ফুটিফাটা মাটির দীর্ঘশ্বাস
--------------------------------
গৌতম
অনেক অনেক দিন আপনার সঙ্গে কথা হয়নি। ফোন করলেই শুনতে পাই, বন্ধ আছে।
সাধারণত আপনি এরকম করেন না। যখনই ফোন করেছি ওপার থেকে শুনতে পেয়েছি------
স্যার বলুন?
আমিও আপনাকে "স্যার "
সম্মোধন করেছি ফোনে। আমাদের বন্ধুত্বের কাছে
এই "স্যার "শব্দটি নিখাদ ভালোবাসার।
আপনার ভালোবাসা নিয়ে বন্ধুত্ব নিয়ে আজ অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে।
আপনার সময় আছে শুনবেন?
আপনি তো সব সময় ব্যস্ত আপনার অফিস নিয়ে সংসার নিয়ে লেখাপড়া নিয়ে। আমি তার একদম উল্টো। কিসুই করি না।
বাংলাবাজারে আমার একটা সুনাম আছে আমি পড়াশোনা করি না। কি আর করবো বলুন?
ছোটবেলা থেকে এখনো একই রকম রয়ে গেলাম।
পড়াশোনা করি না বলে, আমাদের সমসাময়িক এক কবি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি মঙ্গলাচরণ পড়েছি কিনা?
আমি তার প্রশ্নে নীরব ছিলাম।
স্যার, আজ একটা কথা বলি আপনাকে, আপনি নিশ্চয় জানেন, আমাদের দেশে একসময় মুখে মুখে গান রচনা হয়েছে।
আমাদের পুরুলিয়াতেও গরু চরাতে চরাতে বাগালরা মুখে মুখে সৃষ্টি করে গেছে ঝুমুরের পদ।
আমি সেই রকমও কিছু নই।
মায়ের পেট থেকে পড়ে মাটি যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি আকাশ। সেই আকাশে তারা দেখতে দেখতে আমার অক্ষর পরিচয়।
স্যার, এ কি আমার দোষ?
আপাতত দোষ গুণের কথা বাদ দিন। আমি জানতে চাই, আপনি কেমন আছেন?
আপনাদের বাড়িতে এখনো কি সেই পিয়ানোটা বাজে?
মনে পড়ে, প্রথম আপনার বাড়িতে যাচ্ছি। সন্ধের অন্ধকার। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই একটা পিয়ানো ।
যা আমি বাংলা সিনেমাতেই দেখেছি। আগে। সেই যন্ত্রশিল্পটি আপনার ঘরে দেখে জানতে চাইলাম-----কে বাজায়?
আমার যতদূর মনে পড়ছে, আপনি বলেছিলেন , আপনার মা।
আমার মনে হয়েছিল, আমাদের ঘরে
একটা হারমোনিয়ামও বাজে না।
স্যার, কিছু মনে করবেন না
আপনার চেহারা পোশাক-আশাক
আপনার আচরণ আপনার বাড়ি
সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছাপ।
অথচ আমার মত গ্রামের মানুষের সঙ্গে আপনি খুবই সহজ।
সুন্দর বললেও ক্ষতি নেই।
তখনো ব্যাংকের চাকরিতে প্রবেশ করেননি। একটা সিগারেট কোম্পানিতে আছেন।
আপনার মনে আছে, কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা যখন প্রেসিডেন্সির সিঁড়িতে আড্ডা মারছি, আপনি আপনার অফিস থেকে দেরি করে আসতেন আড্ডায়। এবং আপনাকে দেখে সবাই একসঙ্গে বলে উঠতাম----
এবার সিগারেট পাওয়া যাবে।
তখন তো আমাদের বন্ধুরা প্রায় সবাই বেকার। কারোর কাছে সিগারেটের পয়সাও থাকতো না। তখন আপনিও বেশ সিগারেট খেতেন।
আপনার মনে না থাকতেই পারে,
আপনার প্রথম কবিতার বই---
" অন্নপূর্ণা ও শুভকাল " আপনার হাত থেকে পাইনি।
বইমেলার মাঠে পার্থদা আমাকে দিয়েছিলেন। তারপর পুরুলিয়া ফিরে বই সম্পর্কে দু' এক কথা লিখে আপনাকে চিঠি লিখেছিলাম।
তার অনেক পরে আলাপ। মুখোমুখি।
ইদানিং আমরা মুখোমুখি না হতে পেরে, ফোনে কথা বলি। কখনো খুব গভীর কথা। কখনো রসিকতা।
আপনার সঙ্গে কখনোই কোনো বিষয়ে আমার বিতর্ক হয়নি। তার কারণটা বোধ হয়, কী বিষয় নিয়ে বিতর্ক করবো?
কোনো বিষয় তো আমার জানা নেই। একবার শুধু আপনাকে বলেছিলাম-----পৃথিবীতে একমাত্র শ্রেষ্ঠ কবিতার বই-----গীতবিতান।
আপনি না মেনে কোনো একটি
বিদেশি বইয়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
কি বইয়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন, আজ আর মনে নেই।
আমার স্মৃতি খুব দুর্বল।
তারই মধ্যে দু-একটা কথা বলি,
আমি দেখেছি, আপনার মধ্যে কোনো হতাশা নেই। আমি একবার বলছিলাম, কি যে চারদিকে লেখা হচ্ছে, আমার ভালো লাগছে না।
আপনি বলেছিলেন, এ তো সব সময় হয়ে থাকে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গ্রাম বাংলায় অনেক তরুণ অনেক ভালো লিখছেন।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আপনি সব সময় গ্রাম বাংলার দিকে লক্ষ্য রাখতেন, কোথায় কি লেখা হচ্ছে। কে কেমন লিখছে।
তাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল। নৈকট্য ছিল। আপনি অনেক তরুণের বই নিয়ে কোথাও কোথাও লিখেওছেন।
আপনার মনে পড়ে স্যার------
আপনার বেলগাছিয়ার বাড়িতে
খাওয়া-দাওয়ার পর আপনি আমার কবিতা শুনতে চাইতেন। কবিতা পর্ব শেষ হলে আপনি আমাকে বলতেন, এবার আপনি শুয়ে পড়ুন।
আর আপনি?
ঘরের আলো নিভিয়ে আপনার পড়ার টেবিলের আলো জ্বালিয়ে আপনি পড়তে বসতেন। টেবিলে থাকতো এক কাপ কফি।
কফি কেন?
আমি এ সমস্ত বিষয়ে অনভিজ্ঞ।
আপনি জানিয়েছিলেন, কফি খেলে ঘুম আসে না।
তখনো আপনার সঙ্গে শম্পা বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন নি। তখনো মাসিমা মেসোমশাই।
মাসিমার সঙ্গে কথা বললেও মেসোমশাইয়ের সঙ্গে আমার কোনোদিনই কথা হয়নি। তিনি খুব রাশভারি মানুষ ছিলেন।
আচ্ছা স্যার বলতে পারবেন,
আপনার সঙ্গে আমার কেন বন্ধুত্ব হলো? যদিও আজ আর এই প্রশ্নের কোনো অর্থ নেই। তবে এখানে একটা কথা বলে দিতে চাই, আপনি না থাকলে অনির্বাণ না থাকলে, আমার "সীতা" কাব্য পুস্তিকাটি আলোর মুখ দেখতো না।।
এই বইটি থেকেই আমার পরিচিতি।
তাহলে বলা যেতেই পারে, আপনি আর অনির্বাণ আমাকে আবিষ্কার করলেন।
তারপর তো আমার অনেক কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি আপনি তৈরি করে দিয়েছেন। আমি এ বিষয়ে আপনার উপর নির্ভর করতাম।
আপনাকে চিঠিও লিখেছি অনেক। আপনিও জবাব দিয়েছেন সব সময় পোস্ট কার্ডে।
আপনার ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরগুলি
নাকছাবির মতো জ্বলজ্বল করতো।
পড়তে বা বুঝতে কোনো সমস্যাই হতো না।
আসলে, আপনি মানুষটাও সমস্যা করেননি কখনো। বরং কারোর সমস্যা হলে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
৮০ র দশকের শেষে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। অপারেশনের দিন আপনি একা পুরুলিয়াতে এসে হাজির।
সন্ধেবেলা আমার জ্ঞান ফিরতেই আমি খোঁজ করছি, গৌতম কোথায়? গৌতম?
গৌতম ---স্যার
দিন চলে যায়। দিন আসে।
আমাকে এক কবি বললেন----এসময়ে একমাত্র ধ্রুপদী কবি গৌতম বসু।
আমি তাকে বলেছিলাম, আমি ধ্রুপদী জানি না। আধুনিকতা জানিনা। উত্তর আধুনিকতাও জানি না। অতি সম্প্রতি কালের উত্তর উত্তর আধুনিকতাও জানি না। আমি জানি, গৌতম বসু একজন কবি।
হাসবেন না স্যার। আমি এ কথা বলতে পেরেছিলাম। কোনো কবিকে কোনো একটি শব্দে চিহ্নিত করা কিংবা দেগে দেওয়ার বিপক্ষে আমি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় মানেই পদাতিক কবি , বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মানেই বিপ্লবী কবি আমি এ সমস্তর বিরোধী ।
এই কাজগুলো শুধু মিডিয়া করে না, ছোট কাগজের জগতও করে থাকে। ভুল প্রচার ও সংকীর্ণতা ক্ষতি বৈ লাভ করে না।
আপনি যে আমাকে কত বই উপহার দিয়েছেন, আপনি নিজেই জানেন না। আমি দিয়েছি গ্রামীণ হাট থেকে সংগ্রহ করা একটি কাঠের চিরুনি। একবার।
লোক জীবনের শিল্পকলা ছিল আপনার খুব প্রিয়।
একবার আপনাকে ঢোকরা শিল্প উপহার দিতেই আপনি আমাকে বলেছিলেন, আমাদের দেশের শিল্প আমরা চিনতে পারিনি। ব্রিটিশরা এসে চিনিয়ে দিয়ে গেছে।
আপনার পড়াশোনার বহর এতটাই। আমি শুধু ছোটোখাটো রয়ে গেলাম আপনাদের কাছে।
ছোটোখাটো বললে কম বলা হয়
আমি ধুলিকণাও নই। আমার সতীর্থরা অনেকেই আমার বন্ধু। যারা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
বলতে পারি, আমি একজন বন্ধুজীবী।
স্যার, এ বছর তো বর্ষা এলোনা এখনো। খরা হলে আমরা কি চুপচাপ ঘরে বসে থাকবো?
আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে? ফুটিফাটা মাটির দীর্ঘশ্বাস শুনতে শুনতে উচ্চারণ করতে পারবো কি, শুভকাল ?
কোথায় আছি কোন্ কালে আছি আপনি জানেন। শিরদাঁড়া কতটা বেঁকে গেছে আপনি তাও জানেন।
আপনি জানেন, বাংলা কবিতার শিরদাঁড়া কোথায় কোথায় বিক্রি হয়ে গেছে।
আপনার ডালহৌসির অফিসের শিগগির যাব। আমাকে একটু সময় দেবেন। কয়েকটা কবিতা শুনিয়ে আসবো। আবারো আবারো দেখতে পাচ্ছি-------
আমাদের চোখের জল লোহা হয়ে গেছে।
স্যার, এ আমার হতাশা নয়।
আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
নীতি-নৈতিকতা আদর্শ মূল্যবোধ
সব হারিয়ে ফেলেছি।
আমার এই বকবকানি আজকের মত থামিয়ে রাখছি।
আপনি ভালো থাকবেন রাজেশ্বরীদের বাড়িতে।
-----৫ শ্রাবণ ১৪২৯
------২২----৭----২০২২
------নির্মল হালদার
গৌতম বসু
জন্ম : ১৩ মে ১৯৫৫
মৃত্যু : ১৮ জুন ২০২১
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
অন্নপূর্ণা ও শুভকাল ১৯৮১
অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে ১৯৯১
রসাতল ২০০১
নয়নপথগামী ২০০৭
স্বর্ণগরুড়চূড়া ২০১৩
মঞ্জুশ্রী ২০১৫
জরাবর্গ ২০১৮
সুকুমারীকে না বলা কথা ২০১৯
লয় ২০২১
জরাবর্গ ( পরিবর্ধিত সংস্করণ) ২০২২
কবিতাসংগ্রহ ২০১৫
গদ্যের বই
গদ্যসংগ্রহ ২০১৯
অনুবাদ
গিল্গামেশ কাব্য ২০২০
সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারসংগ্রহ ( গৌতম মণ্ডল সম্পাদিত) ২০২২
সম্পাদিত গ্রন্থ
শ্রেষ্ঠ কবিতা দেবদাস আচার্য
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা
স্মরণী ও সরণি : সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ডায়েরি
নির্বাচিত পত্রাবলী ( সটীক)
সাক্ষাৎকারসংগ্রহ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছবি সৌজন্যে : গৌতম মন্ডল






কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন