সোমবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২১

পড়ার জন্য নয় মুছে ফেলার জন্য / নির্মল হালদার

পড়ার জন্য নয় মুছে ফেলার জন্য / নির্মল হালদার



------আপনার ফোন নাম্বারটা দেবেন?
------নদী পাহাড় জঙ্গল।

ঝর ঝর করে হেসে ফেলে মেঘবতী।
সে আবার বলে, দিন না ফোন নাম্বারটা।
আমি বলি, ওই তো আমার নাম্বার।
নদী পাহাড় জঙ্গল। তার আগে মাটি শব্দ টা লাগিয়ে নিও। তাহলে অবশ্যই আমাকে পাবে।
মেঘবতী বলে------আমার সঙ্গে মজা করছেন? আপনিতো ফেসবুক করেন না। কথা কিভাবে বলবো?

-----কথা বলার তো দরকার নেই।
-----আমার যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। তখন মনে হয়, কারোর সঙ্গে কথা বলি। ইচ্ছে তো হতেই পারে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে।
-------হ্যাঁ ইচ্ছে তো হতেই পারে।
তোমার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে বলছি-------তুমি দেখো নদী পাহাড় জঙ্গল নাম্বারটা লাগিয়ে, আমাকে পাবেই।
-----না পাবো না। কখনোই পাবো না।
নদী পাহাড় জঙ্গল কি নাম্বার হতে পারে?
আমি বললাম, হ্যাঁগো নতুন শুরু হয়েছে। আমি প্রথম এই নাম্বারটা পেয়েছি।
মেঘবতী হাসতে হাসতে আমার
নাকটা ধরে নাড়িয়ে দেয়।
আমি খানিক রোমাঞ্চিত হয়ে তাকে বলি, সম্পর্ক করতে হয় কিন্তু সম্পর্ক নিয়ে নাড়াচাড়া করতে নেই। তুমি যেখানে আছো দিব্যি আছো। আর বেশি দূর এগিয়ো না।

------নিকট ও দূরের কি আছে, শুধু কথা বলবো। যদি মনে হয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়তে আপনাকে পড়ে শোনাবো। অথবা গীতবিতান থেকে
একটা গান শোনাতে পারি।
আমার গলায় সুর নেই। আমি গীতবিতানের গান কবিতাই মনে করি।
------আর আমার যদি শুনতে ইচ্ছে না করে? তখন? ফোনের শব্দে আমার যদি ঘুম না ভাঙ্গে? তুমি তো রাগ করবে। তাই বলছি, কোনো ফোনাফুনি নয়। এই যে দেখা হলো আমাদের, এই সাক্ষাৎটাই অক্ষয় হয়ে থাকুক।
এবার মেঘবতী ছদ্ম রাগ নিয়ে বলে,
আপনি আচ্ছা মানুষ তো! একটা মেয়ে আপনার কাছে বারবার ফোন নাম্বার চাইছে, আপনি দিতে চাইছেন না।

----দিলাম তো।
-----নদী পাহাড় জঙ্গল নাম্বার হতে পারেনা।
----১ থেকে ১০০ নাম্বার হতে পারে না।
-----কী হতে পারে?
-----শুধু ভালোবাসা।
-----নিঃসঙ্গতা নাম্বার হতে পারে না?
----পারে বৈকি।
-----তবে আমার সব নাম্বার নিঃসঙ্গতা।

আমার মনে হয় মেঘবতীর নিসঙ্গতার কাছে কেউ নেই। কেবল মেঘবতীর কবিতা ও গান। মেঘবতীর আবেগ। মেঘবতীর অনুভব। উত্তেজনা।

কবিতা ও গান সব সময় নিঃসঙ্গ।

নিঃসঙ্গতার সঙ্গে নিঃসঙ্গতা।
মেঘবতী একা।

আমি একা নই।

নদী পাহাড় জঙ্গল ক্লিক করলেই
সহজেই পেয়ে যাই আমার জগৎ।
সীমাহীন প্রেমের আস্তানা।

মেঘবতীকে বললাম------মোবাইলটা ফেলে দাও। জলে।
দেখবে,
আলো হাওয়ার সমুদ্রে তুমি সাঁতরে বেড়াচ্ছো। 
এসো--------তোমার ললাটে চুম্বন আঁকি। এসো।
আমার কথা শেষ হতেই, মেঘবতী
আমাকে জড়িয়ে ধরে।

একটা মহুল গাছ চেয়ে থাকে। নীরবে।

------৬ কার্তিক ১৪২৮
-----২৪----১০----২০২১
------নির্মল হালদার






খুশিয়াল / নির্মল হালদার

খুশিয়াল / নির্মল হালদার


অনেকদিন আমার সঙ্গে আছে খুশিয়াল।জল তেষ্টা পেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বুঝতে পেরে এক বালতি জল তার মুখের সামনে এগিয়ে দিই। রাস্তায় থাকলে
পুকুরের খোঁজ করি।

তাকে রোজ মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসি।
সে আপন মনে চরে বেড়ায়। ঘাস খায়। আমি কোনো কোনোদিন মাঠেই বসে থাকি। আর খুশিয়ালকে বলি, আমি না থাকলে তোর মত গাধাকে কে দেখতো রে? যেদিন আমি থাকবো না, কি করবি তুই?

কেন যে তুই আমার কাছে ধরা দিলি?
আমিও তোকে সঙ্গী পেয়ে আগুপিছু
কিছুই ভাবলাম না। তোর ভবিষ্যৎটা
ভাবা উচিত ছিল আমার।


ধোবাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
তাড়িয়ে দিয়েছে তোকে। নাকি আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যই আমার কাছে এসেছিস তুই?

আমার সঙ্গে তুই আছিস, তাই
লোকজন আমাকে বলে গাধা।
লোকজনকে আমার প্রশ্ন, মানুষ তো আমাকে সঙ্গ দিলো না সাহচর্য দিলো না, আমি তো গাধার সঙ্গে গাধা হয়েই থাকবো।


খুশিয়াল কি বোঝে কে জানে।
বেশিরভাগ সময় আমার দিকে চেয়ে চেয়ে সূর্যাস্ত দেখে।
সূর্যাস্তের করুণ আভা খুশিয়ালের চোখে পড়লে আমার মন কেমন করে।

সে সারাদিন শান্ত ও চুপচাপ।

আমাকে একটুও জ্বালাতন করে না।
আমি প্রতিদিন সময়ে সময়ে তার কাছে খাবারের জোগান দিয়ে থাকি।
আমার ভাত থেকেও তাকে একমুঠো দিই।তার পেট ভরবে না জেনেও
আমার মনে শান্তি আসে। যে 
তাকে একমুঠো খাওয়াতে
পেরেছি। ভাগ দিতে পেরেছি।

খুশিয়াল কখন যে ঘুমোয় কে জানে।
মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে, আমি বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়াই।
দেখি,সে জেগে আছে।

জেগে জেগে সে কী তারা ভরা আকাশ দেখে? সে কী চাঁদের সঙ্গে কথা বলে?
নাকি সে আমার নিঃসঙ্গতাকে পাহারা দিয়ে থাকে? যেন আমার নিঃসঙ্গতা আমার কাছেই থাকে। কেউ যেন চুরি করে না নিয়ে যায়।

আর আমি?

খুশিয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে বলি,
ঘুমিয়ে পড়্। ঘুমিয়ে পড়্।
ভোরের অনেক দেরি।

আমি অনেকদিন বাঁচবোরে। তুই দুশ্চিন্তা করিস না। আমি এখনো আছি। যতদিন আছি, তোকে দেখবো।


-------৩ কার্তিক ১৪২৮
------২১-----১০-----২০২১



আনন্দ / নির্মল হালদার

আনন্দ / নির্মল হালদার


গাধাটা এসে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে।
জানতে চাইলাম, এতদিন দেখিনি কেন? সে বললো--------কোনো কাজ নেই আজকাল আর। ধোপারাও তাড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে
খাবার জোগাড় করতে পারি না। কি করবো?
শেষমেশ তোমার দুয়ারে এসে দাঁড়ালাম। যদি একটু মাড়জল দাও প্রাণে বাঁচি।

আমি বললাম, চলো তোমায় নিয়ে যাচ্ছি গেরস্থের ঘর। আমার ঘরে তো
শুধু জল ছাড়া কিছু নেই।
আমার এক কথায় গাধা রাজি হয়ে গেল । মনে হয়, সে জানে আমার অবস্থা।

গেরস্থের ঘরে যেতেই, আমার সঙ্গে গাধাকে দেখে অবাক।
আসলে, লোক জানে একটা মানুষের সঙ্গে খুব জোর একটা কুকুর থাকতে পারে। গাধা যে থাকতে পারে মানুষের ভাবনার বাইরে। তো, এক মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করে---------গাধাকে নিয়ে এসেছি কেন? গাধাটি কি আমার পোষা ?
আমি বললাম, গাধাটি আমার বন্ধু । আমি শুধু আপনাদের কাছে এসেছি, আপনারা যদি গাধাটাকে
একটু মাড়জল দেন।
মহিলা আমাকে আবার বলেন, আমাদের ঘরেই কেন ? আরো অনেক ঘরতো আছে।

আমি বললাম, তা জানিনা। তবে একটা কথা বলতে পারি, আপনার যদি দয়া হয় দেবেন। নিরীহ প্রাণী।
ভাতের মাড় ফেলে না দিয়ে গাধাটাকেই দিন।

মহিলা বলেন, আমাদের ভাত অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। ফেলে দিয়েছি মাড়।
তুমি ভাই অন্য কোথাও দেখো।

বন্ধুকে নিয়ে আরেক পল্লিতে ঢুকে যাই। একটা ঘর না করলে আরেকটা ঘর। যেভাবেই হোক বন্ধুর মুখে খাবার দিতে হবে।

একসময়ের বোঝা টানা গাধার পিঠে
অনেক দাগ। আমি হাত বুলিয়ে   বলতে চেষ্টা করলাম--------বোঝা আমিও টানি। আমাকেও টানতে হয়।
কেউ দেখতে পায়না। তোকেও বোঝা টানতে হবে আবার। তাহলেই, আহার জুটবে। ধোপারা তোকে তাড়িয়ে দিলেও আমি তোকে তাড়িয়ে দিচ্ছিনা।
তুই আমার সঙ্গেই থাকবি। শুধু আমার সঙ্গে। এটুকুই তোর বোঝা। আমি ঠিক সময়ে তোর মুখের কাছে এনে দেবো তোর খাবার।
এখন চল্ , দেখিগে , কার ঘরে তোর জন্য খাবার পাই।

আরেক গেরস্থের ঘরে কোনো সাড়া শব্দ না করে ঢুকে পড়েছি। ঘরের সবাই আমার সঙ্গে গাধাকে দেখে রে রে করে ওঠে।
 বলে-------------পাগলটা কোত্থেকে এলো রে বাবা!
তারপরেই বলে, যা যা এখান থেকে যা
এখানে কিছু নেই।
আমি বলবার চেষ্টা করি, আমি পাগল নই। আমি শুধু বন্ধুর জন্য মাড়জল খুঁজতে এসেছি।
তারা আমার কথা কান করে না।
কেবলই বলে যায়--------যা যা এখান থেকে যা। না গেলে গরম জল  ছুঁড়বো।

আমি বাইরে চলে আসি।

বন্ধুকে বলি, একদম হতাশ হবি না।
আমি যতক্ষণ আছি, তোর মুখে খাবার দেবো।
সে আমার মুখের দিকে চেয়ে কি বুঝলো কে জানে। হঠাৎ দেখি, পিচ বাঁধানো রাস্তার পাশে গজিয়ে ওঠা
ঘাসে মুখ দিচ্ছে।
আমার মায়া হলো। মনে হলো, এক প্রাণী এসে আমার কাছে খাবার চাইলো আর আমি দিতে পারবো না!
আমি কেমন মানুষ?

আমি বন্ধুকে নিয়ে গেলাম, সবজি বাজারে। এটা সেটা সবজি ভিক্ষা চেয়ে বন্ধুর মুখের কাছে ধরি। সে মনের আনন্দে চিবোতে থাকে।  এবং চিবোতে চিবোতে সে  তার মনের কথা বলে--------সে আমার কাছেই থাকবে। আমি যেন তাকে অন্য কোথাও ছেড়ে না দিয়ে আসি।
আমি বুঝতে পেরে বন্ধুর মাথায় হাত রেখে বলি-------তোর ভয় নেই। তুই আজ থেকে আমারই বন্ধু। তুই আমার আনন্দ।

আনন্দ আমার কাছেই থাকে।

তাকে নিয়ে ঘুরতে যাই। লোকজন আমাদের দেখলেই, আমাদের ক্ষ্যাপায়। ঢিল ছুঁড়তে থাকে। 
আমি আঘাত পেলেও চেষ্টা করি, আনন্দের গায়ে যেন না লাগে।

আনন্দ আমার বন্ধু।

আনন্দের বন্ধু আমি।

দুজন দুজনের মন টেনে নিয়ে চলতে চাই।


-------১ কার্তিক ১৪২৮
------১৯----১০----২০২১
-----নির্মল হালদার



পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার




১০৩.
ভিতর চিনলেই বাহির চিনবি।

যেমন নিজের ছেঁড়া কাপড়টা চিনেছিস,
তেমনি আকাশটা যে গোটা আছে
চিনতে হবে তোকে। মাটিটা ছিঁড়লেও
মাটি মাখা যায়। কেননা

তোর সর্বাঙ্গ যে মাটি।



১০৪.
পেঁপে পাকলে পাখি ঠুকরে খাবে।

পেকে উঠুক সব পেঁপে
পাখিরা আসুক। কেননা সব পাখি
আমারই মন। সমস্ত মনই
রাহেড় বাড়ি

রাহেড়ের দানাই মে আমার হৃদয়।


১৫----১০----২০২১
বিজয়াদশমী



১০৫.
যা বলার বলছে ভূমি

পেকে উঠছে ধান
খামার নিকানো চলছে
ধারালো হয়ে উঠবে হাঁসুয়া
ঝুড়ি--ঝাঁটাও আসবে।

যা বলার বলছে ভূমি

ঝরে গেছে কাশ
ঝিঙে ফুলে রোদ ঝলকায়
শিরশিরে হাওয়া
ধানক্ষেতে পাখি আসছে।

যা বলার বলছে ভূমি

ভেজা ধান জমি
শিশির ভেজা পাতা
মাঠে মাঠে আগাছা
গরুর পিছনে বাছুর।

যা বলার বলছে ভূমি

কোথায় তুমি?

ধানের ভেতরে নির্জনতা।


-----৩০ আশ্বিন ১৪২৮
----১৭----১০----২০২১



১০৬.
কপাল পুড়লো বলে আকাশ পুড়লো

আকাশও তোর কপাল,
অনন্ত কালের।
তুই লক্ষ্য করলি না বলে,
আকাশ থেকে গেছে আকাশে

নক্ষত্র পুড়ছে।


১০৭.
পাখির ভূমিকা চেয়ে
পাখিকে বলেছি, আমিও মুখে মুখ রেখে
আহার জোগাবো।

ডানা ঝাপটে পালিয়েছে পাখি

আকাশ নেই মাটি নেই, শুধু কুড়ুলের শব্দ।


------৩১ আশ্বিন ১৪২৮
-----১৮----১০-----২০২১



১০৮.
অভাবটাই আমার মূলধন
যত ভাঙ্গাই তত ভাব

যত ভাঙ্গাই তত ভাব

হাত পাততে হয় না কারোর কাছে
ঋণ করতে হয় না কারোর কাছে

অভাবটাই আমার আলো

যত ভাঙ্গাই তত আলো
যত ভাঙ্গাই তত ভাব

সাত রঙের সাতটা সূর্য তাল গাছের ফাঁকে।



১০৯.
গাছের কাছে ডানা চেয়ে শুনতে হলো,
আমাকে বীজ দেবে। আমাকে করতে হবে
বংশ বিস্তার।


বংশবিস্তার তো হয়েই আছে পাখিতে পাখিতে,
বটফলের রঙে। পুটুস ফুলের মধুতে,
কাকের ডাকে

আমি ডাকলে গরুর গলায় ঘন্টি বাজে।


-------২ কার্তিক ১৪২৮
------২০----১০----২০২১



১১০.
হেমন্তের শিশির
ঘাসে ঘাসে শিশির
ভিজে আছে ধুলামাটি
আজ তেসরা কার্তিক।

ভোর
আবছা কুয়াশা
উড়ন্ত পাখি
সবজি বাড়ি।

কাকতাড়ুয়ার হাঁড়ি মুখ
গাছে গাছে বেগুন
ফুলকপির ক্ষেত
ছোট ছোট পালং পাতা।

ক্রমশ আলো
সাত রঙের কিরণ
পুবের হাওয়া
চুলা জ্বলে উঠল ঘরে।

শিশুর কান্না
শীত শীত কাঁথা কানি
দেয়ালে হেলানো সাইকেল
দূর পাহাড়ে রোদ

পাহাড়তলীর ঘরে আমি যাই।



১১১.
যখন যেখানে পারি হাত পাতি

আমার ছোট হাত
অনেক দূর না গেলেও
সময় সমাজের কাছে ভিক্ষা মাগে

আমি একইসঙ্গে ভালো ভিখারি মন্দ ভিখারি

আঁকাড়া চালের সঙ্গে অবজ্ঞা ও অপমান
আমার ঝুলিতে

আমার হাতে ঝরাপাতার সৌন্দর্য।


------৩ কার্তিক ১৪২৮
-----২১----১০----২০২১



১১২.
বুকে দুধ নাই তো কি হবে লো
ধানে দুধ এসেছে। কচি ধানের গন্ধে
থেমেও যাবে তোর নুনুর কান্না।

আমিও আবদার করি,
ভোরের শিশির চিবানো। কে আর মেটাবে
আমার আদর। আমি শুধু

হিমেল রাতে ওই গগনে দীপ জ্বালাই।


------৪ আশ্বিন ১৪২৮
------২২----১০-----২০২১



১১৩.
বট গাছে ফল পেকেছে

কে খাবেরে কে খাবে?

বট গাছে ফল পেকেছে

ফলের স্বাদ?
হাওয়া এসে বলবে আমাকে।
ফলের স্বাদ?
পাখি এসে বলবে আমাকে।


-------৫ কার্তিক ১৪২৮
-----২৩-----১০----২০২১
-------নির্মল হালদার





সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১

আমার মায়ের নাম মায়া







কোনো বন্ধুর লেখা অন্যদের পড়ানোর মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। আর, সে-লেখা যদি হয় এমন।
আসুন, আমরা সঙ্গী হই এক আশ্চর্য যাত্রাপথের।
(লেখাটির নাম আমার দেওয়া, নির্মলের অনুমতি না নিয়েই।)
.
.
আমার মায়ের নাম মায়া
.........
নির্মল হালদার
.
বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
আমার বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
কোনো গাড়ি নেই। গাড়ি বলতে বাস-ট্যাক্সি নেই।
বর যাচ্ছে গোরুর গাড়িতে।
বরের সঙ্গে একজন মুরুব্বি।
তিনি শুধু হুঁকো টেনে চলেছেন।
বর নাকের কাছে হাত রেখে হাওয়া করছে। হুঁকোর গন্ধ তার সয়না।
পুরুলিয়া থেকে মানবাজার অনেকটা রাস্তা। কাঁচা রাস্তা। এবড়োখেবড়ো। উঁচু-নিচু।
ঢিকির ঢিকির গোরুর গাড়ি চলেছে।
বেলা বারোটায় শুরু হয়েছে যাত্রা। এখন, বেলা পড়ে আসছে। গাছপালায় আলো-আঁধারের শেষ খেলা। আর বর চলেছে নতুন জীবনের দিকে।
শেয়াল ডেকে উঠলো।
আরেকটা গোরুর গাড়িতে আছে আমার দাদু শিবপ্রসাদ হালদার। সে বলছে, ভয় নেই রে, ভয় নেই। এ বরং শুভযাত্রা।
আমিও তো আছি গোরুর গাড়িতে। আমি বললাম-- শেয়ালের অভিনন্দনবার্তা।
আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এমন ভাবে লুকিয়ে আছি, আমার নিশ্বাসের শব্দ কেউ টের পায় না। আমি মজা করে, কয়েকবার বাবার পিঠে চিমটি কেটে দিই।
পিছন ফিরে দেখে, কেউ নেই।
কয়েকবারের পর বাবাকে বলতেই হলো-- পিঠে চিমটি কাটছে কে রে বাবা!
মুরুব্বি বলেন-- কে আবার, মশা।
আমি চুপিচুপি হাসি।
বাবার খিদে পায়। মুরুব্বিকে বলে। তিনি জানান, খাবি কী রে বাবা! আজ তো বিয়ের পরে খাওয়া। বাবাজি, আপাতত খিদে চেপে রাখো।
-- জল তো খেতে পাবো।
কিন্তু কোথায় জল?
মুরুব্বি হাঁক দেন-- 'ও খুড়া, বজেনের জলতেষ্টা পেয়েছে। কী করবো?'
আমার দাদু আরেক গাড়ি থেকে জানায়-- বাঁধ দেখলে দাঁড়াবি-ই-ই।
বাবার কপালে ঘাম।
আমি মুছিয়ে দিলাম, নিঃশব্দে। বাবা চারদিকে তাকিয়ে দেখে, কোথায় হাওয়া, কী হাওয়া।
যেটুকু হাওয়া বইছে, ঘাম মুছতে পারে না।
বাবা কী করে জানবে। আমার ছোট দুটো হাত, মুছে দিয়েছে বাবার ক্লান্তি।
বাবার মুখ শুকনো।
বাবার পরনে হাঁটুঅব্দি একটা ধুতি। একটা সাদা পাঞ্জাবি। বাবার পাশেই নামানো আছে টোপর।
সেও কখনো কখনো গরুর গাড়ির দুলুনিতে দুলে উঠছে। নাকি নেচে উঠছে খুশিতে?
গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে।
দুটো গাড়ি থেকেই সবাই নামলো। রাস্তার ধারে একটা পুকুর। অন্ধকার জল।
বরযাত্রীদের কে একজন বললো-- আগে হ্যাজাকটা জ্বালতে দাও, তারপর জলে নামবে।
আমিও নেমেছি। বাবার পিছনে পিছনে। বলা যায়, বাবার পাঞ্জাবি ধরে ধরে নেমেছি।
আমারও তেষ্টা পেয়েছে।
বাবার একবার মনে হলো, কেউ বোধহয় পিছন দিকে টানছে। পিছন ফিরে দেখে, কেউ নেই।
বাবা কোনো কথাও বলছে না। মুরুব্বি দাদুকে বলেন-- হ্যাঁগো খুড়া, তোমার ছেলে যে কোনো কথাই বলছে না। বরযাত্রীদের কে একজন বললো, নতুন বৌয়ের স্বপ্ন দেখছে। ওকে দেখতে দাও।
কী স্বপ্ন?
আমি জানতাম।
আমি জানতাম, স্বপ্ন নয়। বাবার মাথায় ঘুরছিল এক ভাবনা।
বিয়ে তো করছি, সংসার চালাতে পারবো? লোকের দোকানে চাল মেপে যেটুকু রোজকার, সংসার চলবে?
চলবে চলবে... পেঁচা ডেকে উঠলো। গাছে গাছে রাতের পাখিরা ডানা ঝাপটায়। জোনাকিরা উড়ে উড়ে বাবাকে শুভ বার্তা জানায়। প্রতিটি রাস্তায় ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, আজ যেন প্রকৃতির শঙ্খধ্বনি।
আমার বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
আর কত দূর?
কত দূর?
এইতো এসে গেলাম, এসে গেলাম...।
দুটো গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে যায়। বর ও বরযাত্রীরা নেমে পড়ে। দাদুর নির্দেশ, সবাই চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবে। বিয়ে তো শেষ রাতে। আর কনের ঘর কি দেবে না দেবে, দাদু কিছুই জানে না।
চিঁড়ের সঙ্গে মিঠাই ছিল, আমিও পেয়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে।
আমার খিদের কথা কেউ জানে না। আরও কত খিদে, কেউ জানে না।
রাত হয়ে গেল মানবাজার পৌঁছোতে। কুণ্ডুঘরে বেজে উঠলো শাঁখ।
এয়োতিরা পিতল কলসির জল গোরুর গাড়ির চাকায় ঢালে। সবাই বরের মুখ দেখে বলে-- কী সুন্দর মুখ গো! আমাদের মেয়েটা সুখ পাবে গো সুখ পাবে।
বাবার মুখ নীচু।
মুরুব্বি পরিয়ে দেন টোপর।
আমার দিদিমা বাবাকে বরণ করে। মিষ্টিমুখ করায়।
আর আমি দিদিমার খুঁটে-বাঁধা পান খুলে ফেলে দিই।
বাজনা বাজছে।
আমার মামাবাড়িতে দুর্গা মন্দির আছে। দাদু বাবাকে বললো-- যা মন্দিরে গিয়ে প্রণাম কর।
সেই ফাঁকে আমি চলে গেছি মায়ের কাছে। মা বসে আছে সেজেগুজে।
মা না, এক বালিকা।
বারো বছর বয়স।
লাল রঙা এক ফিনফিনে শাড়িতে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মা।
ভয় মেশানো মুখ। মা ভাবছিল-- কোথায় যাবে, কী করবে, কাদের পাবে শ্বশুরবাড়িতে। শেষ হয়ে গেল খেলনাবাটি খেলা। এক্কাদোক্কা। লুকোচুরি। পুকুরে সাঁতার। দুর্গা মন্দিরে খড়ের কাঠামোর পিছনে লুকিয়ে থাকার মজা, শেষ হলো।
ছল ছল করছে মায়ের মুখ।
তখনই আমি ঝপাং করে মায়ের কোলে। মা ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে আমাকে দেখে। বলে-- 'তুই এখুনি এলি! তোর তো অনেক দেরি আছে। এখন যা, পালিয়ে যা! যেন কেউ দেখতে না পায়। তোর বাবা দেখতে পায়নি তো?'
বলে-- 'তোর আসতে দেরি আছে সোনা... তুই যা।'
-- আচ্ছা, যাবো যাবো। তার আগে আমাকে একটা হামি দাও। আর বলো, তোমার নামটা কী?
-- তুই তো জানিস...
-- তোমার মুখে শুনতে চাই।
-- আমার... আমার নাম মায়া।

(১৭-১০-১৯)


একরাম আলি র দেওয়াল থেকে 🙏







শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২১

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি
































বদলি হয়ে যাওয়া // নির্মল হালদার

বদলি হয়ে যাওয়া // নির্মল হালদার




সুব্রত স্যার ক্লাস সেভেনের ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন--------তোরা আমাকে স্যার স্যার করবিনা। সবাই দাদা বলবি।
সুব্রত স্যার ক্লাস সেভেনের ক্লাস টিচার। অঙ্ক পড়ান।

এক ছাত্রী বলেছিল-------স্যার
অন্য মাস্টারমশাইদের দাদা বললে
রাগ করবেন না তো?
সুব্রত স্যার উত্তরে বলেছিলেন------রাগ করতেই পারেন।
আবার না করতেও পারেন। আমি শুধু বলছি, আমি রাগ করবো না।

এই সুব্রত স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের বলেছিলেন-------তোরা সবাই একটা খাতায় আমাকে লিখে দিস, কবে কার জন্মদিন।
ছাত্র-ছাত্রীরা একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল-------কেন স্যার?
সঙ্গে সঙ্গে সুব্রত স্যার-------আবার স্যার? দাদা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোদের?

হেসে ফেলে ছিল সবাই। বলেছিল-----
আর হবে না দাদা।

সুব্রত স্যার মনে করেন, তিনি কখনোই
কোনো সরকারি দপ্তরের চেয়ারে বসে নেই। এবং তার অধীনে ছাত্রছাত্রীরা নেই। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা কেন বলবে, স্যার?

বরং ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে দাদা শুনতে মধুর লাগে। সেখানে স্যার শব্দটি শুনলেই মনে হয়, হাতে একটা ছড়ি আছে। যিনি শাসন করতে পছন্দ করেন। 

সুব্রত মুখোপাধ্যায় স্যার কোনো ভাবেই নন। তিনি সর্বদাই কাছের মানুষ। তাই টিফিন পিরিয়ডে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গাছপালা চিনতে যান। ছাত্র-ছাত্রীরা যা চেনে, তাদের সুব্রতদা কে চিনিয়ে দেয়। সুব্রতদা যা চেনেন ছাত্র-ছাত্রীদের চিনিয়ে দেন। পারস্পরিক এক লেনদেনের মাধ্যমে
কাছাকাছি চলে আসার একটা সুযোগ। তার সঙ্গে অচেনাকে চিনে নেওয়া। 

এই সুব্রতদা প্রতিমাসেই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্মদিন উদযাপন করে থাকেন। তিনি তো ক্লাস সেভেন থেকে টেন অব্দি পড়ান।তো সব ক্লাসের  ছাত্র ছাত্রীদের জন্মদিন উদযাপন করে থাকেন।

কিছুই না, সুব্রত দা নিজে যেকোনো একটা ফুল ছাত্র বা ছাত্রীর হাতে দিয়ে
একটি চকলেট খাইয়ে দেন। মনে মনে উচ্চারণ করেন, কল্যাণ হোক। জন্মদিন শুভ হোক।

ছাত্র বা ছাত্রী প্রণাম করে।


অঙ্কেও পারদর্শী।

ছাত্র বা ছাত্রী একবার না পারলে,
বারবার বুঝিয়ে দেবেন। তাও না পারলে সুব্রতদা বলেন-------টিফিনে আবার তোর কাছেই তোর জন্যেই আসবো। শেষ অবধি দেখা গেছে, অঙ্কে কাঁচা ছাত্র বা ছাত্রী পাকা হয়ে উঠেছে। 

সুব্রতদার জন্যেই সরস্বতী পুজোতে
প্রতিবছর নাটক। সে বছর রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর করেছিল ক্লাস নাইনের ছাত্র ছাত্রীরা। যে ছেলেটি অমল করেছিল, সে পুরস্কার পেয়েছিল অনেক।
আড়াল থেকে সুব্রতদা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছিলেন।

সুব্রতদার জন্যেই পিকনিক। সুব্রতদা যদিও পিকনিক শব্দটি পছন্দ করতেন না।
বলতেন বনভোজন। চেষ্টাও করতেন,
কোনো না কোনো জঙ্গলের দিকে যাওয়া। কারণ, ছাত্রছাত্রীরা তাহলে জঙ্গলের মর্ম বুঝবে।

আর বনভোজন মানেই, শুরু থেকে শেষ অব্দি রবীন্দ্র সংগীত। ছাত্র-ছাত্রীরা না গাইলে সুব্রতদা একা একা গান করবেন ।

এই সুব্রতদাকে হঠাৎ স্কুলে আর দেখা যাচ্ছে না। ছাত্র-ছাত্রীরা জানতেই পারছেনা, সুব্রতদা স্কুলে কেন নেই?

ক্লাস টেনের অনিরুদ্ধ সঠিক তথ্যটাও
নিয়ে আসতে পারলোনা। সে জানেনা
সুব্রতদা বাড়ির কাছাকাছি  অন্য একটি স্কুলে বদলি নিয়েছেন। যাবতীয় ভালোবাসা ত্যাগ করে অনিরুদ্ধদের স্কুল থেকে চলে গেছেন।

প্রিয় সুব্রতদা চলে গেছেন। 

এই সত্যটুকু ছাত্র-ছাত্রীরা যখন জানতে পারলো, তখন ছল ছল করেছিল অনেকের বুক। আর মিত্রার মনে পড়ছিল, সুব্রতদা তাকে উপহার দিয়েছিলেন--------পথের পাঁচালী।
আর গীতাঞ্জলি।

মিত্রা মনে মনে তার প্রিয় মাস্টারমশাই কে একটা চিঠি লিখলো---------

প্রিয় সুব্রতদা
আপনি খুব খারাপ। খুব খারাপ মানুষ।
আমি দেখবো, আপনি আমাদের ছেড়ে থাকেন কি করে! কেননা, আপনার লাগানো আমগাছটা আমাদের সঙ্গেই স্কুলে থাকছে প্রতিদিন ।



-----১২ আশ্বিন ১৪২৮
----২৯----৯----২০২১






আমার পরিবারের একজন // নির্মল হালদার

আমার পরিবারের একজন // নির্মল হালদার




এক প্যাকেট বিস্কুট দিয়ে থাকি।
সকালবেলা।
সিঁড়ির গেট খোলার শব্দ পেলে
কুকুরটা বুঝে যায়, আমি উপর থেকে নামছি। সে আমার দিকে চেয়ে থাকে।

একেক দিন বিস্কুট নিয়ে নামতে আমি ভুলে যাই। আবার উপরে উঠি। বিস্কুট নিয়ে নামি। কুকুরটার সামনে বিস্কুট ভেঙে-ভেঙে ছড়িয়ে দিই।

আজও তাই করলাম। কিন্তু কুকুরটা
একটুও খেলো না। আমি ভাবছি, কী হলো? শরীর--টরির খারাপ নাকি? নাকি মন খারাপ?

মুখটাও করুণ লাগছে। কী হয়েছে তার? কিভাবে জানতে পারবো,
ওরভেতরের কথা?

আমি ডাকলাম-------আয়রে-------
খেয়ে যা। খেয়ে যা-------। তার কোনো
হেলদোল নেই। একবার এদিকে বসছে। আরেকবার ওদিকে। সিঁড়িতে উঠে এসেও বসলো। কিন্তু বিস্কুটের একটুকরোও ছুঁয়ে দেখলো না।


শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, কুকুরটা গর্ভবতী। দেখতে পাচ্ছো না?
কে? কে বলছো?

সামনে-পিছনে তাকিয়ে দেখি, কেউ নেই। আবার শুনতে পেলাম, কে যেন
বলছে, কুকুরটা আসন্ন প্রসবা। ওকে
চুপচাপ থাকতে দাও। ওকে বিরক্ত করো না।

চারদিক তাকিয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই। কুকুরটা একা। আর আমি কুকুরটার জন্য বিচলিত বোধ করছি।

একবার ভাবলাম, রুটির টুকরো দিলে
কুকুরটা খাবে। রুটি কই?
আরেকবার ভাবলাম, এই সকাল বেলা মেঘ করেছে বলে, কুকুরটা বিষণ্ণ হয়ে আছে।

যেহেতু প্রকৃতির সঙ্গে সমস্ত প্রাণীর যোগ আছে।

আমার সঙ্গে যোগ নেই?
আমি যে অন্তর থেকে চাইছি,
কুকুরটা বিস্কুট খেয়ে নিক।
আমি শান্তি পাবো।

আমার সকালের যে শুরু এই বিস্কুট দিয়ে। আমার সকালের যে শুরু কুকুরের সঙ্গে  মনের দুটো কথা বলে। জানিস তো, বাপি অনেকদিন নেই। বাড়িতেই আছে।তার টাইফয়েড হয়েছে। এখন তুই যদি না খেয়ে থাকিস, আমার কি হবে?

তোর বাচ্চা এলে আমার ভালোই লাগবে। ওরা আসুক। আমি আনন্দ করবো নিজের মধ্যে।

কিন্তু আজ কুকুরটা একদম মন মরা।
নড়েচড়ে উঠছে না।
তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে
আমি স্নান করলাম।
এবার চায়ের দিকে যাবো।


আমি হাঁটছি। 

দেখি, আমার পিছনে কুকুরটা।
আমি তাকে বললাম, সামনে চলে আয়।
এর আগে কখনো কুকুরটা আমার সঙ্গে কোথাও যায়নি। এই প্রথম।
আমার ভালো লাগছে।

চায়ের দোকানে আমি দাঁড়াতেই সেও
দাঁড়ালো। আমি একটা বিস্কুট নিয়ে
তাকেও একটা বিস্কুট দিলাম। এখানেও একই রকম ব্যবহার-------
কুকুরটা বিস্কুট খেলোনা।

-------১১ আশ্বিন ১৪২৮
------২৮----৯----২০২১





পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার




৮৭.
পাতা--পুতা জ্বালিয়ে কচু শাক সেদ্ধ।
আটাও গুলবে বসুমতী। আর ছেলেকে দিয়ে বলবে:
খা বেটা খা-----------পেটটা থিরাবে।


৮৮.
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।

বাঁশ ঝাড় থেকে মুরগি দেখলো,
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।
পুকুর থেকে হাঁস উঠতে উঠতে দেখলো,
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।
ঘরে ফিরতে ফিরতে কাক থমকে দেখলো,
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।

অনেক দূরের মেলা অনেক আলো
হাওয়াই লাড্ডু নাগরদোলা।
অনেক দূরের মেলা অনেক আলো
বেলুন উড়ছে কাঠের পুতুল।
অনেক দূরের মেলা অনেক আলো
কথা বলা পাখি খেলনা গাড়ি।

আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে লাউ ফুল দেখলো,
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।
রঙ ছড়াতে ছড়াতে গোধূলি দেখলো,
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।
লাফাতে লাফাতে কাঠবিড়ালি দেখলো,
বাবার হাত ধরে ছেলে মেলা দেখতে যায়।

মেলার ভিড়, ভিড়ের ভয়
বাবা ছেলের হাত ছাড়ছেনা।


------১১ আশ্বিন ১৪২৮
-----২৮-----৯-----২০২১



৮৯.
সারারাত বৃষ্টি।


সকাল থেকেই বৃষ্টি।

ঘরের ছেঁদা চালা থেকে জল পড়ছে।
জাম বাটি পাতোরে
গামলা পাতো,জল ধরো।
মাথা বাঁচাও কাঁথা বাঁচাও।

ছেলেটাও কাঁদছে

চোখের জলও ধরে রাখি
আদরে আদরে।



৯০.
নুন ছাড়া এক দন্ড চলছে না আমার।
নুনের মতো আত্মীয় কে আর আছে!
নুনের সম্পর্ক থেকেই গুণ পেয়েছি,
গাছ থেকে ঘাস ভালোবেসে যাওয়া

শুধু ভালোবেসে যাওয়া

শিশির বিন্দু থেকে বৃষ্টির ফোঁটা
খরগোশের ছুটে যাওয়া থেকে
ঝড়ের ছুটে যাওয়া, সবই তো আমার
সমস্তই দু হাতে

আমার ঘামের নুনে মিলে মিশে আছে।


------১২ আশ্বিন ১৪২৮
----২৯-----৯----২০২১



৯১.
চাল সিজাই জনার সিজাই
কে কী খাবি বলরে নুনুরা?
আমিতো কামে যাবো,
আমার আসতে বেলা ডুবু।

তোরা তো খেলে বেড়াবি।
আমার কথা মনেই পড়বেনা।
আমারই মন পড়ে থাকবে
তোদের দিকে------

তোদের খিদার দিকে।


------১৪ আশ্বিন ১৪২৮
-----১----১০----২০২১



৯২.
কাঁঠাল গাছ
থৈ থৈ করছে রোদ
আশ্বিনের দিন
পদ্ম ফুটছে পুকুরে

শালুকও আছে
পদ্মপাতায় ফড়িঙ
পানকৌড়ি
বক উড়ছে

শাদা মেঘ উড়ছে
আকাশের নীল
অপরাজিতার নীল
আমারই দিকে

আমাকে কে পাঠালো?
আমাকে ভালবাসছে কে?
বেলা যে হলো
আমার যাওয়া কত দূরের?

গাছে গাছে পাতা নড়ে
পথে পথে পথচারী
চোখের আলো
আমার মুখে এসে পড়ে

কোন্ দিকে যাবো, কার কাছে?



৯৩.
সুখ বলো আর দুখ বলো
দুদিন বৈ তো নয়, শুধু
প্রেম পিরিতি থেকে যায় বুকে
লাঙ্গলের দাগের মত।

অনন্তকালের নাঙ্গল
সেই জানে, মাটির গভীরে
শিকড়ের সুর।

অনন্তকালের শিকড়
সেও জানে, পিরিতির সুখ।


------১৮ আশ্বিন ১৪২৮
-----৫-----১০----২০২১



৯৪.
আমাকে ধমক দেবার মত
আর কেউ রইলো না।
এক দাদা ছিল সেও গেল চলে।
আমি ভুল করলে
কে আর শাসন করবে? কে আর
বকুনি দেবে আমি ভুল পথে হাঁটলে?


সব রাস্তা পড়ে রইলো।

আমিও একা একা আর যাব না
পাখি ধরতে। কেননা, আকাশের মত
অভিভাবক আছে এই ভয়ে।



৯৫.
কাশবন
উড়ছে কাশের রেণু
আশ্বিনের ধানক্ষেত
ধান ফুল।

ধান ফুল
আগামীর সম্ভাবনা
আগামীর সম্পদ
মাটির সৌন্দর্য।

রক্ষা করে
আলো করে
গোলা ভরা ভালোবাসা
খড়ের আঁটির বাঁধন ।

বন্ধন, পায়রার পাখায়
মুক্তি, পায়রার পাখায়
পায়রা এসেছে
শালিক এসেছে।


মানুষ এসেছে
একটা মানুষ এক পৃথিবী
আবছায়া অস্পষ্ট
স্পষ্ট হয়েও যায়।

জন্ম আর মৃত্যুতে।


------২০ আশ্বিন ১৪২৮
-----৭----১০-----২০২১


৯৬.
মুখের বিড়িটা ছুঁড়ে দিয়ে
হারু খুড়া বলে, কিসে কি আছে রে
আজ মরলে কাল দুদিন--------
আমি তাই উপর দিকে চেয়ে আছি,
যদি নতুন তারার জন্ম দেখতে পাই।

আলো দেখতে পাই।



৯৭.
আমরা চার ভাই চারটে গাছ
তিনটে গাছ উড়ে গেলে, আমি একটা ভাই
খুদকুঁড়ো খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে খুঁটে খাই।

নিজেকে ছিঁড়েখুঁড়েও খুঁজি
যদি দাদাদের দেখতে পাই, যদি হাত পেতে বলতে পারি,
দে আমাকে আদর দে।


------২১ আশ্বিন ১৪২৮
-----৮-----১০----২০২১



৯৮.
ঝুড়ি--ঝাঁটা বিক্রি করে কি দিন চলে?
হাতে--পায়ে খাটতে হয়।
বাজার যাই,কাজ খুঁজি।আর
কাজের পিছনে দৌড়ে দৌড়ে
দেড়শ টাকার মজুরি।

বাঁশের দামও বেড়েছে, কি করে শুনবে আর
বাঁশির মাধুরী।


-----২২ আশ্বিন ১৪২৮
-----৯----১০----২০২১



৯৯.
কার দোকানে যাব? কাদের দোকানে?

সারি সারি মনোহারি গোলদারি
সারি সারি চালেরও দোকান
কোথায় কি দর আমার জানা নেই।
আমি দেখছি খদ্দেরের ভিড়
আমি শুনছি টাকা-পয়সার ঝমঝম।


হাসি মুখ মলিন মুখ।


আমিও যে বুকের ঝাঁপ খুলে অপেক্ষায় আছি,
কখন আসবে বিনে পয়সার খদ্দের।



১০০.
কী চাইতে পারি আর?

বট গাছের ঝুরি ধরে দোল খায় ছোটরা
বটফলও দুলছে
গাছের মাথায় রোদ
বট পাতার চিকন

কী চাইতে পারি আর?

শিকড়ের চেয়ে থাকা
উঁচু-নিচু মাটি
পিঁপড়ের বাসা
পোকাদের ওঠানামা

কী চাইতে পারি আর?

বট গাছের ডালে ডালে কাঠবিড়ালি
বটের ছায়ায় একটা লোক
মলিন ধুলো
রাস্তা চলে যায়

কী চাইতে পারি আর?

বটের পিছনে দীঘি
পাতা ভাসে একটি দুটি
ঢেউ ওঠে ছোট ছোট
জলের ভিতরে জল

আমার মুঠিতে ধরবেনা।


-----২৩ আশ্বিন ১৪২৮
দুর্গা পঞ্চমী।
-----১০----১০----২০২১



১০১.
কৃষ্ণ নামে অভাব ঘুচবে গো
যদি কৃষ্ণের সঙ্গে ভাব করো।
কৃষ্ণ একমাত্র সুখ
কৃষ্ণ একমাত্র সখা
সুর জানে সৌরভ জানে।
ভালোবাসার ভাত জানে
আর জানে
বৃক্ষের শতনাম।

গাছের নামেও অভাব ঘুচবে গো
যদি গাছের সঙ্গে ভাব করো।


১০২.
আগে রসিক হও
তারপর খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধবে।
হাঁড়ি না পেলে
খেজুর গাছে বুক বাঁধবে।

টলমল করবে রসে।

রসে বশেই রসিকা, রাধা নাম খুঁজে পাবে।


------২৪ আশ্বিন ১৪২৮ / দুর্গা ষষ্ঠী
----১১----১০----২০২১
------নির্মল হালদার





কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ