বুধবার, ২৫ মে, ২০২২

হাড়াই নদীর সন্তান




হাড়াই নদীর সন্তান
-------------------------

হাড়াই নদীর টানে আমি বারবার
অভিদের গ্রাম শরবেড়িয়া গেছি।

অভির টানেও গেছি।

অভি আর হাড়াই একইসঙ্গে উচ্চারণ করি।

মনে পড়ে প্রথম যেবার যাই, সন্ধে
হয়ে গেছলো। খাওয়া-দাওয়া করে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকালে উঠতেই অভি বললো------ চলো নদী যাই।

অভিদের ঘরের পিছনেই হাড়াই।

ছোট নদী ছোট বোনের মত চঞ্চল। দু'পাশেই শাক সবজির ক্ষেত। ধানক্ষেত।

অভিদেরও ফসলের ক্ষেত
নদীর পারেই।
ধান হয়। শাকসবজি হয়।
অভির মা শাকসবজি নিয়ে
" পাড়া "থানার বাজারে বিক্রি করতে যায়।

মনে পড়ে, অভির ঘরের প্রথম সকালে চা ছিল না। একটি থালায় এসেছিল একটি  " আস্কে " পিঠে।
দুধ ছিল কি?

অভির  সম্পর্ক থেকেই আমার 
" কুড়মি " ঘরে আসা যাওয়া। শুরু হলো  কুড়মি অথবা মাহাতদের জীবনকে সামনে থেকে দেখা।

ছোটবেলায় আমাদের ঘরে একজন " মাহাত " ছিল। সে ছিল আমাদের ভাগ চাষি। সে আমাদের দোকানে কাজও করতো। তাকে আমরা মাহাত বলতাম। তখন জানতাম মাহাত একটা নাম।

অভি  আমার ডেরায় এসেছিল
সম্ভবত হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর। সে তখন কবিতার কাছে আগমন করেছে। নিয়মিত চর্চা করছে বাংলা কবিতার।

তাদের পরিবারের আর্থিক অনটনের জন্য অভি তাদের গ্রামেই টিউশনি নিয়েছিল। 
কিন্তু ঠিকঠাক মাইনে পেতো না।
আমাকে বললো, পুরুলিয়া শহরে
টিউশনি জোগাড় করতে।

টিউশনি পেয়ে গেছলো।

আমার ডেরায় অভি নিজে স্টোভে
রান্না করে খেয়ে দেয়ে টিউশনি করে আমার কাছেই থাকতো।

আমার একলা ঘরে সহায় হয়েছিল অভি।

নিয়তি আড়ালে হাসছে।

একটা সময় আমাকে ছেড়ে চলে গেল অভি। ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য।
সে ততদিনে কবিতা চর্চায় অনেকটা পথ  হেঁটেছে।

হেঁটে চলছে আজও।

আমার ডেরা ছেড়ে টিউশনি ছেড়ে
স্থানীয় একটি সংবাদপত্রের কাজে প্রবেশ করল সে। এবং সংবাদপত্রের দপ্তরেই থাকা। হোটেলে খাওয়া।

ক্রমশ অভি অভিমন্যু মাহাত হয়ে
সংবাদপত্রের দুনিয়ায় পরিচিত হয়ে উঠছে। তার কবিতাও আমাদের এই বাংলার বিভিন্ন ছোট কাগজে ।

পুরুলিয়াতে থাকতে-থাকতে তার প্রথম কবিতার বই------
" আওলা বরষা ধনি " প্রকাশিত
হলো। দ্বিতীয় কবিতার বই 
 " মাটি " সাহিত্য আকাদেমি ( যুব ) পুরস্কারে সম্মানিত হলো সে।
অভিমন্যু মাহাতর  হাত ধরেই
সাহিত্য আকাদেমি ( যুব ) পুরস্কার পুরুলিয়াতে এলো। প্রথম।

অভিমন্যু মাহাত পুরুলিয়ার গৌরব।

যে  অভি আমাকে একবার বললো-----আমি আর অভিমন্যু
নামটা ব্যবহার করতে চাইনা। নামটা পাল্টে দাও। আমি বলেছিলাম-----নামটা খুব সুন্দর।
পাল্টাতে হবে না।

আমি তারপরও অভির একটা নতুন নামকরণ করেছিলাম----
অন্বয়।

না,অভি আর নতুন নামের দিকে
যায়নি। সে অভিমন্যু মাহাত নামেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সে আর
শরবেড়িয়া  গ্রামেও থাকে না।
কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্রে সে  তার জীবন ও জীবিকা পোক্ত করছে।

অভি যখন  বড় একটি সংবাদপত্রের কাজ নিয়ে সিউড়িতে  পোস্টিং পেলো প্রথম,
আমি তখন কেঁদে ফেলেছিলাম।

আনন্দে।

বেদনাও ছিল আমি একা হতে হতে একাকী হয়ে গেলাম।

অভি যখন আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল, আমার অসমাপ্ত কাজগুলি, আমার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিগুলি অভির কাছে রেখে যাবো। সেই হবে আমার লেখালেখি জীবনের একমাত্র উত্তরাধিকারী।

তা কি আর হয়?

সে তো বৃহত্তর জীবনের দিকে যাবেই। সেও তো  অভিমন্যু  মাহাত
নামটাকে  উজ্জ্বল করবেই  দিন দিন। আমার আশাকে পূর্ণ করবে কেন? আমি তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করলেও ফোন আসে না।
দশেমাসে আমিই ফোন করি তাকে------কেমন আছিস?

এক সময় দু'জনেরই ফোন ছিল না। আমি তার কাছে তাদের বাড়ি প্রায় চলে গেছি। সেও আমার ডেরায় এসেছে দিনের পর দিন। তখন তো অভিদের বাড়ি আমাদের কলকাতার বন্ধুরাও
প্রায় সবাই গেছে। সকলেই হাড়াই
নদীতে স্নান করে  অভির বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।

সেই অভির  আরও তিনটে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সে
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অনুবাদ করেছে কুড়মালি ভাষায়।
অনুবাদে গীতাঞ্জলির নামকরণ হয়েছে-----" গিতেক নেহর "।
ভূমিকা লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ।
বইটির প্রকাশক গৌতম মন্ডল।
আদম।

সেই অভিমন্যু মাহাত ,অভি অবশেষে   বিবাহ বন্ধনের দিকে।

নতুন কবিতার দিকে।

শিকড় ছিঁড়ে ফেলবে অভি?
নাকি ছিঁড়ে ফেলেছে?
আমার ভয় করে।অভির জন্যেই
যদি হাড়াই শুকিয়ে  ওঠে? অথবা
অভির কারণেই হাড়াইয়ের জলোচ্ছ্বাস যদি বেড়ে যায়?

আমার চোখের জলও আমি লুকাবো না।


-------১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------২৫----৫----২০২২
------নির্মল হালদার









ছবি : সন্দীপ কুমার ও অন্যান্য












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ