মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২২

কবি নির্মল হালদারের গদ্য



ভুবন ডাঙ্গা//

সূর্যাস্তের করুণ আলো ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে। ঘরে ফিরছে পাখিরা।

পাতা ঝরে।

গাছপালার সবুজে সবুজে মায়া লেগে আছে।

ধুলো উড়িয়ে গাই গরুর দল ঘরের দিকে। সেই গোধূলির দিকে চেয়ে আছেন এক অনিন্দ্য সুন্দর পুরুষ।

তিনি একা।

শিলাইদহ থেকে ফিরে এসে
এখানেই তিনি এই লাল মাটির দেশে ।

গাছপালার ফাঁকফোকরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি আদিবাসী ঘর।

নিঝুম।

দু তিনটে শুয়োর শুয়ে আছে মাটিতে। একটা মোরগ ডানা ঝাপটে ঝোপের দিকে চলে গেল।

অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষটি মনে মনে
রচনা করেন-------

চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো
তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।

সুর আসছে না।

তিনি একজনকে খুঁজছেন।

তিনি আকাশের দিকে চোখ মেলতেই , আবছা আঁধার।
তিনি মনে মনে দেখতে পেলেন,
সন্ধ্যাতারার রূপ।
তাঁর মনে হলো, রূপের আগুন
সবাইকে যদি দেখাতে পারতেন।

তিনি প্রশ্ন করলেন নিজেকেই----
অন্তর কি আছে সকলের?

তাঁর হেঁটে যাওয়ার জন্য পায়ের তলার পাতা শুকনো পাতা ভেঙ্গে যাচ্ছে। শব্দ উঠছে শুধু। সেই শব্দ যেন বলছে-----নেই নেই কিছু নেই।

কিছুই কি নেই?

এইযে তারার আলোর মত শব্দ আসছে বাক্য আসছে, এইযে-----

আজি ওই আকাশ পরে সুধায় ভরে

কে পাঠালো আমার কাছে?

তিনি একটি গাছের কাছে দাঁড়ালেন। যেন তাঁর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেবে গাছটি।

তিনি গাছের গায়ে স্পর্শ রাখলেন।
তাঁর গায়ে পড়লো অর্জুন গাছের একটি ফল।
তিনি মাটি থেকে কুড়িয়ে ফলটিকে প্রশ্ন করলেন, তোমার সঙ্গে আগে কোথাও দেখা হয়েছে?

আদিবাসীদের ঘর থেকে শব্দ আসছে। সুতোর মতো ক্ষীণ আলো আসছে।
তিনি এগিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো তাঁর একটি চরিত্র। বিশু পাগল।

তার সঙ্গে এখানে দেখা হলে খুব ভালো লাগতো। মনে হতেই মনে মনে হেসে উঠলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো,দিনু আসবে তাঁর ঘরে। নতুন গানের সুর নিয়ে।

এই এক বিপদ হয়েছে, গান না লিখলে, গান না শুনলে তাঁর মন
বিচলিত হয়ে পড়ে। মনে হয় চন্দ্র সূর্য আর উঠবে না। দিগন্তে উড়বে না কোনো উত্তরীয়।

যখন লেখা আসে না তখন
ইচ্ছে করে না কথা বলতে।

ঊষাকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি
কথা বলেন আকাশের সঙ্গে।
আকাশ অনেক দূরের হলেও তাঁর
সঙ্গে কথা বলতে নিচে নেমে আসে।
একা আসে না শুকতারাকে নিয়ে আসে।

তিনি মাটি থেকে ধুলো কুড়িয়ে
কি যেন দেখলেন।

ধুলোর মধ্যে কি প্রাণ আছে?

গুনগুন করে উঠলো মন------

আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার।

চাঁদ উঠছে আকাশে।

একটি অর্ধ নগ্ন ছেলে এসে
তাঁর পরনের পাঞ্জাবিতে টান দেয়।
তিনি পিছন ফিরে দেখেন, ছেলেটি তার ভাষায় কিছু যেন বলতে চাইছে। তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি ইশারায় বললেন------চলো
তোমাদের ঘরের দিকে যাবো।


------২৩ চৈত্র ১৪২৮
------৭----৪----২০২২




ভুবন সায়র//

আজান ধ্বনির সুর ছলকে পড়ে
সায়রের জলে।

এক --একদিন আজান ধ্বনির সুরে জেগে ওঠে সূর্যদেব।

পাখিরাও জেগে ওঠে।

ছোট্ট রুস্তমের ঘুম ভেঙে যায়।
সে মায়ের কোলে কেঁদে ওঠে।

রুস্তমদের ঘর সায়রের কাছেই।
মসজিদের কাছাকাছি।

রুস্তমের ঠাকুমা আজানের আগেই উঠে পড়ে।

সায়রে যায়।

সায়র শান্ত হয়ে থাকে শিশিরে শিশিরে ভিজে।

শ্যাওলা ভাসে। পাতা ভাসে।
পুরনো ছেঁড়া কাগজ ভাসে।

মন ভাসে বৈকি।

রুস্তমের ঠাকুমা দেখতে পায়। দেখতে পায় জলের ভেতরে খেলা করছে মনের মত মাছ।

সহজে ধরা যাবেনা।

সায়রের জলে স্নান। কাচাকাচি।


গোপন ব্যথার চোখের জল
এই সায়রেই।

এই সায়র নিজেকে লুকিয়ে রাখে।

দয়াবান এক মানুষ নাম ছিল ভুবন সিং ----তিনি এই সায়র
মানুষের উপকারের জন্য দিয়ে গেছেন।
রুস্তমের ঠাকুমা তার বিয়ের পরেই এই গল্প শুনেছে। তারপর তো দিনের পর দিন চলে যায়,
কত কত মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা আনন্দ সায়রের
জলে পড়ে তলিয়ে গেছে।

মসজিদ থেকে ছড়িয়ে পড়ে
আজানের সুর।

ভুবন সিং যেখানেই থাকুন
লক্ষ্য করেন মানুষ তার ঘামের সঙ্গে ধুয়ে ফেলছে নিজের পাপ।

রুস্তমের ঠাকুমা জানে, নিশ্চিত জানে আল্লাহ থাক বা না থাক,
ভুবন সিং আছে সায়রের ছোট ছোট ঢেউয়ে।

ঝড় এলে রুস্তমের ঠাকুমার মনে হয়, আজ ভুবন সিংয়ের রাগ হয়েছে সে জল তোলপাড় করে দেখবে, সায়রের পাড় কারা নোংরা করে গেছে।

উথালি পাথালি জল ধুয়ে যাবে
পাড়। কেননা, মানুষের পা পড়বে যে। মানুষই যে শেষ কথা বলবে।

শেষ কথা বলেও।


------২৭ চৈত্র ১৪২৮
-----১১----৪----২০২২



পুনশ্চ
---------

দূর থেকে দাঁড়িয়ে বাড়িটা দেখছে
অনিকেত। সকালবেলা। শিশিরে শিশিরে ভিজে আছে চারদিক।
সেও ঘাসে ঘাসে পা ফেলে ভুবন ডাঙ্গা থেকে এইখানে।

এই বাড়িটাতে গুরুদেব থাকেন?

অনিকেত কখনো দেখতে পায়নি।

এই বাড়িটাইতো "শ্যামলী"।

বাড়িটাতে প্রবেশ করার মত তার অধিকার আছে কী?

বাড়িটার পিছনে অনেক গাছপালা। সেই সঙ্গে অনেক পাখি। যেনবা পাখিদের ডানা থেকে গাছের ডানায় লটকে আছে
আকাশের টুকরো।

বাড়ির রাস্তাতে লাল কাঁকুরে মাটি। শীতের শিশিরে ভিজে থাকা
মাটিও যেন বলতে চায়--------
আমাকে বস্ত্র দাও।

তিনি কি ভোর বেলা থেকেই ব্যস্ত থাকেন নিজের লেখালিখিতে?
একবার ও দেখা গেল না।

কী লেখেন তিনি?

তাঁকে কেন বলা হয় গুরুদেব?
তিনি কি সাধু? তাঁর মন্ত্র কি?

একটা ছায়া দেখা গেল।
গুরুদেবের ছায়া?

অনিকেত তাঁকে তো দেখেছে গাছতলার ক্লাসে। তারপরও তার কৌতুহল তাঁর বাড়িতে তাঁকে দেখবে।
প্রভাতকে বলছিল তার কৌতূহলের কথা। প্রভাত বলেওছে অনিকেতকে গুরুদেবের বাড়িতে নিয়ে যাবে একদিন।
প্রভাত গুরুদেবের গান করে বলে,
সহজেই তাঁর বাড়িতে যেতে পারে।

দুপুরে ঘুমে যাওয়া অনিকেতের অভ্যাস নেই। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে 
সে কোণার্ক-এর সামনে।

এই বাড়িটাইতো কোণার্ক?

মনে সন্দেহ এলেও অনিকেত 
একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি এই দুপুর বেলা গুরুদেব বাইরে আসেন!

সে কথা বলবে না। শুধু দেখবে
বাড়িতে তাঁর কী ভূমিকা?

দরজা জানালায় পর্দা।

মাঝে মাঝে পর্দা উড়লেও দেখা যায় না কিছুই। দূর থেকে দেখলেও চারদিক নিঃশব্দ লাগে।

অনিকেত আজ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
চলে গেছলো উদয়ন বাড়িটার ভেতরে। কিন্তু কোথাও গুরুদেবকে দেখতে পায়নি সে।

ঘুম ভাঙতেই তার জেদ চেপে গেল মনে, সে কোন কিছু ভাবনা চিন্তা না করে, গুরুদেবের একটা বাড়িতে ঢুকে পড়বে।
যদিও শুনেছে সে, একটা বাড়িতে
একটানা বেশি দিন তিনি থাকেন না। তাহলে?

কোন্ বাড়িতে আছেন কার কাছে খোঁজ করবে অনিকেত?
তার মনের সাধ গুরুদেবকে একটা কলম দেবে।
প্রভাত বলছিল, তিনি কখনো কখনো ছাতিম তলা দিয়ে হেঁটে যান। তখন দিয়ে দিলেই হবে।

শালবীথি দিয়েও তিনি হেঁটে যান।
কই, অনিকেত তো কোনদিন দেখতে পায়না।

শীতকালেও বৃষ্টি।

শান্তিনিকেতনের গাছপালা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কেপে উঠছে।

অনিকেত নিজেও ভিজছে।
সে গায়ের চাদর মাথায় ঢেকে 
হেঁটে যায় উদীচীর কাছাকাছি।
গুরুদেব যদি দরজা জানালার
পর্দা খুলে বৃষ্টি দেখছেন?
তাঁর চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখা যাবে না?

সে শুনেছে, গুরুদেবের বাড়িতেও
নাটকের মহড়া গানের রিহার্সাল
হয়ে থাকে। সে সঙ্গীত ভবনের ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে ঢুকে পড়বে।
কিন্তু তার জড়তা কিছুতেই কাটতে চায়না। কথা বলেনা বিশেষ কারো সঙ্গে।

আশ্রমের যে কোন অনুষ্ঠানে
অনিকেত পিছনে থাকে সবসময়।
তার কাঁধে কেউ হাত রাখলে সে কেঁপে ওঠে।

হোস্টেল ঘরেও সে প্রায় সময়
জড়োসড়ো হয়ে থাকে। অথবা
মুখ গুঁজে থাকে বইয়ের ভেতরে।

গুরুদেব বাড়ি পাল্টে পাল্টে থাকেন। কত লোকের একটাও বাড়ি নেই। আর তিনি একটার পর একটা বাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

এই তো সেই পুনশ্চ।

এখন এই বাড়িটাতে গুরুদেব থাকছেন কয়েকদিন হলো।
দেখা যাচ্ছে, বারান্দায় এক বাউল।
তার উত্তরীয় বারান্দা থেকে উড়তে উড়তে মেঘ ছুঁয়ে দিগন্তের দিকে চলে যায়।

এই বাউল কি গুরুদেব?


--------২৪ বৈশাখ ১৪২৯
-------৮----৫-----২০২২
-------নির্মল হালদার















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ