বন্ধুতার প্রবাহিত শিকড়
------------------------------
১৯৭৭----নকশাল আন্দোলনের আঁচ নিভে যায়নি। তখন আমাদের প্রতুলদা(দত্ত)র নেতৃত্বে পুরুলিয়া শহরে কবি সম্মেলন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নবনীতা দেব সেন বাচিকশিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কবি যোগব্রত চক্রবর্তী সেই কবি সম্মেলনে। সঙ্গে এক ঝাঁক তরুণ কবি। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল কমল চক্রবর্তী মৃদুল দাশগুপ্ত গৌতম চৌধুরী ইত্যাদিরা এসেছে।
আমাদের চকবাজারে কালী মন্দিরের মুখোমুখি একটি হোটেল ছিল। পাঞ্জাবী হোটেল। মদ বিক্রিও দিনরাত।
পার্থদা মৃদুল গৌতমকে নিয়ে ঢুকে পড়লো। সাতসকালে। যদিও ওই পাঞ্জাবি হোটেলের মদ বিক্রির লাইসেন্স ছিল না।
আমার বন্ধুদের তো লাইসেন্সের দরকার নেই। তারা বাংলা মদ খেয়ে সকাল থেকেই শুরু করল পুরুলিয়া উদযাপন। অথবা কবি সম্মেলন উদযাপন। এবং সেই উদযাপন চূড়ান্ত হলো অনুষ্ঠানে।
মৃদুল------কবি মৃদুল দাশগুপ্ত
মঞ্চে উঠে কবিতা পড়ছে। তখন
মঞ্চের নিচে অনুরাগীদের সই দিচ্ছেন সুনীলদা। স্বাভাবিকভাবেই একটা মৃদু কোলাহল। সুনীলদাকে ঘিরে। কবিতা পড়তে পড়তে ব্যাঘাত ঘটছে মৃদুলের।সে কবিতাপাঠ থামিয়ে মঞ্চ থেকে প্রায় ধমকের সুরে সুনীলদার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে----ও মশাই অটোগ্রফ দেওয়াটা বন্ধ করবেন নাকি আমার কবিতা পাঠ বন্ধ করবো?
অনুষ্ঠানের চারদিক একদম চুপচাপ। সুনীলদা সই দেওয়া বন্ধ করলেন। অটোগ্রাফ শিকারিরা চলে গেল।
সেই সময় মৃদুলের খুব নামডাক।
তরুণ কবি হিসেবে বিখ্যাত বলা যায়।
মঞ্চ থেকে মৃদুল নেমে আসতেই,
সুনীলদা তাকে কাছে ডেকে বললেন-----এই ছোকরা শোনো, সই দেবার জন্য আমি কি সবাইকে কাছে ডেকেছিলাম? তুমি যে আমাকে ধমকালে তার কোনো মানে হয়? ওই দেখো দেখো------সেদিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সুনীলদা মৃদুল কে বললেন-----ওই দেখো চাঁদ-------একটু হাসতে পারো না?
চারপাশে সবাই হেসে উঠলো।
মৃদুলের সেই জঙ্গী পরিচয় দেখতে পেলাম কৃত্তিবাসের পাতায়--------আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি।
তার একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত।
সেই কবিতা নিয়ে বাংলাবাজারে
হৈ হৈ পড়ে গেছে। সেই কবিতা তখন সবার মুখে মুখে। আজ প্রায ৫০ বছর হতে চললো সেই কবিতার জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।
আমাদের বন্ধুত্বেরও ৫০ বছর হয়ে এলো। উদযাপন করলে কেমন হয়, মৃদুল?
আমাদের এই বাংলার কোনো গ্রামের মাঠে গাছ তলায় কবিতা পড়লি তুই। বাকি বন্ধুরাও থাকবে। যারা আজও কবিতায় সক্রিয়।
পার্থদাও গৌতম বসুর উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন না করে, তাদের কবিতা পড়ে তাদের আত্মার কাছে আলো জ্বালাবো।
আড়াল থেকে ফল্গু বসু হাসবে।
দেখতে পাবো সঞ্জীব প্রামাণিককে। দেখতে পাবো গোবরডাঙ্গার সন্দীপ মুখোপাধ্যায়কে।
মৃত ও জীবিতের কবিতায় জেগে উঠবে ৭০ দশক।
একবার মৃদুল পুরুলিয়া ঘুরতে এলে আমরা অযোধ্যা গেলাম। তখন অযোধ্যার বাস ছিল না। পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠে ছিলাম সবাই।
সৈকত ছিল অশোক ছিল।
অশোক, অশোক দত্ত তখন
" উপসংহার 'নামে একটি ছোটকাগজ করছে। খুব চমৎকার কাগজ। একটা সংখ্যায় মৃদুলের একগুচ্ছ কবিতা-------
জলপাই কাঠের এসরাজ-------
প্রকাশিত হলো।
সেই কবিতা নিয়েও দিকে দিকে
জলপাই কাঠের এসরাজ এর সঙ্গে বাজতে লাগলো বাঁশি। মাদল। কেঁদরি।
প্রকৃত অর্থেই গ্রাম বাংলা ঘেরাও করে ফেললো নাগরিক সভ্যতাকে। সমস্ত চালাকির গালে থাপ্পড় মারতে মারতে এগিয়ে চললো ৭০ দশক।
মৃদুলের ছন্দ ও শব্দ যে ফাঁকিবাজি নয় তাই এখনো সে পুরো মাত্রায় সক্রিয়। যার লেখাতে ফাঁকিবাজি থাকে সে এগিয়ে যেতে পারে না। যার লেখা শুধুমাত্র আঙ্গিকের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেও অনেকদূর যেতে পারে না। মৃদুল সহ আমাদের বাকি বন্ধুরাও
আজও সবুজ হয়ে শিকড় থেকে রস টানে। বুকের ভেতরে খোঁজে আকাশের অসীমতা।
মৃদুলের সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ
একেবারেই হয় না। ফোনাফুনি সেও না। আবার যখনই দেখা হয়েছে কোথাও ঝলমল করে উঠেছি দুজনেই। হাসি-ঠাট্টা কথাবার্তা ।
মৃদুলের শ্রীরামপুরের বাড়িতেও আমি ও সৈকত গেছি। তখন তো বাবা-মা। সূর্যোদয়ে নির্মিত গৃহ।
মৃদুলের ভাই অম্লান তার কাজে পুরুলিয়া এলেই আমার কাছে এসে আড্ডা দিয়ে গেছে। মৃদুলকে একদিন চাইছি আমার
" মায়া " তে।
সম্পর্কের সেতু ভেঙ্গে যায় নি এখনও। মৃদুল, হঠাৎ একদিন এই জ্যৈষ্ঠ দিনের ঝড়ে আম কুড়িয়ে পাতা কুড়িয়ে চলে আয়। সেই তো আমাদের বাংলা কবিতা।
মৃদুল তোর কি মনে আছে, একবার পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রসদনে " আজকাল " ---এর
বাপি বৈদ্যনাথ ইত্যাদির সঙ্গে। তুমুল বৃষ্টি। আমাদের পেটে পানীয়। আমরা ভিজতে ভিজতে প্রেসক্লাব। মদ দেবে না। চেয়ার টেবিল উল্টে দিলাম।
সময় এসেছে আবার, সমস্ত চেয়ার-টেবিল উল্টে দিতে হবে। নইলে এই বাংলা শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে না।
------২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------৫----৬----২০২২
-----নির্মল হালদার
কবি মৃদুল দাশগুপ্তের বইয়ের তালিকা
ছড়া :
১/ ঝিকিমিকি ঝিরিঝিরি (১৯৯৭)
২/ আমপাতা জামপাতা (১৯৯৯)
৩/ ছড়া ৫০ (২০০১)
৪/ রঙিন ছড়া (২০০৮)
৫/ খেলাচ্ছড়া (২০১৭)
কবিতা :
১/ জলপাইকাঠের এসরাজ (১৯৮০)
২/ এভাবে কাঁদে না (১৯৮৬)
৩/ গোপনে হিংসার কথা বলি (১৯৮৮)
৪/ সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ (১৯৯৮)
৫/ ধানখেত থেকে (২০০৭)
৬/ সোনালী বুদ্বুদ (২০১০)
৭/ আগুনের অবাক ফোয়ারা (২০২০)
গদ্য :
১/ কবিতা সহায়
২/ সাত পাঁচ
৩/ ফুল ফল মফসসল ১ ও ২
গল্প :
১/ পার্টি বলেছিল
২/ সাতটি গল্প
ছবি : সন্দীপ কুমার
আরও পড়ুন





কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন