বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৩

কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ----৯৬




কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ----৯৬
--------------------------------------------------

মহাভারতের কথা উঠলে আমাআমারর বড়দি ভীষ্মের কথা বলতো। আমি বলতাম, কর্ণের কথা। কর্ণ আমার প্রিয় চরিত্র। সঙ্গে সঙ্গে নাকচ------দিদি বলতো, কর্ণ তো স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার সুখও করেছে। রাজ্য সুখেও ছিল। ভীষ্মের মত ত্যাগ মহাভারতে কারোর নেই।

আমাদের বাংলা কবিতায় ক'জনের ত্যাগ আছে?

মধুসূদনের নাম কি উল্লেখ করতে পারি? বিনয় মজুমদারের নাম?

সব সময় তো দেখি, কবিরা দৌড়াচ্ছে। আমার বন্ধু সুরজিৎ পোদ্দারের ভাষায়----দৌড়লে শরীর ভালো থাকে। কবিরা তাই খ্যাতির পিছনে দৌড়াচ্ছে। সংসার ধর্ম পালন করে, চাকরি করে যে যার মত করে দৌড়াচ্ছে শুধু দৌড়াচ্ছে। কারণ আর কিছুই না, বাংলাবাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ এক প্রয়াস। এই সমস্ত কবিরা ত্যাগ ধর্মের কথা শুনেছে কিনা সন্দেহ আছে। চাকরি ছেড়েছে কবিতার জন্যই এরকম দু'চারটে উদাহরণ আছে। কিন্তু সংসার ধর্ম ত্যাগ করতে পারেনি। ত্যাগ যে একটা ব্রত, সেই দিকে না গেলে ত্যাগের মর্ম জানবে না কেউ। অনেক কবি আছে ঘরে ঢুকবে কি, দরজার দিকে গেলোই না। নিজের ঘরের কোণেই তার অবস্থান। তার সারস্বত চর্চা। এ গল্প বা ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সব ছেড়েছুঁড়ে একটা জীবন কবিতার জন্য উৎসর্গ, কেইবা করতে পারে এই জটিল কঠিন সময়ে? যখন এক মুঠো ভাতের জন্য নিজের ঘর নিজের গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে।

বাঁচতে যে হবে।

শুধু কবিতা নিয়ে বাঁচা যে আরো কঠিন। আরো যন্ত্রণার। আরো অবজ্ঞা আরো অবহেলা। অপমান তো থাকেই। আর প্রেম ভালোবাসা?

গাছে না উঠলে তাল পাড়া যাবে না।

-----২ চৈত্র ১৪২৯
----১৭---৩---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা ----কাঠবিড়ালির লাফ---৯৭
-----------------------------------------------------------

রাজমিস্ত্রি না নির্মাণশিল্পী?

যে নামেই ডাকি না কেন, ভালোবেসেই ডাকি। সম্পর্ক যে আছেই। কোনোদিন তো এসেছিল আমাদের কাছেও। একটি সুখী গৃহকোণ গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যে। এবং এই গৃহকোণে রাজমিস্ত্রি বা নির্মাণশিল্পীর ঠাঁই নেই। সম্মান জানিয়ে তার জন্য আসন পাতি না। সে দূরে দূরেই থাকে। যেমন দূরে দূরেই থাকে বিশ্বকর্মা।

লোহার বাসর ঘর নির্মাণ করলেও বিশ্বকর্মার আরাধনা উপলক্ষে ঢাকঢোলের আওয়াজ শোনা যায় না। জোর।

কবিতার ক্ষেত্রে বিশ্বকর্মা যারা তাদের আওয়াজ শুনতে পাই। খুব। একদল কবি মনেও করে, কবিতাও নির্মাণ।

কবি আলোক সরকার এ কথা জোর দিয়ে বলতেন। অগ্রজ কবির সঙ্গে আমি তর্ক করিনি। আমার এক তরুণ কবি বন্ধু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বলে, কবিতা কিছুটা নির্মাণ। কিছুটা সৃষ্টি।

বীতশোক ভট্টাচার্যের কাছে আমি এক সময় তার মেদিনীপুরের বাড়িতে। মাসে একদিন। শুধু আড্ডা দেবার জন্য। কবিতা প্রসঙ্গে নানা কথা বলতে বলতে সে আমাকে বলেছিল, কবিতা শেষ অব্দি বানানো।

যদি বানানো হয়ে থাকে, আমার তবে প্রশ্ন, কবি উপকরণ পেলেন কোত্থেকে? রাজমিস্ত্রির কাছে উপকরণ থাকে ইঁট-বালি--সিমেন্ট-ছড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর গড়ে ওঠে একটা বাড়ি। এখানে রাজমিস্ত্রির কোনো আবেগ থাকে না।

সৃষ্টি তো আবেগের জায়গা।

তাজমহল একটা আবেগ। আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রকাশ। দম্ভের প্রকাশ।

কবিতা শক্তির প্রকাশ দম্ভের প্রকাশ কখনোই নয়। আবেগ থেকে অন্তর থেকে এসে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কবিতা।

কবিতার জন্ম হয়।

একটা বাড়ি তৈরি হয়।

সৃষ্টি ও নির্মাণের তফাৎ থাকবেই। তর্ক? চলতে থাকবেই। যারা নির্মাণের পক্ষে তারা হয়তো কোনোদিন ঘোষণা করবে, ফুল একটি নির্মাণ। সৌরভ সেও নির্মাণ।

প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যকে টেনে হাজির করবে উদাহরণ। তত্ত্ব। আমি সেদিকে না গিয়ে চৈত্র মাসের টাঁড় জমির ঘাসের শিকড় থেকে শুনতে চাইবো-----জন্মকথা।

আবেগের সুর।

----৩ চৈত্র ১৪২৯
----১৮---৩---২০২৩
----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--৯৮
--------------------------------------------------------

একটা সময় অভিযোগ ছিল, পুরুলিয়াতে যারা কবিতা চর্চা করে তাদের কবিতায় খুব ভাত ভাত চিৎকার। অভিযোগ ছিল আরো, বড় বেশি মা মা---। কাঁদুনি।

ধারাবাহিক চর্চা করে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উত্তর ছিল না। আজও নেই। শুধু দু-একটা কথা বলতে পারি।

যে কোনো মানুষের যেকোনো অভিজ্ঞতাই তো সম্পদ। সঞ্চয়তো অবশ্যই। যে সঞ্চয়ের এক মুঠো দু মুঠো করে শাদা কাগজে কবি নিয়ে আসে। কবিতার রূপে। পাঠকের সামনে।

কোনো কবিতা থেকে ভাতের গন্ধ উঠতেই পারে। কোনো কবিতা থেকে ছড়াতে পারে ফুলের গন্ধ। কোনো কোনো কবিতা থেকে সূর্যের কণা। চাঁদের কণা। কোনো কবিতা থেকে খুদকুড়ো।

পাঠক গ্রহণ করবে কি? কবি জানে না। জানার দরকারও নেই।

পুরুলিয়া অভাব অনটনের দেশ। একটু ভেতরে গেলেই চোখে পড়বে, হাহাকার। ঘরে বাইরে বিধ্বস্ত মুখ। কাঁচা পয়সা রোজগার করার মত কেউ নেই। একটি মাত্র পুত্র সন্তান রাজ্যের বাইরে গেছে কাজ করতে। বছরে একবার দুবার গ্রামের ঘরে আসে। তখনই মা-বাপের হাতে দু চারশো টাকা দেয়। তা আর কদ্দিন চলবে? বাপের বয়স হয়ে গেছে। শহরে যেতে পারে না কাজ করতে। আর গেলেই যে কাজ পাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তো, ঘরের গাছ থেকে কচি নিমপাতা পেড়ে আঁটি বেঁধে পুরুলিয়ার বাজারে যায় মা। সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে ঘরের গাছ থেকে দুটো পেঁপে। যেটুকু পয়সা হয়। নুন তেলের দামটা আসবে।

এই জীবন একজন সংবেদনশীল মানুষকে ধাক্কা দিতেই পারে। তা থেকে একটা লেখা সৃষ্টি হতেই পারে।

দারিদ্র্যের সমাধান করা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কবির পক্ষেও সম্ভব নয়। কবি শুধু ছবিটা দেখাতে পারে। অসহায়তা দেখাতে পারে। সেই দেখানো কি শিল্পের পক্ষে মঙ্গল নয়?

১৯৪৩ বাংলার মন্বন্তর। জয়নুল আবেদিন চিত্ত প্রসাদ রামকিঙ্কর সোমনাথ হোড় ইত্যাদি অনেক শিল্পী মন্বন্তরের ছবি আঁকলেন।

সেই ছবি দেখলেই, মন্বন্তরের হাহাকার শুনতে পাই। এবং সেই ছবি থেকে এক সময়ের এক ইতিহাস পাই। যা দেখতে পাই তা শিল্পেরই হাত ধরে।

সাম্প্রতিক সময়ের " করোনা " নামে একটি শোষণ বা শাসন অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। সেইসব ভয়াবহ ঘটনাগুলি গল্পে কবিতায় গদ্যে ছাপ ফেলেছে। ধরে রেখেছে সময়ের স্বাক্ষর।

কেউ মুছে ফেলতে চাইলে, অবজ্ঞা করলে মিথ্যে হয়ে যাবে না "করোনা" র দিনগুলি। যখন দেখেছি গ্রামে ও শহরে চাপা এক আতঙ্ক। বন্দী জীবনের ভয়। শিল্পে তা ধরা পড়লে একদল যদি বলে---গেল গেল সব গেল। শিল্প তো সেই রব অগ্রাহ্য করবেই।

ভাত ভাত করে আর্তনাদ করাও তো সময় ও সমাজের পক্ষে সুখের বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদেরই এক কবি অধিকারের এক সোচ্চার বার্তা রেখে গেছেন-----

ভাত দে হারামজাদি।

-----৫ চৈত্র ১৪২৯
-----২০---৩---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯৯
-----------------------------------------------------------

কলেজ কালির কথা আজকের প্রজন্মের কাছে অজানা। সুলেখা কালিও অপরিচিত।

কালির বড়িও গুঁড়ো করে জল দিয়ে শিশিতে ভরেছি। সস্তায় হয়ে গেছে। সেই সব দিনে পয়সা কড়িরও টানাটানি ছিল। কলমে কালি ভরতে ভরতে----হাতে কালি মুখে কালি।

রিফিল এলো। শেষ হয়ে গেল কালির দিন। কালি তো কবিদের রক্ত। রক্ত ফুরিয়ে যায় না। রক্তই তো সাহস। রক্তই তো মেরুদন্ড। রক্ত থেকেই শিকড়ের সুর আসে।

একদিন লিখেছিলাম---
আশ্বিনের ধানে জমে ওঠা দুধ
কলমে এসো
কালি ফুরানোর কথা নেই।

রিফিল তো একটা শিরার মতো। কতটুকু আর রক্ত থাকবে! ইউজ এন্ড থ্র কলম এলেও আসলে কবিরা লেখে রক্ত দিয়ে। কবিদের কাছে মেঘের কালিও রক্ত। গায়ের কালি তো রক্ত বটেই। রক্তে রক্তে কবিদের দিনলিপি রচিত হতে থাকে, রচিত হয় প্রতিদিন প্রতি পাতায়। গাছের পাতা থেকে মাটির পাতায়।

মা আমাকে একবার একটা সবুজ কলম উপহার দিয়েছিল। আগলে রাখতে রাখতেও কখন যে কোথায় হারিয়ে গেল, টের পেলাম না। কলমটার রঙ ছিল সবুজ। গাঢ় সবুজ। সেই সবুজ কি আমার মনে আজও? আজও কি আমিও নবীন পাতা তুমিও নবীন পাতা?

কবিদের রক্ত কবিদের কালি এ কথাটা বলার পরেও সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কখনো কখনো রক্তের অভাব দেখা যায় আমাদের দেশে। কবিদের কলম থেকে প্রকাশিত হয়ে থাকে, শুধু শব্দ শুধু অক্ষর। যাদের ভিতরে ও বাইরে রক্ত মাংস হাড় নেই। নিজেকে প্রকাশ করতে গেলেও রক্তের প্রয়োজন পড়ে। সেই রক্তটুকুও অনেকের কবিতায় দেখতে পাই না।

শুধু খড়ে কি প্রতিমা গড়ে ওঠে?

উপর থেকে কালি পাড়তে পাড়তে নিচের থেকেও কালি তুলতে হয়। কালিতেই তো রক্ত।

চরাচরের রক্ত।

প্রবাহমান জীবনের রক্ত।

প্রকৃত অর্থে আমার সত্য আমার রক্ত থেকে উঠে আসে আমার কলমে। আমার জীবন থেকে উঠে আসে আমার কলমে। তবেই তো আমি বলতে পারবো----

আমার হাতে কালি মুখে কালি
দেখ মা আমি লিখে আলি।।

-----৬ চৈত্র ১৪২৯
----২১---৩---২০২৩
----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---১০০
-----------------------------------------------------------

আশ্রয়ের অর্থ ছাদ নয়। আশ্রয়ের অর্থ ভালবাসাও নয়। মানুষ আশ্রয় খোঁজে মানুষের ভেতরে। ভালোবাসাও খোঁজে মানুষের ভেতরে।

আজকে যদিও সারা পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ শিকড়হীন হয়ে আশ্রয়হারা। রাজনৈতিক কারণেও দেশছাড়া হয়ে পড়ছে অনেক মানুষ। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এদেশেও এই ঘটনার চিহ্ন হিসাবে-----ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান।

এ যেমন বাইরের ছবি তেমনি ভিতরের ছবি হলো, ভালবাসতে বাসতে মানুষ যখন ছিটকে পড়ে ভালোবাসা থেকে, তখন সেও তো আশ্রয়হীন।

বুক মুচড়ে ওঠে।

যত দিন যায় বিজ্ঞানের নানান কারিগরি মানুষকে গ্রাস করতে করতে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষ থেকে।

এ ছবি তো প্রতিদিনের ছবি। প্রতিদিনের রক্তক্ষরণ। হিংসা বিদ্বেষ খুনোখুনি ধর্ষণ হত্যা রাজনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ বাদ দিয়েও মানুষ আজ বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ।

এও বেদনার বিষয়।

শুধুমাত্র আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে দেশ থেকে দেশ। মানুষ থেকে মনের মানুষ। যা না পেয়ে বিষাদ অবসাদ। যা না পেয়ে পাগল হয়ে যাওয়া। অনেকেই আত্মহত্যার দিকে।

অনেকে বেঁচে থেকেও নিজেকে একটু একটু করে ধ্বংস করে, যা আত্মহত্যারই মতো।

প্রকৃত কারণ এই, আশ্রয় নেই।

অনেক টাকা অনেক বৈভব, ভেতরে ভেতরে একা, এরকম মানুষও চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। তাদের হতাশাগ্রস্ত মুখ লক্ষ্য করে না আমাদের সমাজ।

সমাজ তো শুধু গতানুগতিক ছন্দ চায়। সমাজ তো রাষ্ট্রযন্ত্রেরই আরেক দিক। ছন্দ থেকে এক চুল সরে গেলেই সমাজ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ।

আমিও নিজেকে সমাজবিরোধী মনে করি। আমার ঘর নেই। দুয়ারও নেই। যেখানেই যখন হাঁটি হোঁচট খাই। কাঁটাতারের বেড়া।

আমি তো আর সৃষ্টি করতে পারি না নিরাভরণ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।

ভালোবাসা কি নিঃস্বার্থ হতে পারে?

কবিতা নিঃস্বার্থ হতে পারে। সৃষ্টি করুক যেই, কবিতা শেষ পর্যন্ত নিঃস্বার্থ। এই কারণেই, এখনো আমার অবলম্বন একমাত্র "কবিতা"।

অবলম্বন মানেই আশ্রয়। আমার আশ্রয়। এই এক জীবনে এই আশ্রয় আমাকে বাঁচিয়ে দিলো।

অনেক সময় কোনো মানুষকে মনে হয়েছে এই তো আমার বাঁচার জায়গা। আমি আঁকড়ে আঁকড়ে থাকবো। আমার শিকড়কে নিয়ে যাবো গভীরে। তারপর দেখি, শিকড় ছিন্ন হয়ে গেছে। আঁকড়ে থাকা মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূর।

আমি আশ্রয়হীন। দিনের পর দিন।

আবার সামনে এসেছে কেউ। মনে হয়েছে, আমার রাগ দুঃখ অভিমান রাখার এই তো এক ঠাঁই।

মাটি ধ্বসে পড়েছে।

টলমল করে আশ্রয় চাই আশ্রয় চাই----নীরব আর্তনাদে ছুটে বেড়িয়েছি নদী সমুদ্র পাহাড়ে।

জঙ্গলে জঙ্গলেও আমার আশ্রয় নেই। জঙ্গল তো নিজেই উচ্ছেদ হয়ে যায়। আমিও উচ্ছেদ হতে হতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছি, কবিতার আশ্রয়ে।

এক শিল্পের একক আলোয়
আমার নিঃশ্বাসের চলাফেরা।

আমার প্রাণের নানা রূপ নানা কবিতায়। আমাকে সঙ্গ দেয়। আমাকে নিঃসঙ্গ করে। আমি হেঁটে যাই আমার নিঃশব্দ ভালবাসার দিকে।

ভালোবাসা তুমি রক্তপাত।

-----৭ চৈত্র ১৪২৯
-----২২--৩--২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---১০১
-----------------------------------------------------------

ভোর।
আমার প্রিয় সময়। ভোরের বাতাস গায়ে লাগলে মনেও প্রবেশ করে। ফুরফুরে হয়ে উঠি। গতদিনের কালি কাদা মাথা থেকে প্রস্থান করেছে। ভোরে উঠতেই, কোনো কোনোদিন শুকতারা।

আঁখি মেলে চায়।

যেন বা নতুন এক জীবনের ইশারা। জেগে ওঠার জেগে থাকার ইঙ্গিত।

জেগে থাকাই তো কবিতা।

ঘুমিয়ে পড়বার সময় এলেই, প্রতিদিন আমার মনে হয়, এবার ঘুমোতে হবে। নিজেকেই প্রশ্ন করি, ঘুমোবো কেন? যদিও জানি, ঘুমের প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমার যে ভয়ও করে। যদি দুঃস্বপ্নেরা এসে আক্রমণ করে আমাকে!

জেগে থাকলে সেই ভয়টা নেই।

আবার এও ঠিক, শরীরের কারণে ঘুমোতে হবেই। ঘুম নিবিড় না হলেও ঘুমোতে হবে। অথচ আমি জেগে থাকতে চাই। তার প্রধান কারণ, যতক্ষণ জেগে থাকবো ততক্ষণ দেখা। চোখ দিয়ে দেখা। মন দিয়ে দেখা। দেখতে দেখতে কবিতার কাছে পৌঁছে যাওয়া।

রাতের শিশির ভুলে যায় না, বাবলা কাঁটা বেগুন কাঁটাকেও। দেখা যায়, কাঁটাতেও লটকে আছে শিশির। পাথরেও শিশির। ধূলায় শিশির।

শিশিরে সিক্ত হয়ে গাছপালা আমাকেও ডাকে।

আমাকে উঠতেই হবে ভোরবেলা।

এক-একদিন মনে হয়, ভোরে উঠতে না পারলে আমি দেখতে পাবো না, জাগরণের মহিমা।

শিশির তো সারারাত জেগেই ভোরের সময়। আমার জন্য। আমার কবিতার জন্য।

আমি মনে মনে, ললাটে ললাটে শিশির পরাই। আমি শিশির টাঙ্গাই আমার প্রতিদিনের জীবনে।

-----৮ চৈত্র ১৪২৯
-----২৩---৩---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯১




আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯১
----------------------------------------------------------

প্রভাব?
প্রভাব তো পড়ে। পারিবারিক প্রভাব। পরিবেশের প্রভাব। সামাজিক প্রভাব। কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রভাবও পড়ে। কমবেশি। সবার জীবনে।

প্রাকৃতিক প্রভাবও পড়ে। তবে অনুভবে ধরা পড়ে না।
প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক প্রভাব পড়বেই মানুষের উপরে।

একটা গাছ, শুধু একটা গাছ প্রভাবিত করতে পারে একটা জীবনকে। গাছ তার ডালপালা দিয়ে শিকড় দিয়ে ফুল ফল দিয়ে মানুষকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে। মানুষও গাছের নিকটে বিনত হয়। মানুষের মনেও হয়ে থাকে যে গাছের মতো ধৈর্য, উদার, সহনশীল এবং ফলবতী হতেই হবে। সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে একথা না--খাটলেও কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অবশ্যই।

যে শিশুর জন্ম পাহাড়তলির গ্রামে তার উপরে পাহাড়ের প্রভাব থাকবে না? যে শিশুর জন্ম জঙ্গলের কাছে নদীর কাছে, তার উপরে নদী ও জঙ্গলের প্রভাব থাকবে না?

আমার জন্ম তো মানুষের ঘরে। আর মানুষের ঘর বলেই, নানা রকম ক্রিয়া-কর্ম, লোকাচার, ব্রত, পুজো, পালা পার্বণ এবং বৃহস্পতিবারের আলপনা। আমাকে হ্যাঁ আমাকে, অতি অবশ্যই প্রভাবিত করেছে। এই তো
স্বাভাবিক। সহজ।

ছেলে যেমন বাবার কণ্ঠস্বর পেয়ে থাকে, তেমনি পরিবারের টানাপোড়েন থেকেও প্রভাব আসে। পরিবারের ধর্মাচরণ বা নাস্তিকতাও মানুষের জীবনকে
চালিত করে। প্রভাবিতও করে। তা কতটা সুন্দর কতটা অসুন্দর মানুষ নিজে কি বুঝতে পারে?

তুলসি খানের শান্ত স্নিগ্ধ নীরবতা আমার যে মনে পড়ে, এও তো এক রকমের প্রভাব। গোয়াল ঘরে বাছুরের ডাক আমার মনে পড়ে, এও তো আরেক প্রভাব।

মায়ের দেওয়া একটি কলম হারিয়ে গেলেও আমার জীবনে জড়িয়ে আছে তার কালির স্রোত।

পাশ্চাত্যের প্রভাব?
আমি তো লেখাপড়া করিনি। আমি তো লেখাপড়া করি না। আমার কাব্যদর্শনে কে আছে না আছে আমার জানা নেই। 

তবে জানি, আমার চলার পথে আর কারোর পায়ের শব্দ নেই, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

----বেলা--৪--৩৬
-----১৮ ফাগুন ১৪২৯
------৩---৩---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ ---৯২
---------------------------------------------------------

কখনো কোনোদিন একটা কবিতা আমাকে হয়রান করে মারে। তিনটে লাইন লেখার পর, বাকিগুলো এসে দাঁড়ায় না আমার কাছে। আমি না পারি ঘরে থাকতে, না পারি বাইরে থাকতে। অস্থির হয়ে উঠি। নিজেকে শান্ত করতে কোনো একটি কবিতা-বইয়ের পাতা উল্টাই। না, অস্থিরতা কাটে না। মনে হয়, এ জীবনে আর লিখতে পারবো না। এও ঠিক, এখনো অবধি কিছুই লিখতে পারিনি। যা লিখতে চাই যা বলতে চাই কিছুই পারিনি। কেবল মন খারাপে দিন যায়।

দিন যায় রে বিষাদে।

এই যে এই ফাগুনে পুরুলিয়ার চারদিকে পলাশের প্লাবন। তার উদ্দামতা আমি লিখে উঠতে পারি না। মহুলের গন্ধে গন্ধে যে বাতাস ছুটছে এখন তাকে ধরতে পারিনি। পারবো না। ফেটে পড়ছে শিমুল। তার যৌবন নিয়ে রঙ নিয়ে আমাদের কাছেই ফেটে পড়ছে। ধরিত্রীর কাছে নিবেদিত হয়ে জানান দিচ্ছে তার যৌবন। অথবা তার অস্তিত্ব।

আমি কাগজে কলমে আঁচড় কাটতে অসহায় বোধ করছি।

আমার অসহায়তা এই কারণে দীর্ঘ হয়ে ওঠে। আমি লিখতে পারি না। সারাদিন একটা লেখার পিছনে যদি পড়ে থাকি আহার নিদ্রা বন্ধ হয়ে যাবে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার বই কাছে টেনে নিই। পড়তে পড়তে মনে হয়, এই কবি দেবদূত। সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে মাটিতে একদিন নেমে এসেছিলেন। আমি তো ভিখারি। প্রতিদিন আমার ভিক্ষার ঝুলিতে ভিক্ষা না পড়তেই পারে। কিন্তু ভিক্ষা করে যেতে হবে। বারো মাস।

একটি কবিতার জন্য ভিক্ষা।

কবিতার কাটাকুটিতে আমার আস্থা নেই। অন্তর থেকে আসবে কবিতা। নিজেকে প্রশ্ন করেও থাকি, অন্তর কাহাকে বলে?

অন্তরের ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে আমার যে বেলা হলো অনেক। বাবুই পাখির বাসার মতো অন্তর যদি হয়ে থাকে, তার দুয়ারে আমার প্রবেশ আছে তো? ঝুমুর বা টুসু গানের কলিতেও আমি আমার ঠাঁই পেতে পারি। যদি সুর জানা থাকে।

সুরতো সেই অন্তরেই থাকে।

অন্তর কাহাকে বলে?

কখনো কোনো দিন পুরনো কবিতা মনে পড়লে, মুখ ফিরিয়ে নিই। আমার নিজেরই কবিতা, দুর্বল লাগে। মনে হয় আগে যা লিখেছি, এখনো যা লিখছি নিবেদনের মতো হয়নি। তাহলে মিছিমিছি এত এতগুলো দিন ক্ষয় করলাম? নিজের প্রতি রাগ হয়। বিরক্তি আসে। নতুন করে আরম্ভ করবো। আবার?

----বেলা--৩--৪৮
----২৫ ফাগুন ১৪২৯
------১০--৩--২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৯৩
---------------------------------------------------------

শুধু কি মুদ্রিত কবিতার দিকেই থাকবো? তার কাঁটাছেঁড়া তার তাত্ত্বিকতা বিষয়ে আমাদের শুধু আলোচনা চলবে? পন্ডিতি সমালোচনা, কাগুজে সমালোচনা অথবা অধ্যাপকীয় সমালোচনা আর কতদিন সহ্য করবো?

ওই যে পলাশ গাছে তিনটে পাতা, একজন মা আর একজন বাবা আরেকজন একটি সন্তান। চেয়ে আছে আমাদের দিকে। এও তো এক চরাচরের কবিতা।

লক্ষ্য করতে ভুলে যাই।

গাছ তলায় ভিখারি মায়ের সংসার। উনুন জ্বলছে। ভাত ফোটার শব্দ আসছে গন্ধ আসছে।

কবিতা বলবোনা?

পাতা ঝরে পাতা ঝরে যায়। শুকনো পাতা উড়তে উড়তে কথা বলে। কার কথা? শুধু কি নিজেদের কথা? আমার মর্ম বেদনার কথাও তো বলছে। বলছে না?

মুদ্রিত অক্ষরের বাইরেও যে প্রাণ বয়ে যাচ্ছে অবিরত, যে প্রাণের ধারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন না সমালোচকরা, তাদের থেকে সরে আসার সময় হয়েছে কবি লেখকদের।

একটি তক্ষক ভাঙ্গা পাঁচিল থেকে দেখছে চারপাশ। আমিও তো দেখবো তাকে। একটি কুকুর খাদ্যের আশায় চেয়ে আছে মানুষের দিকে। এই কবিতার সত্য জীবন সমগ্রের কবিতা।

ছুঁয়ে দেখতে ভয় করে?

সাহসের অভাব সর্বত্র। কবি লেখকদের জগতেও ভয়। অসততা ঘিরে ধরেছে সমস্ত ক্ষেত্রে। ঝরে পড়া তারার ব্যথা কে ধরবে আঁজলায়?

প্রতিদিনের চন্দ্র সূর্য মহাকালের কবিতা। তাদের আলো গ্রহণ করতে করতে ভুলে যাই, তারা দূরে থেকেও অনেক কাছে। নিকট আত্মীয়। আত্মীয়তা আছে বলেই তো এত আলো। এই আলোর দিকে সমালোচকের দৃষ্টি যায় না। কবিদের দৃষ্টি গেলেও  আংশিক। এই কারণেই, কবিতার ভেতরে আলোর কিরণ টুকু ঝাপসা লাগে।

বিষণ্ণতা হয়ে ওঠে সর্বক্ষণের সঙ্গী।

------৩/৩১
-----২৯ ফাগুন ১৪২৯
-----১৪---৩---২০২৩
-----নির্মল হালদার




আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯৪
----------------------------------------------------------

" অমরত্ব " শব্দটির কাছে দাঁড়াতে গেলেই কবিদের বিপদ। অবিরত লিখে যাওয়া ছাড়া অথবা কবিতার সঙ্গে থাকা ছাড়া আর কোনো লোভ ও চাহিদার দিকে যাওয়া যাবে না। কবি কীটপতঙ্গের কাছে যেতে পারে। যদি যেতে পারে, তাদের ভাষার সঙ্গে হয়ে উঠবে পরিচিত। তাদের সংসারের সঙ্গেও হবে পরিচয়। যদি গাছপালার কাছে কবি যায়, যদি যেতে পারে, পাতার গড়ন থেকে শিকড়ের সুর হয়তো বা জেনে যেতেও পারে।

অমরত্বের কাছে যাওয়া যাবে না।

কবি যেতে পারে মানুষের কাছে। সব সময়। কবির নিশান এখানেই।

---গোধূলি-৬/১
----৩০ ফাগুন ১৪২৯
-----১৫---৩---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৯৫
---------------------------------------------------------

দর্শন কত প্রকারের হয় এই প্রশ্নটা নিজের কাছে হলেও বোকা বোকা লাগছে। তবে কাব্য দর্শন যে একটা দর্শন, এ আমি জেনেও কুল পাইনি কাব্য দর্শনের।

কাব্য চর্চা করি অথবা কবিতা লিখি, যেমন পারি লিখে যাই। সেই কবিতারও একটা দর্শন থাকে। কি সেই দর্শন?

মনে আছে, একবার শঙ্খ বাবুর কাছে বলেছিলাম। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আলোচনা এগিয়ে যায়নি। সম্ভবত বলেছিলাম, আলোক সরকারের কাব্য দর্শনের কথা।

অনেক চিন্তা করেও আমার কাছে ধরা পড়েনি, কাব্য দর্শনের রূপ। বরং হাজারো রকম প্রশ্ন এসেছে নিজের কাছে। যেমন, পাখি সব করে রব-এ, দর্শন আছে কি নেই? কুমোর পাড়ার গরুর গাড়িতে দর্শন আছে?

আমার মাথা হিজবিজ লাগে।

এখানেও প্রশ্ন, আমার মাথায় কি আছে? ছোটবেলার মাস্টারমশাইয়ের ভাষায় যদি বলি, গোবর আছে?

গোবরে তো দর্শন থাকে না। থাকে কি? জলে দর্শন থাকে না। জলের ভিতর জল বললেই, দর্শন দেখা যায়। তাইতো? দর্শন মানেই কি তত্ত্ব? আমার এতশত জিজ্ঞাসার উত্তর আমার বন্ধু রামানুজের কাছেই জানতে চাইবো। সে পড়াশোনা করা মানুষ, সবই তার জানা।

স্পষ্ট করে বলতে পারি, আমার কবিতা বিশেষ কোনো মতবাদের প্রচার করেনা। আমার জীবনও তাই। কোনো মতাদর্শে আমি আজও কোনো আস্থা খুঁজে পাইনি।

যৌবনে বামপন্থার প্রতি অনুরাগ ছিল। তা কালে কালে ধুয়ে মুছে গেছে। উপলব্ধি করেছি, মানুষের দিকে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো রাস্তা নেই। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি আমার দুর্বলতা যদি আমার একমাত্র দর্শন হয়ে থাকে, কাব্য দর্শন হয়ে থাকে, তবে বলবো সেই দর্শন, শুভ বোধ থেকে সুন্দরতার দিকে।

একটি পাখি একা বসে থাকলে তার পাশে আরেকটি পাখি এসে বসে। একটি মানুষ একা থাকলে তার পাশে আরেকটি মানুষ এসে বসে না। কিন্তু আমি মানুষের পাশে মানুষকে দেখতে চাই। কেন না, মানুষের পাশে মানুষ না থাকলে নতুন নতুন সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যাবে না এ পৃথিবী।

-----দুপুর--২--৫৮
-----১ চৈত্র ১৪২৯
-----১৬---৩---২০২৩
----নির্মল হালদার




আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৮৬




আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৮৬
---------------------------------------------------------

একটা গীতবিতান থাকলে কবিতা লেখার প্রয়োজন পড়ে কি? গীতবিতানই একটি মহাকাব্য। তারপরে আমার কবিতা মানায় না।


মুরগির ডালা খুলে লাফিয়ে উঠল ভোর----এই পংক্তি আমার মেধা ও মননে আজও ঘুরঘুর করে। অথচ পংক্তিটিকে কবিতায় সার্থক করতে পারিনি।

হরিণের শিঙে লটকে গেছে চাঁদ-----তারপর তারপর কি? হরিণতো চাঁদ নিয়ে জঙ্গলে ছুটছে। শিঙে লটকে থাকা চাঁদের আলো ছুটছে। এই দৃশ্য আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও আমি এগিয়ে যেতে পারি না। আমি একই জায়গায় ঘুরপাক খাই---হরিণের শিঙে লটকে গেছে চাঁদ।

আমার কল্পনা শক্তির প্রতি আমার সন্দেহ জাগে। আমার মনে হয়, আমি ক্ষীণ এক মানুষ। আমি দুর্বল। কল্পনাকে কবিতায় রূপ দেবার মত সমর্থ্য নেই।

স্নায়ুর চাপ পড়ে।

অস্থির লাগে। ছটফটানির সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। অশান্তি আসে। পিপাসা এলেও জলের কাছে যাই না। এরকম এক সময়ে নিজেকে শান্ত করতেই মনে পড়ে গীতবিতান। মনে হয়, আর লেখার দরকার নেই। আমি না লিখলেও বাংলা কবিতার ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।

বসন্ত এলেই, রবীন্দ্রনাথের গান। বসন্তের গান। কই, অন্য কারোর কবিতার দিকে আমার মন তো ছুটে চলে না! একই রকম ভাবে গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত শীত শরৎ এলে, রবীন্দ্রনাথের গান। যা কবিতা। অম্লান।

চির নতুন।

মানুষের মন দেখতে পাই। প্রকৃতিকে দেখতে পাই।

প্রতিটি ঋতুর রূপ -রস-গন্ধ যে আলাদা তা গীতবিতানেই সত্য হয়ে আছে। এই সত্যকে ডিঙিয়ে
আমার কবিতা লেখা কোথাও কারো কাছেই যাবে না। আমি আর কেন লিখব?

নতুন কিছু কিংবা টাটকা কিছু বলার আছে কি? আঁকাড়া কবিতাও কি আমাকে ধরা দেবে?

আমার মনে হয়, সমস্তই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ গীতবিতানে। এই মহাকাব্যের কাছে আমি----দূর ছাই।

আমার স্নায়ুর চাপ থেকে অশান্তি থেকে মুক্তির এক ঠাঁই ------গীতবিতান।

অনেক অনেক সময় হয়েছে, গীতবিতানের একটি পংক্তি আমাকে  স্থির করে দিয়েছে। আমি আর নড়তে চড়তে পারিনি।

আজ যেমন ক'রে গাইছে আকাশ তেমনি ক'রে গাও গো।

আমার কাছে আমার প্রশ্ন----কেমন ক'রে গাইছে আকাশ? কি আছে আকাশে? কিসের সুর? আমি আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। মুখ নামিয়ে রাখি মাটিতেও। খুঁজে পাই না কোনো গান?

সূর্যতারা কি গান?

আকাশ কি রহস্যময় সুর? আকাশের রঙ কি কোনো ইশারা? ইঙ্গিত?

গীতবিতানে আরো অনেক আকাশ। এখানে আমার বলতে ইচ্ছে করছে----আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।

রবীন্দ্রনাথ তা পারতেন। আমার তো তেমন গান নেই। আমি দেয়ালে নখের আঁচড় কাটলেও কোনো অক্ষর ফুটবেনা। আমি কবিতার কাছে বারবার কেন যাব? কবিতা কি সহজ কোনো পাখি, ডাকলেই কাছে আসবে? আমি তো অস্থির একজন। আমি তো অসহায়। কেমন করে খুঁজতে হয় মনের মানুষ, আমি সাধনাই করলাম না। ডালপালা যে সহসাই উতলা হয়ে ওঠে, আমি লক্ষ্য করার বা চেয়ে দেখার অভ্যেসটাই করলাম না।

আমার কি কবিতা হয়?

ধানের খোসা খুললেই চাল হয়। কেমন করে খুলতে হয় খোসা?

-----বেলা---৪--১৫
----১০ ফাগুন ১৪২৯
-----২৩--২---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৮৭
----------------------------------------------------------

দুটি বক একই জলাশয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দুজন দু'জায়গায় থাকবে। একজন এপারে তো আরেকজন ওপারে। দুজন দু জায়গা থেকে  জোগাড় করবে নিজেদের খাদ্য। হয় তো একই গাছে দুজনের বাসা। একই বাতাসে উড়েও এলো জলাশয়ের কাছে। খাদ্য জোগাড় করবে কিন্তু দু জায়গা থেকে। কেউ কারোর খাদ্যে ভাগ বসাবে না। এরকম এক বোঝাপড়া আছে। সেই কারণেই কারো সঙ্গে কারোর বাদ-বিবাদ নেই। কাড়াকাড়িও নেই, ধারণা করতেই পারি। বেলা শেষে ঘরে যখন ফিরছে একই সঙ্গে সবাই।

প্রকৃতি সকলের জন্যই উপকরণ সাজিয়ে রাখে। যে যার রুচি মতো পছন্দমতো সংগ্রহ করে। এই নিয়মের অঘটন ঘটলেই প্রকৃতির রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়।

কোনো কোনো কবি প্রকৃতি থেকেই নিজস্ব আহারের সন্ধান করে। কেউ ব্যর্থ হয়ে পড়ে। কেউ কেউ সফল হয়ে মুঠো করে আমলকি।

ব্যর্থতা থেকেও কবিতা। সফলতা থেকেও কবিতা। দু'রকম কবিতাই পাঠকের জন্য। পাঠক বিচার করবে ব্যর্থতা নাকি সফলতা তার আহারের আলো।

কবিও খাদ্যের জোগান দেয়।

পাঠক তার রুচি মতো পছন্দমতো সংগ্রহ করবে নিজের নিজের আহার সমগ্র।

কবিতা সমগ্র।

বকের কাছে খোঁজ থাকে কোন্ জলাশয়ে কি মাছ কেমন মাছ! জলের কত গভীরে মাছের চলাফেরা বক জানে।

বক একইসঙ্গে কবি ও পাঠক এবং ধ্যানী।

তার চরণে আমার প্রণাম।

----বিকেল--৪--৪৫
----১১ ফাগুন ১৪২৯
-----২৪--২--২০২৩
----নির্মল হালদার





আমার কবিতা ----কাঠবিড়ালির লাফ --৮৮
----------------------------------------------------------

পাখিরা ডাকতেই জেগে ওঠে গাছপালা। শেষ রাতের জেগে থাকা তারা পাখির বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ে ঘুমন্ত ডিমের পাশে। তারার তাপে জেগে ওঠে জীবন।

কবিতা।

পুণ্য ভূমির কবিতা।

চরাচরের কবিতা।

কীট পতঙ্গের কবিতা।

জল স্থল আকাশের কবিতা।

এই কবিতার চলাচলের পাশে এক শিশু মায়ের আঁচল ধরে সকালের দিকে হেঁটে চলেছে।

হেঁটে যাওয়ার শব্দ কবিতা হয়ে ওঠে সূর্যের কিরণে। আমি পিছন ফিরে দেখতে পাই, মায়ের আঁচল ধরে হেঁটে চলেছি।

আমার দু চোখে জল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, সূর্যের কাছে চোখের জল ফেলতে নেই। তাকে দিতে হয় তিন আঁজলা জল। তাকে দিতে হয় তিনটে জবা ফুল।

রাস্তায় তো ফুলগাছ নেই।

শুধু পথচারীদের শব্দ। আর রাস্তার কুকুরদের হুটোপুটি। তাদের গায়ে লুটোপুটি করছে ফাগুন সকালের রোদ। শান্ত হাওয়া।

এইতো কবিতা। মহাজীবনের কবিতা। প্রকৃতি রচনা‌ করছে আমাদের জন্য। আমি এই জীবনের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছি। ভালোবেসেছি প্রত্যাখ্যান প্রত্যাশা। ভালোবেসেছি  অভিমান অবজ্ঞা। পানা ফুলের রঙ।

ভালোবাসাবাসিতে জড়িয়ে পড়লেই একটি পলাশ গাছের জন্ম। একটি পলাশ গাছে অজস্র ফুল অজস্র কবিতা।

আমার এই টাঁড় জমিতে বেড়ে ওঠে আমার কবিতা।

----৮--১৫
----১৩ ফাগুন ১৪২৯
---২৬--২--২০২৩
----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৮৯
---------------------------------------------------------

আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া
                  ধরণীতে,
এখন চল্ রে ঘাটে কলসখানি
                 ভরে নিতে।

বিষণ্ণ ছবি।

সূর্যাস্তের ছবি শুধু কি ধরণীতে? মনেও ছায়া পড়ছে। এক বিষাদের ছায়া। কালো ছায়া।
 
না-পাওয়ার বেদনাও বেজে বেজে ওঠে। তখনই একজন আরেকজনকে বলছে-----
এখন চল্ রে ঘাটে কলসখানি
               ভরে নিতে।

মনে পড়ে যায় ছোটবেলার একটি 
পংক্তি---বেলা যে গেল জলকে চলো গো।

এই জল কি শুধু জল?

আলো চলে যায়, সেই আলো ভরে নিতেও কি এই ডাক নয়?

         জলধারার কলস্বরে
       সন্ধ্যা-গগন আকুল করে,
   ওরে, ডাকে আমায় পথের 'পরে
               সেই ধ্বনিতে।
        চল্ রে ঘাটে কলসখানি
                 ভরে নিতে।

কবিতাটি কি এখানে শেষ হয়ে যায়? না। যায় না। কেন না, এখন  বিজন পথে করে না কেউ আসা-যাওয়া------

বিজন পথ? বিজন পথ বলতে রবীন্দ্রনাথ কি বলতে চেয়েছেন? এখানে? এখানে তো জল ভরার ডাক। বেলা যায়, কলসিতে জল ভরে নেওয়ার ডাক। তবে কেন বিজন পথ? বেলা শেষের জল নিতে গেলেই কি বিজন পথে যেতে হবে?

 তারপরেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন--
ওরে  প্রেম -নদীতে উঠেছে ঢেউ,
             উতল হাওয়া। 
বিজন পথে যেতে যেতেই কি, প্রেম--নদী? উতল হাওয়া?

উতল হাওয়ায় কি ভয় নাকি হৃদয় কাঁপে?

এখানে আমার অস্বস্তির কথা বলতেই হচ্ছে তা হলো, প্রেম-নদী। এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার না করে অন্য কোনো শব্দের দিকে যাওয়া যেত না?

   জানি নে আর ফিরব কিনা 
   কার সাথে আজ হবে চিনা, 
ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা 
               তরণীতে। 
   চল্  রে ঘাটে কলসখানি 
             ভরে নিতে।

অজানা বাজায় বীণা। কে অজানা? তিনি কি নৌকার মাঝি? নৌকা পারাপারের মাঝি? তিনি বীণা বাজান তরণীতে। মাঝি কি বীণা বাজান? তিনি কি সরস্বতীর বর পুত্র ? নাকি তিনি স্বয়ং ঈশ্বর? ঈশ্বরের কাছেই তো জল ভরে নিতে হয়। বেঁচে থাকার আলো ভরে নিতে হয়।

বিষণ্ণ ছবি কি মুছে যাচ্ছে? নাকি বিষণ্ণতার সঙ্গে লেপটে থাকে আনন্দ? এই আনন্দ জল ভরে নিতে যাওয়ার আনন্দ। তারপরেই তো সন্ধে নামবে।

ফুটে উঠবে অগণন তারা।

বিকেল--৫ টা--৬ মিঃ 
----১৫ ফাগুন ১৪২৯
---২৮--২--২০২৩
----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৯০
----------------------------------------------------------

লেখা যে সবসময় মাথায় ঘোরে এমনটা নয়। লেখা যে সব সময় আসেও এমনটা নয়। কখনো কখনো লেখার জন্য ধ্যান করতে হয়। সহজ করে বলতে গেলে বলবো, বসতে হয়। মন দিতে হয়।

মন দিলেই যে পাবো তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ হঠাৎ আবার কবিতার একটি বা দুটি পংক্তি আমার মাথায় বিঁধতে থাকে। আমি পংক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। এগিয়ে গেলেই যে চওড়া রাস্তা পাবো তারও কোনো নিশ্চয়তা পাই না। পঙক্তি থেকে কখনো কবিতা। সম্পূর্ণ হয়। কখনো হয় না।

প্রথমে তো সবটাই মাথাতে। লাইন বিন্যাস থেকে শুরু করে সংশোধন বা কাটাকুটি যেটুকু হয় মাথাতেই।

একটি শব্দ এসেও কখনো আমাকে আক্রমণ করে, আমাকে যেতে হবে কবিতার দিকে।

একটি শব্দ নিয়ে একটি কবিতা আমার পক্ষে কঠিন লাগে। কিন্তু শব্দটি তো আমার ভেতরে লেপটে গেছে। তাকে না ছাড়ালে, আমার মুক্তি নেই।

মুক্তি কি সহজে আসে?

দেখা গেল, শব্দটি রয়ে গেল। সৃষ্টি হলো অন্য একটি কবিতা। কিন্তু শব্দটি তো মাছের কাঁটার মতো খচখচ করে। তাকে তুলে ফেলতে হলে, একটি কবিতা চাই।

না, হয়ে ওঠে না।

তখন মনে হয়, শব্দটির ওজন নেই। ধার নেই। অথবা শব্দটি আত্মস্থ করতে পারিনি।

যেকোনো শব্দের ক্ষেত্রে একই কথা, আত্মস্থ করতে না পারলে শব্দটি আসবে না। আমি যদি এক্ষুনি একটা আরবি শব্দ পাই এবং আমার পছন্দ হয়, আমি কি ব্যবহার করতে পারবো আমার কবিতায়? শুধু আরবি শব্দ নয় কোনো লোকজ শব্দ আমার ভালো লাগলেই কি সঠিক ব্যবহার করতে পারবো?

সব মাটিতে যেমন ফসল ফলে না তেমনি সব শব্দ থেকেও উঠবে না ঝংকার।

গাছ একটি কবিতা হলে সমস্ত পাতাই শব্দ। কিন্তু সমস্ত শব্দ কবিতা নয়।

কুমারী নদী থেকে সোনা খোঁজে কুমারী সংলগ্ন গ্রামের মানুষ। কাঁসাই সংলগ্ন গ্রামের মানুষ কাঁসাই থেকে জল খোঁজে। কেউ কেউ জল পেতেও পারে। কেউ কেউ সোনা।

ভোরের বাতাস থেকে আবহ থেকে আমি যে কবিতা পাবো আমি কথা দিতে পারি না।

কার কাছে কথা? নিজের কাছে?

সেও তো এক জটিলতা। নিজের কাছে কথা দিলে নিজেকে রাখতেই হবে।

সব সময় কথা রাখাও যায় না।

আমি আজ চাইছিলাম ডুমুরের বীজ। তার বদলে পেলাম, গাছের গায়ে গাছের পাতায় ধুলো আর ধুলো।

কীভাবে মুছবো এই ধুলো?

অভিমানী এক মুখ দেখতেও পেলাম। মুছবো বললেও মুছতে পারিনি অভিমানের কালো রঙ।


রঙও কবিতা। কবিতা হয়ে ওঠে। সর্ষে ক্ষেতের হলুদ ওড়াতে চাইলেও আমি পদিনার ক্ষেত থেকে গন্ধ নিতে নিতে সবুজ হয়ে যাই।

আমার বাসনা বা আমার ইচ্ছেয় সবকিছু ঘটবে না। আমার মন প্রাণ চাইলেও আমার মুঠোয় ধরা পড়বে না আমলকি। মুঠো খুললেই দেখতে পাই, জাম।

আমার করতল কালো হয়ে গেছে।

আমি কৃষ্ণকে পাবো?

আমার চারপাশে রাধার মতো কত যে অভিমানী মুখ।

কবিও তো রাধা। রাতের পর রাত জেগেও  শব্দ পায় না। শব্দ পেলেও শব্দ করে না টুংটাং।

প্রায় প্রতিটি রাত বাদুড় ঝোলার মতো ঝুলে থাকে।

কবির ঘুম নেই।

কালীকৃষ্ণ গুহর একটি কাব্যগ্রন্থ "হে নিদ্রাহীন "।

নিদ্রাহীনের পাশে এক গ্লাস জল তৃষ্ণাকে আরো দীর্ঘ করে। কবি কলম দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ওল খুঁজে পায়। সে খুঁজছিল আলু। বাদাম। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁজে পায় এলোমেলো শিকড়।

এইবার সে দেখবে কোন্ শিকড়ে লেগে আছে মাতৃপুরুষ পিতৃপুরুষের ঘাম।

রক্ত ঘামই তো কবিতা।

----দুপুর --৩--৪
---১৬ ফাগুন ১৪২৯
----১--৩--২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ



আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ-- ৮১
---------------------------------------------------------

কোনো বিশেষ শব্দ কোনো বিশেষ শব্দবন্ধ আমার পূর্ব পরিচিত হলেও হঠাৎ করে কোনো কোনোদিন অচেনা লাগে। নতুন লাগে। আমি শব্দটির প্রেমে পড়ি। শব্দবন্ধটিও আমাকে লোভী করে। মনে হয়, এই শব্দের কাছে, শব্দবন্ধের কাছে আমার কবিতাকে নিয়ে যাই।

কেমন করে নিয়ে যাব?

আমার মাথায় ঢুকে গেলেও আমি তো আত্মস্থ করতে পারিনি। ব্যবহারিক জীবনেও কতশত শব্দের আসা-যাওয়া। কাকেই বা ধরতে পেরেছি! কাকেই বা 
আমলকির মত মুঠো করেছি!

ছেঁদা কিংবা ছিদ্র আমার খুব চেনা। কাছেরও। অথচ ছেঁদা শব্দটি যত অনায়াসেই ব্যবহার করি না কেন, ছিদ্র শব্দটি ব্যবহার করিনা। কারণ, ছিদ্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মাখো মাখো নয়।

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, ভাতের হাঁড়ি ছেঁদা হয়ে গেছে। জলের কলসি ছেঁদা হয়ে গেছে।

আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারে আমার নিরক্ষর মায়ের কাছে প্রথম শুনি " লোল "শব্দটি। বাক্যটি ছিল এরকম-----মা বসে বসে ঘর ঝাঁট দিতে দিতে বললো---আর কি পারি রে বাবা, গায়ের চামড়া লোল হয়ে গেছে।

শব্দটি আমার ভিতরে গেঁথে গেলেও আমি আজও ব্যবহার করতে পারিনি।

কতোবার তো শুনেছি-----ঘরের কোনো এক জেঠি বা খুড়ি কাউকে নির্দেশ করছে----ছোট বউকে বলবি সে যেন লাজ দুয়ার দিয়ে ঘরে আসে।

আমাদের গ্রাম বাংলায় একসময় সদর দুয়ার এবং লাজ দুয়ার সমস্ত পরিবারেই ছিল। সদর দিয়ে মেয়েরা ঘরে ঢুকলে আব্রু থাকবে না। সেই কারণেই, লাজ দুয়ার।

আমার লেখাতে লাজ দুয়ার নেই। সবটাই সদর। আমি যা আমার শব্দ তাই। একেবারে খোলামেলা।

শব্দেরও রহস্য থাকে, জানি। শব্দেরও মায়া থাকে, জানি। আমি চাই বা না চাই কোথাও না কোথাও রহস্য ও মায়া আমাকে ঘিরে ধরবে। শব্দের জালও থাকে, একবার ধরা পড়লে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া কঠিন। আকাশ আমার কবিতায় ঘুরে ঘুরে আসে। তখন আকাশ আর শব্দে থাকছে না। আকাশ তখন অসীম। শব্দের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আমাকে নিয়ে যায় অসীমের দিকে। জল আঁজলাতে নিয়েও জলের প্রবহমানতা আমি ভুলি না। ভুলবো কেমন করে মাটির বিস্তার!

ভুলি নাই, আমাদের কথ্য শব্দগুলি। পুরুলিয়া জেলায়
মানুষের মুখে মুখে ফেরে অনেক অনেক শব্দ, যার রূপ যার ব্যঞ্জনা ব্যবহার করতে হলে, শব্দকে খেলাতে হবে রক্তে। এখন আমি যদি পেঁদা শব্দটির কাছে যাই, আমাকে ভাবতে হবে শব্দটির ওজন। এবং কবিতার বিষয়। যখন তখন যেখানে সেখানে যে কোনো শব্দ ব্যবহার করা যায় না। প্রাত্যহিক জীবনে যেমন, কবিতার ক্ষেত্রেও এক। হলুদ বললে আমি গাঢ় রঙ দেখতে পাই। হলদে বললে হালকা হলুদ দেখি।

আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমার চেতনা শব্দ গ্রহণ করে। শব্দকে বর্জনও করে। আমার পরিবার থেকে আমার সমাজ থেকেও যে সমস্ত শব্দ আমি পেয়ে থাকি, সব কি আর ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারি! মাড় ভাত বললে, দীপ্ত এক ভঙ্গিমা দেখি। যেন এক দিনমজুর
সকালবেলা মাড় ভাত খেয়ে উঠছে। এবার কাঁধে তুলবে গাঁইতি-কোদাল। যা ফ্যান ভাত খেলে দেখতে পাবো না। ফ্যান ভাতে জোর নেই। মাড় ভাতে পেশি ফুলে উঠতে দেখি। পুরুলিয়ার রুখা-শুখা কঠিন মাটির মতোই দিনমজুরদের চেহারা। সাহসী চেহারা। পাহাড় ডিঙিয়ে কাজের শহরে যায়। অথবা পাহাড়ে যায় গরু ছাগল চরাতে।

শব্দ নিয়ে বলতে হলে নাকছাবির কথা বলতে হয়, আমি অনেকবার ভেবেছি, নাকছবি না নাকছাবি? নাকছবি বললে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যেহেতু, আজীবন শুনে আসছি, নাকছাবি। রক্তে শিরায় শিরায় নাকছাবি চলাচল করে।

জ্বলজ্বল করে মায়ের নাকে। দিদিদের নাকে। এই নাকছাবি তো হলুদ বনে হারিয়েও যায়।

হলুদ বন যে নির্জন।

নির্জনতা প্রেমে ভালোবাসায়। মন খারাপে। আর জনতা নির্জন হয়ে গেলে? সম্প্রতি প্রকাশিত বিভাস রায়চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থের নাম, জনতা নির্জনতা।

আমি চমকে উঠেছি।

জনতা মানেই জোট। জনতা মানেই ভিড়। জনতা মানেই কোলাহল। বিভাস তা কিন্তু বলছে না, বিভাস বলছে-----জনতা নির্জনতা। কেন বলছে জানার জন্য কাব্যগ্রন্থটি সকলেরই পাঠের প্রয়োজন।

পাঠক আছেন। একাকী নির্জন।

-----বেলা--১২--৪৯
-----৪ ফাগুন ১৪২৯
-----১৭---২---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--৮২
-------------------------------------------------------

আমার জীবনে নদীর ভূমিকা? আছে আছে। ছোটবেলায় সুবর্ণরেখাকে পেয়েছিলাম। বড় হতে হতেই হারিয়ে ফেলেছি। কাঁসাই আমার কাছে থাকলেও কাছে নেই। বারো মাস জল থাকে না। জল না থাকলেও যদি কাছে থাকতো, তার কাছে অনেক গল্প-গাথা আমার ঝুলিতে জমে উঠতো।

আমিও অভাবের কথা হাহাকারের কথা বলতে বলতে দিনরাত্রি। কেন না, আমাদের যে নিত্যদিন জল নাই জল নাই। তারপরেও আমার খুব প্রিয়, আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে।

বৈশাখ মাসে হাঁটু জলও থাকে না। কাঁসাইয়ের কাছে যারা থাকে তারা চুঁয়া খুঁড়ে জল। এক কলসি। দু' কলসি।

এই যন্ত্রণা কখনো কখনো কবিতা। কখনো কখনো দিনলিপি। আমার দীর্ঘশ্বাস।

কে আর শোনে?

নদী যে সকলের জীবনেই এক অহংকার। অলংকার। সাজসজ্জাও। অনেক ছোটবেলায় লিখেছিলাম--- যতই চুলে টেরি কাটি যতই পরি জামা কাপড় নদী ছাড়া বেমানান লাগে।

নদীমাতৃক হয়েও আমরা পুরুলিয়ার মানুষ আজও বেমানান। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা ভোটের বাক্সে। নদী মুখ নদীর পথ আগাছা ও মাটিতে পরিপূর্ণ হয়ে রুদ্ধ করেছে জলের গতি। সংস্কারের দিকে নেই, দুয়ারে সরকার।

আমার চেঁচামেচি আমার লেখা কে শুনবে? আমার অভাবে শুধু বালি ওড়াউড়ি। টিউকল থেকে ওঠে লোহা রঙের জল। কোথাও কোথাও আহত টিউকলের নিঃশব্দ গোঙানি।

আমি লিখবো না?

কাছে গিয়ে দূরে থেকেও কোপাইকে ভালোবেসেছি। সেও তো ঢাকা পড়ছে কংক্রিটে কংক্রিটে।

যেদিকে বাড়াবো হাত অন্ধকার। যেখানে রাখবো পা গর্ত আর গর্ত।

কবে আর মাথার চুড়া হবে আমার নদী?

গন্ধেশ্বরী দ্বারকেশ্বর কুমারী শীর্ণ হতে হতে তাদের দশা যে কি হবে মালুম করতে পারি। দেখতে পাই, নদীর জমিতে কল কারখানা। বহুতল বাড়ি। নদী তো আর বিলাস নয় নদী আমাদের কাছে বহমান এক জীবন।

নিবারণ করে আমাদের যাবতীয় তৃষ্ণা। ভালোবাসার জন্য আমরা আরও উন্মুখ হয়ে উঠি।

কবিতার দিকে যাই।

কবিতাও এক নদী। তার অবমাননা অপমানও দেখতে পাই যত্রতত্র। শিল্প যে সাংস্কৃতিক মাফিয়াদের মুঠোয় চলে যাচ্ছে, কে করবে প্রতিবাদ?

প্রতিবাদী কন্ঠস্বরও হারিয়ে ফেলছি। ঘুমিয়ে পড়ছি যেখানে সেখানে যখন তখন।

হে মানুষ, এই ঘুম ক্ষমা কোরো না।

----বেলা ১১--৩০
-----৬ ফাগুন ১৪২৯
----১৯---২---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৮৩
---------------------------------------------------------

রাস্তায় ভিখারি।

ক্ষুধার্ত কবিতা।
কে পড়ে? কারা পড়ে?

খিদেই তো একমাত্র সত্য। আর সত্যই তো কবিতা। লেখা হয় কি?

সত্যের কাছে দাঁড়াতে সাহস লাগে। সাহসী কবিতা লেখা হয় কি?

সত্যের সঙ্গেই থাকে সাহস। শিরদাঁড়া টানটান।

শিরদাঁড়া থেকেই ছুটে যায় তির।

যেকোনো অন্ধকারের দিকে ছুটে যায় তির। জ্বলে ওঠে প্রদীপ। প্রদীপের শিখা, উর্ধ্বশিখাই তো কবিতা।

মাথা নিচু করতে করতে রাস্তা দেখা গেলেও ধুলোবালি মাটি দেখা গেলেও মাঝেমধ্যে মাথা উঁচু করতেই হয়।

আকাশকে দেখতে হয়।

আকাশ সবসময় এক আলোর কবিতা। এই কবিতাই তো মাথা গোঁজার আশ্রয়। যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখা। আশ্রয়হীন হয়ে পড়লে দাঁড়াবো কোথায়?

এই কবিতাইতো সত্যি কথা বলে।

পিপাসা ও পিপাসা নিবারণ দুটোই সত্য। সেই সত্যকে জানতে হলে, সততার কাছে দাঁড়াতে হয়। এখানে আরেকটা কথা------ সৎ কিংবা সততা ভয়ংকর। তার সঙ্গেই লড়াই করার জন্য বাহ্যিক জীবনের চাহিদাকে ত্যাগ করতে হয়। ত্যাগও কবিতা বৈকি।

ক'জন ত্যাগ করে?

লোভ ও লালসা থেকে দূরে থাকা সহজ কাজ নয়। সহজ নয়, এই এক জীবনের আলো ছায়া। তার কাটাকুটি থেকে যে বেদনার ক্ষরণ হয়, তাকে ক'জন দেখে?

কবি দেখেন? পাঠক?

শুধু পাহাড় দেখলে হবে না, জঙ্গল দেখলে হবে না, নদী সমুদ্র দেখলে হবে না, দেখতে হবে তার ভেতরের আগুন।

খিদের আগুনের মতোই সত্য।

আড়াল করলে হবে না।

----১--৪৪
----৭ ফাগুন ১৪২৯
----২০---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--৮৪
-------------------------------------------------------

নদীর কাছে প্রতিদিন দাঁড়ালেও আমি নদীর শব্দ কবিতায় ধরতে পারি না। সংগীত যা পারে কবিতা তা পারে না। সংগীত বা সুরের যা ক্ষমতা তা কবিতার নেই। আর্তনাদের ভাষা শব্দে ধরা যায় না। সংগীত ধরতে পারে। কখনো কখনো বিপন্নতার ছবি কবিতায় আসে। সার্থকতার সঙ্গেই আসে। গদ্য ভাষায় তো আসেই বিপন্ন মুখের ছবি।

নদীর বর্ণনা কবিতা ও গদ্যে নানা রূপে এলেও আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের ওই যে--------আমাদের ছোট নদী চলে এঁকেবেঁকে---

"এঁকেবেঁকে "বললেই কোমর বেঁকিয়ে চলে যাচ্ছে নদী এই ছবিটি দেখতে পাই। তারপরে নদীর ছবি যাই দেখি না কেন, আমার পছন্দ হয় না।

"এঁকেবেঁকে" বললেই আরেকটা চিত্রকল্প আমার সামনে আসে, মনে হয় এঁকেবেঁকে আলপনা আঁকছে কেউ।

নদী তো যেতে যেতে আলপনাও আঁকে দু'পারে। ফসলের আলপনাও দেখতে পাই। সারা বছর।

সংগীতও এই ছবি দেখাতে পারে। সুরে সুরে। কথায়। শুধু সুর দেখাতে পারে কি? যদি কথা না থাকে?

শিল্প তো অসীম। প্রশ্ন এই, অসীম কি সহজ করতে পারে স্পষ্ট করতে পারে আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং জীবনের কলরোল?

সংশয় সন্দেহ  থেকে এগিয়ে যেতে যেতে পাখির পায়ের ছাপ যত সহজে আঁজলায় রাখি সুর পারবে কি?

সুরের সঙ্গে কথা থাকলে পারতে পারে। এখানে বলতেই হচ্ছে, শিল্পেরও কোথাও কোথাও সীমা আছে। অতিক্রম করতে চাইলেও সীমানা ভাঙ্গা কঠিন হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় কখনো কখনো, জীবন থেকে অনেক দূরে শিল্পের ঠিকানা।

জীবন ও শিল্পের একটা লড়াইও আছে। কখনো জীবন জয়ী। কখনো কখনো শিল্পের জয়। দু' রকম খেলাই ঘটে চলেছে। প্রতিদিন।

ঘুমের যে প্রসারতা স্বপ্নের হোক বা দুঃস্বপ্নের, রঙ- তুলি--কলম ও সুর ধরতে পারবে না কক্ষনো। ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু---বললেও  ক্লান্তির যে প্রকৃত রূপ পটে আঁকা যাবে না।

সুরে আঁকা যাবে? রঙে আঁকা যাবে?

অনেক প্রশ্ন। কৌতুহলও আছে। নিজের কাছে প্রশ্ন। অপরের কাছে প্রশ্ন। কৌতুহল সর্বদা।

পিছন থেকে এক যুবকের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে চলে গেল পাখি। কেন গেল? লালসা? লোভ? প্রেম? যৌনতা?

আমি ঘুরে বেড়াই। উড়ে বেড়াই। সুরে। সুর হীনতায়। রঙে। রঙ হীনতায়।

মেলাবেন তিনি মেলাবেন এই আশ্বাসে আমার দু'বেলা আহার ।

----দুপুর --২--৫
-----৮ ফাগুন ১৪২৯
----২১---২--২০২৩
----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--৮৫
-------------------------------------------------------

মানুষ তার বাঁচার অধিকার নিয়ে রাস্তায় নামে। লড়াই করে। বনধ্ ডাকে। অবরোধ করে।

পৃথিবীর আর সব কীটপতঙ্গ পশু-পাখির অধিকারের কথা কে বলবে কারা বলবে? দিন দিন না-বলা প্রাণীদের জীবনযাপন যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই কই?

মানুষের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, বাকি সমস্ত প্রাণীদেরও আছে। এ কথা উপলব্ধি করতে মানুষের দেরি হয় কেন?

শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠায় এই সমস্ত প্রাণীদের জন্য কলমের একটি আঁচড়ও নেই। মানুষের দুঃখ বেদনা আনন্দ বিষয়ে কোনো বিরোধ নেই। পাশাপাশি আশা করতেই পারি, মানুষের বাইরেও যে সমস্ত প্রাণ এই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে, তাদের কথাও ভাবতে হবে। ভাবার সময় এসেও গেছে, নইলে শেষ হয়ে যাবে এই পৃথিবী। শিল্প সাহিত্যের পতনের ছবিও দেখা যাবে।

শিল্প সাহিত্য তো প্রাণী জগতের বাইরে নয়। সকল প্রাণ বেঁচে থাকলে শিল্প সাহিত্য বাঁচবে। বাস্তব যদিও, অন্যান্য প্রাণীদের মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে আধুনিক প্রযুক্তি আধুনিক পুঁজি।

কবিতা এই জায়গাতে অবিচল। শিল্পের বাকি শাখাতেও সাড়া-শব্দ নেই। লক্ষ্য করা যায়, শিল্পী সাহিত্যিকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যতটা সচেতন, ততটা সচেতন নয় দেশ কাল সময় সম্পর্কে।

প্রাণের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক সহজ হলেই, প্রতিটি প্রাণ বেঁচে থাকার জায়গা পাবে। অধিকার তো পাবেই।

মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াবার জায়গা পেলে মানুষের পাশে পশু পাখিও দাঁড়াবে।

শিল্প সাহিত্য সকল প্রাণের ধারায় কথা বলবে। উঁচু হয়ে।

-----দুপুর--২--৫৬
-----৯ ফাগুন ১৪২৯
-----২২---২--২০২৩
------নির্মল হালদার




আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ



আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৭৬
----------------------------------------------------------

দুপুরে একবার ভাত না খেলে তৃপ্তি হয় না। সারাদিন মনে হয়, কিছুই খাওয়া হয়নি।

আবার এও ঠিক, একা খেতে ইচ্ছে করে না। পাশাপাশি এটাও ঠিক, কার সঙ্গেই বা খাবো! তারপরেই ভাবি, আছে আছে আছে। অনেকেই আছে অনেকের সঙ্গে খাবো। সবাইকে খাইয়ে খাবো।

আমি কি খাই?

আমার হয়ে পালক খায়।

আমার সামনে ভাত এসে গেলেই, আমি পালককে হাঁ করতে বলি-------এবং সে হাঁ করলেই, আমার দু আঙুলের ভাত প্রথমে হাতি খায়। তারপরেই পালকের কাছে জানতে চাই এবার কে খাবে? সে বলে, ঘোড়া।

এবার কে খাবে?
বাঘ।
এবার?
সিংহ।
এবার কে খাবে?
হরিণ।
তারপর?
জিরাফ।
পালক কখনো কখনো কোনোদিন নিজেই বলে, এবার খাবে গরু। তারপরেই আমি বলি, এবার খাবে গাধা। সে বলে, ছাগল খাবে, ছাগল খাবে। পায়রাও খাবে।

এদের সবার খাওয়া হয়ে গেলে, পালক খায়। পালকের পরেই, ডোডো দাদু।

এই আমার একলা খাওয়া দোকলা খাওয়া। অথবা বলতে পারি, একলা--ফেকলা দুজন পাখি সবার সঙ্গে খায়।

আমার চারদিক থেকে বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়া কীটপতঙ্গ পাখিরাও আমাকে ভালো থাকতে বলে।

আমিও কুশলে থাকি।

সকালে তুলসি গাছে জল দিয়ে সমস্ত গাছের গোড়ায় জল দিতে দিতে সূর্যের দুয়ারে জল দিয়েছি।

এই জল অনন্ত।

আমাদের আহারও অনন্ত।

পালক আছে রাতেও। আমাকে ন'টা হামি দেবেই। তারপর আমার শুতে যাওয়া।

আমি দেখতে পাই, আমার পালক আমার পিতা আমাকে জোগান দিয়ে যাচ্ছে, নিটোল একটি ঘুম।

------২৮ মাঘ ১৪২৯
-----১২---২---২০২৩
----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৭৭
----------------------------------------------------------

সম্পর্ক কাকে বলে?

সম্পর্কের সরলতা সম্পর্কের জটিলতা কাকে বলে?

সম্পর্কে খালডোব থাকে?
হ্যাঁ থাকে।
সম্পর্কে মসৃণতা থাকে?
হ্যাঁ থাকে।

সম্পর্ক নিয়ে যে যাই বলুক, আমি সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাসী। আমি সম্পর্ক লালনে বিশ্বাসী। সম্পর্ক আমার ঘর। আমার পরিবার।

অনেক অনেক দিন বাদে কলকাতা যাব। বইমেলা উদ্দেশ্য হলেও বন্ধুদের কাছে যাব। কত কতদিন দেখা হয়নি, দেখা হবে কথা হবে। নিঃশব্দে উষ্ণতা বিনিময়।

কোথাও কোথাও খবর দিয়েছিলাম----আমি যাচ্ছি। যেমন হাতিবাগান। বাগবাজার। সল্ট লেক। অজস্র ঘর, সবাইকে খবর দিতে হলে কলকাতায় থাকতে হবে অনেকদিন। তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, শুধুমাত্র একটা রাত দুটো দিনের জন্য যাওয়া। তবে খবর দিতেই হয়েছিল, সুরজিৎ পোদ্দারকে। খুব আশ্চর্য রকমের ছেলে। কবিতা চর্চার পাশাপাশি সমাজ চর্চাও করে। তার বন্ধুরাও খুব চমৎকার। বলেছিলাম, কালীদা, একরাম, স্বপন চক্রবর্তী দুর্গা দত্ত এবং বিভাস রায়চৌধুরী ইত্যাদি ইত্যাদিকে।

কবি কালী কৃষ্ণ গুহ সবার কাছেই কালীদা। তিনি আমাদের অগ্রজ বন্ধু। আমার কাছে এক আশ্রয়। এক অনন্য আশা। আমি বলেছিলাম, আপনার কাছে বেলা ১১ টায় পৌঁছে যাবো। এগারোটা বাজতে বাজতেই, তাঁর ফোন। আমরা তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে তাঁর আস্তানায়। কালীদা আমার সারা জীবনের কাছে এক পরম প্রাপ্তি। কত কিছু যে তাঁর কাছে পাঠ নিয়েছি। সাহস পেয়েছি, লেখালেখি করার। আমরা কোথায় খাবো, না-খাবো এও ছিল তাঁর জিজ্ঞাসা। এও এক রকমের পেট ভরে গেল আমাদের। মন ভরে গেল আমাদের।

সাতসকালে একরামের ফোন। কখন যাবো তার কাছে তারও ছিল এই প্রশ্ন। আমি বললাম নটার মধ্যে। সে জানালো, আমরা যেন ন'টাতেই যাই।

একরাম, একরাম আলি ৭০ দশকের একজন প্রধান কবি। সেই কবে থেকে যোগাযোগ। বন্ধুত্ব। সুখ দুঃখ। আনন্দ বেদনা। তার বীরভূমের গ্রামের বাড়িতেও
হঠাৎ হঠাৎ আমার চলে যাওয়া। দিনভর রাতভর তুমুল কাব্য-কবিতা। প্রভাতদা বাবলিদির সিউড়ির বাড়িতে। রাত্রিকেও বেঁধে রাখার এক অপচেষ্টা ছিল আমাদের। মনে হয়েছে, রাত ফুরালেই শেষ হয়ে যাবে আড্ডা। সেই একরাম আমার কাছে জানতে চাইলো, আমরা কজন আছি, কী খাবো।

বারান্দায় মাঘ শেষের রোদ্দুর মেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল একরাম। বীরভূমের লাল মাটির মতোই, তার রক্তিম অভিবাদন ও অভ্যর্থনায় মুহূর্তের জন্য আমি দেখতে পেলাম, সারি সারি তাল গাছের ছায়া।

এই ছায়াইতো রসিকের ছায়া।

হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ধ্যানী এক কবি। কথা দিয়েছিল, দেখা হবে। আমিও স্থির বিশ্বাসে ছিলাম, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা হবেই। দেখা তো হয়েছে, দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন ও আলোতে রসদ পেয়েছি বেঁচে থাকার।

কবিতা আশ্রমে বিভাস আমাকে জানালো, আমি খুব জ্যান্ত আছি। অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জ্যান্ত আছি। কতটা জ্যান্ত আছি আমার জানা নেই। আমি জানি, আমার জিয়নকাঠি আমার ভালোবাসা। বিভাসের মতো তরুণ বন্ধুর ভালবাসাও আমাকে বাঁচতে সাহায্য করে। অমিত সাহা কনক মন্ডলদের মুখের আলোয় চলার পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে সব সময়।

আন্তরিক আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম " ঐহিক " সম্পাদক ও গদ্যকার তমাল রায়ের কাছ থেকে।

আমার কথা হলো, পরিবার থাকলেই একটা টান থাকে। আত্মিক টান। যে আত্মা থেকে আত্মায় আমিও ঘুরতে থাকি। ভালোবাসা নিতেও থাকি তা যতই ক্ষুদ্র হোক, তুচ্ছ হোক আমি নিতে ভালবাসি। যেমন, ঝুপ্পিকে বলেছিলাম----- সজনে ডাঁটার তরকারি খাওয়াবি। সে আমার অনেক আব্দার ও অত্যাচার সহ্য করে আসছে অনেক যুগ। তার ঘরেই তো সঙ্গী সাথী নিয়ে আমার ভালোবাসার সময় কেটেছে।

সঙ্গী সাথী ছাড়া আমি তো এক পাও হাঁটতে পারি না। এই যে আমার নির্ভরশীলতা, আমাকে বড় দুর্বল করে দিয়েছে। এবারের কলকাতা বইমেলা অথবা কলকাতা  ভ্রমণে উত্তম তো ছিলই, সে কাব্য চর্চা করে। ছবি আঁকে। সঙ্গে আরও ছিল অবিন ও বাপি। এই দু'জন কবিতা থেকে অনেক দূরে থাকলেও আমি তাদের কাছে পাই। অন্যভাবে বলা যায়, ওরা কবিতার কাছেই থাকে।

দূরে থেকেও কাছে থাকে অনেক বন্ধু। অনেক বান্ধবী। তাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আমার অস্তিত্ব। আমাকে জাগিয়ে রাখে।

কলকাতা যাচ্ছি বলেই, একদিন নন্দিনীর ফোন। তাদের বাড়ি কবে যাবো, কী খাবো এইসব খবর নিয়েছিল।

আমি একটি বটবৃক্ষের ছবি দেখতে পেলাম। বট বৃক্ষ না বৃক্ষ মাতা?

নিঃশর্ত প্রেমের এক সজীবতায় আমি সবুজ হয়ে উঠেছি। মনে হয়েছে, আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আরো কয়েকটা বসন্ত।

পলাশ গাছের তলায় নন্দিনী গাইবে রবীন্দ্রনাথের গান। তার গানে গানে আবেগে ও আনন্দে ঝরে পড়বে পলাশ ফুল।

এই সেই বসন্ত আমাদের দুয়ারে।

আড়াল থেকে এসে নন্দিনীর খোঁপায় রঞ্জন গুঁজে দিচ্ছে পলাশের শুভেচ্ছা।

-------২৯ মাঘ ১৪২৯
------১৩---২---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৭৮
----------------------------------------------------------

হাসি
এই ফাগুনে আকাশে বাতাসে।
হাসি
এই ফাগুনে গাছে গাছে।

এই হাসি ফাগুন থেকে বৈশাখ।
এই হাসি বর্ষা থেকে হেমন্তে।
এই হাসি কাশফুলে। শিউলি শাখায়।

এই হাসি বন্ধুর মুখেও।

এই হাসি ভালোবাসার মুখেও।

আমি অবাক হয়ে দেখি।

এই হাসির শব্দ শোনা যায় না।
এই হাসি নিঃশব্দ। চন্দ্র সূর্যের আলো।

আমি নিকটে দাঁড়াই। স্পর্শ করতে গিয়ে  ঝরে পড়ে আমার আঁজলায়।

আমার আঁজলায় কবিতা সংগ্রহ। শ্রেষ্ঠ কবিতা। আমার আঁজলায় তৃষ্ণা।

প্রসূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃষ্ণা।

তৃষ্ণা নিবারণ করতে প্রসূণ এগিয়ে চলেছে রাস্তা থেকে রাস্তায়। ভিড় থেকে নির্জনে। ভালোবাসা থেকে আলো বাসার দিকে। প্রসুণের মুঠোয় ধরা পড়বে জল থেকে জলের কণা।

জোনাকির উড়াল।

হৃদয়ের তাপ।

হৃদয়ের তাপ পাই  প্রসূণের কথা থেকে কবিতা থেকে। ব্যথা থেকে আনন্দ থেকে।

তার কবিতা সংগ্রহ তার শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে উদযাপন করি আমাদের বন্ধুত্ব।

-----১ লা ফাগুন ১৪২৯
-----১৪---২---২০২৩
------নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৭৯
---------------------------------------------------------

যেখানেই যাব উজ্জ্বলের সাইকেল। সাহেব বাঁধ বা সুভাষ পার্কে ছিল মনোরম আড্ডা। উজ্জ্বলের স্কুল ছুটির পর কিংবা ছুটির দিনে তার সাইকেলে উঠে পড়েছি।

সাইকেলের সামনে বসে থাকাও বেশ বিপদের। দেখতে হয়, গাড়ি ঘোড়া। আর উজ্জ্বল যা গতিতে গাড়ি চালাতো, ভয় করতো আমার। যদি পড়ে যাই!
একবার তো ট্রাকের তলায়। চাকার নিচে। ইউনিয়ন ক্লাবের কাছে। সামনের স্ট্যাড থেকে রিক্সাওয়ালারা দেখতে পেয়ে, চিৎকার। জ্যাম থাকার জন্য ট্রাক চলছিল ধীরগতিতে। কেউ কেউ দূর থেকেই, ট্রাক থামাতে বলছিল। রাজুর চায়ের দোকান থেকেও রব উঠেছিল---গেল গেল গেল।

সে যাত্রায় বেঁচে গেছলাম। আর তাই, উজ্জ্বলের সেই সাইকেলটা মনে পড়ছে।

ময়ূখের সাইকেলে আমি কি উঠেছি? তার সঙ্গে সিনেমা হল। সে তো আমাদের বাড়ির কাছেই। ময়ূখ সাইকেলে থাকলেও আমার মনে হচ্ছে, তার সাইকেলে
আমি উঠিনি। হয়তো বা সঠিক তথ্য দিতে পারে ময়ূখ নিজেই।

রামাশিসের সাইকেলে যে উঠিনি স্পষ্ট মনে আছে। তখন সেই ৮৫--৮৬ সালে উজ্জ্বল ময়ূখ রামাশিস ১১/১২ তে। পুরুলিয়া জিলা স্কুল। সায়েন্স। সাইকেলেই স্কুল।

ওরা অনেকবার আমাকে বলেছে, চলুন---আপনাকে সাইকেলটা শিখিয়ে দিই। দুদিন সাহেব বাঁধ গেলেই হবে।

তখন সাহেব বাঁধের চারপাশে এত বাড়ির ভিড় ছিল না। দোকানপাট নার্সিং হোম ছিল না। মুক্ত আবহাওয়ার নান্দনিক পরিবেশ। সেই জায়গাতে এক স্কুল বালক ৪০ ঊর্ধ্বের এক লোককে সাইকেল চালানো শেখাচ্ছে, কারোর চোখে পড়লেও লজ্জায় ফেলবে না। বোধ হয় এই মনোভাব, বিশেষ করে উজ্জ্বলের ছিল। সেইতো আমাকে সাইকেল চালানোর কথা বারবার বলেছে। কারণও ছিল, বেশিরভাগ সময়েই তাকেই টানতে হতো আমাকে।

আমার প্রতি টান ভালবাসাও ছিল তীব্র। সাধারণত, উজ্জ্বল ও ময়ূখ যে কোনো আড্ডাতে থাকলে আমি ময়ূখের সঙ্গেই কথাবার্তা। গভীর। অগভীর। সেই তখন উজ্জ্বলের মনে হয়েছিল, তার ভালোবাসাতে কম পড়ছে। লক্ষ্য করা গেল, সে চুপচাপ হয়ে যেত। অথবা চলে যেত বাড়ির দিকে মুখ কালো করে।

ময়ূখ আমাকে একদিন বললো---উজ্জ্বল থাকলে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।

ময়ূখ বুদ্ধিমান। তার টোটকাতে কাজ হয়েছিল। উজ্জ্বলেরও মনে হয়েছিল, নির্মলদা তাকেই বেশি ভালোবাসে।

আমার সেই ভালোবাসা কতটুকু আছে, আমি বলতে অক্ষম। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু চাপা পড়ে গেলেও বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কোনো কোনো স্মৃতি এখনো জ্যান্ত হয়ে আছে। সজীব হয়ে আমার কাছে চলাফেরা করে। আমি আজও ভালোবাসার ধর্মে বাঁচি। আমি আজও উজ্জ্বল ময়ূখ রামাশিসের নিকটেই আছি। কেবল ভালোবাসা নিয়ে দড়ি টানাটানি নেই।

ভাবতেও ভালো লাগে, রাঁচি রোড থেকে ময়ূখ কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে, সাইকেল নিয়ে ছাতিমতলার দিকে। আস্তে আস্তে বাকিরা এসেও সাইকেল রেখে বসে পড়ছে। রামাশিস তো এসেই বাবলুর দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে চারমিনারে টান।

সেই সিগারেটের ধোঁয়ায় অনেক অনেক কিছু আবছা হয়ে গেলেও অস্পষ্ট হয়ে যায়নি অমলিন ভালোবাসার সেই দিনগুলি।

-----দুপুর---২--২
-----২ ফাগুন ১৪২৯
-----১৫---২---২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৮০
---------------------------------------------------------

আমি সুখী
সুখ কাকে বলে জানো?
সুখ সেই বিষণ্ণতা 
যে আমার কোলে বসে থাকে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার আংশিক উদ্ধৃতি করে বলতে চাইছি----শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই এখনো আমাকে জড়িয়ে আছেন। আরো অসংখ্য পংক্তি আমার রক্তের ভেতরে সব সময় গুনগুন করে।

প্রশ্ন আসতে পারে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কি আমাকে প্রভাবিত করেছেন?

এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে 
আমার জন্মের কোন শেষ নেই।

শঙ্খ ঘোষের কবিতার এই পংক্তি আমাকে শান্ত করে। তাঁর অনেক পরের বই "লাইনেই ছিলাম বাবা "পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, এইরকম একটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আমি পেলে  মনের জোর বাড়তো।

তবে কি প্রভাবের কথা বলতে চাইছি? না, আমি শঙ্খ ঘোষ দ্বারা প্রভাবিত নই। আমি তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকেই গ্রহণ করতে চেয়েছি।

কখনো কখনো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তারাপদ রায় উৎপল কুমার বসু বিনয় মজুমদার পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এঁরা বাংলা কবিতার রত্ন। কিন্তু কেউই আমাকে প্রভাবিত করেননি। এঁদের কবিতা আমাকে বাজিয়ে দেয় কখনো সেতারের মতো। কখনো ঘুঙুরের মত। কালীকৃষ্ণ গুহ দেবারতি মিত্র ভাস্কর চক্রবর্তী মানিক চক্রবর্তী আরো কেউ কেউ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন।

আমি পছন্দ করি।

মনে হয় এ সমস্ত আমারই কবিতা। এঁদের কবিতা বাংলা কবিতাকে জাগিয়ে রেখেছে।

রণজিৎ দাশ আমাদের কিছু আগে শুরু করছিলেন লেখালেখি। আমি নিজে লেখালেখি করতে এসে রণজিৎদার কবিতার স্মার্টনেস আমাকে প্রভাবিত করেছিল। পরে দেখলাম, এই জায়গাটা আমার নয়। আমাকে থাকতে হবে আমারই জায়গায়। অমিতাভ গুপ্তর "মাতা ও মৃত্তিকা" ও "খরা ও যমুনা" আমাকে আলোড়িত করেছিল। প্রভাবিত করেনি। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালও তাই। তাঁর প্রথম কবিতার বই "দেবী" পাঠের পর অনেক বন্ধুকেই বলেছি, এই হলো কবিতা।আবার এও বলেছি, এ কবিতা থেকে কেউ প্রভাবিত হলে ডুবে যাবে।

আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে লোক জীবন।ঝুমুর টুসু ভাদু অহিরা। এ সমস্ত গান হলেও সব সময়ের জ্যান্ত কবিতা। জীবন থেকে উঠে আসা মহাজীবনের কবিতা। ছন্দ ও শৈলির মারকাটারি দেখানেপনা নেই, যা আছে তা হলো অনুভূতি অভিজ্ঞতা উপলব্ধির প্রকাশ। সহজ ভাষায় সরল করে। এক কথায়, প্রাণের প্রকাশ। রক্ত ঘাম ধুলোমাটি লেগে থাকা জীবনের প্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান নকল করতে ইচ্ছে করে। মনে মনে হাসিও। ওই উচ্চতার কাছে আমি ধুলো নই। ধুলো বললে তো এক অস্তিত্বের কথা বলা হয়, আমি এক বিন্দু ধুলো নই।

প্রাচীন কবিতাও আমাকে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু সেই প্রাচীন কবিদের মতো আমার কব্জির জোর নেই। আমি সেই প্রাচীন কবিতা থেকেও সরে দাঁড়াই।

ব্যক্তি মানুষও আমাকে প্রভাবিত করেছে। নারী হোক পুরুষ হোক এখনো আমাকে প্রভাবিত করে। শিশু আমাকে উজ্জীবিত করে। আমাকে কবিতার দিকে নিয়ে যায়। এইসঙ্গে আছে আমাকে ঘিরে থাকা নিসর্গ প্রকৃতি। তার সৌন্দর্য। তার আলো ছায়া। তার উজ্জীবন আমাকে বাঁচতে সাহায্য করে। তার রহস্য আমাকে সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়। যদিও প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে আমি নেই। আমি শুধু নতজানু হয়ে থাকি প্রকৃতির কাছে।

আমার সময় আমাকে উত্তেজিত করে। আবেগী করে।আমি সময়ের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। এই সময় এই দেশ এই রাজনীতির কদর্যতা আমাকে বিচলিত করে।আমি আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে দু এক কথা বলার চেষ্টা করি। আমার ভাষায় প্রতিবাদ।

চারপাশের শিক্ষা সংস্কৃতির যা হাল যেকোনো সংবেদনশীল মানুষকে বিচলিত করবেই। সেই বিচলন থেকে যারা রাস্তায় নামে তাদের রুখে দাঁড়ানো একরকম, আর কবি লেখকদের প্রতিবাদ কাগজে কলমে। দেখা যাচ্ছে যদিও আজকাল অধিকাংশ কলমের শিরদাঁড়া নেই। কলম থেকে যে কালি বাইরে আসে তার রঙ শাদা।

অসহায় লাগে নিজেকে।

আমার অসহায়তা আমাকে প্রভাবিত করে। আমি শব্দ খুঁজি। ভাষা খুঁজি। কখনো কিছু না পেলে আমি কেঁপে উঠি। আমি কাঁদি।

চোখের জলের মতো অস্ত্র আমাকেই আঘাত করে।তখন আরো আরো আমি অসহায়। আমি তাল গাছের দিকে তাকিয়ে শান্ত হই। শাল গাছের দিকে তাকিয়েও নিজের শক্তি অর্জন করি। মনোবল খুঁজি, অজস্র মানুষের দিকে তাকিয়ে।

মানুষই তো হুঁশ।

মানুষই কবিতা। আবহমান।

-----৩ ফাগুন ১৪২৯
-----১৬--২--২০২৩
-----দুপুর--১--৫০
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৭১
--------------------------------------------------------

লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ কি খুব মসৃণ? খুব প্রশস্ত? লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কি সুশিক্ষিত? সুসম্পাদক? বাংলা ভাষায় দক্ষতা আছে? বাংলা ব্যাকরণেও শিক্ষিত? বাংলা বানানে সম্যক জ্ঞান আছে? বদলে যাওয়া বানানের দিকে নজর আছে?

লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক আবিষ্কার কি করেন গ্রামেগঞ্জে কে কোথায় কবিতা লিখছেন? গল্প লিখছেন? শুধু কি গল্প কবিতা? কারা ছবি আঁকছেন? কারা ছড়া লিখছেন? লোকজীবন বিষয়ে কারা কাজ করছেন মাঠে ঘাটে?

শুধু কি পাঁচটা কবিতা দুটো গদ্য ছাপলেই একটা ম্যাগাজিন হয়ে যায়? প্রচ্ছদে মনোহরণ একটা ছবি ছাপলেই, চমৎকার হয়ে যায়? পাতা ওল্টালেই যদি ভুল বানান চোখে পড়ে? পাতায় পাতায় যদি ভুল বানান চোখে পড়ে? কাগজ মুদ্রণ ও বাঁধাই যদি এলোমেলো লাগে?

প্রশ্ন তো এই, উত্তর কোথায়?

প্রশ্ন তো এই, বিগ ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে হিসেব-নিকেশ চলে, লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে চলে না?

সম্পাদক কি, নাম দেখে লেখা ছাপেন না ভালো লেখা ছাপেন? সম্পাদক কি, আঙ্গিক ও ছন্দের বিষয়ে জোর দেন নাকি বিষয়ের উপরে? সম্পাদক কি, বিনিময় প্রথাতে বিশ্বাস করেন? অর্থাৎ, আপনি আমার লেখাটা ছাপলে, আপনার লেখা আমি ছাপবো।

কোথায় রাখবো পা?

লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক লেখক কপি কি পাঠিয়ে থাকেন? লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক লেখককে কি আর্থিক সম্মান দিয়ে থাকেন?

প্রযুক্তির কল্যাণে শত শত কবি। সম্পাদক কি ঝাড়াই-বাছাই সর্বদাই করেন? সম্পাদক কি লেখা ছাপানোর পরেই, লেখককে ভুলে যান?

কবি লেখক সামাজিক মানুষ। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকও সামাজিক মানুষ। সম্পাদক সামাজিক সত্ত্বাকে গুরুত্ব দেন নাকি কবি সত্ত্বাকে?

প্রশ্ন এই, লিটল ম্যাগাজিন কি শুধুই একটি সাহিত্য পত্র নাকি সামাজিক বন্ধন? সামাজিক কর্ম? প্রশ্ন এই, লিটল ম্যাগাজিন কি পথ চলার একটি রাস্তা নয় নাকি মুখ দেখাবার পরিচিত হওয়ার একটি মঞ্চ?

লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ কি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে নাকি চন্দন ছোঁড়াছুঁড়ি করে? লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ কি আরেকটি লিটল ম্যাগাজিনকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়?

লিটল ম্যাগাজিনের দায়িত্ব কতদূর কোথায়? লিটল ম্যাগাজিনের দায়িত্ব কি, কবি লেখক তৈরি?

প্রশ্নেরা ঠোক্কর খেলে, ধাক্কা খেলে আমি চুপ করবো না। প্রশ্ন করেই যাব, করেই যাব। আমার ধারাবাহিক প্রশ্ন থেকে আমি উত্তর চাইছি আরো-----

সম্পাদক মানেই কি, একটি উপাধি? এই উপাধি কে বা কারা প্রদান করেছে? যদি এই উপাধি নিজেই নিয়ে থাকেন, তবে এই উপাধির গুরুদায়িত্ব সম্পাদকের কাঁধে।

লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এইটে মানবেন তো?

আরও একটি প্রশ্ন, লিটল ম্যাগাজিনের শিরদাঁড়া কি সোজা? নাকি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাথা নত করবে?

-----১৮ মাঘ ১৪২৯
-----২---২---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ--৭২
-------------------------------------------------------

সকালবেলা পাড়ার দোকানে চা খেতে গেলেই, এক পাল কুকুর। চা প্রেমিরা চা খাচ্ছে। কেউ কেউ চায়ের সঙ্গে বিস্কুট।

কুকুরের দল চেয়ে থাকে।

প্রতিদিনই মনে হয়, পকেটে আরো কিছু পয়সা থাকলে, বিস্কুট কিনে কুকুরকে দেওয়া যেতো।

আজও সেই একই ছবি।

আমি আমার বিস্কুট থেকে খানিকটা ভেঙ্গে ছুঁড়ে দিলাম। প্রথম কথা, কোনো খাবার কখনো ছুঁড়তে নেই। ছুঁড়ে দিলে খাবারকে অসম্মান করা হয়। যাকে ছুঁড়ে দিচ্ছি, তাকেও ছোট করা হয়। কোনো কিছুকে অসম্মান করার অধিকার আমার নেই। কাউকে ছোট করার অধিকার আমার নেই। এ আমি জানলেও আজ আবার সেই একই কাজ করলাম। ভুল কাজ। দ্বিতীয় কথা, একগাদা কুকুরের কাছে এক টুকরো বিস্কুট দেওয়া উচিত নয়। কে পাবে আর কে পাবে না, আমার তো জানা নেই। যদিও জানি, একজন পাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাকিজন বঞ্চিত।

তার চেয়ে ভালো, না দেওয়া।

এক টুকরো বিস্কুটে একজনেরও পেট ভরবে না।

আমারও পেট ভরে না।

কুকুরগুলো চেয়ে থাকে সবার দিকে। আসলে তো, খিদে চেয়ে থাকে। খিদেও তো এক দেবতা। তার মুখ প্রসন্ন করতে হলে দু' চার প্যাকেট বিস্কুট সঙ্গে রাখা জরুরী।

কখনো কখনো লক্ষ্য করেছি, কোনো যুবক সাইকেল কিংবা বাইকে এসে কুকুরদের কাছে বিলি করছে বিস্কুট।

চা খেতে খেতে মনে পড়লো, ঘরে আছে এক প্যাকেট বিস্কুট। কুকুরটা এলে (যে কুকুরটা আমাদের ঘরকে মনে করছে নিজের ঘর) বিস্কুট দিতে হবে। আমি ভুলেও যাই। দেখি, বিস্কুটের প্যাকেট জমে উঠছে।

তিনটে কুকুর নিয়মিত আমাদের ঘরের গলিতে (যা আমাদের উঠোন) আসা-যাওয়া করে। সন্ধে হলেই বড় কুকুরটা দরজার কাছে চুপচাপ বসে থাকে। চোখ মুদে। কেবল পায়ের শব্দ শোনে।

আমার বন্ধু পুষ্পেন সরকার কুকুরদের জন্য একটা আশ্রম খুলেছে। তাদের খাওয়া দাওয়া তাদের চিকিৎসা সমস্তই তার দায়িত্বে। সঙ্গে আরো লোকজন থাকলেও সে প্রধান। আমার আরেক বন্ধু স্বপন চক্রবর্তী চায়ের দোকানে গেলেই, কুকুরদের জন্য আলাদা বিস্কুট কিনে তাদের দিয়ে থাকেন।

আমার দুই বন্ধুই হৃদয়ের জায়গা থেকে অনেক উঁচু।সেই তুলনায় আমি কিচ্ছু না। আমার মায়া হয়। কষ্ট পাই, এটুকুই।

রাস্তার গাই--গরুদের দেখলেও আমার মায়া জাগে।বাজারের শাকসবজিতে মুখ দিতে গেলে, তারা গালমন্দ খায়। লাঠি খায়।

কখনো কখনো চেষ্টা করেছি, বাজার থেকে শাকপাত কিনে গরুর মুখের কাছে ধরতে। তাতেই বা কি হবে!অনেকটা পরিমাণে খাবার না দিলে তাদের পেট ভরবে না।

অনাথ গাই-গরু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেই থাকে। তাদের করুণ চোখে আকাশ ও মেঘ ভেসে উঠলেও, আমার চোখে ভেসে ওঠে অসহায়তা।

আমি নিজেও যে অসহায়।

আমার অসহায়তা কাকেই বা দেখাবো! কেইবা দেখতে পায়? নাকি দেখাতে নেই? কোনো কিছুই দেখাতে নেই। শুধু আড়াল রাখো। যে দেখার দেখবে।

গাই-গরু কুকুরের দল আমাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে।

----১৯ মাঘ ১৪২৯
----৩---২---২০২৩
----নির্মল হালদার






আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৭৩
-----------------------------------------------------------

------পালক, তুমি কটা সিঁড়ি ভেঙ্গে এলে আমার কাছে?
-----২১ টা।
-----২১ টা!
আমি তো মনে রাখতেই পারি না, আমার ঘরে আসতে হলে কটা ভাঙতে হয়। আচ্ছা, এবার তাহলে বলো-----ছাদে যেতে হলে কটা সিঁড়ি?
-----১৭ টা।
------ও বাবা, তুমি তো দেখছি সবই জানো। এবার তাহলে তোমাকে বলতে হবে, তুমি আর কোথায় সিঁড়ি দেখেছো?
------পেখমদের বাড়িতে।
------আমি তো পেখমদের বাড়ি যাইনি।
------তুমি মিথ্যে কথা বলছো।
আমাকে নিয়েই তো তুমি পেখমদের বাড়ি গেছলে।
------ও ভুলে গেছি ভুলে গেছি।

পালক হাসে। 

আমার হাত থেকে কলমটা কেড়ে নেয়। জানতে চায়, এই কলমের কালি কি রঙের! আমি তাকে জানাই, নীল রঙের। পালক আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ব্লু? আমি বলি হ্যাঁ।

পালক শোনো এবার, আরো প্রশ্ন করবো তোমাকে। সিঁড়ি ক প্রকার বলো তো?
-----ম্যাম তো আমাকে শেখায়নি।

পালকের উত্তরে আমি হেসে উঠি। তাকে বলতে হয়, সিঁড়ি অনেক প্রকার, তার মধ্যে আমার একটা কাঁধ।
-----কাঁধ?

পালককে জানাতেই হবে, হ্যাঁ আমার কাঁধ। সেই যে তুমি একদিন আমার কাঁধে উঠে পেয়ারা পাড়লে। মনে নেই?
------হ্যাঁ হ্যাঁ।
------তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আর কারোর কাঁধে উঠবেনা কখনো। তুমি বড় হলে নিজের নিয়মেই বড় হবে। নিজেই পাড়তে পারবে কুল। আতা। চানাচুরের কৌটো পাড়তে হলে মাকে আর বলতে হবে না। কিংবা মায়ের কোলে উঠে পাড়তে হবেনা বিস্কুটের কৌটো। কোল ছাড়া কাঁধ ছাড়াই নিজে নিজেই সব পারবে। দেখো।

পালক ভুলে যায়নি। সে আবার জানতে চায়-----সিঁড়ি ক প্রকারের? আমি তাকে বলি, বলবো বলবো দাঁড়াও। কী আর বলবো, তার কাছে জানতে চাই----পালক বলোতো, চাঁদের কাছে উঠতে হলে, তুমি কোথায় সিঁড়ি পাবে?
------জানি জানি, জেঠুনদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো। ছাদে রঙ করার সময় গৌরাঙ্গ দাদু নিয়ে এসেছিল।
------কবে যাব আমরা চাঁদে?
-----চাঁদ উঠলেই যাব।
পালক আকাশের দিকে তাকায়। শীতের সূর্য ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠছে। পালকের কপালে কাজলের টিপ। তার উপরে একটি শাদা চিহ্ন।

কীসের ইঙ্গিত বহন করছে?

আমি এবার পালককে জিজ্ঞেস করি----তুমি যখন ঘুমোতে যাও খাটে কে উঠিয়ে দেয় তোমাকে? সে বলে----আমি নিজেই উঠি।
------বাহ বাহ
তুমি তো পারো দেখছি নিজে নিজে উঠতে। তাহলে আর সিঁড়িও লাগবে না।
------লাগবে লাগবে।
মা যখন বলে, বিট্টু ট্যাংকে জল আছে কিনা দেখে আয়-----তখন তো সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হয়। তুমি তখন বলো, সাবধানে উঠবে পালক---লোহার সিঁড়ি। লোহার সিঁড়ি কেন?

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকতে থাকতে বলে উঠি, তুমি স্বপ্ন দেখো? আমার এই প্রশ্নে আমাকেই প্রশ্ন করে পালক-----স্বপ্ন কী?
-----ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তুমি ছবি দেখতে পাও না? এই ধরো হাতি ঘোড়ার ছবি। আরো ধরো, ফুলের ছবি। আর তুমি যে হরিণ হরিণ করো, তার ছবি দেখতে পাও না?
----না না।
----যখন দেখতে পাবে তখন না ঘুমিয়েও দেখতে পাবে। আর দেখার জন্য একটাও সিঁড়ি লাগবে না। এই যে তুমি আমাকে দেখছো এখনো, সিঁড়ি লাগছে?
----আমি নিচে যাচ্ছি।
-----দাঁড়াও দাঁড়াও-----একটু পরে যাবে। তোমাকে যে আমি খুব ভালোবাসি, তার জন্য সিঁড়ি লাগে না। বুঝলে? পালক নীরব থাকে। সে কলমের ঢাকা খুলে বাঁ হাতের পাতায় আঁকিবুকি করে। তাকে জানাতে ইচ্ছে করে-----কোথাও কোনো সিঁড়ি নেই। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি মাটিতে। যারা সিঁড়ি ব্যবহার করে, তারা একটা সময় আর উঠতে পারে না। পালককে বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে পারি না, মাটিতেই পা রাখতে হয়। তবেই মাটি তোমাকে দেখবে। তুমি ভালো থাকবে অবশ্যই। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলে পালককে প্রশ্ন করি, ২+২ সমান কত বলো তো? সে বলে-----৪
আমি বললাম-----হলো না হলো না। ২+২=২

তুমি জিরো জিরো জিরো-----পালক বলতে বলতে সিঁড়ি ভেঙ্গে চলে যায়।

-----২০ মাঘ১৪২৯
-----৪---২---২০২৩
------নির্মল হালদার






আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৭৪
-----------------------------------------------------------

মাঘ শেষের শীত। সন্ধেবেলা। কাঁসাই পারে। একটি দুটি করে তারা উঠছে। তার ছায়া পড়ছে কাঁসাইয়ের গোড়ালি ভেজা জলে। 

শীত শীত অন্ধকার।

একটু কাঁপুনি। গায়ে জড়াতে ইচ্ছে করলো চাদর। জানতে ইচ্ছে করলো তারাদের তাপে উষ্ণতা আসবে না?

না, আসবে না------অবিনের অন্তর থেকে উত্তরটা পেলাম। সে শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বাললো।

আমিও জড়ো করছি একটি দুটি পাতা। কবে থেকে ঝরে পড়ে আছে কে বলবে? গাছে যখন ছিল কে লক্ষ্য করেছে তাদের নবীনতা?

আমাদের পাশেই সরষে ক্ষেত। সরষে ফুলের হলুদ রঙ ছিটকে পড়লেও অন্ধকারে ঠাওর হয় না।

বসন্ত আসছে। পলাশের কুঁড়িও কি আসছে গাছে গাছে? নদীর ওপারেই পলাশের ঘন সারি।

ডেকে উঠলো একটা পাখি।

বেলা ফুরিয়েছে অনেক আগেই। তবে কি পথ হারিয়ে গেছলো পাখিটা? পাখিটার পিছনে পিছনে যেতে পারলে ভালো লাগতো আমার। যদি সে পথ হারিয়ে গেছে , তাহলে তাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো।

আগে কী কী নিয়ে এসেছি? কাদের নিয়ে এসেছি? ভালোবাসা আমার সঙ্গে এসেছে?

কে একজন নদীর জলে ও বালিতে হাঁটতে হাঁটতে এপারে আসছে। মুখের সামনে ধরা আছে একটি আলো।

মোবাইলের আলো?

চরাচর জুড়ে স্তব্ধতা। নির্জনতাও খাঁ খাঁ করছে। একটা ডাক। কার ডাক? শেয়ালের? কাকে ডাকছে?

কে দেবে সাড়া?

শুকনো পাতার আগুন জ্বলছে। বাপিও আগুনে ফেলছে একটার পর একটা পাতা। এইবার একটা পাতা আমার গায়েও পড়লো।

আমরা আছি শিমুল তলায়।

নির্জনতা আরো গভীর হয়ে উঠছে। গম্ভীরও। আমার ভয় ভয় করে। পর মুহূর্তেই অবিন ও বাপির মুখ। আবছা হলেও তাদের যৌবনের মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। তাদের তারুণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতেই, অনেকক্ষণ আগেই উঠেছে চাঁদ। আমি এই লক্ষ্য করলাম। আমার মনে হলো, লাফিয়ে লাফিয়ে ধরতে হবে এই চাঁদ।

মাঘী পূর্ণিমার চাঁদ।

-----২২ মাঘ ১৪২৯
-----৬---২---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ----৭৫
------------------------------------------------------------

নিম্নবর্গের মানুষ মাটি কেটে কাজ করে। শ্রমিকের কাজ করেও পেট ভাতায়। দুবেলা। নিম্নবিত্ত মানুষ খেটে খেতেও পারে না। তাদের খেটে খাওয়ার জায়গা পরের দোকান। মাস শেষ হলে যেটুকু পাওয়া যায়, তা থেকেই দিনাতিপাত।

অনেক অনেক সঙ্কট মুহূর্তে ঘরের মেয়েরা ঘরের কর্তা ব্যক্তিদের কিছু না বলে, ঘটি বাটি বন্ধক দিয়ে সঙ্কট থেকে উদ্ধার পায়। যা ঘরের পুরুষরা জানতেই পারে না। যেমন ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন চালের খরচ থেকে একমুঠো চাল আলাদা করে রাখে। এক দশন তেলও আলাদা করে রাখে। বিপদের সময় এই চাল এই তেল রক্ষা করবে ‌‌। উপোস থেকে।

আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত থেকে আরম্ভ করে নিম্নবর্গের মেয়েরা পরিবারের উদ্ধারময়ী এক একটি লক্ষ্মী। অথবা লড়াকু। যে লড়াইয়ের জন্য তারা সব সময় বুক বেঁধে থাকে।

স্বামী হারা একমাত্র পুত্র সন্তান নিয়ে আজীবন লড়াই করে গেছে ননীবালা হালদার। লোকের ঘরে ঘরে জল দিয়ে, বড়ি দিয়ে, ঠোঙ্গা করে  সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে।

লেখাপড়ায় এগিয়ে যেতে পারেনি তার একটি মাত্র সন্তান। আত্মীয়দের দোকানে কাজ করে সংসার চালিয়েছে। তাকে যেতেও হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার সীমান্ত গ্রামে। আত্মীয়ের দোকানে কাজ করতে।

আত্মীয়র কাছে থাকা মানে সম্মানের সঙ্গে থাকা। সম্মান যেন ক্ষুন্ন না হয় এজন্যেই বাড়ি থেকে দূরে থাকা।

এখনো ছিটেফোঁটা মূল্যবোধ মধ্যবিত্তদের আছে। তার সঙ্গে নিম্নবিত্তরাও মূল্যবোধ আর কৌলিন্যের কারণে শ্রমিকের সঙ্গে শ্রমিক হয়ে মাঠে-ঘাটে কাজ করতে পারে না।

আমাদের পরিবারের কেউ কোনোদিন লোকের ঘরে কাজ করে না, লোকের কাছে হাত পাতে না----এই মনোভাব বেশিরভাগ সময় নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তদের সঙ্কট থেকে সঙ্কটে অভাব থেকে অভাবের দিকে নিয়ে যায়।

তো বিধবার একমাত্র পুত্র সন্তান বটু কৃষ্ণ হালদার পুরুলিয়ার সীমান্ত গ্রামের আরেক হালদার পরিবারের সদস্য হয়ে গেলেও সেও তো পরের ঘর।


স্বাধীনতা হীনতায় বেঁচে থাকা।

পুরুলিয়ার জল কষ্ট সেই অতীত থেকে আজও বর্তমান। সেই অতীতের একটি ছবি, বটু কৃষ্ণ হালদার যে বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে অথবা তার অন্ন সংস্থান হয়েছে, সেই বাড়ির মহিলারা বসতি ছাড়িয়ে ধান জমির কাছাকাছি এক কুয়ো থেকে রাত্রি বেলায় কলসি বালতি নিয়ে জলের জন্য যাওয়া আসা।

সারাদিন জল মিলতো না কুয়ো থেকে। রোদের কারণে। সূর্য ডুবে গেলেই সেই কুয়োতে জমে উঠতো জল। এই কুয়োর জলে ভাত সেদ্ধ ডাল সেদ্ধ হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে এই কুয়োর জলের চাহিদা খুব।

বিভিন্ন পরিবার থেকেই রাত্রিবেলার নির্জনে কুয়ো থেকে জল তুলছে মহিলা বৃন্দ।

তার আগে বটু কৃষ্ণ হালদার মহিলাদের আগে আগে লন্ঠন হাতে এগিয়ে চলেছে। যেন সেই আলোক বর্তিকা।

তার পিছনে পিছনে সারি সারি পিপাসা।

শেষ নেই এই পিপাসার।

বটু কৃষ্ণ হালদারও ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে। আজও এগিয়ে যাচ্ছে। তার সামনে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র।

কাঁখে কলসি হাতে বালতি ভরে উঠবে নক্ষত্রের আলোয়।

----২৩ মাঘ ১৪২৯
----৭--২--২০২৩
-----নির্মল হালদার





মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩

আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ




আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৬৬
--------------------------------------------------------
১.
নারকেল কুলের গাছ। দত্তদের ছিল না হালদারদের? সেই ছোটবেলায় জানার আগ্রহ অথবা কৌতূহল ছিল না আমার। গাছটা যে আমাদের ছোটদের কাছে খেলার সঙ্গী ছিল। প্রায় সারাদিন। এটুকুই সত্যি। এই সঙ্গী সরস্বতী পুজোর আগেই ডালে ডালে ছোটদের লোভ দেখায়।

কাঁচা কুল। ডাঁশা কুল। পাকা কুল।

কেউ আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। কেউ পাতার আড়াল থেকে আমাদের দেখে। আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করি।

কাঁটার ভয় না করেই, কোনোভাবে উঠে পড়ি। কোনো কোনো দিন হাত-পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়ে। তবুও ফুটে ওঠা রক্ত আমাদের দমাতে পারে না।

কুল যে খেতেই হবে।

নিষেধ শুনেছি অনেক, সরস্বতী পুজোর আগে খেলে বিদ্যা হবে না। বারণ করেছে আরো, কুল খেলে কাশি হবে খুব।

কে শোনে কার কথা!

বাজারেও কুল বিক্রি হচ্ছে। পয়সা তো আর নেই, কিনবো কোত্থেকে! আমাদের সঙ্গী গাছটা যতটুকু ভালবেসে দেবে ততটুকুতেই আমরা খুশি।

পুজোর দিন পুরোহিত কিংবা বাড়ির কেউ ছোটদের কাছে জানতে চাইতো----কে কে নারকেল কুল খেয়েছিস? সত্যি করে বললে, মা-সরস্বতী কিছু মনে করবে না।

আমরা ছোটরা একে অপরের দিকে চেয়ে থেকেছি।

চেয়ে থাকতে থাকতেই, হঠাৎ করে বড় হয়ে গেলাম। কত বড়? মানুষ হতে পেরেছি কি?

সরস্বতী হাসছে।

আমার সঙ্গী কুল গাছটা কোথায়?

আমার ছোটবেলাটা কোথায়?

আমার শৈশবের কবিতা কোথায়?


২.
সে বছর হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবো। তার আগেই তো সরস্বতী পুজো। আমার ইচ্ছে হলো, আমরাও পুজো করবো। স্কুলের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই, হইচই করবো কোথায়! আমাদের কোনো ক্লাবও ছিল না। অবনী লাল্টু আর বাবলুকে আমার ভাবনার কথা বললাম। রাজি হয়ে গেল তারাও।তোড়জোড় করে টাকা পয়সা জোগাড়। জায়গা নির্বাচন।

বাবলুদের একটা ফাঁকা বাড়ি পড়েছিল, স্থির হলো আমাদের পুজোটা সেখানেই হবে।

আমার উদ্যোগে সাড়া দিলো সবাই। ভেতরে ভেতরে আমি খুশি। সরস্বতী পুজো করতে পাচ্ছি। তারপর মাথায় এলো, পুজোটা কারা করছে, কী জানবে তুলিনের ছেলেপুলেরা? লোকজন?

সুভাষ সংঘ বিবেকানন্দ ক্লাব অথবা রবীন্দ্র অগ্রণী এ ধরনের নামকরণে আমি নেই। আমি নামকরণ করলাম---আমরা সবাই।

সরস্বতী পুজোর দিন বেলার দিকে বাবলুর বাবা এসে নাম দেখে বললেন----আমরা সবাই ফেল।

না, বাবলু ফেল করেনি। অবনী লাল্টুও ফেল করেনি। আমি বরাবরই ফেলু।

অথচ আজও বাংলা কবিতার কাছে বাসক ফুল আম মুকুল রক্ত পলাশ দু'হাতে নিয়ে অঞ্জলি দিতে যাই।

------১১ মাঘ ১৪২৯
সরস্বতী পুজো
-----২৬---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার




আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৬৭
---------------------------------------------------------

শালুকের লাল রঙ ছিটকে পড়ছে জলে। স্থির হয়ে আছে পদ্মফুল। একটি পাপড়িও নিজেকে মেলে ধরলো না।

শালুকের সঙ্গে পদ্মের ভাব নেই?

বাঁশ ঝাড়ের পাশেই একটা মহুল গাছ। দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশ গাছের মন মহুলের গন্ধে গন্ধে পুলকিত হয়? কাছে আসে?

হাঁসগুলি কোলাহল করলে কে শোনে? লাফিয়ে ওঠে মুরগি? আগাছা থেকে উঁকি মারে পোকামাকড়?

গাছে রস এলে মৌমাছি ছাড়া আর কে খবর পায়? তালগাছ খেজুর গাছ পাশাপাশি থেকেও কেউ কারোর দুঃখ শুনতে পায় না। শুনতে পায় না আনন্দধ্বনি।

ভাব নেই?

একটি তারা খ'সে পড়লে কেঁপে ওঠে না একটি পাতাও।

সম্পর্ক নেই?

একটি কাক ডাকতে ডাকতে কোথায় যে গেল! তার পিছনে পিছনে কোকিল কি যায়?

সম্পর্ক নেই?

একটি মেঘ এসে উড়ে গেল। খোঁজ করবে না আরেকটি মেঘ?

ভাব নেই?

বক এসেও উড়ে গেল, পুকুরে জল নেই। তার খিদের কাছে দাঁড়াবে না কেউ? বকের সঙ্গেই তো একটা গাছে থাকে শালিকের বাসা।

ভাব নেই?

একই মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছে না।

হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাওয়ার তরঙ্গে তরঙ্গে বেজে উঠছে বিষণ্ণতা।

----১২ মাঘ ১৪২৯
----২৮---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৬৮
-----------------------------------------------------------

ভোর নিজেই একটি কাব্য। ভোর নিজেই একটি কাব্যগীত। ভোরের কাছে দাঁড়ালেই, সুর আর সুর। ঝর্ণাধারা।

মায়ের কোল থেকেই আমার ভোর দেখা শুরু। আলো ফোটার আগেই আমি কেঁদে উঠতাম। আমার কান্না শুনতে শুনতে ফর্সা হয়ে উঠতো আকাশ। আরেকটা কথাও বলতে পারি, আমার কান্নার সুর নিয়ে রাতের তারারা নিজের নিজের ঘরে চলে যেতো।

ভোরে যে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের সুর, আমি আঁজলা করি। আঁজলা থেকে দুচোখেও ধরে রাখি। সূর যে শুনতেই হবে। সুরে সুরে গান।

আমার ভোর।

ভোরের পাতায় পাতায় লেখা থাকে গানের পরে গান। গাছের কাছে দাঁড়ালেও গান। পাতা থেকে বিন্দু বিন্দু ঝরে।

আমি গান ভালবাসি।

ইভাদির কাছে গান। রবীন্দ্রনাথের গান। স্কুলে। তখনো ভোর যে একটি কাব্য আমার উপলব্ধিতে ছিল না । অনেক অনেক পরে দেখলাম, শৈশব তো থেকেই ভোর আমার সঙ্গে আমি চিনতে পারিনি।

একেকটা পাখির ডাক ভোরের গান। ঘাসের মুখেও থাকে ভোর। ভোরের আলাপ। এই আলাপের কাছে না দাঁড়ালে একটা দিন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। এই আলাপের কাছেই, প্রথম আলোর চরণ ধ্বনি।

স্কুল বেলায় আমার এক বান্ধবী ছিল, সে আমার কাছে শুনতে চাইতো গান। আমি শুরু করলেই, হেসে উঠতো খুব। সেই হাসির শব্দটাওতো আজও আমার কাছে গান।

আমি শুনতে পাই।

প্রতিটি ঋতুতেই গানের কলি ঘুরে বেড়ায়। উড়ে বেড়াতে বেড়াতে বাসা বাঁধে মৌমাছিদের মত। সুর ঝরাতে ঝরাতে পরিপূর্ণ করে রসের ভান্ডার।

রাত থেকে তাই আমার পথ চলা। ভান্ডারে ডুবতে হবে।ভোরের সঙ্গে উঠতেও হবে।

ভোর ভালোবাসা।

ভোর বন্ধন।

-----১৪ মাঘ ১৪২৯
-----৩০---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬৯
----------------------------------------------------------

চায়ের গাছ আমি দেখিনি।

চা হয়ে যাওয়ার পর চায়ের- গুঁড়ো শুকাতে দেখেছি। শুকিয়ে গেলেই আরেকবার চা। আরেকবার চা-পান।

আরেকবার দারিদ্র্য পান।

দারিদ্র্য শুকিয়ে শুকিয়ে যতবার পান করা যায়, ততবার ভাবতে হবে না চা কেনার কথা।

চিনিও কিনতে হয়। চিনির বদলে তাই শক্ত গুড়। গুড়ের গন্ধ যেন না আসে, তার জন্য চায়ে একটা তেজপাতা।

সেই চায়ের অনন্য স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে।

এই স্বাদ আমার কবিতাও।

আমার জীবনে লেপ্টে থাকা অনেক কবিতার মধ্যে একটি কবিতা। কবিতাতো সেও, ঠোঙ্গা করার সময় আঠার দরকার হয়। এবং সেই আঠা ঠোঙাতে লাগানোর পর শুকিয়ে গেলেই, অভাব মোচন।

ঠোঙ্গা বিক্রি করে দুটো পয়সা।

বিউলির ডালের বড়ি টিনের পাতে দেবার পর রোদে শুকানো।

দারিদ্র্য শুকানো।

শুকিয়ে গেলেই বড়ি বিক্রি। দু'চারটে পয়সায় তেল নুন। ঢাকা পড়বে দারিদ্র রেখা।

দেয়ালে ঘরের মেঝেয় ফাটাফুটি রেখা। চাপা পড়েনা। ঢাকা পড়ে না। হীরার মায়ের ধুতিতে কোনো ভাবেই ঢাকা পড়ে না। হীরার মা বরং গ্রীষ্মকালে পরনের ধুতির আঁচল মেঝেতে বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। একটি মাত্র পুত্র সন্তানের মা, বাপ-মরা বেটাকে মানুষ করার জন্য, বাঁচার জন্য লড়াই করে গেছে দিনের পর দিন। ঘরে ঘরে কলসি কলসি জল দিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, যদি সুসময় আসে। যদি একটি মাত্র বেটার মুখে হাসি ফোটানো যায়, তবে ভোরের সূর্যকেও সুন্দর লাগবে। সেই একটি মাত্র বেটা বটু কৃষ্ণ হালদারও মারা গেল। এই এতকাল পরেও হীরার মা বটুর হয়ে যাবে কি?

হীরার মাকে কেউ কোনোদিন বটুর মা বলেনি। বড় মেয়ে হীরার নামেই, হীরার মা হিসেবে পরিবার থেকে পাড়ায় পরিচিতি। এবার স্বর্গের দেব-দেবীরা নিশ্চয়ই হীরার মাকে বটুর মা-ই বলবে, মনে হয়। হীরার মায়েরও আফসোস ঘুচবে, বটুর মা শুনতে শুনতে।

----১৬ মাঘ ১৪২৯
-----৩১---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ--৭০
---------------------------------------------------------

মাথার উপরে আকাশ। পায়ের তলায় মাটি। আমাদের জীবনের অঙ্গ। আমরা মাটি ও আকাশের উপরে নির্ভর করেই বাঁচি।

আমি তো বেশি বেশি করে বাঁচি।

মাটি ও আকাশে নানা রকম প্রাণ খেলে বেড়ায়, তাদের সঙ্গে আমিও আমার খেলায়। দুঃখ-বেদনা আনন্দে।

আমার লেখাতে তাই, মাটির প্রভাব। আকাশের ছায়া। আমার লেখাতে তাই, পায়ের শব্দ।

মানুষের পায়ের শব্দ।

আমার লেখাতে তাই, পোকামাকড়ের পায়ের ছাপ। ব্যাঙের ডাক। পানকৌড়ির ডুব। গেঁড়ি-গুগলিও উঁকি মারে। থাকে হাঁসের কোলাহল। মুরগির ডাক। পায়রাও আসে।

মানুষের আঁকি-বুকি মুখ। শ্রম। বিনোদন। সেই সঙ্গে হাঁড়ির গায়ে লেগে থাকা ফ্যানের দাগ।

আমার লেখাতে, ঘুরেফিরে আমার অভিমান। আমার আর্তি। আমার ভালোবাসা।

এসবের বাইরে কেমন করে যাবো অন্য কোথাও? অন্য কোনোখানে?

বাঁশ ঝাড়ের সরসরানি হাওয়া এসে আমার গায়ে লাগে। পলাশ বনের ফুরফুরে হাওয়া এসে আমাকে বিষণ্ণ করে। আমি ভেতরে ভেতরে কাঁপি। আমি ছুটে যাই, জলহারা নদীর দিকে। পুকুরের দিকে। শুকনো কুয়োতলার দিকে।

আমি কবি নই। কবিতা লেখার চেষ্টা করি মাত্র। সেই সব লেখাতে ভাঙ্গা পথের রাঙা ধুলো উড়ে বেড়ায়।

রঙিণ হই। রসরাজও হয়ে উঠি। ধুলোর ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্যের বীজ। অনেক জনপদের ইতিহাস। কান পাতলেই, রক্ত ঘামের শব্দ। কান্নার শব্দ।

আনন্দ ধ্বনি।

এ সমস্ত আমার লেখা। আমার অনুভূতি। এ যদি কারো কারো কাছে কবিতা হয়ে ওঠে আমার বলার কিছু নেই। আমি এসবের বাইরে যেতে পারি না আর কোথাও।

এক ধীবর মাথার উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জাল ফেলছে পুকুরে। নদীতে। শিকার করবে মাছ। তা যে আমাকেও শিকার করছে, কাকেই বা বলবো?

সব সময় তো বলা যায় না, এ কারণেই দু এক পংক্তি বলার চেষ্টা করি মাত্র। সব সময় তো বলা যায় না, অভুক্ত অসহায় কুকুরের কথা। গাই-গরুর কথা। যারা রাস্তাতে রাস্তাতে। সারাদিন। বলার চেষ্টা করলেও বলা যায় না, শতশত পাখি গাছের অভাবে ফুল ফলের অভাবে, হাহাকার করছে।

এই হাহাকারের আওয়াজ কে পৌঁছে দেবে সবার কাছে?

আমার মন খারাপ করে। আমি একলা হয়ে পড়ি।

নীতি নৈতিকতা, আদর্শবোধ, মূল্যবোধের অভাবে আমি রেগে যাই। আমি একা হয়ে যাই।

আমার এই একাকীত্ব আমার লেখাতে। কারোর কারোর সহ্য না হলে, আমি আর কি করবো!

আমি রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথও করি, এ আমার দোষ।আমাকে বললেন বিখ্যাত এক কবি। তাঁর বক্তব্য------ আমি তো রবীন্দ্রনাথ পড়িনি।

আমি তো পড়িনি। আমি তো পড়ি না কিছুই।

কবিতা লেখার চেষ্টা করি মাত্র। আমার লেখাতে ফুল পাখি আসবেই। খিদে আসবেই। ফসল, না-ফসল আসবেই।

ঝুমুর-টুসু-ভাদু-ছো আমাকে প্রভাবিত করে। আমাকে প্রভাবিত করে গরু চরানো বাগাল ছেলে। রাস্তায় ধান শুকানো বুড়ি।

এই বুড়ির কাছেই তো আমি চাইবো এক আঁজলা জল। আমার যে প্রাচীন তৃষ্ণা। আমি যে পিপাসা থেকে পিপাসায় পথ হাঁটি। আমি যে কাকের সঙ্গেই ফাগুন চৈত্রে পলাশের মধু খুঁটে খাবো। আমাকে হ্যাংলা বললেও আমি শুনতে রাজি। কারণ, আমি তো 
হ্যাংলাই। আমি পেয়ারার দিকে চেয়ে থাকি। আমি কুলের দিকে চেয়ে থাকি।

আমি মানুষের দিকে চেয়ে থাকি।

আমি কাঙালও।

আমি ভিখারি।

দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াই।

একমুঠো ভিক্ষে মানে এক মুঠো লেখা। এক মুঠো ভিক্ষে মানে কোথাও কোথাও অপমান।

একমুঠো অপমান একমুঠো লেখা।

লিখন আমার ধূলায় হয়েছে ধুলি।

----১৮ মাঘ ১৪২৯
----১--২--২০২৩
------নির্মল হালদার





আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ



আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬১
----------------------------------------------------------

কাক এসে ঘরের চালায় বসলো। উঠোনে পড়ে নেই এঁঠোকাঁটা। বিফলে গেল প্রত্যাশা। 

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

পায়রা এসেও ঘরের চালায়। উঠোনে ছড়ানো নেই চালের খুদ। প্রত্যাশা বিফলে গেল। 

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

কুকুর এসেও ফিরে গেল। কোনো খাবারই নেই। সকালের প্রত্যাশা হতাশার দিকে। 

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

মৌমাছিরা উড়ে উড়ে গাছে গাছে ফুল দেখতে পায় না। আর কোথায় খুঁজবে মধু? প্রত্যাশার এই সকালবেলায় মন মরে গেল মৌমাছিদের। 

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

পাখি গাছের ফল ঠুকরে খেতে যাবে যেই পড়ে গেল মাটিতে। 

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

নদী ও পুকুরে জল শুকিয়ে গেলে কোথায় যাবে মাছেরা? জলের জন্য তাদের প্রার্থনা কে শুনবে?

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

জঙ্গলের ঝর্ণায় জল খেতে গিয়ে হাতিরা দেখতে পায়, কেবল পাথর আর পাথর। তাদের দৈনন্দিন জীবনে, একটা বড় আঘাত।

প্রত্যাশায় ভুল আছে কি?

শুঁড়ে তুলে কাকেই বা মারবে আছাড়?

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

স্বপ্নের দিকে যেতে যেতেও শুঁয়োপোকা রয়ে গেল শুঁয়োপোকা হয়েই। 

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

গাই--গরুর দল মাঠে গিয়েও পেল না একটিও ঘাস। চরে বেড়ানোর ফুর্তিটুকু প্রত্যাশাটুকু এক নিমেষে অন্ধকার।

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

চাষিরা শীত কালেও দু একটা বৃষ্টির আশা করে। কাজে লাগে শাক সবজির। চাষিরা আকাশের দিকে চেয়ে দেখে, মেঘ এসেও চলে গেছে।

অভিমান করবে? কার প্রতি অভিমান?

পানের সঙ্গে চুন খয়ের না থাকলে কে কার প্রতি অভিমান করবে? ডালের সঙ্গে নুন হলুদ না থাকলে
কে কার প্রতি অভিমান করবে?

ও আমাকে পাহাড় দিলো না। প্রেম দিলো না। অভিমান করবো?

" অভিমান তো সেই কোকিল যে কেবল নিজেকে লুকায় ।"

-----৩ মাঘ ১৪২৯
-----১৮---১---২০২৩
------নির্মল হালদার






আমার কবিতা----কাঠবিড়ালির লাফ---৬২
-----------------------------------------------------------

যে মহিলা সবজির ঝুড়ি মাথায় হেঁটে আসছে দশ কিলোমিটার দূর থেকে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে মহিলা ধানক্ষেতের আলে শিশুর সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে ধান কাটছে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে মহিলা ভোরের অন্ধকারে গুগলি-শামুক কাড়ছে পুকুরের শীতল জলে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি।

যে বালকের মাথায় ইটের বোঝা আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে বালক হোটেলের থালা-বাসন ধুচ্ছে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। যে বালক মটর মেকানিকের সঙ্গে কালি ঝুলি মাখে, আমি তার দিকে চেয়ে থাকি।

লাঙ্গল নেই। ট্রাক্টরের ভাড়া দিয়ে আবাদ ফলানো যাবে না। সেই সমস্যার দিকে আমার চেয়ে থাকা। ঘরে ধান চাল নেই, কাজ নেই শহরে। সেই সমস্যার দিকে আমার চেয়ে থাকা। পণের অভাবে বিয়ে দিতে পারছে না মেয়ের। সেই সমস্যার দিকে আমার চেয়ে থাকা।

এই যে জীবন, প্রাণ প্রবাহ আলো অন্ধকার, এই যে টানাপোড়েন, হোঁচটের পর হোঁচট এখান থেকেই শিল্পের জন্ম। এখানে ছন্দ বিশারদ এসে দাঁড়ালে, আঙ্গিক কুশলী এসে দাঁড়ালে জীবন জীবনের কাছেই থাকবে। সহজ সরল। নিদ্রা অনিদ্রায়। ঘামের গন্ধে। রক্তের চলাচলে।

এখানে কাব্য সমালোচক, তাত্ত্বিক ও পন্ডিত এসে দাঁড়ালেও ছিটকে পড়বেন।

আমার চেয়ে থাকাই আমার কবিতা। তা যদি শিল্প না হয়ে ওঠে না হোক, আমি চেয়ে থাকবো ছেঁড়া খোঁড়া জীবনের দিকে। যে জীবনের কাছে  জল নেই। মাথার ছাদ নেই। শিক্ষা নেই চিকিৎসা নেই। চারদিকে শুধু আত্ম অহমিকার প্রকাশ। চারদিকে আত্ম সর্বস্ব প্রচার। অগণিত মানুষকে ছোট করার বড় প্রয়াস।

আমি চেয়ে থাকি।

আমি রচনা করি আমার প্রতিবাদ। আমার প্রতিরোধ। আমার সঙ্গে থাকে  অজস্র পায়ের শব্দ। হাতে হাত। আড়ালে থেকেও থাকে। সব সময় এই সাহস আমাকে লেখায় আমার কবিতা।

কেন না, জন্মের পরেই মানুষ ধ্রুপদী হয়ে ওঠে। শিল্প তার অনেক অনেক পরের কথা।

-----৪ মাঘ ১৪২৯
----১৯---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা-----কাঠবিড়ালির লাফ---৬৩
-------------------------------------------------------------

ব্যর্থতা কাকে বলে? আর কাকে বলে সাফল্য? এরকমই একটি প্রশ্ন করেছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী তার বন্ধু সুব্রত চক্রবর্তীকে।

দুজনেই কবি ছিলেন।

ব্যর্থতা কি ভাস্কর চক্রবর্তীকে জড়িয়ে ধরেছিল?সাফল্য কি জড়িয়ে ধরেছিল সুব্রত চক্রবর্তীকে?

আমার জানা নেই।

যে সব সময় প্রচারের আলোয় ও বাজারে বিপণনে, সেই কি কবি? শিল্পী? নাট্যকার? অভিনেতৃ? সেই কি সফল?

যে রচনা করে নিভৃতে নিরালায় যার সৃষ্টির কাছে  আলো পড়েনি, সেই কি ব্যর্থ?

বিচার করবে কে? বাজার?

যার যত প্রচার সে তত বিখ্যাত, সেই কবি লেখক, শিল্পী কোন্ মানদণ্ডে?

আমাদের এই বাংলায় অনেক কবি শিল্পী আছেন, যারা নিজের মতো করে নিজের জায়গায় প্রচারের বাইরে  সৃষ্টিতে মগ্ন, যাদের কোনো সমাদর নেই, তাদের ব্যর্থ বলবো?

কলকাতা শহরেই অনেকেই আছেন একা একা  নিজের সৃজন কাজে, যাদের সৃষ্টি অথবা কবিতা গল্প ছবি ভাস্কর্যের  কাজ অনন্য অসাধারণ। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে গল্পকার ঔপন্যাসিক স্বপন চক্রবর্তীর কথা। দুর্গা দত্তর কথা। মনে পড়ছে সিউড়ির গৌতম দাসকে। যে যুবক চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিল অফিসে ঘুষ নিতে পারবে না বলেই। সে শুধু কবিতা লিখতেই চেয়েছিল।

মারা গেল অকালে।

তার আপসহীনতার কাছে আমি দন্ডবৎ।

বোলপুর শান্তিনিকেতনে সংঘমিত্রা ঘোষ নিয়মিত কবিতাচর্চা করেও নিজে আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। তাকে কবি বলবো না? বোলপুরের আরেকজন রামানুজ মুখোপাধ্যায় কলেজ বয়সে রচনা করেছে কবিতার পরে কবিতা। আজ সেই পথ ফেলে দিয়ে সে গদ্য ও প্রবন্ধের দিকে। তাকে ব্যর্থ বলবো নাকি সফল? 
যদি বলি, কোথাও ব্যর্থতা নেই কোথাও সফলতা নেই, শুধু নিজের কাজ করে যাওয়া।

অমিতাভ মন্ডল কলকাতায় থাকলেও তার বন্ধুরা ছাড়া তাকে চেনেনা আজকের সাহিত্য সমাজ।

অমিতাভকে ব্যর্থ বলবো?

হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কি তরুণ কবি সমাজে খুব পরিচিত নাম? সে মঞ্চ থেকে ক্যামেরা থেকে দূরত্বে থাকে। প্রভাত সাহার কবিতা ক'জন পড়েছে?

পুরুলিয়ার অজ গাঁয়ে থাকে অনিল মাহাত। সেই বাহাত্তর সাল থেকে কবিতাচর্চা করে নীরব থেকে নীরবতায়। পশ্চিমবঙ্গ কেন, তার খোঁজ রাখে না পুরুলিয়ার শিল্প সংস্কৃতি জগত। ২১ বছরের যুবক মুকেশ কুমার মাহাত মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে দেখতে পেয়েছে কীটপতঙ্গের চলাফেরা। সে কোনো ফটোগ্রাফারের কাছে ন্যাড়া বাঁধেনি। সে ছবি তুলতে তুলতেই জেনেছে মোবাইল ক্যামেরাতেও একটা চোখ আছে। এবং নিজের দুটো চোখ। অর্থাৎ তিনটে চোখ এক করে এই চরাচরকে পর্যবেক্ষণ। উত্তম মাহাতর ভাষায় মুকেশ হলো একলব্য।

কবিতা লিখতে লিখতে সরে দাঁড়ালো দেবমাল্য মাহাত। 

ব্যর্থতা বলবো?

হিমালয়ের চূড়াতে অনেকে ওঠে। শৃঙ্গ বিজয় করছে অনেকে। গজাবুরুতেও অসংখ্য তরুণ উঠছে। 

কে সফল আর কে সফল নয় বিচার করবে কে?

লাল রঙ গাঢ় হলে এক রকমের সৌন্দর্য। লাল রঙ একটু হালকা হলে আরেক রকমের সুন্দরতা। দুটি রঙই প্রধান। একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজন নয়।

চিত্রকলার জগতে চিত্রকরদের আসা যাওয়া চলছেই।এক -একজন একেক রকম চিহ্ন রেখে যায়। আর আদিবাসীরা নিজেদের ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকে।

ছবিগুলি কে আঁকে?

আশিস নন্দীর ছবি দেখতে ক'জন ছুটে যায়? সে পুরুলিয়া শহরে আঁকার স্কুল খুলে যেমন জীবিকা অর্জন করে, তেমনি ছবি আঁকে নিজেও নিয়মিত। ধারাবাহিক।

দীপংকর রায়ের কবিতার বই কার কাছে? তিনি কবিতা বাদেও গল্প উপন্যাস লেখেন।

"স্লো পয়জনের ফাইল" প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরেই অজ্ঞাতবাসে চলে গেল মন্থন মোদক। আমরা তার পাঠকেরা তার কাছে আরো নতুন কিছু আশা করছিলাম।
কিছুই কিছু নয় এই বোধ কি তাকে অস্থির করে তুলছিল?

"থিরবিজুরি" শুধু সম্পাদনা করে না। বিভিন্ন বিষয়ের উপরে প্রবন্ধ লেখালেখি করে অপূর্ব সাহা। নীরবে। আমরা তার কতটুকু খবর রাখি?

কীসের অভিমান? কবিতা থেকে মাইল মাইল কিলোমিটার দূরে অনির্বাণ দাস? নবাবই দশকের এই কবির কবিতা আমাদের এক সময় আলোড়িত করেছে খুব।

জগন্নাথ দত্তের কবিতা চর্চাও নির্জনে। সে কবি অনেকে জানলেও তার কবিতার কাছে কজন ঝুঁকে পড়েছে? 

বাজার ও বিপণন থেকে অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষ আড়ালে থাকে। প্রবীর ভট্টাচার্যের নাম নিঃশব্দ থেকে যায়। সেও তো কলকাতার ভিড়ে একা। তার কবিতাও নির্জন।

আমার মনে হয়, অনেক পাঠকের কাছেই নির্জনতা প্রিয়। কোনো কোনো পাঠক আছে নীরবতা থেকেই সংগ্রহ করে নীরব শিল্প।

ওর বাজারদর আছে বলে ও কবি। ওর বাজারদর নেই ও কবি নয়, এই সহজ অঙ্ক মান্য করা যায় না।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে অনেক গুণী মানুষ আছেন যারা আলোকবর্তিকা নিয়েই হেঁটে চলেছে ধুলামাটির রাস্তায়। তাদের পায়ের শব্দ সকলের কানে পৌঁছবে না কোনোদিন। 

আমি নিজেও কবিতা লিখতে আসিনি। নিজের অনুভব গুলি লেখার চেষ্টা করি মাত্র। থাকিও ঘরের এক কোণে। চন্দ্র সূর্যের আলোটুকু সম্বল করে। বেদনা একটাই, অভিমন্যু মাহাত একটা অজ গাঁ থেকে উঠে এসেও সে আজ নগরে। কর্মসূত্রে নগরবাসী হতেই পারে তা বলে সে ভুলে যাবে নিজের শিকড়? উত্তম মাহাত শিল্পের জন্য এখনো লড়াই করেই চলেছে।

মাটি পাথর সিমেন্ট বালি নিয়ে ভাস্কর্যের দিকে রাজীব মন্ডল। কোলকাতার কোলাহল থেকে দূরে নিজের কাজে বুঁদ হয়ে থাকে সব সময়। 

আমার শহরে ব্রততী পরামানিক টিউশনি করেও কবিতা চর্চায়। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, সময়ের সঙ্গে সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে জানে।

ভাস্কর চক্রবর্তীর অমোঘ পংক্তিটি আরেকবার উচ্চারণ করে আমার নমস্কার জানাই----

ব্যর্থতা কাকে বলে? আর কাকে বলে সাফল্য?

------৫ মাঘ ১৪২৯
-----২০---১---২০২৩
------নির্মল হালদার






আমার কবিতা---কাঠবিড়ালির লাফ---৬৪
---------------------------------------------------------

বিশু কবিতা লিখত।

বিশু মানে বিশ্বনাথ বাউরি। গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল লেখাপড়া করতে। প্রথমে বিএসসি। পরে বদলে গিয়ে ইতিহাস অনার্স। মাস্টার ডিগ্রীও করেছে। তাদের গ্রামে সেই প্রথম এমএ। স্কুল বয়সে তবলাও শিখেছে বিশু। এক আধটু গান বাজনা। পুরুলিয়া শহরে " লৌকিক "ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবলা বাজাতো। কিবোর্ড বাজাতো। সেই বিশু, বিশ্বনাথ বাউরি কবিতা থেকে গান বাজনা থেকে অনেক দূরে। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি এবং সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিন ব্যস্ত।

আমার একটা স্বপ্ন ছিল, মুখার্জি ব্যানার্জি চ্যাটার্জি ঘোষ বোস মিত্তিরদের পাশাপাশি বাউরি সম্প্রদায় শিল্প সাহিত্যে এগিয়ে আসবে। শুধু শিল্প সাহিত্য নয়, রাজনীতি থেকে প্রশাসনেও দেখতে পাবো পিছিয়ে পড়া অবদমিত শ্রেণীকে। 

বাস্তব অন্য কথা বলে, বিশুরা ঘর সংসার সমাজের চাপে দুমুঠো জোগাড় করার চাপে শিল্প ও সাহিত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। বিশুতো তবু স্কুল কলেজ গেছে, তাদের সম্প্রদায়ের বাকি সব ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যেতেই পারে না। অনেকটাই দারিদ্র্যের কারণে। চেতনার অভাবে। ফলে, বিশ্বনাথ বাউরির একটি কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে মুখোমুখি হতে পারলো না আজকের বাংলা কবিতা। আমি অবশ্যই আরেকজন কবিকে চিনি, সে হলো জয়দেব বাউরি। ধারাবাহিকভাবে কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাসে আছে সে। বিশ্বনাথ বাউরি এলে এবং কবিতার সঙ্গে থাকলে বাংলা কবিতা দু'জন বাউরিকে পেতো।

মাহাতরা আসছে। সমাজের নানান স্তরে দেখতে পাই মাহাতদের মুখ। আদিবাসীরাও নিজেদের ভাষায় সৃষ্টি করে যাচ্ছে গল্প কবিতা নাটক। খুব আনন্দের বিষয় আদিবাসীরা রক্ষা করছে নিজেদের ভাষা। সাঁওতালি ভাষার হরফ তৈরি করেছেন রঘুনাথ মুর্মু। কুড়মালি ভাষা রক্ষা করতে অথবা সংরক্ষণের জন্য সাম্প্রতিককালে উদ্যোগ দেখতে পাই। সাঁওতালি ভাষায় শিশু সাহিত্যে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পেয়েছে গণেশ মারান্ডি।গণেশ আমাদেরই ঘরের ছেলে। পুরুলিয়া বর্ধমান সীমান্তে তাদের গ্রাম মহেশ নদী।

আরো অনেক অনুন্নত শ্রেণী এই দেশে এই বাংলায়।

ডোম বা কালিন্দীরাও শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা পেলেও অনেক পিছিয়ে আজও। অনাময় কালিন্দী কবিতা লিখলেও চর্চাতে খুবই মন্থর। তার কাছ থেকে আশা করতে পারি, সে কালিন্দী সম্প্রদায়ের ভেতরে আলো ফেলবে। তার চেষ্টাও থাকবে বৈকি, সে অন্তত সম্প্রদায় থেকে সবাইকে না হলেও দু চারজন যুবককে আলোকপ্রাপ্ত করে তুলবে।

এদেশে এই বাংলায় শিক্ষা ব্যবস্থার যা হাল, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরাও নিজের নামের বানান ভুল লেখে। শিক্ষক মহাশয়রা স্কুলে পড়াতে যান না চাকরি করতে যান?

রাসু হাঁড়ি ছো--নাচে ধুলো উড়িয়েছিলেন এক সময়। আজ ধুলো ওড়ায় নৃপেন সহিস। 

সহিস বা হাঁড়ি সম্প্রদায় থেকে মেয়েরাও উঠে আসছে ছো-শিল্পে। মাহাত সম্প্রদায় থেকেও ঝুমুর নাচে গানে ও ছো-নাচে স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে মেয়েরা।

শিক্ষার অন্যান্য দিকে?

মাহাতরা শুধু কি ভোট ব্যাংকের পুঁজি? মিছিলের মুখ? বাউরি সম্প্রদায় ভোট ব্যাংকের পুঁজি? জ্যোৎস্না মান্ডিকে মন্ত্রীর পদ দিয়ে আদিবাসী সমাজের কতটুকু উন্নতি হলো? সন্ধ্যা রানী টুডুকে ক্ষমতা দান করে আদিবাসীরা ক্ষমতা পেয়েছে কি?

বেনে তামলি ময়রাদের মত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সম্প্রদায় বাণিজ্যের দিকে চলে যায়। কারো কারো ছোট পুঁজি বড় পুঁজির কাছে হারিয়ে গেলে ছোট পুঁজিকে রাস্তায় বসতে হয়। 

মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের ভিতরে কেবল শ্যাম অবিনাশ একা কবিতা গল্পে উপন্যাসে। আর যদি কেউ লেখালেখি করছেন আমার কাছে খবর নেই।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আমরা পেয়েছি মুজিবর আনসারীকে। ইতিমধ্যে মুজিবর বাংলা কবিতায় নিজের ছাপ রেখেছে। এছাড়াও মহঃ খুরশিদ আলম কবিতা বাদেও লোকসংস্কৃতিমূলক প্রবন্ধে জাগিয়ে তুলছে নিজের প্রতিভাকে।

নিরাময় মুদি গন্ধবনিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন। একটি কাব্যগ্ৰন্থ প্রকাশের পর নিজেকে গুটিয়ে ফেললো।

নাপিত বা পরামানিক সমাজ থেকে লিখতে এসেছিল সুবোধ পরামানিক। ধারাবাহিকভাবে না থাকার জন্য ক্ষুরধার হয়ে উঠলো না তার কবিতার ভুবন। বিদ্যুৎ পরামানিককে মাঝে মাঝে দেখতে পাই।

দুঃখ হয় সঞ্জীব বাউরি চিত্রকলায় মনোনিবেশ করলো না। আমরা খোঁজ পেলাম না তার মগ্ন চৈতন্যের। সাবান ফেনার মতো হেসে উঠেছিল ব্রজ কিশোর রজক। তার অক্ষর ও শব্দ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ওঠে না।

আমরা কি তবে ভট্টাচার্য গাঙ্গুলী রায়দের লেখালেখি পড়বো শুধু? আমরা কি শুধু সরকার মল্লিক সেনগুপ্ত দাশগুপ্তদের শিল্প সাহিত্যের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে উঠবো?

গরু চরাতে চরাতে একটি বাগাল ছেলেও গাছের পাতায় মাঠের ধুলোয় তার অন্তর ধ্বনি রেখে যায়। বেলা শেষে। সেই লেখার খোঁজ কে করবে?

কে এগিয়ে দেবে? কারা এগিয়ে দেবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে? ধীবর কী শুধু জাল ফেলে মাছ ধরবে? রুহিদাস কী শুধু মাথা নিচু করে জুতোয় পেরেক ঠুঁকবে? চেতনার দ্বার বন্ধ করতে কে বা কারা প্রয়াসী হয়েছে, খোঁজ করতে করতে চলো যাই, সদর দুয়ারে কামান দাগি।



-----৮ মাঘ ১৪২৯
-----২৩---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার





আমার কবিতা--কাঠবিড়ালির লাফ---৬৫
---------------------------------------------------------

গাছপালায় ঢাকা আঁধার এবং রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলেছে সে। কতদূর হেঁটে হেঁটে যাওয়া, সে জানে না। কোথায় যাবে সে জানে না।

আঁধারে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে যাওয়া।

ঝিঁঝিঁ পোকা শব্দ করছে না একবারও। পা পড়লেও শুকনো পাতা থেকে শব্দ ওঠে না।

জোনাকি নেই।

হেঁটে যাওয়া হেঁটে যাওয়া। 

কোথাও কোনো জায়গায় দমকা হাওয়া এসে জড়ো হয়ে আর শব্দ করে না।

চারদিক নিশ্চুপ। 

যেন বা ছুঁচের ছিদ্রেও শব্দের আসা-যাওয়া নেই। যেন বা জন্ম নেই মৃত্যু নেই। শুধু হেঁটে যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে কার কাছে যেতে হবে, সে জানে না।

তৃষ্ণা এসে আটকে গেছে গলায়।

গাছের গায়ে একবার ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো, গাছটা উপড়ে উঠে পালিয়ে যাবে কোথাও। সে আতঙ্কে আঁতকে উঠলো।

বসে পড়তেই মনে হলো একটা পাথরে বসেছে।কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলতেই, পাথরটা নড়ে চড়ে উঠলো। কেঁপে উঠলো সেও।


হেঁটে তো যেতেই হবে।

সে আঙুলের রেখা গুনতে গুনতে এগিয়ে গেলেও ভুল হয়ে যায় কররেখা। সে কামড়ে ফেলে দু'হাতের দশটা আঙুল। দেখতে চায়, ঠিক ঠিক জায়গায় ঠিক ঠিক আঙুলগুলি আছে তো!


সে হোঁচট খেয়ে পড়ে। অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারে রক্ত নয়, জল বইছে সারা শরীর থেকে।

সে চিৎকার করে ওঠে------

প্রতিধ্বনি নেই।

তার জুতো ছিঁড়ে গেছে। প্যান্ট শার্ট ফালা ফালা। তার মনে পড়ছে না কাউকেই। যন্ত্রণাও কি মনে আসছে?

হেঁটে তো যেতেই হবে।

হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ একটা ঘর। গাছপালা ঢাকা।অন্ধকারে অন্ধকারে শব্দহীন। সে ঢুকে পড়লো ঘরের ভিতরে।

দুটো জানালা। ভাঙ্গা। দরজায় কপাট নেই। মাটির দেয়ালে উইপোকা। চামচিকে উড়ে বেড়ায়।

একটাই মাত্র ঘর। তার মাঝে একটা প্রদীপ।কোনোদিন শিখা ছিল। কার ফুঁয়ে নিভে গেছে?

সে পকেটে দেশলাই খুঁজলো। যদি পুরনো সলতে জ্বালানো যায়। যদি নিজের সঙ্গে জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা বলা যায়!

-----১০ মাঘ ১৪২৯
----২৫---১---২০২৩
-----নির্মল হালদার





কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ