শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

আমবাগান / নির্মল হালদার

আমবাগান / নির্মল হালদার



আমবাগানে মালি আছে। তার ইয়া গোঁফ, দেখলেই সবাই ভয় পেয়ে পালায়। এই কারণে আম চুরি হয় না।

আমের যা রঙ যা সুবাস দেখলেই লোভ হয়। আমের যা গড়ন দেখলেই কাছে যেতে ইচ্ছে করে।

মালির ভয়ে বাগানের ধারে কাছে কেউ যেতে পারে না। একবার এক বালক ধরা পড়তে বেঁধে রেখেছিল মালি। বালকের বাবা এসে ক্ষমা চাওয়ার পর বালককে ছাড়া হয়েছিল। সেই থেকে বালকের দলের মালির উপরে খুব রাগ।

আম বাগানের পাশেই বড় একটা মাঠ। ফুটবল হয়। ক্রিকেট হয়। অন্যান্য খেলাধুলাও হয়ে থাকে।
বালকরা এই মাঠেই খেলতে আসে।

খেলতে খেলতে বল গিয়ে পড়ে আমবাগানে।বালকদের ক্যাপ্টেন ঠিক করে দেয়, কে যাবে বল কুড়াতে। দুইদলের ২২টা ছেলে ২২বার বল কুড়াতে যাবে। কারণ একটাই, ২২টা ছেলেই আম পকেটে করে নিয়ে আসবে। মালি টের পাবে না।

বালকরা ইচ্ছে করেই খেলতে খেলতে বল পাঠায় আমবাগানে। আর বল খুঁজতে গেলে মালি কিছু বলতে পারেনা। এদিকে ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে একটা দুটো আম বালক পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।

গাছে কম পড়ে না আম। মালি বোঝে না বলেই, সে স্বার্থপর । সে ছোটদের ভালবাসে না। সে একদিন  ধরে ফেলেছে এক বালককে। বালক মালির হাত কামড়ে, দে ছুট। একেবারে মাঠের দিকে।

মালি বলে, তোদের চালাকি বুঝতে পেরেছি। দাঁড়া, কি করছি আমি দেখতে পাবি। বালকের দল হাসে।

এবার বাগানে বল পড়লেই, মালি ফুটো করে দেয় বল। বল খুঁজতে এসে বালক হতাশ হয়ে পড়ে। তখন আর আম চুরির ইচ্ছে মনে জাগে না। দলের ক্যাপ্টেন বুদ্ধি করলো, বাগানে বল পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে একজন নয় দুজনকে ছুটে যেতে হবে। মালি যেন সুযোগ না পায় বল ফুটো করে দেবার। একজন বল খুঁজলে আরেকজন লক্ষ্য করবে মালি কোথায় কি করছে।

মালি বালকদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। বালকদের পকেটে আম আসতেই থাকে। খেলা শেষে মহানন্দে তারা আম খায়। আমের আঁঠি চুষতে থাকে। এবং সেই আঁঠি বালকরা ছুঁড়ে দেয় বাগানেই। ক্যাপ্টেন বলেছে, আঁঠি থেকে আবার গাছ হবে। তাই, আঁঠি নষ্ট করো না।

মালির নাতি আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। সে ঘর থেকে দেখতে পায় মাঠের খেলা। তার মনে সাধ হয়,
সেও খেলবে। নাতি দাদুর কাছে আবদার করে, তাকে মাঠে নিয়ে যেতে হবে। সে খেলবে সবার সঙ্গে।

মালি দাদু খেলার সময় মাঠে গিয়ে ক্যাপ্টেনকে বলে-------তার নাতিকে খেলাও। ক্যাপ্টেন জানায়
নিশ্চয়ই খেলাবো। তবে আমাদের দিতে হবে আম। মালি রাজি হয়ে যায়। কেন না, মালির নাতি একটাই।

মালি যখন নাতিকে মাঠে নিয়ে যায় খেলাতে তখন সঙ্গে নিয়ে যায় আম। সবার হাতে হাতে আম দিয়ে মালি নিজেও খেলা দেখে।

দেখতে থাকে, তার একটা নাতি নয় তার অনেক নাতি। অনেক মুখ। অনেক আলো ছুটছে।


------১০ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৭----৮----২০২১
-----নির্মল হালদার







উল্কা / নির্মল হালদার

উল্কা / নির্মল হালদার




মেয়েটি একা একা হাঁটছে।

ভাবছিলাম, সামনে বা পিছনে কেউ আছে। অথবা আড়ালে আছে কোন এক কারণে।

অনেকক্ষণ আমিও ঘোরাঘুরি করছি, কাউকে দেখছি না।
মেয়েটি একা একাই ঘুরছে।
এই নির্জনে।

মেয়েটির সঙ্গে আমার আলাপ হচ্ছে না। জানতে পারছি না তার নাম। আমি মনে মনে তাই, নামকরণ করে ফেললাম, উল্কা।

এখানে নদী নেই পাহাড় নেই।

উল্কা কার সঙ্গে কথা বলছে?

কয়েকটা গাছপালা আর একটি জলাধার। এদের সঙ্গে কথা বলা যায়?

আমার ইচ্ছে করছে উল্কার
কাছে যাই। কথা বলি।

এইতো এইতো আপনি-----

----আপনার পরিচয়?
----আমি বৃক্ষ। বন্ধুরা মজা করে বলে, আমি ভিক্ষুক।
আপনি যে কোন নামে ডাকতে পারেন।
----আমি বৃক্ষ বলব। ভারী সুন্দর নাম। শব্দটা উচ্চারণ করলেই, গাছপালার নিবিড়তা। বন্ধুত্ব। ভালোবাসা।

----আপনি একা একা ঘুরছেন সঙ্গে কেউ নেই?
-----আমি একা ঘুরতে ভালোবাসি। আর শুনুন, আপনি আমাকে তুমি করে বললেই ভালো লাগবে।

----আচ্ছা আচ্ছা।
তোমার বাড়ি?

-----এটা জানা কি খুব জরুরী?

-----না জরুরী নয়। তবু তো আমরা একটা ঠিকানা চাই।

-----ঠিকানা?
আমি যে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এই তো একটা বড় ঠিকানা।

-----তুমি সুন্দর সুন্দর কথা বলো দেখছি।

-----নির্জনের কাছে এলে
কথারা সুন্দর হয়ে যায়।
------মানুষও সুন্দর হয়।
-----সবাই হয় কি?
------সেভাবে সমীক্ষা করে দেখা হয়নি কোনদিন।
-----তর্ক বাদ দিলেই ভালো. এই নির্জনতা তর্কের রব পছন্দ করেনা।
-----তোমাকে নিশ্চয়ই করে।
----আমি দেবদ্যুতি নই। আমি সামান্য একজন মানুষ। আমাকে বড় করে দেখবেন না।
-----তোমার অন্তরের সৌন্দর্য
তোমাকে বড় করে দেখাচ্ছে।
আমি কি করতে পারি।

-----মনে হচ্ছে, আপনিও অন্তর থেকে একজন বড় মাপের মানুষ।
----না না একদম না।
আমার কোন অস্তিত্ব নেই কোথাও। অস্তিত্ব নিয়ে থাকলে
নিজের মধ্যে অনেক টানাপোড়েন চলে। কে মূল্য দিলো কে মূল্য দিলোনা , সব সময় হিসেবে থাকতে হয়।
হিসেব কি সবাইকে মানায়?

---এই কথাটা অমূল্য।
অস্তিত্বের যা জটিলতা তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়। বরং প্রকৃতির অস্তিত্বকে নিয়ে
আমরা চিন্তাভাবনা করবো।
কিভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করা যায়।

একি, উল্কা দাঁড়িয়ে পড়লো কেন? হঠাৎ তার মুখ থমথম করছে। কি হলো?

আমি বিচলিত হয়ে মুখোমুখি হই। প্রশ্ন করি, কি হল তোমার? শরীর খারাপ লাগছে না তো?
উল্কা চুপ করে আছে। আমিও
নীরব থাকি।

কিছুক্ষণ পর সে বলে ওঠে, চলুন একটা চায়ের দোকান খুঁজি।

খুঁজতে খুঁজতে এই কথা সেই কথা। এলোমেলো কথারাও আমাদের চারপাশে ঘুরতে থাকে।
দোকান খুঁজে না পেয়ে উল্কা বসে পড়ে একটা পাথরে। সঙ্গে আমিও।

তারপর, রোদ পড়তে থাকে।
হেমন্তের হাওয়ায় শিরশিরানি।
ঠান্ডা। রং পাল্টে যাচ্ছে আকাশের। হঠাৎ উল্কা
আমার পিছনে এসে কাঁধে
মুখ রাখে।

সে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
তার চোখের জল আমার কাঁধ 
বহন করতে পারবেতো?



----১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
----২৬---১১---২০২০
------নির্মল হালদার






ছবি : সন্দীপ কুমার

মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার



২৪.
রাস্তা চলে যায়
সোজা যায় বেঁকে যায়
সরু হয়ে যায়

রাস্তায় পায়ের শব্দ
যান চলাচল
ধুলো বালি , পাথর

রাস্তায় হোঁচট
ভিড়-ভয়--ভালোবাসাও
দেখা সাক্ষাৎ

রাস্তায় আলো অন্ধকার
বয়ে যায় জল
উঁচু নিচু খাল ডোব

হঠাৎ একটা গাছ
হাওয়া আসছে পথিকের।



২৫.
দুই পারে দুটি নৌকা
পারাপারের যাত্রি নেই
মাঝে নদী ছল ছল

নৌকা ঘরে উনুন জ্বলে
তেল হলুদের গন্ধ
চড়চড় করে দুপুরবেলা

জল ছুঁয়ে উড়ে গেল বক
পানা ভাসছে শ্যাওলা ভাসছে
পাতা আছে ধীবরের জাল

নৌকার পাল নড়ে উঠছে
মাথার উপরে স্তব্ধতা
নদীর বালিও চুপচাপ

দূরে কোথাও ধোঁয়া উঠছে
ঝমঝম করে ট্রেন চলে যায়
ঝনঝন করে ব্রিজ

একটা ডাক নদীর এপার ওপার।



-----২ ভাদ্র ১৪২৮
----১৯---৮---২০২১



২৬.
শিশু কোলে মা হাঁটছে

খাঁ খাঁ করছে চারদিক
রোদ পুড়ছে রোদের গায়ে
পড়ে আছে পাহাড় ভাঙা পাথর
দেখা যায় বনের পথ

মায়ের কোলে শিশুর হাসি

একটা গরুর গাড়ি আসছে
চাকায় জড়িয়ে আছে কাদা
গাড়োয়নের মুখে ক্লান্তি
মধ্য গগনে সূর্য

মায়ের দুধ টানছে শিশু।




২৭.
ঘর থেকে চলে যাচ্ছে টিনের তোরঙ্গ

দরজার মাথায় সিঁদুরের দাগ
দুয়ারে ঝুলছে আম পল্লব
ঘরের ভিতরে ঘুমিয়ে আছে শিশু
কুলুঙ্গিতে ফটো প্রতিমা

পিলসুজ দাঁড়িয়ে আছে একা
এক কোণে একটা কলসি
থালা-বাটিও সাজানো
আলনায় জামা কাপড়

ঘর থেকে চলে যাচ্ছে টিনের তোরঙ্গ

দেয়ালে ক্যালেন্ডার
দেয়ালে আঙুলের দাগ
এক কোণে কাঁথাকানি,হাঁড়িকুড়ি
ভেঙ্গে গেছে জানলার শিক

আকাশ ঢুকে পড়ছে।



-----৩ ভাদ্র ১৪২৮
----২০---৮---২০২১



২৮.
ধার বাকি করতে নেই

যা আছে যেটুকু আছে খাও পরো
চাল থেকে বেছে নাও কাঁকর
কচু শাক রান্না করো
ওল খুঁড়ে নিয়ে এসো

ধার বাকি করতে যেও না

ধার বাকি শোধ করতে না পারলে
এক জন্মের পাপ
ঋণের বোঝা সব সময়
মাথা থেকে নামিয়ে রাখো

ঘটি বাটি যা আছে বন্ধক দিতেও যেওনা।



২৯.
আম খেয়ে আমের আঁঠি পুঁতি মাটিতে

বীজ ফেলতে নেইরে ভাই
মাটি থেকে এসেছে তাকে মাটিতেই রাখি
ফলে ফলে শোভা পাবে ঘর

ফলের রঙ ফলের আলো সন্তানের মুখে পড়বে

সন্তান আমাদের শ্রী।


-----৪ ভাদ্র ১৪২৮
----২১---৮--২০২১



৩০.
বড়ি শুকানো রোদে
মা--খুড়িরা চুল শুকায়
বাপের ঘরের গল্প করে

সেই যে সেবার এক গাছ কুল
সেই বারেই তো গোপাল হয়েছিল
ঘরে প্রথম পুত্র সন্তান
শাঁখ বেজেছিল

মা---খুড়িদের গল্পে কাক ঢুকে পড়ে
খুঁটে দিয়ে গেল বড়ির মুখ
শীতের বেলা সূর্য ঢলে পড়ে

মায়ের চুলে চিরুনি চালায় খুড়ি।



৩১.
কে ডাকছে ধরণীকে?

মাঠে কাজ করছে একজন
দূরের শালিক কাছে আসে
ইঁট পাঁজায় উড়ছে নিশান

বুড়ি শাক তুলছে
ঝুড়ি ভর্তি রোদ
পাথরের খাঁজে শুকনো মাটি

কে ডাকছে ধরণীকে?

বুনো ফুলের বাহার
বাঁধের জলে শালুক পাতা
বেড়ে উঠছে আখের রস

জনার বীজের আভা
কাশের রেণু উড়ছে হাওয়ায়
কাঁটা ঘাসে বুনছে ঝাঁটা

কে ডাকছে ধরণীকে?

ধরণী দু ফাঁক হলে বীজের রোশনাই।



----৫ ভাদ্র ১৪২৮
----২২---৮---২০২১



৩২.
একটা নিম গাছ
দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা।
একটা কুল গাছ
দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা।

কে অপেক্ষা?

একটা কুয়াশা
দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা।
একটা রোদ
দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা।

কে অপেক্ষা?

একটা শুকনো হাঁড়ি
দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা।
একটা শুকনো কলসি
দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা।

কে অপেক্ষা?

অপেক্ষার কোনো নাম নেই।




৩৩.
শাল পাতায় পিঠে বেঁধে দাও।
যেখানে যে কুটুম আছে দিয়ে আসবো।
আমার সুখ দুঃখ দিয়ে আসবো।
পেঁপে গাছটা যে বড় হয়ে গেছে বলে আসতে হবে।

ইঁদুরে ধান চুরি করলেও চালে কম পড়বে না।
ছেলে মেয়েদের মুখে হাসি কম পড়বে না।
আলুও হয়েছে দেদার, বাদাম ও বিক্রি করেছি।
হাত পাততে হবে না কোথাও কারও কাছে।

কুটুম কে সব কথা না বললেও
বলে আসতে হবে, ঘরের দিকে যাবে হে।

ঘরের দিকে যাবে গো, ছোটটার মুখেভাত দিব।



----৬ ভাদ্র ১৪২৮
----২৩---৮---২০২১



৩৪.
কালি লেগে আছে থাক-----
তবে তো বুঝবে হাঁড়ি চড়েছিল উনুনে।
তবে তো বুঝবে রাঁধাবাড়া হয়েছিল।
পাত পড়েছিল।

গেরস্থের ঘরে উনুন টাও মঙ্গলের চিহ্ন।
উনুন জ্বললেই দুয়ারে দাঁড়ায় কাক ও কুকুর।
ভুলে গেলে চলবে না,
ওরাও আমাদের সংসারের

শুভকামনায় আছে।



৩৫.
একটা বাঁধেই সিনান করো।
জলের ভালো-মন্দ বুঝবে।
একটা ঘাটেই নামো, তোমাকে চিনবে
বাঁধের ঘাট

তুমিও চিনবে ঘাটের পাথর।

যে পাথরে পা ঘষতে ঘষতে
মনে পড়বে না, কে বহন করেছিল পাথর।
ডুব দিতে দিতেও মনে পড়বে না
কারা খুঁড়েছিল বাঁধ।



৩৬.
এক মুঠি চালের সঙ্গে দুটো আলু দাও।
যদি পারো একটু নুন দাও।
যদি ইচ্ছে করে শুনে নাও হরিনাম।
তুলসী গাছটাও খুশি হবে সকালের হরিনামে।

তুলসী গাছে জল দিয়েছো?

কপালে রসকলি না আঁকো মাথায় ঠেকিয়েছো ধূলা?



----৭ ভাদ্র ১৪২৮
----২৪---৮----২০২১
----নির্মল হালদার








আমার বয়স মাত্র ১৮ দিন / নির্মল হালদার

আমার বয়স মাত্র ১৮ দিন / নির্মল হালদার




আমি জন্ম থেকেই শুধু কাঁদি। মা বলে, কী খাবি রে?কী খাবি? আমার বুকে দুধ নেই। সে কথা আমি শুনবো না। আমিতো কাঁদবোই। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বো। খিদে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়বো। মা বাবাকে বলে, হ্যাঁগো দুধের বদলে অন্য কিছু পাওয়া যায় না? ছেলেটাকে দিতাম। বাবা বাজার থেকে এনে দেয় হরলিক্স।

হরলিক্স দুধের বিকল্প নয়। আমি খেলেও আমার পেট ভরে না। আমি কেঁদে উঠি। মায়ের মন বুঝতে পারে। কিন্তু মা করবে কি! আমার হাতে ধরিয়ে দেয় চুষিকাঠি। আমার ছোট আঙুলে কচি আঙুলে আমি ধরতে পারি না। ধরতে পারি শুধু মায়ের বুক। আমার একমাত্র পৃথিবী। সেও তো ধরতে পারি না। মায়ের বুকে দুধ নেই। আমি কাঁদি।

বাবা এসে আমাকে কোলে নেয়। আমি ভুলি না।দিদিরা এসে আমাকে কোলে নেয়। আমার কান্না থামে না।

আমি জন্মেই জেনে গেছি, মায়ের দুধের বিকল্প নেই। তাই সব সময় আমার কান্না। মা বিরক্ত হয়ে নিজেও কেঁদে ওঠে। বলে------কী কপাল করেছিসরে তুই? শেষ বেলায় আমাকেও কাঁদাতে এলি? মায়ের বেদনা দেখে আমি আরো কাঁদতে থাকি। মা ভাবে, আমার খিদে পেয়েছে। আমাকে কোলে নেয়।পিঠ চাপড়ায়।আমার মুখে পুরে দেয় শুকনো স্তন। আমি খানিক শান্তি পাই। মনে হয়, এইতো পেয়ে গেছি, আমার মায়ের পৃথিবী। আমার পৃথিবী।

আমাকে কোলে নিয়েই মা ঘরের কাজকর্ম করতে থাকে। আমি থেকে থেকে কেঁদে উঠছি। আমার জেঠি আমাকে কোলে তুলে নেয়। আমার পিসি আমাকে কোলে তুলে নেয়।

দুধের অভাব কি কোল মেটাতে পারে? আর আমার যে কিছু নেই দুধ ছাড়া। আমার যে কিছু নেই মা ছাড়া।

আমি কারোর কোলে উঠেও ঘুমোতে পারি না। আমার খিদে পায়। আমি জন্মেই আকাশটাকে দেখতে পেয়েছি। মনে হচ্ছে, আমার দুই হাতে খামচে টেনে নামাই। মনে হচ্ছে, আকাশটাকে কামড়াই।

মায়ের দুঃখ-বেদনার দিকে আর তাকাতে পারি না।

আমার বয়স মাত্র ১৮ দিন।



-----৭ ভাদ্র ১৪২৮
----২৪----৮----২০২১
-----নির্মল হালদার



শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১

পাতা ও পাখি / নির্মল হালদার

পাতা ও পাখি / নির্মল হালদার




বালক-বালিকার দল খেলা করছে। তাদের মাঝে এসে পড়েছে এক যুবক। রঞ্জন।

খেলার মাঠ যেমন বড় তেমনি মাঠে আছে অসংখ্য ফুল ফলের গাছ। মাঠের ধারে ধারে। মাঠের আকর্ষণ তাই সকলের কাছে। সকাল-বিকেল অনেক মানুষই বেড়াতে আসে এখানে। মনোরম হাওয়া। অনেক পাখ-পাখালি। নানা সুর।

এখানে রঞ্জন পাখিদের সুর তুলতেই আসে। প্রায় দিন। কখনো কখনো তার টিউশনের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঠে নিয়ে আসে। পাখিদের সুর শুনিয়ে পাখিদের ডাকে। রঞ্জনকে অনুসরণ করে তার ছাত্র-ছাত্রীরাও। রঞ্জন বলে, পাখিদের সুর গলায় তুলতে পারলে গলা কখনোই খারাপ হবে না। নষ্ট হবে না। যে যতটুকু পারবে পাখিদের সুর তুলে নাও।

বালক-বালিকারা খেলতে এসে খেলা বন্ধ করে দেয়। তারা শোনে রঞ্জন কি চমৎকার পাখির সুরে সুর মেলাচ্ছে।

বালক বালিকাদের মধ্যে একজন রঞ্জনকে বলে, আমাকে শিখিয়ে দেবে। রঞ্জন উত্তর দেয়, হ্যাঁ শিখিয়ে দিতে পারি, যদি একটা গাছের কত পাতা আছে গুনতে পারিস? বালকটি বলে, আমি পারবো আমি পারবো--------।

বালক জাম গাছে উঠে পড়ে। সে জানে এখন গাছে অনেক ফল। ফল খেতে খেতে পাতা গুনে ফেলবে সে।
অসংখ্য জাম খেয়ে ফেলার পরও বালক গাছের পাতা গুনে ফেলতে পারলো না। রঞ্জন ও তার ছাত্র ছাত্রীরা হেসে উঠলো। রঞ্জন জানে, এই কাজটি কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সে বালককে বলে, এখন যা তোকে অন্য দিন পাখির সুর শুনিয়ে দেবো। অথবা পাখিকে ডেকে দেবো তোর কাছে। পাখি শোনাবে তার সুর।

এবার রঞ্জন এক বালিকাকে ডেকে বলে, তুই গাছের পাতা গুনতে পারবি? যদি পারিস তোকে ছবি আঁকার জন্য রংপেন্সিল দেবো। বালিকা রাজি হয়ে শাল গাছে ওঠার চেষ্টা করে। পারে না। আরেক বালক এসে জাম গাছে উঠবো বলে। রঞ্জন "না" করে না। বালক জানে গাছের পাতা গুনতে পারবে না। তবে জাম খেয়ে নেমে আসতে পারবে। বালকের এই চালাকি ধরতে পারেনা রঞ্জন। সে বালকের গাছে ওঠার দিকে চেয়ে থাকে। বালক গাছের মাঝ বরাবর গিয়ে একটা ডালে বসে পড়ে। আর জাম তুলে তুলে ফেলতে থাকে মুখে।
নিচ থেকে রঞ্জন দেখতে পায়। কিন্তু কিছু বলে না। ছোট ছেলে খাচ্ছে খেয়ে যাক। তো সেই ছোট ছেলে রঞ্জন কে উপর থেকে বলে, স্যার স্যার---সাতশো এগারোটা পাতা আছে।

রঞ্জন হেসে ফেলে। কারণ, সে জানে গাছের পাতা গোনা যায়না। বালকের কথা মিথ্যে কথা। রঞ্জন কিছু মনে করে না। সে বালককে নিচে নামতে বলে। আর বলে, তুই বলতেই পারতিস, তোর জাম খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। শোন্ একটা কথা, আমিও গাছের পাতা গুনতে পারবোনা। তবে তোদের দিতে পারবো একটা করে চকলেট। এখানে সবাইকে ডাক-----।

বালক-বালিকারা এক জায়গায় জড়ো হলে রঞ্জন তাদের বলে, একটা দিন আমরা গুনবো মাঠে কটা গাছ আছে। কী কী গাছ আছে। আমার মনে হয়, এই কাজটা আমাদের পক্ষে সম্ভব। ঠিক তো?

যেদিন এই কাজটা করবো, সেদিন ডাকবো অনেক পাখিকে। তোদের গলার স্বরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো পাখিদের।

আজ সন্ধ্যে হয়ে আসছে সবাই বাড়ি যাও।


----৩ ভাদ্র ১৪২৮
----২০---৮---২০২১
----নির্মল হালদার







বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব//নির্মল হালদার

পানকৌড়ির ডুব//নির্মল হালদার



১১.
গরুর কাঁধে হালের দাগ
গাছে কুড়ুলের দাগ
পাতায় পাতায় পোকায় কাটা দাগ

শুয়োর চরছে
শুয়োর ছানারাও আছে
ঝোপ জঙ্গলে মাকড়সা

রাস্তায় পিঁপড়ের বাসা
মাটি তুলছে কেঁচোরা
ছাগল চিবোয় ঘাসপাতা

মাথায় কাঠের বোঝা
সাইকেলে সবজি যায়
হাটবার

আমার সবকিছু আমার নয় কিছু।



১২.
পাহাড়তলীর ঘর
পাখির কলরব।
পাহাড়তলীর ঘর
পত্র পল্লব।

আলো হাওয়া
মেঘের আসা যাওয়া
আকাশ ঝুঁকে পড়ছে
শিকড়ের রস।

ধারালো টাঙ্গি
চকচকে কুড়াল
মহুলের গন্ধ
হাঁড়িয়ার সুবাস

মাদলের বোল
বাঁশির সুর
নাচ-গান পরব
শুয়োরের মাংস

থৈ থৈ প্রাণ।


-----২৬ শ্রাবণ ১৪২৮
----১২---৮----২০২১



১৩.
কী দেখবো আর এই তো সকাল

শিশিরের নিঃশব্দ মুখ
পাতায় পাতায় স্তব্ধতা
ফুলে ফলে ধরিত্রী নীরব

কী দেখবো আর এই তো সকাল

পাখিদের ডাকাডাকি
সূর্যের কিরণ
লাঙ্গল কাঁধে একজন

কী দেখবো আর এই তো সকাল

মাটি থেকে ওল খুঁড়ছে
মান পাতায় একটা মাছি
বাদামের ছোট ছোট গাছ

কী দেখবো আর এই তো সকাল

রাস্তায় চলাচল
নিম দাঁতনের গল্প
ভাঙ্গা টিউকল

আমার আগেই এসেছে সকাল অনেক আগে।



১৪.
আমবাগান
মৌমাছিরা উড়ছে।
আমবাগান
মৌমাছিরা উড়বেই।

আমবাগান।

আমের বোঁটা ছিঁড়লেই
আমের মধু।

মধু।

মধুমঙ্গল।

----২৭ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৩---৮---২০২১



১৫.
কিছুই তো নেই অনেক কিছুই আছে

ভাঙ্গা মন্দির
দেয়ালে শ্যাওলা
বুড়ো বেল গাছ

বটতলে তাসের আসর
শিশুদের ধুলো খেলা
সাইকেলে ফেরিওয়ালা

মাথায় ঘাসের বোঝা
দড়ি ছেঁড়া বাছুর
পায়রা উড়লো

কিছুই তো নেই অনেক কিছুই আছে

বালিকার কোলে হাঁস
জল ছাপ ছপ পা
পুকুরে সিনান করছে বউ

জামবাটিতে মাড়ভাত
সজনে শাকের সুয়াদ
হাঁড়িতে জনার সিজছে

কুলুঙ্গিতে আয়না
কাঠের কাঁকই
ঝুলছে ময়লা কাঁথা

কিছুই তো নেই আলোছায়া খেলছে




১৬.
ওইতো দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা

রাস্তা যায় 
লোক যায়
গোধূলির আলো

ওইতো দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা

শাঁখ বাজে
সন্ধ্যা তারা আসে
ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে

ওইতো দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা

কপালে টিপ
মলিন মুখ
আঁচল টানে ছেলে

ওইতো দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা

কবে আসবে?
কখন আসবে?
কতদূরে কাজের দেশ?

অপেক্ষা ভেঙে পড়ছে কান্নায়।


-----২৮ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৪---৮---২০২১



১৭.
স্তব্ধ জবা থেকে ফেটে পড়ছে রঙ
অপরাজিতাও ফুটছে
রঙের স্রোত

টগরের পাশে টগর ফুটছে
মাধবীলতায় ফুলের গৌরব
রঙের স্রোত

শিউলির গন্ধ উড়ছে
মৌমাছির গুঞ্জন
প্রাণের স্রোত

কে আসছো ফুল তুলতে?




১৮.
পুঁইলতায় জড়িয়ে আছে শিশির
ঝিঙেলতায় শিশির
ভোরের হাওয়া

আকাশ জুড়ে আলো
গাছে গাছে কানাকানি
বুয়ান ডালে চড়ুই

লঙকা ফুটেছে লাল
কাঁটা বেগুনের জমি
কাকতাড়ুয়া

কোদাল কাঁধে চাষী
ভেঙ্গে গেছে আল
অড়হরের পাতা কাঁপছে

তুলসীর ঝোপ
কল্কে ফুলের মধু
ফনিমনসা

আর আছে সকল প্রাণের আনন্দ

----২৯ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৫---৮---২০২১



১৯.
অন্ধকার রাত্রি
একলা মানুষ
লন্ঠন এগিয়ে আসছে না

নির্জন পথ
হু হু করছে হাওয়া
জ্বলছে নিভছে তারা

কাছে দূরে আত্মীয়তা
কাছে দূরে ঘুম
নিদ্রাহীনতাও

কুকুর ডেকে উঠলো
ঝিঁঝিঁপোকার সুর
জোনাকি এগিয়ে আসছে না

গাছপালা অন্ধকার
একলা মানুষ
রাতচরা পাখির ডাক

সাড়া শব্দ নেই
নিঝুম চারপাশ

নিঃসঙ্গতা।


----৩০ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৬---৮---২০২১



২০.
আলতা পরা পা
শাড়ির রঙিণ পাড়
হাতে চুড়ি রুণুঝুনু

উঠোনে ঝাঁট
গোয়াল পরিষ্কার
গরু গেল গোঠে

ন্যাংটো শিশুর কান্না
চালে ঝুলছে কাঁথা
লাউ লতের বেড়ে ওঠা

উনুনে আধপোড়া কাঠ
দড়ির খাটিয়া
হেলানো সাইকেল

বেলা বাড়ছে
সজনে গাছে রোদ
মাড়ুলি শুকায়

ভুবনের এক কোণে মায়ের সংসার



২১.
ভিজতে ভিজতে আসছে ছাগলের পাল
গাছপালাও ভিজছে
বৃষ্টির অন্ধকার।

এ অন্ধকারে মেঘের মাদল বাজে
কে বাজায়?
বিদ্যুৎ ঝলকে কার মুখ দেখি?

ব্যাঙ চলে যায়
কয়েকটা শামুক
বকের উড়াল

ধানের মাথা কাঁপছে
জলে জলে গলে যায় মাটি
খালডোবে জল

পুকুরে লাফায় মাছ
ঘাটে পড়ে আছে দাগ
চেয়ে আছে পাকা ডুমুর

বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় প্রাণের শব্দ।


----৩১ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৭---৮---২০২১



২২.
ঝিরিঝিরি নাচ
ঝিরিঝিরি গান
মেঘ ও রোদের খেলা

শিউলি ঝরছে
অপরাজিতার নীল
কল্কে ফুলের হলুদ

ধানক্ষেতে ছুটে বেড়ায় মাছ
ফেটে পড়া তাল
কাশবনে হুটোপুটি

মাঠে-ঘাটে আগাছা জন্মায়
ঘাস কাটছে বুড়ো
ফড়িঙের ডানা

বিরি-কলাইয়ের সবুজ
বাদাম ফুলের মধু
মৌমাছির ডাক

কী ভাষায় কথা বলব আর।



২৩.
মাটি কাটছে
গাঁইতি-কোদাল
মাটি কাটছে
এক চৌকা দু চৌকা।


ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি
বালি কাঁকুরে মাটি
মাটি কাটছে
ঘাম

পিপাসা জাগছে
ছায়া নেই কোথাও
বাতাসেও উষ্ণতা
মরীচিকা

মেয়ে মরদের কাম
পুকুর খনন
কাছে দূরে গ্রাম
পাহাড়ের আভাস

দিনমজুরের গল্পে আমলকি নেই।



-----১ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৮---৮----২০২১
----নির্মল হালদার










জ্যান্ত / নির্মল হালদার

জ্যান্ত / নির্মল হালদার



তোমাকে আমার চিঠিটাই লেখা ছিল বাকি। অনেক কিছুই দিইনি তোমাকে। যেমন, মেঘ বৃষ্টি। যেমন রৌদ্র ছায়া। যেমন শরতের ধানক্ষেত। হ্যাঁ, এটাও ঠিক তোমাকে কোনো সন্তান দিতে পারিনি। আবার এটাও ঠিক, তোমাকে দিয়েছি একটা বাড়ি।

বাড়িটা আগলে আগলে তুমি থাকো। সম্পত্তি নাইবা ভাবলে। ভাবো, বাড়িটাই তোমার একমাত্র সন্তান। যে তোমাকে দেখবে।

তোমাকে দিতে পারিনি কাশবনের ছোটাছুটি। তোমাকে দিতে পারিনি অপরাজিতার রঙ। লাজুক শালুক ফুল। তবে আমি তোমাকে দিয়েছি একটা বাড়ি।

আমরা ভাড়া বাড়িতে ছিলাম। মাত্র দুটো ঘর। সব সময় অন্ধকার। ঝকঝকে বাথরুম ছিলনা। একটা কল তলা ছিল। একটা পায়খানা। তুমি সব সময় মুখ কুঁচকে থাকতে। তুমি সব সময় আমাকে বলেছো, আমি অকর্মণ্য। কলম ছাড়া আমার নাকি কিচ্ছু নেই। আমার রোজগার করার ক্ষমতা নেই। একটা বাড়ি পর্যন্ত আমি করতে পারিনি। আমার মুরোদ নেই।
তুমি আমাকে উঠতে বসতে অপমান করতে। আমি কোনোদিন কোনো অপমানের জবাব দিতে যাইনি।
আমি সবসময় চেষ্টা করেছি, আমার মুখের হাসি থেকে তোমাকে ভালো রাখতে। কিন্তু তুমি বুঝতে না। তুমি বলতে, আমার লেখালেখি থেকে এক পয়সা উপার্জন করি না। আমার আবার কিসের অহংকার। আমার নাকি হাসিও মানায় না।

যেদিন খবর পেলাম আমার বাবার জমানো টাকা আমি পাচ্ছি। তা প্রায় পনেরো লাখ টাকার মতো। বাবা নাকি কাউকে কিছু না বলে, আমার নামেই ফিক্সড করে গেছলেন। আমি যখন জানলাম, প্রথমেই তোমাকে বলেছি, তোমাকে বাড়ি করে দেবো। আর চিন্তা করতে হবে না। তুমি মহা খুশি হয়ে সেদিন আমাকে মাংস ভাত খাইয়েছিলে। বলেছিলে এটাও, আমি যেন দোকানের খাতা লেখার কাজ ছেড়ে দিই। অথচ কোনোদিন জানলে না, ওই খাতা লেখার কাজ থেকেই আমাদের সংসার চলে। এবং ওই খাতাতে আমার যাবতীয় লেখালেখি। সেও আমার মালিক জানতেন। তিনি সহৃদয় ব্যক্তি। আমার লেখালেখির কাজে তার মৌন সমর্থন ছিল। তাই সরস্বতী প্রকাশন থেকে আমার এক একটা বই প্রকাশ হয়ে চলেছে। প্রকাশক টাকা না দিলেও বইটা যে প্রকাশ পাচ্ছে, এও তুমি কোনোদিন জানার চেষ্টা করলে না। কেবলই
আমাকে লোকজনের কাছেও ছোট করে গেছো। মন্দ কথা বলে গেছো।

তোমাকে দিতে পারিনি একটা নদী। তোমাকে দিতে পারিনি সবুজের আলো। তোমাকে দিতে পারিনি পাখির উড়াল। একটা জঙ্গল দিতে পারলে তুমি বুঝতে পশুপাখিদের সংসার। এখন তুমি নতুন বাড়িটা নিয়ে সুখী হয়ে থাকো।

যেদিন ১ কাঠা জমি দেখাতে তোমাকে নিয়ে গেলাম শহর শেষের সীমানায়। সেদিন তুমি আমার কপালে রেখেছিলে একটা চুম্বন।

আমাকে খুঁজে দেখতে হবে চুম্বনের দাগটা আছে কিনা। সেই তো তোমার প্রথম ভালোবাসা। আমার মনে হয়। কেন না তুমি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতেই পারোনি। আজ আমার মুক্তি। বাড়িটা করে দিতে পেরেছি। তোমার নামেই করে দিতে পেরেছি। আর আমি নিজে পাহাড়ি এক গ্রামের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছি। অনেক দূর। আর কোনোদিন ফিরে না আসার চেষ্টা করবো। তুমি থাকো। ভালো থাকো।

তোমাকে দিতে পারিনি ঘন বৃষ্টির রাত্রি। তোমাকে দিতে পারিনি গ্রীষ্মের আমবাগান। তোমাকে দিতে পারিনি হেমন্তের গোধূলি। এই এতদিন পর তোমাকে দিতে পারলাম একটা জ্যান্ত বাড়ি। তাকে সন্তান মনে করে লালন করবে। এই আশা করতেই পারি।

একটা বাড়িও এক সন্তান।

তোমাকে আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। পড়ে নিয়ে কুচি কুচি করবে। আমি মনে করি, আমার এই কথা রাখবে।


----১ ভাদ্র ১৪২৮
----১৮---৮---২০২১
----নির্মল হালদার








সন্দীপ সম্পর্কে আমি যা জানি / নির্মল হালদার

সন্দীপ সম্পর্কে আমি যা জানি / নির্মল হালদার



সন্দীপ সেই ক্যামেরাম্যান যে শুধুমাত্র চিত্রকর সনৎ করের ছবি তোলার জন্য শান্তিনিকেতন ছুটে যায়। কবি দেবদাস আচার্যর ছবি তোলার জন্য কৃষ্ণনগর ছুটে যায়। সে সুদূর ব্যাঙ্গালোর ছুটে গেছে গায়ক মান্না দের ছবি তুলতে। জলপাইগুড়ি ছুটে গেছে কালাচাঁদ দরবেশের ছবির জন্য।

শুধু কবি শিল্পী নয় নাটকের, অভিনেতাদের, সিনেমার অভিনেতাদের ছবি তুলে গেছে দিনের পর দিন। গল্পকার ঔপন্যাসিকদের ছবি তুলে গেছে।

সৈকত রক্ষিতের ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করেছে বছরের পর বছর। শেষ অবধি এই গত শীতে
সৈকত রক্ষিতের ছবি তুলতে পেরেছে।

অর্থের লোভে নয়। খ্যাতির লোভে নয়, শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ছবিগুলো থেকে যাবে। ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে।

আমার মনে আছে, আমাকে মডেল করে সে যখন
ছবি তুলে যাচ্ছে, তখন তার ইচ্ছে ছিল, আমার ন্যুড ছবিও তুলবে। আমি আমার সংস্কার থেকে সেই ছবি তুলতে দিইনি। তবে সে বডি পেইন্টিং এর ছবি তুলেছে। এজন্যে কত তোড়জোড়। সারা শরীরে কে ছবি আঁকবে? শিল্পী আশিস নন্দী কে প্রস্তাব দিতেই,
রাজি হয়ে গেল।

আশিস আমার বাড়িতে এসে আমার খালি গায়ে ছবি যেমন আঁকলো তেমনি দুই তরুণ বিশ্বনাথ বাউরী ও বাপি কর্মকারের গায়ে ছবি এঁকে ভরিয়ে তুললো তাদের শরীর।

সেদিন তাদেরও ছবি তুলে সন্দীপ খুশি হয়েছিল খুব। সেদিন অবিনদের গ্রামের কাছে কাঁসাই যাওয়া হয়েছিল দুপুরের পরে। সেখানে সঞ্জীব বাউরী আমার খালিগায়ে ছবি এঁকেছিল। সন্দীপের ক্যামেরায় আমি বন্দি হয়ে গেছি।

ছবি তোলার ব্যাপারে সন্দীপের আবেগ এতটাই যে  সে যখন তখন দূরদূরান্ত ছুটে যায় ক্যামেরা নিয়ে। 

পুরুলিয়ার নাচনি--শিল্পীদের ছবি সন্দীপের কাছেই সমস্ত আছে। পুরুলিয়ার কোনো লোকশিল্প অনুরাগীর কাছে নেই।

 
সে ছুটে এসেছে পুরুলিয়াতে টুসু বা মকর পরবের ছবি তুলতে। এই সন্দীপের আচার-আচরণে কোনো অহংকার প্রকাশ পায় না। তার যে ছবির বিষয়ে আবেগ তাকে  কুর্নিশ করতেই হয়।

------নির্মল হালদার
-----১৪---৮---২০২১







মৌমাছিরা / নির্মল হালদার

মৌমাছিরা / নির্মল হালদার



একেকদিন ক্লান্ত লাগে খুব। ঘুম আসে। আর ঘুম এলেই , এসে দাঁড়ায় অবন্তিকা। সে মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে। তখন আমার মনে হয়, আমবাগানে ছুটে যাই। মৌমাছিদের সঙ্গে খেলা করবো।

ঘুম তো ভাঙ্গে না।


ঘুম ভাঙলেই, আমি চলে যাবো মৌমাছিদের কাছে।
ডাকলেই কাছে চলে আসে। কি সুন্দর যে তাদের নাচ। কি মধুময় তাদের গুঞ্জন। আমি নেচে নেচে উঠি।

কি সকাল কি দুপুর যখনই যাই কাছে পাই মৌমাছিদের। ওদের ডানায় ডানায় আমার স্পর্শ রেখে
আমি ওদের নাচ করতে বলি। আমি ওদের গান করতে বলি।
ওরা শোনে আমার কথা। আম হলে কতটা পেকেছে আমাকে জানায়।আমে রঙ এলেই ওদের ফুর্তি। ওরা জানে , আমের মধু। যা আমিও পাই ওদের কাছ থেকে। গাছে মুকুল এলেই ওরা আমাকে ঘরে এসে খবর দেয়। আমিও ছুটতে থাকি আম বাগানের দিকে।

অবন্তিকা এলেই আমি ঝামেলায় পড়ি। সে বলবে, পার্কে গিয়ে বসতে। যদিও পার্কে কিছুই নেই। দুটো দোলনা দুলছে শিশুদের জন্য। এ বাদে একটিও গাছ নেই।

আমি তাকে আম বাগানের কথা বলি। মৌমাছিদের কথা বলি। সে বলে, আমি নাকি রূপকথা শোনাচ্ছি। রূপকথা যে নয় সে না গেলে কি করে বুঝবে। তাকে দেখাতেই পারি, মৌমাছিরা আমার কাঁধে উঠে নাচে। আমার হাতে উঠে নাচে। মনে হবে মৌমাছিদের নাচের সঙ্গে গানের সঙ্গে আম গাছ নেচে নেচে উঠছে।

অবন্তিকার কাছে নাচ মানে মানুষের নাচ। অবন্তিকার কাছে গান মানে মানুষের গান। সে তো আছেই। থাকবেও। তারপরও দেখতে হয়, মৌমাছিদের নাচ।

আম যখন থাকে না তখন মৌমাছিরা আমাকে বলে, জাম বাগানে চলো-----জাম রঙ দেখলেই ভালবাসতে ইচ্ছে করবে।

মৌমাছিদের সঙ্গে অপরাজিতার কাছেও গেছি।শিউলির কাছেও গেছি। আর অবন্তিকার সঙ্গে হোটেল রেস্তোরাঁ। অবন্তিকার সঙ্গে মেলায় মেলায়। চাপ চাপ
ভিড়ে।

মৌমাছিদের সঙ্গে নির্জনতায়।

মন যেখানে সুস্থ হয়। মন যেখানে প্রাকৃতিক হয়। মন যেখানে আলোকিত হয়ে ওঠে। এই কথা বলার পরেও অবন্তিকাকেও আমার চাই।

কখনো কখনো সেও আমার শুশ্রূষা। আম পল্লব মাথায় ছোঁয়ালে যে শুশ্রূষা আসে, সেইরকম শুশ্রূষা না হলেও মানবিক শুশ্রূষা বলতে পারি। যেমন আমার মাথা ধরেছে। অবন্তিকাকে ডাকতেই হবে। কিংবা  ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার টিকিটটা সেই মোবাইল থেকে কেটে দেবে। আমি তো প্রযুক্তির কিছুই বুঝি না এখনো। আমার কাছে মৌমাছির আলোবাসা।

মৌমাছিরা একদিন আমাকে বলেছিল আমাকে দেখাবে মৌচাক। আমি দেখেছি। আমি গন্ধ নিয়েছি মধুর। ওরা আমার বাড়ির জন্য মধু দিতে চেয়েছিল।

না, আমি নিইনি।

মৌচাকে মধু থাকুক। জীবন্ত হয়ে।

আজ আমবাগানে এসে আমি হতাশ। দেখতে পেলাম একটা মৌমাছির একটা ডানা ভাঙ্গা। কী করে ভাঙলো? কে ভাঙলো? কার কাছেই বা খোঁজ করবো? আমি মৌমাছিকে কাছে ডেকে জানতে চাইলাম, এই দুর্ঘটনা কি করে ঘটলো? সে চুপচাপ থাকে। সে যে যন্ত্রণা পাচ্ছে, আমি টের পাই। আমি দেখতে পাই, ভাঙ্গা ডানার একটি অংশ মাটিতে পড়ে আছে।

আমি হাতে নিয়ে ডানার সঙ্গে জোড়া লাগাতে চাই। জোড়া লাগে না। আমার কষ্ট হয়। মনে হয়, এ জীবনে কিছুই পারলাম না।

-----২৭ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৩---৮---২০২১
-----নির্মল হালদার





বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার



১.
হাঁসটাকে দিয়ে এসো জলে
গরুটাকে খুলে দাও
দুয়ারে দাও মাড়ুলি

ঘরটাকে ঘর বলবে
ছিরিছাঁদ আসবে
লক্ষ্মী আসবে তবেই

মানুষকে ছুঁয়ে থাকো
আত্মীয়তা পাবে
মনের টান

মনটাই তো আসল
মনটাকে জাগিয়ে রাখো
হৃদয় থেকে সাড়া পাবে

সাড়াশব্দ পাবে ঘর ও বাইরের।



২.
খুঁটে বাঁধা পান দোক্তা খুলে মা মুখে নিয়েছে। পান চিবোচ্ছে মা।
নইলে ঢুল আসবে।
মহাভারতের কথা শোনাই হবে না।

মহাভারত পড়ে শোনায় দত্ত বাড়ির মেজ বউ।

একটি কাকও ডাকছে না।

গ্রীষ্ম দুপুরের স্তব্ধতায় অভিমন্যু বধ হয়ে গেল।
মা--খুড়ির চোখে জল।

আমি ঘুমিয়ে পড়েছি মায়ের কোলে।


-----২১ শ্রাবণ ১৪২৮
----৭---৮---২০২১



৩.
এসেছি যখন দু'দণ্ড থেকে যাই

ঢালা--মাড় নাই বা দিলে
দুটো কথা দিও।
নুনের কথা না হোক গুড়ের কথা না হোক
শুকনো কথা দিও।

চোখের হাসি না হোক
দৃষ্টি তো দিবেই।
আসন না দাও দু'দণ্ড বসতে দাও
এসেছি যখন।

এসেছি যখন এক ঘটি জল চাইবো
চোখ মুখ ধুয়ে দেখতে চাই,
সজনে গাছ টা আছে তো?
কালো গাইটা?

আগের মতই কি পায়ে শব্দ ওঠেনা?
আগের মতই কি ঘুমাও বেশি?
চুড়ির ঝন ঝন শুনতে পাবো তো?
পড়তে পারবো তোমার মন?

মনের কোথায় ফুল ধরেছে না ফল
আমাকে না বলো,তবে বলতে দোষ নেই
তুমি কেমন আছো?


----২২ শ্রাবণ ১৪২৮
-----৮---৮---২০২১



৪.
কাঁখে কলসি টলমল করছে
মেঘ টলমল করছে
রাস্তা টলমল করছে

পায়ে কাঁটা ফুটলো।

ভেজা শাড়ি থেকে জল ঝরছে
নাকছাবিতে রোদের ঝিলিক
ভেজা চুল থেকেও জল ঝরছে

পায়ে কাঁটা ফুটলো।

কাছে আসছে ঘরের দুয়ার
ছেলের মুখ
রান্নাঘর

রাস্তার পরে রাস্তা খালি পা।



৫.
ধূলায় লুটালেও বাঁশি বাজে

বাঁশির ভিতরে আসা-যাওয়া করে হাওয়া

ধূলায় লুটালেও বাঁশি বাজবে আর
বাঁশির সুর ধরে ধরে
আমিও যাচ্ছি

আমি যাচ্ছি

চাষী বউয়ের কথার দিকে
ভুট্টা ক্ষেতের দিকে
অফলা জমির দিকে

আমি যাই

রাহেড়ের দানা বেড়ে উঠছে
বিরি শাক সবুজ হয়ে উঠছে
বর্ষার জলে ভরে উঠছে বাঁধ

আমি যাই

মেঘের ওড়না উড়ছে বালিকার বুকে।


-----২৩ শ্রাবণ ১৪২৮
----৯---৮---২০২১
----নির্মল হালদার



৬.
দেয়ালচিত্র আড়াল করে দেয়াল লিখন।

দেয়ালে হেলানো গরুর গাড়ির চাকা
ঘুন ধরেছে চাকাতেও।

আগাছা জন্মায়
বিনবিন করে পোকা

খড়ের চালা উড়ে যায়
ছাই উড়ছে ভাঙ্গা উনুনের

উইঢিবিতে কে ঢুকবে?

আমার দুয়ার নাই।



৭.
গাছের গায়ে আঁচড়
ফড়িংয়ের ছেঁড়া ডানা
গরু চলেছে একা একা

জমিতে পড়ে আছে হাল
কাকের মুখে রা নাই
আলপথ ভাঙাচোরা

নদী করছে ধু ধু
মাছের সংসার উৎখাত
বালি পাথরের হাঁ

কুকুরের শুকনো মুখ
মাঠে-ঘাটে গর্ত
সাপের খোলস

এই কথা বলতে দেরি হয়ে যায়।


-----২৪ শ্রাবণ ১৪২৮
----১০---৮---২০২১



৮.
ধীবরের জালে ছটপট করছে মাছ
আঁশটে গন্ধ
কোলাহল।

নদী আপন মনে চলেছে
নদীর জলে লাফায় ছেলে
একটা ডাক।

আখের ক্ষেতে ঢুকলো একটা লোক
আখের পাতায় ঝিলমিল
ধানগাছ মাথা কাঁপায়

উড়ছে কাশ ফুলের রেণু
বুনো লতায় নীল রঙের ফুল
কেন্নো হাঁটছে

আল কোপায় এক রমণী
যুবকের কোমরে হাঁসুয়া
বট গাছের ঝুরি

চকচকে শালপাতায় কে রাখবে অন্ন?



৯.
পড়লো একটা তাল
ধুলো উড়লো
ভাদুরে হাওয়া

চার্চের মাঠ
ভেড়া চরছে
ডোবার জলে শালুকের রঙ

পায়ে চলা পথে স্বর্ণলতা

পড়লো আরো একটা তাল
ছুটে গেল ছেলে
খাটাল থেকে দুধ দোওয়ার শব্দ

শালুক পাতায় রোদের কিরণ
ঘন্টা বাজছে
প্রার্থনা গান

চিরজীবীতের সুর।



১০.
তাল গাছের তলে রসের হাঁড়ি
মাছিরা উড়ছে।
তালপাতাও পড়ে আছে শুকনো।

থালা বাটি হাতে পুকুরে যায় বউ
পিছনে পিছনে কাঁদছে ছেলে
রাস্তায় খালডোব।

আস্তাকুড়ে মুরগির লাফালাফি
মুরগির ছানারা আহার খুঁজছে
খসে গেল মুরগির পালক।

আমি আসছি একটু দাঁড়াও


-----২৫ শ্রাবণ ১৪২৮
-----১১----৮----২০২১
----নির্মল হালদার






ছবি : আলোকচিত্রী সন্দীপ কুমার

পাহাড়ের গল্প / নির্মল হালদার

পাহাড়ের গল্প / নির্মল হালদার


রোজ পাহাড়ের কাছে সে এসে দাঁড়ায়। সকালবেলা। সে অর্থাৎ বাপি মনে করে পাহাড়টা তার আপনজন। তার দাদুও প্রতিদিন পাহাড়ের কাছে এসে পাহাড়ের দেখভাল করতো। যেন কেউ পাহাড়ের গায়ে আঘাত না করে। যেন পাহাড়ের গাছপালা পাহাড়েই অক্ষত থাকে।

দাদুর মত বাপিও পাহাড়ের কাছে এসে পাহাড়ের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে-----কেমন আছো? আর কোনো বন্ধু এসেছিল তোমার কাছে? আজ?
কী বলছিল?
বাপির মনে হয় পাহাড়টা নড়েচড়ে বলে-----আজ কেউ আসেনি। তবে কাল রাতে শিশির পড়েছে খুব। ঠান্ডা লাগছিল। বাপি তার কথার উত্তরে বলে------ দাঁড়াও দাঁড়াও আরো গাছ লাগাবো। তাহলে শিশির আটকানো যাবে। নিশ্চয়ই গাছ হবে তোমার গায়ে ।
আগেও তো হয়েছে। কিন্তু গাছপালা বেশি নেই বলে, শিশিরের ছ্যাঁকা লাগছে।

বাপি কখনো কখনো সন্ধের দিকে যায়। সন্ধের অন্ধকার পাহাড়কে আরো রহস্যময় করে তোলে। যেন ধ্যানী এক মহামানব। অথবা এক শক্তি। বাপির গা ছমছম করে। সে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে সাহস পায় না। তার মনে হয় , যদি ধ্যান ভেঙ্গে যায়? যদি ক্রোধের সৃষ্টি হয়? এবং ক্রোধ থেকে আগুনের সৃষ্টি হয়? ক্ষতি হয়ে যাবে চারপাশের।

বাপি  পাহাড়ের দিকে চেয়ে ঘরে ফিরে আসে। ঘুমোতে গিয়েও বাপির মন ছটফট করে পাহাড়ের জন্য।কেবলই মনে হয়, পাহাড়টা যদি ছোট হয়ে যায়? সেও ছোট হয়ে যাবে। পাহাড়টা যদি ছোট হয়ে যায়?আকাশটা ছোট হয়ে যাবে। একবার মাঝরাত্রে তার মনে হলো কেউ চুরি করতে এসেছে পাহাড়ের পাথর। সে ঘুম থেকে উঠে দৌড়োতে দৌড়েতে পাহাড় কোলে পৌঁছে যায়। কেন না, পাথর হলো পাহাড়ের হৃৎপিণ্ড।
পাথর হলো পাহাড়ের শরীর। পাহাড়ের মন।

এক একটা পাথর পাহাড়-শরীরের একেকটা অংশ। কোনো ভাবেই পাথর চুরি করতে দেওয়া হবে না। পাথর কাটা চলবে না।

পাহাড়ের গায়ে যত গাছ আছে পাহাড়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। পাহাড়ের নিঃশ্বাস গাছের গায়ে গায়ে বইতে থাকে। গাছের নিঃশ্বাস পাহাড়ের গায়ে গায়ে বইতে থাকে।

পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমলে পাহাড়কে আরও সুন্দর লাগে। গাছপালা হলো পাহাড়ের প্রেম। মেঘ হলো পাহাড়ের প্রেম।

বাপি লক্ষ্য করলো, ইদানিং পাহাড়কে খুব করুণ লাগছে। কারণটা সে বুঝতে না পেরে, পাহাড়ের চারদিকে ঘুরতে থাকে। তারপরেই চোখে পড়লো, পাহাড়ের পায়ের তলার দিকটা ছিন্নভিন্ন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লো। তার চিন্তা পাহাড়কে কীভাবে রক্ষা করবে?

যদি গ্রামের লোককে বলে, পাহাড় বাঁচাও, শুনবে কি? যদি  গ্রামের লোককে বলে-----পাহাড় আমাদের চৌদ্দপুরুষের। সবাই শুনবে কি?

সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে বাপি গ্রামের কোনো কোনো যুবককে তার ভয়ের কথা বলে। বিশেষ করে বাপির যারা বন্ধু। কথাগুলো শুনলেও কেউ কোনো
সমাধানের পথ বাৎলায়না। একজন তো বললো, পাহাড়টা আমার বাপের নয়। পাহাড়কে নিয়ে যে যা ইচ্ছে করুক গে।

বাপির মুখে বিষণ্ণ ছায়া।

সে এইবার কয়েকটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে পাহাড় তলে
পলাশ গাছ লাগাতে শুরু করলো। সে দিনে রাতে দেখতে চায় কারা আসছে পাহাড় ভাঙতে। এবং সে একা একা পাহাড় কোলেই রাত্রিবেলা ঘুমোয়। কারণ, বাপি পাহারায় থাকতে চায়।

সে একদিন স্বপ্নে দেখতে পেলো অনেক ট্রাক্টর এসেছে। অনেক লরি এসেছে। পাহাড় কাটার যন্ত্র
এসেছে। সে চিৎকার করেও কাউকে আটকাতে পারছে না। সে মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে পাহাড়ের নীচে শুয়ে পড়েছে। সে বলছেও-----আমাকে আগে মারো তারপর পাহাড়কে আঘাত করবে।

তার ঘুম ভেঙে গেল।

ঘুম ভাঙ্গা মাত্রই বাপি তার কাঁধে ওঠায় পাহাড়টাকে। তার আদরের পাহাড় ভালোবাসার পাহাড় তাদের ঘরেই থাকবে।


-----২৫ শ্রাবণ ১৪২৮
-----১১---৮---২০২১
-----নির্মল হালদার




মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১

আমার প্রথম কবিতার বই / নির্মল হালদার

আমার প্রথম কবিতার বই / নির্মল হালদার


তখন আমি আর সৈকত শহরে গ্রামে উড়ে বেড়াই। আমাদের পাগলপারা জীবন। তখন সারাদিন টই টই করছি। তখন সারাদিন কাব্য কবিতা। তখন রাস্তা থেকে শাদা কাগজ কুড়িয়ে কবিতা লিখছি। তখন মধ্যরাত্রির কালী মন্দিরে ঢুকে কবিতা পাঠ করছি।
মন্দিরে শুয়ে থাকা ঘুমিয়ে থাকা ভিখারিদের ঘুম ভেঙে যেতো। হয়তো বা আমাদের শাপ শাপান্ত করেছে। আমরা গ্রাহ্য করিনি। আমরা শুধু কবিতার ঘোরে কাটিয়ে গেছি আমাদের যৌবন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৮০ অনেকগুলো বছর আমাদের কবিতা পাগলামি কিংবা সাহিত্য পাগলামি রাস্তায় রাস্তায়। অন্ধকার গলিতে। চায়ের দোকানে। অযোধ্যা পাহাড়ে। মাঠার জঙ্গলে। ধারাবাহিক চলছেতো চলছেই।কোনো বিরাম নেই। সঙ্গে আছে আমাদের পত্রিকা "আমরা সত্তরের যীশু"। যা বাসে উঠে গান গাইতে গাইতে যাত্রীদের বিক্রি করেছি। যা তিন টাকা দাম, দশ টাকায় বিক্রি করেছি আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের। বিক্রি করেছি শহরের মোড়ে মোড়ে। গান গেয়ে গেয়ে। এবং স্ট্রীট কর্নারে কবিতা পড়েছি। কবিতার প্রদর্শনী আমাদের উদ্যোগে শহরের সদর রাস্তায়।

এইসব উন্মাদনার মাঝে হঠাৎ খেয়াল হয়েছে আমাদের দুজনেরই বই নেই। এবং বই করতে হলে টাকা লাগবে। টাকা নেই। ঘর থেকে তো বই প্রকাশ করার জন্য টাকা দেবে না।

দুজনেই নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। দুজনেই উড়ে বেড়াই। কোথাও কোনো অর্থের সংস্থান নেই। তো, সৈকত পরিকল্পনা করলো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের।

পুরুলিয়ার রবীন্দ্রভবনে তিনদিনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। তখন রবীন্দ্রভবনে চেয়ার ছিল না। সাউন্ড ছিল অত্যন্ত খারাপ। সৈকত কলকাতা থেকে সমস্ত আয়োজন করলো।

অফিসে অফিসে টিকিট বিক্রি করলাম আমরা। রিকশা নিয়ে প্রচার করলাম আমরা। তখন আমাদের শুভাকাঙ্খীরা আমাদের সহযোগিতা করেছিল খুব।

সেই প্রথম পুরুলিয়া শহরে ফিল্ম ফেষ্টিভ্যাল।
এইবার টিকিট বিক্রির লভ্যাংশ টাকা থেকে দেখলাম দুজনের বই হয়ে যাবে।

প্রকাশক কে হবে?

তখন আমাদের কাছের বন্ধু কবি বন্ধু সুজিত সরকার শোণপাংশু নামে একটি পত্রিকা করছে। তাকেই বললাম, প্রকাশক হতে।


আমি তখন কবিতা লিখেছি খুব অল্প। একটা চার ফর্মার বই হবে না। মনে পড়ছে, একদিন কালী মন্দিরে বসে আমি আর সৈকত দুজনে আমার কবিতার ঝাড়াই-বাছাই করলাম। দেখা গেল একটি দু ফর্মার বই হবে। তাই হোক। দুজন মিলেই ঠিক করলাম বইয়ের নামকরণ-----"অস্ত্রের নীরবতা"।

ছাপাছাপির কাজ কলকাতায়। মলাট এঁকে দিলেন কবি ও শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী। বইয়ের সব কাজ
দেখভাল করেছিল সৈকত নিজে। আমার কাব্য গ্রন্থের পাশাপাশি সৈকতের গল্পের বই "আরাম চেয়ার" প্রকাশিত হয়েছিল।

সেই তখন বই উদ্বোধনের এত আলো এত ক্যামেরা সুসজ্জিত মহল ছিল না। সৈকতের ইচ্ছে হলো
আমাদের বই উদ্বোধন হবে, শ্মশানে।

কলকাতা থেকে বই চলে এলো। বই উদ্বোধনের দিন স্থির হয়ে গেল। নির্দিষ্ট তারিখে কবি অশোক দত্ত কে সঙ্গে নিয়ে আমরা চললাম শ্মশানে। তখন আমরা কোনো নেশা করতাম না। রাতের আহার টুকু করে তিনজন শ্মশানের স্তব্ধতায় উন্মোচন করলাম আমাদের প্রথম বই। কবিতার পর কবিতা পড়া। গল্প পড়া। আলোচনা।

কে জানে আমাদের কবিতা পাঠ আমাদের আলোচনা মা কালী শুনতে পেয়েছিলেন কিনা। তবে বলতে পারি, আমাদের সেই উন্মাদনা আমরা রেখে এসেছিলাম শ্মশানের নিস্তব্ধতায়।

নতুন বইয়ের গন্ধ। আমাদের যৌবনের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের ভবিষ্যৎ সবই রেখে এসেছিলাম।

ভোরের আগেই অন্ধকার থাকতে-থাকতে সোজা কবি মুকুল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি----চা চাই।

এইতো আমাদের প্রথম বইয়ের গল্প। সেই যৌবনের দিন। সেই দিন রাত্রি সমান করে আমাদের পথ চলা। আর অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে কেবলই, কবিতা কবিতা।

তখন ভেতরে বাইরে আমাদের নান্দনিক সাজ। এখনও ভেতরে বাইরে আমাদের কাব্য উন্মাদনা।

-----২৪ শ্রাবণ ১৪২৮
-----১০---৮---২০২১
-----নির্মল হালদার





কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি














































































রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১

প্রিয় কবি নির্মল হালদারের জন্মদিনে


জন্মদিনের কথা / নির্মল হালদার
_______________________________________________


জন্মদিন এসেছিল। চলেও গেল।
আরতো মায়ের কোল নেই। এখন
ধুলোবালি মাখা ধরিত্রীর কোল। এখান থেকেই বলতে চাই, সেদিন
আমার তরুণ বন্ধুদের কাছে বলতে পারিনি, যে, আমি একজন
রক্তমাংসের মানুষ। দোষে-গুণে একজন মানুষ। আমাকে সেভাবেই সবাই দেখো। বিচার করো।
আমি আমার তরুণ বন্ধুদের চেয়ে বড় বলে আমি কোনো ভুল করতে পারি না, এমনটা নয়।
এখনো আমার ভেতরে প্রেম অপ্রেম, মান অভিমান, বিরহ এবং
ঈর্ষাও আছে।তা যত ক্ষুদ্র ই হোক
আছে। তাই আমার ভেতরে ক্রোধ আছে। রক্তচাপ আছে। এর ফলে,
আমিও উত্তেজিত হই। রেগে যাই।

প্রতি বছর জন্মদিন এলে, মনে মনে স্থির করি, মনের ভিতরে যা যা কুদোষ কু-সংস্কার আছে, এবছর থেকে কাটিয়ে উঠবো।

অনেক শান্ত হবো। ধীর।

অযথা ছটফটানি কাটিয়ে
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো। অথবা একটি গাছের রূপ কল্পনা করবো।
দেখি,
প্রায় একই রকম থেকে যাচ্ছি।
দেখি,
আমার অস্থিরতা কাটছে না।
দেখি,
দিনের-পর-দিন উদ্বেগ বাড়ছে।
অথচ হাত বাড়ালেই, কোনো না কোনো বন্ধু। বন্ধুর হাত।
আমার সহায়ক।

নির্ভরতাও কাটিয়ে উঠতে হবে।
যতই ঠিক করি নির্ভরতা এসে যায়। এবং নির্ভরতা যে ক্ষতিকর
এ জেনে-বুঝেও আমি যখন
কারোর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠি,
কোনো কিছুর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠি, তখন নিজের প্রতি রাগ হয়। আত্মগ্লানি হয়।
এ সমস্ত জানবেনা বুঝবেও না
আমার চারপাশ। আর কেনইবা বুঝবে? নিজেকে সংশোধন করতে করতে এগিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র কাজ।
তো, এ বছরের জন্মদিনে এই শ্রাবণ এসে আমাকে ভেজাতে ভেজাতে কতদূর নিয়ে যাবে, জানিনা। শুধু জানি, আকাশের মত উদার হয়ে প্রশস্ত হয়ে আমার চারপাশ দেখা দরকার।

এই জন্মদিনে এই অঙ্গীকার কি করলাম না?

চোখের জলে ধরিত্রীর কোল
ভেজাবার আগে আমি যেন
ভালোবাসায় ভিজতে পারি। যেন
ভালোবাসায় ভেজাতে পারি।


-----২৩ শ্রাবণ ১৪২৮
-----৯----৮---২০২১
-----নির্মল হালদার




কবি নির্মল নাকি একটি নির্মল কবিতা প্রবাহ...


তপন পাত্র



স্তন্যপায়ী মাত্রেরই দ্বিজত্ব আছে । একবার সে জন্মায় মাতৃগর্ভে আরেকবার এই বসুমাতার কোলে । ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষণটি দৃষ্টিগোচর কিন্তু গর্ভস্থ হওয়ার মুহূর্তটি অদেখাই থেকে যায় । এই দ্বিজত্বও মানুষের ক্ষেত্রে 'বাহ্য' । ক্ষণে ক্ষণে তার নবজন্ম এবং প্রায়শই তা ঘটে নিজের অগোচরে , অলক্ষ্যে । একটি খোলামকুচির ভুবন থেকে পরবর্তী সময়ে তিলে তিলে জন্ম নেয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কে হাতের তালুতে আনার বাসনা । তাই প্রতিমুহূর্তে মানুষের মৃত্যু , মানুষের নবজনম ।

                একটি তাল গাছ একটি খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি হঠাৎ কখন ঝরে পড়লো একটি ডাল , ওদিকে ততক্ষণে গজিয়ে উঠেছে অন্য একটি নতুন শাখা । বৃদ্ধির, উত্তরণের এই তো চিরচেনা জন্ম-মৃত্যু । একটি জীবন মানে অনেকগুলি জন্ম । বেশ কতকগুলো জন্মক্ষণ ।

           এত কথা কেন ? এত হেঁয়ালি কীসের ? সে কথাই খুলে বলি । এখন তো প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কানে আসে জন্মদিনের খবর । কিন্তু কারো জন্মদিনটা যখন অন্যদের কাছে পালনের প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে , একটা তাৎপর্য বাসা বাঁধে মনের নিভৃতে , তখন সেটাই হয়ে ওঠে প্রকৃত জন্ম-জয়ন্তী । ফি বছর আপনজনদের কাছে, প্রিয় মানুষজনের কাছে , কবি বন্ধু, পাঠক অনুরাগীদের কাছে কবি নির্মল হালদারের জন্মদিন একটি উদযাপনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে । অনাড়ম্বর আন্তরিক গানে, কবিতায় , গল্পে ,কথায় , হাসিতে-রসে , হাস্যরসে । একুশে শ্রাবণ বাংলার কবি নির্মল হালদারের শুভ জন্মদিন । কিন্তু আমি যতটুকু দেখেছি প্রতিদিনই তাঁর নবজন্ম । মনে প্রশ্ন জাগে -- তিনি কবি ,না কি নিজেই একটি আস্ত জীবন্ত কবিতা ? 

           সেই ছাতিমতলার বন্ধুসকল , সেই "ধান ও জলের ধ্বনি" থেকে শুরু করে অগণিত , অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের একটিও যত্ন করে সাজানো নেই নিজের পাঠগৃহে । বলা ভালো তাঁর গৃহের কোন শ্রেণীবিভাগই নেই , যেখানে লেখা , সেখানেই পাঠ , সেখানেই ক্ষুধার উৎপত্তি , সেখানেই ক্ষুধানিবৃত্তি , সেখানেই জাগরণ , সেখানেই আলস্যের আগমন , সেখানেই মাটিতে খেজুর পাতার তালাই বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়া । বই রাখার যেমন তাক নেই তেমনি নিজের বলতে সাড়ে তিন হাত রেখে দেওয়ার মতো একটা তক্তপোশের ওপর বিছানাও নেই । নেই কারণ তিনি চান না । এ এক মানুষের এক জীবনের মাঝেই অন্যতর নবজন্ম । 
       
           পুরস্কারের পর পুরস্কার , মানপত্রের পর মানপত্র .....একটিও কোথাও সাজিয়ে রাখা নেই । কিছুই সঞ্চয় করেন নি তিনি । যখন যার প্রতি ভালোবাসা উপচে পড়েছে, তখন সেই তার ঘর সংসারের মালিক , সেই তাঁর স্বত্বভোগি । এগুলি তাঁর জন্মদিনের কথা নয়, এগুলি তাঁর এক জন্মে নব নবজন্মের কথা । সারাবাংলায় , বহির্বাংলায় যতো বই বেরিয়েছে বিগত ৫০ বছরে, তার অনেকটাই সৌজন্য সংখ্যা হয়ে তাঁর হাতে এসে পৌঁছেছে । কিন্তু হাতে নেই একটিও । যে যখন সামনে , তার হাতে তুলে দিয়েই নিজের রিক্ত হাত পূর্ণ করেছেন । এ আর এক নবজন্ম । সম্মানে তাঁর বিশ্বাস নেই, ভালোবাসায় পূর্ণ আস্থা । ব্যথা আছে, বেদনা আছে, শূন্যতা আছে; কিন্তু গোমড়া মুখ নেই ! তাঁর প্রত্যেকটি ছবির দিকে তাকালেই দেখি তিনি হাসছেন । এ তাঁর জন্মদিনের কথা নয়, এক একটি নবজন্মের পরিচয় । প্রতিটি ক্ষণে যাঁর নব নব রূপে আত্মপ্রকাশ দৃষ্টিগোচর হয় , কেমন করে বুঝবো ঠিক কবে তাঁর জন্মদিন ! কত হলো তার তারুণ্যের বয়স !

           তিনি মহাদেবের মতো উদার । মহাদেবের মতো ভিখিরি । একের কাছে চেয়ে নেন, অন্যের হাতে তুলে দেন । যার কাছে নেন, তার সাথে আত্মীয়তা আর যাকে দেন তার সাথে কুটুম্বিতা । এ এক অদ্ভুত ঘটকালি , এ এক কাব্যময় মধ্যস্থতা । যাঁর প্রেমময় মধ্যস্থতায় কাঁকর থেকে হেঁটে আসেন কবি , মাটি থেকে উঠে আসে কবিতা । তাই তাঁর জন্মদিন বড়ো কথা নয়, ক্ষণে ক্ষণে তাঁর নব জন্ম --এটাই বড়ো কথা । তিনি কতো বড়ো কবি সে প্রশ্ন নিজেকে করি না , তাঁর গোটা জীবনটাই একটা আস্ত কবিতাপ্রবাহ --এটুকু স্থির বিশ্বাস রাখি ।




জন্মদিন আসলে একটা মিলনের দিন


কল্পোত্তম



অনিকেতের পক্ষ থেকে কবি নির্মল হালদারের জন্মদিন পালন করা হয়ে থাকে প্রায় প্রতিবছর। সেও এক সর্বাঙ্গীণ রঙিন উৎসবের মধ্য দিয়ে। নাচ, গান, কবিতা পাঠ, আলোচনাচক্র, আড্ডা, সবই হয়ে থাকে এই উৎসবে। বলতে গেলে সেটা হয়ে ওঠে অনিকেতের বন্ধুদের এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যদের মিলন উৎসব। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ফলে লকডাউনের সময় থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিলাম আমরা। বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না কবির সাথে একসঙ্গে মিলিত হওয়ার। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে সেই সুযোগটাই চলে এলো হঠাৎ করে। প্রায় সকলেই পৌঁছে গেলাম কবির বাড়ি। তারপর হৈ-হুল্লোড়।
           ৭ আগস্ট জন্মদিন, ৮ আগস্ট রোববার জড়ো হলো সবাই। ছুটির দিন। না আসার বাহানা নেই।
           কেক কাটার বিষয়টা ভারতীয় রীতিনীতির বাইরে হলেও আবেগ কোনো কিছুই মানে না। তাই কবির পছন্দের বাইরে গিয়েও ৮ আগস্ট সকাল থেকে পরপর কাটা হলো অনেকগুলো কেক। কখনও আলোকচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে তো কখনও কবি-সাহিত্যিক, নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে। ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই কবির।
             কবি শুধু হাসতে জানেন, ভাবতে জানেন, কাঁদতে জানেন। মনের মতো মানুষ পেলে ভালোবাসায় বাঁধতে জানেন। জানেন শুধু বিলিয়ে দিতে নিজের হৃদয় জনে জনে।
             সেই কবির জন্মদিনের বাহানা পেয়ে আমিও ছুটলাম চাষবাস ছেড়ে। একটাই তো দিন। কবির জন্মদিন। সেই দিনটার অপেক্ষায় অনায়াসে পেরিয়ে যায় একটা বছর। আমার বউ বলেছিল, দাদাকে একটা কিছু কিনে দিও। আমি বলেছিলাম, দূর-র-র, আমার দেওয়ার দরকার নেই। সে আবার বলেছিল, তুমি শুধু দাদার কাছ থেকে নিয়ে আসবে?
            আমি আর কিছুই বলিনি। বলার মতো কিছু ছিলও না।
             জন্মদিনের অনুষ্ঠান অনেকেরই হয়। কিন্তু যৌথতার ভাবনা নিয়ে জন্মদিন পালন খুব সম্ভবত হয় না। তথা কথিত সেলিব্রিটি বা বিখ্যাতদের জন্মদিনেও সম্ভবত একটাই কেক কাটা হয় সে যত বড় আকারেরই হোক। যত দামিই হোক। কিন্তু কবির জন্মদিনের মতো ভালোবাসার মানুষরা দলে দলে আসছেন, কেক কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন এমনটা সম্ভবত বিরল।
             এই বিরলতম জায়গাটা সারা জীবন ধরে অর্জন করেছেন কবি নির্মল হালদার, আমাদের কবি, অনিকেতের তরুছায়া।














































































































































কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ