মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ছাতিমের জ্বর হলে / নির্মল হালদার

ছাতিমের জ্বর হলে / নির্মল হালদার



পায়রাটা জানলায় এসে বসলো।
মনে হলো, আমাকে বলবে আজ,
চিঠি নেই তবে খবর আছে--------
ছাতিমের জ্বর হয়েছে।

ছাতিমের বয়স কতোই বা এই ২৭/২৮
এই বয়সে জ্বর হয় নাকি? ছাতিমের মতো তরুণের জ্বর হলে সারা পৃথিবীতে জ্বর আসবে। না না-------
পায়রাটা মনে হয় ভুল বলছে। কিংবা
আমি ভুল শুনছি।

পায়রাটাকে আমার সন্দেহ থেকে জিজ্ঞেস করি------- ঠিক বলছো তো,
ছাতিমের জ্বর হয়েছে? পায়রাটা এবার আমার কাঁধে এসে বসে পড়ে।
আমার কান কামড়ে বলে-------সত্যি গো সত্যি ছাতিমের জ্বর হয়েছে?

আমি তাকে বললাম------তাহলে চলো
তোমার সঙ্গে যাই তাকে দেখতে। পায়রাটা বললো, সঙ্গে বাসবদত্তাকে নাও-----ছাতিমের জ্বর ভালো হয়ে যাবে।

বাসবদত্তাকে কিভাবে পাবো? তার বাড়ি চিনি না। তার ফোন নাম্বার জানা নেই। একবার শুধু ছাতিমের সঙ্গে দেখেছিলাম তাকে।

আচ্ছা বাসবদত্তার বদলে চড়ুইকে নিয়ে যাই যদি? ছাতিম শুশ্রূষা পাবে না?

যে কোনো মেয়েই তো শুশ্রূষার একটা রূপ?

পায়রাটা আমাকে বলে-----অতশত চিন্তা করে লাভ নেই, তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে চলো।
আমি কিন্তু কিন্তু করি। বাসবদত্তাকে মনে পড়ছে শুধু। আমি পায়রাটাকে বললাম------বাসবদত্তাকে নিয়েই যাবো। চলো, আমরা তাকে খুঁজে বেড়াই।

আমি পায়রার পিঠে উঠে বসলাম।

উড়তে উড়তে দেখতে পাই অজস্র লোকজন রাস্তায় চলাফেরা করছে।
ছাদে ছাদে জামা-কাপড় মেলছে মেয়েরা। দেখতে পেলাম আরো একটি মেয়ে ছাদের এক কোনে চুল এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পায়রাকে বললাম-----চলো মেয়েটির কাছে। মেয়েটিকে বললাম, তুমি বাসবদত্তার মত দেখতে। তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে ছাতিমের কাছে। ছাতিমের জ্বর হয়েছে। তুমি গেলে তার জ্বর নেমে যাবে। 
মেয়েটি বললো, আমি যাবো না। কারুর ভূমিকায় আমার পক্ষে অভিনয় করা সম্ভব নয়। যদি যাই, আমি আমার নামেই যাবো।
আমি বললাম, তাই চলো। ছাতিমের জ্বর এই পৃথিবীতে মানায় না। তার জ্বর মানে প্রকৃতির জ্বর।

পায়রাকে বললাম, তুমি উড়তে উড়তে চলো। আমরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি।

রাস্তায় কোনো কথা নেই। মেয়েটি একবার শুধু আমার কাছে জানতে চেয়েছিল-----ছাতিম আমার কে?
আমি বললাম, আমার তরুণ বন্ধু।

হঠাৎ দেখি এক মনোহারি দোকানে
বাসবদত্তা। আমি এগিয়ে যাই তার দিকে। সে প্রথমে আমাকে চিনতে পারেনা। পরিচয় দিতে ছাতিমের কথা বলতে চিনতে পারলো। তারপর জিজ্ঞেস করে------কেমন আছি?

আমি তো সবসময় ভালো থাকি। আমার চারপাশটা শুধু খারাপ থাকে বলে আমি পীড়িত হই। আপাতত
ছাতিমের জ্বর হয়েছে। তুমি চলো তার কাছে। সে সুস্থ হয়ে উঠবে।
সেই মেয়েটি এবার আমাকে বলে-----
আপনি তো বাসবদত্তাকে পেয়ে গেছেন। আমি তাহলে চলে যাই।

দুজনকেই নিয়ে যাবো-------আমি বলি। তারপর বাসবদত্তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

বাসবদত্তা সমস্ত ঘটনা শুনে আমাকে বলে-------ছাতিমের জন্য এত কাণ্ড করছেন? সে তো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। শুনেছি। এখন যদি আপনাকে দেখে বলে-------আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।

সেই মেয়েটি বাসবদত্তাকে বলে, তুমি যাও ভাই। আমাকে আর টেনো না।
আমাকে দেখিয়ে আরো বলে--------
এই ভদ্রলোকের পাগলামি আমার সহ্য হচ্ছে না।
পায়রা বলে-------পাগলামির কিছু নেই। খুব স্বাভাবিক, একজনের জ্বর হয়েছে বলে আরেকজন অস্থির হয়ে গেছে। এই অস্থিরতাকে স্থির করতে
সবাই আসবে না। তোমাদের যখন পাওয়া গেছে, তোমরা চলো ছাতিমের কাছে। এসো -------আমার পিঠে তিনজনেই উঠে পড়ো।

ছাতিমের পাশে শুয়ে আছে আরেকজন। সেও ছাতিমের মত দেখতে। দুজনেই ঘুমোচ্ছে।


এবার কি করবো?

-----২৯ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৫-----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার





আনন্দ-বেদনা / নির্মল হালদার

আনন্দ-বেদনা / নির্মল হালদার








পাশের ঘরটা সব সময় বন্ধ থাকে।
সকালে একবার খুলে পরিষ্কার করে
বন্ধ করে দিই। সন্ধ্যেবেলা একবার খুলে ধুপ জ্বালাই। বাদবাকি সময়
ঘরটা বন্ধই থাকে।

হঠাৎ কখনো কোনো অতিথি এলে
শোওয়ার ব্যবস্থা করি। এছাড়া ঘরটাতে আমার কোনো কাজ থাকে না।
একেকদিন দরজা যেই খুলেছি,
মনে হয়, একটা নতুন ঘরে ঢুকছি।
সব অচেনা লাগে।

মনে আছে, একদিন ঘুমাবো ঠিক করলাম। শুয়ে পর খটমট করছে মন।
উঠে পড়লাম।

ঘরটার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ওঠা নামা হয়নি। তাই বুঝি, ঘরটার সঙ্গে
অভ্যস্ত হতে পারছি না।

এই ঘরটাতেই হঠাৎ করে খুঁজে পেলাম
আমার পুরনো স্মৃতি। যেমন, আমার মনে পড়লো --------কিছু পুরোনো কাগজপত্র বই বিক্রি করে ছিলাম স্কুলে পড়াকালীন। তো একটা বইয়ের মধ্যে লুকানো ছিল একটা চিঠি।

ক্লাস নাইনের প্রেমপত্র।

মনে পড়তেই, মেয়েটির মুখ মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই মনে
পড়লোনা।

আরেকদিন দরজা খুলতেই, সেই কুকুরটা। আমি তখন ক্লাস ফাইভ।
কুকুরটা আমার খুব ন্যাওটা ছিলো।
যেখানেই গেছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে।
সেই কুকুরটা হঠাৎ হারিয়ে গেল।
আমি মুষড়ে পড়েছিলাম।

সন্ধ্যেবেলা।
কি একটা খুঁজতে ঘরটা খুলেছি।
দেখতে পেলাম মায়ের লক্ষ্মীর হাঁড়ি।
সেই লক্ষ্মীর হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে
আমি পুরনো টাকা পয়সা এবং রূপোর টাকা বের করছি।

ঘুগনি খাবো বন্ধুদের নিয়ে।

আমার মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো।
মাকে মনে পড়ছে।
ঘরের আলো জ্বালাইনি। আলো জ্বালতেই কোথাও কিছু নেই। কেবল
দেয়ালে ছবি। আলমারিতে বই।

আমার একটা ভয় তৈরি হলো। যে
ভয় থেকে ঘরটা খোলার সাহস পাই না। কিন্তু দুবেলা খুলতেই হবে। এবং আমি ভয়ে ভয়েই ঘরটা খুলি।

কাল যেমন, সকালবেলা তালা চাবি খুলে ঘরে ঢুকছি , দেখি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে একজন। আমার শব্দ পেয়েই সে ঢাকা খুলে আমাকে বললো-------কেমন আছো হে?
আমি প্রদীপ রায়। চিনতে পারছো?

আমি থমকে দাঁড়াই।

কাল রাত্রে তো কেউ আসেনি?
আমিতো দরজা বন্ধ করেই, আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম। প্রদীপ রায় কিভাবে এলো?

প্রদীপ আমাকে চুপচাপ দেখে বলে,
তুমি ছিলে ক্লাস ফাইভ। আমি ছিলাম এক ক্লাস উপরে। মনে পড়ছে?

মনে পড়লেও মনে পড়ছে না,
কাল রাত্রে প্রদীপ কখন এলো আমার কাছে? মাঝরাত্রে কি? আমি কি তখন ঘুম ঘোরে ছিলাম?

এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব।

ভাবছি------ঘরটা আর রাখবো না।
স্মৃতিরা আমাকে ক্লান্ত করছে। আমাকে বিধ্বস্ত করছে।
ভাবছি-------ঘরটাকে তুলে ফাঁকা মাঠের মধ্যে রেখে আসবো।

আজ দুপুরবেলা কি একটা বইয়ের জন্য ঘর খুলেছি। একটা ঝোড়ো হাওয়া আমাকে ধাক্কা দিলো খুব জোর। আমি পড়ে যেতে যেতে দরজাটা ধরে ফেললাম।

বন্ধ ঘরে ঝোড়ো হাওয়া?

দেখতে পাই, একটা শাড়ি।
সারা ঘরে উড়ছে।
কার শাড়ি?

আমার মনে পড়লো, রসিকা এসেছিল একদিন। সেই বোধ হয় ভুল করে  শাড়িটা ফেলে গেছে।
কিন্তু আগে দেখতে পাইনি কেন?

ঘরটা আর খুলবো না।
ময়লা জমলে জমে উঠুক। যখন যেদিন অতিথি আসবে খুলবো।

দু' তিনদিন বন্ধ রাখার পরে
মনে পড়লো, ওই ঘরে টেবিল ফ্যান আছে। এই ঘরে নিয়ে আসা জরুরি।

ঘরটা খুলতেই দেখলাম, টেবিল ফ্যান নেই। একটা হাত পাখা পড়ে আছে মেঝেতে। সে বলে-------তুমি লম্ফর আলোতে বড় হয়ে উঠেছো।কোনো
ইলেকট্রিক লাইন ছিল না। তুমি আজ
টেবিল ফ্যান খুঁজছো?

 
এই সব স্মৃতি আমাকে আজ বিচলিত করে। স্মৃতিরা যে  সততই দুঃখ-বেদনার ঘরটা ঢুকলেই আমি টের পেয়ে যাচ্ছি।

না না ঘরটাকে আর রাখতে চাই না।

সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর
বাড়িতে এসে শুয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো, কে যেন ডাকছে আমাকে।

কে?
কে?

কোনো উত্তর নেই।

বাইরে যাই।
কেউ কোথাও নেই। চারদিক অন্ধকার।

আমার মন কি ভুল শুনেছে?

আজ ঘরটা খুলতেই হবে। একটা কলমের দরকার। এই ঘরেতো কাগজ-কলম কিছুই থাকে না। 

ঘর খুলে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। কোনো কারণে ইলেকট্রিক কানেকশন কাটা পড়েছে।

অন্ধকারেই আন্দাজে, আলমারি খুলে
ফেলি। হাৎড়াই, একটা কলমের জন্য।
না -----কলম পাই না। বদলে একটা ছোট কাগজের গোছা। বুঝতে পারছি না, কিসের গোছা।

ঘর থেকে বেরিয়ে এই ঘরে এসে দেখি
একটা নোটের বান্ডিল। সুতো দিয়ে বাঁধা। সঙ্গে একটা চিরকুট।
স্নেহের
গোরা 
তুমি আমার কাছে কোনোদিন কিছুই 
চাওনি। আমারও ক্ষমতা হয়নি তোমাকে কিছু দেবার। আজ
তোমার জন্য পাঁচ হাজার টাকা রেখে গেলাম তোমাকে না জানিয়ে।  কারণ,
আজকের দিনে পাঁচ হাজার টাকা কিছুই না। আর আমারও এর বেশি ক্ষমতা নেই। অথচ তোমাকে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।
তুমি খুশিমনে গ্রহণ করলে, আমার ভালো লাগবে।

ভালো থেকো।

আশীর্বাদক
তোমার বাবা


আমার বাবা কবে এসেছিল?
আজ মনে হচ্ছে, আমারও একটা বাবা ছিল। যিনি আমাকে  আশীর্বাদ করেছেন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে।
যা আমি গুপ্তধনের মত আজ পেয়ে
মনে করছি, আমারও একটা শিকড় আছে। এবং এই ঘরটাও একটা শিকড়।

------৩১ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৭-----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার



ছবি : কল্পোত্তম



মৎস্যকন্যা // নির্মল হালদার

মৎস্যকন্যা // নির্মল হালদার




একটা গল্পের খোঁজে এসে স্বাগত কে দেখতে পেলাম। সে পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। আমি জানতে চাইলাম, কি মাছ পেলে?
সে জানালো----একটাও মাছ পায়নি। বরং দেখতে পেয়েছে এক মৎস্যকন্যাকে। সে বারবার জল থেকে লাফ দিয়ে উঠছে। আর ডুবে যাচ্ছে।

স্বাগত আরও বললো------সে নাকি
কথা বলতে চাইছিল। মৎস্যকন্যা
কোনো কথা বলেনি। একবার ছিপের কাছে এসেও চলে গেছে। 

আমি স্বাগতর কাছে জানতে চাইলাম----মৎস্য কন্যার নামটাও জানতে পারলে না? সে বললো,
মৎস্যকন্যাদের কোনো নাম হয় না।
তারা শুধু মৎস্যকন্যা।
অপূর্ব সুন্দরী।

মৎস্যকন্যা একবার পদ্মপাতায় এসে শুয়ে ছিল। স্বাগত তখন ছিপ ফেলে চেষ্টা করেছিল কাছে যাওয়ার।

জলে শ্যাওলা খুব। যেতে পারেনি।

গল্পের খোঁজে এসে এই গল্প খুবই রহস্যময়। আমি ভাবছিলাম, মৎস্যকন্যা আছে যখন, তখন জলকন্যাও থাকবে নিশ্চয়ই।

আমি পুকুর ঘাটে বসে পড়লাম।
যদি একবার উঠে আসে জলকন্যা।
যদি একবার উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলে------চলো নৌকাবিহার করি।

জলদেবতা উঠে এসে আমাকে নিশ্চয়ই ধমক দেবেন । জলদেবতারা পছন্দ করেন না, মানুষ প্রজাতির সঙ্গে জলকন্যারা মেলামেশা করুক। কেননা, মানুষ প্রজাতি খুবই স্বার্থপর হয়।
এই স্বার্থপরতা মানুষকে অনেক নিচে নিয়ে গেছে। তাই, পুকুরের জল পুকুরে থাকেনা। নদীর জল নদীতে থাকেনা।

মানুষ জলের অপচয় করে।

আমি শেষমেষ উঠে পড়লাম। স্বাগতকে বললাম, যদি মৎস্য কন্যার সঙ্গে কথা বলতে পারো, তবে আমাকে জানিও। এবং কি কি কথা হলো, তাও জানাবে। আমি একটা গল্প লিখব।

এই গল্পের নায়ক হবে স্বাগত।

এখানেও জলদেবতারা যদি আপত্তি করেন, গল্পের নায়ক মানুষ হবে না। তাহলে, আমার গল্পটাও হবে না।

কারণ, মৎস্যকন্যা নায়িকা হলে
স্বাগত নায়ক হলে, স্বাগতর গা থেকে
আঁশটে গন্ধ ছড়াবে।

আমার প্রয়োজন আঁশটে গন্ধ।

যা পাঠক কে আকর্ষণ করবে খুব বেশি। পাঠক তো মূলত বাঙালি। যারা
মাছ ভালোবাসে।

মাছের সঙ্গে বাঙালির আজন্ম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে
মাছের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে।

মৎস্যকন্যা বাঙালির পাতে পাতে না এলেও বাঙালির মনে আসবে, তৃপ্তি দিতে আসবে, এই ইচ্ছে থেকেই আমার অনুরাগ-------মৎস্য কন্যার সঙ্গে স্বাগতর প্রেম।

পুকুর পাড়ে ঘুরতে ঘুরতে আরেক মাছ শিকারীর সঙ্গে দেখা হলো। কাছে যেতেই দেখতে পেলাম, শিকারি হচ্ছে আমাদের অতনু।
সে প্রতিদিন পুকুর থেকে মাছ ধরে।
মাছের সঙ্গে গল্প করে। আর মাছ ছেড়ে দেয় জলে আবার।
সে নিজে বলে--------সে শিকারি নয়।
সে প্রেমিক।

প্রেমিকার সঙ্গে কি কথা হয় কত দূরের কথা হয়, আমার কৌতুহল হলো। আমি জানতে চাইলাম। কিন্তু
অতনু বলে না। সে চুপচাপ থেকে
কেবল হেসে যায়। 

তার হাসি ধরে ধরে আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। দেখলাম, তার মাছ ধরা ছিপ বাঁশের নয়। শুধু রূপো।
এই কারণেই রূপো যে  রূপোর ঝলকে
মাছ উঠে আসে।

অতনু বলছিল, পৃথিবীতে সমস্ত স্ত্রীলিঙ্গ সোনারূপো পছন্দ করে। হয়তোবা সেও কোনোদিন তার ছিপে
সোনা লাগাবে।

আমাকে উঠে আসতেই হলো।

আমি তো সোনা--রূপোর গন্ধ চিনিনা।
শুধু মাটির গন্ধ চিনি। আমি গল্পের খোঁজে এসেও গল্প পেলাম না।

কোথাও যে মাটি নেই।

-------৩ আশ্বিন ১৪২৮
------২০----৯-----২০২১



ছবি : রেখা সহিস


ঘটনা দূর্ঘটনা / নির্মল হালদার

ঘটনা দূর্ঘটনা / নির্মল হালদার





ঋজুর হাত ভেঙেছে বাইক এক্সিডেন্ট করে। আপাতত সে ঘরবন্দি।
মনীষা তাকে বলছিল, একটা হাত এনে দেবে । অর্থাৎ ঋজু তিনটে হাত নিয়ে কাজ করবে।
ঋজু বললো, সে নিজের যন্ত্রণায় অস্থির। এখন রসিকতা ভালো লাগছে না তার।
মনীষা ঋজুর প্লাস্টার বাঁধা হাতে হাত রেখে বলে--------রাগ করিস না। মানুষ একটা হাতেও কাজ করতে পারে। প্রয়োজনে একটা হাত দশটা হাত হয়ে যেতে পারে।
আজ তুই বরং আমার সঙ্গে বাইরে চল্। তোকে আমি আমার বাইকে ঘুরিয়ে আনবো।

ঋজু রাজি হয় না। সে এখন বাইকে উঠতে ভয় করছে। যদিও তার ইচ্ছে করছে, মনীষার সান্নিধ্য।

এই মুহূর্তে দুহাত জড়িয়ে মনীষাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে ঋজুর। কিন্তু একটা হাত ভাঙ্গা। তার নিজের উপর রাগ হলো। এতদিন সে বাইক চালাচ্ছে কখনোই এক্সিডেন্ট করেনি।
সেদিন হঠাৎ -------------দুয়ারে সরকারের লাইন। একেবারে স্কুলের চৌহদ্দি পার হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ। সমস্ত ভিড় লক্ষীর ভান্ডারে। মেয়েদের লাইন।

ঋজু দেশ--গাঁ থেকে ফিরছিল শহরের বাড়িতে। এক মহিলা রাস্তা পার হয়ে আসছিল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না, মহিলা কোন্ দিকে যাবে। এবং মহিলা এসে পড়ে বাইকের সামনে।
ঋজু মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে বাইক থেকে নিজেই পড়ে যায়। এতটাই দূরে পড়ে যায়, যে  কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। মাথায় ভাগ্যিস হেলমেট ছিল।
বাঁ--হাতটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
তার যন্ত্রণা হচ্ছিলো। সে অবস্থায় সে দেখতে চেষ্টা করছিল, মহিলার কিছু হয়নি তো!

কিছু লোকজন দৌড়ে এসে ঋজুকে তুলে দেয়।তাদের মধ্যে একজন বলে,
খুব জোর বেঁচে গেছো ভাই। তখন কোনো গাড়ি আসেনি ভাগ্যের জোর।
নইলে কি যে হতো। তবে মহিলার কিছু হয়নি তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। এখন যাও হাসপাতলে।

গাড়ি তুলে শহরে যাওয়ার মত ঋজুর 
ক্ষমতা ছিল না। ঋজুর মতো এক যুবক ঋজুর গাড়িতেই হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। ছবি ও প্লাস্টার হয়ে গেলে
বাড়িতেও পৌঁছে দিয়ে যায়।

ঋজু মনে মনে দুয়ারে সরকার প্রকল্পকে গালাগাল করে। মনে মনে এও বলে------
দুয়ারে সরকার
ঘরে ঘরে বেকার।

মনীষার দিকে চেয়ে  ঋজু বলে, সত্যি সত্যি তুই যদি একটা হাত এনে দিতে
পারিস মন্দ হবে না। 
এমন তো হতেই পারে, ভাঙ্গা হাতটাকে খুলে মেরামত করলাম। তারপরে আবার লাগিয়ে নিয়ে কাজকর্ম করা। অথচ হাতটা হাতেই থাকবে। ভোগ করতে হবে যন্ত্রণা।

আজ ৭ দিন হয়ে গেল। বিরক্তি এসে গেছে--------এই বলে ঋজু ডান হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয় মনীষাকে। মনীষা তার ভাঙ্গা হাতটা কাছে নিয়ে
চুমু খেতে থাকে। ঋজুর মনে হয়
হাত থেকে ব্যথাটা আস্তে আস্তে নির্মূল হয়ে যাচ্ছে।  ঋজু মনীষার মাথায় চুম্বন রাখে।  সে কুয়াশা দেখতে পায়।
দেখতে পায়--------ঋজু মনীষাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। আর বিড়বিড় করে বলছে----------------
মনীষার ভালবাসা মাহুতের মত ছিল
উঁচু/মনীষার ভালবাসা মাহুতের মত উঁচু।
সে মনীষাকে যেন বা চার হাত দিয়ে
নিষ্পেষণ করে। যেন বা সে তার চার হাত দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় তুলে দিতেও পারে।

ঋজু সামনেই দেখতে পায় মস্ত এক পাহাড়। আলোয় আলোকিত।

-----৪ আশ্বিন ১৪২৮
----২১---৯---২০২১
-----নির্মল হালদার



নিঃশব্দ / নির্মল হালদার

নিঃশব্দ / নির্মল হালদার




বড় হাট থেকে ২ কেজি পটল। ২ কেজি টমেটো। ৩ কেজি কুঁদরি নিয়ে চক বাজারে বিক্রি করতে আসে বাসমতী মাহাতান।

বাসমতীর তিনটে বেটা।
সবাই আলাদা আলাদা খায়।
বাসমতীও আলাদা রান্না করে।
ভোর আঁধার থাকতেই সে উঠে পড়ে।
জোগাড় করে রান্নার।

প্রতিদিন বিকেলবেলা চকবাজার থেকে গিয়ে কাঠকুট সংগ্রহ করে রাখে। ভোরবেলা কাঠের আগুনে
ভাত চাপায়। সঙ্গে হয়তো দু-একটা আলু। অথবা সজনে শাক সিঝা
ভাতের সঙ্গে। 
তারপর হাঁটতে হাঁটতে শহরে আসে।

স্বামী নাই।

শরীর খারাপ হলে দেখার কেউ নাই।

সেবার অসুখে পড়েছিল। বেটারা উঁকি দিয়ে চলে গেছলো নিজের নিজের কাজে। গাঁয়ের এক মহিলা বাসমতীর অবস্থা দেখে টোটোতে নিয়ে গেছলো
সদর হাসপাতাল।

বলছিল আজকাল হাঁটতে কষ্ট হয়।
পা দুখায়।

গাঁ থেকে টোটো যায় শহরে। বাসমতী 
ভাড়ার ডরে গাড়িতে ওঠে না।
কে দিবেক ২০ টাকা! সবজি বিকে
রোজগার নাই।

বেশি পুঁজি হলে বেশি লাভ।

বাসমতীর পুঁজি নাই।
তিন তিনটা বেটার মত পুঁজি থাকতে
আর পুঁজি পাবে কোথায়?

চকবাজারে এসে কিছু কিনেও খেতে হয়। যে টুকু ভাত পেটে পড়ে  হেঁটে আসতে আসতে হজম হয়ে যায়। ঘরে ফিরে দুপুরবেলা আর কিছু খায় না 
বাসমতী। একেবারে সেই রাত্রিবেলা।

বলছিল-------সেদিন কে একজন
মুসুরির ভাল দিয়ে গেছলো। যেতে হয়েছিল পেট কোলে লুকিয়ে।বেটার
বউরা দেখলে কেড়ে লিবেক।

শহরে অনেকেই আছে, যারা গরিব-দুখিদের দান ধ্যান করে। তো কখনো কখনো বাসমতীও পুরনো সায়া--শাড়ি-ব্লাউজ পেয়ে থাকে।
সেও বউরা কেড়ে নিয়েছে।
তাদের অভাব নাই। কিন্তু শাশুড়ির সবকিছুতে ভাগ বসাবে। না দিলে গালমন্দ করবে। 

এই বাসমতী  সন্ধ্যা রাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে। কেন না সে ক্লান্ত থাকে খুব। পায়ে ব্যথা বেদনাও থাকে। যেহেতু সে ভোর আঁধারে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তাই ক্লান্তিতে বেশি রাত অব্দি জেগে থাকতে পারেনা। বয়সও হয়েছে।

বলছিল------
ঠান্ডা কালে এক মাড়োয়ারি চকবাজারের অনেক সবজিওয়ালিকে কম্বল দান করেছিল। সেই কম্বল পেয়ে বাসমতী খুব খুশি। জাড়টা কেটে যাবে। ছেঁড়া কাঁথা আর গায়ে জড়াতে হবে না।

বাসমতীর কপালে অত সুখ সইলো না। সে ঘুমিয়ে গেছলো। তার গা থেকে কম্বলটা তুলে মেজ বউটা লিয়ে পালালো।

আলাদা ঘরে শুলে কি হবে, বাসমতীর ঘরের কপাটে কোনো হুড়কা নাই। পরেরদিন মেজ বউ আবার বলে------ তোর ত কাঁথাকানি আছে--------কিসকে কম্বল লিবি? হামদের ছুটু ছুটু বেটা বিটি। হামদেরেই দরকার খুব।

বাসমতী মুখে কাপড় চাপা নিয়ে
নিঃশব্দে কাঁদে।

------৫ আশ্বিন ১৪২৮
-----২২----৯----২০২১
----নির্মল হালদার




ছবি : রেখা সহিস


নীরবতার কাছে // নির্মল হালদার

নীরবতার কাছে // নির্মল হালদার




নীল গল্প করছিল।
কার সঙ্গে গল্প করছে?
রঙ্গনের সঙ্গে।

সকালে উঠেই নীল দেখেছে, গাছে ফুটে আছে দু তিনটে রঙ্গন।
তার কি বাহার! এবং নীরবতা।

এই নীরবতার সঙ্গেই নীল গল্প করছে।

গল্পের বিষয় রঙ্গনের পাতা।

দেবী প্রতিমার চোখের মতো রঙ্গনের পাতা। হাত দিলেই টলমল করে উঠবে জল। 
চোখের জল।

এই জল নিবেদন করা যাবে না কোথাও। শুধু চোখেই থাকবে।
শুধু চেয়ে থাকতে হবে।

নীল গল্প করতে করতে অপরাজিতার কাছে যায়। এইতো সবে ফুটছে অপরাজিতার রঙ। এখন কথা বলা যাবে না। সে মাধবীলতার কাছে আসে।
গাছে অজস্র ফুল।

নিবেদিত হয়ে আছে আলোর কাছে।

নীল কোথায় নিবেদিত?

সে একবার রঙ্গিলার প্রেমে নিবেদিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু রঙ্গিলা বেশিদিন
থাকলো না। নীলের মনে হয়েছিল তখন, সম্পর্কে যে বিশ্বাস রাখতে হয়, রঙ্গিলা জানতো না।
আর প্রেম করলে যে, সমস্ত কিছুতেই অধিকার থাকবে,
এও সঠিক নয়।

আমরা অধিকারের ভুল প্রয়োগ করে থাকি-------একথা নীল বন্ধুদের বলে।
মা-বাবাকেও বলেছে।
তার বাবা কথায় কথায় বলে, তুমি জানোনা তোমার ওপর আমার সব অধিকার আছে। তুমি আমার সন্তান।

নীল তর্ক করেনা।

সে বরং বিছানাতে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

তার মায়ের কাজ শুধু ছেলেকে খাওয়ানো। সকাল থেকে রাত অবধি
কেবল বলবে---------খা খা। না খেলে কি হয়। না খেলে কি শরীরে পুষ্টি হয়?
যেনবা খাওয়ালেই, মায়ের অধিকার
ফলানো যাবে।

রঙ্গন মাধবীলতা অপরাজিতা টগর
শিউলি শালুকের কোনো অধিকারবোধ নেই। তাই তারা নীরবে থাকতে পারে। 
তাই তারা অধিকার প্রয়োগ করে না নীলের উপর।

নীলও সহজ স্বাচ্ছন্দে ওই ফুলেদের কাছে কথা বলতে পারে। খুব দুঃখ কষ্টের কথাও বলতে পারে। সকালবেলা চায়ের কথাও সে বলে।

বিশেষ করে যেদিন নীল ভোরে ওঠে
সেদিন সে  রংগন কে বলবেই, কি চা
খাওয়াবে নাকি?
রঙ্গন হাওয়ায় দুলতে দুলতে বলে-----
একটু দাঁড়াও-------চা আসছে।


নীলের মা ছাদের বাগানে চা নিয়ে আসে।

বাগান আর কতটুকু, ৭/৮টা ফুলের টব। নীলের কাছে সাধের বাগান।
কথা বলার বাগান। কি সকাল কি রাত্রি একবার না একবার নীল বাগানে আসবেই। 
সে দেখবে রঙ্গনের  নীরব ভাষা।

নীল দেখে  রঙ্গনের চোখের মতো পাতা। যা নিটোল। যা গভীর।যা সৌন্দর্যময়।

রঙ্গিলা চলে গেলেও নীলের মনে পড়ে। বিশেষ করে রঙ্গনের পাতা দেখলেই। কেননা, সে তো চোখের ছায়ায় ঘুমিয়ে ছিল অনেকদিন। রঙ্গিলার প্রতি আস্থা রেখেছিল বলে পথ হেঁটে ছিল অনেকটাই।

নীল নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর পায়না--------কেন পথ ভেঙ্গে যায়?
কেন পথ টুকরো টুকরো হয়ে যায়?
ভালোবাসা তবে কি?

ভালোবাসা যদি অপরাজিতার মত
মাধবীলতার মত টগরের মত শিউলির মত নীরব হতো?
কেমন হতো?
নিশ্চয়ই দেওয়া---নেওয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠতো না।

দেওয়া-নেওয়ার ভেতরে বিশ্বাস অবিশ্বাস। এবং সন্দেহ। যা সম্পর্ককে
তিক্ত করে। এই তিক্ততা অন্ধকার বৈ কিছু নয়।

নীল মাঝেমধ্যেই একা একা নিজের ঘরে প্রশ্ন করে-------অন্ধকার
এতো অন্ধকার কেন?

রঙ্গিলা সামনে এসে দাঁড়ালেও সে কথা বলে না। কারণ সে জানে
রঙ্গিলা আজ মিথ্যে।
সে জল খায়। ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। ঘুম আসে না। 

ফুলের কোনো অন্ধকার নেই।
নীল বাগানে যায়। সে  কথা বলে সবার সঙ্গে। মনে মনে শুশ্রূষা পায়।

শুশ্রূষা ফুলের। শুশ্রূষা গাছের।
পাতার। সৌরভের।
হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। নীল দেখতে পায়,মা এসে দাঁড়িয়েছে। তার পিঠে হাত রেখে জানতে চায়----------
কীরে ঘুম আসছেনা?
চল্ ঘুমোবি চল্---------আমি মাথায়
হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

নীল ঘুমোবে না।

সে মাকে ছেড়ে আরেক ছাদে চলে যায়। কথা বলতে চায়-----------তারাদের সঙ্গে।

নীরবতার সঙ্গে।

------৮ আশ্বিন ১৪২৮
-----২৫-----৯---২০২১




ছবি : রেখা সহিস

পরী কাহিনী // নির্মল হালদার

পরী কাহিনী // নির্মল হালদার




আজ লেখা নেই।

মেঝেতে কয়েকটা মুড়ির দানা পড়ে আছে। দেখতে ভালো লাগছে না।
আমি সবকটা মুড়ির দানা তুলে
অ্যাশট্রেতে তুলে রাখলাম।

আজ লেখা নেই।

ঘরের কোণে ঝুল লেগেছে। ঝেড়ে ফেললাম। টেবিলটা খাতা পত্র বইয়ে এলোমেলো হয়ে আছে। গুছিয়ে রাখলাম।
মনে হলো, গায়ের গেঞ্জিটা ময়লা লাগছে। খুলে ফেলে সাবান জলে ধুয়ে
রোদে মেলে দিলাম।
গেঞ্জিটা যদিও সকালেই পরেছি।

এখন কেন ময়লা লাগছিল জানিনা।

জানলার শিকে কালি লেগেছে।
দরজার কপাটেও ধুলো-ময়লা।
সব পরিষ্কার করে ফেললাম।
এবার ঘরটা ধুতে হবে।

জল ঢালছি। মেঝেয়।
দেখি, এক পরী এসেছে। সে বলে,
আমাকে ছেড়ে দাও আমি কাজটা করে দিচ্ছি।

অসময়ে পরী?

পরীদের সময় তো রাত্রে।এই বেলা
এসে আমাকে বলছে, তুমি বসো।
আমি আমার পাখা দিয়ে সমস্ত নোংরা
ঝেড়ে ফেলবো।


পরী কেন?

আমাকে সাহায্য করতে পারতো
আমার পিসি। কোথায় গেল পিসি?
পিসিকে বলিহারি! কাজের সময়
পাওয়া যায় না।
পরীকে কাজ করতে বললে অথবা
সে কাজ করলে, আমার মানহানি হবে।
আমি পরীকে বললাম--------------
তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না।
তুমি বরং আমাকে তোমাদের দেশের গল্প শোনাও।
পরী হাসে।
সে বলে, আমাদের দেশে কোনো কাজ নেই। তাই, এ দেশে এসে কাজ করতে আমার ভালোই লাগে। কাজের বিনিময়ে আমাকে এক বাটি মুড়ি খাইও।
মুড়ি তো আমাদের মতোই ফর্সা।
আমি এক ঝুড়ি নিয়েও যাবো সকলের জন্য। এই বলে, পরী ঘরের মধ্যে
উড়তে উড়তে কত যে ঝুলকালি পরিষ্কার করে ফেললো। কি বলবো আর।
তারপর সে আমাকে বলে------
চলো------তোমাকে আকাশটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। আমি বললাম------
আমার তো লেখার কাজ আছে। আজ
যেতে পারবো না। লেখা হচ্ছে না একদম। খুব কষ্টে আছি। লেখা হোক আগে। তারপর না হয় অন্য কোনোদিন আকাশ বেড়াতে যাবো।

পরী বলে-----এইতো আমি তোমার লেখার বিষয়। আমি গল্প বলছি শোনো--------যে গল্প তুমি লিখবে।
আমি আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করি, কি গল্প কি গল্প জলদি বলো?

সে বলে------

পরীরা সবাই পাখা খুলে রাখে।
এদেশে এলেই , পাখা লাগিয়ে নেয়।
একবার একদল পরী রাত্রিবেলায়
পাখা খুলে নদীতে স্নান করতে নেমেছিল। রাত চরা পাখির দল সেই পাখা তুলে উড়ে যায়।

সে এক বিষম ঝামেলা।
দেশে ফিরবে কি করে? অনেক কাকুতি-মিনতির পরে রাত চরা পাখির দল ফেরত দিয়েছিল পাখা।

আমি পরীর কাছে এই গল্প শুনে
খুব মজা পেলাম। আমি পরীর কাছে
হাত পেতে চাইলাম--------
আমাকে দুটো পাখা দাও। মাঝেমধ্যে
তোমাদের দেশে গিয়ে বিশ্রাম করবো।
আকাশেও অনেক জায়গা। সেখানেও
শোওয়ার জন্য যেতে পারি।

এদেশে তো শুধু ইট বালি সিমেন্ট।
মাটি নেই । আমার ঠাঁই নেই।
পরী বলে-------তোমরা কেন
আমাদের দেশে যাবে? আমরাই
চলে আসবো কখনো কখনো। তোমাদের গল্প শোনাবো। দেখবে,স্বস্তি পাবে তোমরা। 
এদেশে মাটি দেখতে না পেলেও মাটির গন্ধটা আছে। ও দেশে কেউ তো নেই।
না, ও দেশে যাবার দরকার নেই।
আমরা তো মাটির গন্ধ নিতেই এখানে আসি। এখানে কত রকমের মানুষ।
অজস্র ফুল ফল। এখানে বৈচিত্র অনেক। আমার দেশে পরী আর পরী।
পরীদের বন্ধন নেই। মানুষ বন্ধন নিয়েই সারাক্ষণ বাঁচে। এই বাঁচা আনন্দের বৈকি।

পরীকে কি আর বলবো।

আমি চুপচাপ হয়ে দেখলাম, পরী আমার ঘর থেকে উড়ে যাচ্ছে। আমি তাকে মুড়ি দিতে ভুলে গেলাম।


-------১০ আশ্বিন ১৪২৮
------২৭----৯----২০২১




ছবি : রেখা সহিস


সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার




৭১.
কাড়ার পিঠে কাক চলে যায়

ফাঁকা মাঠ
দূরে রেল ব্রিজ
ঝমঝম করে ট্রেন যায়।

গোবর কুড়ানির কাঁখে ঝুড়ি
আলপথে চোরকাঁটা
তাল পুকুরে জল নাই।

কাড়ার পিঠে কাক চলে যায়

নদী পারে পাখির বাসা
কুল গাছে লাক্ষার ফলন
পাতা ঝরা হাওয়া।

কাড়ার পিঠে কাক চলে যায়

রাস্তা উঁচু-নিচু খালডোব
কুঁদরি লতে শিশির শুকায়
ধান জমিতে সার ছড়াচ্ছে লোক।

কাড়ার পিঠে কাক চলে যায়

কোথায় যে যায় কার কাছে?




৭২.
গোবর জড়ো করছে
ধান জমিতে ফেলে আসবে।
ধানের ফলন বেশি হলে
খড় উঠবে ঘরের চালায়।

খড়ে লেগে থাকা একটি ধান
মহাকালের বীজ

আমাদের আলো-অন্ধকারে

নূপুর বাজায়।


------২৯ ভাদ্র ১৪২৮
------১৫-----৯----২০২১



৭৩.
খড়ে আর কি বাঁধবি
চোখের জলে বাঁধলে কঠিন হবে গিঁট।
খড়তো উড়ে--পুড়ে যায়

চোখের জলে আগুন লাগে না।



৭৪.
যাবি যদি বেগুন বাড়ির দিকে যা।
মরদের সঙ্গে দেখা না হলে,
বেগুন কাঁটাতো আছেই। সেও তো জানে
পিরিতের মর্ম। তোর আঙুলে ফুটে
তোকে দেখাবে তোর রক্ত।

তোর রক্তের উষ্ণতায় মুখ ডোবাবে

ভালোবাসার ভুখ।


------৩০ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৬----৯----২০২১



৭৫.
ঝিঙা ফুলের হলুদে কে ফুটলরে?

কোথায় জাত কোথায় কুল
কোথায় বা পিরিতের মূল
কে খুঁজবে?

ঝিঙা ফুলের হলুদ গড়িয়ে পড়ে মাটিতে

মাটির তো জাত নেই কূল নেই
মাটির শুধু মাটি
আমাকে ভাঙ্গে আমাকে গড়ে

আমিও ঝিঙা ফুলের কুঁড়ি



৭৬.
ছেঁড়া শাড়ি কত আর সেলাই করবে

আব্রুও থাকেনা।

সেজো বউ দু হাতে আড়াল করে শরীর।
আড়াল কি আর হয়, লোকে চেয়ে থাকে।
গাছপালাও চেয়ে রয়। জলে নামতে
লাজ লাগে, জল যদি টেনে ধরে শরীর?

সেজো বউ চেয়ে থাকে সূর্যের দিকে।


------৩১ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৭---৯----২০২১



৭৭.
আমার বাপের বাপকে আমি দেখি নাই।
সেই আমলের ছবিও নাই। শুধু
তার রেখে যাওয়া ভিটেমাটি দেখছি।
দেখতে দেখতে খুঁজছি শিকড়ের মুখ

পিতৃ পুরুষের আলো।



৭৮.
কাঁধের কুড়ুলটা ফেলে দিলে
কাঁধে আর ভার থাকবে না ।
মনেও ভার থাকবে না,
কোন্ গাছটা কাটবো, কে পুরনো হলো।

গাছ গাছের জায়গায় থাকুক।
যেতে হবেনা জ্বালানি কাঠ বিক্রি করতে।
আজ বরং মাদল বাজাতে বাজাতে
জিরিয়ে নাও

বাঁশিতে সুর জাগাবে কেউ।


-----১ আশ্বিন ১৪২৮
-----১৮----৯----২০২১



৭৯.
বাঁধের ঘাটে গা মাজছে বউ।
আরেক বউ হাঁড়ি--কড়াই মাজছে।
পাশের ঘাটেই মরদরা সাবান মাখে।
তেল মাখে।

আকাশ থেকে মুছে যায় মেঘের কালিমা।

শালুক পাতা ছলছলায়।

বাঁধের পাড়ে অর্জুন গাছে সবুজ ফল।

এক গলা জলে কুমারীর বুক ওঠানামা করে।

উড়তে উড়তে ডেকে উঠলো একটা পাখি।



৮০.
কে বলেছে তুই দরিদ্র?

এত বড় একটা আকাশ থাকতে
কে দরিদ্র? আর এইযে
প্রজাপতি ছুঁয়ে গেল তোকে
তুই--ও ধনী হয়ে উঠলি

তোর  ধন-সম্পদের কাছে আমি বাসা বাঁধবো।


------২ আশ্বিন ১৪২৮
-----১৯-----৯----২০২১



৮১.
বিহারী মাহাত বললো,আখ হয়েছে
আমাদের জমিতে। ক' টা আখ নিয়ে যাও দাদা।
আমি বললাম, আমি আখের কি বুঝি!
কেননা, আখের রস গভীর এক বিষয়।
না--পারবো পান করতে, না--পারবো ডুবতে।

আমি বরং আখ ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকবো
কবে আখের রস থেকে গুড়?

আমি মাছি হয়ে উড়বো গুড়ে গুড়ে।


----৫ আশ্বিন ১৪২৮
----২২---৯----২০২১



৮২.
খটখটে রোদের মতো মেজাজি
আমার বড়দা
আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলতোনা।
আমিও ভয়ে ভয়ে চেয়ে থেকেছি
দাদার দিকে, যদি ধমক দেয়!

আমি যে পড়াশোনা করতাম না।

দাদাকে কেউ বলেওনি, আমার ছিল
ধুলায় ধুলায় লেখাপড়া। দাদাও যেমন
লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে গেছে
নাটকের পর নাটক। যা আজও
মঞ্চস্থ হলো না।

দাদা আজও নাটক লেখে
আকাশের তারায় তারায়।
আমি দেখতে পাই, নাটকের
কুশীলব কারা। শুধু তাদের
সংলাপ শুনতে  পাইনা।


------৬ আশ্বিন ১৪২৮
-----২৩-----৯-----২০২১



৮৩.
রমণীর মাথায় ঘাসের বোঝা
আরেক রমণী গরু পাহারায়
নদীতে মাছ ধরছে ছেলে
ছোট গাছের পাতা টানছে ছাগল

হাঁসুয়া হাতে একটা লোক
কাশের রেণূ উড়ছে হাওয়ায়
আকাশের নীলে মেঘের স্তুপ
একদল ভেড়া।

আশ্বিনের ধানক্ষেতে বকের উড়াল
ধান ফুলে রোদের ঝলক
আলপথে একটা ছাতা যায়
বুয়ান ডালে কাজল লতা

পাহাড়ের আবছা মাথা
অনেক দূরে জঙ্গলের রেখা
বালুচরে পায়ের ছাপ
বালুচরে শ্যাওলা, পাতা পুতা

নদীতে ছোট ছোট ঢেউ

আমাদের ছোট নদী

ছোটবেলা।



৮৪.
নিভু নিভু লম্ফ। উনুনের আলো।

বেলুন চাকিতে ঘুরছে রুটির পৃথিবী।

মায়ের কপালে ঘাম।

আমার চাই একটা গরম রুটি।

স্নেহের--আগুন পোড়া রুটি।


------নির্মল হালদার
------৮ আশ্বিন ১৪২৮



৮৫.
আকন্দের ঝাড়
বুনো তুলসি
পিঁপড়ে তুলছে বালি
মৌমাছির গুঞ্জন

রোদের বেলা
নিম গাছের পাশে নিম গাছ
কাজের লোক রাস্তায়
কাক ডেকে উঠলো

সাইকেলে বালির বস্তা যায়
তাল তলে ভাঙ্গা হাঁড়ি
খোলামকুচি
কুকুরের সঙ্গে কুকুর

গরু ছাড়া হেলানো গাড়ি
দেওয়াল লিখন
পথের ধারে ধারে ঘর
মাটির পাঁচিল

খোলার চালে কাপড় শুকায়
সজনে গাছের পাতা ঝরে
হাঁস নামে ডোবায়
বাঁশের গোড়ায় গোবর

কী চাইছি আমি কার কাছে?



৮৬.
আমার আত্মীয় স্বজনরা
আমাকে তুলসির চারা এনে দেয় নি।
আমি শুধু তুলসি গাছের নামে ধূপ জ্বালাই।

ধূপের ক্ষীণ আগুনে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে
তুলসির ছায়া বুকে পুঁতে রাখি।


------৯ আশ্বিন ১৪২৮
-----২৬-----৯-----২০২১
-----নির্মল হালদার




মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দরিয়া / নির্মল হালদার

দরিয়া / নির্মল হালদার


দরিয়ার মনটা আজ অস্থির হয়ে আছে। কলেজে বিহু মনে করে একজনের পিঠে থাপ্পড় মেরেছিল।
সে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বলেছিল,
ঠিক আছে ঠিক আছে-------তুমি এখন ফোন নাম্বারটা দাও। পরে কথা বলবো।
দরিয়া ফোন নাম্বার দেয়নি।

এখন সে ভাবছে------দিলেই বা কি হতো। বড়জোর প্রেমের প্রস্তাব করতো।
করলেই বা কি ক্ষতি ছিল।
বিহুর সঙ্গে প্রেম থাকলে অন্য কারো সঙ্গে কি কথা বলা যায় না?
প্রেমের প্রস্তাব নানা জনের কাছ থেকে আসতে পারে। তা গ্রহণ করা বর্জন করা তার হাতেই তো আছে। আর
কথা বলতে তো দোষ নেই। বন্ধুত্ব করতে দোষ নেই। তবে কেন আজ
ওই ছেলেটিকে ফোন নাম্বার দিলো না?
কিসের ভয়? কেন ভয়?
বিহুকে সে কি ভয় পায়?

শালের পাশে শিমুল তো দাঁড়িয়ে থাকে।

ছেলেটিকে কলেজে আর দেখতে
পায়নি।কাল খুঁজতে হবে । এই ভেবে
দরিয়া ঘর থেকে বাজার দিকে চলে এলো। 

মফস্বল শহর। ছোট।

এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে দরিয়া
এক জুতোর দোকানে দেখতে পায়,
সেই ছেলেটিকে। মনে হচ্ছে, জুতো কিনছে সে।
দু'জনের চোখ পড়ে যায় দু'জনের উপরে। ছেলেটা দরিয়াকে দোকানের ভেতরে ডাকে। জানতে চায়, তুমি কি জুতো কিনবে?
দরিয়া "না" করে। তখন ছেলেটি বলে,
আমি যদি তোমাকে এক জোড়া জুতো
উপহার দিই?
দরিয়া "না"করে আবার। সে বলে,
আমি বরং তোমার জুতো পছন্দ করে দিতে পারি। তুমি যদি চাও।
ছেলেটি বলে, অবশ্যই। মেয়েদের পছন্দ মন্দ হয় না।  তারপরেই ছেলেটি বলে, আমরা কিন্তু কেউ কারোর নাম জানি না। জানতেও চাই না। আমি তোমাকে ইমলি বলবো। তুমি আমাকে কি বলবে, তুমি ঠিক করো। 
দরিয়া বলে, তোমাকে আমি ভোঁদড় 
বলবো। রাজি তো?
ছেলেটি বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ। যে কোন একটা নাম। ছেলেটি কিংবা ভোঁদড় মনে করিয়ে দেয়,ইমলি জুতো পছন্দ করে দেবে।

ইমলির পছন্দ হয়না। সে  অন্য দোকানে যেতে বলে। সেখানেও
একই অবস্থা। ভোঁদড় বলে, আজ বাদ দাও। কাল আবার আসবো। জুতোর নামে দু'জনের দেখা হবে।
খুব ভালো না?
দরিয়া কিছু না বলে, হাসে শুধু। 

ভোঁদড়  ইমলিকে বলে, কলেজে
ফোন নাম্বার চেয়েছিলাম। পাইনি।
এবার কি দেবে?
ইমলি বা দরিয়া এবার বলে, ফোন নাম্বার যখন দিইনি, আর দেবো না।
আমাদের দেখা হবেই হাটে বাজারে।
কলেজ তো আছেই।
এবার ভোঁদড়ের কথা------হঠাৎ করে
রাত্রিবেলায় কথা বলতে ইচ্ছে করলে?
দরিয়ার কথা------ইচ্ছে করলেও দমন করবে। দেখো না, মনের কী অবস্থা হয়। দেখো না, মনকে তুমি বাঁধতে পারছো কিনা।

দু'জন  দু দিকে চলে যায়।

দরিয়া আবার ভাবতে শুরু করে, দেখা হওয়ার পরও কেন সে ফোন নাম্বার দিলো না? তবে কি সে বিহু বাদ দিয়ে
অন্য কোনো ছেলেকে ভয় পায়? কিসের ভয়? সব ছেলেই কি আলাপের পর পরই আক্রমণ করে?
শারীরিক আক্রমণ?

সে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয়।
নিজেকে সংকীর্ণ মনে করে। সে মনে মনে বলেও--------একটি ছেলে যেমন মানুষ, তেমনি একটি মেয়েও মানুষ।
মানুষ মানুষকে আক্রমন করবে কেন?
কাল কলেজে দেখা হলেই ফোন নম্বরটা দিয়ে দেবে।

সে ঘরে ঢুকেও আনমনা হয়ে গেল।

চুল খুলতে খুলতে আয়নার মধ্যে দেখতে পায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।
সে ছেলেটির মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলে-------এই নাও আমার ফোন নাম্বার।

দরিয়া লিপস্টিক দিয়ে আয়নার মধ্যে লিখে দেয় নিজের ফোন নাম্বার-------
৬৯০৪৩১২২৫২।


----২৭ ভাদ্র ১৪২৮
----১৩----৯---২০২১






পানকৌড়ির ডুব



৫৩.
ছেঁড়া শাড়ির পাড় থেকে সুতো টেনে
ছুঁচের ফাঁকে সুতো পার করে সন্ধ্যা পারুল।
বুনন করবে চটের আসন।

কুটুম এলে বসতে দিবে।

তুলিন--বেগুনকোঁদর থেকে বরপক্ষ আসবে
মেয়ে দেখতেও। দু বোন সাবধানী তাই,
আঙুলে যেন না--ফোটে ছুঁচ।


৫৪.
গ্রাম থেকে এসেছে চাল

মহাজনের জন্য মেপে দিলে
মজুরি পাবে দু চার আনা পয়সা।
ছেলেরও আবদার মেটাবে
ময়রা দোকানে দু পয়সার নিমকি--বোঁদে।


-----১৬ ভাদ্র ১৪২৮
----২---৯---২০২১


৫৫.
পুকুরঘাটে নেমেছে মেয়েরা স্নান করতে

ফুটে ওঠা লাল শালুক লাজুক বৌয়ের মত
কথা বলছে মেয়েদের সঙ্গে।
মেয়েরা সাত জন্মের ননদিনী, হাসাহাসিও করে।

হাসি ও কথার ফাঁকে সাবান পিছলে পিছলে যায়।

হাঁসগুলি করে জলকেলি।



৫৬.
গাঁ থেকে শহরে এসেছে গরুর গাড়ি।
দোকানদারের মাল যাবে গাড়িতে। এখন
গরু দুটি খড় চিবোয়।বিড়ি টানে গাড়োয়ান।


আশ্বিনের আকাশ।

নির্মল বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ।
অপরাজিতার রঙ টলমল করে। শালুক ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন।

দোকানের মালপত্তর কেনার ফাঁকে
দোকানদার বৌয়ের জন্য কিনে ফেলে
আলতা সিঁদুর শাড়ি।


-----১৭ ভাদ্র ১৪২৮
-----৩----৯----২০২১


৫৭.
ক টা সিঁড়ি উঠে এলাম
মনে নেই রে ভাই।
মনে আছে, কতটা বয়স
পার হয়ে এলাম। এবার
কাঁধের হাল কাঁধে থাকবে তো?

সংসার তো চলছেই না।

রান্নার তেলটা পেলেও
লম্ফ জ্বালতে তেল নাই, গমটা পেলেও
চাল নাই। জলের হাঁড়ি
শুধু ছেঁদা হয়ে যায়। এবার
কাঁধটাও যে ভারি লাগছে ভাই।

কার ভরসায় কাঁধের ভার মাটিতে নামাই?



৫৮.
ভাদরের রোদে
গাছেই সেদ্ধ হয়ে যায়
জনারের দানা।
রোদের যা তেজ
ধানের গোড়াও ফেটে যায়।

বাঈদ জমিতে জল ছিটতে হয়

পোকা লাগে ধান গাছে
আগাছার জন্ম হয়
ঘরে চালের অভাব
ঘাস বিকতে চলে যায় বউ।


-----১৮ ভাদ্র ১৪২৮
-----৪---৯---২০২১


৫৯.
বর্ষা আসছে বউ
ঘুঁটে--কয়লা তুলে রাখ।
দেখেছিস তো, আমাদের ঘরে জল
বাইরে জল, জলে জলে জলময় হয়ে ওঠে
আমাদের ঘর উঠান।

ঘুঁটে --কয়লা তুলে রাখ
আগুনটা তো জ্বালতে হবে
ছেলেপিলেদের নিয়ে বাঁচতে হবে।

মাথায় তো আর কড়িকাঠ নেই যে
গুঁজে দিবি উনানে।ৄ্



৬০.
তুই আর আয়না দেখিস না
তোর রূপের কাছে দাঁড়ালে রোদ ঝলকায়।
তোর মুখের কাছে দাঁড়ালে
প্রজাপতি মুখ দেখে।

আমাকে দেখ তুই, আমি কেমন শুকিয়ে শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেলাম, যে দড়ি
বাঁধতে পারেনা পিরিতির ছলাকলা,যে দড়ি
বিনা আগুনেই জ্বলে উঠবে

তারপরেই তো অন্ধকার।


-----২০ ভাদ্র ১৪২৮
-----৬---৯---২০২১


৬১.
সংসার তো আর দুধ জলের নয় যে
জলটাকে বাদ দিয়ে দেবো! সংসার ভাসছে শুধু
জলে জলে। থালাটাও নেই যে ভিক্ষে করবো,
থালাটাও ভাসছে জলে জলে।

বাটিটাও ডুবে গেছে।

ঋণ ধারে আমিও ডুবে আছি। ডুবতে ডুবতে
আকাশের তারা আর দেখতে পাবো না।



৬২.
মহুলের রস কপালে আর নাই

দেনার দায়ে গাছটাকে বিকতে হয়েছে।
মনে হয়, গাঁইতি--কোদালও ওজন দরে
বিক্রি করতে হবে। কাজও নাই
শহরে বাজারে।

ফুল ফলের আশায়, যদি পায়ের তলার মাটিতে
গাছ লাগাই, আমি দাঁড়াবো কোথায়?


-----২১ ভাদ্র ১৪২৮
-----৭----৯---২০২১



৬৩.
সূর্য গেল পাটে

গাছে গাছে গোধূলির আলো
মায়াবী নির্জনতা
ঘরে ফিরছে পাখিরা।

পাকা ফসলের গন্ধ
ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি
ঘাসে ঘাসে হাওয়া

মাঠের পরে মাঠ
তাল খেজুরের গাছ
গরুর গাড়ির মন্থরতা।

বাবার কাঁধে ছেলে মেলা থেকে ফিরছে
বাবার কাঁধে ছেলে ঝুমঝুমি বাজায়।



৬৪.
আমি যতই ছোটখাটো হই শরীরে তাকত আছে।
আমি কাম--কাজেও দড়।

একদিনেই দশ চৌকা মাটি কাটতে পারি।

আমাকে কাজ দিয়ে দেখো, আমার শরীরের ঘাম
কথা বলবে।


-----২২ ভাদ্র ১৪২৮
----৮----৯----২০২১



৬৫.
শিল--নোড়ার শব্দ হলে
হলুদ মশলার গন্ধ পাই।
বঁটিতে সবজি কাটার শব্দ হলে
বঁটির ধার দেখতে পাই।

যে যার কাজ করতে করতে ঘরের রোশনাই।

ও বউ, হাতা খুন্তিও আমাদের আত্মীয়।



৬৬.
বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে।

আকাশ মন মরা
মাটিও ধূসর
হাওয়া নেই কোথাও

বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে

আবছা গাছপালা
পাখিদের আসা-যাওয়া নেই
আবছা রোদের আলো

বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে

ফুল ফলের রঙ ফিকে হয়ে আসছে
ধুলোবালির স্তব্ধতা
নদীও থেমে পড়ছে কোথাও

বাবার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে মেয়ে

বাবা ও মেয়ে
মেয়ে ও বাবা

একা।

বটের ঝুরি নামছে।


-----২৪ ভাদ্র ১৪২৮
-----১০---৯---২০২১



৬৭.
কিসের মাগো তুই
ছ মাসের শিশুকে মাড় দিচ্ছিস?
বুকে যদি দুধ নাই, যদি গরুর দুধ কেনার
পয়সা নাই, ছাগল মাকে খুঁজে দেখ,
দাঁড়িয়ে আছে কোথাও

দাঁড়িয়ে আছে তোর ছানাকে দুধ দেবে।



৬৮.
সন্ধ্যা হলো গো প্রদীপটা জ্বালাও।
পূর্বপুরুষকে আলো দেখাও।
আলোর পথ ধরেই,
পিতৃ কুল মাতৃ কুল এসে দাঁড়াবে।

কেউ এক আঁজলা জল চাইলে দাও।
কেউ শিশির জল চাইলে দিও।
তৃষ্ণার কাছে আলো জ্বালালে
শান্ত হয়ে ওঠে এই জন্ম গত জন্ম।

দুধের মত আলো মাটিতেও বইবে।


-----২৭ ভাদ্র ১৪২৮
-----১৩----৯----২০২১



৬৯.
তুই চাইলে,
ছেঁদা কলসিতে জল আসবে।
তুই চাইলে,
আগুন ছাড়াই রান্না।

তুই আয়লো

আমাকে দুমুঠো না -দে
হাঁস--মুরগিকে দে।
সারাদিন ওরা লাফালাফি করছে।
সারাদিন ওরা আমাদের কাছেই।

তুই আয়লো

তোর দু হাতেই তো আমার বেড়।



৭০.
গরুটাকে জল দেখালে?

আমি না হয় খুঁজে খাবো
গরুটাতো আর খুঁজবেনা।
না চাইলেও
ঘরের গাছটাকে যেমন জল দাও
তেমনি
ঘরের গরুটাকেও জল দেখাও

জলের জীবনেইতো যোগ হয়
আরো অনেক জীবন। জলের জীবনেই,

প্রাণের স্পন্দন।


-----২৮ ভাদ্র ১৪২৮
----১৪----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার







শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

হোয়াটসঅ্যাপ / নির্মল হালদার

হোয়াটসঅ্যাপ / নির্মল হালদার




আমি কি মহিলার কাছে জানতে চাইবো, আপনি কী ফুল পছন্দ করেন? আমি কি জানতে চাইবো,
কী রঙ আপনার প্রিয়?

না না,কোনো কিছুই জানতে চাইবো না। চুপচাপ থাকাই সহজ উপায়। ঘনিষ্ঠ হলেই যত বিপদ।

মহিলা আমার কাছে আমার ফোন নাম্বার চেয়েছিলেন------আমাকে ফোন করবেন। আমি ফোন নাম্বার দিইনি। যদি মহিলার কাছাকাছি চলে আসি, ঝামেলায় পড়তে পারি। জটিলতায় পড়তে পারি। এই ভয়ে 
আমি মহিলার নাম জানতে চাইনি।
শুধুমাত্র হোয়াটসঅ্যাপে সুপ্রভাত শুভ রাত্রি। এর বাইরে যেতে চাই না। খামোকা বিপদ ডেকে আনার দরকার কি? মহিলা যেখানে আছে থাক। আমিও যেখানে আছি থাকবো। বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া ঠিক কাজ হবে না।

মহিলা আমাকে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্র নাথের গান পাঠিয়ে থাকেন। আমি শুধু পরিবর্তে ধন্যবাদ পাঠাই। বেশি কথা বললে যদি জড়িয়ে পড়ি, যদি
কাছাকাছি চলে আসি, আমার খুব ভয় করে।

আমার স্ত্রী ছাড়া আমার জীবনে ঘনিষ্ঠ
কোনো মহিলা নেই। মা ছিল একসময়। গত হয়েছে অনেককাল আগে। তা বাদে পাড়া-প্রতিবেশী মহিলাদের সঙ্গে আমি তেমন কথাই বলি না।
আমার কেবলই ভয় করে। পাছে
কারো সঙ্গে জড়িয়ে--মড়িয়ে উঠি।
কী হবে তখন?
আমার দুটি ছেলে মেয়ে। তারা স্কুলে যায়। তারা আমার কাছে ছুটে আসে
বাবা বাবা করে। তাদের আমি কোনো
কারণে উপেক্ষা করতে পারবো না।

মহিলা একদিন হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কটার সময় ঘুম থেকে উঠি। কটার সময় ঘুমোতে যাই।
আমি উত্তর দিলাম না। উত্তর দিলে
যদি নৈকট্য বাড়ে? যদি কাছাকাছি চলে আসি?
এই কাছাকাছিকে আমি খুব ডরাই।

একদিন ভাবছিলাম, হোয়াটসঅ্যাপে
সুপ্রভাত জানাবো না। শুভরাত্রি
জানাবো না। কী দরকার? সম্পর্ক বজায় রাখা, কী দরকার? সম্পর্ক মানেই তো ভালোবাসা। সম্পর্ক মানেই তো সহানুভূতি। সম্পর্ক মানেই তো আদান-প্রদান।

কী দরকার?

মহিলা দূরে আছে দূরে থাকুক।

তিনি যতই লিখুন, আজকের দিনটা খুব ব্যস্ততায় কাটলো। অথবা তিনি যতই লিখুন, আমার মন খারাপ করছে।
আমি উত্তর করবো না। কথা বাড়তে বাড়তে অনেক কথা। বেড়ে যাবে স্বাভাবিক নিয়মে। আমি কোনো দিক থেকেই এগিয়ে যাব না।

আমি যেমন দশটা পাঁচটা অফিস করি, আমি যেমন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে সংসার করি, করে যাব। নতুন কোনো সম্পর্কে নিজেকে জড়াবো না আর।

মহিলার কি উদ্দেশ্য আমিতো জানিনা। মহিলা কি চাইছে আমার জানা নেই। এমনকি মহিলাকে এখনো দেখিনি আমি। হঠাৎ যদি আজ বাদ
কাল দেখতে ইচ্ছে করে ?

না বাবা দেখা দেখিতে আমি নেই।
যদি নতুন করে আমার গাছে মুকুল আসে? সেই আতঙ্কে আমি কাছে যেতে নারাজ। যদি কাছে যাই যদি
এক কাপ চা এগিয়ে দেয়? তাহলেই তো হয়ে গেল।
না বাবা, আমি ওসবে নেই। একদম নেই।
আমার স্ত্রী আমার মাটি ও আকাশ।
আমি দুবেলা মাটির দিকে তাকাই।
আকাশের দিকে তাকাই। এই আমার সুখ। অন্য কোনো অসুখ নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। এবং আমার স্ত্রী
আমার সন্তানদের মা। আমি তাকে
অগ্রাহ্য করতে পারি না।

আমি তাই মহিলার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার উড়িয়ে দেবো। কি করে যে আমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পেয়েছেন আমি জানি না। তিনি তাই প্রথম থেকে নিজেই এগিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে আমার কোনো দোষ নেই।

আমি ছাপোষা মানুষ। আমি একজন
হরিপদ কেরানি। আমার কোনো বিষয়ে কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। উচ্চাশা নেই। লোভ নেই। ছেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেবো-------এরকমই মনের সাধ।

মহিলা দূরে আছেন দূরেই থাকুন।
তাকে কোনোদিন বলবো না, আমি র চা পছন্দ করি। আমি চারবার চা খাই।
চা আমাকে এনার্জি দেয়।
তাকে কোনোদিন বলবো না, চুনো মাছ আমার পছন্দের তালিকায়। বলতে গেলেই তো, ছোঁয়া ছুঁয়ির জায়গায় চলে আসতে পারি।
বাবারে, আমি মরে যাব।  
তিনি তার মত একা একা জীবন যাপন করছেন, করুন। আমি আমার মতো যাপন করছি জীবন, এইতো বেশ।

মহিলার কত বয়স আমার জানার আগ্রহ নেই। মহিলা চাকরি করেন, নাকি শুধু ঘরকন্না করেন, আমার জানার আগ্রহ নেই।
তবে জেনে ফেলেছি, মহিলা বিধবা।

এক্কেবারে একা থাকেন।

তার নিসঙ্গতার কাছে আমি পৌঁছোতে চাই না।

-------১৮ ভাদ্র ১৪২৮
------৪----৯----২০২১
------নির্মল হালদার








বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার






পানকৌড়ির ডুব / নির্মল হালদার


৩৭.
একটা নদী
ফসলের ক্ষেত
ঘাস জমিও আছে
ঘাস বীজ ও আছে

ছোট-বড় পলাশ গাছ
পোকামাকড়ের সংসার
কুল গাছে লাক্ষার ফলন
হাওয়া ওড়াউড়ি করে

শালপাতা তুলছে একজন
নিমকাঠি খুঁজছে একজন
সাইকেল নামছে নদীতে
বস্তা বস্তা বালি

দূরের মন্দিরে ঘন্টা বাজলো
নদীর পারে পোড়া কাঠ
শুঁকে বেড়ায় কুকুর
মোষের পিঠে রোদ হাসছে

কেটে যাচ্ছে কুয়াশা
স্পষ্ট হয়ে যায় পাহাড়ের রেখা
আকাশ ও আস্তে আস্তে নিকটে
মুখ দেখবে জলে

এইতো শুরু
শেষের খেলা কখন কে জানে?


--------৮ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৫----৮----২০২১



৩৮.
একটা মেয়ে
একটা রাস্তা
পথিকের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা নিশ্বাস
মেঘের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা রঙ
বাতাসের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা সূর্য
রোদের চলাচল

একটা মেয়ে
একটা দিন
ধুলোর চলাচল


একটা মেয়ের মাটিতেই পা।



৩৯.
নাপিত বউ এসেছে গো নাপিত বউ
কে নখ কাটবে এসো কে আলতা পরবে পরো

আজ বুধবার নাপিত বউয়ের দিন

নখ কাটতে কাটতে সেজ বউ বলবে, ও দিদি
নরুণে ধার নাই। মেজ বউ বলবে,
ঝামা ইঁটে ঘষবে গোড়ালি।আর
বড় বউ আলতা বাটির দিকে
পা বাড়িয়ে দিলেই, ঘরের কুল গাছটাও
বাড়িয়ে দেবে পা

আলতা পরবে।


----৯ ভাদ্র ১৪২৮
----২৬----৮----২০২১



৪০.
নিমতল থেকেই কান্নাটা আসছে
কে এলোরে কে এলো?
নিমতল থেকেই কান্নাটা আসছে
কে জন্মালো?

নবজাতকের চোখের জল
এক--একটি ফল।



৪১.
সন্ধ্যার রঙ
জোনাকির টুপটাপ
ঝিঁঝিঁ পোকা
নির্জনতা

কে কথা বলবে বলো?

আকাশেও ফুল
সৌরভের আলো
নিস্তব্ধ মাটি
গাছপালা অস্পষ্ট

কে কথা বলবে বলো?

দূরে দূরে গ্রাম
অন্ধকারের নীরবতা
ছায়ার কাঁপন
হিম পড়ছে

কে কথা বলবে বলো?

বাঁশবনের ঝর ঝর
শিয়াল দৌড়ে আসে
পোকা উড়ছে
রাত চরার ডাক

আমার কথা নেই একটিও


-----১০ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৭----৮---২০২১



৪২.
উঁচু জমির জল নিচু জমিতে।
জলের সঙ্গে পুঁটি ও মৌরলা।
মেঘ আসে মেঘ যায়।
রৌদ্র ছায়া।

গাছ তলে থেৎলে গেছে তাল।
মাছির ভনভনানি।
পিঁপড়ের অসংখ্য ডিম।
শুকনো গোবর।

খেজুর পাতা থেকেও জল পড়ছে।
মাঠে-মাঠে চোরকাঁটা।
মাথায় হাঁড়ি চলেছে রাস্তায়।
টিউ কল ভাঙ্গা।

ধানক্ষেতের আল ভেঙ্গেও গেছে।
ধান গাছের মাথায় ভাদুরে হাওয়া।
নদী জলে ঝাঁপ মারে বালক।
কাদা মাখছে শিশুরা।

আমি তো ধুলাও মাখি না।



৪৩.
নুন লঙ্কা হলুদ-তেল বিক্রি করতে করতে
ভুলে যায় না, লোকটার চারটে বিটি। চারটে বেটা।
একটা বিটিরও বিয়া দিতে পারে নাই। মানুষ হলো না একটা বেটাও। ছোটটা এত ছোট
শুধু কাঁদে, কাজ করতে দেয় না ওর মাকে।

আনমনা হয়ে কখনো কখনো
জিরার বদলে পস্তু পোটলা করে দেয়।
হয়তোবা লোকটা নিজের দুঃখকেই পোটলা করে দেয়।

লোকটার সারা গা থেকে ঝরে বেদনার নুন।


------১১ ভাদ্র ১৪২৮
-----২৮---৮--২০২১



৪৪.
চাঁদ উঠেছে
তারার ঝিকিমিকি
কেউ এসেছে
কেউ আসে নাই

ঘর অন্ধকার
উনুনের আলো
রুটি ফুলছে
শিশুর কান্না

মহুল পাতে শিশির
কাঁপছে হ্যারিকেন
লম্ফতে তেল নাই
রাত বাড়ছে

জনার পোড়ার গন্ধ
মশার ওড়াউড়ি
কথা আসছে
কথা যাচ্ছে

ঘরের দুয়ারে চাঁদ
দরজায় আগুড়
তারার ডাকাডাকি
স্তব্ধ রাস্তা

গগন তলে কে বাজাও গো বাঁশি?



৪৫.
উনুন শুকনো থাকলে
উপোসে থাকবে সবাই। উনুনটা ধরাও গো।
দেখো কোথায় জমানো আছে চাল।
ঘরে তো থাকেই একটা লক্ষীর হাঁড়ি।

উনুনটা জ্বালাও গো

ভাতের হাঁড়ি চাপাও।

এক মুঠো চাল পেলেই এক হাঁড়ি ভাত

আমাদের তো অন্নপূর্ণার সংসার।


------১২ ভাদ্র ১৪২৮
------২৯----৮----২০২১



৪৬.
বাসি হলেও হলুদ টাটকা হলেও হলুদ
হলুদ ছাড়া সংসার অচল।
ডালে হলুদ দিতেই হবে, তবেই তো রঙ।
সংসার ধর্ম।

নুন--তেলটাও চাই। ধনে--জিরে--লঙ্কাও চাই।
পাঁচফোড়ন ও লাগে। একটা তেজ পাতাও 
রান্নাঘরের শ্রী। ভুললে চলবেনা
সরষের কথাও। মা যেমন ভুলে যায় না, তার কোলে কাঁদছে শিশু, দুধ দিতে হবে।



৪৭.
সকালবেলা
বৃষ্টির অন্ধকার
বৃষ্টির হাওয়া
আঁচল উড়ছে

সাড়া শব্দ নেই
গাছপালা ভিজছে
মাঠ-ঘাট ভিজছে
শুকর ছানা একা

বালকের ছুটে যাওয়া
ডুংরি কোলে জল
ঘাসের কাঁপন
বুনোলতা

মাটি গলছে
একটা কাকের উড়ে যাওয়া
গরু ভিজছে
আবছা পুকুর ঘাট

আলপথে কাশের দোল
মান পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা
ভূঁইয়ে লুটায় অপরাজিতা
নীল রঙের স্রোত

আঁচল উড়ছে।


---১৩ ভাদ্র ১৪২৮
----৩০----৮---২০২১



৪৮.
চিরুনিতে লটকে থাকা লম্বা লম্বা চুল
কার চুল? কে এসেছিল?
জানলা থেকে দেখি আকাশের মাথা
আমি ভুল করে আঁচড়েছি মেঘের রেখা।



৪৯.
ঠোঙা তৈরির মজুরি থেকে
মেয়েরা টাকা জমিয়েছিল। বাপকে দিয়ে বলেও ছিল, এই নাও পণের টাকা। 
সেই মেয়েরা বিয়ের পর সংসার করতে করতে 
গরীব বাপের দিকে মুখ তুলে চেয়েছিল।
আজীবন।

বাপ --বিটি কেউ নেই শুধু রয়ে গেছে ঠোঙা।
ঠোঙা ভর্তি হচ্ছে। ঠোঙা উড়ছে। ঠোঙা লুটিয়ে পড়ছে ধুলায় ধুলায়।


-----১৪ ভাদ্র ১৪২৮
----৩১----৮---২০২১



৫০.
নুন মশলার দোকানে
সারাদিন আসা-যাওয়া করে
দু--এক পয়সার খদ্দের। বিকেল হলেই
কেরোসিন বিক্রি। দোকানেও লম্ফ জ্বলে।

আলো আঁধারের ছায়ায় মেয়ে এসে বলে, 
বাবা-দিদি আমাকে দিচ্ছেনা বুট ভাজা। তখন ঘরের ভেতর মেয়ের মা মুড়ি ভাজছে। আর
কয়লার উনুনের কাছে সেদ্ধ হয়ে উঠছে। তখন

তুলসী তলায় জ্বলছে একটি পিদিম।




৫১.
দেয়ালে দেয়ালে ঘুঁটে

আমি ঘুঁটের মধ্যে খুঁজি আঙুলের ছাপ।
যদি আঙুল গুলি ধরে রাখতে পারি,
আঙুল গুলি পুড়বেনা উনুনের আগুনে।



৫২.
পুকুর ঘাট
বালিকার কোলে হাঁস
জলের চঞ্চলতা।

ছাগল ছানার লাফ
গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে
ছিপ হাতে এক যুবক।

ঘোমটা টানা বউ
রাস্তায় নোংরা জল
কাদা ছপ ছপ।

দেয়ালে হেলানো লাঙ্গল
মাথায় গোবরের ঝুড়ি
ঘরের চালায় ডিংলা।

ধোঁয়া উঠছে
সকালবেলায় ভাতের হাঁড়ি
সজনে শাক।

রোদ এসে দাঁড়িয়ে আছে
উঠোনে খেলছে শিশু
টঙে উঠছে পায়রা।

এই বেলার এই খেলায় আকাশ প্রশস্ত।


-----১৫ ভাদ্র ১৪২৮
-----১----৯----২০২১
-----নির্মল হালদার







ভুল নম্বর / নির্মল হালদার

ভুল নম্বর / নির্মল হালদার




৯৪৩৪২৪৬৬৭৭----এই নম্বরে দুবার ফোন করলাম। রিসিভ হলো না। তিনবারের বেলায় রিসিভ হতেই, ওপার থেকে আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করে-----কেমন আছেন মাস্টারমশাই?
আপনার স্কুল চলছে তো?
আমি বলবার চেষ্টা করি, আমার তো কোনো স্কুল নাই। আমি মাস্টারিও করি না। ওপার থেকে তখন আমাকে বলে-----ও ও ভুলে গেছলাম ----- আপনি তো বাগান নিয়ে থাকেন। তো আপনার বাগানে এখন কি কি ফুল ফুটছে? রঙ্গন ফুটছে তো?
কাঞ্চন?
আমাকে কোনো বলবার সুযোগ না দিয়ে ওপার থেকে বলে যেতেই থাকে-----একসময় আপনার বাগানে গিয়ে ফুল গাছের আলো নিয়েছি আমি। চেয়ে থেকেছি টগরের শাদা রঙের দিকে। আপনার সঙ্গে চা খেয়েছি সকাল বেলায়।
কেমন আছেন আপনি?
আমি আবার বলবার চেষ্টা করি, কখনোই আমার বাগান ছিল না।
আজও নেই।
ওপার থেকে তখন আমাকে বলে,
আপনার তো দোকান আছে না? মুদিখানার দোকান। তাই তো?
আপনার দোকান থেকে আমি মাসকাবারি করতাম। আপনি একবার ১ লিটার তেলের বদলে দু লিটার তেল দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি বাড়ি থেকে বাকি ১ লিটার তেল আপনাকে ফেরত এনে দিয়েছিলাম। মনে পড়ে আপনার?
আমি এবার বলি ------ আমার মুদিখানা ছিল না। আমি দোকানদার নই।
ওপার থেকে তখন বলে------আমি তো ঘুরে বেড়াই। তবে কি আপনার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই আলাপ?
মনে পড়ছে মনে পড়ছে ------ একদিন শিয়াল ডাঙ্গার মোড়ে আমরা দুজনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি কারণে দাঁড়িয়েছিলাম মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাস কি চলছে না? তখনই আমরা একে অপরের নাম ধাম জানতে পারি। ঠিক বলছি তো? আমি বলতেই পারলাম না, ঠিক বলছে না। আমাকে একমুহূর্ত চুপ দেখে, ওপার থেকে বলে-------আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। আমার চারপাশে আত্মীয়-স্বজন। বন্ধুবান্ধব। আমার চারপাশে অনেক ভালোবাসা। বলতে বলতে ফোনটা ছেড়ে দিলো। আমার মনে হলো, কথার মধ্যে যেন একটা চাপা কান্না আছে। সেইসঙ্গে প্রশ্ন জাগলো মনে-----আমি কাকে ফোন করেছিলাম? ফোনের নম্বরটা ঠিক ছিল তো?

কয়েকদিন বাদে ৯৪৩৪২৪৬৬৭৭----এ ফোন করেছি। আবার। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওপার থেকে আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করে------কেমন আছেন ? জানেন, আমি প্রতিদিন ভালো থাকি। আমার কোনো রোগ-অসুখ নেই। আপনার চাকরির দিনগুলি ভালো কাটছে নিশ্চয়ই।
আমি বললাম----চাকরি আমি করি না।
ওপার থেকে তখন বলে-----একদম ভুলে গেছলাম। আপনি তো চায়ের দোকান করেন। আপনার দোকানেই নিশ্চয়ই চা খেতে আসছে সবাই। র চায়ের দাম কী বাড়িয়ে দিয়েছেন? আমি যখন যেতাম তখন দাম ছিল তিন টাকা।
স্পেশাল চায়ের দাম এখন কত? আপনার দোকানের চা এখনো জিভে লেগে আছে। শিগগির যাব একবার। শুধু চা খেতেই।
আমি যত বলবার চেষ্টা করি, আমার চা দোকান নেই। শোনে না। আমার কোনো কথাই শোনে না। ওপার থেকে কেবল বলে যেতে থাকে------আপনি কি এখনো বিড়ি খান? আমি বলতে চাই, আমি কোনোকালেই বিড়ি খেতাম না। আমার কোনো নেশা নেই। আমার
চা--দোকান নেই। ওপারের কণ্ঠস্বর কোনো গ্রাহ্য না করে আমাকে বলে, আপনার সঙ্গে দেখা হবে জলদি। সেদিন তিন কাপ চা খাবো।

আমি বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা রেখে দিলাম। কেন না ওপার থেকে যা যা বলছে, সমস্তই ভুল।

কিন্তু আমি কাকে ফোন করেছিলাম?
নম্বরটা কি ভুল করছি বারবার?
তবে আমার মন বলছে, ফোন নাম্বারটা সঠিক। একদম নির্ভুল। ছ মাস আগেও ফোন করেছি। কথা হয়েছে। তখন তো কেউ ভুলভাল কথা বলেনি। এখন ফোন করলেই, কী সব কথাবার্তা।
আজ ওই নম্বর থেকেই আমার কাছে ফোন। এবং আমাকে প্রশ্ন-----কেমন আছেন?
কী উত্তর দেবো? কি বলবো বুঝতে পারছি না। যৎসামান্য চুপ থেকে বললাম------আমি ভালো আছি। আমাকে ভালো থাকতে হয়। ওপার থেকে হাসির শব্দ এলো। আমি জানতে চাইলাম----হাসির কি হলো?
শুনতে পেলাম আরো হাসি। আমি ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম-----হাসির কি হলো?
যত প্রশ্ন করি বা জানতে চাই
ওপারের হাসি থামে না।

আমি ভয় পেয়ে যাই।

আমি জড়োসড়ো হয়ে ঘরের কোণে ঢুকে পড়লাম। মনে মনে ঠিক করলাম, কাউকেই আর ফোন করবো না। ফোন করলে যদি হাসি শুনতে হয়, ফোন করলে যদি ভয় পেতে হয়, তাহলে ফোন না করাই ভালো। আমার বাড়িতে খোঁজ করলাম ৯৪৩৪২৪৬৬৭৭ এই নম্বরটা আত্মীয়দের মধ্যে কারোর আছে?
সবাই জানালো------এই নম্বরের কোন অস্তিত্ব নেই।

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আমার প্রশ্ন------
আমার অস্তিত্ব আছে তো?

১৫ ভাদ্র ১৪২৮
১---৯---২০২১










কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ