১ লা বৈশাখ//
গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে যাবে।
এখানে এই বীরভূম জেলায় গ্রীষ্মকালে জলের স্তর অনেক নিচে চলে যায়। অভাব দেখা যায় জলের।
কুয়োতে জল থাকে না। শুকিয়ে যায় নদীনালা পুকুর। কাঁদরে কাঁদরে ধুলো ওড়ে।
আশ্রম এ যেটুকু জলের ব্যবস্থা আছে শুকিয়ে যায়। এ কারণেই
আশ্রম বিদ্যালয়ে ঘোষণা করা হয় ছুটি ।
গুরুদেব যখন ছিলেন তিনি এই ব্যবস্থা করে গেছেন।
ললিত আরো শুনেছে, গুরুদেবের জন্মদিন ১ লা বৈশাখেই পালন করার রীতি। যেহেতু আশ্রমের
ছেলেমেয়েরা গ্রীষ্মের ছুটিতে চলে যাবে বাড়ি এবং তারা না থাকলে
জন্মদিন টা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।
ললিতের মন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আশ্রমের অনেকেই আজ
চোত--সংক্রান্তির মেলা দেখতে গেছে গ্রামের দিকে। কথা ছিল
সেও যাবে। তার মনে পড়ে গেছে,
তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাকে একটা গান গাইতেই হবে
পল্লীর ক্লাবঘরে। সেই গানটা এখনো তুলতে পারেনি ললিত।
আজ রামময় দার হোস্টেলে গিয়ে
তুলে নিয়ে আসতে হবে গানটা।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ-----
এই গানে গ্রীষ্ম কে আহ্বান করা হচ্ছে। কিন্তু ললিতের গলায় সেই আন্তরিক সুর পাওয়া যাচ্ছে না।
বারবার তালিম নিয়েও কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে ললিত।
রামময় দার এই বক্তব্যের কাছে
আর কোনো কথা চলে না। তাকে
তালিম নিতে আজ বসতেই হবে।
কাল সকালে গুরুদেবের জন্মদিন হয়ে গেলে চলে যেতে হবে গ্রামের বাড়ি।
এই গানটা গাইতেই হবে। যদিও ললিতের ইচ্ছে ছিল ওই গানটা------
মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি
হে রাখাল , বেণু তব বাজাও একাকী।।
এই গানে মন খারাপ আছে। লুকানো এক কান্নাও আছে।
আর এই গানটাই করতে ইচ্ছে করে ললিতের।
গুরুদেবের জন্মদিনেও তার গান গাইবার কথা ছিল। সে কোনো ভাবে নানা অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে।
জন্মদিন অনুষ্ঠানে যাবে শুধু।
দূর থেকে দেখবে গুরুদেবের
ছবিতে ঝুলে আছে শুকনো মালা।
গাছে গাছে শুধু কচি কচি পাতার হিল্লোল। গুরুদেব কে অভিবাদন জানাবে।
গতবছরের একটা দৃশ্য মনে পড়ে ললিতের । জন্মদিনের অনুষ্ঠানে
এক বৃদ্ধা কাঁদছিলেন।
সেই কান্না দেখে ললিতের চোখ ভিজে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল তার, তার চোখের জল
গুরুদেবকেই সে উৎসর্গ করলো
নতুন বছরে। জন্মদিনে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলেমেয়েরা চলে যাবে বলেই, ২৫ শে বৈশাখের বদলে সবাইকে নিয়ে গুরুদেব পালন করতেন নিজের জন্মদিন।
কেমন ছিল সেই জন্মদিন?
ললিতের গলায় এসে পড়েছে
সেই গানটি----------
মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে
এই গানেওতো মন খারাপ।
গুরুদেবের গানে বিষণ্নতা ছাড়া কিছু কি নেই?
ললিতের গায়ে এসে পড়লো একটা দমকা হাওয়া।
------১৮ চৈত্র ১৪২৮
-----২---৩---২০২২
অঙ্কুরের মাটি//
বাবার হাতে ক্যামেরা দেখে ছেলের ঝোঁক-----তারও ক্যামেরা চাই।
ক্যামেরা যেন খেলার সামগ্রী।
ক্যামেরা না পেলে কেঁদে ওঠে ছেলে। ৭ বছরের ছেলের কাছে তাই ক্যামেরা হয়ে উঠল পুতুল।
খেলার পুতুল।
বাবা পলাশ ঘোষ আলোকচিত্রশিল্পী। ক্যামেরা নিয়ে হাটে ঘাটে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ান।
সঙ্গে ছেলেও যাবে।
বাবার কাছে ছেলের বায়না, সে দেখবে ক্যামেরা নিয়ে বাবা কি করেন। তার কাছে তো ক্যামেরা
খেলনা বৈ কিছু নয়।
কিন্তু ছেলে দেখতে পেলো, বাবার ক্যামেরায় ছবি আসছে।
ঘরবাড়ি গাছপালা নদী পুকুর পাহাড় মানুষ সমস্তই আসছে।
এওতো এক খেলা।
ছেলে আদিত্য। আদিত্য রঞ্জন ঘোষ সেই ছোট থেকেই ক্যামেরার নেশায়।
এবং তার ক্যামেরায় স্থির হয়ে পড়ে চলমান জীবনযাত্রা।
পুরুলিয়ার ভূপ্রকৃতি। তার বৈচিত্র্য। তার পরব---পার্বণ।
মানুষের "রিঝ"। সঙ্গে ধরা পড়ে
পুরুলিয়ার মাটি। রুক্ষতা।
এক ফসলি জমির চরিত্র।
এখানে এই ছবিগুলিতে পুরুলিয়ার পালা পার্বণ এবং পালা-পার্বণের রঙ। সাধারণ মানুষের উল্লাস ধরা পড়েছে।
আদিত্য যেন বলতে চায়-----
"সবকিছুতেই খেলনা হয়"।
যে খেলনাগুলি জীবনের অঙ্গ।
কান্না হাসির মতই জীবনের সঙ্গে।
ক্যামেরা নিয়ে খেলতে খেলতে
তার ক্যামেরা কথা বলে। নিঃশব্দ।
নিঃশব্দ--নীরব ভাষার সঙ্গে থাকতে থাকতে আদিত্য পনেরো বছরে এসে দাঁড়ালো।
আমি তার খেলার সঙ্গী হতে চেয়ে
বন্ধুতা করেছি তার ছবির সঙ্গে।
বন্ধুতা করতে পারবো?
সাপ যেমন পদ্মফুলকে জড়িয়ে
খেলা করতে চাইলেও খেলা করতে পারে না। কেবল পদ্মের ডাঁটি ধরে ধরে ঘুমিয়ে যায়।
আমিও আদিত্যর ছবির কাছে
তার ছবির আবেশে ঘুমিয়ে পড়ছি।
আমার এই ঘুম আসলে এক জাগরণ।
আমি শান্ত হয়ে একা একা
আদিত্যর শাদা কালো ও
রঙিন ছবির সঙ্গে থাকতে চেয়ে
আদিত্যকে দিলাম প্রতিদিনের আকাশ।
মাটিতো পেয়েছে সে।
ক্যামেরা তার কাছে যেমন পুতুল
তেমনি মাটিও। যে মাটি থেকে
সে সৃষ্টি করে অসংখ্য পুতুল।
নড়াচড়া করে পুতুল।
চুপচাপ থাকে পুতুল।
জেগেও ওঠে পুতুল।
আমি আদিত্যর পুতুলের গলায়
পরিয়ে দিলাম রামধনুর মালা।
-------২০ চৈত্র ১৪২৮
------৪-----৪----২০২২
কুঠিবাড়ি//
দময়ন্তী হোস্টেলে ফিরে এসেই
জ্বরে পড়লো। তার ঘরের বন্ধু বিশাখা বলে-----তুই আবার বাড়ি চলে যা। সারাদিন তোকে কে দেখবে?
আমিতো ক্লাস করতে চলে যাবো।
একা একা যদি যেতে না পারিস
আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
দময়ন্তীর বাড়ি তেঘরিয়ার কাছে।
বাস থেকে নেমে গরুর গাড়িতে যেতে হয়।
অথবা হেঁটে যাওয়া।
দময়ন্তীর বাবা চেয়ে ছিলেন
মেয়েকে যে কোনো কলেজে ভর্তি করতে। কিন্তু দময়ন্তীর মনের সাধ মেটাতে শেষ অবধি এইখানে।
গুরুদেবের আশ্রমে।
গুরুদেবের আশ্রম বীরভূম জেলাতে হলেও বীরভূমের ছেলেমেয়েরা যে খুব পড়তে আসে এমনটা নয়। দময়ন্তীর
ইচ্ছে পড়াশোনার পাশাপাশি
গান-বাজনা করবে। যা অন্য কোথাও নেই।
সে তো সঙ্গীত ভবনে যায়।
তার পড়াশোনার ক্ষতি হয় না কোনো। সে আশ্রমে এসে গুরুদেব কে পেয়েছে দু'বছর। গান করেছে গুরুদেবের কাছে।
গুরুদেবের প্রশংসা তার মাথায়
ধান দুর্বার মত। সে আজীবন বয়ে বেড়াবে ।
জ্বর টা আবার আসছে।
শীত করছে দময়ন্তীর। সে
খুঁজে পায় না কোনো চাদর।
একটা কাঁথাও ছিল তার।
সাবিনা তাকে উপহার দিয়েছিল।
কাঁথায় ছিল সাবিনার মায়ের
হাতের কাজ। দেখার মত।
কাঁথাটা কোথায় গেল?
সে দরজা খুলে খুঁজছে এক টুকরো রোদ।
শীতের দিন বেলা তিনটে বাজতে বাজতেই রোদ ফুরিয়ে যায়।
যেটুকু রোদ আছে আড়াল হয়ে গেছে গাছপালার জন্য।
ছাতিমতলার দিকে খেলা করছে
কয়েকটা চড়ুই।
ওরা কি দময়ন্তীর মা-বাবাকে বলে দিয়ে আসবে,
তার শরীর খারাপ।
আজ চণ্ডালিকা।
দময়ন্তীর কন্ঠে গান। কিন্তু কিভাবে গান করবে সে?
আমি চন্ডালী-----সে যে মিথ্যা
সে যে মিথ্যা।
সে যে দারুন মিথ্যা।
শ্রাবণের কালো যে মেঘ
তারে যদি নাম দাও চন্ডাল
তা বলে কি জাত ঘুচিবে তার,
অশুচি হবে কি তার জল।
কে গাইবে? কে গাইবে আজ?
দু'বছর এসেও দময়ন্তীর কুঠিবাড়ি দেখা হয়নি। সে ভেবেছিল অনুষ্ঠানের অনেক আগেই বিশাখার সঙ্গে চলে যাবে। ঘুরে ঘুরে দেখবে কুঠিবাড়ির ভেতর-বাহির।
কুঠিবাড়ি সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছিল রামানুজদা। দময়ন্তীর অবাক লাগে, রামানুজ দা ছাত্র হয়েও ঠাকুরবাড়ির অনেক গল্প জানে। অনেক তথ্য জানে।
মাথা যন্ত্রণা করছে তার ।
দময়ন্তীর শরীর খারাপের কথা
সঙ্গীত ভবনে পৌঁছে দিয়েছে বিশাখা। গুরুদেব একজনকে পাঠিয়ে ছিলেন দেখার জন্য।
কতটা শরীর খারাপ। গান করতে পারবে কিনা।
দময়ন্তী জানিয়ে দিয়েছে তার পক্ষে গান করা সম্ভব নয়।
তার গলায় কথাও আসছে না।
হোমিওপ্যাথিকের বড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন গুরুদেব। যদি সন্ধ্যে অবধি দময়ন্তীর শরীরটা ভালো হয়ে ওঠে। কেননা, গুরুদেব দময়ন্তীর বিকল্প হিসেবে আর কাউকে ভেবে রাখেননি।
দময়ন্তী মুষড়ে যায় । মনে মনে ।
তার মনের মধ্যে কেউ বাজিয়ে দিয়ে যায় ---------
জল দাও, জল দাও, জল দাও।।
------২২ চৈত্র ১৪২৮
-----৬-----৪----২০২২
------নির্মল হালদার
আরও পড়ুন

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন