রকম রঙে চিঠি লিখতো। রঙও আবেগের প্রকাশ। রামানুজ মুখোপাধ্যায় অবশ্যই রঙের একজন। সে মাঝে মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে চিঠি লেখে আমাকে। চিঠি লেখা তার কাছে প্রিয় বিষয়।

রামানুজের চিঠির সুললিত ভাষা কবিতা হয়ে ওঠে। সে কবিতা লিখলেও প্রধানত প্রবন্ধ লেখাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তার লেখা অবশ্যই  প্রবন্ধ নয়। গদ্য। সে গদ্য মুক্ত গদ্য নয়,  তথ্যসমৃদ্ধ গদ্যই সে লেখে। কিন্তু একাডেমিক নয়।

আমাদের জীবনে  চিঠিও একাডেমিক নয়। আজকের কবিতা? হয়তো আগামী দিনে কবিতার নিচে থাকবে টিকা। তখন কবিতা বোঝার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাইদের আমন্ত্রণ করতে হবে। মনে হয়, সেই সময় আসতে দেরি নেই।

এখানে আজ আর  চিঠি নেই।

হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান নেই।

শুধু আজ সকালে আমার হোয়াটসঅ্যাপে আমার বান্ধবীর লেখা আপনাদের জানাই------

সকালবেলা একটা পাখি ডেকে ডেকে চলে গেল। কাকে ডেকে গেল?

এই একটি প্রশ্ন একটি কবিতা হয়ে আমার কাছে। সাতসকালে। 

আমি উত্তরে কী লিখব?

-----৯ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----২৬---১১---২০২২
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ --২৭
----------------------------------------------

কাল সন্ধেবেলা অবিনকে বললাম, তোদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করবি? কোনোদিন দুপুরে?
সে জানালো, ধান কাটা চলছে।
মা খুব ব্যস্ত। এখন বাদ দাও।

আমি যে খুব খাই দাই, এ কথা বলবে না নিন্দুকেও।কিন্তু আমার ইচ্ছে করে, একটু স্বাদ পাল্টানো গেলে নতুন মুখও দেখতে পাবো। অবিনদের বাড়িতে আমার আসা-যাওয়া থাকলেও রোজ তো আর যাইনা। আর ওদের গ্রাম গেলে শীতের কাঁসাই দেখতে পাবো। কথা হবে, আশ্রমের বাবাজীর সঙ্গে। কাঁসাই পারে দেবাশিস বাবাজীর কালীমন্দির হরিমন্দির। আশ্রম। গাছপালা।সব মিলিয়ে একটা ইশারা। কাছে যেতে ইচ্ছে করে খুব।

মনের বাসনা মনে থেকে যায়।

অবিন "না" করেছে।

অবিনের এই "না" আমাকে বেদনাবোধ থেকে আনন্দের দিকে নিয়ে যায়।

অবিনের এই  "না" আমার কাছে "হ্যাঁ"। আমি "নিষেধ"থেকে পেয়ে যাই আমার "প্রবেশ"। 

অবিনের বাবা আমাকে বলছে----হালদার চলো হে আমাদের সঙ্গে ধান কাটতে। অবিনের হাসি। তার দাদাও তার কচি ছেলেকে কোলে নিয়ে হেসে উঠলো। আমি অবিনের বাবাকে বললাম------ চলো তবে। অবিনের মা বলে---না খেয়ে কোথাও যাবে না। আমার কাছে জানতেও চাইলো----বেগুন পোড়া খাও? আমি লাফিয়ে উঠি। বেগুন পোড়া আমার খুব প্রিয়।অবিনদের বাড়িতে কাঠের উনুনে বেগুন পুড়বে।স্বাদেও হবে চমৎকার।

বেলা পড়ে আসছে।
আমি ধানক্ষেতের আলে বসে আছি। অবিনের মা ধানের আঁটি বাঁধছে।

জীবনকেই বাঁধছে নিজের বাঁধনে।

আমার কবিতা।


-----১০ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----২৭---১১---২০২২
-----বেলা ১২--৪৬
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--২৮
-------------------------------------------------------
একটা শালুক ফুটে আছে।

ছোট্ট এক ডোবা।

উড়ন্ত পাখির ছায়া পড়ছে জলে। হাওয়ায় হাওয়ায় কেঁপে উঠছে জল। স্থির হয়ে পড়ছে জল। ডোবার পাড়ে শুকর ছানাদের চলাফেরা।

ডোবাটি আছে বলেই, কয়েকটা একচালা ঘর।ঝকঝকে । মাটির দেওয়াল তকতকে। একটা ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে তীর ধনুক। উঠোনো লাফালাফি করছে মুরগি। উঠোন থেকে একটু দূরেই একটা মহুল গাছ। তার ছায়ায় বসে আছে একটা শুয়োর। একটা হাঁড়িও উল্টে আছে।

কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। যে যার কাজে গেছে। 

স্তব্ধতা।

আমাকে আসতে বলেছিল মড়িরাম মুর্মু। সে কোথায়? কার কাছেই বা জানতে পারবো কেউ তো নেই।

দরজা খোলাই আছে।

একটা কুকুর এসে আমার পায়ের কাছে শুঁকতে লাগলো। চলেও গেল  কোথায় কে জানে। দেখতে পেলাম না আর।

মাদল ঝুলছে। একটা বারান্দায় চালার কাঠে বাঁধা মাদলের দুই মুখেও নীরবতা।

স্পর্শের দাগ আছে?

কত কত পূর্ণিমার রাতে মাদল বেজেছে সারারাত। তার শব্দ তার মাধুর্য এই দুপুরেও যেন আমার বুকে ।

একটা মহুল পাতা খসে পড়লো। সোজাসুজি মাটিতে না পড়ে, ঘুরতে ঘুরতে হাওয়া যে তাকে কোথায় নিয়ে গেল, আমি তো আর পাতার পিছনে পিছনে গেলাম না।

জল তেষ্টা পেয়েছে।

আমার দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে কোনো মানুষ। না, চারদিকে কেউ নেই। গৌউর বাবু আমাকে বলেছিলেন, ধান কাটার মরসুম এ সময় গেলে কাউকেই পাবেন না।

মড়িরাম পট আঁকে। গাঁয়ে গাঁয়ে পটের গান ক'রে দু'চার পয়সা রোজগার করার চেষ্টা।

আজকাল আর গান শোনেনা কেউ। ওই যে হাতের মুঠোয় একটা যন্ত্র থাকে। তা থেকেই গান। দিনরাত।

দু' একটা ঘরে এ্যাজবেস্টারের ছাউনি। মনে হয়, সরকারি অনুদান থেকে এ সমস্ত ঘর। দেওয়ালও পাকা।

পাকা ঘরের পিছন দিকে একটা পেয়ারা গাছের আভাস। কাছে গেলে হয়তো মিলতেও পারে দু-একটা পেয়ারা। পেয়ারা চিবোতে পারলে তেষ্টা মিটবে?

পিপাসার তো শেষ নেই।

হেমন্তের হাওয়া। শিরশিরে শীতলতা। আমি রোদের দিকে যাই। দুটো হাত বুকের কাছে এনে উত্তাপ নেওয়ার চেষ্টা করি।

ঘর ছাড়িয়ে রাস্তার দিকে। যদি পায়ের শব্দ পাই? শুনতে পাবো। রাস্তায় পায়ের ছাপ। সাইকেলের টায়ারের দাগ। গরুর গাড়ির চাকার দাগ। রাস্তার ধারে বুয়ান গাছের ঝোপ। এ ডাল থেকে ও ডালে তক্ষক।

মনে হলো, আমাকে একবার দেখে চেনার চেষ্টা ক'রে লুকিয়ে গেল কোথাও।

একটা মৃদু শব্দ আসছে। চেয়ে দেখি, একটা গরু-বাছুর। শীর্ণ।

মড়িরাম কোথায়?

আমি হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে যেতেই আরেকটি ডোবা। চুপচাপ। ডোবার পিছন দিকে ধান ক্ষেত।

ধান কাটা হয়ে গেছে। পড়ে আছে ধানের গোড়া।আলপথে একটা শাড়ির একটা অংশ।

আমি ঢিল  ছুঁড়ি। ডোবার জলে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে।দু-একটা শুকনো পাতা ভেসে ভেসে এদিক-ওদিক।

ডোবার পাড় থেকে দেখতে পাই, দূরে বন সৃজন প্রকল্পের গাছপালা। ধূসর।

আমি আবার মড়িরামের ঘরের দিকে। কাছে যেতেই হঠাৎ যেন চোখে পড়লো ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি।

একবার তো ঘুরে গেলাম, দেখতে পাইনি তো! তবে কী এখুনি কেউ এসে আঁকাআঁকি করে গেল এইসব ছবি?যেন আদিম মানুষের আঁকা।

মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পাই, একটা হরিণ ছুটছে। তার শিঙে লটকে আছে ডালপালা লেগে থাকা পূর্ণিমার চাঁদ।

----বেলা-১--১১
-----১১ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----২৮---১১---১৪২৯
-----নির্মল হালদার
 



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--২৯
-------------------------------------------------------

অন্ধকার।

অন্ধকার থেকে জেগে উঠলো একটা হাট। কোনো কোলাহল নেই। শুধু একটি মুখ। পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছি------ অমরেশ মাজী।

আর কোনো মুখ নেই।

সবজি বিক্রেতাদের মুখও দেখতে পাচ্ছি না। আবছা আলো আঁধারে শুধু অমরেশের মুখ। ৪০ বছর আগের অমরেশ। অমরেশ মাজী।

আমি ছুটে যাই। পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরি। সে আমাকে দেখে না। সে  ২৫০ করলা কিনতেই ব্যস্ত।

বিক্রি করছে কে?

কোনো বিক্রেতার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। শুধু অমরেশ, অমরেশের মুখ। ৪০ বছর আগের সেই মুখ। গালে হালকা দাড়ি। চোখ মুখ শান্ত। লাবণ্যময়।

কোত্থেকে এলো অমরেশ? তাকে তো আমি ডাকিনি।মনেও করিনি তাকে। তবে কী ভাবে কার কাছে এলো? আমার ঘরে না এসে একটা হাটে এসেছে।আমার সঙ্গে তবে কি দেখা করতো না?

সেই অমরেশ, ৪০ বছর আগের অমরেশ চেহারা একটুও পাল্টায়নি। সেই অমরেশ বার্ণপুরের কাছের কোনো গ্রাম থেকে এসেছিল আমাদের শহরে লেখাপড়ার সূত্রে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সিনেমা হলে।

সিনেমা দেখতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। কার সঙ্গেই বা বন্ধুতা হয়? অমরেশের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্বই হলো না, ঘনিষ্ঠতা হলো।

সেই ঘনিষ্ঠতা যে ঝালাই করবো আজ সময় হলো না।

তাদের হোস্টেলে আসা যাওয়া তো করেইছি, আহার নিদ্রাও হয়েছে। কবিতা পাঠ করেছি রাতের পর রাত। হোস্টেলের বাকি ছেলেরা ঘুমিয়ে গেছে, শুধু অমরেশ আর আমি। আমাদের জাগরণে দেখতে পেয়েছি রাতের নক্ষত্রের মতো শ্রোতা। সে শুধু আমার কবিতার
শ্রোতা নয়। অমরেশের সবুজ কবিতাও শান্ত হয়ে শোনে।

সেই রাত্রি কোথায়?

তুমি কোথায় অমরেশ?

আজকের হাট কি ছিল মুহূর্তের হাট? হাটেও কি মরীচিকা আসে? ভোরের অন্ধকার থেকে আমার যে তেষ্টা পেয়েছে খুব।

স্বপ্ন আমাকে আক্রান্ত করে। স্বপ্ন থেকে স্মৃতি আমাকে আক্রান্ত করে। আমি কবিতার দিকে যাই।

আমি অমরেশের দিকে যাই।

কোনো যোগাযোগ নেই। তার কোনো ঠিকানা নেই আমার কাছে। কেন তবে অমরেশ? কেন তবে একটি হাট? কোনো বেচাকেনা নেই, শুধু অমরেশ। আমাকে আক্রমণ করতে করতে স্মৃতির দিকে নিয়ে যায়।কবিতার দিকে নিয়ে যায়। সেই কবিতা যদি চোখের জলের শব্দ করে?

তুমি কি শুনতে পাবে অমরেশ?
 

-----বেলা --১
-----১২ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----২৯--১১---২০২২
----নির্মল হালদার
 




আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---৩০
---------------------------------------------------------
---কোথায় যাবি রে?
---ইউনিভার্সিটি
----তাহলে তোর সঙ্গে বিকেলে দেখা হচ্ছে তো?
----না দেখা হবে না। বিকেলে ঘর যাব। ঘর থেকে সেরখাডি। আজ ছো-নাচ আছে।

বাঁশি ছো-নাচও করে।

বাঁশির প্রকৃত নাম শ্যামাপদ মাহাত। বাড়ি---- বরাবাজার থানার রাজডিতে। সিধু কানু বিরসা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করছে। তার পিএইচডির বিষয়---বাংলা গল্প উপন্যাসে লোকসাহিত্য। লোকজীবন। ছো-নাচে জড়িয়ে আছে তার আবেগ। সব সময় দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচতে পারে না। তার কারণ, লেখাপড়া।

বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান শ্যামাপদ। তার বাবা বাউল সঙ্গ করে। তার বাবার পথ অনুসরণ ক'রে তার মা-ও গেরুয়া পোশাক ব্যবহার করে থাকে। দু'জনেই 
এক আধটু বাউল গান।

মাহাতরা ভূমিপুত্র। জমির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকবেই। শ্যামাপদদেরও যৎসামান্য ধান জমি আছে।বছর দিন যায় না। শ্যামাপদর বাবা রোগ অসুখে ভুগতে ভুগতে চাষবাসের কাজে আর মন দিতে পারে না। শ্যামাপদ নিজেই যতটুকু পারে চাষের কাজ থেকে ধানটুকু তোলে। তাদের অন্য কোনো রোজগার নেই। শ্যামাপদ পুরুলিয়া শহরে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করে। তার আগ্রহ দেখতে পাই, কবিতার দিকে। প্রবন্ধের দিকে। আরো একটি আগ্রহ অবশ্যই আছে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়।

শ্যামাপদর বেঁচে থাকার লড়াই, ছো-নাচের পরিশ্রমের মতো। তার সঙ্গে তার আবেগ। যে আবেগের সঙ্গে মিলেমিশে আছে পুরুলিয়ার জল মাটি হাওয়া। এ জন্যই সে লেখাপড়ার পাশাপাশি লড়াই করতে পারে। সে বলেও, আমি বাঁচলে ছো-নাচও বাঁচবে।

সে বাঁশি হলেও সে ধামসাও। সে মাদল। সে ধূলা ওড়ানো নাচের ছন্দ। সে এক জ্যান্ত শিল্প।

সেই জ্যান্ত শিল্পের আরেক নমুনা, রামকৃষ্ণ মাহাত।পটে আঁকা ছবির মত একটি গ্রামে থাকে। পুরুলিয়ার কাশীপুরের শিউলি বাড়ি। সে  তার মা ও বোনকে নিয়ে থাকে। তার বাবা নেই। তাকেই টানতে হয় সংসার। ধান যেটুকু হয় সারা বছর চলে না। সে ক্লাস ইলেভেন থেকেই যুক্ত হয়েছে ছো-নাচের দলের সঙ্গে।ছো-নাচে তার আবেগ যেমন কাজ করে, তেমনি দুটো পয়সা হয়। একরাত নাচ করলে আড়াইশো টাকা।যদিও সারা বছর কাজ থাকেনা। সে বলে, বোনের পড়াশোনার জন্য টাকা চাই। অসুখ-বিসুখের জন্য টাকা লাগে। লোক-লৌকিকতাও করতে হয়। সবকিছুর পিছনেই টাকা চাই।

কে দেবে?

হাত পাতবো না। শরীরে তাকৎ আছে খেটে খাবো।

সেই খেটে খাওয়া রামকৃষ্ণ মাহাত কবিতাও লেখে।সম্প্রতি বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা আশ্রম পত্রিকা তাকে তরুণ কবি হিসেবে সম্মান জানিয়েছে।

রামকৃষ্ণের বাড়ির কাছেই দ্বারকেশ্বর নদী। কখনো কম কখনো বেশি কখনো মাঝারি আবেগ নিয়ে চলে দ্বারকেশ্বর। প্রভাব তো পড়বেই রামকৃষ্ণের হৃদয়ে।

আমিও ভিজতে চাই হৃদয় থেকে উৎসারিত আনন্দ থেকে আনন্দে।

রামকৃষ্ণ অভাবে অনটনে বড় হলেও গ্র্যাজুয়েশন  করেছে। মাস্টার্স পড়ার ইচ্ছে থাকলেও কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই সুযোগ পায়নি সে।

সে কখনো কখনো সুযোগ পায় ছো-নাচের দলে। দুর্গা বাদে সখি থেকে কার্তিক গণেশের নাচ সে করতে পারে। এক রাতের একটা নাচ আড়াইশো টাকা।পারিশ্রমিক। সারা বছরে হয়তো বা ৩০ দিনের কাজ।তাকে টিউশনি করতেই হয়। গ্রামের দিকে টিউশনিতে অল্প টাকা। এ বাদে কিছু করারও নেই। তার ভাষায়---- লড়ে যেতে হবে।

শ্যামাপদ ও রামকৃষ্ণের লড়াইয়ের পাশে আমি আছি।আমার আবেগ থেকে আছি। আমি জানি, তাদের লড়াই তাদের আবেগ তাদের ভালোবাসা ফুটছে।সকালে সন্ধ্যায়। তার বিকশিত সৌরভ থেকে গড়ে উঠছে আমারও কবিতা।

শাদামাটা সজীব কবিতা।

------১৩ অঘ্রাণ ১৪২৯
-----৩০---১১--২০২২
-----বেলা ১--৭
------নির্মল হালদার








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ