মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২১

বেঁচে থাকার রাস্তা / নির্মল হালদার




বেঁচে থাকার রাস্তা / নির্মল হালদার



খুশিয়ালকে দেখে মনে হলো,
গাছতলা থেকে ওঠার জন্য ছটফট করছে। ওর কি জল তেষ্টা পেয়েছে?
ওর কি খিদে পেয়েছে?

আমি খুশিয়ালের সামনে কিছু পাতপালা এনে দিলাম। সে মুখে নেয় না। বুঝতে পারলাম, তার খিদে পায়নি। তারপর তাকে একটা পুকুরের কাছে নিয়ে গেলাম। সে জলেও মুখ দিলো না। সে চেয়ে রইলো পাহাড়ের দিকে।

পাহাড়ের ওপারেই শহর। বাজার হাট।
হাসপাতাল। গ্রাম থেকে যেতে হলে পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয়। মানুষকে কষ্ট করতে হয়। মরণাপন্ন রোগীকে নিয়ে যেতে হলে বেশি যন্ত্রণা।

গাঁয়ের এক মুরুব্বি বলছিল, পাহাড় ভেঙ্গে দাও। নইলে, মানুষের যন্ত্রণার শেষ থাকবে না। আমি বলি , পাহাড় ভাঙবো না। একটি পাহাড়ও ভাঙবো না।

খুশিয়ালকে বলেছি, সে যদি এক একটা পাহাড় পিঠে করে নিয়ে যায় আর নামিয়ে রাখে অন্য জায়গায়, তাহলে বেশ হয়।

পাহাড় তো আমাদের সম্পদ।

আমি অন্তত সম্পদের ক্ষতি করতে চাইনা। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই খুশিয়াল একমত হবে।


আজ খুশিয়ালকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
ঘরে ফিরলাম।

সন্ধ্যে হয়ে গেছে। একটানা ডেকেই চলেছে ঝিঁঝিঁ পোকারা।

দিনের বেলা আলু সেদ্ধ ভাত খেয়েছি।
তারই অবশিষ্ট কিছু আছে। তা দিয়ে দিলাম খুশিয়ালকে। আমি নিজে এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।


খুশিয়াল গাধা হলেও সমস্তই বোঝে।

সে বুঝে গেছে ঘুম পেয়েছে আমার।

সেও চোখ মুদলো।

আমারতো ভোরেই ঘুম ভাঙ্গে।
ঘুম ভাঙতেই মনে পড়লো, পাহাড়গুলো অন্যত্র সরাতে হবে।
মানুষের জন্য শহরে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করতে হবে।

স্কুল-কলেজও শহরে।

খুশিয়ালকে বললাম, চল্ তবে পাহাড়ের কাছে। আজ সারাদিন তুই আর আমি একটার পর একটা পাহাড় অন্য কোনোখানে বসাবো।

কোনো ক্ষতি না করে পাহাড়কে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সুখ-সুবিধা করতে হবে।

প্রথমেই ছোট ছোট ডুংরি গুলি
খুশিয়ালের পিঠে চাপাই। সে ধীরগতিতে গেলেও আমার সঙ্গে যায় গ্রামের শেষে। মাঠের একপাশে।

ডুংরি গুলি সমস্ত নামিয়ে
বড় পাহাড়ের কাছে যাই। প্রণাম করি।
তারপর পাহাড় ওঠাই। খুশিয়ালের পিঠে রাখি।
তার আগে অবশ্যই খুশিয়ালকে
জল খাইয়েছি। পাতপালা খাইয়েছি।
সে যেন আমার কাছে কোনো অভিযোগ না করে।


পরপর ডুংরি গুলি সাজিয়ে পাহাড়টা সাজিয়ে বেশ লাগছে। ওদিকে শহরে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি।

খুশিয়াল যে এত কষ্ট করলো এজন্য
ওকে একটা আম পাতার মুকুট পরাতে হবে।


-------৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
------২০----১১----২০২১
------নির্মল হালদার





যাচ্ছেতাই / নির্মল হালদার




যাচ্ছেতাই / নির্মল হালদার


কাক এসে বললো, পায়রার সঙ্গে দেখা হয় না আজকাল। শালিখ এসে বললো,চড়ুইয়ের সঙ্গে দেখা হয় না আজকাল।

কার সঙ্গে কার দেখা হয়?

বটের সঙ্গে অশথের দেখা হয়?

একই সঙ্গে দুটি ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দেখা হয় কি?
একই সঙ্গে দুটি লোক পাশাপাশি হাঁটছে। দেখা হয় কি?

কাক এসে আরও বললো, সে তো
অনেক অনেক ঘরেই উঁকি দেয়। এবং দেখে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।
কেউ কেউ আলস্য করছে। অথবা
ঘাঁটাঘাঁটি করছে মোবাইল।

সেদিন একটা গাছের সঙ্গে দেখা হলো আমার। আমি কোনো খবর নিলাম না। সে কেমন আছে জল হাওয়া পাচ্ছে কিনা, খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না।

যেতে যেতে একটা নতুন রাস্তায় এসে পড়লাম। কত দূরে থাকো, কেমন আছো জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

ভুলে গেলাম নাকি এই আমার স্বভাব?

নতুনের সঙ্গেওতো নতুন করে পরিচয়ের প্রয়োজন আছে। ভালো থাকা না থাকা নিয়েও কথা বলার দরকার আছে।

যে দু'জনের সঙ্গে থাকি তাদের সঙ্গেও
কথা বলি না। মনে হয়, কথা নেই।
কোনো কথা নেই। তারাও আমার সঙ্গে
কথা বলে না। অথচ একই সঙ্গে আছি।

দুটো কুকুর সকাল থেকে এসে বসে থাকে আমাদের গলিতে। তাদের সঙ্গেও আমার কথা বলা হয় না। 
ভাবি কিইবা কথা বলবো।

কাকটা আমার মনের কাছে এসে
কা--কা করে উঠলো। অর্থাৎ বলতে চাইছে------আমিও অযোগ্য।

গাছ কথা বলে গাছের সঙ্গে। নীরবে।

আমার নীরব কথাও নেই।

 বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে মনের কথা
বলতে পারি কই? বাতাসের সঙ্গে
সব সময় দেখা হয়। একটাও কথা বলি না।

তবে  কি আমার কথা নেই?

সেদিন  হিল্লোল বলছিল, সে নাকি
এক কাপ চায়ে এক ঘণ্টা কাটাতে পারে। তার মানে, সে নিশ্চয়ই চায়ের সঙ্গে কথা বলে?

কী কথা?

আমার কথারা কী ফুরিয়ে গেল?

আমার আবেগ আমার অনুভূতি কিছুই কি নেই? আমার সংবেদনশীলতা কোথায় গেল?

অনেকদিন হয়েছে রাত্রিবেলায় আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছি।
কোনো তারার কাছে কোনো প্রশ্ন করিনি।

কথা থাকলেই তো প্রশ্ন থাকে।
কৌতুহল থাকে। আমি কি হারিয়ে ফেললাম? একদিন শুধু আকাশকে বলেছি, তুমি অনন্ত বলেই, আমি ক্ষুদ্র। শুধু এইটুকু কথা।
তারপর আকাশ কিছু বলতে চাইছিল।
আমি শুনিনি।
তালগাছের কাছেও নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। কেন মনে হয়? নিজেকে আর প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন করলেই তো কথা। কথার পরে কথা।

আমার কথা নেই।

আমার সঙ্গে কারুর দেখা হবে না।

টিয়ার সঙ্গে ময়নার না দেখা হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখাই তো হচ্ছে না। 
কথাই তো হচ্ছে না।

রামানুজ বলছিল, তাকে যেন চিঠি লিখি। কিন্তু কোনো কথা নেই আমার।
একটা চিঠি লিখতে গেলে কথার দরকার পড়ে।
রামানুজকে লেখার মত বলবার মতো কথা নেই আমার।

ব্যর্থতা কিংবা সফলতা আমার নেই।
যা নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়।

শুধু অপমান আছে। যা বলতে গেলেও
অপমান সামনে দাঁড়ায়। আমি ভয় করি। তাই অপমান অবজ্ঞার কথা বলতে চাই না।

প্রেমে প্রত্যাখ্যান আমার জীবনে নেই।
যা নিয়েও সাতকাহন করা যায়। কেবল প্রেম আছে চোরা স্রোতের মতো।তা নিয়ে কি আর বলবো? চুপচাপ থাকি।

আমার জীবনে নৈঃশব্দ নেই। নীরবতা নেই। শুধু চুপচাপ থাকা। চুপচাপ থাকার সঙ্গে নৈঃশব্দের সম্পর্ক নেই। নীরবতার সম্পর্ক নেই।

এ কারণেই, নীরবতার সঙ্গেও আমার কথা হয় না।

একটা পাতা চেয়ে থাকে আরেকটা পাতার দিকে। চেয়ে চেয়ে বিনিময় করে নিজেদের সুখ-দুঃখ।

আমিতো চেয়ে থাকি না আলো অন্ধকারের দিকেও।

প্রজাপতি গাছে বসলো মানেই, ফুলের সঙ্গে কথা বলছে। মৌমাছি গাছে বসল মানেই, ফুলের মধুর সঙ্গে কথা বলছে।

কতবার যে ভেবেছি, নিজেকে হত্যা করবো। পারিনি। কেননা, নিজেকে হত্যা করার আগে নিজের সঙ্গে কথা থাকে।

আমি তো নিজের সঙ্গেও কথা বলতে পাচ্ছিনা। আমাকে চলে যেতেই হবে, সমুদ্রের কাছে।

একটার পর একটা ঢেউ আসবে
আমাকে কথা বলাবার জন্য। আমি কথা বলতে বাধ্য হবো।

নিজেকে দেখতে পাবো অনেক অনেকদিন পর।


তারপরেও একটা কিন্তু আছে, সমুদ্রের কাছে যেতে পারবো কি?  


------২৬ কার্তিক ১৪২৮
-----১৩-----১১----২০২১
-----নির্মল হালদার





সোমবার, ২২ নভেম্বর, ২০২১

পাহাড়তলির মাঠ / নির্মল হালদার




পাহাড়তলির মাঠ / নির্মল হালদার


৬৩.
পাথরের গায়ে গা লাগিয়ে আরেকটি পাথর

পাথরের গায়ে গা লাগিয়ে একটু মাটি।

আর মাটি ফুঁড়ে একটি বুনোলতা।

একটি বুনোফুল।

সূর্যের কিরণ এসে পড়ে।


৬৪.
পাকা বেলের কাছে এসেও ফিরে গেছে পাখি।

বেল গাছটি দাঁড়িয়ে আছে একা।

পাকা বেলের কাছে এসেও ফিরে গেছে পাখি।

বেল গাছটি নির্জন, একা।

বেলের ভিতরে বীজও একা।

একাকী সুন্দর।


৬৫.
প্রজাপতির পাখায় আকাশের ওড়াউড়ি।

আকাশ চিত্র-বিচিত্র আকাশ এক প্রাণ।

আকাশের পাখায় মেঘের ওড়াউড়ি।

মেঘ চিত্র-বিচিত্র মেঘও এক প্রাণ।

মেঘের পাখায় হাওয়ার ওড়াউড়ি।

হাওয়া চিত্র-বিচিত্র হাওয়া এক প্রাণ।


------৩০ কার্তিক ১৪২৮
-----১৭----১১----২০২১


৬৬.
ইঁট চাপা পড়েছে ঘাস।

ইঁটের তলা দিয়ে আলো ঢুকলেও
ঘাস মাথা তুলতে পারেনা।

ঘাস মাথা তুলতে পারেনা।

ইঁট চাপা পড়েছে ঘাস।

ঘাসের সবুজ।

গুমরে ওঠে ঘাস বীজের কান্না।


৬৭.
মাঠের মাঝে একটা উই ঢিবি
তারপাশেই পিঁপড়ের রাস্তা।
কে কোথায় যায় কতদূর যায়
কোথায় বা পান করে জল?

মাঠের মাঝে একটা উই ঢিবি
তারপাশেই ঘাসের আস্তানা।
কে কখন মাথা তুলছে কত উপরে
কী করেই বা পান করে জল?


৬৮.
শালের ছায়া পড়ছে শিমুলের গায়ে।

শিমুলের ছায়া পড়ছে শালের গায়ে।

দুজন দুজনের ছায়া চেনে।

দুজনেই দুজনের অন্তরঙ্গ শিকড়ে শিকড়ে।

দুজনেই পাখির বাসায় ডিমে দেয় তা।


------১ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
------১৮-----১১----২০২১



৬৯.
ডালিম ফুলের রঙ ছুঁয়ে যায় মাটি

কবে আসবে ডালিম?

ডালিমের দানা গুলি হৃৎপিণ্ডের টুকরো

কবে আসবে ডালিম?

হৃৎপিণ্ড ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি সূর্যকে ছোঁবো



৭০.
আমলকি পড়তেই গড়িয়ে পড়লো ধূলায়

কে রচনা করেছে ধূলা?

কে রচনা করেছে ধুলা মাটি?

আমলকি পড়তেই ধুলা মাটির আলোয় 

কে রচনা করে আলো ?

আমলকি আলোর এক কণা।


------২ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
------১৯-----১১----২০২১



৭১.
থোকা থোকা ডুমুর
একটি একটি ধূলাতে পড়ে ধূলাতে গড়ায়
একটি একটি থেৎলে যায়

তার অজস্র বীজ চেয়ে থাকে আমারও দিকে

আমি মাটি নই।



৭২.
ধানে পোকা এসেছে।

ধানের আলো কামড়ে কোথায় যাবে পোকারা?
ধানের আঁধার কামড়ে কোথায় যাবে পোকারা?

ধানে পোকা এসেছে।

পোকাদের সঙ্গে কথা বলছে হাওয়া,
ধান কাটার পরে কোথায় যাবে পোকারা?
পোকাদের সঙ্গে কথা বলছে ভিজে মাটি,
ধান কাটার পরে কোথায় যাবে পোকারা?

ধানক্ষেতে মেঠো ইঁদুরের মত মেঘ ছুটছে।



৭৩.
তেঁতুল পাতা ঝিরিঝিরি
আম পাতার সুর
কে পাতবে হাত?
কে পাতবে বুক?

বটগাছের উঁচু-নিচু হাওয়া
নিম গাছের মধুর বাতাস
কে পাতবে মাথা?
কে খুলবে দুয়ার?

পাতা কুড়ানির মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা।


-----৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
----২০-----১১-----২০২১



৭৪.
ফেলে যাওয়া পালক ঠোঁটে তুলে 
নিজের বাসাতে সাজায়।

একটি কাক।

একটি কাকের এই ভূমিকায় আরেকটি কাক
নিজের পালক ফেলে গেলে

আবার ঠোঁটে তুলে নিজের বাসাতে সাজায়

নিজের বাসায় খড়কুটো কম পড়েছে।



৭৫.
শালিখের পাশে চড়ুই

ফুল নেই ফল নেই

শুধু মেঘের আসা যাওয়া

শুধু কুয়াশা

শালিখের পাশে চড়ুই

কোনো কথা নেই

শালিখের পাশে চড়ুই পাখা মেলবে

চড়ুইয়ের পাশে শালিখ পাখা মেলবে

ছায়ায় ছায়ায়  ঢেকে ফেলবে আমাকে।



৭৬.
একটি পায়রা আরেকটি পায়রার পাশে

নীরবে। নিস্তব্ধতায়।

একটি পায়রা আরেকটি পায়রার পাশে

রৌদ্র ছায়ায়।

একটি পায়রা আরেকটি পায়রার মুখে আহার বাটছে।

আহারের আলো বাটছে।


-------৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
-----২১-----১১-----২০২১



৭৭.
কোত্থেকে ছায়া পাড়বে রাখাল?

পাখির পাখার ছায়া মাঠে নামে না।

কোত্থেকে ছায়া পাড়বে রাখাল?

মনের ছায়াও মাঠে নামে না।

মাটি দু ফাঁক হলে রাখাল ঢুকে পড়বে গর্তে

ভূমির শীতলতায়।



৭৮.
পাশাপাশি দুটি জানলা
যেন দুই বোন।
চেয়ে থাকে রাস্তার দিকে।

পাশাপাশি দুটি জানলা
যেন দুই বোন।
চেয়ে থাকে হাওয়ার দিকে।

একবারও চেয়ে দেখেনা দরজার মুখ।



৭৯.
রোদের পাশে এসে দাঁড়ালো রোদ।

শিশুর মতো সহজ লাগছে শিশুর মতো গভীর।

রোদের পাশে এসে দাঁড়ালো রোদ।

শিশুর মত সুন্দর লাগছে শিশুর মতো খুশি।

সকালবেলা

কাছে ডাকছি।


------৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
-----২২----১১----২০২১
-----নির্মল হালদার





পাহাড়তলির মাঠ / নির্মল হালদার




পাহাড়তলির মাঠ / নির্মল হালদার


৪৪.
কলসি কাঁখে আসছে মেয়েরা

যার কাছেই আঁজলা পাতো
জল পবিত্র জল নির্মল।

মেয়েদের ছায়া পড়ছে রাস্তায়
যার কাছেই আঁজলা পাতো
ছায়া পবিত্র ছায়া নির্মল।


৪৫.
গাছে ফুল এলে
পাতারা সবুজ হয়ে ওঠে।
গাছে ফল এলে
পাতারা ঘন সবুজ হয়ে ওঠে।

পাতারা কাঁপে।

গাছে ফুল এলে
শিকড়ে রোমাঞ্চ জাগে।
গাছে ফল এলে
শিকড়ে শিকড়ে রসের প্রবাহ।


৪৬.
মেঘে মেঘে ঘুঙুর বাজে
মেঘের দিকে চেয়ে থাকে মেয়ে।
ও মেয়ে, মেঘবতী হও
অথবা পায়ে পায়ে ধুলো পরো

ধুলো বাজবে।


৪৭.
জলের ভিতরে জল জন্ম দেখেছে।

জলের ভিতরে জল জন্ম দেখেছে।

জলের ভিতরে জন্মের স্তব্ধতা জল দেখেছে।


--------২৪ কার্তিক ১৪২৮
-------১১-----১১----২০২১


৪৮.
আমার সঙ্গে খেলতে যাবি?

আমি ধুলা খেলবো।

রাশি রাশি ধুলা বইছে।

রাশি রাশি ধুলায় প্রাণ বইছে।


৪৯.
আকাশে যাবি?

চাঁদ ধরবো সূর্য ধরবো।

আকাশে যাবি?

চাঁদ পরবো সূর্য পরবো।

আকাশে যাবি?

আকাশ পরবো মাথায়।


৫০.
থোকা থোকা খেজুর
রসিক চেয়ে আছে গাছের দিকে।
থোকা থোকা খেজুর
মাটি চেয়ে আছে গাছের দিকে।

রসিক না মাটি কে পাবে
প্রথম একটি খেজুর?
রসিক না মাটি কে পাবে
প্রথম রসের ফোঁটা?


-------২৫----১১----২০২১
----১২-----১১----২০২১


৫১.
মেয়ে গেছে মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে।


মেয়ের তৃষ্ণা পেয়েছে।

কোথায় জল কোথায় জলের ধারা?

মেয়ে গেছে মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে।

ও মেয়ে এসো, কাঁসাই নদীর কূলে।

জল দিব জলের কাদা দিব আদরে আদরে।


৫২.
পাতা কুড়ায়।

পাতা কুড়ানির মেয়ে পাতা কুড়ায়।

পাতা কুড়ানির মেয়ে শব্দ নৈঃশব্দ কুড়ায়

রাস্তা থেকে রাস্তায়।


৫৩.
ফুলতো ফুটেছে
ফুলের অর্থ কী?
আমাকে বলে দিলেই
আমি তোর সাথী।


------২৬ কার্তিক ১৪২৮
-----১৩----১১----২০২১


৫৪.
এখানে মেঘ এলে
বৃষ্টি আসে কথার মত।
কথা আসে প্রেমিক প্রেমিকার মত।
আনন্দ বেদনার মত।

এখানে মেঘ এলে
বৃষ্টি আসে বিরহের মত।
বিরহ আসে প্রদীপ শিখার মত

কেঁপে কেঁপে ওঠে।


৫৫.
এদেশে নৌকা নেই, নদীও ছোট।

কেবল পাতা ভাসে।

চন্দ্র-সূর্যের ছায়া ভাসে।

এদেশে বৃষ্টিও নেই, নদীও ছোট।

দুঃখরাও ছোট ছোট চোখের কোনায় থাকে।


৫৬.
পাতা চেয়ে থাকে পাতার দিকে

একটি পাতা সবুজ হলে
আরেকটি পাতা ঘন সবুজ।

পাতা চেয়ে থাকে পাতার দিকে

একটি পাতা হলুদ হলে
আরেকটি পাতা ঘন হলুদ।

পাতা চেয়ে থাকে পাতার দিকে

নতুন পাতার দিকেও।


--------২৭ কার্তিক ১৪২৮
-------১৪-----১১----২০২১



৫৭.
মন কি আর পড়তে পারি

মন শুধু মনেরই দিকে।

মন পুরনো হলেও প্রাচীন হলেও
মন কি আর পড়তে পারি
মন যে রহস্যময় এক তারা।

জ্বলে নেভে।


৫৮.
অর্জুন ফল
আরেক অর্জুন ফল ছুঁয়ে ফেললে
ঝুমঝুম করে বাজে।

অর্জুন ফল ঝুলছে।

অর্জুন ফলের শুকনো রঙ দুলছে।

অর্জুন ফল
আরেক অর্জুন ফল ছুঁয়ে ফেললে
ঝমঝম করে বাজে।

অর্জুন গাছ কান পেতে শোনে।


৫৯.
নিম ফলের দিকে চেয়ে আকাঙ্ক্ষা আসা-যাওয়া করে

কার আকাঙ্ক্ষা?

নিম ফলের দিকে চেয়ে আকাঙ্ক্ষা আসা যাওয়া করে

কবে এসেছে নিম ফল?
কবে হলুদ হলো নিম ফল?
কবে ঝরবে নিম ফল?

নিমতলে নিমের ছায়া অপেক্ষা করে।


------২৮ কার্তিক ১৪২৮
------১৫-----১১----২০২১


৬০.
ঝলমল করে পেয়ারা ফুলের আলো

কাঠবিড়ালি লক্ষ্য করে পেয়ারা ফুলের আলো

কে গাঁথবে আলো? কে গাঁথবে ফুল?

কার রচনায় কবে একটি পেয়ারা?


৬১.
একটা ডাল ঝুঁকে পড়ছে আরেকটা ডালের দিকে।

গাছ নিস্তব্ধ।

একটা ডাল সবুজে সবুজ আরেকটা ডালে পাতা নেই।

গাছ নিস্তব্ধ।

আরও একটা ডাল ঝুঁকে পড়ছে মাটির দিকে।

মাটি নিস্তব্ধ।

স্তব্ধতা কথা বলো।


৬২.
বটের ঝুরি নেমে আসে মাটিতে।

বট পাতায় আলো ছায়া বট পাতায় ধুলো

পাতা ঝরে পাতা ওড়ে।

বটের ঝুরি নেমে আসে মাটিতে

বটের ঝুরি প্রণতি জানায় মাটিতে।


------২৯ কার্তিক ১৪২৮
------১৬------১১-----২০২১
------নির্মল হালদার





বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০২১

দেশলাই বাক্স / নির্মল হালদার




কথার সঙ্গে দেখা হয় না আজকাল।
সে যে কোথায় গেছে কে জানে!
আমার সঙ্গে শেষ দেখা একটা বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে। সেও তো হয়ে গেল তিন চার মাস।

হেমন্ত এসেছে। হিমের পরশ। শীতের ছোঁয়া। কথা আসবে না? উষ্ণতা নিয়ে
আসবেনা?

ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে ফুটে উঠছে ধূসরতা। আমার মন কেমন করছে।

টেবিলে মুখ গুঁজে বসে ছিলাম। ভ্রমর এসে ডাকে: কাকু কাকু-------। চোখ খুলে দেখি, ভ্রমরের ফুটফুটে মুখ। শিশু মুখ।
আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। তাকে কোলে নিয়ে বাইরে এসে দেখি, গরুর গাড়িতে ধান যাচ্ছে। দু'তিনটে শালিক খুঁটে খাচ্ছে ধান।
ভ্রমরকে বললাম, ওই দ্যাখ ওইটা শালিক। হয়তোবা পায়রাও আসবে।

কথা আসবে না?

কথার পায়ের দিকে চেয়ে থাকতাম।
ওর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের কাছে একটা কালো তিল।
ওই তিল কখনো আমার কাছে শুধু চিহ্ন নয়। যেনবা একটা গোল সূর্য। কথার পায়ের কাছে এসে মিনতি করে-------তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।
কথা গ্রাহ্য করে না।

ওই গোল চিহ্ন আমিও তো হতে পারি।
আমিও তো বলতে পারি, তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। আজীবন। এজন্যে তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছি।
আমাকে গ্রহণ করো।

কথা আমাকে গ্রহণ-বর্জন কিছুই করেনি। তার সঙ্গে যে আমার দেখাই হয় না। প্রতিদিন বাতাসকে বলি, কথার খবর এনে দাও। প্রতিদিন আমার সময়কে বলি, কথাকে সামনে এনে দাও। আমি দুচোখ মেলে দেখবো।

কথা একদিন মাত্র আমার ঘরে এসেছিল। আমার চিরুনিতে রেখে গেছলো, তার মাথার লম্বাচুল। তিনটি মাত্র চুল। সে চলে যাওয়ার পর আমি ওই তিনটে চুল দেশলাই বাক্সে ভরে রেখেছি।

দেশলাই বাক্সটি কথাকে ফেরৎ দিতে চাই। কেননা,ওর মাথার রাশি রাশি চুল থেকে তিনটে চুল কম পড়ে গেছে।
ওকে ফেরৎ দিলে কথা আবার লাগিয়ে নিতে পারবে। সে যদি না পারে, আমি গেঁথে দিতে পারবো ওর মাথায়।

কথা কত দূরে আছো?

ধান পাকা হাওয়া ফিরে এসেছে।
আমাকে কিছুই বলতে পারলোনা, তুমি কোথায় আছো?
ভোরাই বলতে পারবে? নাগরিকা?

গতকাল স্বপ্ন দেখছিলাম, আমার হাত ধরে তুমি শ্মশানকালী নিয়ে যাচ্ছো। শ্মশানকালীর স্তব্ধতায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। তুমি এই কথা বলতেই, আমি রাজি হয়ে গেলাম।

আমরা গেলামও।

স্তব্ধতা নেই।
কেবল আলো আর আলো। আলো যেন চিৎকার করছে। কালী পূজা উপলক্ষে সাজানো হয়েছে আলোকমালায়।

আমি কথাকে বললাম---এই আলো তো চাইনি আমি।

আমার ঘুম ভেঙে গেল।

কথা কত দূরে তুমি?
এসো দেখা করো। তোমার মাথার চুল তোমাকে ফেরৎ দিতেই হবে। নইলে দেখা যাবে আরও চুল উঠে যাচ্ছে তোমার। তা আমার সহ্য হবে না।
আমার কাছে যে তিনটে চুল এরাই তো ধরে রাখবে বাকি চুল। বা বেঁধে রাখবে।

না--বলে কোথায় যে চলে যাও?

যদি আমার কাছে একটা নদী রেখে যেতে, তাহলে নদীর হওয়া আমাকে রোজ খবর দিতো,
তুমি কোথায় আছো? কি করছো?

কারুর কাছ থেকে কোনো খবর নেই তোমার। তুমিতো চিঠিও লেখোনা। ফোনে তোমার এলার্জি।

যে বাড়িতে থাকতে বর্তমানে ভেঙ্গে গেছে। শুনলাম, থাবা পড়েছে প্রোমোটারের।

আকাশ কী প্রোমোটারের খপ্পরে পড়বে? আমি জানিনা। আমি শুধু জানতে চাই, কবে মুখোমুখি হয়ে কথার সঙ্গে কথা বলবো?

প্রতিদিন একবার দেশলাই বাক্সটা খুলে কথার মাথার চুল আমার গালে বুলিয়ে নিই।
মনে হয়, তাকে আমি ছুঁয়েই আছি। কিন্তু আজ দেশলাই বাক্সটা কই?

কই?

টেবিলের ড্রয়ার খুলে আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। নেই নেই। আমার বুক ফেটে কান্না আসে।

আমি ছটফট করি।

মাথার চুল ছিঁড়তে থাকি। হাত পা ছুঁড়তে থাকি।
ভ্রমর আসে তখনই। সে বলে-----
এই নাও তোমার দেশলাই বাক্স।
আমি খেলছিলাম।

দেশলাই বাক্সে তিনটে চুল নেই।

------১৭ কার্তিক ১৪২৮
-----৪----১১----২০২১
-----নির্মল হালদার







পাহাড়তলির মাঠ // নির্মল হালদার

পাহাড়তলির মাঠ // নির্মল হালদার




২১.
ছেঁদা হাঁড়িতে জল ফুটছে।

ছেঁদা হাঁড়িতে চাল ফুটছে।

ছেঁদা হাঁড়ির ভাত ছেঁদা নয়

ছেঁদা হাঁড়ির ভাত শুধু অন্ন।



২২.
যে ফুলের মধু নাই
সেই ফুলের কাছে মধু চোর।
যে ফুলের মধু আছে
সেই ফুলের কাছে মধু চোর।

ফুলের রঙ চেনেনা মধুচোর।



২৩.
হরিণের পেছনে ছুটছে শিকারি

ফুলের গন্ধ আসে ফলের গন্ধ আসে
চন্দনের গন্ধ আসে

শিকারি দাঁড়িয়ে যায়।

জঙ্গলের অস্থিরতা স্থির হয়ে যায়।



২৪.
কোকিল ডাকলে পাহাড় ডাকে।

পাহাড়ের ভিতরে কোকিলের বাস।

পাহাড়ের ভিতরে বসন্তের সুবাস।


------১৬ কার্তিক ১৪২৮
-----৩-----১১----২০২১



২৫.
গাভীর চারটে বাঁট

একটা বাঁটের দুধ গাছপালাকে দিই।
একটা বাঁটের দুধ পাখিদের দিই।
একটা বাঁটের দুধ বাছুরকে দিই।

একটা বাঁটের দুধে মনকে ভেজাই।



২৬.
পথে পথে রামধনু উঠলে আকাশে পাঠিয়ো।

পথে-পথে লাফায় মাছ, আমাকে ধরে দিও।
আমার যে মাছের সঙ্গে খেলা।

ধুলোখেলা খেলতে পারে মাছ।

এ মাছ ধরা পড়েনা জালে, এ মাছের কপালে
সোনার টিকলি, গলায় চন্দ্রহার।

হৃদয়ে সুগন্ধ।



২৭.
নাকছাবি জ্বলজ্বল করে বনের ভিতরে।

কার নাকছাবি কার?

নাকছাবি জ্বলজ্বল করে বনের ভিতরে।

বনের ভিতরে একটি নদী বনদেবী স্নান করতে যায়।

নাকছাবিটি কাছে ডাকে: আয় আয় আয়


------১৭ কার্তিক ১৪২৮
-----৪----১১----২০২১


২৮.
বাঘকে দেখে হরিণ পাহাড়ে উঠলো।

হাওয়াকে দেখে মেঘ পাহাড়ে উঠলো।

পাহাড়ে খেলা করে হরিণ ও মেঘ।



২৯.
আমি শব্দ করলেও পোকারা নিঃশব্দ।

পোকাদের দেশ কোথায়?

পোকাদের জন্ম কোথায়?

ধান গাছে পোকা লেগেছে।



৩০.
গরুটি ঘুরে বেড়ায় একা একা

কোথায় আছে রাখাল?

গরুটি ঘুরে বেড়ায় একা একা

কোথায় আছে রাখাল?

আছে আছে, শুধু পায়ের শব্দ নেই।


------১৮ কার্তিক ১৪২৮
-----৭-----১১----২০২১



৩১.
গাঁইতি--কোদালে মাটি ওঠে।

আকাশ খামচালে দু-একটি তারা উঠে আসে।

হৃদয় খামচালে রক্ত উঠে আসে।

আঁজলা পাতলে জল না আসতেও পারে।

ফুল ফুটলে গন্ধ না আসতেও পারে।

গাঁইতি--কোদালে শিকড় ওঠে।



৩২.
হাঁড়ি গড়েছো কলসিও গড়েছো

পরখ করে দেখবো
কোথায় কোথায় ছেঁদা

কুমোর হে, তোমার চাকায় ঘুরে ঘুরে
পৃথিবীও গড়ে উঠেছে।

পরখ করে দেখবো এবার, কোথায় কোথায় খুঁত।



৩৩.
সমুদ্রের জন্ম হলো কবে?

আকাশের সৃষ্টি হলো কবে?

কার আঁতুড় ঘর কোথায়?

আমিতো ধুলোবালির মত অনাথ।



৩৪.
গাঁ মুড়ার গাছে খোকা খোকা তেঁতুল।
টক করবে না কাঁচাই খাবে
নাকি রাজার বিটি খুঁজেছে দিয়ে আসবে?

রাজাটা বড় বজ্জাত এক সের ধানে নাই।


------২০ কার্তিক ১৪২৮
-----৭----১১---২০২১



৩৫.
সাগরের সঙ্গে নদীর মিলন হলে
নদী আর নদী থাকেনা,হয়ে যায়
নুনের সাগর।

সাগরের সঙ্গে নদীর মিলন হলে
নদী আর নদী থাকেনা, হয়ে যায়
নূনের পুতুল।



৩৬.
গাছের কোটরে একটি ডিম। কার ডিম?

সূর্যের কিরণ এসে পড়ে।

গাছের কোটরে একটি ডিম। কবেকার ডিম?

ডিম ফুটলেই শিশুর মুখ, রোদের মত তাপ।




৩৭.
ভ্রমর তুই সাবধানে যা
ওই গাছে ফুল থাকলেও কাঁটা আছে।
ভ্রমর তুই সাবধানে যা
ওই গাছে গভীর কাঁটা।
তোর পায়ে ও পাখায় কাঁটা লাগলে
আমার গায়ে আঘাত লাগবে।

ভ্রমর তুই সাবধানে ধীরে ধীরে
মধুরস পান কর্ ।


-----২১ কার্তিক ১৪২৮
-----৮----১১----২০২১



৩৮.
সারারাত শিশির ঝরেছে

শিশিরে শিশিরে ভিজে আছে পথ

সারারাত শিশির ঝরেছে

শিশিরের মায়া।



৩৯.
বক জানে,
কোন্ পুকুরে জল আছে।
কোন্ পুকুরে জল নাই।
বক শুধু জানে না,
তার ওড়ার পথে কুয়াশা নেমেছে।



৪০.
দু চার আঁটি খড় কম পড়লে
ঘরামি হে, আমার মনটা নিও
পোক্ত করো আমার ঘরের ছাউনি।



৪১.
কানের দুলটি পড়ে আছে ধুলায়
কে কুড়াবে কে পরবে কানে?
কানের দুলটি পড়ে আছে ধুলায়

রাজার বিটি ফেলে গেছে ছুঁতে ভয় করে।




৪২.
পাখিরা ডেকে উঠলে, সূর্য ওঠে।
পাখিরা ঘরে ফিরলে, সূর্য অস্ত যায়।
পাখিরাই বলে, পূবে ঘর পশ্চিমে ঘর।

আমাদের অনিবার্য স্বর।


-------২২ কার্তিক ১৪২৮
-------৯------১১----২০২১




৪৩.
ঘরের ভিতরে ময়ূর নাচে

শিকারি লক্ষ্য করে

শিকারি চুরি করবে না ময়ূর

ময়ূরের নাচ চুরি করবে।



-----২৩ কার্তিক ১৪২৮
-----১০------১১-----২০২১






নীরবতা // নির্মল হালদার




চিরাগের কাছে যাই। কথা বলার চেষ্টা করি। সে চুপচাপ থাকে।

সিনেমা শিল্প-সাহিত্য, সমাজ সময় নিয়েও কথা বলার চেষ্টা করি।
সে কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে শূন্যতার দিকে।

একদিন জানতে চাইলাম, শূন্যতার অর্থ আমাকে বলো। সে নীরব থাকে।
তার নীরবতায় আমার রাগ হয়না। বিরক্তি আসে না একদম।
আমি অনেক সময় তাই, একা একা
তার সামনে কথা বলি।

আমার যে কথা আছে।

তাল গাছ অনেক লম্বা হলো। খেজুর গাছ হলো না কেন? অথচ দুটো গাছেরই ফল মিষ্টি। সুস্বাদু।
কুল গাছে অনেক কাঁটা। আম গাছে
কোনো কাঁটা নেই।
কারণ কী?

চিরাগের চোখে ঝিলিক দেখা গেলেও
সে চুপচাপ থাকে।

একদিন তার কাছে চা এনে বললাম,
খাও। সে নিস্তব্ধে চায়ের কাপ উঠিয়ে শুরু করলো খেতে। একটিও কথা বললো না।তার কাছে একটি স্মার্ট ফোন আছে। ফোন আসে। সে ধরে না। কল এলেই কেটে দেয়।

আজ সে শুয়েছিল।

আমি প্রথমেই প্রশ্ন করলাম, কেমন
আছো?
আমি জানি কোনো জবাব আসবেনা।
তবুও অভ্যাসবশত আমার প্রশ্ন, যদি কথা বলে।

আগে এই রকম ছিল না। নর্দমার পোকা নিয়েও কত কথা বলেছে। উইঢিবি নিয়ে কত কথা বলেছে।
ব্যাখ্যা করেছে নারীর শরীর নিয়ে।
শরীরের রহস্য নিয়েও কত রকম
আলো ফেলেছে আমার সামনে।

আজ সেই যুবক স্তব্ধতার দিকে।
কারণটা কী? খুঁজে পাইনা।
একদিন মনে হলো, কোনো বিষয়ে
আঘাত পেয়েছে বুঝি। তার বন্ধুদের কাছেও খোঁজখবর করলাম। কেউ কিছুই বলতে পারলোনা। কেউ জানেও না,সে কোথাও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কিনা। তবে কি অন্য কোনো ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে?
যা বলা যায় না কাউকে।

হাত ধরে টানাটানি করি, চলো ঘুরে আসি কোথাও।
সে কোনো ভাবেই উঠবে না।

একদিন দেখলাম, দেয়ালে
নখ দিয়ে কি সব লিখে চলেছে।
সামনে গিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম।
কিছুই বুঝতে পারলাম না। হরফ গুলি
হিন্দি না হিব্রু বাংলা না ইংলিশ
বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখেই সে চেয়ারে বসে পড়লো।
চেয়ারের গায়েও দেখলাম, আঁকি-বুকি। সেও পড়বার চেষ্টা করলাম। স্পষ্ট হলো না কিছুই। শুধু
একটি মাত্র শব্দ, আমার কাছে সহজ হয়ে ধরা পড়লো--------আলো।

চিরাগ কী তবে আলো খোঁজার চেষ্টা করছে? আলো কোথায়?
তার চোখে-মুখে কালো ছায়া পড়েছে।
সে ক্রমশ শীর্ণ। তার মা-বাবা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার চেষ্টা করেন। সে যাবে না কোনোভাবেই।
মা-বাবা তাগা তাবিজ এনে বেঁধে দেবার চেষ্টা করেন। সে ছুঁড়ে ফেলে।

মা বাবা তো চাইবেনই, যেকোনোভাবে
ছেলেকে সুস্থ করার। চিরাগ বলবেও না, সে সুস্থ নয়। সে অসুস্থ নয়। সে স্বাভাবিক এ কথাও বলবে না। কেবলই নীরবতা।

চিরাগের ছোটবেলার বন্ধু মৌরি
এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে।
একটাও কথা বলেনি। মৌরি তার মা-বাবাকে বলে গেল, চিরাগ পাগল হয়ে গেছে। চিকিৎসা করান।

কী চিকিৎসা ?

সে তো নিয়মিত স্নান খাওয়া-দাওয়া করে। শুধু কারো সঙ্গে কথা বলে না।
ঘরের বাইরে যায় না একদম।

একে কী পাগলামি বলা যাবে?


কি ভাই কী করছো?
তোমার ঘরে তোমাকে পেলাম না বলে
ছাদে উঠে এলাম।

কোনো উত্তর নেই।

দেখতে পাই, খোলামকুচি দিয়ে
ছাদের মেঝেতে আলপনা এঁকেছে।
আমি বললাম, তোমার হাতে ছবি আছে। আরো আঁকো।
চিরাগ আমার দিকে চেয়ে রইলো।
সে তখন আবার , একটা প্রদীপের ছবি এঁকে আমার দিকে চেয়ে থাকে।
আমি বললাম, আলো আলো।
আলোর সঙ্গেইতো আমাদের সম্পর্ক।
আলোকে ঘিরেই আমাদের বেঁচে থাকা।
আমরা সবার কাছ থেকেই আলোর আশা করি।

আলো কই?

প্রদীপ তো আছে। এমনকি প্রতিদিন
সূর্য আছে। কেবল আলো নেই। অন্তরের আলোটা নেই।
চিরাগ, তুমি কি তাই বলতে চাইছো?

চিরাগের রোগ বলতে, ফর্সা জামা কাপড় পরবেনা। তার বাড়ির লোক জামাকাপড় পাল্টাবার কথা বলে।
সে শোনে না।
ব্যবহার করেনা তেল সাবান। অনেকে তাই তার কাছে যেতে চায় না। এখন সবাই আড়ালে আড়ালে বলে, চিরাগ পাগল হয়ে গেছে।

আমি তার কাছাকাছি এসে আমার যে ধারনা হয়েছে তা হলো, সে কোনভাবেই পাগল নয়। তার আলো শব্দটি থেকে, প্রদীপের ছবি থেকে আমি যা বুঝেছি, সে আলোর খোঁজে আছে।
কিন্তু কোথায় আলো?

আলো অর্থে সে কি বোঝে, কিইবা বলতে চায়, আমার জানা নেই। আমি হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবোনা।

আপাতত সে কথা বলছে না। অনেকদিন হলো কথা বলছে না।
আলমারিতে যেটুকু বইপত্র ছিল
ছিঁড়ে ফেলেছে।

চিরাগের মা শুধু কাঁদেন।

আমি একদিন সপ্তর্ষিমণ্ডল নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। ছায়াপথ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। সে মুখ নিচু করে যেমন ছিল তেমনি রইলো। মুখ তুলে আমাকে কিছুই বললো না।এবার আমার খুব কষ্ট হলো। তার মাথার চুল ধরে ঝাঁকুনি দেবার চেষ্টা করলাম। সে কেবল উঃ আঃ করে
আমার হাত ছাড়িয়ে দিলো।

কী করবো আর?

মৌরি এসেছিল আরেকদিন। সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি শুনে বললাম, চিরাগ কে একা থাকতে দিলেই ভালো হবে বলে মনে হয়।

কোনোদিন সে কথা বলবেই।

আজ তার কথা নেই।কোনো কথা নেই।তাকে কথা বলানো মানে তাকে বিরক্ত করা। তাকে একা থাকতে দাও।
সে কোনোদিন না কোনোদিন কথা বলতে বলতে কথার আলো আমাদের দেখাবে।

আপাতত সে নীরব থাকুক।

------১৪ কার্তিক ১৪২৮
-----১---১১----২০২১
-----নির্মল হালদার







মঙ্গলবার, ২ নভেম্বর, ২০২১

পাহাড়তলির মাঠ // নির্মল হালদার

পাহাড়তলির মাঠ // নির্মল হালদার



১.
কত আর অপেক্ষা করবে কত জনের জন্য!
আর তাই স্থির হয়ে না থেকে
পাহাড়ও চরে বেড়ায় গাই--গরুর সঙ্গে।

পাহাড়তলীর মাঠ ঝমঝম করে বাজে।



২.
গাছের দিকে চেয়ে আছে গাছ,
নীরবতা।
ফুলের দিকে চেয়ে আছে ফুল,
নীরবতা।
পাতার দিকে চেয়ে আছে পাতা,
নীরবতা।

গোপনে গোপনে শিকড়, আমার নীরবতা।



৩.
মাছ লাফাতেই জলে তোলপাড় হলো

কার মাছ লাফালো?

আমার মাছ
আমার মাছ

আমি মাছের মন ভক্ষণ করি।



------৬ কার্তিক ১৪২৮
-----২৪----১০----২০২১



৪.
পুঁটি মাছ ধরে দিব
মৌরলা মাছ ধরে দিব
যদি আমার সঙ্গে ঝর্নাতে যাও।

শালুক ফুল ধরে দিব
পদ্মফুল ধরে দিব
যদি আমার সঙ্গে পুকুরে যাও।

পিরিত ধরে দিব
যদি আমার সঙ্গে বাঁশ বনে যাও।



৫.
পিঁপড়েরা থাকে কার মায়ের ঘরে?

পিঁপড়েরা থাকে আমার মায়ের ঘরে।

মায়ের ঘর কেমন গো?

ঘাসে ছাওয়া ঘর গো।



৬.
তুমি কী রঙের মেঘ ধারণ করবে?

আমি কালো রঙের মেঘ ধারণ করবো।

তুমি কী রঙের বৃষ্টি ঝরাবে?

আমি দুধ রঙের বৃষ্টি ঝরাবো।

তুমি কী মাটি ভেজাবে?

আমি শিশির ভেজা মাটির পারা ভিজেই আছি।


------৮ কার্তিক ১৪২৮
-----২৬----১০----২০২১



৭.
কার পায়ের নূপুর রিনিঝিনি করে?

কার চলার পথ রুমঝুম করে?

কার বুকের ঢেউ ওঠানামা করে?

কার পায়ের শব্দে কে জন্মগ্রহণ করে?



৮.
কোন্ তারাটি পেড়ে দিব বলো?
কোন্ তারার আলো চোখে ধরবে?
কোন্ অরণ্যে বাস করবে বলো?
কোন্ পাখির ছায়া মনে ধরবে?

কী দিবে কাহারে বলো?

কার হাত ধরবে?



৯.
কোন্ বনে রাখালের ডাক?
কোন্ বনে বাঘ?
কোন্ বনে ফলের ভিতর বীজ নাই?
কোন্ বনে পাতার রঙ লাল?

হাওয়ার ভিতরে বাতাসের ডাক।



১০.
নদীর ভিতরে নদী কেঁদে চলে

রসিক কোথায়?

নদীর ভিতরে নদী কেঁদে চলে

কোথায় গেল রসিকের অন্তর?

রসিক জেগে উঠলেই নদীর ঘর।


--------১০ কার্তিক ১৪২৮
------২৮----১০-----২০২১



১১.
যে তারা নিভু নিভু সেই তারা
গরুর স্তন থেকে দুধ টানে।
আকাশ আলো করে আলোর অধিক।

গরু দুধ ঝরায় মাটিতেও।

শিকড় শুকিয়ে উঠছে।



১২.
পাখিরা উড়তে উড়তে আলো পাড়ে।

গাছ থেকে গাছে গড়িয়ে যায় আলো
মাটি থেকে মাটিতে গড়িয়ে যায় আলো

পাখিরা উড়তে উড়তে ডিম পাড়ে।



১৩.
আম তলে পড়ে আছে আম
কে কুড়াবে?
আম তলে পড়ে আছে ছায়া
কে কুড়াবে?

আমের স্বাদ টক--মিষ্টি হলে,
ছায়ার স্বাদও টক-মিষ্টি।



১৪.
আমার এক মুঠিতে নদীর উচ্ছ্বাস।
আরেক মুঠিতে সমুদ্রের ঢেউ।
কিছুই তো চাইছোনা তুমি, তুমি চাইছো
হাল ছাড়া গরুর করুণ চোখ

অনেক গোপন দুঃখ।


-----১২ কার্তিক ১৪২৮
----৩০----১০-----২০২১



১৫.
যুবতীর পায়ের নুপুর রাস্তায় পড়ে গেলে
কুড়িও ভাই, ফেরৎ দিও।

যুবতীর পায়ের নুপুর রাস্তাকে সজীব করে।

যুবতীর পায়ের নুপুর যৌবন জাগায়।



১৬.
রাস্তা কোথায় থাকে? বুকের ভিতরে।
রাস্তা কোথায় যায়? বুকের ভিতরে।

বুকের ভিতরে বুক পাখির রাস্তা
বুকের ভিতরে বুক হাওয়ার রাস্তা

বুকের ভিতরে বুক আমার মিলনের পথ।



১৭.
কোন্ পুকুরে জল নাই
বক বলে গেল।
কোন্ নদীতে জল নাই
বক বলে গেল।

ধুলো--মাটি--আকাশে দুঃখ আছে,

বক বলে গেল।


------১৪ কার্তিক ১৪২৮
-----১-----১১----২০২১



১৮.
বাঁশের জন্ম কোথায়?বাঁশির জন্ম?

কে দেখেছে জন্ম?

জন্ম চিহ্নে সুরের আসা-যাওয়া

ব্যথা বেদনার মতো সুরের আসা-যাওয়া।



১৯.
শালুক ফুলে ভ্রমর এসেছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অশথ গাছ।

অশথ গাছেও ফল এসেছে।

ফলের স্বাদ হৃদয়ের মতো।

পাখিরা ঠুকরে গেলে ছিটকে পড়ে রক্ত।



২০.
আকাশ থেকে দুধ দোয়ার শব্দ আসছে।

কে হে গোয়ালা?

মুখ দেখতে পাইনা। কত দূরের মানুষ তুমি?
কাছে আসবে কবে?

কে হে গোয়ালা?

মুঠিও ভরে উঠছে দুধে দুধে

দুধের আলোয়।



-------১৫ কার্তিক ১৪২৮
-----২-----১১---২০২১






কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ