লালবাঁধ//
সাতসকালে কাপড় কাচছে ধোবিরা। সাবান জলের ঘূর্ণি ওঠে।
বাঁধের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করে নিরাময়।
সেও এই সকাল বেলা বাঁধের দিকে। তার ঝোলাতে রং তুলি কাগজ।
ড্রয়িং করবে।
আউটডোর স্টাডি।
বাঁধ ছাড়িয়ে গেলে সাঁওতাল পল্লী।
নিরাময় সেদিকেও যাবে।
বেলা হলে।
আপাতত ধোবিদের ছবি।
তারা যখন জামা কাপড় পাথরে আছাড় দেয় তখন হাত পায়ের পেশি কেমন হয়, নিরাময় আঁকবে।
ধোবিদের কাজটা পরিশ্রমের কাজ। অনেক ঘাম ফেলতে হয়
বাঁধের জলে।
সাবান জলের ঘূর্ণিতে যখন
সূর্যের কিরণ এসে পড়ে, তখন
সাত রংয়ের ঘূর্ণি।
নিরাময়ের সন্দেহ হয়, সেকি পারবে ঐ রঙের খেলা ধরতে?
নিরাময়ের মত ছাত্রদের কিঙ্কর দা
একটা কথা বলেন----ছবি আঁকবো বললেই কি আঁকা যায়?
ছবি আঁকতে হলে জীবনকে দেখতে হয়। শিল্প আলাদা কোনো বিষয় নয়, শিল্প জীবনের আরেক দিক।
কিঙ্কর দা কোনো কোনো দিন
মাথায় টোকা সাইকেল নিয়ে
বাঁধের পাড়ে চলে আসেন।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, কে কি
আঁকছে।
নিরাময়ের মনে পড়ে, একদিন
তার ড্রইং খাতায় একটা ছায়া পড়েছে। সে পিছন ফিরে দেখে,
কিঙকর দা ঝুঁকে পড়ে দেখছেন
তার আউটডোর স্টাডি।
সেদিন তার রেখাতে কয়েকটা ভুলত্রুটি ছিল, কিঙকর দা নিজে পেন্সিল ধরে তা ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে যান। যাওয়ার সময়
বলে গেলেন-----জল খেতে ভুলিস না। আর ভুলিস না, বাঁধের ওপারে কয়েকটা গরু চরে বেড়াচ্ছে। তাদের ছবিও আমাকে দেখাস।
নিরাময় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। এই শান্তিনিকেতনে এসে
কিঙ্করদার মত মাস্টারমশাই পাওয়া এবং তাঁর কাছ থেকে শেখা ভাগ্যের ব্যাপার।
আজ ইন্দুমতী এসেছে এদিকে।
এসেই তার মাথার চুল টেনে দিয়ে চলে গেছে গ্রামের ভেতর দিকে।
সে নাকি গ্রামের জীবন যাপন
রাস্তাঘাট মানুষজনকে স্টাডি করছে।
যাওয়ার সময় নিরাময় কে দিয়ে গেছে এক ঠোঙা মুড়ি।
ইন্দুমতী কলাভবনের ছাত্রী হলেও
সঙ্গীত ভবনে যাতায়াত করে। তার গানের গলা খুব সুরেলা।
বসন্ত উৎসবে এবারও ইন্দুমতীর গান।
ইন্দুমতীর গান শুনতে শুনতে
নিরাময়ের মনে হয়েছে অনেকবার, সুরকে কোনদিনই
রঙে রেখায় আঁকা যাবে না।
সে মনে করে, যেকোনো বিমুর্ত বিষয়কেই আঁকা যায় না ।
শিশির ঝরার শব্দ, নদীর কল্লোল
নিরাময় আঁকার চেষ্টা করেছে খুব। শেষ পর্যন্ত পছন্দ হয়নি তার।
এক ধোবি বউ কাপড় জামার
একটা গাঁটরি নামায় বাঁধের পাড়ে। সঙ্গে একটি শিশু। তার পরনে শুধু একটি প্যান্ট। খালি গা। সে মায়ের আঁচল ধরে ধরে
মিনমিন করে কাঁদে ।
নিরাময়ের ঝোলাতে অন্যদিন
লজেন্স থাকে। আজ নেই। ক্ষণিকের জন্য তার মন খারাপ হয়ে গেল। সে শিশুটিকে কাছে টেনে চোখের জল মুছিয়ে বললো,
তোর জন্য কালকে অনেকগুলো লজেন্স নিয়ে আসবো।
ফাগুন দিনের সূর্য মধ্য গগনের দিকে। রোদ লাগছে গায়ে। সে
ঝোলা কাঁধে তুলে হাঁটতে থাকে।
তার মাথায় ঘুরছে সাবান জলের ঘূর্ণি।
-------৯ চৈত্র ১৪২৮
------২৪----৩---২০২২
-----নির্মল হালদার

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন