রবিবার, ২৭ জুন, ২০২১

রু / নির্মল হালদার

রু / নির্মল হালদার


সকাল হলেই ছাগলটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সকাল হলেই, এই একটা কাজ------অন্তত দু' কিলোমিটার ছাগলটাকে নিয়ে ঘোরে।
ডান হাতে ছাগলের গলায় বাঁধা দড়ি ধরে রু হাঁটতে থাকে।

অনেক লোক চেন বাঁধা কুকুর নিয়ে প্রাতঃভ্রমণ করে। সেখানে রু দড়ি বাঁধা ছাগল নিয়ে। লোকের কাছ থেকে বিদ্রুপের হাসি শুনতে হয়। কেউ কেউ আছে যারা সরাসরি ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। অশ্লীল ভাষায় বলে, দেখ দেখ ছাগলটাকে দেখ------
ভালোই খেতে লাগবে। একদম কচি আছে। এখনো।

তখন ছিল ছাগ শিশু। যখন হারিয়ে গেছলো ঘরের পথ। যখন হারিয়ে গেছলো তার মাকে।
এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। 

একদিন হঠাৎ মা'কে হারিয়ে ছাগ শিশুটি ঢুকে পড়েছিলো রু দের ঘরে এবং ছাগ শিশুর করুণ মুখ দেখে রু বেঁধে রেখেছিলো। মনে করেছিলো যদি কেউ খোঁজ খবর করে ছাগ শিশুকে ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ খোঁজ খবর করেনি। তারপর থেকেই ছাগ শিশু রু দের ঘরে বড়ো হয়ে উঠছে।

রুতো চরাতে যেতে পারেনা। তাই
সকাল বেলাটা এক পাক ঘুরিয়ে 
ছাগলের গায়ে হাওয়া লাগায়। এবং তার নিজের গায়েও হাওয়া লাগে।

বেচারী সারাদিন বাঁধা থাকে ঘরে।

ভাগ্যিস রুয়ের মা আছেন। সময়ে সময়ে মুখের সামনে খাবার দিয়ে যায়। আর রু বাজার থেকে অশথ পাতা কিনে এনে দেয়। রু শহর বাজারে থাকে বলে, ছাগলটা নিয়ে ঘুরতে পারে না। শুধুমাত্র ভোর থেকে সকাল অবধি পারুলডাঙার দিকে। এখনো যেদিকে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়নি। এখনো কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা আছে।
একদিন এক যুবক রুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল, ছাগল নিয়ে ঘুরলে হবে না। গাছে উঠতে হবে।
পাতপালা পেড়ে দিতে হবে। রু শুনেও শোনে না। 
গাছে উঠে কি বিপদ করবে! হাত পা ভাঙলে সোজা বিছানায়।

ছাগলটাকে দেখবে কে?

আজ রু ছাগলটার কাছে একমাত্র আশ্রয়। রু ছাগলটার কাছে মা।

হ্যাঁ------মা বৈকি।

যদিও রুয়ের মা--ও ছাগলটাকে আদর-যত্ন করেন। কিন্তু কথা তো বলে রু। কোলে তো নেয় রু। আর
ছাগলটাকে দেখলে জ্বলে পুড়ে যায় সোনাই।

সোনাই রুয়ের বান্ধবী।

সেই শুধু বলবে------দাঁড়া দাঁড়া
তোর ছাগলটাকে একদিন বিক্রি করে দিয়ে আসবো। এবং সেই বিক্রির টাকায় তোকে খাওয়াবো পাঁঠার মাংস।

সোনাই ঈর্ষাও করে। তার মনে হয় রুয়ের সমস্ত প্রেম-ভালোবাসা ছাগলটার প্রতি। তার দিকে নজর নেই।  সে অনেক সময় ছাগলটার পিঠে চড় থাপ্পড় মারে। ছাগলটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সোনাইয়ের দিকে। অবলা প্রাণী কিছুই বলতে পারে না। শুধু বেঁধে রাখা খুঁটির চারপাশে ঘুরতে থাকে।

ভয় করে।

সে তার অনুভূতি থেকে দেখে, মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে মাঠে।
ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। ঘাস খাচ্ছে। পাতাপুতা খাচ্ছে। আর ছোট ছোট গাছে উঠে পড়ছে।

কোথায় মা?

ছাগলটাকে শুধু ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। যদি রু ঘরে না ফেরে? আদর করবে কে? কেইবা
খবর নেবে-----জোতিয়া খেয়েছিস তো? অথবা বলবে রু------শীত আসছে। জোতিয়া
তোর জন্য একটা গরমের জামা বানাতে হবে।
রাতের সময় শীত করবে না তোর।
তুই আমার বিছানাতেই থাকবি। মা কিছু বললে, আমি ম্যানেজ করবো।

দিনের বেলা  রু চাকরিতে যায়। 
 তার মন পড়ে থাকে জোতিয়ার দিকে।জোতিয়াও তার অনুভবে দেখে, বাইক নিয়ে ছুটছে রু। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। এই তার কাজ। সময়ে খাওয়া হচ্ছে না তার।
দুজন দুজনের জন্য । মন নিয়ে টানাপোড়েনে থাকে।
রু জানে মা খাবার-দাবার ঠিকই দেবে। তবু তার মন ছুটে যেতে চায় বাড়ির দিকে। জোতিয়ার দিকে।

এই জোতিয়াকে নিয়ে ভোর বা সকালবেলা পারুলডাঙ্গার দিকে গেলে কুকুরের চিৎকার। যেন বা
কুকুরের দল রুয়ের হাত থেকে ছিনিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে জোতিয়াকে। রুয়ের বুক কাঁপতে থাকে। সে জানে তাকে কেউ বাঁচাতে সাহায্য করবে না।

রু শক্ত হাতে জোতিয়ার গলার দড়ি ধরে থাকে।
সে মনে করে , আমার হাত থেকে কেউ কখনও ছিনিয়ে নিতে পারবে না। যদিও তার মা মাঝেমধ্যে বিরক্তি প্রকাশ করে----
এ্যাই শোন্-----ছাগলটাকে এবার
বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয়। আমি আর ছাগল নাদি পরিষ্কার করতে পারছিনা।

রুয়ের মন খারাপ হয়ে যায় জোতিয়ার জন্য। তাকে ছাড়া জোতিয়াই বা থাকবে কি করে!
তারতো কেউ নেই। 
জোতিয়াতো চিনলো না ছাগলের পাল। তাদের চলাফেরা। মায়ের দুধ কেমন একেবারেই জানলো না। সে শুধু রুয়ের কাছে বড় হয়ে উঠলো।

আজ রুয়ের অফিসে ঝামেলা হয়েছে অনেক। কথা কাটাকাটি।
সে রাগ থেকে বলেও ফেলেছে,
চাকরি ছেড়ে দেবে।

ঘরে ফিরে মায়ের সঙ্গে কোনো কথা না বলে, জোতিয়াকে না দেখে শুয়ে পড়লো।
তার মা ডাকাডাকি করলেন অনেকবার । রু খেতেও উঠলো না। মাঝ রাতে যখন ঘুম ভাঙছে,
তখন আগে মনে পড়লো তার ----
জোতিয়া কোথায়?
সে ধড়পড় করে উঠে বাইরে আসে।দেখে জোতিয়া ঘুমিয়ে গেছে। সারা শরীর শিশির ভেজা।

রু গলার দড়ি খুলে তার নিজের ঘরে নিয়ে যায়। বুকে চাপা কষ্ট চোখে যে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে, রু বুঝতে পারেনি। সে বিড়বিড় করে------তোকে নিয়ে আমি আর থাকব না। তোকে ছেড়ে দিয়ে আসবো রাস্তায়। তুই নিশ্চয়ই খুঁজে পাবি  তোর আত্মীয়স্বজনকে।

রু দু চোখ মুছতে থাকে।


-----১২ আষাঢ়১৪২৮
-----২৬----৬----২০২১
-----নির্মল হালদার







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ