মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২২

শরাবন কালিন্দী-----মাদলিয়া / নির্মল হালদার




শরাবনের গাঁ সেনাবনার কাছেই
সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়।
সে ঢোল - ধামসা বাজায়। মাদল বাজায়।
তার হাতের ওঠা - নামা দেখলে মনে হয়, সে আকাশের গায়ে চাঁটি মারলেও বিনা মেঘে বৃষ্টি ঝরবে মাটিতে।
সে বাজনা চায়, বাজনার ছন্দ চায়।
তো এই শরাবনের সারাক্ষণের সঙ্গী চারুবালা। যে ধুমড়ি নাচের শিল্পী। ধুমড়ি নাচ নাচনি নাচের
আরেকদিক। এই নাচের শিল্পী চারুবালার রসিক হলো শরাবন।

সেও ছোটখাটো পাহাড়।
মানুষ পাহাড়।
সব সময় চোখে মুখে এক সরল ঝরনা। তবু সে পিপাসায় থাকে । ক্ষুধায় থাকে।
তার পেটের খিদে মনের খিদের খবর কেউ রাখেনা।

শরাবনের অভাব থাকলেও মনের অভাব নেই।
সে সবসময় রসে - বশে।
প্রযুক্তির কারণে বিনোদনের রূপ-রঙ পাল্টে পাল্টে গেছে। তাই আর নাচনি নাচ ধুমড়ি নাচের কদর নেই।
একটা সময় ছিল পুরুলিয়ার নানান মেলায় গ্রামে গ্রামে নাচনি নাচের আসর। জমজমাট হয়ে উঠতো।
দিনকাল পাল্টে গেছে শরাবনের ডাক আসে না। চারুবালার ডাক আসেনা।
শরাবনের পাথুরে চেহারা লোল
হয়ে পড়ছে। তার অসহায়তার কাছে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে অযোধ্যা পাহাড়। জঙ্গল। ছোটোখাটো ঝোরা।সে কখনো কখনো একা একা গোধূলির আলোয় ঢোল নিয়ে চলে যায়
ডুংরি কোলে।

জেগে উঠে চরাচর ।

শরাবনকে দারিদ্র ছুঁতে পারেনা।
সে শিল্পরসের বাসিন্দা।
ঢোল - ধামসা - মাদলের চামড়া ছিঁড়ে গেলে সে জানে নিজের পিঠের চামড়া ঢোল--ধামসার
মুখে লাগিয়ে দুহাতে বাজাবে।

জল - স্থল - অন্তরীক্ষে বাজতে বাজতে
ব্রহ্মাণ্ড বাজবে।

------৫ বৈশাখ ১৪২৯
-----১৯----৪----২০২২
------নির্মল হালদার





চারুবালাকথা 

দুর্গা দত্ত


বিয়া হয় নাই তো কী হয়েছে
উ-ই আমার স্বামী, উ-ই আমার কিষ্টধন , 
উ-ই আমার প্রেমের রসিক ।

এমন মাদল তুলতো ঝাঁকড়া চুলে আকাশ কাঁপিয়ে...
বুকের ভিতরে যেন হুপ্যাল মা'রত শোল মাছ
পায়ের পাতায় ঢেউ, লাচ --
ঘর ছ্যাড়ে এককাপড়ে পালিয়েছি 
সেই আসর থেকেই, ঝুঁঝক্যা রাতেই , 
উয়ার হাত ধ'রে ।
সেই থেকে উ-ই আমার রসিক আর 
আমি হঁছি উয়ার লাচনি ।
শরাবণ কালিন্দির জুড়ি আমি ,  
লাচনি চারুবালা --
উয়ার মাদল-বোলে সেই থেকে হাটে মাঠে বাঁশবনে
ধুমড়ি লাচে আসর কাঁপাই

 বিয়া করা বৌ লই তো কী হয়েছে !
 উ-ই আমার স্বামী। 
 রান্না বান্না ছুঁয়াছুঁয়ি বাদ দিয়ে
 সংসারের সব কাজ করি।
 ছাগল চরাই, কাঠকুচা ডালপালা 
 ঝেঁটিয়ে কুড়িয়ে আনি, শুকনো গোবর।
 ঘুঁট্যা দিই, ঘরে বাইরে গোবরের লাতা দিই, 
 মাথায় করেই বঝা বঝা ধান আনি ক্ষেত থেকে, 
 পালুই সাজিয়ে দিয়ে রসিকের খামার ভরাই...

 
বিয়া করা বৌ লই তো কী হয়েছে !
রসিকের ঘরদুয়ার তো আমারই সংসার ! ন কি !
পেটে ধরি নাই তো কী হয়েছে
রসিকের বিয়া-করা বৌয়ের ছেল্যাপুল্যা 
সবকটা ত আমারই,  ন কি !
কোলেকাঁখে বড়ো করেছি , 
নুনুকে তো কোলে নিয়েই 
ডাঙ্ ডহরে টাঁড়ে টাঁড়ে চরিয়েছি 
গরু বাছুর ছাগল ভেড়াকে।
বুকে আমার দুধ ছিল না বঠে। তাই
দুধ খাওয়াতে নাই পারি । ত !  কি হয়েছে !
নুনুকে ত বুকে লিয়ে কান্না ভুলিয়েছি ।

পেটে ধরলেই শুধু মা হয় ?
পেটে ধরি নাই ব'ল্যে কি  
উয়ার কি মা লই, বল ?
উ-ই আমার ব্যাটা ।
উ-ই আমার বুকের ধন । নুনু।

একটুকুন না দে'খল্যেই 
বুকের ভিতর কেমন হুদক্যে উঠে --
'বায়না'-র কথা শুনলেই বুক কেমন 
উথাল পাথাল ...
মনকেমন শুরু হয়ে যায় --
দস্তুর ধুমড়ি আমি ,তবু ঝিকিরমিকির লাচের আসরে
তোর মুখ ছলক্যে উঠে বাপধন যখন তখন --
তাল ভুল হয়ে যায় বাপ , থেমে যায় ঘুঙুরের বোল --
খেপে যায় শরাবণ রসিক

পেটে ধরি নাই ত কী হয়েছে !
গোয়ালঘরের এক কোণে 
খড়বিচালি ছেঁড়া চট ছেঁড়া কাঁথা আমার সংসারে
তুই-ই ত একমাত্র ধন বাপ ! 
কত কী যে ভাবি !
মরে গেলে আমাকে তো কেউ ই ছুঁবেক নাই । 
কেবল রসিক 
যে আমাকে আদরে আহ্লাদে লাচনি করেছে
মরে গেলে গরু বাঁধবার পাগা পায়ে বেঁধে 
টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবে 
টাঁড়ের ভাগাড়ে ---

আমাদের, লাচনিদের  কেউ কখনো 
মুখে আগুন দেয়নি বাপধন
একমাত্র গীতারাণী ,
নিবারণ মাহাতোর লাচনি ছিল , মাঝিহিড়া-য় ঘর
ছেল্যা নাই , পুল্যা নাই ,তবু মুখে আগুন জুটেছে।
কিত্তিবাস ‌কম্মকার, নামী ঝুইম'রা, গান বাঁধত।
গীতা মাহাতোর গলায় কিত্তিবাস ছিল যেন 
অন্য কোনো কবি কিত্তিবাস
যেন জলজ্যান্ত ভবপিতা-র রঙ্ --

আমার ত কিত্তিবাস নাই 
দীনা তাঁতি, চামু কামার, বরজুরাম 
আমার ত কেউ নাই বাপ
সবাই ত চলে গেছে কতদিন আগে --
আমার ত কেউ-ই নাই --
আমার কেবল তুই ; সুর ,তাল ,বুকের ধুকপুক
তুই ছাড়া কেউ আমাকে ছুঁয়েও দেখবে না ...

টাঁড়ের ভাগাড়ে শিয়াল শুকনিতে কুত্তায় 
ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ করবার আগে
তুই বাপ মুখে একটু আগুনের নুড়া গুঁজে দিস্।
তোর হাতের আগুন পেলেই
আমার শুকনো চোখে ঢেউ উঠবে
ধন্যি হয়ে যাবে এই লাচনি জীবন।
সব পাপ ধুয়ে যাবে কাঁসাইয়ের জলে
সগ্গবাস হবে , আমার সগ্গবাস হবে বাপধন 

আমি মরল্যে মুখে একটু আগুনের নুড়া দিবি বাপ্ ...





শরাবনের সঙ্গীনি কিংবা নাচনি
চারুবালাও তার লড়াইয়ের জীবনে একটা অংশ। দুজনের শিল্প সত্ত্বা এক হয়ে যৌথ এক রূপ।
সেই চারুবালাকে নিয়ে কবি দুর্গা দত্তর একটি কবিতা এখানে প্রাসঙ্গিক বলেই রাখছি।

পাঠকের কাছে আমার নম্র নমস্কার।




প্রথম ছবি : সন্দীপ কুমার 
বাকি ছবি : অজয় মাহাত







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ