পার্থদা, দূরের সন্ধ্যা
-------------------------
যৌবনের দিনগুলিতে গৌ চৌয়ের
হাওড়ার কইপুকুর লেনে আমার একটা জায়গা ছিল।
পুরুলিয়া থেকে গেলেই সোজা গৌতমের বাড়ি।
হাওড়া স্টেশন থেকেও কাছে।
তখন তো কবিতা আর কবিতা।
তখন তো কবিতায় ফুটছি। শুধু কি ফুটছি? পুড়ছিও। এবং পুড়তে পুড়তে ইচ্ছে করছে
যতসব পুরাতন আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলি।
কলকাতা যাই কবিতার টানে।
বন্ধুদের টানে। বন্ধুদের ঘর আমারও ঘর হয়ে ওঠে।
গৌতমকে বললাম, আজ তোকে দেখিয়ে দিতেই হবে
কে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল?
কলকাতা থেকে দূরে থাকলেও
লেখালেখির শুরু থেকেই, আমাদের কাছে পৌঁছে যেতো
নতুন বই নতুন পত্রিকা।
আমরা পেয়ে গেছলাম পার্থপ্রতিম
কাঞ্জিলালের "দেবী "কবিতার বইটি। পেয়ে গেছলাম অমিতাভ গুপ্তর " আলো "। তারপরেই রণজিৎ দাশের " আমাদের লাজুক কবিতা "।
কলকাতা থেকে অনেক দূরে থাকলেও কবিতা সংবাদও আমাদের কাছে এসে পড়তো ঠিক ঠিক। কোনো কোনো বই নিয়ে
পাগলামিও করেছি। যেমন পার্থদার " দেবী "বইটি নিয়ে আমার সৈকত কল্লোল ও অশোকের মধ্যে তুমুল আলোচনা।
তখন আমাদের যা বয়স এবং কবিতা পাঠেরও যা অভিজ্ঞতা, দেবী বইটি সম্পূর্ণভাবে আমাদের বোধগম্য হয়নি।
কিন্তু কিছু একটা আছে যেন, ধরতে পারছি না।
গৌতমের সঙ্গে কফি হাউসে উঠছি। তাকে ছোট ছেলের মত একইভাবে বলে যাচ্ছি, পার্থ প্রতিম কাঞ্জিলালকে দেখিয়ে দিবি।
উঠেই, কফি হাউসের দরজা থেকেই গৌতম আমাকে দেখিয়ে দিলো----ওই যে দেখছিস ওই টেবিলে দু' তিনজনের সঙ্গে বসে আছে, সেই পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল।
রোগা ছিপছিপে এই মানুষটি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল !
ইনি দেবী লিখেছেন?
গৌতম আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো।
সেদিন টেবিলে আর কে কে ছিল
আজ আর মনে নেই। মনে আছে
আমি খুব নীরব ছিলাম। এক মুগ্ধতা নিয়ে গৌতমের সঙ্গে তার বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম।
চন্দ্র সূর্যের যাওয়া আসা চলে।
আমাদেরও বয়স বাড়ে।
পার্থদার সঙ্গে আমার নৈকট্য তৈরি হয়। ঘনিষ্ঠতা হয়। কফি হাউসে দেখা হলে, পকেট থেকে কবিতা বের করে কবিতা শোনাই।
পার্থদা তখনই আমার একটি কবিতা পড়তে পড়তে স্পেসের কথা বলেছিলেন।
তখন আমি কবিতায় স্পেসের ব্যবহার একদমই জানতাম না।
পার্থদা কবি হিসেবে যে উচ্চমানের সেই উচ্চতার মূল্য তিনি পাননি।
আমার সঙ্গে একবার আমাদের সময়ের এক কবির বিতর্ক হয়েছিল ফোনে। আমি বলেছিলাম, বাংলা কবিতায় পার্থ প্রতিম কাঞ্জিলাল এক বিরাট পর্বত। তিনি আমার কথা নাকচ করে বলেছিলেন, না। পার্থর চেয়েও বড় কবি অমুক এক কবি।
যে কবির কথা বলেছিলেন তিনি আলোক বৃত্তের তৈরি করা এক আলোক স্তম্ভ।
আমি আজও মানতে রাজি নই।
পার্থদা তো শুধু কবি ছিলেন না। তিনি আবিষ্কারও করেছিলেন অনেক কবি। পার্থদার কাছ থেকেই প্রথম পাই গৌতম বসুর অন্নপূর্ণা ও শুভকাল। হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নশ্বর অলীক যাতায়াত। মল্লিকা সেনগুপ্তের
চল্লিশ চাঁদের আয়ু। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে
আমার প্রথম ও দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। তারপর
ঘনিষ্ঠ হই গৌতম বসু ও অনির্বাণ লাহিড়ীর সঙ্গে।
এক সকালে গৌতম বসু আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন অনির্বাণের কাছে। আমাকে বলা হলো কবিতা পড়তে। আমার কবিতা শুনে তাদের উচ্ছ্বাস।
আজও মনে পড়ে।
তখনই অনির্বাণ ও গৌতম স্থির করলেন , আমার একটি এক ফর্মার বই করবেন। এবং দায়িত্ব দেবেন তারা পার্থদাকে।
হ্যাঁ, সেই বইয়ের প্রকাশক ছিলেন
পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল।
পার্থদা আমার কবিতা পছন্দ করতেন না করতেন না, তার সঙ্গে মেলামেশা করতে করতেও আমি স্পষ্ট করে কখনো বুঝতে পারিনি।
তবে আমার এক বন্ধু তরুণ কবি বন্ধু সজল রায় তার নিজ উদ্যোগে আমার একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিল।
বইটি হলো , " অন্ন যাত্রা "।
যা আমি পার্থদার কাছে ডাকযোগে পাঠিয়েছিলাম।
তার তখন প্রায় শরীর খারাপ হয়।
আমি ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম বইটি সম্পর্কে তার মতামত। তিনি বলেছিলেন-----
তোমার এই বইটি বাংলা কবিতায় একটি মাইলস্টোন।
মনে আছে কালীদাও প্রশংসা করেছিলেন।
বন্ধুরা মাফ করবেন, অনেক নিজের কথা বলে ফেলছি।
হাত দেখাচ্ছি পার্থদাকে। কফি হাউসের টেবিলে। তিনি তো তন্ত্র মন্ত্রেও বিশ্বাস করতেন। তার কাছে সে বিষয়ে কখনো কখনো দু'চারটে কথা শুনেছি।
তার সঙ্গে আমার কোনোদিন কোনো বিষয়ে বিরোধ হয়নি। তার কারণ হলো, পার্থদা বলতেন আমি শুনতাম। এও ঠিক , পার্থদার সঙ্গে আমি কোনোদিন একা একা আড্ডা দিইনি।
আমি তো সবসময়ই কারো না কারো সঙ্গে। হয়তোবা প্রসূন। হয়তোবা প্রবুদ্ধ প্রসূন। হয়তো বা অমিতাভ অনির্বাণ। কিম্বা গৌতম বসুর সঙ্গে আমি। আর তখন আড্ডা মানেই তো মধ্যমণি পার্থদা।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে। আরো এক আড্ডা। উৎপলদা আসতেন।
আমরা বন্ধুরা তো ছিলামই।
হ্যাঁ একরামও থাকতো।
একরামের সঙ্গে পার্থদার ঘনিষ্ঠতাও ছিল দেখবার মত।
তখনই একরামের কাছ থেকে পার্থদা বিষয়ে অনেক গল্প শুনেছি।
শঙ্খবাবুর শ্যামবাজারের বাড়িতেও দাঁতে নোখ কাটতে কাটতে মধ্যমণি হয়ে পার্থদার গল্প শুনেছি। রবিবারের কত কত সকাল।
পার্থদার চলে যাওয়ার সময় হয়নি। তার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে, বাংলা কবিতার অনেক অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।
যেকোনো রাস্তা থেকে একটি বটগাছের পতন হলে, তার ছায়ারও পতন হয়। এখানে আমি বলবো, পার্থদা অকালে চলে গেলেও তার ছায়া চলে যায়নি।
চলে যাবে না।
প্রচারিত কিংবা আলোচিত ছায়া
চলে যেতেই পারে। কেননা, সেই ছায়ার শীতলতা অথবা উষ্ণতা থাকে না কোথাও। বরং বলা যায় প্রচারিত ও আলোচিত ছায়া
ঔদ্ধত্যের প্রসারতা বাড়িয়ে চলে।
অমাবস্যা পূর্ণিমা আসে। তিথি নক্ষত্রের কথা আসে। পার্থদার কথাও আসে।
আসবেও।
যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলা কবিতা থাকবে।
-------৪ শ্রাবণ ১৪২৯
------২১----৭----২০২২
------নির্মল হালদার
জন্ম :১৯৪৯ মৃত্যু : ২০২০


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন