সোমবার, ৩১ মে, ২০২১

মাঠ// নির্মল হালদার

মাঠ//


১.
বাবার হাত ধরে ছেলে শহরের গলি থেকে গলি হাঁক দিয়ে চলেছে: একটা মাঠ দেবে গো মাঠ
একটা মাঠ দেবে গো মাঠ--------

একবার বাবা হাঁক দিলে একবার
ছেলে হাঁক দিতে থাকে: একটা মাঠ দেবে গো মাঠ------
একটা মাঠ দেবে গো মাঠ------?

হাটবাজারের মানুষ, পথ চলতি মানুষ, উঁকিঝুঁকি মারা মানুষ
কৌতুহলের সঙ্গে শুনতে থাকে,
বাবা ও ছেলের হাঁক।

সবারই প্রশ্ন: মাঠ আবার কী?
মাঠের জন্য ফেরিওয়ালার মত
হাঁক দিলেই কি মাঠ পাওয়া যাবে?
এরা কি পাগল?

বাবা ও ছেলে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বসে যায় সবজি বাজারে। যেখানে
নিত্য কোলাহল। বেচাকেনা। কেনাবেচা।

বাবা ও ছেলে হাঁক দিতে থাকে :
একটা মাঠ দেবে গো মাঠ?
বাজারিরা ঘুরেফিরে বাবা ও ছেলেকে দেখে। নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে: একইসঙ্গে বাপ বেটা পাগল হয়ে গেছে। কেউ কেউ পাগল মনে করে, পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে যায়। অনেকেই হাসাহাসি করে। খুব কৌতুহলী যারা কাছে এসে জানতে চায়, তোমরা কি বলতে চাও, সঠিক আমাদের বলবে? তোমরা কোথা থেকে এসেছো? কত দূরে বাড়ি?

কেউ কেউ বলে ভিক্ষার এই নতুন ধরণ দেখে অবাক লাগছে ভাই।

বাবা ও ছেলে চুপ থাকে।

ছেলেটির নাম বাগান। ফুলের মতোই সে সুন্দর। বাঁ চোখের নিচে
কাটা দাগ। তাকে আরো সুন্দর করেছে।
সে প্রতিদিন ব্যাংকের মাঠে খেলা করে আরো বন্ধুদের সঙ্গে। কখনো ক্রিকেট। কখনো ফুটবল। কখনো শুধুই দৌড়ঝাঁপ। এই মাঠেই কিছুটা হাওয়া বয়। চার পাশেই তো ঘর বাড়ি। বাজার হাট। দোকানপাট। সব সময় থিকথিক করছে ভিড়।
দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন আবার
স্কুল বন্ধ। রায় দেড় বছর হয়ে গেল স্কুল বন্ধ হয়ে আছে। চলছে
লকডাউন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই বাজার হাট ছেড়ে আর কোন্ মাঠে যাবে খেলাধুলো করতে? এই একটাই তো মাঠ। ছোট্ট মাঠ। ছেলেরা
দুহাত খুলে দিয়ে দৌড়োয়। নিজেদের মধ্যে মারপিট করে।

সে এক অনাবিল আনন্দ।


হঠাৎ করে কোনো কোনোদিন
প্রজাপতি এসে ফড়িং এসে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করে। রঙ ছড়ায়।

সেই উদার মাঠ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল। কোনো প্রোমোটার সমস্তটাই কিনে নিয়েছে। শপিং মল হবে।
তার আগে কাজ শুরুর আগে, মাঠের চারদিক বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ যেন ঢুকতে না পারে।

ছেলেরা চাওয়া চায়ি করে।
কোথায় যাবে তারা? আর তো কোনো মাঠ নেই।

মাঠ নেই।

বাগানের মত অনেকেই দুঃখ কষ্ট চেপে বাড়িতে বন্দি হতে থাকে।

বাগান একদিন তাদের গলিতে
ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল। কলোনির লোকজনের বাধা পেয়ে
সে আশাও ছাড়তে হয়েছে তাকে।

বাগানের বাবা ছেলের যন্ত্রণা অনুভব করে এই রকম একটি প্রতিবাদে শহরের অলিতে গলিত
রাস্তায় রাস্তায় হাঁক দিয়ে যায়: একটা মাঠ দেবে গো মাঠ-------?

সেই ব্যাংকের মাঠে ছেলেরা নেই বলে হাওয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। সেই ব্যাংকের মাঠে প্রজাপতি আর আসে না। ফড়িং আর আসে না।

কেবল ট্রাক ট্রাক ইঁট-বালি--সিমেন্ট। ছড়।পাথর।


বাগান একা একা দূর থেকে দেখে। আর বুঝতে পারে, তার চোখের কোনে কি একটা চিকচিক করছে।



-----১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----৩১----৫----২০২১
-----নির্মল হালদার



২.
বাবার হাত ধরে ছেলে শহরের গলি থেকে গলি হাঁক দিয়ে চলেছে: একটা মাঠ দেবে গো মাঠ
একটা মাঠ দেবে গো মাঠ--------

একবার বাবা হাঁক দিলে একবার
ছেলে হাঁক দিতে থাকে: একটা মাঠ দেবে গো মাঠ------
একটা মাঠ দেবে গো মাঠ------?

হাটবাজারের মানুষ, পথ চলতি মানুষ, উঁকিঝুঁকি মারা মানুষ
কৌতুহলের সঙ্গে শুনতে থাকে,
বাবা ও ছেলের হাঁক।

সবারই প্রশ্ন: মাঠ আবার কী?
মাঠের জন্য ফেরিওয়ালার মত
হাঁক দিলেই কি মাঠ পাওয়া যাবে?
এরা কি পাগল?

বাবা ও ছেলে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বসে যায় সবজি বাজারে। যেখানে
নিত্য কোলাহল। বেচাকেনা। কেনাবেচা।

বাবা ও ছেলে হাঁক দিতে থাকে :
একটা মাঠ দেবে গো মাঠ?
বাজারিরা ঘুরেফিরে বাবা ও ছেলেকে দেখে। নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে: একইসঙ্গে বাপ বেটা পাগল হয়ে গেছে। কেউ কেউ পাগল মনে করে, পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে যায়। অনেকেই হাসাহাসি করে। খুব কৌতুহলী যারা কাছে এসে জানতে চায়, তোমরা কি বলতে চাও, সঠিক আমাদের বলবে? তোমরা কোথা থেকে এসেছো? কত দূরে বাড়ি?

কেউ কেউ বলে ভিক্ষার এই নতুন ধরণ দেখে অবাক লাগছে ভাই।

বাবা ও ছেলে চুপ থাকে।

ছেলেটির নাম বাগান। ফুলের মতোই সে সুন্দর। বাঁ চোখের নিচে
কাটা দাগ। তাকে আরো সুন্দর করেছে।
সে প্রতিদিন ব্যাংকের মাঠে খেলা করে আরো বন্ধুদের সঙ্গে। কখনো ক্রিকেট। কখনো ফুটবল। কখনো শুধুই দৌড়ঝাঁপ। এই মাঠেই কিছুটা হাওয়া বয়। চার পাশেই তো ঘর বাড়ি। বাজার হাট। দোকানপাট। সব সময় থিকথিক করছে ভিড়।
দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন আবার
স্কুল বন্ধ। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল স্কুল বন্ধ হয়ে আছে। চলছে
লকডাউন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই বাজার হাট ছেড়ে আর কোন্ মাঠে যাবে খেলাধুলো করতে? এই একটাই তো মাঠ। ছোট্ট মাঠ। ছেলেরা
দুহাত খুলে দিয়ে দৌড়োয়। নিজেদের মধ্যে মারপিট করে।

সে এক অনাবিল আনন্দ।


হঠাৎ করে কোনো কোনোদিন
প্রজাপতি এসে ফড়িং এসে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করে। রঙ ছড়ায়।

সেই উদার মাঠ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল। কোনো প্রোমোটার সমস্তটাই কিনে নিয়েছে। শপিং মল হবে।
তার আগে কাজ শুরুর আগে, মাঠের চারদিক বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ যেন ঢুকতে না পারে।

ছেলেরা চাওয়া চায়ি করে।
কোথায় যাবে তারা? আর তো কোনো মাঠ নেই।

মাঠ নেই।

বাগানের মত অনেকেই দুঃখ কষ্ট চেপে বাড়িতে বন্দি হতে থাকে।

বাগান একদিন তাদের গলিতে
ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল। কলোনির লোকজনের বাধা পেয়ে
সে আশাও ছাড়তে হয়েছে তাকে।

বাগানের বাবা ছেলের যন্ত্রণা অনুভব করে এই রকম একটি প্রতিবাদে শহরের অলিতে গলিত
রাস্তায় রাস্তায় হাঁক দিয়ে যায়: একটা মাঠ দেবে গো মাঠ-------?

সেই ব্যাংকের মাঠে ছেলেরা নেই বলে হাওয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। সেই ব্যাংকের মাঠে প্রজাপতি আর আসে না। ফড়িং আর আসে না।

কেবল ট্রাক ট্রাক ইঁট-বালি--সিমেন্ট। ছড়।পাথর।


বাগান একা একা দূর থেকে দেখে। আর বুঝতে পারে, তার চোখের কোনে কি একটা চিকচিক করছে।



-----১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----৩১----৫----২০২১
-----নির্মল হালদার







কবর বাড়ি// নির্মল হালদার

কবর বাড়ি//
----------------------

এখানে এসে দেখা যে হবেই ভাবতে পারেনি কিরাত। একটা কবরে বসে তার বন্ধু হরি বিড়ি টানছে।

----কিরে তুই এখানে?
----আমিতো এখানে রোজ আসি
----আমিও তো আসি। দেখতে পাই না তো।
---কি করে দেখবি, আমি তো মাঝেমধ্যে কবরের ভিতরে চলে যাই, যে শুয়ে আছে ভিতরে তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে আসি।
বিড়িও দিয়ে আসি।
---কি আবোল তাবোল বকছিস?
-----তোর কাছে আবোল-তাবোল মনে হতে পারে, ইয়ার্কি মনে হতে পারে, আমার কাছে নয়।
যা সত্যি তাই বললাম।
----কবরের ভিতরে যাওয়া যায়?
----যায়রে যায়। যাব বললেই যাওয়া যায়। এজন্যে মায়া টান থাকতে হয়। এজন্যে কবরের
দরজা জানতে হয়।
-----তুই কি দরজা জানিস?
আমাকে দেখাবি?
----না। সবাইকে দেখানো যাবে না।
যার কোন টান ভালোবাসা নেই, সে কি করে যেতে পারে! টান ভালোবাসা থাকলে, দরজা আপনা আপনি খুলে যায়।

কিরাত বিচলিত বোধ করে। সে চিন্তা করে, এ কি সম্ভব নাকি হরি
কল্পনাতে যায় কবরের ভিতরে? সে আর কোনো কথায় বলতে পারেনা। সেও হরির কাছে একটা বিড়ি চেয়ে ধরিয়ে ফেলে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হরির কাছে জানতে চায়-----------হ্যাঁরে
কবরের ভিতরে যে শুয়ে আছে সে তো মৃত ব্যক্তি। তোর সঙ্গে বিড়ি খায়?
-----খায় খায়
বিড়ি দিয়েও আসতে হয়। ভেতরে
তেষ্টা বেশি।
----জল তেষ্টা পায় না ওদের?
হরি বলে তাকে কোনদিনই জলের কথা বলেনি। কোনোদিন খাবার খুঁজলো না তার কাছে। কেবল
চারপাশের খবর শুনতে চায়। নতুন করে ভালোবাসার কথা বলতে চায়। বলে, খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করছে রে------না কোনো মেয়েকে নয়, শিশুকে।
হরি নাকি হাসতে হাসতে বলেছিল একদিন, আমি তোমাকে কবরের মাটি থেকে পুতুল বানিয়ে দেবো। তুমি যত পারবে ভালবেসো।

মৃত ব্যক্তি হরির সঙ্গে উপরে উঠে আসতে চায়। দেখতে চায়, চারপাশ কেমন বদলে গেছে। এবং তাদের বাড়িটার কাছে গিয়ে
উঁকি দিয়ে আসবে একবার।
হরি মানা করে।

সন্ধের অন্ধকার পার হয়ে রাত্রির অন্ধকার আসছে। কবর বাড়ির অশথ গাছে ডেকে ওঠে রাতচরা
পাখি। কিরাত আকাশের দিকে মুখ তুলে হরিকে বলে, মেঘ আসছে রে--------।
-----আসুক না কি আর হবে
আমি কবরের ভিতরে চলে যাব।
একটুও ভিজবো না। বৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার করি।
-----তো ভাই কবরের দরজাটা
আমাকে দেখিয়ে দে না! আমি একটু ঘুরে আসবো।
-----না তা আমি পারবো না।
তুই যদি নিজে কোনোদিন দরজা খুঁজে পাস, সেদিন নিজেই যেতে পারবি। একা একাই যেতে পারবি।
আমাকে তো কেউ দরজা দেখিয়ে দেয় নি। আমি তো নিজেই খুঁজে পেয়েছি। তুইও হয়তো পাবি। এজন্যে একটা মন লাগে। সেই মন
এখন তোর নেই।
-----কিন্তু কবে খুঁজে পাবো দরজা?
------তা আমি কি করে বলবো।
------আচ্ছা আচ্ছা--------আচ্ছা
আজ আমার সামনেই কবরের ভিতরে যেতে পারবি? আমার সামনে আবার আসতে পারবি?
-----না আমি কারোর সামনেথেকে যাইনা। সব সময় একা গেছি। একা এসেছি।
এবার সন্দেহ হয় কিরাতের। হরি বোধহয় বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে। সে বসেছিল কবরের উপরে। উঠে পড়লো। ঘুরে ঘুরে
দেখতে লাগলো, অন্ধকারেই দুচোখ দিয়ে দেখতে লাগলো, যদি
কবরের দরজাটা দেখতে পায়।
যে কবরের উপরে হরি বসে আছে, তার পিছন দিকে একটা গর্ত। কিরাতের মনে হলো, এই বুঝি দরজার মুখ। সে গর্তের মধ্যে
পা ঠুকে ঠুকে হরি কে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে এই কি দরজা শুরু?

হরি হেসে ওঠে জোর।

মেঘ ডাকতে শুরু করে। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি। বিদ্যুতের ঝলক। বিদ্যুতের আলোয় দেখা যায়
অশথ তলায় দাঁড়িয়ে আছে
এক যুবক। তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পরনে জিন্স। খালি গা। সে একা একা হাসছে। নিঃশব্দ।

-----১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----৩০----৫----২০২১
-----নির্মল হালদার





কবিতা




কবিতা// নির্মল হালদার


৮৬.
প্রতিদিন নক্ষত্রের জন্ম

আমি যাই নক্ষত্রের দেশে

আমি চাইবো জন্মের কান্না
আমার কোলে রাখি,
আমার সন্তানের মতো,
আমারই স্নেহে।

প্রতিদিন নক্ষত্রের জন্ম।

প্রতিদিন কান্নার তাপ
আমাকে আলোকিত করে।


----১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮২
-----২৮----৫----২০২১



৮৭.
নুন কম পড়লেও
মানুষ কম পড়ে নাই
মানুষের খিদে-তেষ্টা কম পড়ে নাই

খিদে তেষ্টা কাটারির কোপ
যার গায়ে পড়ে
সেইতো চিৎকার করে

তুমি শোনো বা না শোনো
চিৎকার হচ্ছেই
তুমি শোনো বা না শোনো
চিৎকার উঠছেই উড়াকলের দিকে

হুড়মুড় করে চিবোবে সবাই
উড়াকলের আওয়াজ।


-----১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৯---৫---২০২১



৮৮.
আমার সকল ত্রুটির পরেও
আমার সঙ্গে দেখা করে চন্দ্র-সূর্য।
কি সহজ কি সাবলীল,
প্রতিদিন সৌহার্দ্য স্থাপন। প্রতিদিন সুন্দরতা।

আমি দেখতে পাই আতার অন্তর।

আমার কাদা মনে শাদা লাগে

আমি দেখতে পাই তারার গৌরব।


-----১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৩০----৫---২০২১



৮৯.
সম্পর্ক আকাশ হলে সম্পর্ক নীল
সম্পর্ক গভীর।
সম্পর্ক সূর্য তারা হলে সম্পর্ক আলো অন্ধকার
সম্পর্ক দিন ও রাত্রি

সম্পর্ক সম্পূর্ণ করতেই নিসর্গের নিঃশ্বাস।



৯০.
দিনের শুরুতে সম্পর্কের সাতরঙ কিরণ ছড়ায়

আমিও সাত রঙের পিপাসায়
আমিও আম গাছ হই জাম গাছ হই
আমিও বট হই অশথ হই
আমিও সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্ক

আমিও চাল ফুটলে ফ্যান চাই

ধান কুটলে চাল।


----১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----৩১---৫---২০২১
----নির্মল হালদার





শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি


































































টালোবাসা

টালোবাসা// নির্মল হালদার

দর্পণের খুব মন খারাপ।
বৃষ্টি শুরু হলেই তার মন খারাপ তীব্র হয়ে ওঠে। সে মনমরা হয়ে
শুয়ে থাকে কেবল।
একটু আগেই তার মা বিকেলের চা দিতে এসেছিল। ফিরিয়ে দিল সে। দুপুরেও ভাতে হাত দিয়েছিল মাত্র। মা বলছিল, দিপু কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে?
সে না না করে। তার মা পাল্টা প্রশ্ন করে, তাহলে খাওয়া-দাওয়া করছিস না কেন? চা--টাও খেলি না যে-----?

দর্পণ কিছু না বলে, একটা খাতা টেনে নেয়। আঁকিবুকি করে। তারপর লিখে ফেলে কয়েকটা নাম-------দীঘি শর্বরী তুতুল
ছো অবিন। নামগুলো কেটেও ফেলে সে।
একটা আকাশ আঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনভাবেই ধরা দিচ্ছে না আকাশ। দর্পণ ঘরের জানলা খুলে আকাশ খোঁজে।

আজ আর কোথায় আকাশ! থৈ থৈ করছে মেঘ। কালো হয়ে আছে মেঘ। বইছে ঝোড়ো হাওয়া। বৃষ্টি চলছে।
দর্পণ জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে
বৃষ্টি ধরার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে
তার আঁজলাতে এসে দাঁড়ায়, অচেনা এক মেয়ে। সে দর্পণের কাছে জানতে চায়, বলো আমাকে কি বলবে?
দর্পণ হতচকিত হয়ে বলে, না না
কিছু বলতে চাই না। কেবল গলা নামিয়ে জানতে চায়, তুমি কে?

মেয়েটি হাসে।

মেয়েটির হাসিতে দর্পণের ডান হাত কাঁপতে থাকে। তার মনে হয় মেয়েটি এবার হাত থেকে পড়ে যাবে। একদম মাটিতে।
তখন?

দর্পণের ভয় করে।

সে বলে, তুমি ঘরের ভেতরে চলে এসো-------। মেয়েটি আবার হেসে ওঠে। এবার দর্পণের বুক কাঁপতে থাকে। বোধহয় মেয়েটি বিপদ একটা করবেই।

তখন?

দর্পণ তার ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে মেয়েটির পা ছোঁয়ার চেষ্টা করে। আঙুল পৌঁছতে পারেনা।
সে বলে, তুমি যদি ঘরে না আসো
পড়ে যাবে। চলে এসো---------
দুজনে বৃষ্টির গল্প করবো। মেয়েটি বলে, বৃষ্টির গল্প নয়------সোঁদা
মাটির গল্প করতে চাই।
তুমি তো দোতলার ঘরে বসে কোনো রূপ রস গন্ধ কিছুই পারছ না------আমি সেই রূপ রস গন্ধ
তোমাকে দিতে চাই।
দর্পণ বলে, তার সঙ্গে আর কিছু?
মেয়েটি বলে, বলো কি চাইছো?

ভালোবাসা-------দর্পণের কাছ থেকে ভালবাসা শব্দটি শুনে মেয়েটি দুহাত বাড়িয়ে তার গলা ধরে। সে শিউরে ওঠে। মেয়েটি বলে, ভালোবাসা তো নেই----
টালোবাসা আছে-------তুমি কি নিতে চাও?

দর্পণ চুপচাপ থাকে।

তার মুখে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। হাতে জল। আর কিছু নেই। সে সম্বিৎ ফিরে হাতের জল
চোখে নেয়। দেখে, তার দু চোখে জল।
সে নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয়। সে বিড়বিড় করে, আমার চোখে জল কেন? চোখের জল কেন?
দর্পণ আরেকটা জানলা খুলে দেয়। দেখতে পায় বৃষ্টির অন্ধকারে মেয়েটি একা একা
হেঁটে চলেছে।
তার মনে হলো, নিচে গিয়ে মেয়েটিকে ঘরে নিয়ে আসা। কিন্তু তার অস্থির মন সেই কাজ থেকে তাকে বিরত করলো। কারণ,
কাউকে ডেকে এনে কারোর কাছে
আর ভালোবাসার কথা বলবে না।

ভালোবাসা বড় সংক্রামক।

ভালোবাসার বদলে টালোবাসা নিয়েই থাকতে চায় সে।

টালোবাসাই বা কি?

-----নির্মল হালদার
----২৬----৫---২০২১



কবিতা




কবিতা / নির্মল হালদার


৭১.
হঠাৎ একটা গিরগিটি কী করতে এখানে?

বৈশাখের কচি পাতায় কাঁপন লাগে

মানুষ ও কাঁপছে
ঘরে ফেরার রাস্তা আছে
অথচ ঘরে ফিরতে পারে না।

আমিই বা কার কাছে ফিরবো?
আন্তরিকতার কাছে ফিরতে ফিরতে
অন্তর যদি শুকিয়ে ওঠে?

উই ঢিবি কী আমাকে দেবে ঠাঁই?


৭২.
ইঁট পুড়ছে

ইঁটের পর ইঁট পুড়ছে

আমার পেটের আগুন নিয়ে জ্বলছে ইঁট ভাটা

আর কোথাও আগুন নেই
আমার পেটেই শুধু আগুন

আমার পেটের আগুন নিয়ে জ্বলছে ইঁট ভাটা

ইঁটের পর ইঁট সাজিয়ে একতল বহুতল

আমার শুধু ভাত নেই ছাত নেই।


----১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৬----৫----২০২১


৭৩.
পাতার শিরা উপশিরা থেকে হাওয়া এসে
আমার শিরা উপশিরায়। আমি হাওয়ার ভিতরে
নৌকা বাইছি। আমি মাঝি না হয়েও
মাঝির ভূমিকায়--------
পান্তা ফুরাবার আগে
নুন সংগ্রহ করছি।

নুনের মতো অমূল্য আর তো কিছু নাই।



৭৪.
আড়ালে চলে গেছে ঢেঁকি।
ধান কুটতে চাল করতে ঢেঁকিতে আর পা পড়ে না।
সেই কঠিন ও কোমল পায়ের অপেক্ষা করছি।
যদি পা গুলি দেখতে পাই, যদি
পায়ে লেগে থাকে মাটি-------

আমি প্রণতি করবো।

আদ্যিকালের পায়ে ধরা আছে
রাস্তার পর রাস্তা

আমার ঘরে ফেরার রাস্তা।


-----২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৭----৫----২০২১


৭৫.
প্রকৃতি থেকে ছিটকে এসে
এইতো পাঁকে পড়েছি।
কি পাঁক কি পাঁক,পা ঢুকে পড়েছে

অন্ধকারে।

এই অন্ধকার আমারই, আমারই নির্মাণ

আমারই প্রয়াসে রচিত
আমার ধ্বংস
আমি যে কোথায় নিয়ে যাবো

কতদূর?


----৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৮---৫---২০২১

৭৬.
তৃষ্ণা কি তৃষ্ণা কোথায় থাকে
তরমুজের কাছে দাঁড়ালেই, তরমুজের কালো বীজ
আমাকে বলবে।

জমিতে গড়াগড়ি যায় অসংখ্য তরমুজ
চলো যাই-------

অনেকতো বেড়ানো হলো জনারণ্যে, নির্জনতায়
এবার না হয় তরমুজের কাছে

তরমুজের জলে।


----৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৮---৫----২০২১


৭৭.
মাটির কি দোষ
মাটির গভীরে গেল না? দাঁড়িয়ে আছে ধূলায়
ছোট্ট একটি বীজ

আমি কী বীজের ভিতরে যাবো?

আমি তো জলের ভিতরে গেছি মূল খুঁজতে

আমি তো খুঁজে পেয়েছি জলের মুখশ্রী।


-----৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৯---৫---২০২১



৭৮.
নদীর মূল কেটে দিয়ে আমাকে বলছো,
জল খাও।
গাছের মূল কেটে দিয়ে আমাকে বলছো,
ফল খাও।

আমার খিদে তেষ্টা তুমি চিনলে না।

তুমি চিনলে না আমাকেও
আমি হাততালি দিতে দিতে হাতের ঘর্ষনে
আগুন জ্বালতে জানি

তোমাকে পোড়াবো।



-----৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----২১----৫----২০২১


৭৯.
পানকৌড়ি ডুবছে উঠছে
ছায়া ফেলছে পানা ফুলের সবুজ
হাওয়া এলে দুলে উঠছে জল
এপার ওপার মেঘ ভাসে।

লাশ ভাসছে নদীতে।

কার নদী? কার লাশ?
মৃতদেহ একবারও বলছে না একটি ও ঠিকানা
বেহুলা নেই

লজ্জাতে মুখ লুকায় আমার আকাশ।


----৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২২----৫----২০২১



৮০.
হাওয়া, আমাকে জাগাও

যেভাবে জেগে আছে রাস্তা
যেভাবে জেগে আছে বৃক্ষ লতাপাতা
যেভাবে জেগে আছে পথিকের দিন ও রাত্রি
আমাকে জাগাও।

আমারই দোষে আমি সঞ্চয় করি ধন সম্পদ।
ভুলে যাই, আমের বোঁটায় থিকথিক করছে জীবন

মৌমাছির মন।


-----৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৩---৫----২০২১



৮১.
থরে থরে মেঘ
আকাশের মত থালায়
আমি বজ্র--বিদ্যুৎ মাখামাখি করে দু'মুঠো সাজাই

ধুলোমাটি সাজিয়েছি।

ডাল-ভাত সাজিয়েছি। পংক্তি ভোজনে
এসেছে সবাই। সবারই এক রা:
খাই খাই

খাই খাই

আমি খিদের নিশান ওড়াই।


----১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৫----৫---২০২১



৮২.
থরে থরে মেঘ
আকাশের মত থালায়
আমি বজ্র--বিদ্যুৎ মাখামাখি করে দু'মুঠো সাজাই

ধুলোমাটি সাজিয়েছি।

ডাল-ভাত সাজিয়েছি। পংক্তি ভোজনে
এসেছে সবাই। সবারই এক রা:
খাই খাই

খাই খাই

আমি খিদের নিশান ওড়াই।


----১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৫----৫---২০২১



৮৩.
হালের গরু নেই

ট্রাক্টর ভাড়া ঘন্টায় ন'শ টাকা

অফলা জমিতে কে নামবে?
সূর্য তো নেমেই আছে, মাটিও ফাটছে খুব

মেঘ আসছে

বলরামের লাঙ্গল কোথায়?

-----১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----২৬---৫---২০২১



৮৪.
পাখি এসে দাঁড়াতেই মাটির তাপ কোমল হয়ে ওঠে।

পাখির ডানার ছোঁয়াতে আকাশও কোমল

আমিও আকাশবিহারী
মেঘের কোমলতায় বৃষ্টির উষ্ণতা পেয়েছি

বৃষ্টি আর কিছুই না মাটির জাতক।


----১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৬----৫----২০২১



৮৫.
নদী দেখলে হবে না
মাথায় বেঁধে আগলাতে হবে।
পাহাড় দেখলে হবে না
হাতের তালুতে আগলাতে হবে।

যেভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে নদী
শুধু পড়ে থাকবে হাড়ের গুঁড়ো।
যেভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে পাহাড়
শুধু পড়ে থাকবে ধুলো।

নদী আমার শিরা উপশিরা।

পাহাড় তো পাহারাদার

মনুষ্যত্বের।


-----১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৭----৫----২০২১
-----নির্মল হালদার





সোমবার, ১৭ মে, ২০২১

লকডাউন / নির্মল হালদার

লকডাউন// এক

সুবোধ বাঁধ ধারে যেতে ভয় পাচ্ছে। যদি পুলিশ ধরে।
যে গাঁয়ে কোনো কালেই পুলিশ দেখা যেত না, সেখানে এখন
পুলিশ এসে ঘোষণা করে যাচ্ছে,
বাড়ির বাইরে কেউ ঘোরাফেরা করবেন না। অন্যথায় জরিমানা হতে পারে।

বাঁধতো যেতেই হবে।

সকাল সন্ধ্যা দুবার। তাদের তো আর পায়খানা নেই। এখন পায়খানা করতে বসলে, পুলিশ যদি ধরে? এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সুবোধ বাঁধের দিকে হাঁটতে থাকে।

নতুন করে এসেছে, করোনা ভাইরাস।ই বার ত গাঁয়ে গাঁয়ে
নিউমোনিয়া। টাইফয়েড। ইনফ্লুয়েঞ্জা। একদম গেবে গেছে।
হেলথ সেন্টারে ডাক্তার নেই। নার্স নেই। এমন কি ওষুধ পর্যন্ত নেই।

বড় বিপদে পড়েছে গাঁয়ের মানুষ।

শহরেও নাকি ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। কি করবে সুবোধরা?
১৫ দিনের লকডাউন। কামকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে যেটুকু চাল আছে, সেদ্ধ করে দুবেলা। কালকে শেষ হয়ে গেছে আলু। আজ অনিলের ঘর থেকে ভেন্ডি এসেছিল। তাই ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে খাওয়া হয়েছে।

কাল যদি নুনের পয়সা না থাকে?

লকডাউন যদি বাড়ে ধুলা মাটি খেয়ে থাকতে হবে। দিন মজুরদের কথা কে আর চিন্তা করে! ভোটের সময় বাবুরা সব বড় বড় কথা বলে যায়। তারপর পাঁচ বছর আর দেখা নাই। 
ইবার মনে হয় ঘাসের বিচ খেতে হবে। ত মাঠে ত ঘাস নাই। জুটছে নাই গরু ছাগলের।

বাবুদের এত বড় বড় কথা, তারা কি পারে নাই, ভাইরাস আটকাতে?

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অস্বস্তি নিয়ে ভয় নিয়ে সুবোধ বাঁধে পৌঁছে দেখে, গাছে গাছে আঁধার। অস্পষ্ট হয়ে গেছে বাঁধের জল। পায়খানা করে জলের কাছে যাওয়া যাবে তো? সুবোধের ভয়ডর থেকে
আকাশে দেখা গেল একটি দুটি তারা।

-----১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৬----৫-----২০২১
----নির্মল হালদার





লকডাউন// দুই

ছড়রা স্টেশনেই থাকে এই কয়েকটি পরিবার। ভিখারি পরিবার। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে
একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে
এদের বসবাস।

প্যাসেঞ্জারদের কাছেই এই ভিখারির দল হাত পাতে। আর
দু মুঠো চাল ভিক্ষা করতে ছড়রা 
গাঁয়ের ভিতর দিকে যয়।

কোনো কোনো ঘর থেকে 
চালের সঙ্গে আলুও দিয়ে থাকে।
ওরা খুশি হয়।
একদিন বলরাম ওর বউকে বলছিল ফিসফিস করে, হ্যাঁগো
নুন চাইলে হয় না? বউ মুখ ঝামটা দিয়ে বলরামের মুখ বন্ধ করে।

এই বলরামের পরিবার আরেক গাঁ থেকে ভাগ্য অন্বেষণে গ্রাম শহর ঘুরতে ঘুরতে এই ছড়রা স্টেশনেই শেষ অব্দি গেড়ে বসেছে।

মাথায় ছাদ নেই। শুধু গাছতলা।

শুধু বলরামের পরিবার নয়, আরো কয়েকটি পরিবার। ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে যেদিন যেটুকু পায়, চলে যায় এদের।

এরা সুখ জানে না। দুঃখ জানেনা।
এদের কাছে কেবল অভাব। এরা
ভোটাধিকারের বাইরে। তাই, রাজনৈতিক দলগুলি এদের কাছে এসে দাঁড়ায় না।

এদের কাছে স্বেচ্ছাসেবী দল নেই।

এদের মাথায় তেল নেই। পরনের জামা কাপড় ছেঁড়া। ময়লা।
এরা কখনো কখনো এক মালগাড়ির ড্রাইভার এর কাছ থেকে 50 টাকা করে পায়। সেই 
ড্রাইভার একবার এদের দিয়েছিল
কয়েকটা কম্বল।

বলরামের দল দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল।

ভাগ্যিস কেউ বলেনি, ভিখারির আবার আশীর্বাদ!

এই ভিখারির দল হঠাৎ শুনলো,
নতুন করে শুনলো, ট্রেন আর আসবেনা। দু-একটা প্যাসেঞ্জার চললেও দাঁড়াবে না এই স্টেশনে।

কারণ, লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেছে। ভিখারিদের মনে হলো,
তাদের মাথায় বাজ পড়লো আরেকবার। গতবছর লকডাউনের সময় কি কষ্টে যে কেটেছে। অনেকদিন তেঁতুল পাতা
চিবিয়ে দিন কাটিয়েছে। মনে আছে তাদের, ছড়রার এক ঘরে
সজনে পাতা খুঁজতে গিয়ে ছিল।
সেদ্ধ করে খাবে। কিন্তু ওদের শুনতে হয়েছিল, ধুর ধুর---------।
ওরা অপমানে , লজ্জায় ফিরে এসেছিল গাছ তলায়।

ভিখারিদের ও অপমান লাগে।
লাগেনা?

এবারে কি হবে? কারা দেবে পয়সা? ছড়রার মানুষ ভিক্ষা
দেবে তো?

ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের ওঠানামা থাকবে না। কি করবে বলরামরা?

দু-তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পর
বলরাম তার বউকে নিয়ে পুরুলিয়া শহরে এসেছে। বউয়ের কোলে ছোট্ট শিশু।

শিশু কি ভিখারী হয়?

কোলের শিশু কি ভিখারী হয়? 

শহরের এক গলিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের কাছে বলরামের বউ হাত পাতে। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলে, এখন আবার কিসের ভিক্ষা---------
লকডাউন চলছে তো----------

----২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৭---৫---২০২১
-----নির্মল হালদার





লক ডাউন// তিন

সকাল ৭ টা থেকে ১০টা। বেলা ১০টা থেকে বিকেল ৫টা।কোনো কোনো দোকান বেলা ১২টা থেকে 
বেলা ৩টে।

খিদের তো নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। হোটেল তো সব সময়ের জন্য বন্ধ। কি করবে রাস্তার গরু? রাস্তার কুকুর?

হোটেলের এঁঠো কচি শাল পাতা
চিবানোর সুযোগ নেই গরুদের।
শাল পাতা চেটে খাওয়ার সুযোগ নেই কুকুরদের।কি করবে এই সব
প্রাণীরা?


মন্দিরের চাতালে বসে এক বৃদ্ধা মহিলা মাস্ক সেলাই করছে।
ছুঁচ- সুতো পেলো কোথায়? মাস্ক
কেনার জন্য পয়সা নেই যখন, তখন ছুঁচ--সুতো পেলো কোথায়?
এই বৃদ্ধা মহিলার আহার জুটছে কী?

যেটুকু বাজার খোলা আছে এখন
শুধু ছুটোছুটি। গায়ে গা ধাক্কা। যেনবা বাজার হাট বন্ধ হয়ে গেলে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে!

কিন্তু গরু কুকুর শুয়োর এরা খাবে কোথায়? এরা যাবে কোথায়?

একটি পঙ্গু লোক হাতে ভর দিয়ে চলেছে রাস্তায়। দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। সারা শরীরে জীর্ণতা।
কোথাও কোথাও থেমে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও বাজারিদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।

এই মানুষটি থাকে কোথায়?
এই মানুষটির কেউ আছে?
ঘর আছে?
কে দেয় দু মুঠো?

মানুষটার হাতে একটি কালচে স্টিলের গ্লাস। মাঝেমাঝেই গ্লাস ঠুকে ঠুকে রাস্তায় চলেছে।

কারোর কাছে কিছু চাইছে না।

মানুষটি কি জানে, লকডাউন কাকে বলে?

দশটা বেজে পার হয়ে গেছে, মিষ্টির দোকানের শাটার খুলছে এবার। মানুষটি এক মিষ্টির দোকানের কাছে এসে, গ্লাস দেখিয়ে বলে, একটু জল দিবে বাবু জল?


দোকানের মালিক মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, এই দোকান খুলছি,
তুই কে রে লাট সাহেব জল খুঁজতে চলে এলি? যা ভাগ------

ভাগ্-----------।

-----৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----২১---৫----২০২১
-----নির্মল হালদার





লকডাউন// চার

পুলিশ আসছে-----পুলিশ আসছে
একটা রব উঠলো বাজারে।
তড়িঘড়ি সবজি বিক্রেতারা গোছাতে শুরু করলো। পুলিশ এসে পড়লে, পিঠে পড়বে লাঠি।
যেটুকু সবজি আছে ফেলেও দেবে।
রাধি মাহাতান কমলা মুদি এসেছে দূর গাঁ থেকে। ভোরবেলা। জলদি জলদি বিক্রি করে ফিরে যাবে ঘরে।

৫ কিমি রাস্তা হেঁটে এসেছে। যাওয়ার সময় টোটো তে যাওয়া।
সেও ভাগ্য ভালো থাকলে পাওয়া যায়। বেলা নটার মধ্যে বেচাকেনা
হয়ে গেলে ভালো। কিন্তু আজ
খদ্দের নেই। কমলার দুটো কুমড়ার বিক্রি হয়েছে একটা। আরেকটা কাটা অবস্থায় পড়ে আছে। বিক্রি না হলে, ঘরে নিয়ে যাওয়া মানে ইঁদুরে খাবে। রাধি
বুড়ি নিয়ে এসেছিল এক কেজি বেগুন। যদি ১০টা টাকাও হয়। সেও পড়ে আছে২৫০র মত। আর আছে গাঁয়ের জমি থেকে তুলে নিয়ে আসা গিমা শাক। কেউ
ভুলেও দেখছে না।

রাধি বুড়ি ও কমলার চোখেমুখে
চিন্তার রেখা।

খদ্দেররা ছুটছে।

একজন তো একটা লাউ ------দু কেজির মত হবে------১০ টাকায়
এক খদ্দের কে দিয়ে দিলো। অথবা বলা যায়, দিয়ে দিতে বাধ্য হলো।

পুলিশ এলেই সব লুটপাট হয়ে যাবে। 

এক জেলেনি ১কে জি মাছ অর্ধেক দামে বিক্রি করে ঝুড়ি মাথায় ঘরের দিকে। সে মনে মনে
হায় হায় করছে। মনে মনে বলছে,
ই লকডাউন কবকে শেষ হবেক?
কবকে? কম দামে বিনা লাভে ই ভাবে বিকলে পুঁজি পাটা শেষাবেক।

পুলিশ পুলিশ

রব উঠছে আবার।

দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকলো। চা-ওয়ালা কোনভাবে
সমস্ত গুটিয়ে দৌড়াচ্ছে।
পুলিশ এসে পড়লে কোনো কিছুই আস্ত থাকবে না।

মুখে মাস্ক হাতে বাজারের ব্যাগ
একটা লোক এ সময় এসে বলে,
পালা পালা------পুলিশ চলে এসেছে।

কে যে বললো মুখে মাস্ক থাকার জন্য কাউকেই চেনা যাচ্ছে না।

রাস্তায় শুয়ে থাকা গাই গরু এবং কুকুর নির্বিকার। তাদের ছুঁতে পাচ্ছে না কোনো ভাইরাস। যে ভাইরাসের কারণে আইনকানুন।


খিদে কী আইন-কানুন মানবে?
নাকি মানা যায়?

তেলেভাজার দোকানে এক খদ্দের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চপে কামড় দেয়। তখনই পুলিশ এসে
তার পিছনে মৃদু আঘাত করে। লাঠিতে। বলে----বাড়িতে গিয়ে খেতে পারিস না? দোকানিকে বলে, উনানে কী জল ঢালবো?
 কটা বাজছে দেখেছো?

পুলিশকে দেখে মুহুর্তের মধ্যে বাজার ফাঁকা। কমলা ও রাধি বুড়ি ঝুড়িতে সাজাচ্ছে বাকি সবজি। পুলিশ এসে রাধি বুড়ির
গিমা শাক যেটুকু ছিল লাঠিতে উঠিয়ে রাস্তাতে ফেলে দেয়।

বুড়ির বুক কাঁপতে থাকে।

ভোরের আঁধার থাকতে-থাকতে
তুলেছিল শাক। যদি কটা পয়সা হয়, ঘরের কাম কাজে লাগবে।
সেও গেল।
সে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, হ্যাঁ বাবারা ই কটা শাগ
ফেলে দিয়ে কি লাভ হলো তোদের?

-----১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২৫---৫---২০২১
----নির্মল হালদার




রবিবার, ১৬ মে, ২০২১

কবিতা






৬৬.
পাথর যদি তার দিকে ছুটে যায়
আমি বলবো,এই আমার দেশ।
পাথর যদি আমার দিকে ছুটে আসে
আমি বলবো, এই আমার দেশ

কে কার দিকে থাকবে আর

নদীও চুরি হয়ে যায়
পাহাড় ও পাথর হয়ে যায়
কে কার সঙ্গে থাকবো আর
কে কার উপশম

ধ্বসে  পড়ছে বৃক্ষ চূড়ার আলো।



৬৭.
আমারই অন্তরে তুমি আমার অন্তর
একইসঙ্গে একই রঙে
আমরা দুজন।

তুমি যা দেখাও আমি দেখি
আমি যা দেখাই তুমি তাই দেখো
আমরা অখন্ড

আকাশের মত

আলো-আঁধারে সম্পৃক্ত

আমরা একই সঙ্গে একটি হৃদয়

মাটির বাঁশি বাজাই।


------২৬ বৈশাখ ১৪২৮
-----১০----৫-----২০২১


৬৮.
মাটি ও আকাশের সংযোগে যে তাপ ওঠে
তার নাম প্রেম। সেই প্রেমের আকাঙ্ক্ষায় সাহসী হয়ে
তোমাকে চাই।

তুমি অসীম হয়েও বাসা বাঁধো।
তোমার পূব নেই পশ্চিম নেই, চারদিকেই দুয়ার।
আমি কি দাঁড়াবো না? আমিও পাখির ঠোঁট থেকে
পড়ে যাওয়া একটি বীজ

জন্ম-জন্মান্তরের বীজ।



-----২৭ বৈশাখ ১৪২৮
----১১----৫----২০২১


৬৯.
স্পর্শ পাবার লোভে
আকাশ ঝুঁকে পড়েছে আমার কাঁধের কাছে।
কী আছে আমার? আছে তো শুধু
একটা দেশ
স্বপ্ন আর স্বপ্ন হীনতায়, আর্তনাদে

হাহাকারে, কান্নায়

তুলসী থানের মাটিও ক্ষয়ে যায়।

আমার অন্তর আমার দেশ
কী দেবে আর কি দিতে পারে!
আমার শরীর আমার দেশ
কী দেবে আর কী দিতে পারে!

আকাশকে ফিরিয়ে দিই আরেক আকাশে।


-----২৮ বৈশাখ ১৪২৮
----১২---৫---২০২১


৭০.
ধূপের আগুন খিদের আগুন

ছোট ছোট খিদের আগুন

তার রূপ রস গন্ধ পুড়তে পুড়তে
বড় খিদে জাগায়।
আমাকেও জাগায়, আমি চিৎকার করি:
খেতে দে
খেতে দে

আমি আলো খাই বাতাস খাই

আমি মাটি কামড়াই

আমি মাখি ধূপের ছাই।


----৩০ বৈশাখ ১৪২৮
-----১৪----৫----২০২১
-----নির্মল হালদার






ছবি : সন্দীপ কুমার

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ