রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২২

পর্যটন বাণিজ্য



পর্যটন বাণিজ্য
-----------------------

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে পর্যটন শিল্পে পুরুলিয়া জেলা জায়গা পেয়ে গেছে। পুরুলিয়ার মানুষের কাছে সুসংবাদ হলেও পুরুলিয়ার জনগণের কোনো লাভ নেই।

পুরুলিয়ার কোনো সাধারণ নাগরিক অযোধ্যা বেড়াতে যাবো বললে, দু একদিন ছুটি কাটিয়ে আসবার চিন্তা করলে, তাকে অযোধ্যা থেকে ফিরে আসতে হবেই। কারণ, সরকারি সহায়তায় যে সমস্ত হোটেল লজ রিসর্ট অযোধ্যার মাথায় গজিয়ে উঠেছে সেইসব জায়গায় থাকা সম্ভব হবে না। ভাড়া অনেক।প্রতিদিনের ভাড়া অনেক। তারপরে খাওয়া-দাওয়ার খরচ আলাদা।

আমার অনেক আত্মীয় বন্ধু অযোধ্যায় থাকার জন্য গিয়েও ফিরে এসেছে। তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, প্রতিদিন মাথা পিছু খরচ শুধু থাকার জন্য ২০০০ টাকা।

অধিকাংশ হোটেলগুলি তৈরি করেছে বহিরাগতরা। যাদের সঙ্গে পুরুলিয়ার শিকড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ আমরা শুনি , গণমাধ্যমে প্রচার হয়েও থাকে, আমাদের সরকার হোম স্টে করার জন্য গ্রামের মানুষদের সহযোগিতা করছে। 

তা যদি হতো, গ্রামের মানুষ দু এক পয়সা লাভের মুখ দেখতে পেতো অবশ্যই। কিন্তু তার বদলে ছবিটা অন্যরকম। স্পষ্ট হয়ে গেছে, হোটেল ব্যবসায়ীরা টুরিস্টদের (যাদের হাতে পয়সা আছে অনেক) কথা চিন্তা করে কেবলমাত্র ব্যবসা করছে। পাশাপাশি হোটেল ব্যবসা থেকে নোংরা হচ্ছে চারপাশ। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

অযোধ্যা জঙ্গলের ভিতরেও (এখনো যেটুকু জঙ্গল বেঁচে আছে) বনভোজন, টুরিস্টদের খানাপিনা থেকেও  নোংরা হয়ে যাচ্ছে অযোধ্যা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি।

পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে সভা সমিতি হলেও কাগজে কাগজে লেখালেখি হলেও বোকা বাক্স থেকেও গাল ভরা বাণী উচ্চারণ হলেও সচেতনতার কোনো চিহ্ন দেখতে পাই না  কোথাও।

দুঃখের বিষয়, ফুটিয়ারি জলাধারের পাড় ঘেঁষে সুউচ্চ
বাড়ি বা রিসর্ট সম্প্রতিকালেই তৈরি হয়েছে। একটা হোটেল নয় সারি সারি অনেক হোটেল ফুটিয়ারির সৌন্দর্যে তৈরি করেছে ক্ষত। দ্বারকেশ্বর নদীর কাছাকাছিও গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্পের আরেক বাণিজ্য কেন্দ্র।

কেউ বেড়াতে গেলে সেই রিসর্টে যদি খাওয়া-দাওয়ার কথা ভাবে, তাহলে তাকে মাথাপিছু সাড়ে ৩০০ টাকা দিতে হবে।

এই রিসর্ট করেছে একজন বহিরাগত। বহিরাগত সুভদ্র মানুষটি একবারও চিন্তা করে দেখেননি, পুরুলিয়া একটি গরিব জেলা। এখানের মানুষও বেড়াতে আসতে পারে। দেখতে পারে, কতটা উন্নতি হল পুরুলিয়ার। 

শুধু পুরুলিয়ার কথা বলছি কেন, পশ্চিম বঙ্গের যে কোনো জেলা থেকেই যে কোনো মানুষ বেড়াতে আসতেই পারে এবং এসে হোটেলের ভাড়া বা খরচ দেখে পালিয়ে যেতেও সময় লাগবে না তাদের এ বিষয়ে কি হোটেল মালিকরা চিন্তা করেছেন? হোটেল মালিকরা শুধু চিন্তা করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাওয়ালা টুরিস্টদের বিনোদন। সেই বিনোদনের আরেকটি অংশ, আদিবাসীদের নাচ গান টুরিস্টদের দেখিয়ে লাভজনক বাণিজ্য।

পর্যটন শিল্পের নামে যে ধরনের বাণিজ্য তার সঙ্গে রাজনীতির খেলা যা চলছে, পুরুলিয়ার জনগণ একদিন ধরে ফেলবেই। উৎখাত করবেই,  কুৎসিত ব্যবসা।

এ বিষয়ে সরকার কতটা এগিয়ে আসবে আমাদের জানা নেই। আমরা জানি, মাটির বাড়ি দেখিয়ে খড়ের চালা দেখিয়ে, পলাশ ফুল দেখিয়ে, ছো টুসু দেখিয়ে টুরিস্টদের ডেকে এনে লোভের বাণিজ্য । যা পুরুলিয়ার জনগণের কাছে অশ্লীল থেকে অশ্লীলতম। এক শোষণ ছাড়া কিছুই নয়।


-----নির্মল হালদার 
-----১৬---১০---২০২২




পর্যটন বাণিজ্য---২

পুরুলিয়ার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে পুরুলিয়ার ব্যবসায়ীও হোটেলের কারবার করছে। সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরাও পুরুলিয়ার মানুষের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করে না। পুরুলিয়ার মানুষও যেতে পারে বেড়াতে, ব্যবসায়ীদের মাথায় থাকে না। তারা পুরুলিয়ার বাইরের টুরিস্টদের কথাই চিন্তা করে বেশি। যারা এলে মুনাফা হয় অনেক।

এক্ষেত্রে পুরুলিয়ার বাইরে থেকে যারা ব্যবসা করতে এসেছে, তারা যেমন দোষী, তেমনিভাবে পুরুলিয়ার ব্যবসায়ীরাও একই দোষে দোষী।

দুপুরে ভাত খেতে হলে মাথাপিছু খরচ যদি সাড়ে তিনশো টাকা হয়, পাশাপাশি ১০০ টাকা খরচেও একজন খেতে পারবে এই ব্যবস্থাও থাকা দরকার।

হোটেলে একটা ঘরের জন্যে যদি ২০০০ টাকা লাগে, পাশাপাশি কেন থাকবে না ৮০০ টাকায় একটা ঘর?

যাদের পয়সা আছে তাদেরই কেবল বেড়াবার মতো মন আছে, এই ধারণা যদি হয় ব্যবসায়ীদের, তবে তা ভুল।

আমার এক বন্ধু পুষ্পেন সরকার তার দুর্গাপুরের বন্ধুদের নিয়ে অযোধ্যা বেড়াবার জন্য পরিকল্পনা করেও আসতে পারেনি। শুধুমাত্র অনেক বেশি খরচের ভয়ে। একইভাবে পঞ্চকোট বেড়াবার কথা মনে এলে, একজন সাধারন মানুষকে ভাবতে হয়, পকেটে কত টাকা আছে।

সমস্ত পর্যটন কেন্দ্র গুলি যদি বড়লোকদের জন্য হয়, তাহলে পুরুলিয়ার মানুষ  , যে কোনো জায়গার যে কোনো সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে বেড়ানো থেকে।

একজন সাধারণ চাকুরে, একজন সাধারণ ব্যবসায়ীর ইচ্ছে হতেই পারে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাবে পুরুলিয়ার কোথাও। তারপর খোঁজ খবর করে দেখতে পায়, হোটেল, খাওয়া দাওয়া, বেড়ানো সমস্ত নাগালের বাইরে। এ বিষয়ে প্রশাসন নীরব।

পুরুলিয়ার মানুষ হয়েও পুরুলিয়াতে বেড়াতে হলে
আরেক জটিলতা, গাড়ি। শহর পুরুলিয়াতে গাড়ি আছে দেদার তার ভাড়াও দেদার। আমার ভাইপো তার পরিবার নিয়ে শীত এলেই অযোধ্যা যাওয়ার পরিকল্পনা করে। এবং প্রতিবছরই তাদের বেড়াবার মতো একটি মন ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে। হতাশা থেকে তার ছেলেমেয়েদের মুখও কালো হয়ে যায়।
শুধু অযোধ্যা নয় গড় পঞ্চকোট বড়ন্তি রঞ্জনডি যেতে হলে দশবার ভাবতে হবে, টাকার জন্য। সম্প্রতি পুরুলিয়ার পর্যটন মানচিত্রে পাহাড়পুর নামে একটি কেন্দ্র চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে পুরুলিয়ার পর্যটন যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, ভয় করছে , কোনোদিন হয়তো তিলাবনি পাহাড় কেটে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। ভয় করছে, সিঁদুর পুরের পাহাড় কেটে পর্যটন কেন্দ্র হলে সিঁদুর পুরের নির্জন সৌন্দর্যের ক্ষতি হয়ে যাবে সম্পূর্ণ। এরই মধ্যে একদল মুনাফাখোর
তিলাবনি  পাহাড় কেটে দামি পাথর খোঁজার পরিকল্পনা করছিল। গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের ফলে সেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।

টুরিস্টদের কাছে বাগমুন্ডির কাছে পাখি পাহাড় একটি দ্রষ্টব্য স্থান। বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন এক চিত্রকর প্রশাসনিক সহায়তায়  একটি পাহাড় খোদাই করে পাখি পাহাড় করতে চেয়েছিল। শেষ অব্দি তা না হয়ে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে কিছু ক্ষত। সেই ক্ষত থেকে রক্তপাত। নিঃশব্দে। যে শোনার শুনতে পায়।

জয়চন্ডী পাহাড়ের দিকে চোখ পড়লেই দেখতে পাওয়া যায়, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিভিন্ন রকম কটেজ। আমাদের শহরের বন্ধু নাট্য কর্মী সুদিন অধিকারীর ভাষায়-----টুরিস্টরা কটেজ থেকে হাত বাড়িয়ে পাহাড় ছোঁবে। তাদের মনোবাসনার কথা চিন্তা করেই, সরকারের এই পরিকল্পনা। যা কুৎসিত।

আমার আগের প্রতিবেদনে হোমস্টের কথা বলেছি, সেও এখন দালাল চক্রের আওতায়।

পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত জায়গা গুলি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ও বিখ্যাত সে সমস্ত জায়গার আদিবাসীদের ঘর নিয়ে হোমস্টের নামে রমরমিয়ে চলছে দালাল চক্রের ব্যবসা। 

ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে নিশ্চয়ই। ব্যবসা -বাণিজ্য আমাদের জীবনেরই এক দিক। বাঁচার এক রাস্তা। সেই ব্যবসা বাণিজ্য মানুষের ক্ষতি করে নয়। কেননা,
মানুষকে ডিঙিয়ে  কোনো কিছুই গড়ে উঠতে পারে না।

পুরুলিয়া শুধু মহুয়ার দেশ নয়। পুরুলিয়া শুধু পলাশের দেশ নয়। পুরুলিয়া শুধু ছো--টুসু--ভাদুর দেশ নয়। পুরুলিয়া মানে মানুষের দেশ। সেইসব মানুষদের জানার জন্য কজন টুরিস্ট আসেন, আমার জানা নেই।

আমার আরেক বন্ধু বিবেক সেন বলছিল, কতশত বছর ধরে এই দেশের তীর্থস্থান গুলি, দ্রষ্টব্য স্থানগুলি  নষ্ট হয়ে গেছে শুধুমাত্র সরকারি পরিকল্পনার অভাবে।

নষ্ট হবে না, আমাদের সরকার যদি পর্যটন কেন্দ্র থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে হোটেল ও রিসর্ট করার আইনি ব্যবস্থা করে। তাহলে, পর্যটন কেন্দ্রের বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলির ক্ষতি হবে না। টুরিস্টরা দেখেই চলে যাবে নিজের নিজের হোটেলে।

ছবিটা একদম উল্টো, অযোধ্যার মাথার উপরেই সারি সারি ছোট বড় হোটেল। গড় পঞ্চকোট শেষ হয়ে আসছে। জয়চন্ডী পাহাড়ে আর পাহাড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ হবে বলে মনে হয় না। 

মুনাফাখোর যারা তারা বন বিভাগের জমিও দখল করে হোটেল ব্যবসা ফাঁদার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সব সময়। যেভাবে ফুটিয়ারিও শেষ হয়ে গেল।

প্রশাসনিক মদতে   আমার দেশের অনেক জায়গা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শেষ হয়ে যাবেই, তার কু লক্ষণ
দেখতে পাচ্ছি সর্বত্র।

-----১ লা কার্তিক ১৪২৯
----১৯---১০---২০২২
-----নির্মল হালদার











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ