আমাদের ছোট নদী
------------------------
নদীর কাছে গেলেই নারীকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে।
নদীর কাছে গেলেই নৌকাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে।
নদীর সঙ্গে নারী ও নৌকা যুক্ত না হলে, নদী তার রূপে সম্পূর্ণতা পায় না।
আমাদের ছোট নদী।
নারী আসতে চায় না। জল থাকে না সাঁতার দেবার মত।
নৌকা আসে না। যেতে পারবে না
কাছে দূরে কোথাও।
আমাকে যেতেই হয় নদীর কাছে।
বৈশাখ মাসে হাঁটু জল না থাকলেও নদীর কাছে যেতে হয়।
নদীর সঙ্গে দেখা না হলে, নিজের সঙ্গে দেখা হয়না।
নদীর নিভৃত নির্জনতায় নিজের সঙ্গে কথা হয়।
কত কত যে কথা আমার, এক জনমে ফুরাবে না।
নদীর দু পারেই গ্রাম। ফসলের ক্ষেত। চারণভূমি।
কোথাও কোথাও নদীর বালিতে
চুঁয়া খুঁড়ে জলের সন্ধান করছে রমণীরা।
আমাদের ছোট নদীতে বারো মাস জল থাকে না। শুধু বালি আর বালি। ছুটে বেড়ায় খেলে বেড়ায় ছেলেমেয়েরা।
বর্ষার সময় ওই নিচের দিকের গ্রামের মানুষ মাছ ধরে। মাছ বিক্রি করে। তার আগে কোথাও কোথাও বড় বড় পাথর। যেন বা
গত জন্মের মানুষ ও পশুর হাড়গোড় পড়ে আছে। দেহ পড়ে আছে।
কারো কাছে দাঁড়ালে কি সাড়া পাবো? একবার কোনো গরুর ঠ্যাং পেয়েছিলাম। মরা ঠ্যাং। তবু মনে হলো, পায়ের শব্দ আসছে।
মনে হলো, পায়ের ক্ষুর থেকে এখুনি পাবো ঘাসের টুকরো। ধুলোমাটি।
আমাদের ছোট নদী। আমাদের সুখ দুঃখ। আমার শৈশব এই নদীতেই ভাসিয়েছিল কাগজের নৌকা। আমি তার পালতোলা
খুশি দেখতে পাবো বৈকি। আমি তার নীল আকাশ দেখতে পাবো বৈকি।
এই নদী দিয়েই তো বেহুলার ভেলা গেছলো স্বর্গের দিকে।
বেহুলা আমাদের ঘরের মেয়ে। তার নাকের নোলক একবার হারিয়ে গেছলো। আমি খুঁজে দিয়েছিলাম।
আমাদের ছোট নদীর কাছে
বেহুলার বেদনাও রাখা আছে।
বর্ষার সময় পাড়ে উঠে এসে
ফসলের রূপ ধারণ করে। যে ফসলের আনন্দ ধানের শীষের মত।
মাথা উঁচু করে থাকে।
যে ধানের দুধ রোদ হাওয়া পান করে। যে ধানের দুধ ঝরে পড়ে মাটিতে। যে ধানের দুধ সাপ এসে চেটে খায়।
আমাদের ছোট নদী । ছোট ছোট নুড়িপাথর । প্রাচীনকালের বেদনা হয়ে জলের সঙ্গে গড়ায়। থেমেও থাকে। চেয়ে থাকে আমার দিকে।
ব্যর্থতা ছাড়া আমার আর কিছু নেই।
ব্যর্থতা এক বিষয়।
কোনো সফলতা বিষয় হয়ে শিল্পের দিকে যায় না।
শিল্প সব সময় হাহাকার।
পাতারা কেঁপে ওঠে।
আমাদের ছোট নদী থেকে
গামছায় ধরেছি মাছ। মাছের খেলা। ছেড়েও দিয়েছি, জলে জলে খেলা দেখবো।
পায়ে জড়িয়ে গেছে শেওলা।
নদীর ভেতর থেকে উঠে আসছে ডাক-----নিমাই নিমাই------।
কে নিমাই?
এই নদী পথ দিয়েই নিমাই গেছলো জগন্নাথ দেবের কাছে।
শুনেছি। তার পায়ের চিহ্ন খুঁজে পাবো আমাদের ছোট নদীর পাড়ে।
ওই পাড়েই তো অবিনদের সরষে খেত। সরষে ফুলের রেণু উড়তে উড়তে অবিনের মায়ের গল্প বলে যায়। আজ তার মা ধান কুটতে কুটতে বলছিল, অবিনের জন্য
এবার রাঙা বউ নিয়ে আসবে।
আমাদের ছোট নদীর পথে একদিন পালকি এসেছিল। ঘোড়া ছুটেছিল এক দিন।
একদিন এক গাধা ছোট নদীর শীর্ণ জল থেকে মিটিয়েছিল তার তৃষ্ণা। তার পিঠে আমার কথার বোঝা না চাপিয়ে তার সঙ্গে গল্প করেছিলাম দু-একটা।
বকের সঙ্গে তো গল্প করতেই হয়।
তার ঠোঁটের কাছে আমার পাপ পুণ্য ধরে রাখলেও সে ছুঁয়েও দেখে না।
আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে------।
-------২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
-------১০----৬----২০২২
-------নির্মল হালদার
ছবি: অভিজিৎ মাজী












কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন