শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০২২

পায়েসের আলো



পায়েসের আলো
-------------------------

দোকান থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাবা এসে মায়ের কাছে জানতে চায়---- কি করছো গো ছোট বউ?
মা উত্তরে বলে----কি আর করবো
এইতো ঠাকুর পূজা করে উঠলাম।

বাবা আরো জানতে চায়----কি রান্না করবে তুমি?
মা বলে---আগে উনুনটা ধরাই।
তারপর ভাববো, ঝোল হবে না ঝাল হবে। নাকি শুধু ভাত ডাল পোস্ত?

মায়ের কথাবার্তা বাবার পছন্দ হলো না। বাবা চলে গেল দোকান দিকে। দোকানে খদ্দের দেখছে, আমার বড়দা।

বেলা ঢের হয়েছে।

শ্রাবণের দিন। সকাল দিকে বৃষ্টি ছিল। এখন গনগনে রোদ। বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। ঘাম জমছে খুব।

বাবার গায়ের গেঞ্জি ভিজে গেছে।

বাবা হঠাৎ ভাবলো, আর দুটো ছেলে কোথায়? স্কুল গেছে তো?
বড় ছেলে নারানকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে দোকানে ঢোকাতে হলো।
বাবা আর একা একা পেরে উঠছিল না।

চারটে মেয়ের মধ্যে তিনটে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছে। ছোট মেয়েটা এখন বেশ ছোট।

আর আমি বেশ ছোট হলেও 
আমাদের ঘরের সব দেখতে পাই।
সব শুনতে পাই।

মা কখনো কখনো লুকিয়ে কাঁদে।
আমি দেখতে পাই। কিন্তু কান্নার কারণ বুঝে উঠতে পারি না।

আমি তো পাড়ার এক স্কুলেই পড়ি। প্রতিদিন সকালবেলা।

বাবা আবার দোকান থেকে হড়বড়িয়ে ঘরে ঢুকে এক থলি সবজি মেঝেতে ঢেলে দেয়। আর মাকে ডেকে বলে---আজ সাত তরকারি রান্না করবে।

মা রাগের সুরে বলে----একহাতে অত রান্না করতে পারবো না। বাবা বলে----বড় বৌমা তো আছে, তোমাকে সাহায্য করবে।
মা এবার বেশ জোর গলায় বাবাকে জানায়---কয়লা নয় সব পাথর। উনুন ধরবে কিসে?
ডাল ভাতটা হয় কিনা দেখো?

কি কথা বলছো তুমি?
এই কথা বলে বাবা চলে যায় চৌকাঠের বাইরে। 
উনুনে পাখার হাওয়া দিতে দিতে
বৌদির চোখে ধোঁয়ার জল। দাদা দোকান থেকে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানতে চায়----অনেক বেলা হল গো---আমাকে কেউ দুটি মুড়ি দিলে না?
মুড়ি খেয়ে বাজার যেতে হবে একবার। বাবা বলেছে, মাছ নিয়ে আসতে।
মাছ তো আমি রোজ নিয়ে আসি।
বাবা জানে। তারপরও কেন বললো আজ মাছ আনতে? বেশি করে আনতে বলেছে। বেশি করে কেন? মা তুমি জানো?

মা ঘুঁটে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বৌদির হাতে দিয়ে বলে----আমি জানি না। আজ কি পরব।

উনুন ধরছেনা বলে, বৌদি উনুনে ঘুঁটে 
গুঁজতে থাকে। তার সঙ্গে কাঠের কুচো।

ছোটমামা এসে গেছে। সঙ্গে এক থলি মাছ। অন্যদিন মামা দুধ নিয়ে আসে। প্রতিদিন নিয়ে আসে। আজ দুধ নেই।

আমার ছোট মামা বাসের ড্রাইভার। মানবাজার থেকে পুরুলিয়ার বাস নিয়ে আসে।
আমাদের ঘরেও রোজ এসে মুড়ি খেয়ে যায়।
আমি খুব ছোট হলেও সব দেখতে পাই। সব শুনতে পাই।

বাবা একদিন বলছিল----ভাগ চাষী আর ভাগের ধান দিচ্ছে না।
ধান বিক্রি করে যে  আরো কিছু করতে পারবো, তার কোনো দিশা নেই।

তিন মেয়ের বিয়ের পণ দিতে দিতে যেটুকু জমানো ছিল শেষ হয়ে গেছে। দোকানেও তেমন পুঁজি পাটা নেই। 

মা গজগজ করে। বলে----তোমার ঘরে কুটুমের আনাগোনাও তো লেগে আছে। 
বাবা বলে----সে তো ভালো গো।
তুমি যদি তোমার রাঁধা ভাত কুটুমকে খাওয়াতে পারো পুণ্য হবে গো। পুণ্য।

মা বাবার কথার জবাব দেয়------
আজ কি দরকার ছিল এত শাকসবজির। এতেও তো বেশ পয়সা চলে যায়।
বাবা এবার হাসতে হাসতে বলে--
তুমি ভুলেই গেছো ছোট বউ, আজ তোমার ছোট বেটার জন্মদিন। আজ ২১ শ্রাবণ।

মায়ের গালে হাত। ওমা---এই দেখো আমি ভুলেই গেছি। সকালবেলায় বলবে তো, মন্দিরে পুজো দিতাম। সে হয় দিলাম না।
কিন্ত পায়েস তো করতে হবে। আজ দুধ নেওয়া হয়নি। বাছুরে সব দুধ খেয়ে ফেলেছে।

বাবা আবার হাসতে হাসতে বলে--
দাঁড়াও দেখছি। আমি বাজারে যাই।

আমি জানি, বাবা দুধ পাবে না।
এ সময় ময়রা দোকানেও মিষ্টির কাজ শেষ হয়ে যায়।

আমি ছোট হলেও সব জানি।

আমি শুধু মাকে বলতে পারলাম না, পায়েস ছাড়াই আজ ভাত খাব। তুমি শুধু ছোটবেলার মতো আমার কপালে চাঁদের টিপ দিয়ে দিও।
  
সারা ঘরে পায়েসের গন্ধ ছড়াবে।


----১৯ শ্রাবণ ১৪২৯
-----৫---৮----২০২২
------নির্মল হালদার




আরও পড়ুন












































কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ