মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩

ঘর গেরস্থের শিল্প - ২১




ঘর গেরস্থের শিল্প

২১.
বঁটি

বঁটিতে দু চারবার আঙুল কেটেছে মা মাসিদের, দিদি বৌদির এই তো স্বাভাবিক। রক্তের দেখা না পেলে সম্পর্ক যে পোক্ত হয় না। বঁটির সঙ্গে সহজ হতে হলে এক আধবার রক্ত দিতেই হবে। বঁটিও থাকবে ঘরে।

এক রকম নয়, তিন তিন রকমের বঁটি।আঁশ বঁটি। নিরামিষ বঁটি। ফল কাটার বঁটি। তিন রকম বঁটি নিয়ে সংসার চলে।

আঁশ বঁটিতে মাছ মাংস কাটা হবে। শাকসবজিও কাটাকুটি করে। একেবারে নিরামিষাসীদের জন্য নিরামিষ বঁটি। অনেক পরিবারেই অনেকে আছেন যারা পেঁয়াজ - রসুন ছোঁয়া স্পর্শ করেন না। নিরামিষ বঁটিও তাই আঁশের ধারে--কাছে আসবে না একেবারেই।

ঠাকুর ঘরের বঁটি ঠাকুর ঘরেই থাকে। ফলমূল কাটে। শুদ্ধ শান্ত হয়ে থাকে চুপচাপ।

এ সমস্ত বঁটি কামার ঘরের বঁটি।

কামার শালে হাতা খুন্তি কড়াই তৈরির পাশাপাশি বঁটিও তৈরি হয়। আজও। আজও ধুকধুপ করে চললেও কামারশাল গ্রাম বাংলায় চলে। কোথাও কোথাও।

মাছের বাজারে যে সমস্ত বড় বড় বঁটি দেখা যায় তা আসে হুগলির কামারকুন্ড থেকে। পুরুলিয়ার ঝালদাতেও লোহার সামগ্রী তৈরি হয়ে থাকে। পুরুলিয়ার বাজারে দেখাও যায়।

পুরুলিয়ার ছোটখাটো মেলা বড় মেলাতে লোহার হাতা খুন্তি কড়াই বঁটি ও ছুরির দোকান বসে।

বিহার ও ঝাড়খন্ড থেকেও লৌহজাত সামগ্রী মেলাতে মেলাতে আসে বিক্রির জন্য। মহিলাদের কাছে চাহিদাও খুব।

নারকেল কোরার জন্য আরেক রকম বঁটি আছে, যার মাথা মোরগের ঝুঁটির মতো। যার সাহায্যে নারকেল কোরানো হয়। সেই বঁটিতে ফল কাটাও হয়ে থাকে। বঁটির নাম মাহাত্ম্য মহিলাদের কাছে থাকলেও আমার কাছে কামার বা কর্মকারদের বিশেষ একটি বিষয়, পুরুলিয়া জেলায় অনেক কর্মকার আছেন, যারা একসময় লিখে গেছেন ঝুমুরের পদ। তার মধ্যে চামু কর্মকার।অখু কর্মকার। উদয় কর্মকার। পরেশ কর্মকার। কৃত্তিবাস কর্মকার এছাড়াও আরো অনেকে আছেন। কামারদের সম্পর্কে একটি প্রবাদ শোনা যায় :
         ঢোলে গামহার
                        ঝুমুরে কামার।

কামার বা কর্মকাররা লোহার কাজে যুক্ত থেকেও রসিক হয়ে আছে পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিতে।

-------২৬ আষাঢ় ১৪৩০
-------১২---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার




২২.
তালপাতার পাখা।। হাতপাখা

(উৎসর্গ : মৃগাঙ্ক আমলকি)

সারা বছর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ঘরেই থাকে। এখনও আমাদের চারপাশে নিম্নবিত্ত পরিবার। গরিব পরিবার তো আছেই। এই সব পরিবারের সঙ্গে সারা বছর তালপাতার পাখা। হাতপাখা। শুধু কি গরম লাগলে হাতে পাখা ঘুরবে? উনুন না জ্বললে পাখার হাওয়া উনুনে পাঠিয়ে জ্বালাতে হবেই। জ্বর জ্বালা অসুখ-বিসুখ করলেও মাথার কাছে একটি পাখা। 

নিম্নবিত্ত পরিবারে গরিব পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে তালপাতার পাখা অপরিহার্য।

বাজারে প্লাস্টিকের পাখা এলেও সেই পাখার হাওয়াতে কোমলতা নেই। শীতল নয়।

যে সব জেলাতে পাখা তৈরি হয়, যারা পাখা তৈরি করে তারাও এক ধরনের শিল্পী। মানুষের শরীরকে সুস্থ ও সহজ রাখতে পাখার ভূমিকা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

পাখাও তো কুটির শিল্প।

শুধু তালপাতাটি বেঁধে শিল্পীর মুক্তি নেই। তিনি প্রতিটি পাখায় রঙের চিহ্ন  দিয়ে পাখার সাজসজ্জা করেন। আরো মনোহরণ। কোনো কোনো পাখায় ফুল লতা পাতা। হাতে পাখা ঘুরতে ঘুরতে ফুল লতা পাতার শিশির গায়ে লাগবে। যেন বা।

প্রকৃতি কত রকম ভাবে আমাদের উপকারে। আজও।

তাল গাছের মাথার দিকে চোখ না গেলেও তাল পাতা ঘরে ঘরে এসে সেবা করছে।

সেবা বলবো না শুশ্রুষা?

-------২৯ আষাঢ় ১৪৩০
------১৫---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার




২৩.
বাসনকোসন

আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কাজের লোক ছিল না। তখন কাজের লোক রাখারও চল ছিল না নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারে।

অথচ কাজ ছিল দেদার। ঘরদোর পরিষ্কার থেকে থালা-বাসন ধোওয়া -ধুয়ি। এঁঠো থালা বাসন ধোয়া মোছা করার কাজটি ছিল কঠিন কাজ। তো, সেই কাজটি সহজ করার জন্য ঘরের কেউ না কেউ বাজার থেকে নিয়ে এসেছি শাল পাতা। খাও দাও ফেলে দাও।

সেই আমলে কাঁসার থালা বাটি প্রায় সব ঘরে। আমার মনে আছে বেশ, আমি একটি পিতলের গ্লাসে নিয়মিত চা খেয়েছি।

কুটুম এলে কাঁসার বগি থালায় সাজানো হতো ভাত তরকারি। বাটিতে বাটিতে ডাল ঝোল। পিতলের গ্লাসে জল। এ থেকেই একটা পরিবারের আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

চুরিও হয়েছে।

তখনকার দিনেও কাঁসা পিতলের দাম ছিল যথেষ্ট। মেয়ের বিয়েতে পিতাকেও দান হিসেবে দিতে হয়েছে কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী।

মর্যাদার চিহ্ন।

মর্যাদা আর কতদিন রক্ষা করবে মানুষ? নিম্নবিত্ত মানুষ? বাজারে আসতে লাগলো টিন দস্তা স্টিল। ছেয়ে খেললো চারদিক।

মর্যাদার মূল্য বেড়ে যেতে যেতেই, কাঁসা পিতল বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত ধাতুর বাসন-কোসন দেখা গেল ঘরে ঘরে।

চেটেপুটে খাওয়া-দাওয়ার পরেও এঁঠো থালায় আঁকিবুকি করছি, নাম লিখছি নিজের। অথবা থালায় দেখতে পাচ্ছি, দুধে ভাতে থাকো। সেই খোদাই করা আশীর্বাদ স্টিলের বাসনে এলেও আশীর্বাদকে মনে হয় স্টিলের মত। যার গা থেকে দিনরাত্রির কিরণ নেই।

কাঁসা-পিতল সামগ্রীর সুনাম আছে মুর্শিদাবাদের। বাঁকুড়ার মলিয়ানেও হয়ে থাকে কাঁসা-পিতলের কাজ। এবং যারা এই কাজে দক্ষ তাদের আমরা চিনি না। চেনার চেষ্টাও নেই। যারা এখনও গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসী। তার সঙ্গে তাদের জীবিকাও জড়িত।

কাঁসা-পিতলও পরিবারের শ্রী। সৌন্দর্য তো নিশ্চয়ই। যা ভুলে যেতে যেতে ভুলে যাচ্ছি কাঁসা-পিতলের কৌলিন্য। 

------- ৯ শ্রাবণ ১৪৩০
---------২৬---৭---২০২৩
---------নির্মল হালদার




ঘর গেরস্থের শিল্প - ১৬



ঘর গেরস্থের শিল্প 

১৬.
পিঁড়ি

মেঘ এসেছে পিঁড়ি পেতে দে।

বৃষ্টি এসেছে পিঁড়ি পেতে দে।

কুটুম এসেছে সেবা করতেই হবে।

সেবা করার প্রথম কাজ, পিঁড়ি পেতে দাও। কাঠের পিঁড়ি। ঘরের পিঁড়ি।

কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি না থাকলেও পিঁড়ি আছে। বসতে দাও মাসি-পিসিকে।

ঈশ্বর যদি অতিথি হয়ে আসে পিঁড়ি পেতে দাও। সেবা করো। আশীর্বাদ পাবে।

পিঁড়ি ঘরের আসবাব নয়। পিঁড়িও কল্যাণমুখী। সে চেয়ে থাকে কখন আসবে কুটুম কিংবা অতিথি। সে চেয়ে থাকে কবে কখন বিবাহ অনুষ্ঠান। সে বর কনেকে বসাবে।

বিবাহ অনুষ্ঠানের পিঁড়িতে আঁকা হয়েছে ফুল লতা পাতা। পিঁড়ি হয়েছে সৌন্দর্যময়।

ঝড় এলেও বসতে দিও পিঁড়িতে। ঝড় থেমে যাবে। কথাও শুনবে সুখ দুঃখের।

মেয়েদের ব্রত কথায়, লোকাচারেও পিঁড়ি।

পিঁড়িতে বসতে দিলেই মন বসবে।

মনেই অধিষ্ঠান করে ঈশ্বর।

আমাদের গার্হস্থ কাঠামোতে পিঁড়িও এক শিল্প। রান্নাঘর থেকে বারান্দায় সাজানো আছে সারি সারি পিঁড়ি।

শিশুর জন্যেও আছে। সে পিঁড়ি পেতে খেতে বসবে ভাত। এখুনি একটা পিঁড়ি পাতো মামা আসছে।

বড় কুটুম।

-------দুপুর--১--৫১
-------১৬ আষাঢ় ১৪৩০
------১---৭---২০২৩
-----নির্মল হালদার




১৭:
ঝ্যাঁটা

ঝ্যাঁটা।
ঘর সংসারের উপকারে লাগলেও উপেক্ষিত হয়েই থাকে। অবহেলিত সর্বদা। লোক চক্ষুর আড়ালেই তাকে রাখা হয়। প্রয়োজনে ব্যবহার।

ঝ্যাঁটা।
নিম্নবর্গের মানুষ তৈরি করে থাকে। যত্নের সঙ্গে তৈরি করে আদিবাসীরাও। মাঠ থেকে এক একটি চোর কাঁটা তুলে একসঙ্গে বাঁধন দেয়। যে বাঁধন সংসারের বাঁধন। সংসার কে পরিচ্ছন্ন রাখে।

ঝুলকালিও ঝাড়ে ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ।

ঝ্যাঁটাইতো ব্যবহারিক শিল্প। অন্তর থেকে বাহির ধুয়ে মুছে সংসার করে পরিচ্ছন্ন। এই পরিচ্ছন্নতা থেকে মনের সুবাস।

এ বিষয়ে ঝ্যাঁটার অবদান প্রতিটি সংসারে। জগৎ সংসারেই তার অবস্থান। তাকেও যেন সম্মান দেখাতে ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই, যারা ধোওয়া মোছা করার জন্য তৈরি করছে ঝ্যাঁটার মত প্রয়োজনীয় এক সামগ্রী, তাদের কাছেও যেন নমস্কার রাখি।

------১৮ আষাঢ় ১৪৩০
-------৩---৭---২০২৩
-------নির্মল হালদার




১৮.
শাঁখ অথবা শঙ্খ

শাঁখ বাজছে।

সন্ধ্যে হলো গো মা------।

শাঁখ বাজলেই শুনতে পাই, সমুদ্রের ধ্বনি। সমুদ্রের সুর। শাঁখের সঙ্গেই থাকে সমুদ্র। এই সমুদ্র থাকে হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে।

সকাল সন্ধ্যা পূজার্চনায় শাঁখ বাজে। মন জুড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে ধূপের গন্ধ ।

এক নারী মুখ উঁচু করে শাঁখে ফুঁ দেয় যেন বা শাঁখের প্রথম ফুঁ উৎসর্গ করছে দেবদেবীর উদ্দেশ্যে। এই ছবি সারা বাংলায়। সকাল সন্ধ্যা। প্রতিদিন।

শঙ্খ হয়ে উঠল ঘরে ঘরে শাঁখ। তাকে ব্যবহার উপযোগী করে তুললো অজানা শিল্পীরা। তার ঠাঁই হলো পূজা বেদির কাছে। এবং পূজার সময় একটি তুলসী পাতা দিয়ে শাঁখকেও নিবেদন করা হয়। সেও তো মনকে শান্ত করে। ঘরেও নিয়ে আসে শান্তি।

শাঁখও কুটির শিল্প থেকে গেরস্থের ঘরে এসে কল্যাণমুখী। সে বিবাহ অনুষ্ঠানেও বেজে ওঠে। সংসারে নবজাতক এলে শাঁখ বাজিয়ে নবজন্মের উদযাপন। কিংবা নবজাতকের আগমনের পথ প্রশস্ত করা হয়, এ কথাও বলা যায়।

যেকোনো মাঙ্গলিক আচার -অনুষ্ঠানে শাঁখ বাজবেই। শঙ্খ ধ্বনির মধ্যেই সংসারে সমুদ্র এসে দাঁড়ায়। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধুয়ে দেয় আমাদের মনের কালিমা।

শঙ্খ ধ্বনি দিগন্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে সন্ধ্যেবেলার প্রথম তারার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিশোরী কন্যার মতো। যে তার মায়ের কথামতো শিখেছে শাঁখে ফুঁ দিতে।

------১৮ আষাঢ় ১৪৩০
------৪---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার




১৯.
পানের ডাবর

সবকিছু রাখার একটি পাত্র চাই। যেমন জলের আধার মাটি। যেমন ভালোবাসার আধার হৃদয়। তেমনি পান রাখার একটি পাত্র ডাবর।

কাঁসার ডাবর।

অল্প জল থাকবে ডাবরে পানকে ভিজিয়ে রাখার জন্য। সজীব রাখার জন্য। ডাবরের উপরে একটি কাঁসার থালা। যেখানে থাকে জাঁতি।

বিবাহের সময় কনের সঙ্গে দান সামগ্রী হিসেবে কাঁসা-পিতলের বাসন-কোসন দেওয়া হয়। এইসঙ্গে পানের ডাবরও থাকবে।

পুরনো হলেও এই ছবি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতির শিল্পের ধারা। সেই শিল্পকেই ধারণ করেছে বাঙালি, যা ব্যবহার উপযোগী। যা যথার্থ সুন্দর। যা থেকে গেরস্থ পরিবারের জীবনযাত্রার একটি রূপ আজও আমাদের কাছে।

আচার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দেবদেবীর পূজায় পান লাগবেই। পানের প্রতীকি ব্যঞ্জনা যেই হোক, পানের ঠাঁই একটি কাঁসার ডাবর।

ডাবরের চেহারাও গর্ভবতী নারীর মতো। ধারণ করে আছে পান।

মঙ্গলদাত্রী।

-------২১ আষাঢ় ১৪৩০
------৭---৭---২০২৩
------নির্মল হালদার



২০.
কুলা

বাঁশের তৈরি একটি কুলো।

কালিন্দী বা ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ ঝুড়ি ঝ্যাঁটার সঙ্গে তৈরি করে কুলো। কুলোর সমস্ত বাঁধন বাঁশের বাঁধন।

কঠিন বাঁধন।

কুলোর তিনটে বেড় দেখলেই মালুম হয়, কুলো-কারিগর, কারিগর নয়, শিল্পী। কুলো থেকে সহজেই পড়ে যাবে না ধান গম চাল।কুলোর পিছন দিকটি নিচু যেমন, উপরের দিক উঁচু।

পাছড়াতে পাছড়াতে চাল থেকে উড়ে যায় আবর্জনা। চাল বা গম থেকে আলাদা হয়ে যায় বালি ও কাঁকর।

ঘর গেরস্থে কুলো অপরিহার্য।

কুলো নিয়েই পূজার্চনা হয়ে থাকে।

কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়ানো হয়ে থাকে ঘরের অলক্ষীকে।

কুলো আমাদেরই।

সেই কুলো শিল্পীরা এই বাংলার গ্রামে গ্রামে। তাদের খোঁজ ক'জনই বা রাখি! ক'জন  জানি, তাদের ভাঙাচোরা জীবনের ছন্দে ছন্দ মেলানোর আর কেউ নেই।

ক'জন জানি, চড়াই-উৎরাই।

কুলোতেই তো  ফুল ফল রেখে ঘরে অভ্যর্থনা করি নতুন মানুষ।

নতুন আলো।

সূর্যোদয়।

--------২৩ আষাঢ় ১৪৩০
--------৯---৭---২০২৩
--------নির্মল হালদার






ঘর গেরস্থের শিল্প - ১১




১১:
ঘর গেরস্থের শিল্প

শাঁখা চাই -----শাঁখা চাই----
এই মহল্লা থেকে ওই মহল্লা----
শাঁখা চাই ---- শাঁখা চাই -----

রোদ পড়ে যাওয়া বেলাতে শাঁখারিদের হাঁক----মহল্লা থেকে মহল্লা।

লাজ দুয়ারের দরজা খুলে উঁকি দেয় ছোট বউ। জানলা খুলে উঁকি দেয় সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি। শাঁখারি দাঁড়িয়ে গেছে। মনে হয়েছে তার, ঘরের ভিতরে কেউ ডাকছে। কেউ কেউ শাঁখা পরবে।

ধূতি ও কামিজ পরা শাঁখারির মুখে আলগা হাসি। সে ঘর ভিতরে ঢুকে উঠোনে বসে পড়ে। ঘরের বউ ও অন্যান্যরা একে একে জড়ো হয়। শাঁখারিও তার টিনের বাক্স খুলে দেখাতে থাকে শাঁখা। দেখাতে দেখাতে সেও নিজের ঘরের গল্প করে। তিনটে মেয়ে ছিল, এখনো বিয়ে দিতে বাকি একটি মেয়ের। পণের টাকা কোথায় কিভাবে কার কাছে পাবে, শাঁখারি দুশ্চিন্তার কথা বলে। বলতে বলতেই, শাঁখা পরায় মেয়েদের কোমল হাতে। তারই মাঝে কোনো বউ কোনো গোপন কথা থেকে হেসে উঠে, আরেক বউয়ের গায়ে পড়ে।

শাঁখারির জল তেষ্টা পেলে এক গ্লাস জল খোঁজে মেয়েদের কাছে। কোনো কোনো ঘরে শাঁখারির জুটে যায় এক কাপ চা।

এই তো ছিল একসময়ের গ্রাম বাংলার ছবি। এই ছবি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হয়ে ধূসর হয়ে গেছে।

শাদা শাদা শাঁখা গুলি রয়ে গেছে আজও। গ্রাম বাংলার মেয়েদের হাতে। এখানে প্রশ্ন---শাঁখারিরা কোথায় গেল? যারা নিজেদের ঘরে নিজেরাই তৈরি করত শাঁখা। নিজেরাই গড়ে তুলেছিল কুটির শিল্প। শাঁখার গঠন শাঁখার সৌন্দর্য সেই কারিগরের দল জানতো বলেই শিল্পকেও এক রকম জেনেছিল তারা।

সেই শাঁখারিরা বিকল্প কাজ খুঁজে পেয়েছে কি?

আজও গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে দারিদ্র ও অসহায়তা থাকার পরেও মেয়েরা পরবেই শাঁখা। সেই শাঁখা গুলি তাই চাঁদের শুভ্রতার সঙ্গে থাকে।

-------৭ আষাঢ় ১৪৩০
-------২৪---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার



১২.
চন্দন পিঁড়ি

গন্ধ আসছে। শরীর ও মন হয়ে উঠছে পবিত্র। ঘরের ভিতরে ঢুকে টের পাই , গন্ধটা হলো চন্দনের গন্ধ। কিন্তু এই ঘরটা তো ঠাকুর ঘর নয়। এই ঘরটা বসার ঘর। বৈঠকখানা।

তবে কি ভেতর ঘর থেকে গন্ধটা আসছে? ভেতর ঘরে কেনই বা, চন্দনের গন্ধ?

আমার মনে পড়তে লাগলো, শ্বেত শুভ্র চন্দন বাটা। ঠাকুর ঘরে পুজো করছে মা। সকাল বেলা। মনে পড়তে লাগলো, আমার সঙ্গে চন্দনের সম্পর্ক ছিল বছরে দুবার। একবার ভাই ফোঁটার সময়। আরেকবার পরীক্ষা চলাকালীন। কপালে চন্দনের ফোঁটা দিলে মাথা ঠান্ডা থাকে। ভালো হয় পরীক্ষা। এ বাদে চন্দনকে আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, বিয়ের কনের কপালে চন্দনের ফোঁটায় সাজাতে।

গ্রীষ্মকালে গায়ে হাতে ঘামফোঁড়া হলে চন্দনের প্রলেপ। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।

এ সমস্ত কারণেই, পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে চন্দন পিঁড়ি সবার ঘরে ঘরে। মনে পড়ছে, ঘষতে ঘষতে চন্দন ক্ষয়ে গেলে মা অনেককে বলতো, একটা চন্দন কাঠ নিয়ে আসবি রে। পূজা করতে পারছি না।

গৃহস্থ ঘরে যা যা প্রয়োজন হয়ে থাকে, তার মধ্যে চন্দন কাঠ ও চন্দন পিঁড়ি অবশ্যই থাকবে। শিল্প হয়েই থাকবে। যে শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল মানব সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে। যা আজও ধারাবাহিক। মানুষের মঙ্গলে।

ঠাকুর ঘরে দেবদেবীর সঙ্গে শান্ত হয়ে থাকে চন্দন পিঁড়ি ও চন্দন কাঠ।

চন্দনের গন্ধ শিল্পের সুবাস। আবহমান। এইতো সেদিন পুরুলিয়ার মাঠাতে চন্দন গাছের কাছে দাঁড়িয়ে নত হয়ে গেলাম। মনে মনে।

জানতে চাইছিলাম, যুগ যুগ ধরে এই সুগন্ধ কে পাঠায়? জানতে চাইছিলাম, এই সুগন্ধ কি স্বর্গ থেকে আসছে?

নিরুত্তর চন্দন গাছ থেকে দু একটি পাতা খসে পড়ল আমার মাথায়।

------১০ আষাঢ় ১৪৩০
------২৬---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার


১৩:
ঘর গেরস্থের শিল্প

কুমোরের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে হাঁড়ি-কলসি। এক তাল দু তাল তিন তাল মাটি কুমোরের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী গড়ে ওঠে।

হাঁড়ি--কলসির পাশাপাশি গড়ে ওঠে প্রদীপ। পিলসুজ। কুমোরের কুটির শিল্প সংসার জীবনে হয়ে ওঠে গেরস্থের শিল্প।

এই শিল্প আলো করে তুলসি থান।

দেবদেবীর কাছেও প্রদীপ জ্বলে।

আর আমি দেখতে পাই, প্রদীপের আলোয় একটি ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনা করছে। আমি দেখতে পাই, রাস্তা হারিয়ে একটি ছেলে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘরের সামনে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরে জ্বলছে একটি প্রদীপ।

একাকী প্রদীপ।

প্রদীপের নিঃশব্দ শিখায় আবছা হলেও দেখা যায়, ফাটা দেওয়ালের গায়ে পাঁচটা আঙুলের চিহ্ন।

সামনে খুব সামনে না গেলে দেখা যাবে না স্পষ্ট হবে না, প্রদীপটি পেতলের না মাটির।

কোনো একদিন প্রদীপ ও পিলসুজ ছিল পেতলের। সন্ধ্যে দেবার আগে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতো ঘরের কোনো মেয়ে।

অর্থনীতির টালমাটালে অনেক কিছুর রূপ পাল্টে গেছে। কুটির শিল্প যেটুকু আছে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষের দিকে।

গ্রাম জীবনের সংসারে মাটির প্রদীপের চাহিদা বেশি। গরাম থান থেকে তুলসি থানে মাটির প্রদীপ জ্বলে।

পিলসুজও মাটির। পিলসুজের উপরে থেকেই প্রদীপ তার শিখা ঊর্ধ্বমুখী করে।

ঊর্ধ্বে কে আছে?

শিল্পের দেবদেবী কোথায় থাকেন?

প্রদীপের রূপ মাতৃমুখী।

মাতৃমুখী আলো থেকেই শিল্পের আগুন। ঘর গেরস্থে অনির্বাণ। প্রদীপের মুখে। প্রদীপ শিল্পী কুমোর মাটি মাখতে মাখতে মঙ্গল কামনা করে এই সংসারের।

প্রদীপ জ্বলবেই সংসারে।

--------১১ আষাঢ় ১৪৩০
--------২৭---৬----২০২৩
---------নির্মল হালদার




১৪.
জাঁতি


জাঁতিও পরিবারের একটি অঙ্গ। পানের বাটার সঙ্গে থাকবে। বরের সঙ্গেও থাকবে বিয়ের সময়।

জাঁতি বরের সঙ্গে। কনের সঙ্গে কাজললতা।

জাঁতি ও কাজল কিসের প্রতীক না জানা থাকলেও বলতে পারি, বাঙালি বিবাহে যখন থাকছে, তখন তা মাঙ্গলিক।

জাঁতি পরিবারের একটি অঙ্গ।

এক সময় তো ছিলই, পানের বাটা থাকলে জাঁতি থাকবেই। জাঁতি যে সুপারি কুচি কুচি করে।

পান রসসিক্ত হয়ে ওঠে চুন সুপারি খয়েরের মিশ্রণে। লাল হয়েও ওঠে। সে এক অন্য কথা, এখন কথা জাঁতি সম্পর্কে। একসময় রূপোর জাঁতিও দেখা যেত। ব্যবহার না হলেও ঘরের অলংকার হিসেবে একটি শোভা। এবং তার অনেক রূপ। কর্মকারদের মতো কারিগররাও লোহার জাঁতি তৈরি করেছে। এই জাঁতি যেন পরিবারের ছোট ছোট দুঃখ-বেদনা গুলি সুপারির মতো কাটে। এক সময় কেটেওছে। আমরা পেয়েছি, জাঁতির মত এক শিল্প। আজ হারিয়ে যাওয়ার মুখে জাঁতিকেও মনে পড়ে বৈকি।

জাঁতির গায়েও লেগে আছে চুনের দাগের মতো অথবা পানের লাল দাগের মতো আবছা অভিমান।

যে অভিমানের রঙ বয়ে বেড়াতো মা ঠাকুমা। জেঠি খুড়ি। মাসি পিসিরা।

শিল্পে যতই ঠাঁট-ঠমক আসুক,কুটির শিল্পের গরিমা পেতল কাঁসা লোহা থেকেও প্রকাশ পেয়েছে। ঘরে ঘরে। তা রক্ষা হলে, শিল্পী বা কারিগররাও রক্ষা পাবে বলেই মনে করি।

--------১২ আষাঢ় ১৪৩০
--------২৮---৬----২০২৩
---------নির্মল হালদার



১৫.
শিলনোড়া

বেলা বারোটা বাজতে বাজতেই সবাই খিদে খিদে করে। কাক এসে ডাকে। পায়রা এসে ডাকে। দুয়ারে কুকুর এসে দাঁড়ায়। রান্নাঘর থেকে হাতা খুন্তির শব্দ শোনা যায়। কড়াইয়ে তেল পড়লেও শব্দ শোনা যায়। শিল--নোড়া থেকেও শব্দ আসে।

শিল--নোড়া সংসারের অতি প্রয়োজনীয় কাজের সামগ্রী। সংসারে কবে এসেছিল কেউ মনে করতে পারে না। একসঙ্গে এসেছিল একসঙ্গেই আছে। শিলের সঙ্গে নোড়া, যুগলবন্দী এক রূপ।

বাটাবাটির শব্দ হলেই, মেয়েদের হাতে চুড়ির রুনুঝুনু। যেকোনো মসলা বাটার সঙ্গে শিল ধোওয়া জল। শাঁখা-চুড়ি ধোওয়া জল।

যেকোনো রান্নাকেই সুস্বাদু করে।

হিন্দু বাঙালি পরিবারে অরন্ধনের দিন শিল-নোড়াকে শান্ত রাখা হয়। লাল পাড়ের শাড়ি পরিয়ে অঞ্জলি দেওয়া হয়ে থাকে।

উনুন ও শিল-নোড়াকে মা ষষ্ঠী রূপে দেখা হয়। বাঙালি ঘরের ধারাবাহিক এই লৌকিক পূজার্চনার ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে আছে ব্যথা বেদনার ও আনন্দের প্রতীকি ব্যঞ্জনা। যা শিল্প হয়ে উঠেছে।

শিল্প তো সেই, ঘর থেকে বাইরে বৃত্তকে করে বৃহৎ। এখানে শিল-নোড়ার ভূমিকাও পরিবারের সদস্যের মতোই। সঙ্গে সঙ্গে আছে।

আমরা মনে করতেই পারি, সভ্যতার শুরুতে পাথরে পাথরে ঘর্ষণ। জ্বলে উঠেছিল আগুন।

শিকড় -বাকড় বাটার জন্যে মানুষ সাহায্য নিয়েছিল পাথরের। হয়ত পাহাড় থেকে গড়ানো পাথর শিল-নোড়ার কাজ করেছিল।

যা ধারাবাহিক শিল্প রচনা।

------ ১৪ আষাঢ় ১৪৩০
------৩০--৬--২০২৩
------নির্মল হালদার






ঘর গেরস্থের শিল্প - ৬




ঘর গেরস্থের শিল্প

৬.
গোবর মাড়ুলি

আজও হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে ভোরের দিকে গোবর মাড়ুলি দেখা যায়। দরজার বাইরে। তুলসী তলায় গোবর মাড়ুলি। বিশেষ করে গ্ৰামীণ সমাজে এবং মফস্বল শহরে। কুড়মি সমাজেও গোবর মাড়ুলি দেবার রীতি আছে।

হিন্দু সংস্কৃতি ধারায় আরও যে সমস্ত সম্প্রদায় আছে তারা যেমন গোবর মাড়ুলি দেয় তেমনি হিন্দু সংস্কৃতির বাইরের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও মাড়ুলি দেবার প্রচলন আছে।

এই মাড়ুলি দেবার প্রচলন সম্পর্কে শোনা যায়, যখন দেখা গেল গোহত্যা চলছে দিকে দিকে, তখনকার সেই সমাজের মুখিয়াদের মাথায় হাত----গেল গেল সব গেল। কেন না, গরু কৃষি কাজের উপকারে লাগে। গরুর দুধও উপকারী। এই গরু হত্যা দিন দিন চললে, লুপ্ত হয়ে যাবে গরুর বংশ। তখন গরুকে রক্ষা করার জন্যই শুরু হলো ভগবতীর পূজা। গরু হলো ভগবতী। মায়ের মত। গরুর বিষ্ঠাও উপকারী। চাষবাসের জন্য। অর্থাৎ গোবর হল সার। গোমূত্র এলো পুজোর অনুষ্ঠানেও।

গরুর সবকিছুই হিন্দু বাঙালির ঘরে পবিত্র হয়ে উঠলো। এবং কুড়মি সম্প্রদায়ের মধ্যেও। এ কারণেই, ভোরবেলায় দুয়ারে বা উঠোনের মাঝে, তুলসি থানের সামনে গোবর মাড়ুলি কিংবা গোবর ছড়া দিয়ে চারদিক শুদ্ধিকরণ করা হয়।

ঘরের মেয়েরা মাড়ুলি যখন দিচ্ছে তখন যেমন তেমন করে দিচ্ছে না। প্রায় আলপনার মতই আঁকছে একটি গোল বৃত্ত। যেন বা ভোরের প্রথম সূর্য। ঘরে ঘরে এসে গৃহস্থের কল্যাণ করবে।

এই মাড়ুলিও কল্যাণমুখী। এই মাড়ুলিও মেয়েদের হাতে শিল্প হয়ে রচনা করছে সকালের সূচনা।

এই মাড়ুলি প্রসঙ্গে আমার কবি বন্ধু দুর্গা দত্তের একটি কবিতা সবার জন্যেই রাখছি :

মা
-------
মা মাড়ুলি দেয় ভোরের আভায়
সদর দরজার সামনে দোকান দাওয়ায়
জলে ও গোবরে খুব ঘন করে গোল গোল করে
মাড়ুলি দিয়েই চলে শিবথানে আটচালায়
ওলাইচণ্ডীর থানে মনসাতলায়

মায়ের কপাল থেকে সিঁদুরের টিপ
উঠে পড়ে পুবের আকাশে----

প্রতি ভোরে ঠিক ঠিক মাড়ুলি যেমন।

------৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১৫---৬---২০২৩
-----নির্মল হালদার




৭.
মুড়ি

বাঙালির ঘরে ঘরে মুড়িও এক আহার। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের পুরুলিয়া বাঁকুড়া বীরভূমে। সকালের জলখাবার ------ মুড়ি। মুড়ির সঙ্গে তেল কাঁচা লঙ্কা ও তেলেভাজা।

একসঙ্গে মাখামাখি করে সুস্বাদু জলখাবার। সকাল বেলা।

আমার মাকে দেখেছি, এক থালা মুড়িতে এক গ্লাস জল ঢেলে এক চিমটে নুন মিশিয়ে কাঁচালঙ্কা মুড়িতে ঘষে মায়ের খাওয়া। মা কোনোদিনই তেলেভাজা খেতো না। দিদিদের দেখেছি, তেলেভাজা না পেলে ডাল মেখে মুড়ি খেতে। তখন হয়তো উনুনে চাপানো হয়েছে ডাল।

এ গল্প তো পারিবারিক গল্প। এই গল্পে আর একটু যোগ করতে হয়, আমাদের ঘরেই মুড়ি ভাজার চল ছিল। আমার মা মুড়ি ভাজতো। বড় বৌদিকেও দেখেছি ভাজতে।

সবাই মুড়ি ভাজতে পারে না। মাটির খোলায় বালি দিয়ে মুড়ির চাল ফেলে বাঁশের কুচিতে নাড়াচাড়া করতে করতে ফুটে উঠতো চাল।

কুচি কতটা নাড়াবে কতটা নাড়াবে না এবং খোলার বালি কতটা তেতে থাকবে, জানতে হবে অবশ্যই।

একটা সময় ছিল যখন মহল্লায় মহল্লায় মুড়ি ভাজুনিদের দেখা যেত। ঘরে মুড়ি ভাজার কেউ নেই, ভাজুনিকে ডাকা হলো। সে পারিশ্রমিক পাবে কয়েক সের ধান।

মুড়ি ভাজাও ছিল এক ধরনের জীবিকা। এবং এ কাজ করেছে মহিলারাই। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে মেয়েদের ভূমিকা সবসময় উজ্জ্বল।

দেখার জন্য মন চাই।

মনের দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা যায় মেয়েদের ভূমিকা সন্তান লালন থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে মেয়েরা এগিয়ে। এজন্যে ওদের কোনো মাসমাইনে নেই। কিন্তু পরিশ্রম আছে। তার মূল্য দিতেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অপারগ। এই সমাজের প্রধান দোষ, অর্থ দিয়ে সবকিছুর মাপামাপি করা।

মেয়েদের গুণের পরিমাপ করবে কে? মেয়েরাই তো সন্তান লালন পালন করে। মেয়েদের হাতেই গড়ে ওঠে দিন রাত্রির আহার। এখনও। এই দেশে।

মেয়েদের এড়িয়ে অথবা আড়াল করে ঘর ও বাইরের রাস্তা এগিয়ে যায় না। যাবেও না।

আরেকটা কথা বলতে হয়, আমরা পুরুষ ও মহিলা আলাদা আলাদা করে ভাগ করবো কেন? আমরা বলবো না কেন, মানুষের পাশে মানুষ সৃষ্টি করে নির্মাণ করে প্রেম ভালবাসা থেকে রান্নাবান্না।

হয়তো গ্রামের দিকে দেখা যায় আজও শোনা যায় আজও, মুড়ি ভাজার শব্দ। যদিও এই শব্দ চাপা পড়েছে যন্ত্রের তলায়।

মুড়ি ভাজুনিদেরও দেখা যায় না আজকাল। তাদের খুঁট থেকেও খুলে গেছে পানদোক্তা। পা মাড়িয়ে চলেও গেছে কেউ। শালপাতায় নিজেকে মুড়ে নিজেকে রক্ষা করছে কান্না আর কান্না।

-------৩ আষাঢ় ১৪৩০
-------১৯---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার



৮.
আচার

আচার। আমের আচার করতে হলে, মৌরি গোটা জিরে ধনে শুকনো লঙ্কা, কম পরিমাণে মেথি শুকনো কড়াইয়ে গরম করে কিংবা ভাজা ভাজা করে গুঁড়ো করতে হয়। তার আগে কাঁচা আম সুন্দর করে কেটে, নুন হলুদ মেখে রোদে শুকানো। তার পরের কাজ সর্ষের তেল গরম করে অন্য একটি পাত্রে আলাদা করে রাখতে হবে। তারপর মসলা মাখিয়ে আবার অল্প নুন দিয়ে রোদে শুকানো আম গুলি ফেলে দেওয়া।

এই হলো, তেলের আচার।

মিষ্টি আচার করতে হলে, কম তেল কড়াইয়ে গরম করে শুকানো আমগুলি ফেলে দাও। তারপর দিতে হবে গুড়। আগুনের আঁচে থাকতে থাকতেই মাখামাখি হবে সব একসঙ্গে। এরপর আগুন থেকে নামানো।

এবং প্রতিদিনই রোদে রাখা। হাওয়ার মধ্যে রাখা। যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়ে যায়।

এসব তো কেজো গল্প।

আচার নিয়ে আমারও আছে ছোটবেলার গল্প। আমি তো আর আচার তৈরি করতে যাইনি। যা করেছে যেটুকু করেছে মা।

আমাদের অভাবের সংসারে আচার করতেও ভাবনা চিন্তা করতে হয়েছে। কারণ আর কিছুই না, খরচ হয়। তেলের খরচ গুড়ের খরচ। জোগাড় করতে হয় অথবা দেখতে হয়, গত বছরের কাচের বয়াম এ বছর আছে তো! ভেঙ্গে যায় নি তো!

এই জটিলতার দিকে না গিয়ে আমার দায়িত্ব থাকতো, আচারের বয়াম দিয়ে আসতে হবে রোদে। আমি তখনই মিষ্টি আচার দু-একটি তুলে মুখে নিয়ে ঘরে থাকতাম না। কারো সামনে থাকতাম না, ধরা পড়ে যাব।

যখন তখন বাসি কাপড়ে ছোঁয়া যাবে না আচার। আচারেরও অনেক আচার-নিয়ম। ঘরের ভেতরেও তাকে রাখতে হয় সাবধানে। ধরা ছোঁয়া থেকে দূরত্ব রেখে। তো বলছিলাম, মায়ের আমলে মা সব সময় বলতো, বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এলেই বলতো, বাজারে দেখবি রে আম এসেছে তো নিয়ে আসবি। আচার করব একটু।

গ্রীষ্ম পার হলেই শাকসবজির অভাব দেখা যায়। বেড়ে যায় দাম। অথচ ভাতের সঙ্গে একটু টক না হলে মানায় না। পাল্টায় না মুখের স্বাদ। বর্ষার দিনে টমেটো যাকে পুরুলিয়ার সাধারন মানুষ বলে, বিলাতি। বিলাতির দাম হয়ে যায় আগুন ।

ঢেঁড়সের সঙ্গে বিলাতি দিয়েও এক রকমের টক হয়ে থাকে। আজও হয়। শুকনো আবহাওয়াতে টকের প্রয়োজন হয় খুব। কুচো চিংড়ির সঙ্গে বিলাতির টক খেলে জিভে লেগে থাকবে। আর আচার তো বছরে একবার। কুটুমের মত আসে চলেও যায়।

গ্রীষ্মের সময় আচার চাই ।

আমার বাড়িতে আজও আমার মাড়োয়ারি কবি বন্ধু শ্যাম অবিনাশের বাড়ি থেকে আচার আসে। গ্রীষ্ম দিনে।

মাড়োয়ারি পরিবারের আচারের সঙ্গে আমাদের বাঙালি পরিবারের আচারের খুব সামান্য তফাৎ। তাদের আচার বেশি বেশি শুকনো। কারণটা মনে হয়, তারা রুটির সঙ্গে আচার খেয়ে থাকে।

আমার বালক বেলাতে আমি এক বিহারী ঘরে ছোলা পাতার আচার খেয়েছিলাম। এখনো সেই ছোলা পাতা দেখলে আমি পিছন দিকে ফিরে যাই। আমার মনে পড়ে বিহারী পোস্টমাস্টারের কথা।

তাঁর স্নেহ ছিল মিষ্টি আচারের মত।

সেই সমস্ত আচার বাজারে বাজারে পণ্য হয়ে উঠলো। কুলের আচার তো আমরা খেয়েছি। আজও খাই। বাজারে এখন রসুনের আচার বিক্রি হয়। আদার আচার বিক্রি হয়ে থাকে। নানান কিসিমের আচার। বেশ চড়া দাম।

কাছে দাঁড়াতে ভয় করে।

ছোটবেলায় দেখা, আচার তৈরি করার মধ্যেও  অনেক গল্পগাছা এক জায়গায় জড়ো হয়ে,বঁটিতে আম কাটা। আবার আঁশ বঁটি হলে চলবে না।

শুদ্ধতা বজায় রেখে আচার তৈরি করতে হয়। আজও। সেই ঘরের আচার মা কাকিদের তৈরি করা আচার পাওয়া না গেলেও বাজারের দিকে চলো।

মায়ের তৈরি আচারের স্বাদ না পেলেও বাজারের তৈরি করা স্বাদ গ্রাহ্য করতেই হবে। বেঁচে থাকার যে কত আঁকাবাঁকা পথ।

হেঁটে যেতেই হবে।

নান্দনিকতার সঙ্গে দেখা না হলেও হেঁটে যেতেই হবে।

-------৫ আষাঢ় ১৪৩০
------২১---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার




৯.
ঠোঙা

খবরের কাগজ কতজনের ঘরে আর থাকতো! খবর পড়ার ও খবর শোনার মত আগ্রহ কতজনের ছিল?

আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে না কিছুই।

তুলিনের দিদি বাড়িতে আনন্দবাজার দেখেছি। প্রতিদিন। বাসি কাগজ। পড়ার অভ্যেস হয়ে গেছলো। আমি পাতা উল্টে বিনোদনের পাতা অথবা সিনেমার পাতা দেখতাম। সেই খবরের কাগজ বাড়িতেও দেখেছি। ছোটবেলায়। ছোড়দি বাদে বাকি তিন দিদি ঠোঙা করতো। নিয়মিত। শুনেছি, তাদের বিয়ের জন্যেই  তারা বাবাকে সাহায্য করবে। ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি ক'রে। কেননা, বিয়েতে বাবাকে দিতে হবে পণ।

বিকেল না হতে হতেই, দিদিরা ঠোঙা করতে বসতো। আমার আবছা মনে পড়ে, ঠোঙা করতে করতে কোনো দিদি ঘুমে ঢলে পড়ছে।

ঠোঙা করার আগে একটা পুরনো পাত্রে ময়দার চিট ( আঠা) তৈরি করতো রান্না শেষের উনুনের আঁচে।

আমরা ছোটরা ঠোঙা করার বাতিল কাগজ নিয়ে ঘুড়ি বানিয়েছি কত। আমাদেরও প্রয়োজন পড়তো চিট। কাগজের সঙ্গে কাগজ জুড়তে হবে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরেই , দিদিরা মেঝেতে খবরের কাগজ পেড়ে সাইজ করে কাটতো। একদিকে ছোট ও মাঝারি ঠোঙা আর আরেক দিকে বড়ো ঠোঙা। মোট তিন রকমের ঠোঙা।

তিন চার দিনে গাদা গাদা ঠোঙা জমে উঠতো। চিট শুকানোর পরে ঠোঙা সাজানো। বেঁধে ফেলা। এর পরে বিক্রি। অনেকেই ঘর থেকে কিনে নিয়ে যেত।

খবরের কাগজের ঠোঙার পাশাপাশি আটা বিক্রি করা হবে এমন ঠোঙাও তৈরি করতো দিদিরা। কোনো আটা কলের মাড়োয়ারি মালিকের অর্ডার।

ঠোঙা সাপ্লাই করলেই মজুরির টাকা।

সেই আটকল থেকে অনেকদিন মাথায় করে কাগজ নিয়ে এসেছি। বিশেষ এক কাগজ। মাটি মাটি রঙ। মালিকের কাগজ, দিদিরা বানালে মজুরি পাবে।

আমাদের পরিবারে শুধু নয় অনেক পরিবারেই ঠোঙার কাজ। এবং ঠোঙা বিক্রি থেকে দু চার পয়সা রোজগার। সংসারের মুখে আলো জ্বালানো।

সেও তো মেয়েরাই করতো।

কোনো কালেই ঘরে বসে থাকেনি মেয়েরা। কোনো না কোনো কাজ করে সংসারের সূরাহা করেছে। এ কথা লেখা হয়নি কোথাও।

ঘরে ঘরে নিঃশব্দে কুটির শিল্পের কাজে মেয়েরা এগিয়ে ছিল। এগিয়ে আছে আজও। সমাজের চোখে পড়ে না ব'লে, লেখা হয় না ইতিহাস। ঠোঙা বড়ি আচার মেয়েরাই করে এসেছে চিরকাল। এখন, প্লাস্টিক এসে খেয়ে ফেলেছে ঠোঙার কদর। যে প্লাস্টিক ক্ষতি করছে মাটির। প্লাস্টিক তো পচেও না। তা থেকে জন্মায় না কোনো কিছু।

মাঝেমধ্যে রব ওঠে-----প্লাস্টিক বর্জন করো। দোকানদারদের সাবধান করে প্রশাসন থেকে, প্লাস্টিক ব্যবহার করলে জেল জরিমানা ফাইন। দুদিন চুপচাপ।
তারপর আবার, প্লাস্টিক প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের মতো দানব ছেয়ে ফেলেছে বাজার হাট গ্রাম শহর।

এদিকে ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি ক'রে যে সমস্ত পরিবারে আধ বা এক সের চাল আসতো, তাদের অভাব আরো বেড়ে গেল।

বড় বড় শহরের শপিংমলে কাগজের ব্যাগ দেখা যায়। সুদৃশ্য। সে তো কল থেকে তৈরি হয়ে আসছে। মেয়েদের হাতের তৈরি ঠোঙা, আমি বলবো শিল্প। একেবারেই লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে। তাকে উদ্ধার করার মত কে এগিয়ে আসবে? কারা এগিয়ে আসবে?

ঠোঙাও তো আমাদের গরীব বাংলায় কুটির শিল্প। যা যন্ত্রের তলায় পড়ে, রক্তাক্ত। এদিক-ওদিক যে দু'চারটে ঠোঙা বেঁচে আছে, তারা উড়ছেতো উড়ছেই। আমি তাদের গায়ে দেখতে পাই, বাংলার অসংখ্য দিদি ও বোনের আঙুলের দাগ।

--------৬ আষাঢ় ১৪৩০
--------২২---৬---২০২৩
---------নির্মল হালদার



১০.
কাজললতা ও কাজল

কাজলের মতো একটি প্রসাধন সামগ্রী মেয়েরা নিজেরাই তৈরি করতো ঘরে। গল্পকথা নয়, বাস্তব। সেই সময়ের বাস্তব। ঘিয়ের প্রদীপ শিখা থেকে যে কালি হয়, সেই কালি কাজললতার পাতায় ধরে কাজল তৈরি। যে সমস্ত ঘরে ঘিয়ের প্রদীপ ছিল না, সেখানে লম্ফর শিখা থেকে হ্যারিকেনের শিখা থেকে মেয়েরা কালি ধরে রাখতো কাজললতায়।

কাজল তো শুধু মেয়েরা পরতো না, শিশুদের চোখেও পরানো হতো কাজল। তাদের কপালেও কাজলের একটা টিপ। শিশুদের কপালে ওই টিপ থাকলে কারোর কুনজর পড়বে না। এই সংস্কার এখনো আছে। তবে সেই কাজল নেই। তার বদলে আই ভ্রু পেন্সিল। যা বাজারের একটি সামগ্ৰী। কাজললতাও উঠে গেল।

মাছের আকারে ছোট ছোট কাজললতা কামার শালে তৈরি হয়ে হাটে বাজারে বিক্রি ।

একটা শিল্পের সঙ্গে আরেকটা শিল্প জড়িয়ে শিল্পের সুষমা। মেয়েদের প্রসাধনে বেঁচে বর্তে ছিল। আজ কামার শালের হাপর ওঠানামা করে না। কাজললতাও নেই। ছোট ছোট লোহার কাজললতা দরজায় ঝুলতে ঝুলতে মেয়েদের চোখের শিশুদের চোখের কামনা করতো শুশ্রুষা।

কাজললতাও মাঙ্গলিক এক রূপ।

বিয়ের সময় আজও মেয়েদের হাতে থাকে কাজললতা।

ফিঙে পাখি পুরুলিয়াতে কাজললতা পাখি। কারণ, ফিঙে পাখির লেজটি কাজললতার মতো। গায়ের রঙও ঘন কালো।

ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট শিল্প। কুটির শিল্প। কামার কুমোররা ছিল তার কারিগর। তারা আজ কাজ হারিয়ে বেকার। আমাদের সমাজ তাদের দিতে পারেনি বিকল্প কোনো কাজ। 

সময়ের ঝাপটায় পাল্টে যেতে যেতে শোনা যায় বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নিঃশব্দ চিৎকার। 

ঘিয়ের প্রদীপ শিখার তলায় কাজল পাড়ছে এক মা। একটি মেয়ে। এই ছবি ধ্বসে যাওয়ার পরেও একটি লম্ফ শিখার কালি এখনো আকাশের দিকে লতিয়ে লতিয়ে উঠছে। এই আমাদের ভারতবর্ষের প্রকৃত রূপ। সেই রূপের কাছে কাজললতা নেই। 

শিল্পের নামে প্রসাধনের নামে কোম্পানির প্রোডাক্ট গুলি বিকৃত করছে দূষিত করছে শরীর ও ত্বক। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার নামে লুট করছে গরিব দেশের টাকা। চাপা পড়ে গেছে শিশুর কান্নার কাছে মায়ের গান:

আয় চাঁদ মামা আয়রে  
আমার সোনার কপালে টিপ দিয়ে যা----

------৭ আষাঢ় ১৪৩০
------২৩---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার





ঘর গেরস্থের শিল্প - ১




ঘর গেরস্থের শিল্প

১:
উনুন

উনুন ভেঙে গেছে।

উনুন ভেঙে গেছে। মাটি লাগবে। মা একে বলে তাকে বলে, কেউ এনে দেয় না। শহরে মেলেনা মাটি। যা পাওয়া যায়, উনুন হবে না।

সব মাটিতে উনুন হয় না।

শেষ অব্দি মা আমাদের ভাগ চাষী মতি মাহাতর কাছে অনুনয়-বিনয় করে বললো---মাহাত, কাল তোদের গাঁ থেকে এক থলি মাটি এনে দিতেই হবে আমাকে। উনুনটা ভেঙে গেছে।

উনুনের কোনো বিকল্প তো নেই।

দুবেলা রান্নার জন্য উনুন আবশ্যিক।

কয়লার উনুন। পাথুরে কয়লা হলে আঁচ হবেনা। এবং উনুনের মুখে কয়লা দেবার আগে কাঠ ও ঘুঁটে সাজানো। কম বেশি হলে হবে না, যতটুকু দরকার ততটুকু।

উনুনের যত্ন আত্তি চাই।

সাত সকালে ছাইপাশ ফেলে, উনুন পরিষ্কার করে উনুনে গোবর লেপতে হবে। এ একরকম উনুনের স্নান। তারপর তো বেলা নটা দশটা থেকে উনুন জ্বলবে।

খিদে দাউ দাউ করে জ্বলবে।

প্রথমেই, মাটির খোলাতে সেদ্ধ হবে ডাল। ফুটতে ফুটতে ডালের ফেনা উপচে পড়বে উনুনের গায়ে।

হলুদ রঙের অলংকরণ দেখা যাবে উনুনের চারপাশে। তারপর তো ভাত। ভাত ফুটতে ফুটতে ভাতের ফেনাও উপচে পড়বে। গায়ে পড়বে উনুনের।

আগে ছিল ডালের হলুদ। পরে এলো ভাতের ফেনার শাদা। হলুদ ও শাদা মিলেমিশে উনুনের আরেক রূপ।

নানা সবজির তেল হলুদ মসলার সেদ্ধ জল উনুনকে সাজাবেই। কিংবা ডাল ভাত তরকারির প্রথম স্বাদ উনুনকেই দিতে হবে প্রথম।

উনুন তো গেরস্তের দেবতা। তাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে। নইলে যে অকল্যাণ।

কল্যাণ চাই।

সবাই যে উনুনের মতো দেবতা গড়তে পারেনা। দেখা গেছে, হালদার ঘরের খুড়ি দত্ত ঘরের এক বউকে বলছে---ও মেজ বউ আমাদের উনুনে একটু তোমার হাত লাগিয়ে দিয়ে যাবে গো। একটু উপকার করবে গো। দেখবে তোমার ব্যাটা, দুধে ভাতে থাকবে।

কড়াইয়ে দুধ ফুটতে ফুটতেও উপচে পড়ছে। যেন বা উনুনের হাসি হয়ে উঠছে। উনুন যে গেরস্থের কল্যাণ কামনা করে। সব সময়।

বছরে দু একবার অরন্ধনের সময় উনুনের বিশ্রাম। তখন উনুনের পূজা। একবার মাঘ মাসে। আরেকবার শ্রাবণ বা ভাদ্র। তখন উনুনের রূপ ঝকঝকে তকতকে।

আরেক দেবী প্রতিমা।

উনুন এক শিল্প। কুটির শিল্প। গেরস্থ ঘরের শিল্প। যা এক সময় মেয়েদের হাতে গড়ে উঠেছিল।

একেক জায়গায় একেক রকম তার চেহারা। শহরের উনুন কয়লার উনুন। গ্রামের উনুন কাঠের উনুন। সেই উনুনে শুধু কাঠ জ্বলবে। অথবা শুকনো পাতা। গ্রামীণ কাঠামোতে দেখা গেছে উনুনের তিনটে মুখ। বিশেষ করে আদিবাসীদের ঘরে। এখনো দেখা যায়। তাদের জীবনযাত্রা থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি উনুনের ভূমিকা।

কোনো সচ্ছল পরিবারে গ্যাস ওভেন প্রবেশ করলেও উনুনেই রান্নাবান্না হচ্ছে।

গাছ তলাতেও ইঁটের উনুনে ভাত ফোটে। গ্রামের দিকে খেটে খাওয়া দিনমজুরদের ঘরে পাথরের উনুন। তিনদিকে তিনটে পাথর সাজিয়ে উনুনের রূপ।

নানা দিকে নানাভাবে উনুনের চেহারা দেখে মনে হয়, দেব দেবীদের রূপতো বিভিন্ন রকম হবেই। এই তো স্বাভাবিক।

তোলা উনুন হলো, ভাঙ্গা বা অকেজো লোহার বালতিতে তৈরি করা হয়। পাতা উনুন হলো, মেঝেতে তৈরি করা হবে। যা গ্রাম দেশে দেখা যায়। তোলা উনুন মফস্বল শহরের ঘরে ঘরে দেখা যেত এক সময়।

যেকোনো পরিবারে উনুন হলো সবার উপরে। আগে উনুনের পরিচর্যা। এখনো গ্রামীন পরিবারে চাষী পরিবারে দেখা যায় বড় বড় উনুন। ধান সেদ্ধ করার জন্য।

শহুরে জীবন চর্যায় উনুন আজ ব্রাত্য হয়ে পড়লেও গ্রামীন জীবনযাপনে উনুন আছে উনুনের উজ্জ্বলতায়।

উনুন এক শিল্প। যা এদেশে মেয়েদের হাতেই গড়ে উঠেছে। জানলা ভাঙ্গা লোহার শিক তার পাঁজর ।

কত কত আগুন যে ধরে রাখে, কত কত উত্তাপ, শেষ হতে হতেও অক্ষয় হয়ে আছে এই গরিব বাংলায়।

------২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১০---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার




২:
পান : খিলি পান

রাজা--রাজড়াদের পান কোত্থেকে আসতো সেই
গল্পের কাছে যাচ্ছি না। পানের রং-রস মেয়েদের ঠোঁট রাঙিয়ে তুলত‌। তা কতটা মনোরঞ্জন করত পুরুষদের সে গল্পেও যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি, আমার পানের ডাবরের কাছে। চুনের ভাঁড়ের কাছে। দোক্তা --সুপারি--খয়েরের কৌটোর কাছে। যা আমাদের ঘরেও ছিল। মা বৌদির জন্য।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে পান-দোক্তা মায়ের চাই। যদি দেখতো পান নাই, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ডাক: যারে দু পয়সা পান এনে দে---মুখটা টক টক লাগছে। অনেক সময় মায়ের কথা আমি গ্রাহ্য করিনি। কোনো হুঁ হাঁ-ও করছি না। মা আবার ডাকে : যা বাবা যা একটু এনে দে---।

ইচ্ছা অনিচ্ছায় মাকে আমি পান এনে দি।

এই পান আমাদের সংসারের।
দোক্তা ফুরিয়ে গেলেও মা আমাকেই বলতো : বাজারের দোকান থেকে দোক্তা পাতা নিয়ে আসার জন্য। তার সঙ্গে দোক্তার মসলা মৌরী ধনে ও জোয়ান নিয়ে আসতে হবে।

দোক্তা ভাজবে মা।

দোক্তা ভাজাটাও এক বিশেষ কর্ম। বাঙালি জীবনে ঘরোয়া শিল্প। উনুনে শুকনো গরম তাওয়াতে ভেজে নিতে হবে মৌরি ধনে জোয়ান। তারপর হাতের মুঠোয় গুঁড়ো করে দোক্তা পাতার সঙ্গে মেশানো। মেলানো।

দোক্তা পাতার চাষ হয়ে থাকে দামোদরের দু পাশে। বর্ধমানের কাছাকাছি।কারণ,নদীর জলে ধুয়ে শুকানো হয়ে থাকে। এবং দোক্তা গাছ ছোট হলেও পাতাগুলি সেগুন পাতার মত বড় বড়। দেখতে ইস্কাপনের মত। এইসঙ্গে চুনের কথাও বলতে হয়।

পানের ডাবরের কাছে চুন না থাকলে মা আমাকেই ডাকতো : কইরে কোথায় গেলি! একটু চুন এনে দে---। আমি দোকান থেকে দুটো পয়সা নিয়ে কিংবা একমুঠো চাল নিয়ে চুনওয়ালিদের কাছে গেলাম। ওরা পয়সার চেয়ে চাল নিতেই উৎসাহ দেখাতো।

ওরা গ্রাম থেকে আসতো চুন বিক্রি করতে। পাথুরে চুন। জল দিলেই ফুটে যায়। সেই চুন বাজারে বিক্রি। যে যার মতো কিনে নিয়ে যেত।

পানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ সমস্ত জীবন। যে জীবন রাঙিয়ে দিয়ে যায়। পানের রস ঠোঁট রাঙালেও অম্বল নাশও করে।

পানের ব্যবহার পুজো থেকে শুরু করে যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। পানের মর্যাদা প্রতিদিন। প্রতি ক্ষণ। নিঃশব্দে।

ঘরে ঘরে।

চুন সুপারি খয়ের দোক্তা দিয়ে পান সাজানো পানের খিলি করাও রীতিমতো এক শিল্প।

কুটির শিল্প।

আমাদের ছোটবেলায় পারিবারিক বড় কোনো অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়ার পরে ঘরের সাজা পান অতিথিদের হাতে হাতে দেওয়া হতো। এ জন্য ঘরের বয়স্ক মহিলারা দুপুর থেকেই পান সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। একটা দুটো পান নয়তো, দুশোর বেশি অন্তত।

আমাদের সমাজ জীবনে পানের ভূমিকা আজও উঁচু হয়ে আছে। কেন না, পান খাওয়া হয় যেমন তেমনিভাবে পানকে আমরা ব্যবহার করে থাকি শুভ কাজে।

পান আমাদের সঙ্গেই থাকে। পরিবারের অংশ হয়ে। শুভ আকাঙ্খায়।

-----২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১১---৬---২০২৩
-------নির্মল হালদার




৩:
কাঁথা ও আসন এবং অন্যান্য

গ্রীষ্ম দিনের দুপুর বেলা। চারদিক চুপচাপ। এঁঠো কাঁটা মুখে নিয়ে উড়ে গেছে কাক। ঘরের টঙে উঠে গেছে পায়রা।

শিশুরা ঘুমিয়ে গেছে।

কোনো কোনো মহিলা শাড়ির পাড় থেকে টেনে টেনে জড়ো করছে সুতো। সেলাই করবে কাঁথা।

এক রকমের সুতো নয়, নানান শাড়ি। তাদের নানান পাড়। অনেক রকমের রঙ।

যত রঙ তত ভালো লাগবে কাঁথার চেহারা। মহিলারা তাই শাড়ির পাড় থেকে সুতো টেনে টেনে জড়ো করছে। তার ফাঁকেই সংসারের গল্প। শ্বশুর শাশুড়ি থেকে আরম্ভ করে জা-ভাসুর, ননদের গল্প। সোমবার নাপিত বউ এলে পরতেই হবে আলতা----পা-টা খালি খালি দেখাচ্ছে---এ গল্পও
চলছে।

কাঁথার যে প্রয়োজন খুব। মাটিতে মেলতে। শুতে। গায়ে ঢাকা নিতেও হয়। লেপ তোষক কম্বলের ঘর যে নয়, সাধারণ বাঙালি ঘর। নিম্নবিত্ত। কাঁথা ছাড়া চলবে না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোলে শীত চলে যায়। এ কারণেই, খর দিনের এই দীর্ঘ দুপুরে কাঁথা সেলাই। বিকেল অব্দি চলবে।

সেলাইয়ের ছুঁচ ছোট বড় মাঝারি।

যার হাত চটপটে তার কাঁথা সেলাই এগিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। সে হয়তো মাসে দুটো বড় মাপের কাঁথা তৈরি করে ফেললো। শুধু তো সেলাই নয়, কোনো কোনো কাঁথায় ফুল ফল লতাপাতা।

ঘরে এসেছে নবজাতক। তার জন্য কয়েকটা লাগবে কাঁথা। ছোট কাঁথা সেলাই করতে সময় লাগে। কেউ কেউ নবজাতকদের কাঁথায় সেলাই করে--"সুখে থাকো খোকা"। কোনো কাঁথায় লেখা হয়----"দুধে ভাতে থাকো"।

নবজাতকদের জন্য তৈরি হয়ে উঠতো ছোট ছোট অনেক কাঁথা। ওরা যে ঘন ঘন কাঁথা ভেজায়।

সেই আমলে শাড়ি ছিঁড়ে গেলেও একদিকে জমিয়ে রাখা হতো। কাঁথা তৈরিতে কাজে লাগবে। শাড়িটা যদি একদম ফলাফালা হয়ে থাকে তবুও জমানো থাকতো। টিনের বাক্সে। শাড়ির পাড় থেকে পাওয়া যাবে সুতো।

কাঁথা-কানির সংসারে কাঁথাও ছিল ঘরের একজন। যে দেখতে পেয়েছে, ঘরের মেয়ে বউদের কান্না। লুকিয়ে ফেলেছে চোখের জল।

এই মেয়ে বউরা বৈশাখ -জ্যৈষ্ঠ মাসেই আসন বুনতো। চট জোগাড় করে আসনের মাপ মতো কেটে আসন সেলাই। সেই আসনেই সেলাই হয়েছে------"আসুন বসুন"।

একদিন আমাদের ঘরের মেয়েরা নিজেরাই খুঁজে নিয়েছে নিজেদের কারু কাজ। নিজেদের ঘরোয়া শিল্প। তাদের হাত বাড়াতে হয়নি অন্যদিকে। এবং নিজেরাই হয়েছে নিজে গুনে স্বনির্ভর। নিজেদের এই কাজ থেকে অর্থ উপার্জন না হলেও সংসারের উপকার হয়েছে। সেও তো অর্থের চেয়ে কম নয়।

তখনকার দিনে পাত্রী দেখতে এলে, পাত্রপক্ষ দেখতে চাইতেন, পাত্রীর হাতের কাজ। দেখানো হতো, আসন। নানা রঙের সুতোয় বোনা খাবারের ঢাকনা। দেয়ালে টাঙানো দুই হরিণ শিশু। যা শাদা কাপড়ে ছুঁচ--সুতোয় বোনা।

কালি ঝুলি পড়লেও দেখা যায় দেয়ালে ঝুলছে---পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম----।

সেকালের সেই মেয়েদের ঘরোয়া কাজ গুলি ছুঁচ--সুতোর কাজগুলি নতুন আঙ্গিকে আসছে। বিপণন হয়ে। তা কিছুটা যন্ত্র থেকে তৈরি হচ্ছে। আর কাঁথা শিল্পের তো জগৎজোড়া খ্যাতি। বীরভূম জেলার মেয়েদের হাত থেকে তৈরি হয়ে চলে গেছে পাহাড়ে। সমুদ্রে।

এই ছবি থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেই সময়ের বাংলার মেয়েদের কাজ আজ নতুন করে মূল্যায়ন হচ্ছে।

এই মেয়েদের আমরা যেন ভুলে না যাই।

-----২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
----১২---৬---২০২৩
-----নির্মল হালদার




৪:
আলপনা

আলপনা। বৃহস্পতিবার ঘরের চৌকাঠে। এ শুধু লক্ষ্মী দেবীকে আহ্বান করার জন্য নয়, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকেও আলপনার আহ্বান।

আমি মনে করি এই।

আমাদের মেয়েরা জানে, সবাইকে ভালোবাসতে হলে একই রীতিতে ভালবাসতে হয়। তাই, লক্ষ্মী দেবীকে যে রীতিতে আহ্বান করা হচ্ছে কিংবা ভালোবাসা হচ্ছে, মানুষকেও সেই রীতি ধরেই ভালবাসতে হয়।

লক্ষী দেবী হলেও ঘরেরই মেয়ে।

বাঙালি ঘরের মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই আলপনা আঁকে। পুজো থেকে আরম্ভ করে বিয়ের অনুষ্ঠানেও।

আলপনা আঁকা আঁকির জন্য কোনো প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই মা মাসি পিসি জেঠি খুড়িদের আলপনা আঁকা দেখতে দেখতে মনে মনে পাঠ নিয়ে থাকে----- কেমন করে আঙুল ঘোরাতে হয়,প্যাঁচাতে হয়। এবং খড়ি মাটিতে কতটুকু জল মেশালে ফুটে উঠবে আলপনার শাদা।

প্রায় সমস্ত বাঙালি ঘরেই খড়ি মাটি থাকে। বৃহস্পতিবার যাকে লক্ষ্মী বারও বলা হয়ে থাকে, কেননা, এই দিনে লক্ষ্মীর পুজো।

সপ্তাহে একদিন।

প্রতি সপ্তাহে পুজো। 

ঘরে ঘরে আলপনা। যা দৃষ্টিনন্দন।

মনে হয়, বাঙালি মেয়েরা জন্ম থেকেই বহন করে নান্দনিক বোধ। তার প্রথম উদাহরণ, আলপনা।

আমাদের এই বাংলাদেশের এক একটি গ্রামে এক এক রকম আলপনা। রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করতেও চেয়েছিলেন। জেনেছি।

আমি দেখেছি, বৃহস্পতিবারের আলপনা এবং বিবাহ অনুষ্ঠানের আলপনা একই ধাঁচের নয়। মেয়েরা জানে, কোথায় কি আঁকতে হবে।

এই শিক্ষাও পারিবারিক শিক্ষা।

এখানে আমি বলতেই পারি, মেয়েরা কোনোদিন পিছিয়ে ছিলনা সৃষ্টি ও কল্পনা থেকে। 

সন্তানকে মানুষ করার মধ্যেও কল্পনা থাকে। যেমন আলপনা আঁকার জন্য খড়ি মাটি থাকে। মেয়েরা তা জানে বলেই, মেয়েরা আজও সুন্দর।

মেয়েদের সুচারু আঙুল থেকেই নব নব রূপে আলপনা এসেছে ঘরে ঘরে। চৌকাঠে।

এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে----বাইরে থেকে ঘরে ঢুকছি যেই----- "দাঁড়া দাঁড়া" মায়ের সাবধান বাণী --- "দেখিস
পায়ে পায়ে আলপনা যেন মুছে না যায়।"

-----২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১৩---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার



৫:
বড়ি

বিরি কলাই ভেজানো হয়েছে। সারারাত ভিজবে। সকালে হবে শিল -নোড়াতে বাটা। তার আগে শিল-নোড়া দিয়েই ভাঙ্গা হয়েছে বিরি। ঝরে গেছে বিরির কালো খোসা।

বিরি বাটা থেকেই বড়ি।

তেলের টিন বা ঘিয়ের টিন কেটে বড়ি দেবার ও শুকানোর একটি পাত্র তৈরি করা হয়। প্রধানত শীতের দিকেই বড়ি দেবার কাজ। যা থেকেও যাবে প্রায় সারা বছর। কেউ কেউ ঘরের খাওয়ার জন্য বড়ি তৈরি করে। কেউ কেউ বিক্রি করার জন্য।

বড়ি বিক্রি করেও দুটো পয়সা আসে। সংসারের তেল-নুনটা হয়।

সবাই তো বড়ি দিতেও পারেনা। দু আঙুলে বড়ি বাটা নিয়ে টিনের পাতে একটি একটি করে ফেলা, সহজ কাজ নয়। যেন বড়ির নাকটিও উঁচু হয়। মানুষের নাকের মতো খাড়া। বয়স্ক মহিলাদের কেউ কেউ যত সহজে বড়ি দিতে পারে কম বয়সী মেয়েরা পারেনা।

যেকোনো রচনা যেকোনো শিল্প সবার হাতে গড়ে ওঠে না। অথবা বলা যায়, সৃষ্টির দিকে যায় না।

অনেকে কারিগর হয়। শিল্পী হয় না। বড়িও তো শিল্প। মন দিতে হয়েছে। ধ্যান দিতে হয়েছে। তারপর এক একটি বড়ি। রোদে শুকনো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের রূপে।

এই বড়ি-শিল্প বিক্রি করে নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারে হাসি দেখা গেছে। একসময়। আজ অবশ্যই কলে বানানো বড়ি বাজারে দেখা যায়। তার স্বাদ কি ঘরে বানানো বড়ির মতো?

সময়ের ঘূর্ণনে অনেক কিছুই পাল্টে যেতে যেতে দেখা গেল দেখা যাচ্ছে আজও অনেকের জীবিকাও শেষ হয়ে গেল। যেমন, টোটোর মত যান এসে রিক্সাওয়ালাদের পেটের ভাত মেরে ফেলেছে।

আমাদের এই বাংলায় বড়ি ও ঠোঙা ঘরে বানিয়ে মেয়েরা সহযোগিতা করেছে স্বামী ও সংসারকে। মেয়েরাই পেটকোলে কাঁসার থালা প্রতিবেশীর কাছে বন্ধক রেখে নিজের ঘরের সম্মান বজায় রেখেছে। অনেক সময় কোনো বড় বিপদে মেয়েরা নিজেদের গয়না বন্ধক রেখেছে। কখনো কখনো বাধ্য হয়েছে বিক্রি করতে। এই মেয়েরাই সবচেয়ে অবহেলিত, উপেক্ষিত বাঙালি পরিবারে।

 নিজের খাওয়া পরার দিকে না তাকিয়ে ছেলে মেয়ে ও স্বামীর জন্য প্রাণপাত করে গেছে সেকালের মেয়েরা। এখনো করছে। হয়ত ছবিটা পাল্টে গেছে কোথাও কোথাও। কিন্তু নিজেদের উৎসর্গ করতে মেয়েরা ভুলে যায়নি। এখনো তাদের যে ত্যাগ, নীরবে---অনেক সময় বাড়ির গৃহকর্তা জানতেও পারেন না।

একটু আগেই দেখা গেছে চাল নেই। তার একটু পরেই এসে পড়লো চাল। জাদু খেলা তো নয়, কিভাবে কেমন করে এলো, ঘরের কেউ টের পেলো না।

অভাব যেন চোখে মুখে প্রকাশ না পায়, এজন্যেই বড়ি। বড়ি তৈরি। তা ভোরে উঠেই, শিল-নোড়ার কাছে যাওয়া। কোমরে ব্যথা ধরে। ঘাড়ে টান। তবু অভাবকে শিল-নোড়াতে পিষতে পিষতে কোনো কোনো মা দেখতো বড়ির মতো শাদা হাসি ছেলেমেয়েদের মুখে।

সেই বড়ি দেওয়া মেয়েদের কথা যেন ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই বাঙালির সংসারে মেয়েদের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে কত ছোটখাটো শিল্প। শিল্প সামগ্রী।

যা হাতে হাতে বিক্রি হয়েছে।

ঘরে এসে নিয়ে গেছে দু পয়সা চার পয়সার বড়ি। সেই বড়ির সৌন্দর্য নিম্নবিত্ত বাঙালি মেয়েদের সৌন্দর্য।

-----৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----১৪---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার






মুক্তগদ্য



আমি বলতে চাই

কোনো পন্ডিত কোনো তাত্ত্বিক কোনো ছান্দসিক নির্দেশ করতে পারে না---কবিতা এই। কবিতা ওই।

কাঠবিড়ালির লাফ কোনো নির্দেশ পালন করে না। পালন করতেও সে বাধ্য নয়। গাছের কোন্ ডালে সে উঠবে, কোন্ ডালে উঠবে না সে জানে। সে এও জানে, গাছের কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে কাঁচা ফল পাকা ফল। ডাঁসা ফল।

কাঠবিড়ালির এক একটি লাফ এক একটি কবিতা। সে জানে, তার কোনো সংবিধান নেই। সে তাই পায়রার সঙ্গেও মুড়ি খেয়ে যায়।

প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা।

পায়রা ও কাঠবিড়ালি সকালবেলায় বিনিময় করে ভালোবাসা।

ভালোবাসাই তো কবিতা।

চরাচরের প্রতিটি বিষয় তো কবিতা।

আমি এই কবিতার কাছে ঋণী হয়ে আছি। এবং এই বইয়ের লেখার পিছনে সাহস জুগিয়েছে সে হলো রামানুজ মুখোপাধ্যায়। তার কাছেও আমার ঋণ জানিয়ে, পাঠক-বন্ধুকে জানাই আমার নমস্কার।

-----২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৬---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার



দু এক কথা

সংশোধন করা আমার ধাতে নেই। যেকোনো লেখা আমার ভেতরে ভেতরে গড়ে ওঠে। তারপর কাগজে-কলমে। কখনো কখনো দু একটি শব্দ এদিক ওদিক করি। বিন্যাস পাল্টাই। এটুকুই।

এখানে "শুকনো হল কাঁদর " কবিতার বইটি প্রায় সম্পূর্ণ সংশোধন করে পাঠক বন্ধুদের কাছে রাখছি। এখানে আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখছি, লেখাগুলো যখন লিখছি তখন ডাইরির পাতায় নামকরণ করেছিলাম,"গত জন্মের শান্তি নিকেতন "।

এই এখন নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থে পুরোনো নামকরণটি রাখা হলো। এবং এ সমস্ত হলো রামানুজ মুখোপাধ্যায়ের সাহসে।

আমার তো কোনো সাহস নেই।

ভয়ে ভয়ে তাই বলে রাখছি, সংশোধিত কবিতা বইটির যাবতীয় ভালো মন্দের দায়ভার আমারই। দোষ ভুল থাকলে, হে আমার পাঠক-বন্ধু আমাকে মার্জনা করবেন।

ইতি---
২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
৬---৬---২০২৩
নির্মল হালদার



আমার বাবা আমার বন্ধু নয়

বাবার কাছে আব্দার করলাম---আমাকে নিয়ে চলো খালাই চণ্ডীর মেলা। নিয়ে গেল না। বললো, কাজ আছে। বাবার কাছে আব্দার করলাম--আমাকে নিয়ে চলো টুসু মেলা। নিয়ে গেল না। বললো, কাজ আছে।

এ সমস্ত আব্দার করার মত আমি সুযোগ পাইনি। মনে হয়েছে, আমার বাবা কি ছিল কোনোদিন?

মায়েরা শুধু থাকে। বাবারা থাকে না কোথাও। আমার ক্ষেত্রে তো ছিলই না। মাঝে মাঝে আরো মনে হয়, মা বাবা কেউ ছিল না আমার।

বাবারা বন্ধু হয়, শুনেছি। মা-ও বন্ধু হয়ে থাকে, শুনেছি। এই দুই বন্ধু থাকলে আর কোনো বন্ধুর প্রয়োজন পড়ে না। আমার তো একজনও নেই। যে কারণে, বন্ধু বন্ধু করে ছুটে বেড়াই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।

ওই দুই বন্ধুর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে ভালবাসাও খুঁজে বেড়াই শহর থেকে গ্রাম। রাস্তা থেকে রাস্তা।

কেউ কোথাও নেই।

আজ তালগাছ ভালোবাসতে বাসতে সরে দাঁড়াই। ছায়া নেই। আজ শালগাছ ভালবাসতে বাসতে সরে দাঁড়াই। পাখিরা এসেছে। পাখিদের জায়গা নিতে নেই। পাখিরা কষ্ট পেলে আকাশের কষ্ট।

এসব তো আমার বাবা বুঝলো না।

আমার হাত একবারই ধরে ছিল। জোর করে ধরলে আমি বাবার হাতেই বাঁধা হয়ে থাকতাম। আমার রাগ হয়, বাবা আমার বন্ধু ছিল না।

আমার বাবা ছিল শনিবার।

শনিবারই তো বাবা পালিয়ে গেছে। কোথায় যে পালিয়ে গেল! কেন পালিয়ে গেল, আজও স্পষ্ট নয় আমার কাছে।

কার প্রতি অভিমান হয়েছিল?

একা একাই তো চলে গেছে। মাকেও বলে যায়নি কিছু। এখানে মা কেন এলো আবার? বাবারও তো বন্ধু ছিল না। আমার মনে হয়, মায়েরও বন্ধু ছিল না।

কেউ কারোর বন্ধু নয়। "বন্ধু " একটি শব্দ মাত্র। যার পিছনে মিছিমিছি ঘুরতে ঘুরতে বৃথা যায় সময়। সোনার মত সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ নেই। জেনে নিতে হবে, বুঝে নিতে হবে, আমার কোনো বন্ধু ছিল না। আজও নেই।

নিজের কাছে নিজেকে বন্ধু করে নিতে পারলে, সারাদিন কথা বলা যায়। সারাদিন তৈরি করা যায় বাকপ্রতিমা।

আমি সাধারণ পরিবারের একজন। তার মানে, বাবাও ছিল সাধারণ পরিবারের একজন। যে পরিবারের প্রধান বিষয়------অভাব অনটন। সেই পরিবারে বন্ধুত্ব কীসের?

এই পরিবারে সন্তানও বন্ধু হয় কি?

অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দিন মাস বছর চলে যায়। বন্ধুত্ব করার মতো পর্যাপ্ত সময় মনের স্বাচ্ছন্দ্য একেবারেই থাকে না। তাই, বাবা আমার হাতটা ধরেছিল, আলগা।

বাবাকে কেমন করে বলবো-----আমাকে কিনে দেবে না, এক পয়সার বোঁদে?

আমার বাবা আমার বন্ধু হলে, আমাকে নিশ্চয়ই কিনে দিতো কালো কালো জাম।

বাবারা বন্ধু হয় না। যদি বন্ধু হয়ে উঠতো, আমার পাশে দাঁড়াতো বৈকি। শিমুল গাছ না দাঁড়ালেও বাবা নিশ্চয়ই দাঁড়াতো।

আমার বাবা আমার বন্ধু ছিল না।

বাবার বন্ধু ঈশ্বর ছিল কিনা আমার জানা নেই। নাকি বাবাদেরও বন্ধু থাকতে নেই? মায়েদের বন্ধু থাকতে নেই?

" বাবা " শব্দটি অসহায়। একা। " মা "শব্দটির ওজন বেশি হলেও হাহাকারে ভরা।

আমি কার পাশে দাঁড়াবো?

আমি পিছনে দৌড়ে যাই। সামনে দৌড়ে যাই। হোঁচট খেতে খেতে উঠে পড়ি। হেঁটে যাই। আর নিজেকেই বলতে থাকি--------আমার বাবা আমার বন্ধু ছিল না। আমার অভিভাবক ছিল না। তবে বাবা একটা ছিল। আমি তাই, শব্দটি পেয়েছি। মুঠো বেঁধে রেখেওছি। যদি কোনোদিন বন্ধু হয়,যদি বন্ধু হয়ে ওঠে।

-------২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------৯--৬---২০২৩
------নির্মল হালদার





মাটিতে রামধনু ওঠে - ৪৬




৪৬:
মাটিতে রামধনু ওঠে

কুয়োতলার চাতালে মধ্য বয়স্ক কয়েকজন তাস খেলছে। বিকেল বেলা। এখানেই একটা অশ্বত্থ গাছ। পাখিরা আসা-যাওয়া করে। বাসা বাঁধে। অশ্বত্থ ফল মাটিতে পড়ে টুপটাপ। গরু এসে খায়।

কুয়োতলার সামনে হনুমান মন্দির। সময় অসময় নেই ঘন্টা বাজে। মন্দিরের ভেতর থেকে ফুল বেল পাতার গন্ধ আসে। ধূপের গন্ধ আসে।

এ সমস্তর মাঝেও একটি কুয়ো। অল্প জল আছে। ব্যবহারযোগ্য নয়। আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত হয়ে উঠছে।

সচেতন কিংবা অচেতন হয়ে তাসুড়েরা খালি সিগারেটের প্যাকেট খালি দেশলাই বাক্স কুয়োতে ফেলে দেয়। সেই সঙ্গে সারাদিন গাছের পাতা পড়ছে তো পড়ছেই।

কুয়োতে উঁকি দিলেও দেখা যাবে না মুখ। কুয়ো নিজেও কষ্ট পায়। মনে হয়, তার দুঃখ থেকেই আজও একটু-আধটু জল জমে।

প্রতিদিন বিকেলে তাস খেলা জমে। কুয়োটি একা থাকে। অন্তরে। বাহিরে। সারাদিন।

আজও কোনো কোনো গ্রামের মুখে পুরনো দিনের ইঁদারা কুয়ো। বারো মাস জল থাকে। গ্রামের দু' একজন ইঁদারার জল ব্যবহার করলেও অধিকাংশই করে না। তারা বলে, কে কষ্ট করে দড়ি টানাটানি করবে! আমাদের টিউকলেই ভালো ।

কুয়োতলার সার্বজনীনতায় ঝুলকালি পড়তে পড়তে অন্ধকার হয়ে গেল। কুয়োতলা একা এবং একা।

কুয়োতলায় মহিলা মহল চলে না আর। হাসি দুঃখ কান্নার বাতাস চলাচল করে না।

কুয়ো অন্ধকার।

কুয়োর প্রতি উপেক্ষা ও উদাসীনতা কুয়োকে আজ করেছে একা।

কুয়োতলাও সমাজ জীবনের এক জ্যান্ত ছবি ছিল একসময়। যেখানে বালতি ওঠানামার মত আনন্দ বেদনা ওঠানামা করতো।

আজ দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়ায় সকালে সন্ধ্যায়।

-----১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৩১---৫---২০২৩
-----নির্মল হালদার



৪৭:
মাটিতে রামধনু ওঠে

দৃশ্য কল্প--১

নিম দাঁতন শাল দাঁতনের খোঁজ আমাকে দেবে? নিম গাছের তলায় দাঁড়ালে দাঁতন পাবো? শাল গাছের তলায় দাঁড়ালে দাঁতন পাবো?

ঘরে বাইরে কত রকম পেস্ট। কত কত কোম্পানি আমার দাঁতের কাছে আমাকে ইশারা করে। সেই ইশারাতে মজে গিয়ে অনেককাল কেটে গেল। এবার নিম ও শাল দাঁতনে মন দিতে চাই।

অরণ্য প্রকৃতি আমার দিকে চেয়ে হাসে। আমি ছুটতে ছুটতে ঘরে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলি।

দৃশ্য কল্প--২

আমার ঘুমের কাছে এসে দাঁড়ায় একটি জাম গাছ। আমি হাত পাতি। টুপটুপ করে পড়বে চোখের মনির মত কালো কালো জাম।

আমি দাঁড়িয়ে। স্থির।

হঠাৎ শুকনো পাতা ঝরে। এবং তার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। দেখি, আমি ঢাকা পড়েছি শুকনো পাতায়। আমি উঠে দাঁড়াতে পারিনা। ছটফট করি।

দৃশ্য কল্প--৩

আমি ঝাঁপ দিয়ে তোলপাড় করছি জল। আমি সাঁতার কাটছি। বন্ধুদের সঙ্গে জলকেলি করতে করতে এপার ওপার।

গ্রীষ্ম দিনের রোদে তেতে উঠেছে জল। কুছ পরোয়া নেহি----জল ছুঁড়তে ছুঁড়তে দেখতে পেলাম একটা ডাক----উঠে আয় উঠে আয়।

কোথায় আর উঠবো? আমি তো এক ধুলো উড়ানি মাঠে সাঁতার কাটছি। আমার সারা গায়ে ধুলো। আমার মাথায় ধুলো।

দৃশ্য কল্প--৪

কোথায় যে মাঠ কোথায় যে ধুলো! চারদিকে বহুতল বাড়ির ছায়া আমাকে গিলে ফেলছে। আমি কাতরাতে কাতরাতে মা মা করছি। বহুতলের দরজা জানলা হাততালি দেবার মত শব্দ করছে।

আমি বলার চেষ্টা করছি পারছি না, এ যে আমাদের খেলার মাঠ ছিল। এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতেও দেখতে পেয়েছিলাম, একটি মেয়ের কাজল কালো দৃষ্টি।

সেই দৃষ্টির ভেতরে প্রবেশ করতে কখনো পারিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্ষয়ে গেল অনেক অনেক দেয়ালের ইঁট। আমার পা ঝিমঝিম করছে।

দৃশ্য কল্প---৫

দর্জি দোকানের ছিট কাপড় কুড়িয়ে কুড়িয়ে আমার পুতুল। সেই পুতুলের সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল। সে আমার কাছে জানতে চাইছিল----আজকে আমার খেলার সঙ্গী কারা? আমি থতমত খেয়ে পালিয়ে গেলাম।

সেই পুতুল পিছন থেকে চিৎকার ক'রে আমার দিকে প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে দিলো-----তোমার সঙ্গে মানুষ আছে তো ? মানুষ?

তীরে বেঁধা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়।

দৃশ্য কল্প---৬

একটা কাঁচের মার্বেল গড়াতে গড়াতে আমার পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার মুখোমুখি। আমি জানতে চাইলাম--আমার কাছে কী চাইছো? সে বললো----কি আর চাইবো, চাইছি তোমার খেলার জমিয়ে রাখা মার্বেলগুলি। ছোটদের দেবো। তারা যদি খেলতে পারে।

আমি হেসে উঠলাম।

আমার হাসি শুনে শিশুরা আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমার কাছে জানতে চায়---মার্বেল কেমন ছিল বলতে পারবে? মার্বেলের রঙ কত রকমের ছিল বলতে পারবে?

আমি আবার পালাতে থাকি। পালাতে পালাতে ধাক্কা খাই রাস্তার মাইল পোস্টে। কিন্তু লেখা নেই আমার বাড়ি কত কিলোমিটার।

দৃশ্য কল্প---৭

হাঁসুয়ার সঙ্গে রচনা করতে চাই একটি ধান জমি। হাঁসুয়া জানতে চাইলো---খাতা আছে? ডাইরি? আমি বললাম----আমার হাতের তেলোতেই আমি লিখব আমার রচনা। তুমি বুকে তুলে নিও। দেখবে, সারি সারি ধান গাছ মাথা দোলাচ্ছে শরতের হাওয়ায়।

------১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
------১---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার




৪৮:
মাটিতে রামধনু ওঠে

উৎসর্গ : প্রতাপ দত্ত

চিরুডি একটি গ্রাম।

চিরুডি হয়েই যেতে হবে ঝিলিমিলি। ঝাড়গ্রাম। বান্দোয়ান ছাড়িয়ে চিরুডির দিকে যাওয়া।

কোনো পাহাড় থেকে নামতে হয় না চিরুডিতে। চিরুডি একটি গ্রাম। বাসে যাওয়া যায়। যেকোনো বাহনে যাওয়া যায়। এবং যেতে হবেই। চিরুডিতেই আছে ফুল ফলের মত আত্মীয়তা।

কত যে ফুল ফল। আত্মীয়তার সাত রঙ। আমি ছুঁতে পারি না। আমার ক্ষমতাও নেই। যেমন করে ছুঁতে পারলাম না বিল্টুকে। অথবা, সে আমাকে নতুন সেতু গড়ার অধিকার দিলোনা।

দোষ কারো নয় গো মা-----।

সম্পর্ক স্থাপনে কেউ আগ্রহী না হলে, সেতু রচনা করেও যাতায়াত করা যাবে না।

চিরুডি যেতে হলে কোনো সেতু নেই। একটাই রাস্তা। সহজ সরল। মসৃণ। কোনো নদীও নেই। লাফ দিয়ে যেতে হবে না। অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড় আছে, আত্মীয়-স্বজনের মতই। দেখতে দেখতে, হঠাৎ করে দাঁড়িয়েও হাত বাড়িয়ে কাছে চলে যাওয়া যায়।

চিরুডিতে কার কাছে যাবো?

প্রতাপ নেই। চিরুডি নিজেই একা হয়ে গেছে। তার একাকীত্ব দীর্ঘ করতে আমি কি আর যাবো?

অনেক গ্রাম একা থাকে। যেমন রামানুজ ছাড়া তাদের গ্রাম খুব একা। ভীষণ একা। অবনী নেই লাল্টু নেই তুলিল একা হয়ে গেছে।

গ্রামের হৃদপিণ্ড প্রেম ও ভালবাসা। তা যদি দূরে চলে যায় কিংবা দূরত্ব রচনা করে গ্রাম একা হয়ে যাবেই।

যুবক ও যুবতীদের তারুণ্য গ্রামের শোভা। চেয়ে থাকে চন্দ্র সূর্য।

অনেক সময় ঘরও একা হয়ে পড়ে। পালক ছাড়া আমার ঘর নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকে।

বাপি ছাড়া বাথান বেমানান।

অবিনকে না পেলে কাঁসাই তো গোপনে গোপনে অশ্রু ঝরায়।

এ সমস্ত এই এক জীবনের সঞ্চয়

দিন রাত্রির আলো বাতাস জানে। পেঁচাও জানে। চেয়ে থাকে।

আমিও চেয়ে থাকি চিরুডির দিকে।

আমি কি যাব না তার কাছে?

-----১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----২--৬--২০২৩
----নির্মল হালদার



৪৯:
মাটিতে রামধনু ওঠে

ভাল্ লাগছে না --- ধুর্ ভাল্ লাগছে না ---এই ছিল আমার ছোটবেলার রোগ। কারণে অকারণে সব সময় বলে উঠতাম। আমার বন্ধু ছোটন রেগে উঠতো। সেই ছোটনের একথা মনে পড়বে কি? আমাকে ছাড়াই ছোটন তো দিব্যি আছে। আমার থেকে অনেক অনেক দূরে। সে ছুঁতেই পারবে না আমার বিষণ্ণতা।

সে কি জানে একাকীত্ব কাকে বলে?

তুলিনকে মনে আছে তার? মনে পড়ে সুবর্ণরেখা? ওর গল্পের খাতা আমার কাছে দীর্ঘদিন ছিল। ওর একটা উপন্যাস আমার কাছে ছিল।

ওর কাছে কি আছে স্বপন কুমারের ডিটেকটিভ বইগুলো, যা ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম? বইয়ের দাম ছিল আট আনা।

ছোটনের মনে আছে?

মনে পড়বে কি, আমার ভাইজি বুলিকে সে পড়াতো? শেখরকে মনে আছে? লাল্টু অবনীকে মনে আছে?

আমলাপাড়া স্কুলেই তো আমাদের প্রথম পাঠ। ছোটনরে, তোর মনে পড়ে? নাকি মনে পড়লে পিছিয়ে যেতে হয়? আর পিছিয়ে পড়লে খালডোব। অন্ধকার।

কে আর চায় হোঁচট খেতে!

ছোটন বরাবর তুখোড় ছাত্র। সে যখন আই আই টিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, পড়াশোনা করছে খুব, তখন তাকে ডাকতে গেলে রেগে যেতো। আমি মুখ চুন করে ফিরে এসেছি।

ছোটবেলা থেকেই আমার দোষ আমি কারোর প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে গেলে, তাকে এক দন্ড ছেড়ে থাকতে পারিনা। এখনো এই শেষ বয়সেও আমি যদি একটি গাছের প্রতি আচ্ছন্ন হই, একদম ছেড়ে থাকতে পারবো না।

আচ্ছন্নতা আমাকে জিইয়ে রাখে। আমাকে সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়।

সেই ছোটবেলায় ছোটনও ছিল আমার আচ্ছন্ন এক বিষয়। তার সঙ্গে অনেক বিষয়ে মিল। অনেক বিষয়ে অমিল। তারপরও বন্ধুত্ব ছিল অটুট।

আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও দু'চারটে চিঠি লিখেছে আমাকে। তারপর হঠাৎ যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

আমি বিচ্ছিন্ন হইনি। এখনো ছোটন। ছোটবেলার অমলিন সম্পর্ককে জিইয়ে রাখতে চাই। আজও।

একবার কি দেখা হবে না? অন্তত একবার? ছোটনকে জড়িয়ে একবার যদি কেঁদে উঠতে পারি? একবার অন্তত?

কী চমৎকার চিঠি লিখতো আমাকে। নিয়মিত। আর ছোটনের চিঠি মানেই, দিদিকে পড়ে শোনাতে হবে। কখনো দিদি নিজেই পড়তো।

আমার তুলিনের দিদি সেজদি ছোটনকে খুবই ভালোবাসতো। ছোটনও সুযোগ পেলেই পুরুলিয়া থেকে তুলিন। আমার কাছে। সেজদির বাড়ি।

তখন দিদি বাড়িতে ইলেকট্রিক ছিল না। হ্যারিকেনের আলো। সারা বছর। গরমের দিনে তালপাতার পাখা। ছোটনের কোনো অসুবিধে হয়নি। 

ছোটনদের পারিবারিক মান ছিল উঁচুতে। আমাদের ছিল না। কিন্তু আমাদের মেলামেশায়, সম্পর্কে সহজ বাতাসের আসা যাওয়া ছিল।

সেই সহজ বাতাস কি আমার কাছে আরেকবার আসবে? আমি জানি আমার চেয়ে অনেক লম্বা ছোটন। আমি তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা না করে, দেখতে তো পারি। যেমন মাটিতে দাঁড়িয়ে মাটির আরেক সন্তান তাল গাছের দিকে চেয়ে থাকতে পারে।

ছোটন রে, আমার ক্ষমতা নেই তোর কাছে ছুটে যাওয়ার। তুই তো আসতে পারিস। আমরা দুজন আমলা পাড়া প্রাইমারিতে আরেকবার ভর্তি হয়ে ছুটোছুটি করবো। করবো না? শুধু আমরা না, বাকি বন্ধুদেরও ভর্তি করে হৈ হৈ করতে পারি।

তুই তো আমাকে দিবি তোর গল্পের খাতাটা। আজকের খাতাটা। যেখানে সমুদ্র আছে। আমি শুধু নেই।

------১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৩---৬---২০২৩
-----নির্মল হালদার


৫০.
মাটিতে রামধনু ওঠে

( উৎসর্গ: রামানুজ মুখোপাধ্যায় )

বাক্সটা খুলতেই একটা ব্লাউজ। গরম কাপড়ের ব্লাউজ। হ্যাঁ, আমি রেখেছিলাম। মনে পড়ছে। মনে পড়ছে না শুধু, মা কি একদিনের জন্যেও ব্লাউজটা পরেছিল?

আমি কোনোদিনই মাকে ব্লাউজ পরতে দেখিনি। সারা বছর একই পোশাক। একটি নরুণ পাড় শাড়ি। পায়ে কোনোদিন জুতো ছিল না।

চৌকাঠের বাইরে পৃথিবীকে চেনেনি। নাকি চিনতে চায়নি? কেবল সংসারের সুখ-দুঃখে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে মুড়ি ভেজেছে। উনুনে চড়িয়েছে হাঁড়ি।

সবার মুখে অন্ন জোগাতে হবে।

তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়ে মেয়েদের বলতে হবে : শাঁখটা বাজা রে। বাজা।

ব্লাউজটা ছাড়াও আরো কত স্মৃতি পেয়ে গেলাম। ধনরত্ন পেয়ে গেলাম। এবং সমস্ত স্মৃতি একদম একা। নির্জন নিঃসঙ্গ।

নির্জনতা বলতে যদি  ধূ ধূ প্রান্তরকে দেখানো হয় শুধু, তাহলে ভুল হবে। আমার কাছে নির্জনতা একটি গাছের ডালে একটি কাক। আমার কাছে নির্জনতা একটি মাঠে একটি শুকনো পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে।

ন্যাপথলিনের গন্ধেও নির্জনতা থাকে। একাকীত্ব থাকে। এই একাকীত্ব থেকেই আমি পেয়েছি মন খারাপের গন্ধ।

ন্যাপথলিনের গন্ধ।

আমি মায়ের গা থেকে রান্নাঘরের গন্ধ পেয়েছি। বিশেষ করে হলুদের গন্ধ। এবং এই গন্ধটা আজও আমার কাছে ঘুরে বেড়ায়। আজ অবশ্য গন্ধটার মধ্যে চোখের জলের গন্ধ পাই।

আমি ছাড়া আর তো কেউ পাবে না। আমার দাদা দিদিরা কেউ নেই আজ আর।

গন্ধটা পাঠাতে চাইলেও পাঠানো যাবে না কারো কাছেই। গন্ধটা শুধু আমাকেই আক্রমণ করে।

আমি মায়ের শেষ বয়সের সন্তান।

আমার মাকে দেখে বন্ধুরা বলতো, আমার ঠাকুমা। তখন তাদের বলতে পারিনি, মা কখনো কোনোদিন বৃদ্ধ হয় না।

-----২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৫---৬---২০২৩
------নির্মল হালদার



৫১.
মাটিতে রামধনু ওঠে

বগলাকে কেউ চেনে না। বগলা হালদারকে কেউ চেনে না। আমি চিনি। সে আমার ছোটবেলার বৃন্দা দূতি।

আমি রাধা নই। তবুও বৃন্দা দূতি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গে সঙ্গে আছে। তখন যে আমার কাছে ছিল কৃষ্ণ যাত্রার পালাগুলি। তার মধ্যে মানভঞ্জন আমার খুব প্রিয়। সেই পালাতেই বগলা, বগলা হালদার বৃন্দার ভূমিকায়। কৃষ্ণের সঙ্গে রসিকতা। গানে গানে কৃষ্ণের উত্তর।

সেই বগলা হালদার কোথায় যে গেল! কোথায় আছে কোনো খবর পাই না। আজকাল খবর বলতে, রাজনীতি খুন ধর্ষণ। এবং ঘটনা দুর্ঘটনা হয়ে প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে সব সময়।

আমার ভয় করে।

এসময় আমি খুঁজে বেড়াই, রাধা কৃষ্ণ ও বৃন্দাকে।

রাত্রির রঙ অভিনয়ের বেশভূষা ছেড়ে দেওয়ার পরেও বগলার কাছে কত সকাল এসেছে। আমিও গেছি তার সামনে। মনে হয়নি কখনো, গতকাল রাতে হ্যাজাকের আলোতে আমার ভারতবর্ষের এক রূপ, এই যে বগলা অভিনয় করছিল। এই বগলা আমার চেয়ে বড় হয়েও বন্ধু হয়ে গেছলো আমার।

বগলা কোথায়?

মোহন ? মোহন দে-কেও চেনে না আজকের লোকজন। সেই তো ছিল কৃষ্ণ। তার বাঁশি কে লুকালো? নাকি তার বাঁশি একলা অন্ধকারে নীরব হয়ে আছে?

সেই কৃষ্ণকেও আমার চাই।

এই ভর দুপুরেও আমাকে শোনাবে মান ভাঙ্গানো গান। সেই গান আমার অন্তরে জাগিয়ে রাখতেই হবে। আমার সামনে পিছনে যে অনেক অভিমান। আমিও শোনাবো মান ভাঙ্গানো গানের
করুণ সুর।

একটা পান দোকান ছিল। সেইখানে কৃষ্ণ বৃন্দা ও রাধার সকাল বেলার কুঞ্জবন। ওদের দেখতে পাবো, এই লোভে চলেও গেছি নিকটে।

তমাল তরুর ছায়া না থাকলেও হাসি মস্করার শব্দ ছিল। এ ওকে বলছে---কাল তুই যা পাট করেছিস, মেডেল তো পাবারই কথা। তখন রাধা কৃষ্ণকে বলছে-----কাল তুই বাঁশিটা উল্টো ধরেছিলি।

রাধা কোথায়?

অবনী?

অবনী হালদারই রাধা প্রায় দিন রাত্রিবেলায়। তখন তো অধিকাংশ গ্রামেই পালা পার্বণে গ্রামের মানুষ যাত্রাপালার আয়োজন করতো। আর এই তুলিনে রাধু বিটের পরিচালনায় কৃষ্ণ যাত্রা। রাধু বিটের লেখা পালা গুলিতে রাধু বিট সংগীত পরিচালকও।

বাঙালি মানসে একটা বড় জায়গা ছিল যাত্রাপালার। এক সময়। তখন জাঁকজমক ছিল না। কেবল সামিয়ানার নিচে অভিনয়। যে অভিনয় দেখার টানে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে অসংখ্য মানুষ।

সেই রাধা অবনী হালদারকেও আমি খুঁজে বেড়াই রাস্তা থেকে রাস্তায়। জঙ্গলে। ভিড়ে। দোকানেও। যদি দোকানে এসেছে নুন কিনতে।

আমার রাধা কৃষ্ণেরও নুন লাগে।

মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি যে কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।

তোকেও যে খুঁজে পাচ্ছি না।

যাত্রাপালা শেষ হতে হতে অনেক রাত। অন্ধকারে ঘরে ফিরতে একটা হ্যারিকেন। সেই হ্যারিকেন কার হাতে যেন দুলতে দুলতে হারিয়ে গেল?

আমি যে মনে করেছিলাম, হ্যারিকেনের কাঁচের কালি আমার চোখের জলে ধুয়ে ফেলবো।

-----দুপুর--১--৩৩
----২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
-----৭--৬--২০২৩
----নির্মল হালদার





কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ