যে কথা বলা হয়নি
-----------------------
রাত্রে গৌ চৌয়ের বাড়িতে ছিলাম।
সকালবেলায় তার অফিস যাত্রার সঙ্গেই আমিও যাব।
সেই রকমই কথা হয়েছে রাত্রিবেলায়।
আমাকে যেতে হবে রণজিৎ দাশের কাছে। তখন তার
"আমাদের লাজুক কবিতা" নিয়ে তুমুল হইচই।
কবিতার বইটি থেকে এক মুগ্ধতা শুরু হয়েছিল। মনে সাধ জেগেছিল, এই কবির সঙ্গে আলাপ করতেই হবে।
আমি তখন কলকাতার কিছুই চিনি না। গৌ চৌ তার পার্ক স্ট্রিট অফিসের কাছে আমাকে নামিয়ে
একটা বাসে তুলে দিলো।
আমাকে একাই যেতে হবে হাতিবাগান। রণজিৎ দাশের মেসবাড়ি।
বাস কন্ডাক্টরকে বারবার বলছি,
হাতিবাগান এলে আমাকে একটু নামিয়ে দেবেন।
এক সহযাত্রী আমার অবস্থা দেখে
বা বুঝতে পেরে বললেন, দেরি আছে ভাই। আপনি চুপচাপ থাকুন আমি আপনাকে নামিয়ে দেবো।
আমি মনে মনে আওড়ে যাচ্ছি---
মেঘ সে তো সংস্কৃত জানে না, জানে যতীনের বড় বোন।
এরকম কবিতার পংক্তি আগে পড়িনি। এই যে আরও একটি কবিতার পংক্তি-------
এই তো সময় উপহার আনো
জিহ্বা তরল, জলরাশি ক্ষার
খোলা কঙ্কন, অস্ফুট গলা এবং তোমার ভিতর শরীর।
অত্যন্ত স্মার্ট লেখা। নাগরিক লেখা। সেই যৌবন বেলায় আমি আলোড়িত। কিন্তু রূপক, উপমা সব বুঝে উঠতে পারছি না।
অথচ ভেতরে ভেতরে অনুরাগী হয়ে উঠেছি। আমি শুধু কেন, আমাদের সময়ের প্রায় সবাই
তখন রণজিৎ দাশের অনুরাগী হয়ে উঠেছিলাম।
সাধে কি আর অরণিদা ( সত্তর দশকের আরেক কবি ) লিখেছিলেন------- যত কবি রণজিৎ দাশ।
হাতিবাগান স্টপেজে নেমে এবার একটা কাজ মেসবাড়ি খোঁজা। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম।
রণজিৎদা তখন মেসে থাকলেও
তার নিজস্ব একটি ঘর ছিল।
আমার সঙ্গে মুখোমুখি হতেই,
তার নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ।
আমি তখনই "আমাদের লাজুক কবিতা " র প্রতিটি কবিতার প্রতি ভালবাসা জানিয়ে তার কাছ থেকে অর্থ জানতে চাইছি। যা যা তখন আমার বোধগম্য হয়নি। তিনিও হাসতে হাসতে আমাকে বলে দিচ্ছেন সব। তার আগে অবশ্য মেসের নিচে গিয়ে জিলিপি কচুরি আমাকে খাইয়েছেন। আমি যতই বলছি, গৌতমের বাড়িতে আমি ভাত খেয়ে এসেছি---------
তিনি শুনবেন না।
সেই সময় কারোর কবিতা পড়ে ভালো লাগলে কিংবা মুগ্ধতা তৈরি হলে,কবির সঙ্গে আলাপ করতে
ইচ্ছে করতো।
প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কাছেও
আমি ও সৈকত চলে গেছলাম।
শঙ্খ বাবুর শ্যাম বাজারের বাড়িতেও একা গেছি।
আবু সৈয়দ আইয়ুবের কাছে
আমি ও সৈকত একা একা।
বলতে ভুলে যাচ্ছি, রণজিৎদা আমার স্বাস্থ্য দেখে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কী ব্যায়াম করি?
আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলাম-------
না না।
তো রণজিৎ দার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। তার কাছ থেকে চলে আসার মুহূর্তে বললাম---চিঠি দেবো। উত্তর দেবেন তো?
তখনো রণজিৎদা চাকরি করছেন না। সম্ভবত ডাব্লিউবিসিএস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলেছে। চাকরি পেয়েছেন।
কলকাতা গেলে রণজিৎদার
অফিস চলে যাই। পকেট থেকে
খুচরো কাগজে লেখা কবিতা
তাকে শোনাই।
হিন্দি সিনেমার গল্প করি।
রণজিৎদা সিনেমার ভক্ত।
আমিও তাই।
তখন শাহরুখ খানের " ডর "
চলছে। আমার তিনবার দেখা হয়ে গেছে তাকে বলতেই বললেন, কাউকে বলবেন না।
তখন অনেক কবি হিন্দি ছবির
শ্রাদ্ধ করে । যদি তাদের জানাই,
শাহরুখ খানের অমুক ছবি দেখলাম, সবাই ছি ছি করবে। অতএব চুপ থাকা ভালো।
রণজিৎদা আমাকে একটি বিদেশি ছবিও দেখিয়েছিলেন নন্দনে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না কোন্ দেশের ছবি। মনে পড়ছে, তিনি আমাকে ইংরেজি সাবটাইটেলের তরজমা করে দিচ্ছিলেন।
আমি তো বাংলাটাই ভালো করে জানি না, তারপরে আবার বিদেশী ছবি। যাই হোক, আমাকে একবার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন।
রণজিৎদা, আপনার মনে আছে?
মাধবীলতায় জড়িয়ে থাকে শিশির। ঝরেও যায়। জাম পাতায় পোকা ওঠে। নেমেও যায়। এভাবেই সময়ের ওঠা নামায় আমরা আজ কেউ কারো সঙ্গে দেখা করি না। খোঁজখবর রাখার দরকার মনে করি না।
প্রত্যেকেই নিজ নিজ দ্বীপে নিজেরাই নির্বাসিত হয়েছি। সঙ্গে গীতবিতান থাকলেও অনেক কবিতাই সঙ্গে থাকবে আমার অন্তত।
রণজিৎদা কয়েকবার পুরুলিয়াও ঘুরে গেছেন। অত্যন্ত রসিক মানুষ। কবি তো অবশ্যই।
-----৩১ আষাঢ় ১৪২৯
------১৬----৭---২০২২
-----নির্মল হালদার
ছবি : সন্দীপ কুমার



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন