কাছিম
খুঁকড়ামুড়া একটি গ্রাম।
পুরুলিয়ার আরও পাঁচটা গ্রামের মতো একটি গ্রাম। প্রায় সমস্ত মানুষ চাষবাসের উপরে নির্ভরশীল। সেই সঙ্গে দিনমজুরি।
এই যে এখানে কাছিম মাহাতকে দেখতে পাচ্ছি,
সেও খুঁকড়ামুড়ার একজন বাসিন্দা। শ্রমজীবী মানুষ। বয়স হয়ে গেছে বলে শহরে কাজ করতে যেতে পারে না। নিজের গ্রামেই ছোটখাটো কাজ পেলে করে। মজুরি মাত্র
দেড়শো টাকা।
গ্রামেরই একটি ঘরে ভাঙ্গা হালের কাজ করতে এসেছে।
সেই কোন্ ছোটবেলায় কাছিম তার বাবার সঙ্গে কাঠের কাজ শিখেছিল। তবে সে চেয়ার টেবিল পালঙ্কের কাজ করতে পারে না। কারোর দড়ির খাটিয়ার খুরা ভেঙ্গে গেছে, কারোর হাল ভেঙ্গে গেছে মেরামত করে দেয়।
কপাট যদি নড়বড় করে , কাছিমকেই গ্রামের লোক ডাকে।
আজ গোবিন্দ মাহাতর ডাকে হালের মেরামতি করতে এসেছে।
বর্ষা এসে গেছে। চাষীদের ঘরে হালের দরকার। হাল মজবুত হলেই তল মাটি উপর করতে পারে।
কাছিম ভক্ত লোক।
সকালে উঠে স্নান করে দুর্গা থানে ধুপ দিয়ে তবে মুখে কিছু দেয়।
মুখে কিছু দেওয়া মানে এক জামবাটি মাড়ভাত। তারপর গাঁয়ের কুলিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
হয়তো কেউ এসে বলে তার ঘরের শিকলটা খুলে গেছে কিংবা জানলাটা নড়বড় করছে, চল্ রে ঠিকঠাক করে দিবি।
যদি এক ঘন্টার কাজ হয় মাত্র ৫০ টাকা মজুরি। সারাদিনের কাজ হলে দেড়শো টাকা।
এই কাছিমের একটাই ব্যাটা। ব্যাঙ্গালোরে চলে গেছে কাজ করতে।
পুরুলিয়ার বেশিরভাগ গ্রামের যুবকের দল দেশের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে চলে যায়। কারণ, অন্য রাজ্যে মাইনে বেশি। যে যেমন কাজ করতে জানে, সে অন্য রাজ্যে গিয়ে সেই কাজ জুটিয়ে নেয়।
এক বছরে কাজ করে যা সঞ্চয় করে বাড়িতে আসে। মকর পরবে।
দু' চার দিন ঘরে ফুর্তিফার্তা করে আবার চলে যায়।
কাছিমের ব্যাটা সেই কবে এসেছিল পরবে। আসছে পৌষ মাসে আসবে কিনা জানা নেই।
সেদিন ফোনে বলছিল কাজের চাপ বেড়েছে।
খুব দরকার ছাড়া ফোনও করে না।
ব্যাটার মা কান্নাকাটি করে। বিয়ে-শাদির কথা বললে, মুখ ফিরিয়ে থাকে ব্যাটা।
কাছিম ও তার বউ সন্দেহ করে ব্যাটা অন্য রাজ্যে অন্য জাতে বিহা করলো নাকি!
বর্ষার মরশুম হলে কি হবে, এবছর এখনো বৃষ্টির তেমন দেখা নেই । বীজতলা জলের অভাবে শুকিয়ে উঠছে। চাষীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
চাষ না হলে সারাবছর খাবে কি!
পুরুলিয়াতে এক ফসলি জমি।
তারপরে আবার বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। বর্ষা না হলে , গেল গেল রব।
কাছিম হালের কাঠ ছুলতে ছুলতে গোবিন্দকে বলছিল-----ই বছর একটা ব্যাঙও ডাকে নাই। হবেক নাই রে জল।
গোবিন্দ কাছিমের কথা ধরে বললো------জল হোক আর না হোক হাল তো জুৎ করে রাখতেই হবেক।
কাছিম বলে-----মা বসুমতি আমাদের উপরে এতটা নির্দয় হবেক নাই। মনে হয়। জল তো জরুর হবেক।
গোবিন্দ কাছিমের কাছে জানতে চায়-----হ্যাঁ ভায়া হামদের সাথে দু' পহরা করবে নাকি?
কাছিম বলে যদি ঘরে টুকু থাকে বেশি, দিবে ত দাও।
খাওয়া দাওয়া করে সজনে গাছে হেলান দিতেই কাছিমের ঝিমুনি এসে গেছে। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে দেখতে পায় একটা পালঙ্কের পায়া মেরামতি করছে।
ব্যাটার বিহা।
পালঙ্কে ঘুমাবে বউ ব্যাটা।
গোবিন্দ এসে ঠেলা দিতেই কাছিমের ভাত ঘুম ভেঙে যায়।
সে চোখ কচলে বলে ----চোখটা লেগে গেছলো হে-----।
গোবিন্দ একটা খাটিয়ার ভাঙ্গা খুরা এনে বলে------ কাছিম ভায়া ইটাও টুকু সেরে দিবে। হামি খাটে ছাড়া শুতে পারি নাই।
কাছিম দেখতে পায়-----তার বাবুই দড়ির খাটও ভেঙ্গে গেছে।
কাঠ চাই। বাবুই দড়ি চাই। বুনতেও হবেক। সব নতুন করে চাই। শুধু শরীরটা আর নতুন নাই।
-----৩ শ্রাবণ ১৪২৯
-----২০----৭----২০২২
-----নির্মল হালদার
ছবি : কল্পোত্তম













কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন