শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১

হাতি ও পালক / নির্মল হালদার

হাতি ও পালক / নির্মল হালদার



হাতিরা এসেছে পালককে খুঁজতে। তাকে দেখাবে দলমা পাহাড়। হাতিদের ডেরা দলমা পাহাড়েই।

কোথাও পালককে দেখা যাচ্ছে না। সে এই এখুনি ধুলো খেলা খেলছিল। তারপর কোথায় যে
লুকিয়েছে তার মা--ও খুঁজে পায় না। হাতিরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। আজ পালককে নিয়ে যেতেই হবে।তাকে দেখাতেই হবে পাহাড় কেমন হয়।

শুধু কি পাহাড়? পাহাড়ের সঙ্গে জঙ্গলও আছে।
হনুমান আছে অনেক। হাতিদের সঙ্গে খুব ভাব। কখনো কখনো হাতির পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে।

একটা হস্তি শাবক ছটফট করছে পালকের জন্য। সে পালকের সঙ্গে খেলবে। পালক কোথায়?

সে  হাঁসের সঙ্গে পুকুর দেখতে গেছে। এই বর্ষায়   পুকুরে দেদার জল। পালক  হাঁসের সঙ্গে সাঁতার 
শিখবে।

হাতিরা পুকুরে গিয়েও দেখতে পেল না। কে যেন বললো,পালক ঘুমোচ্ছে।হাতিরা তার মায়ের কাছে এসে জানতে পারলো, ঘুম ভাঙতেই পালক চলে গেছে কলা বনে। সে হাতিদের কলা খাওয়াবে। 

হাতিরা খুশি হয়ে পালকদের ঘরের কাছে বসে রইল। তখন একটা পিঁপড়ে এসে  হাতিদের বলে-----তার বাড়ি কাঁসাইয়ের ওপারে। কিন্তু নদী পার হয়ে যেতে পারছে না। হাতিরা যদি পার করে দেয়, পিঁপড়ে  উপকৃত হবে।

এখন কাঁসাইয়ে খুব জল। হাতিদের দল থেকে একটা হাতি পিঁপড়েকে পিঠে নিয়ে নদী পার করতে গেল।পালক কোথায়? কখন আসবে?

হাতিরা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় আরো। তারা কলা বনে যাব বলছিল। তখন পালকের মা এসে বলে, তোমরা বোসো------ একটু দুধ খাও। হাতিরা দুধের বদলে জল খাবে, জানিয়ে দিতেই পালকের মা
হাতিদের কাছে জল এনে দেয়।

পালকও এসে গেছে।তার সঙ্গে কয়েক কাঁদি কলা।হাতিদের খুব আনন্দ। তারা কলা ভোজন করে পালককে বলে ------চলো এবার পাহাড় দেখতে। পালকের মা বলে, আগে ওদের ইস্কুল থেকে ঘুরে এসো।আজ ওর ড্রয়িং পরীক্ষা আছে। হয়তো ওকে হাতি আঁকতে বলবে। তোমরা সঙ্গে থাকলে কাছে থাকলে  তোমাদের দেখে দেখে আঁকতে পারবে।

হাতির পিঠে উঠে পালক ইস্কুলে যায়।

----১৪ শ্রাবণ ১৪২৮
----৩১---৭---২০২১
----নির্মল হালদার







গোঠে / নির্মল হালদার

গোঠে / নির্মল হালদার



-----কুথা থিকে এলিরে? তকে তো কনদিন নাই দেখি।
কুথায় ছিলি? কার সাথে আসেছিস? একা একাই যদি আসেছিস,তবে হামার গরু গিলার সাথেই চরে বেড়া।
আর কি বলবো তোকে? যা উদকে। ঘাস আছে দেদার।

বলরামের গোঠে আজ একটা গাধা। কোত্থেকে এসেছে, কিভাবে এসেছে, বলরামের জানার কথা নয়। সে দেখছে, গরুর দল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে গাধা।

গরু ও গাধা দুজনেই নিরীহ। তবে গাধা খুব বোকা। এই যে এসে পড়েছে এখানে হয়তো কোনো মালিক তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো বোঝা আর টানতে পারছে না। বলরাম ভাবতে ভাবতে গাছ তলায় শুয়ে পড়লো।

মেঘ ও রোদের খেলা চলছে। সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েছিল। আপাতত বৃষ্টিটা নেই। এ জন্যেই বলরাম মাঠে আসতে পেরেছে।

বলরামের মনে পড়লো, জল খাওয়াতে হবে গরুদের।সে উঠে পড়ে  সব গরুকে ডাকে। ডাক দিলো গাধাকেও ------আয়রে আয় চল্-------জল খাবি চল্-------।

মাঠের সামনেই একটা বাঁধ। বারোমাস জল না থাকলেও এই বর্ষাতে টইটম্বুর । বলরামেরও ভখাছে।সে আর কি খাবে!সে প্যান্টের পকেট থেকে খৈনির প্যাকেট বের করে বাঁ হাতে খৈনি ডলতে থাকে।আর নিজের পেটকে সান্ত্বনা দেয়-------ডাঁরারে ডাঁড়া------ বেলা পড়লেই ঘরকে যাবো। আগু গরুগিলাকে দেখতে দে-------। গরু গিলাইত হামকে ভাত দেয়।তবেই ন হামি টিকে আছি। গাধাটা বাঁধের দিকে গেলেও একা একা। সে হয়তো ভয় পাচ্ছে গরুর শিঙকে। যেহেতু গরু ও গাধা একই সম্প্রদায়ের নয় বলে, গাধার তরফ থেকে একটা দূরত্ব। বলরাম বুঝতে পারে গাধার মনের অবস্থা। সে বলে, ভয় নাইরে ভয় নাই-----হামার গরু তকে নাই ঢুঁসাবেক। যা জল খাবি যা।

গাধার মুখ শুকনো হয়ে আছে।

গাই গরুর দল হইহই করে জলে নেমে জল খায়। একটু দূর থেকে গাধা দেখে। গরুরা জল থেকে উঠে পড়ার পর গাধা নামে। বলরাম চেয়ে চেয়ে দেখে।

বৃষ্টি হচ্ছে বলে মাঠে মাঠে ঘাসের ছড়াছড়ি। কোথাও কোথাও জমে আছে জল। ফড়িঙ উড়ছে।পোকামাকড়ের নিঃশব্দ চলাফেরা।

সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে। গাই গরুর দল নিয়ে বলরামের সময় এসে গেছে ঘরে ফেরার। সে এইবার ভাবছে , গাধাটাকে কোথায় রেখে যাবে।   কোনো গোয়ালেতো ঢুকিয়ে দিলে হবেনা। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গাধাটার প্রতি বলরামের মায়া জন্মে গেছে। তার ভাবনা ,কি করবে সে।গাধাটাকে ছেড়ে যেতেও পাচ্ছে না। দলছুট হয়ে এসেছে নাকি মালিক তাড়িয়ে দিয়েছে কে জানে। বলরাম লক্ষ্য করে, গাই গরুর দল ঘরের রাস্তায় চলে গেলেও গাধাটা একা দাঁড়িয়ে আছে। সে আর কিছু না ভেবে গাধাটাকে বলে-----তুই চল্ আমার সাথে। তকে কার সাথে কুথায় রাখবো পরে ভাবা যাবে। এখন তুই চল্। হামার সাথেই চল্------

-----১২ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৯----৭---২০২১
----নির্মল হালদার








শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০২১

একটা কাপ / নির্মল হালদার


একটা কাপ / নির্মল হালদার




আমি সারাদিনে তিন কাপ চা খাই। যদিও আমার আছে ৫০ টা কাপ। বিভিন্ন রকমের কাপ। নানান জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছি। কিন্তু সব কাপে চা খাওয়া হয় না। সকালের কাপ নির্দিষ্ট হয়ে আছে। বিকেলেও তাই। বেলা ১১টার পরে আরেক কাপ চা খেলেও কাপের অদল বদল ঘটে না। আখরের এই গল্প শুনে আমার দেখতে ইচ্ছে করলো, কাপের   চেহারা। কেননা, আমি আখরের কাছে মাঝে মধ্যেই চলে আসি। আমারও মনে হয়, নানা রকমের কাপের সঙ্গে আমার পরিচয় হোক। যখন আখর চা আনতে যায়, তখন সাধ হয়, আমি কাপটাকে পছন্দ করে পাঠাই। আমি বলার আগে দেখার আগে কাপ চলে যায় নিচে। চায়ের কাছে।

আমি মনে মনে হতাশ হয়ে কাপের রূপ আঁকতে থাকি। সোমবার থেকে রোববার , সপ্তাহের ৭টা দিন একেকটা কাপে একেক দিন চা খাই। কোনোদিন এক কাপ চায়ে মেঘ ভাসতে থাকে। আমি মেঘের গন্ধে
বুঁদ হয়ে  ঢলে পড়ি।এত নেশা যে উঠতে পারিনা। কোনোদিন  চায়ের কাপে কেবল আকাশ। নির্মল আকাশ। আমাকে ডাকে। আমি কাছে যাই না। শুধু আকাশের দেয়ালে ছবি টাঙাই।

একেকদিন  কাপের  গায়ে প্রজাপতির রঙ ছড়াই। যদি
প্রজাপতি আসে আরো , আমি সারা ঘরে প্রজাপতির সঙ্গে উড়বো।

একদিন এক কাপ চায়ে লবঙ্গের গাছ দেখতে পেলাম। লবঙ্গের গন্ধে  আমি ছুটোছুটি করলাম লবঙ্গ জঙ্গলে। তারপরেই দেখতে পেয়েছি এলাচের গাছ। আমি চা বাগানেও ছুটে গেছি।

আখর আমাকে আনমনা দেখে জানতে চায়----- আমার কি হলো? কারণ, আমি চায়ে চুমুক দেবার সময় একদম চুপচাপ থাকি। আজ একটা কাপ দেখেছি আখরের আলমারিতে। আমার মন খুব টানছিল কাপটার দিকে। তাকে  বলার ইচ্ছে হয়েছিল, ওই কাপে আমার চা চাই। বলতে পারিনি।

কীই বা বলতে পারি ? ফাটা কাপে চা দিলেও তো আমি খাই। স্টিলের গ্লাসে চা দিলেও তো আমি খাই।

আমার পছন্দ কি , কি নয় বাকিদের জানবার কথা কি? আমি তো শাল পাতায় ভাত চাই। কে দেবে?
অথবা পদ্মপাতায় মুড়ে কেউ খাবার দিলে আমার খুব ভালো লাগবে। আখর বলছিল, সে এক সেট তামার কাপ প্লেট নিয়ে আসবে। আমার খুব খুশি খুশি লাগছিল। একদিন না একদিন ওই তামার কাপে আমি চা খাবো।

আমারতো কেনার ক্ষমতা নেই। কেবল দেখার শক্তিটুকু আছে। দেখার মন টুকু আছে। অহল্যাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে কোনো কিছু উপহার দিলে বই অথবা কাপ। যদিও সে আজ অব্দি কোনো উপহার দেয় নি। একবার শুধু ক্যাডবেরি খাইয়েছিল।

সেদিন রাস্তার ধারে একটা দোকানের সামনে থমকে গেলাম। কাঁচের শো--কেসে সাজানো আছে বিভিন্ন রকমের কাপ। একজোড়া আমার পছন্দ হলো।

কেনার টাকা নেই। আখর কে বললাম-----সে যদি কিনে ফেলে আমি কাপটাকে দেখতে পাবো। কাপটাতে চা পেতেও পারি।

আপাতত আখরেরও  টাকা নেই। সে কিনতে পারবে না। 

আমার এই কাপ  বিলাসিতার মধ্যে  আমার চরিত্র
ধরা পড়ে। কত কত মানুষের ভাঙাচোরা থালা। তাদের দিকে আমি কী তাকাই?

আখর ও আমি প্রায় একই মেজাজের বলে, আমরা একইসঙ্গে  প্রতিদিন আড্ডা দিয়ে থাকি। আমরা দুজনেই চায়ের দোকান দিকে না --যাওয়ার চেষ্টা করি।
চায়ের দোকানের গ্লাস কিম্বা কাপ আমাদের পছন্দের বাইরে। নোংরাও হয়। আখর বলছিল, সে  ঢোকরার দুর্গা সংগ্রহ করবে। আর আমি মনে মনে বলছিলাম, কাপ সংগ্রহ করবো। কাপেই তো ঠোঁট ছোঁয়ানো রায়।
এক কাপ চায়ে দুজনের ঠোঁট। দুই দিক থেকে। আহা! কি মধুর দৃশ্য। এই দৃশ্য আমি রচনা করতে চাই।

আসলে,কোনো দৃশ্য আমি লিখতে পারি না। একবার ভেবেছিলাম টাকা আঁকতে পারলে টাকা আসবে।  অনেক অনেক টাকা। তখন যা ইচ্ছে কিনতে পারবো।

পরে জেনেছি, টাকার ছবি সবচেয়ে কঠিন। টাকা জটিল ও কঠিন বলেই, টাকা আঁকতে যাওয়া বোকামি।

খুব ক্লান্ত লাগছে এখন। জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুর। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে নেয়ে গেছি।

আখর আমার সঙ্গে ছিল। সে অনেক আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। অহল্যাকে ডেকেছিলাম। সে বাড়ির বাইরে এই গরমে কোথাও যাবেনা। আমাদের পাগলামির সঙ্গে সে নেই।

চারদিকে বাড়িঘর দোকানপাট। গাছতলা কোথায় গাছতলা? দেখতে পেলাম হাড় জিরজিরে একটা গাছের নিচে এক ভিখারি পরিবার। দোমড়ানো মোচড়ানো থালা বাটিতে ভাত খাচ্ছে।

এই ভাতের গন্ধের কাছে আমি একটু জিরোবো।

-----১৩ শ্রাবণ ১৪২৮
----৩০----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার










বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০২১

বাঁশি / নির্মল হালদার

বাঁশি / নির্মল হালদার
__________________


লিখন বাঁশিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে করে, বাঁশিটা একমাত্র মনসংযোগের উপাদান।

আজ সারা দিন মনটা উড়ু উড়ু। কোনো বিষয়ে মন দিতে পাচ্ছেনা। তখনই তার মনে পড়লো,বাঁশিটা টাঙানো আছে দেয়ালে। চেয়ে থাকলে মন শান্ত হবে। মন স্থির হবে। মন স্থির না হলে, সে যেতে পারবে না সোনাঝুরির কাছে। কাল রাতে বেদম তর্ক হয়েছে তার সঙ্গে। তর্কের কারণ তুচ্ছ একটা বিষয়ে। ধুলোর রঙ কী? প্রশ্নটা ছিল লিখনের। সোনাঝুরি প্রথমে বলেছিল -----জানি না। পরে আরও বলেছিল---- প্রশ্নটা ইন্টারভিউর মত। উত্তর দিতে পারবো না। জটিল প্রশ্ন। ধুলো কালো হয়ে থাকে। ধূসর হয়ে থাকে। কিন্তু কখনোই লাল নয়। লিখন বলেছিল----- যেকোনো একটা বলতে হবে। সঠিক বললে সম্পর্ক থাকবে। ভুল বললে, কাল থেকে তোর সঙ্গে আমি নেই। সোনাঝুরি রেগেমেগে লিখনের জামার বোতাম ছিঁড়ে দিয়ে বলেছিল -----সামান্য একটা বিষয় উত্তর দিতে না পারলে, সম্পর্ক থাকবে না? তার মানে তুই সম্পর্ক কী বুঝিস না। কিংবা বলতে পারি, আমাদের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। লিখনের উত্তর ছিল-----হ্যাঁ আমাদের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠলে ধুলোর রঙ কী, তুই বলতে পারতিস। তখন সোনাঝুরি পাল্টা প্রশ্ন করে, আকাশের রঙ কি বলতে পারবি?
তুই এখুনি বলবি, আকাশের রঙ নীল। আর আমি বলবো লাল। মানবি তো?

রঙ নিয়ে দুজনের তর্ক চলতেই থাকে। কেউ কারোর কাছে নত হবে না। শেষে লিখন সোনাঝুরির মাথার চুল টেনে মাথাটাকে ঠুকে দেয় দেয়ালে। রক্ত দেখা যায়।

আড্ডাতে আরো বন্ধুরা অবাক হয়ে দু'জনকেই চুপ করতে বলে। সোনাঝুরি আর কিছু না বলে বাড়ির দিকে চলে যায়।

লিখন রাত্রিতে আর ঘুমোতে পারে না। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে মাথা গরম করা উচিত ছিল না। পরে সে ভেবে দেখেছে, এবারেও এস এস সি তে তার হলোনা। সেই হতাশা থেকেই বোধহয়, সোনাঝুরির সঙ্গে বাকবিতন্ডা। ঝগড়াও বলা যায়।

আজ সকালে উঠে সে চা--ও খেলো না। কেবল ভাবছে কখন দেখা হবে সোনাঝুরির সঙ্গে। দেখা হলেই, মার্জনা চেয়ে নেবে।

একেকবার ভাবছে, কেন মার্জনা চাইবে? সোনাঝুরির সঙ্গে তার ক্ষমা চাওয়ার মত সম্পর্ক নয়। তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে, তা আবার আপনা আপনি মিটেও যায়। অকারণ দীর্ঘায়িত করে, মন কষাকষি করে কী লাভ!

সাতসতেরো ভাবতে ভাবতে লিখনের মন আরো অশান্ত হয়ে উঠছে ।সে তাই বাঁশিটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে বাঁশির নীরব রূপ তাকে সহযোগিতা করবে। এর আগেও অনেকবার বাঁশি তাকে শান্ত করেছে। 

বাঁশি চুপচাপ থেকেও প্রতিটি মুহূর্ত একটা সুর প্রবাহিত করে ঘরের মধ্যে। লিখন শুধু দেখতে পায়। শুনতেও পায় সুরের তরঙ্গ।

সে মনে মনে বাঁশির ভেতরে শুয়েও থাকে। তার ঘুম আসে। স্বপ্ন আসে। বাঁশি তার একান্ত আপন। একান্ত প্রিয়।

সেই কবে সংক্রান্তির মেলা থেকে বাঁশিটাকে নিয়ে এসেছিল । এখনো তার সঙ্গেই আছে। এই এখন যেমন বাঁশিটা বলছে-----"বাঁশির ভিতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যায় সারাদিন। লিখন, তোমার ভেতর দিয়েও সোনাঝুরি বয়ে যাচ্ছে। সে তোমার সঙ্গেই আছে।
তোমার সঙ্গেই থাকবে।"

লিখন বাঁশির পরিপূর্ণ কথা শুনে ঠিক করে, সে এবার থেকে বৃথা তর্ক করবে না। মাথা গরম করবে না। প্রেম একবারই আসে। তাকে ধরে রাখতেও হয়। আর বাঁশি প্রেমের এক নিঃশব্দ রূপ। সেই আজ তাকে রক্ষা করেছে।

লিখন বাঁশিকে নিয়েই সোনাঝুরির দিকে যায়।

----১১ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৮---৭---২০২১
----নির্মল হালদার











মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই, ২০২১

বাড়িটা কোথায় / নির্মল হালদার

বাড়িটা কোথায় / নির্মল হালদার




ফুল্লরা বারান্দায় বসেছিল। রাস্তার ধারে বারান্দা। তাই, সে মানুষজনের চলাচল দেখতে পায়। শব্দ শুনতে পায়। মানুষজনের মুখের অভিব্যক্তিও দেখতে পায়। ফুল্লরার এই রুটিন প্রতিদিন।

আজ হঠাৎ একজন লোক বারান্দার গ্রিল থেকে মুখ বাড়িয়ে ফুল্লরাকে জিজ্ঞেস করে------আচ্ছা রঘু বাবুর বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারবেন?
----কে রঘু বাবু?
-----ওই যে মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করেন।
-----কোন্ পাড়ায় থাকেন বলেছেন?
-----আপনাদের এই মায়া কলোনিতেই বলেছেন।
-----এটাতো মায়া কলোনি নয়, এটা সুভাষপল্লী।
----ও তাই

লোকটি হতাশ হয়ে ফিরে যান।

আরো একটি লোক বারান্দার গ্রিল থেকে মুখ বাড়িয়ে ফুল্লরার কাছে জানতে চান------রাম বাবুর বাড়িটা কোন্ দিকে বলতে পারবেন?
-----কে রাম বাবু?
----ওই যে ফুড অফিসে চাকরি করেন।
----কোন্ পাড়ায় থাকেন বলেছেন?
-----বলেছিলেন, সরোবরের কাছেই। এদিকেই তো সরোবর।
-----এদিকে সরোবর নেই। একটি ডোবাও পাবেন না।
-----তাহলে?

লোকটি হতাশ হয়ে ফিরে যান।

আবারও একটি লোক বারান্দার গ্রিল থেকে মুখ বাড়িয়ে ফুল্লরাকে জিজ্ঞেস করেন-----সীতানাথ বাবুর বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারবেন?
-----কে সীতানাথ বাবু?
----ওই যে ডিএম অফিসে চাকরি করেন?
-----কোন্ পাড়ায় থাকেন বলেছেন?
-----এই তো তালতলাতে
-----এটা তো তালতলা নয়। এখানে একটি খেজুর গাছও নেই।
----আমাকে আরেকজন বললেন, এদিকেই বাড়ি।
-----আপনি তবে খুঁজে নিন, আমি জানি না।

এই লোকটিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্য রাস্তায় পা বাড়ান।

ফুল্লরা ভাবে,  "এ তো বেশ ঝামেলায় পড়া গেল।বারান্দায় আর বসা যাবে না। কত লোককে কত উত্তর দেবো।" সে উঠে পড়লো। গেল ছাদে। চুলে
চিরুনি চালাতে চালাতে। 

হঠাৎ একটা লোক উপর দিকে মুখ করে ফুল্লরার কাছে জানতে চান-----তপন বাবুর বাড়িটা কোন্ দিকে?
----কে তপন বাবু?
----ঠিকাদারি করেন।
-----ঠিকাদার এখানে কেউ নেই।
----হ্যাঁ এদিকেই বললেন যে।
----বলতে পারেন কিন্তু নেই।

বাকিদের মতো এই লোকটিও হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন।

ফুল্লরা চুল আঁচড়ায়। শ্রাবণের মেঘের মতো চুল। যেন বা  মাটির দিকে  নিচে নেমে আসতে চায়। ফুল্লরা যত্নের সঙ্গে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নিচের দিকে মুখ বাড়াতেই, আরেকটি লোক তাকে জিজ্ঞেস করেন-----অমিয় বাবু কোন্ দিকে থাকেন?
-----কোন্ অমিয় বাবু? এখানে চারজন অমিয় থাকেন।
----আমি অমিয় মিত্রর কথা বলছি।
----না,অমিয় মিত্র নামে কেউ থাকেন না।

অমিয় অনল অলীক কেউ নেই। কেউ থাকেন না। ঘরবাড়িও কারোর নেই। ফুল্লরা বিড়বিড় করে বলে।
বলতেই থাকে অদৃশ্য কাউকে। সে স্থির করে, এবার কেউ বাড়ির কথা জানতে এলে, রামবাবু শ্যাম বাবুর বাড়ি জানতে এলে, কিছুই বলবে না। কেন না, এখনও অবধি তারও বাড়ি নেই।

ঘরবাড়ি কারোরই থাকে না।

----১০ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৭---৭---২০২১
----নির্মল হালদার







সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি














































































এই পোস্টের অনেক ছবিই আলোকচিত্রী সন্দীপ কুমারের তোলা।





কবিতা / নির্মল হালদার

কবিতা / নির্মল হালদার




১৬৩.
এটুকুই চাই
কখনো পায়ের দিকে চেয়ে থাকবো
কখনো শব্দের দিকে

যেখানে যা আছে থাক

ঘরের কোণে মাকড়সা
দুয়ারে সিঁদুরের দাগ
চৌকাঠে আলপনা

যেমন আছে থাক

আমি শুধু পায়ের দিকে চেয়ে থাকবো
নিত্যনতুন শব্দের দিকে
আগমনের দিকেও

আগমনেই দুলে উঠবে আম পল্লব।



১৬৪.
আষাঢ়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে
এসে পড়লো শ্রাবণ।
শ্রাবণের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।
শুশনি শাক তুলতে হবে।

ভোর হয়েছে কবেই।

ঝিঙে ফুলের হলুদে রোদ পড়েছে।
ধান জমি থেকে আগাছা তুলছে চাষী বউ।
আমাকে যেতে হবে অনেক দূর।
স্নান করতে হবে।

আমার কোনো ছায়া পড়ে থাকবে না।


------৫ শ্রাবণ ১৪২৮
-----২২----৭----২০২১



১৬৫.
একেকটা ঋতুতে একেক রকম গন্ধ আসে।
সেই গন্ধ বিচার করার মতো
আমার ক্ষমতা নেই।
আমি শুধু বলতে পারি, সব গন্ধ ছাপিয়ে
আমার কাছে একটাই গন্ধ, মায়ের মুখের
পান দক্তার গন্ধ।

চিরদিন।



১৬৬.
আমার মায়ের কোনো ঘর ছিল না
অথবা মা নিজেই ছিল একটা ঘর।

আমার কাছে কান্নার এক ঘর

মা থাকতেও আমার মন ছিল নিরাশ্রয়।



----৬ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৩---৭---২০২১



১৬৭.
জেঠি--খুড়ির সঙ্গে মায়ের ঝগড়া হলেও
আমার তো আর ঝগড়া ছিল না।
আমি আদর খেয়েছি জেঠি---খুড়ির কাছে।
সন্ধে হলেই গল্প পেয়েছি রাজারাজড়ার।
আর ঘুমিয়ে গেছি বুকের গন্ধে

কোলে কোলে।



১৬৮.
চুন সুপারি খয়ের আছে, দোক্তাও আছে
আর পানের বাটা থেকে উঠে আসছে,
বোঁটা লাগানো সবুজ একটি পান।

পানতো নয় যেন আমার মায়ের মুখ।

অনেক পুরনো গল্প অনেক নতুন।



-----৭ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৪----৭----২০২১



১৬৯.
পাখি কখনো মা হয়ে কখনো প্রেমিকা হয়ে
সৌন্দর্য ছড়ায়। পাখি কখনো কেবলই দূরত্ব
সম্পর্ক থেকেও সম্পর্ক নেই।

নৈকট্য নেই।

আমার অন্তর পুড়তে পুড়তে আমি পাখি আঁকতে থাকি।
পাখির ডানাতে লাগাই আমারই তাপ।
পাখি ওড়ে। পাখির ডানায় লাগে আকাশের প্রবাহ।
আমি আর ছুঁতে পারিনা আমার পাখিকে।

দূরত্ব রচনা হয়। দূরত্ব প্রেম হয়।



-----৯ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৬---৭---২০২১
-----নির্মল হালদার










জাল / নির্মল হালদার

জাল / নির্মল হালদার





পাহাড়টা উড়ছিল। হাত পেতেছি যেই, আমার হাতে
দাঁড়িয়ে পড়লো। আমাকে প্রশ্ন করে, কী চাই?

কী চাই? নিজেকে প্রশ্ন করি এবার। কিছুই তো চাই না। পাহাড় আমাকে চুপচাপ দেখে, উড়তে শুরু করে।  
এই অবধি লিখে ডাইরিটা বন্ধ করে কবীর।সে ঘরের সিলিংয়ে চোখ রাখে। দেখতে পায়, একটা মাকড়সা। জাল বুনছে। এবং সে উপর দিকে উড়তে থাকে। আস্তে আস্তে জালে আটকে যায়। ছটফট করে। চিৎকার করার চেষ্টা করে, স্বর বেরোয় না। তার জল তেষ্টা পায়।

কোথায় জল পাবে? কে দেবে জল? তার কণ্ঠস্বর কোথাও পৌঁছয় না। সে মাকড়সার জালে জড়িয়ে জড়িয়ে  শেষে কাঁদতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়,
চোখের জল তাকে মানায় না। সে দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে থাকে সমস্ত জাল। জালের জটিলতা। 

এত কঠিন জাল সহজে ছেঁড়া যায় না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে। দাঁতে দাঁত ঘষে। কিন্তু জাল ছেঁড়েনা। যদিবা জাল থেকে বেরিয়ে আসে শরীর, মাথা আটকে যায়। দম বন্ধ হয়ে যায় কবীরের। সে বুক ফাটিয়ে ডাকতে থাকে। মৃত্যু চিৎকার করতে থাকে ------ রুমেলা ------ রুমেলা ------। রুমেলা ----- ।

অনেক ডাকাডাকির পর রুমেলা এসে দাঁড়ায়। সে কবীরের অবস্থা দেখে মাথায় হাত রাখে। সে বলে,
মাকড়সার জাল থেকে কিভাবে তোমাকে মুক্ত করবো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিনা। কবীর বলে,আগে এক গ্লাস জল দাও------তারপর দেখছি, কিভাবে কি করা যায়।
বেশি দেরি করা যাবে না আর। আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মুখের থুতুও শুকিয়ে গেছে।

কবীর হাত--পা ছুঁড়তে থাকে। সে ঘরের সিলিং  এ নোখ আঁচড়ায়। সিলিং এর রঙ ঝরতে থাকে। কিছুতেই কিছু হয়না। রুমেলা বলে, তুমি উপর দিকে উঠলে কেমন করে? তুমি উড়ছিলে নিশ্চয়ই। কবীর বলে, এখন প্রশ্ন করার সময় নয়। তুমি চিন্তা করো আমাকে কিভাবে বাঁচাবে। রুমেলা উত্তর দেয় ------ বাঁচাবো বাঁচাবো। দাঁড়াও আমি যাচ্ছি তোমার কাছে।
রুমেলাও উড়তে উড়তে সিলিং এর কাছে। সে হাঁ করে মাকড়সার মাথা মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। আর চিবোতে থাকে। ক্রমশ জাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে কবীরকে মুক্ত করে।

দু'জনে নেমে আসে নিচে। যেন বা এই প্রথম প্রাণ পেলো কবীর।

-----৯ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৬---৭---২০২১
----নির্মল হালদার








শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

ভারতবর্ষ / নির্মল হালদার

ভারতবর্ষ / নির্মল হালদার




ক্লাস এইট অব্দি পড়াশোনা করে মকরের মনে হলো, দিনমজুরের কাজ করা ঢের ভাল। মায়ের হাতে অন্তত দু চার টাকা দিতে পারবে।

বাপটাও মরে গেছে। বাপও ছিল দিনমজুর। সন্ধ্যা হলেই, বাংলা মদ গিলতো। এত গিলতো যে অকালে চলে গেল।

মকরদের চাষবাসও নাই। শুধু একটা একচালা ঘর। খড়ের ছাউনি। মকরের মা একটা ছাগল পুষে ছিল। ছাগল চাষে লাভ হয় নাকি। সে ছাগলও রোগে রোগে
মরলো।

কপাল মন্দ হলে যা হয়। মকরের মা এই কথা বলে, কপাল চাপড়ায়। মকরকে কাজে যেতেই হয়। আর এমন ঠিকাদারের পাল্লায় পড়েছে, রোজ কাজ নাই।
যেদিন কাজ থাকে না সেদিন মকর হাড়াই নদীতে মাছ ধরতে চলে যায়।

মকরের বয়সীরা আজকাল ক্রিকেট খেলে না। ফুটবল খেলে না। শুধু মোবাইলে গেম। দেখা যায় অনেক ছেলেই নদীর ধারে এসে গেম খেলছে। কারণ একটাই, নদীর দিকে টাওয়ার থাকে। মকর তখন চেয়ে থাকে ছিপের দিকে------কখন একটা মাছ  লাগবে। অন্তত একটা মাছ। রাত্রিবেলা তাহলে, ভাতের সঙ্গে মাছের তরকারি। দু'মুঠা ভাত বেশি খাওয়া যায়। এমনিতে
প্রতিদিন শাক সিজা। আলু সিজা। ভাত। মকরের নাই ভাল লাগে। সে জানে তাদের পয়সা নাই।তার মা
লোকের ঘরে কাম করে এক থালা ভাত পায়।আর মাসে তিনশো টাকা। এই বৈশাখে যা হলো,ঝড়ে উড়ে গেছলো মকরদের খড়ের চাল।সে যা অবস্থা একটা রাত তো  ছাউনি ছাড়াই মা বেটা ঘরে শুয়ে ছিল।
খড় জোগাড় না হলে চাল ছাইবে কী করে? পরের দিন মাহাতদের ঘর থেকে একশো খড় এনে  ছাইতে হলো।
মাহাতরা মকরের মায়ের সঙ্গে শর্ত করলো,বেতন ছাড়াই কাজ করে দিতে হবে এক মাস। উপায় ছিল না। মকর মাঝেমাঝে যা রোজগার করে, এক পয়সাও জমে না।

মকরের বাপ কোনো টাকা পয়সা রেখে যায়নি। মকরও লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে তেমন কোনো কাজে
ঢুকতে পারে নাই।

গাঁয়ে থাকে। মকরের আর কোনো আয়--উপায় নাই।সে সময় সুযোগ পেলেই, মাছ ধরে।

হাড়াই নদীতে বারো মাস জল থাকে না। এখন বর্ষাকাল বলে, জল আছে। মাছও আছে। আজ
তাই, ছিপ ফেলেছে আশায় আশায়। যদি চ্যাঙ--গড়ই উঠে আসে।যদি উঠে আসে কয়েকটা পুঁটি। সেই আশাতেই মকর ছিপটা মাটিতে রেখে খৈনি ডলে বাঁ--হাতের তালুতে। আর ছিপটা পড়ে যায় জলে।ছিপটাও নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে যায়। সে দেখতে পেয়েই, ঝাঁপ দেয় জলে। তুলে নিয়ে আসে।

মকরের জেদ বেড়ে যায়, সে আজ মাছ ধরবেই।রুই-কাতলাও ধরতে পারে। সে ভিজা কাপড়েই নতুন করে ছিপ ফেলে। উপর দিকে মুখ করে জোড় হাত করে বলে-----হে ঠাকুর আমার আশা পূরণ করবে। আমি তোমাকে  রঙ--বরঙের মাছ দেখাবো। এই নদীতে রঙিণ মাছও ঘুরে বেড়ায়। সবাই জানে না ঠাকুর।

এই  এইতো উঠছে একটা মাছ।

সূর্যাস্তের রঙ হাড়াই নদীর জলে খেলা করে।


-----৭ শ্রাবণ ১৪২৮
-----২৪-----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার










শুক্রবার, ২৩ জুলাই, ২০২১

বালিকার মুখ / নির্মল হালদার

বালিকার মুখ / নির্মল হালদার




আমার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে এক বালিকা। আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি, কিছু নেই।
বালিকার হাত ধরে বললাম-------চল্ আমার বাড়িতে।
সে না না করে। আমি বললাম-----ভয় নেই তোর চল্ -----তোকে মুড়ি দেবো। গুড়--মুড়ি খেতে চাইলেও দিতে পারি।

অনেকবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বালিকাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। যদিও তার জড়োসড়ো ভাব কাটছে না। মাকে বললাম, গুড় মুড়ি দেবার জন্য। মা বললো, গুড়তো নেই, মুড়ির সঙ্গে ছোলা ভাজা দিতে পারি।
 
বালিকার মলিন মুখের দিকে চেয়ে মনে হলো, এই আমার দেশ। এদের রক্ষা করতে আমরা পারিনা। আমরা এদের ভিখারি সাজাই। অথবা ভিখারি তৈরি করি।

বালিকা বারান্দায় বসে নিচু মুখে মুড়ি খেতে খেতে লক্ষ্য করছে, খেলনা ট্রেনের দিকে। পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারছি। বালিকাকে বললাম, ওই খেলনা ট্রেন তোর লাগবে? সে চুপচাপ থাকে। আমার দিকে
চেয়ে রয়। আমি বললাম, তোকে ট্রেনটা দিয়ে দেবো। তার আগে ওই ট্রেনে করে আমরা ঘুরে আসি চল্------।


খেলনা ট্রেন আমার ছোট ভাইপোর। সে এখনই চাইলে
দিতে হবে। ঝটপট তাই বালিকাকে নিয়ে ট্রেনে উঠে বসেছি। টিকিট কাটা হয়নি। না-হোক। আপাতত ঘুরে আসি। ধানচাটানি হয়ে উশুলডুংরি। পাহাড় ঘেরা গ্রাম। 

যে কোনো একটা গ্রামে নেমে পুতুলের সঙ্গে দেখা করবো। আমার সেই কাঠের পুতুল। বিয়ে হয়েছে বাঁশিটাঁড়ে। সে আমাদের দেখে খুশি হবে খুব।আমাদের খাওয়াবে নাড়ু।


একটা স্টেশন থেকে একজন হকার উঠলো। সে বিক্রি করছে কাগজের পুতুল। তেঁতুলের আচার। আমি বালিকার জন্য কিনে ফেললাম। তার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক। সে তেঁতুলের আচার খেতেও শুরু করলো। আমার জিভে জল। তার কাছ থেকে খানিক নিয়ে জিভে দিয়েছি যেই, কি টক। কি টক। তবুও ভালো লাগছে। কেননা, অনেকদিন বাদে ঘুরতে বেরিয়েছি।

ধানচাটানির কাছে এসে দেখলাম সূর্যাস্ত হচ্ছে। তার রঙের বিভায় আমার মনে হলো, ঘরে ফিরবো না আর। বালিকাকে নিয়ে থেকে যাবো কোথাও।

বালিকাও ট্রেনের জানালা থেকে দু'চোখ ভরে দেখছে নানান দৃশ্য। সেও খুশি খুব।


দুপুর পার হয়ে যায়। খিদে এসেছে। যা আসে প্রতিদিনের মত। বালিকাকে শুধাই------তোর
খিদে পাচ্ছে। সে ঘাড় নাড়ে।


ট্রেন কে বললাম-----চলো ঘরের দিকে। জোরে জোরে হাঁক পাড়ি-----মা মা আমাদের খিদে পেয়েছে । খেতে দাও।  

খিদেই তো আমার দেশ। ক্ষুধা তৃষ্ণা আমার দেশ। এই বালিকা আমার দেশ। এই বালিকাকে আমি শুধু
খেলনা ট্রেনে তুলে বেড়াতে নিয়ে যাবো। তার বেশি কিছু করবো না। এই বালিকাকে আমি শুধু গুড়--মুড়ি খাওয়াবো। সেই সঙ্গে বালিকার হাতে গুঁজে দেবো কয়েকটা টাকা। আর ভুলে যাবো বালিকার মুখ।আমার দেশের মুখ।

----৬ শ্রাবণ ১৪২৮
----২৩----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার






বৃহস্পতিবার, ২২ জুলাই, ২০২১

এই আমি / নির্মল হালদার

এই আমি / নির্মল হালদার




পালকের সঙ্গে দুপুরে দেখা হলো। আজ সকালে দেখা হয়নি। আমি কোথায় ছিলাম?

পাহাড়ে যাইনি। সমুদ্রেও না। আমি কোথায় ছিলাম?

আচ্ছা আচ্ছা এবার মনে পড়লো, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শৈলেন কুন্ডুর। অনেকদিন বাদে দেখা। কথা ফুরোয় না। দেরিটা সেখানেই। ফলে, অযোধ্যার আঙুর বাগানে যেতে দেরি হয়ে গেল। আরও দেরি, শেয়ালের জন্য। সে যে থাকবে আমার ভাবনার বাইরে ছিল।
ভাগ্যিস ছিল, তাই টক আঙুর মিষ্টি আঙুর চিনতে পেরেছি। পালকের পছন্দের মিঠে আঙুর একটা একটা তুলে ভর্তি করেছি আমার ঝুলি।

পালককে কিছু না দিলে সারাটা দিন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কালকে তো গেছলাম কমলালেবুর বাগানে।
কি রঙ।কি  সুগন্ধ। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। পালকও খুশি হয়। সে যে কোনো ফল ভালোবাসে।তার জন্য কলা বনেও যাই। দেখা হয়ে যায় হাতির সঙ্গে।

আজ শৈলেন বাবুর সঙ্গে দেখা হলো কেন? তার সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্কই নেই। এমনতো হতে পারে, তিনি শৈলেন বাবু ছিলেন না, ছিলেন মৃন্ময় বাবু। কিংবা  আশুতোষ বাবু। যিনি হাত দেখাতে পছন্দ করেন। হাতের রেখা চেনেন খুব বেশি করে। ভাগ্যের প্রতি অগাধ বিশ্বাস।

কিন্তু শৈলেন বাবু মৃন্ময় বাবু হতে যাবেন কেন? অথবা আশুতোষ বাবু কেন হবেন? আমার সঙ্গে শৈলেন বাবুরই দেখা হয়েছিল। এই শৈলেন বাবু কোনো ভাবেই মুখোপাধ্যায় নন। এই শৈলেন বাবু, শৈলেন কুন্ডু। আপাদমস্তক ভদ্রলোক।

কি কথা বলছিলাম, যে, আমার দেরি হয়ে গেল পালকের কাছে পৌঁছোতে? জুতোয় তো পেরেক ছিল না। পথে কোনো কষ্ট ছিল না। তবে?

রাস্তায় রাস্তায় ভিড় ছিল না। গাড়িঘোড়ার জটিলতা ছিল না। আমি তো হাঁটছিলাম। আমি সমুদ্রে গেলেও হেঁটে যাই। নিজের পায়ের শব্দ শুনতে শুনতে হেঁটে যাওয়া খুব সুখের। মনে হয়, আমার একজন সঙ্গী আছে।

শৈলেন বাবু কি বলছিলেন মনে পড়ছে না তেমন। একটাই কথা মনে পড়ছে শুধু, তিনি বলছিলেন এই শ্রাবণ মাসে  অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। তাই তিনি বেশ আনন্দে আছেন।

আমার সঙ্গে তো কারো দেখা হয় না। একই ঘরে থেকে পালকের সঙ্গে দেখা করতেও আমার তো দুপুর হয়ে যায়।

দুপুরটা খুব খাপছাড়া। কোথাও মসৃণতা নেই। খচখচে লাগে। তখনই মনটা বেসামাল হয়ে ওঠে। মনে হয়, পালকের সঙ্গে খেলাধুলা করি।ওর কাছে নানা রকম পুতুল। দু'জনে পুতুল খেলবো।

আমরা পেয়ারা বাগানও যেতে পারি। গাছে উঠে পেয়ারা ফুল খুঁজে খুঁজে আমরা সহজেই জেনে
যাবো, ক'টা পেয়ারা হবে।

এখনো আশ্চর্য লাগছে, শৈলেন বাবু আমাকে চিনতে পেরেছেন ঠিকই কিন্তু আমার নামটা ভুলে গেছেন। আমি নীলেন্দু না নিমাই তিনি মনে করতে পারছিলেন না। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপনি যা ইচ্ছে নামে ডাকতে পারেন। আপনি আমাকে ভোদাই বললেও খুশি হবো।

একথা সে কথার পর আমরা চায়ের দোকানে গেলাম। আমার মন যদিও ছটফট করছিল, কখন দেখা হবে পালকের সঙ্গে।

পালকের জন্য আঙুর। পালকের জন্য পেয়ারা।পালকের জন্য কলা। 

কেবল কাছে যেতে হয়। হাত পাততে হয়।

হাতটা আমি বড়োই করেছি। আকাশের কাছে হাত পেতে পেতে হাতটা এত বড়ো হয়ে গেছে যে এখন আর কারোর কাছে হাত পাততে সমস্যা হয় না।

কখনো কখনো হাত না পেতেও বৃষ্টি পেয়েছি। বৃষ্টির রঙ বৃষ্টির আনন্দ পেয়েছি। শৈলেন বাবু জানেন না, আমি ধুলায় ধুলায় শুয়ে পড়তে পারি। শৈলেন বাবু জানেন না, আমি ভালোবাসার কাছে শতবার নত হতে পারি।

শৈলেন বাবুর সঙ্গে দেখা হলো কেন? এ প্রশ্নটাও আজ আমার মধ্যে ঘুরছে। দীপক বাবুর সঙ্গেও দেখা হতে পারতো।  যে দীপক বাবু আমাকে বলেছিলেন--------
কারো সঙ্গেই দেখা হয় না হে------কেবল দিনরাত্রির সঙ্গে দেখা হয়।

আমার সঙ্গেও শৈলেন বাবুর দেখা হয়নি। অযথা কিছু বিভ্রম আমাকে আজ পীড়িত করছে। আমি আজ  পালকের সঙ্গে কথা বলিনি একটাও।


-----৫ শ্রাবণ ১৪২৮
----২২----৭----২০২১
----নির্মল হালদার




বুধবার, ২১ জুলাই, ২০২১

ডাক / নির্মল হালদার

ডাক / নির্মল হালদার




ঠিক বাগান নয়, বাড়ির পিছন দিকে এক ফালি জমিতে লাউ--কুমড়া হয়ে থাকে। ঢেঁড়স হয়ে থাকে।  কিছু ফুলও ফোটে।

পিদিম পরিচর্যা করে। এই বাড়ির। প্রতিদিন সকাল সন্ধে সে আসবেই। যে গাছে জল দেওয়ার প্রয়োজন, জল দেয়। শুকনো জীর্ণ পাতা, ছেঁটে দেয়।  পরিষ্কার করে।

জবা গাছটার নিচেই ব্যাঙের সঙ্গে দেখা হয়। আজ দেখা পায়নি এখনও। কোথায় গেল?

পিদিমের মনে হয়, ব্যাঙটাই এই বাড়ির রাজা।সেইতো ফুল ফল গাছের দেখভাল করে। সারাদিন থাকে। রাত হলেই, ডাকাডাকি। মিলনের ডাক।

ডাকেরও রকমফের আছে। কোনো কোনো ডাক কর্কশ লাগলেও, আসলে সেও যে মিলনের ডাক, বুঝতে হবে।

এখন তো সকালবেলা। ব্যাঙটা চুপচাপ থাকে। একা থাকে। রাত হলেই ডাক। পিদিম অনেকবার ভেবেছে, ডাক শুনে সে যদি সাড়া দেয়? সে তো কোনো ঋতুতে কাউকেই ডাকতে পারে না। 

কাল রাতে সে মনে মনে ডাকছিল, শিমুল---- শিমুল ------ । কোনো সাড়াশব্দ আসেনি। কোকিলের ডাক কি মধুর। বসন্ত এলেই, ডাকাডাকি। এবার তো আষাঢ়েও কোকিলের ডাক শোনা গেল। আজ ব্যাঙটা গেল কোথায়? কার কাছে গেল? আজ রাতে কি আর ব্যাঙের ডাক শোনা যাবে না?

পিদিমের মনে হয়, ব্যাঙটার শরীর খারাপ। হয়তো কোনোখানে শুয়ে আছে। একবার দেখা হলে যে পিদিমের ভালো লাগতো খুব। তার সঙ্গে দেখা হলেই, সকলের সঙ্গে দেখা হয়। প্রতিদিন। এরকমই ভাবে সে। কিন্তু আজ কি হবে?

পরিচর্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। টগর গাছটাতে জলও দিয়েছে। টগরটা ছোট আছে বলে, বেশি যত্ন করতে হয়। এবার স্নান করতে হবে। কিন্তু মন নেই পিদিমের। তার মনে হচ্ছে, সে অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে আজ।

শিমুলকে বলতে হবে। শিমুল জানে ব্যাঙের কথা। সে না দেখেও পিদিমের কাছে জানতে চায়,কিরে তোর ব্যাঙ কেমন আছে?

পিদিমের কাছে ব্যাঙ শব্দটা ভালো লাগে না সব সময়। সে তাই, শিমুলকে বলেছিল, ব্যাঙটার একটা নাম দিতে পারলি না?

মেঘও ডাকে। নানা দিকে নানা ডাক। কোনো কোনো ডাক কখনও আর্তনাদ মনে হয়েছে। কেঁপে উঠেছে বুক।

বর্ষার দিনে ব্যাঙের ডাক বিরহীর ডাক। বিষণ্ণ করে। 

পিদিম অফিস করবে না আজ। তার শরীর ও মন কোন কিছুই কাজ করছে না। সে ফুল-ফলের বাড়িতে কাদা মাটির মধ্যে শুয়ে পড়লো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখতে পেলো, দু'দিক দিয়ে দুটি ব্যাঙ আসছে। একটি ব্যাঙের পরনে লাল বেনারসি। কপালে চন্দন। আরেকটি ব্যাঙ ধুতি-পাঞ্জাবিতে
ঝলমল করছে। হাসছেও। পিদিমের দিকে চেয়ে চেয়ে। পিদিম গা ঝাড়া দিয়ে যে উঠবে কিন্তু উঠতে পারছে না। সে কেবলই মুদে ফেলছে চোখ। চারদিক অন্ধকার দেখছে। দেখছে, জবা ফুলের পাপড়ি কুঁকড়ে গেছে। লাউ কুমড়ো লতায়  সারি সারি মাছি। সে মাছিদের ওড়াতে গেলেও পেরে উঠছে না।

পিদিম একটা ডাক দিলো ব্যাঙের মতোই। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙটাকে দেখতে পেলো সে। এই তো আমার বন্ধু। আমার সখা। সে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। এই সঙ্গে বাড়ির সব গাছপালা ডেকে উঠলো।

ডাক দিতেই হবে। সব সময় ডাক দিতেই হবে। ডাক না দিলে, চারদিক মরুভূমি হয়ে উঠবে। ডাক না দিলে, শুকিয়ে যাবে আকাশের রঙ। ডাক দিতেই হবে।ডাকাডাকির মধ্যে যে স্বর লুকিয়ে থাকে, সেই তো মাধুর্য। সেই তো প্রেম। আলো অন্ধকারে সুখে দুঃখে
একটা ডাক। ব্যাঙের ডাক থেকে যে মিলন, সেই মিলন তো আবহমানের মিলন। পিদিম শুধু শুনবে সেই ডাক। শিমুলের সঙ্গে তার মিলন হোক বা না হোক, সে জানবে সে শুনেছে ব্যাঙের ডাক। সেই তো সৌন্দর্য।

চোখ লেগে গেছলো পিদিমের। ধড়পড় করে উঠে পড়ে সে। দেখতে পায়, বাইরে থেকে এসে ব্যাঙটা গাছপালার মধ্যে ঢুকে পড়ছে।


-----৪ শ্রাবণ ১৪২৮
----২১----৭---২০২১
-----নির্মল হালদার







মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০২১

কবিতা /নির্মল হালদার

কবিতা /নির্মল হালদার




১৫৩.
শাক তুলতে গিয়ে মনে হলো আমার
এও আমার দেশ। শাকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে
আমার ঘাম আমার আকাঙ্খা।

শাক তুলতে গিয়ে মনে হলো আমার
শাকের সঙ্গে কান্নাও আছে, আমি দু হাতে
নিয়ে যাচ্ছি।


১৫৪.
একটি নক্ষত্রের জন্ম হলে
আমি জন্মের কাছে যাই।


আমারই জন্মের কাছে যাই।


আকাশেও জন্ম আমার, মাটিতেও।
গাছেও জন্ম আমার, জলেও।

বাতাসেও আমার বীজ।

তুমি ধারণ করো।

একটি নক্ষত্রের জন্ম হলে
শাঁখ বাজে ঘরে ঘরে। শাঁখের ফুঁ হয়েও
আমার প্রকাশ।

আমি শব্দ আমি ধ্বনি।


-----৩০ আষাঢ়১৪২৮
----১৫----৭----২০২১



১৫৫.
সূর্য তারা এসেছে আমাদের করবে লালন

সূর্য তারার সঙ্গে জোনাকিও আছে
আমাদের করবে আলো। ডুবতে ডুবতে
পানকৌড়ি আমাকে দেখছে, আমি কেমন আছি

আমি যাই

আমার ছেঁড়া ছেঁড়া দুঃখকে ঢেকে রাখবো
শাল--শিমুলের ছায়ায়।



১৫৬.
বিরহ যদি খুদকুড়ো হয়, অভিমান তবে
ভাঙ্গা থালা। প্রেম তবে এক রাস্তা
হেঁটে যেতে হয়।

অনেক দূরের যাওয়া, যেখানে ভিখারির পাতে
রাজার আহার।


----৩১আষাঢ়১৪২৮
-----১৬----৭----২০২১


১৫৭.
বট গাছের নিকটে গিয়ে মনে পড়লো,
অশথ গাছও আছে। তার এক কোটরে
বাসা বেঁধেছে সাপ আর সাপিনী।
ওদের সংসারেও ছানাপোনা আছে, যদি
খোঁজ করো। খোঁজ করেই তো জেনেছো,

আমরা আট ভাই বোন, হরির লুটের বাতাসা কুড়াতে 
রাস্তায় এসেছি।

সম্পর্কের রাস্তায়।

রাস্তাও রক্তের সম্পর্কে আমার আত্মীয়।


৩২ আষাঢ়১৪২৮
১৭----৭----২০২১


১৫৮.
বটফল যেই মাটিতে পড়লো
আমি কুড়িয়ে নিয়েছি। আমার জন্য সে
টুকটুকে, রাঙা। অনেকদিন গাছে ছিল
এবার আমার কাছে সে, আমারই মুখে
মুখ দেখবে

ভালোবাসার অনেক মুখ

আমি বাক্স-প্যাটরা গোছালেও আমার সঙ্গে থাকবে না।



১৫৯.
যে হাত রুইছে ধান
সেই হাতের কাছে দাঁড়াবো
যদি আমাকে রোপন করে
আমিও ধান।

ধানের গৌরব।

ধানতো মান নিয়ে আসে

আর আমার জীবনে যে শুধুই অপমান।


----১ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৮---৭----২০২১



১৬০.
আমি অর্ধেক মানুষ
একটি ফল পেয়েছি, যে ফলের ভিতরে
বীজ আছে। যে ফল সম্পূর্ণ

যে ফল স্বাধীন।

আমি তো স্বাধীনতাহীনতায় নুব্জ
হয়ে গেছি।

আমি কথাবার্তাতেও পরাধীন।



১৬১.
যে স্বরেই কথা বলো
তুমি একজন মানুষ।
বাতাসে সাঁতার কাটতেই পারো
জলে আঁক কষতেই পারো

এক পায়ে দাঁড়ালেও তুমি একজন মানুষ
তুমি তাল গাছে উঠতেই পারো অথবা
চাঁদ পাড়তে পারো
তুমি যে তোমারই ভাষায় স্বপ্ন দেখো।

স্বপ্ন দেখার অধিকারে তুমি স্বাধীন

তুমি সুন্দরও।

তোমাকে বাদ দিয়ে ফুটবে না একটি চালের দানা।


----২ শ্রাবণ ১৪২৮
----১৯----৭----২০২১



১৬২.
চলো এক গ্রামের দিকে

ধানের চারা কি বলছে শুনবো।

এতদিন তো আমরাই কথা বলে এসেছি,
দুয়ারে দুয়ারে টাঙিয়েছি,
আমাদের গৌরব গাথা। এবার না হয়
জল কাদা মাখামাখি
ধানের চারার কথা শুনবো।

গল্পে গল্পে উঠে আসবে আমার প্রাচীনা ঠাকুমা।
জ্যোৎস্না রাতে শুকাতে দিয়েছিল সেদ্ধ করা ধান।


-----৩ শ্রাবণ ১৪২৮
----২০----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার








এই তো গল্পের শুরু / নির্মল হালদার

এই তো গল্পের শুরু / নির্মল হালদার


প্রাঙ্গণ রাস্তায় যেতে যেতে দেখতে পেলো,২১ শে জুলাই ময়দান চলো------ চলো বললেই কি যাওয়া যায়?

অন্য কেউ বলতে পারে, ২২শে অগাস্ট চলো গান্ধী মূর্তির পাদদেশে।

যে যখন বলবে, যেতে হবে নাকি?

আজ যেমন  প্রাঙ্গণ চাচার দোকান যাবে না। কালকেও যায়নি সে। সে বলতে চায়, আমার যখন ইচ্ছে হবে, আমি যাবো।

রাজনৈতিক দলগুলি জনগণকে কি পেয়েছে কে জানে। হঠাৎ হঠাৎ গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়।মিটিং মিছিল করে। সভা-সমিতি করে।

জনগণের কিছু লাভ হয় না।

প্রাঙ্গণ বলে-----কাল যদি আমি বলি, চলো পুকুর খনন করতে। সবাই যাবে কি? যদিও সে জানে, তার কোনো দল নেই। ক্ষমতা নেই। তবুও তার ইচ্ছে হয়, চারপাশের মানুষজনকে বলবে, চলো যাই-----জঙ্গল পরিষ্কার করতে।

২১শে জুলাই বা ২৩শে জুলাই যেতে হবে বললেই যাবো কেন? আমি বরং ২২শে শ্রাবণ যাবো, কাছে পাবো আরেক জনকে।

প্রাঙ্গন এসমস্ত কথা বললে, বন্ধুরা বিগড়ে যায়। তারা প্রাঙ্গণের মতো সপ্রতিভ নয়। প্রাঙ্গণ যেমন বলে, মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। সব সময় ঠকানো হচ্ছে। মানুষ সহ্য করছে মুখ বুজে। এ জন্যেই, এই দেশটা
পিছিয়ে পড়ছে।

নীলাম্বরী প্রাঙ্গণকে অনেকবার বলেছে, তোর মুখে কাঁটাখোঁচা নেই, যখন যা পারিস বলে দিস। তোকে এজন্যেই লোকজন ভুল বোঝে।

ভুল বুঝলে কি আর হবে! আমার সঙ্গে কথা বলবে না এই তো। না বলুক, আমি সত্যিটা বলতে ছাড়বোনা।

জনগণকে ভেড়া করে  ছেড়েছে, রাষ্ট্র শক্তি। তাই, যে কোনো বিষয়ে  আমাদের সরকার ক্ষমতা প্রদর্শন করে জনগণের উপরে।

নীলাম্বরী বলে-----তুই নতুন একটা দল কর। তুই নেতা হয়ে জনগণকে বোঝাবি, ক্ষমতা কি? দেখা যাবে, তুই নেতা হয়ে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে, জনগণের মাথার উপরে ছড়ি ঘোরাচ্ছিস। ক্ষমতা খুব খারাপ, এটা তুই ভালই বুঝিস। নীলাম্বরীর  মুখের দিকে চেয়ে কোনো উত্তর করে না প্রাঙ্গণ। হাত পাতে। বলে------দশটা টাকা দে। সিগারেট খাবো। নীলাম্বরী বলে, চাচার দোকান চল্, চা সিগারেট বাদেও সিঙ্গাড়া খাওয়াবো।
প্রাঙ্গণ এই মুহূর্তে চাচার দোকান যাবে না। যাবে না মানে যাবেই না। সে চেয়ে আছে ২১ শে জুলাই
লেখাটার দিকে। লেখা না বিজ্ঞাপন? সে রেগেমেগে নীলাম্বরীকে বলে, চল্ বিজ্ঞাপনটা মুছে দিয়ে আসি।
নীলাম্বরী "না" করে। সে আরো রেগে যায়------বলতে থাকে আরো কথা----এই দেশটার কিছু হবে না। তখন নীলাম্বরী বলে, চারদিকে আরও কুৎসিত বিজ্ঞাপন। তুই মুছতে পারবি? সমস্ত বিজ্ঞাপনেই একটি মেয়ে আছে। একটা ব্লেডের বিজ্ঞাপনেও নারীর শরীর। আমাদের সভ্যতা মেয়েদের অধিকারের কথা বলেও শেষ অব্দি মেয়েদের করেছে পণ্য সামগ্রী।

তুই চিৎকার করেও মুছে দিতে পারবি ঐ সব বিজ্ঞাপন? এবারে প্রাঙ্গণ রাস্তায় বসে পড়ে। সে জানে বিজ্ঞাপনের গিমিক। বিজ্ঞাপনের নোংরামো। আসলে
সে এও জানে, সবই পুঁজির খেলা। পুঁজি যা বলবে তাই হবে। এই পুঁজির কাছে প্রাঙ্গণ নিজেও পুতুল। সে মাথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে মনে হচ্ছে, এবার ছিঁড়ে ফেলবে। রেগে গেছে খুব।

নীলাম্বরী সামনের দোকান থেকে এক বোতল ঠান্ডা জল এনে তাকে দেয়। সে প্রথমে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর নিজে গিয়ে বোতলটা নিয়ে এসে গলায় ঢালতে থাকে।
বোতলের জল চোখেমুখেও নেয়।

প্রাঙ্গণ উঠে দাঁড়িয়ে নীলাম্বরীকে বলে, আজ যে ১লা শ্রাবণ সবাইকে বলে আসি। চল্। অন্তত একটা দেওয়ালে যদি লিখতে পারতাম,আজ১ লা শ্রাবণ
সকলের জন্মদিন। সকলের শুভ হোক। কিন্তু লিখে উঠতে পারলাম না। এ আমাদের ব্যর্থতা নীলা। সমস্ত ব্যর্থতার মাঝেও তোর হাতে তুলে দিচ্ছি,আজকের এই ১লা শ্রাবণ। তুই বিলি করে দে।

না না তুই একা বিলি করবি কেন? আমরা দুজনেই বিলি করবো ১লা শ্রাবণের শুভেচ্ছা।

আজ যে সবার জন্মদিন। আজকের এই জন্মদিন যাবতীয় কুৎসিত বিজ্ঞাপনকে ঢেকে ফেলবে নিশ্চয়। আজকের এই জন্মদিনে মানুষ মানুষকে ভালবাসবে।

চল্-------।

নীলাম্বরী ও প্রাঙ্গন হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে।


-----১লা শ্রাবণ ১৪২৮
-----১৮---৭---২০২১
-----নির্মল হালদার








শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০২১

ঝড় / নির্মল হালদার

ঝড় / নির্মল হালদার



প্রস্তাবনার মন ভালো নেই। সে আমলকি গাছের কাছে যায়। তার ছায়া জড়িয়ে বলে------ আমার অন্তরে ঝড়। থামিয়ে দাও। কিছুই ভালো লাগছে না আমার।
সে গাছের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে, চলে যায় নদীর কাছে। নদীকেও বলে------আমার অন্তরে ঝড় থামিয়ে দাও। সে নদীর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চলে যাচ্ছিলো। তাকে দাঁড়াতে বলে এক যুবক। তার কাঁধে মাছধরা জাল। পরনে বারমুডা। গায়ে গেঞ্জি। যুবক বলে----আমি শুনতে পেয়েছি আপনি কি চাইছেন। শুনুন, ঝড় কেউ থামাবে না। থামাতে হবে আপনাকেই। আপনি স্থির হয়ে দেখুন,
নদীর চলাচল। নদী আপন-মনে চলেছে। নিজের আনন্দে চলেছে। তাকে নির্দেশ দেওয়ার মতো কেউ নেই। আপনিও নিজেই থামাতে পারবেন আপনার অন্তরের ঝড়।

সকালবেলা। আকাশে মেঘ। নদীর ধারে গাই--গরু চরে বেড়ায়। বাগাল ছেলেও গাই গরুর পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ধানক্ষেতে জমে আছে জল। ধান রোয়া শুরু হবে এবার। নদী সংলগ্ন জমিতে ধান রোয়া চলছেও। কাজের লোকজন কাজ করতে করতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এবারের বৃষ্টিতে নাকি শাক সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এই কারণে বাজারে সবজির দাম চড়া।

যুবকের কথা শুনে প্রস্তাবনা নদীর ধারে গিয়ে বসে। সে বুঝতেই পারছে না, কাল রাত থেকে মন কেন উথাল পাথাল করছে। কাল তো দেখা হয়েছিল আজাদের সঙ্গে। হাসি ঠাট্টাও হয়েছিল অনেক।

তবে? প্রস্তাবনার কি হয়েছে? কোন্ অপূর্ণতায় সে অস্থির? তার কেবলই মনে হচ্ছে, যে ঝড় এসেছে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

যদিও সে দেখছে, নদীর ছোট ছোট ঢেউ। উঁচু-নিচু ঢেউ। নদীর জল পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নিজের গন্তব্যে চলেছে। সে কি নদীর সঙ্গে যাবে?

কোথায় যাবে?

ঘরে তো ফিরতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, কেন ফিরতে হবে? সে যদি নদীর গতির সঙ্গে পা মিলিয়ে হেঁটে যায়?

প্রস্তাবনা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, যুবকটি জাল ফেলছে নদীতে। জালে উঠে আসবে মাছ। ছোট বড় মাছ। ডাঙায় উঠে স্থির হয়ে যাবে তাদের প্রাণ। এই তো জীবন।

প্রস্তাবনার অন্তরে আরো ঝড় ওঠে। সে দাঁড়িয়ে যায়। যেদিকে ধান রোয়া চলছে, সেদিকে গিয়ে দাঁড়ায়। এক মহিলাকে সে বলে, আমাকে কিছু কাজ দেবে?

প্রস্তাবনা জানে, যারা ধান রুইছে তারা এখুনি হেসে উঠে বলবে----- তুমি নাই পারবে আমাদের মত কাজ করতে। তুমি বরং বসে থাকো। আমাদের কাজ দেখো।

ধান ক্ষেতের আলে শোয়ানো আছে এক শিশু। মা ধান রুইছে। শিশুকে দেখে প্রস্তাবনা বলে----- আমি কি ছোট্ট ছেলেকে নিতে পারি? তার মা বলে---- উ ঘুমাছে।

সে নদীর কাছে আবার এসে দাঁড়ায়। মাছ ধরা যুবক তাকে লক্ষ্য করছে। সেও ভাবছে, মেয়েটি কোত্থেকে এলো? কত দূরে বাড়ি? মেয়েটির মনে কেন ঝড় উঠেছে? মেয়েটি কি কোনো বিষয়ে আঘাত পেয়েছে? যুবক দেখছে, প্রস্তাবনা জলের কাছে নেমেছে। আস্তে আস্তে সে বুক জল অবধি নেমে গেছে।

যুবক চিৎকার করে বলে------ আপনি উঠে পড়ুন উঠে পড়ুন। জল থেকে উঠে পড়ুন। হঠাৎ বান এলে আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রস্তাবনার কানে যায় না কথা। সে একা একা জলের সঙ্গে খেলা করছে। সে ভাবছেও ,এবার নিশ্চয়ই ঝড় থেমে যাবে। কিন্তু না, ঝড় বরং তাকে আরো বেশি অস্থির করে ফেলছে।

না---পাওয়া গুলি কি বড় হয়ে উঠছে বারবার? তার জীবনে? সে নদীর জল থেকে ভেসে যাওয়া শ্যাওলা তুলে মাথায় রাখে। ভেসে যাওয়া গাছের ডাল , পাতাপুতা মাথায় রাখে।

মাছধরা যুবক দেখতে দেখতে ভাবে, মেয়েটি কি পাগল হয়ে গেল?

সকালেই ঘন মেঘ। বৃষ্টি নামবে এখুনি। মেয়েটিকে জল থেকে তুলতেই হবে। নইলে বিপদ। সে জাল তুলে পাড়ে রাখতে যাবে যেই, বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। যুবক দৌড়াতে দৌড়াতে এসে প্রস্তাবনাকে ডাকে। আপনি বিপদ করবেন দেখছি-----দেখছেন না বৃষ্টি এলো। নদীর জল আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আপনি উঠে আসুন।

প্রস্তাবনা শোনে না যুবকের ডাক। আর কোনো উপায় না দেখে, যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। তখন নদীর জল বৃষ্টির জল প্রস্তাবনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যুবকের ভয় এই বুঝি মেয়েটিকে আর রক্ষা করা যাবে না। সে সাঁতার দিতে দিতে প্রস্তাবনাকে ধরে ফেলে। ধমক দেয়। আপনি তো এখনই মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছিলেন। কি ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছিলেন নিজেই। যুবক প্রস্তাবনাকে পাঁজাকোলা করে পাড়ে নিয়ে আসে । বলে------আপনি বাড়ি ফিরে যান। না আমি বাড়ি ফিরবো না। আপনি আমার ঝড় থামিয়ে দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে আপনাদের বাড়ি যাবো।

-----৩১  আষাঢ়১৪২৮
-----১৬----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার









বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

জন্মদিন / নির্মল হালদার

জন্মদিন / নির্মল হালদার



আজ বিহুর জন্মদিন।

নন্দিনী বিহুকে আসতে বলেছিল তাদের বাড়িতে। কিন্তু বিহু আসবে না। বিহু বলে------যা হবে রাস্তায় হবে। রাস্তাই একমাত্র রাস্তা দুহাত খুলে দেয়। টেনে নেয় বুকে।

নন্দিনী আর কি করবে! সে বাড়িতে পায়েস রান্না করে একটা পাত্রে তুলে নিয়ে ছাদে রেখে দেয়। পায়েসের গন্ধ হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে। সবাই জানুক আজ বিহুর জন্মদিন।

নন্দিনীর সঙ্গে বিহুর আজকাল দেখা সাক্ষাৎ হয় না। দুজনেই চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। যেটুকু কথা হয় ফোনে ফোনে। সেও সপ্তাহে এক আধদিন।

কেউ কাউকে বিয়ের প্রস্তাব না দিলেও সম্পর্কটা থেকে গেছে। ধারাবাহিক। সেই কলেজ জীবন থেকে। তো সেই সম্পর্কের এবং ভালোবাসার আজ আরেকটি দিন। বিহুর জন্মদিন।

নন্দিনী পায়েস রান্না করেছে।

সে সকালেই পায়েসের পাত্র ছাদে রেখে এসেছে। এখন প্রায় ১০টা বাজে। নন্দিনী ছাদে এলো। এসেই দেখতে পায়, কয়েকটা পায়রা খুঁটে খায় পায়েস।

নন্দিনী খুব খুশি হয়। তার মনে হয়, এই তো জন্মদিনের মেলা। এই তো আমি বিহুর জন্মদিন উদযাপন করছি। সে মনে মনে বলে ------ বিহু দেখে যা ----- তোর জন্মদিনে কারা এসেছে। সে চার দিকে তাকিয়ে একটা কাক দেখতে পেলো না। তার দেখতে ইচ্ছে করছিল, কাকও খুঁটে খাচ্ছে পায়েস।

বাতাস তো পায়েসের গন্ধ নিয়ে গেছে। কাক এলেও ভালো লাগতো নন্দিনীর। সঙ্গে আরও শালিক--চড়ুই।

জন্মদিন তো সবাই মিলেই উদযাপন করবে। উদ্দীপ্ত হবে। বিহু এলে দেখতে পেতো, তার জন্মদিনের সমারোহ।

নন্দিনী মনে মনে বিহুকে জিজ্ঞেস করে-----পায়েসের গন্ধটা কেমন লাগলো বল? তোর জন্মদিনে আমাকে তো কিছুই দিলি না, আমি অবশ্য মনে মনে তোর কাছ থেকে নিয়েছি হাতের স্পর্শ।

হাতটা তুই বাড়িয়ে না দিলেও তোর হাতের স্পর্শ আমি চিনি। তোকে কি চিনেছি? তুই কাছে থেকেও কাছে নেই। যেমন যে কোন গাছ সামনে থাকলেও চেনা যায় না। গাছ অচেনা থাকে বলেই রহস্যময়
তুইও রহস্যময় ---- বিহু।

যেদিন তোর মাথা আমার বুকে ছিল সেদিন তোকে চেনা যায় নি। আজ চিনতে গেলে কি আর চেনা যাবে?
অনেক দেরি হয়ে গেল বিহু।

পায়েসে কতটা দূধ কতটা চিনি আছে, তুই কি বলতে পারবি? একটা পায়রা এসে বলে দেবে, কিছুই না থাক, আমার সর্বস্ব আছে। আজ বিকেলে একবার দেখা হলে ভালো লাগতো আমার। নন্দিনী জানে, দেখা হবে না। তবু মন মানে না। মনে হয়, দেখা হলে বলবে-----এই চল্ এই বর্ষার দিনে আমরা গাছের চারার সঙ্গে নিজেদের রোপন করি মাটিতে। যদি আরেকটা জন্ম হয়? জন্মের সুবাস ছড়িয়ে পড়বে নতুন করে।

নন্দিনী ছাদের খোলামেলা রোদে দু' হাঁটুর মাঝখানে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে।


----৩০ আষাঢ় ১৪২৮
----১৫---৭----২০২১
----নির্মল হালদার








কবিতা / নির্মল হালদার

কবিতা / নির্মল হালদার




১৪৩.
পথ তো নিজেই পথের শিখা
পথের দিকে আমার যাওয়া।
পায়ে পায়ে শব্দ উঠছে
আগুন জ্বলবে আরো

আগুনের দিকে আমার যাওয়া

পায়ে পায়ে শব্দ উঠছে
পায়ে পা মিলিয়ে
আগুন জ্বলবে আরো
আলো জ্বলবে আরো

আলোর দিকে আমার যাওয়া।



১৪৪.
আকাশ যখন টলমল করে
আমি তখন স্থির থাকতে মিনতি করি।
মেঘে মেঘে আকাশ যখন ছটফট করে
আমি তখন আকাশ টাঙাই আমার বুকে

বৃষ্টি হলে আমার বুকেই হোক।


----২১আষাঢ়১৪২৮
----৬----৭---২০২১


১৪৫.
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলছি, 
মিথ্যে কথা বলবো না

শাদাকে শাদা বলছি
কালোকে কালো বলছি
ভালোবাসায় ওড়াচ্ছি হৃৎপিণ্ডের নিশান

সত্যি কথা বলতে কি
আমার হৃৎপিণ্ডের তাপে তৈরি করছি
আরেক উত্তাপ।


----২৩ আষাঢ়১৪২৮
----৮---৭---২০২১


১৪৬.
যা আছে 
যত টুকু আছে
এই আমার খুদকুঁড়ো
তুমি নাও।


যদি চাও
আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা
এই নাও

আমি ভিজিয়ে দেবো আমার চোখের জলে।


----২৫ আষাঢ় ১৪২৮
-----১০--৭---২০২১


১৪৭.
শরীর?
নদীও আমার শরীর।
মন?
নদীও আমার মন।

আমারই স্রোত বয়ে চলেছে
মানুষের দিকে।
আমারই স্রোত বয়ে চলেছে
সৃজনের দিকে।

সৃজন?
আমারই শরীর থেকে।
সৃজন?
আমারই মন থেকে।

তুমি ফসল তুলবে।


----২৬আষাঢ়১৪২৮
----১১---৭---২০২১



১৪৮.
আকাশও আমার অস্তিত্ব।
আকাশ যতক্ষন আছে আমার চোখ আছে।
আমার মন আছে। আকাশকে তাই
প্রতিদিন ধুয়ে রাখি আমার কান্নায়। কান্নাকে তাই
আগলে রাখি আমারই অন্তরে।

আমার আলোয়।


----২৬আষাঢ়১৪২৮
----১১---৭---২০২১


১৪৯.
তাল গাছের পাশ দিয়ে যেতে যেতে 
মনে পড়লো, খেজুর গাছ কেমন আছে? 
আজকাল খেজুরের রসে মন আছে তো?

বনতো ফুরিয়ে যায় ক্রমশ
 হরিতকী বহেড়ার খবর পাইনা।
 মেঘ এলে ময়ূর কি নাচে?
তাল গাছের পাশ দিয়ে যেতে যেতে
তালগাছ জানালো, কোনো দিকে
কেউ ভালো নেই। আস্তে আস্তে

ছোট হয়ে যাচ্ছে তাল গাছের ছায়া।



১৫০.
আমার বুকে রামধনু

আমার বুকে রামধনুর রঙ
কাকেই বা সাজাবো?
আমার বুকে রামধনুর মালা
কাকেই বা পরাবো?

আমি রঙহীন হয়েও রঙিণ আজ
আমি সাত রঙের সমুদ্র
আমার বুকে চিহ্ন আঁকে
ময়ূরপঙ্খী নাউ


২৮আষাঢ়১৪২৮
১৩----৭----২০২১


১৫১.
শিরদাঁড়া সোজা হলেই সাহস

একবার নয় সবসময়ের জন্য
শিরদাঁড়া সোজা হলেই সাহস

একবার নয় সব সময় হাঁটবো সোজা
সহজ রাস্তায় সহজ ভাষায়

আমার ভাষাও আমার মেরুদন্ড
আমাকে করেছে টানটান, সোজা

আমি সাধাসিধে কথা বলবো

মুখ বন্ধ করবোনা।


-----২৯আষাঢ়১৪২৮
----১৪----৭----২০২১



১৫২.
নদীর চরে বকের সারি
মেঘের ছায়া
ঘাসের মুখে গরুর মুখ

এসবই আমার
এসব কিছুই নয় আমার

ধানের চারায় ফড়িঙ বসে
জমির জল হাওয়ায় কাঁপে
আলপথে পায়ের ছাপ

এসবই আমার
এসব কিছুই নয় আমার

কথা বলছে চাষার বেটা
মেঘ ডাকে আপন মনে
বাঁশবনে হাঁসের ছানা

এসবই আমার
এসব কিছুই নয় আমার

দিনরাত্রিকে আমার প্রণাম


-----২৯আষাঢ়১৪২৮
----১৪----৭----২০২১
-----নির্মল হালদার












কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ