বন্ধু ও কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দু'একটি কথা।
ধ্যানি এক বক
------------------
হেমন্ত
বন্ধুদের নিয়ে লেখালিখি করা কঠিন এবং জটিল। তারপর আমার মত মূর্খ যে লিখতেই পারে না। যে পড়াশোনাই করে না। যে আমাকে শুনতে হয়, আমার লেখাতে শুধু ভাত আর খিদে।
এক রকমের আক্রমণ।
ফাঁপা আধুনিকতার আক্রমণ।
কি আর করবো, আমাকে যে প্রতিদিন চিন্তা করতে হয়, আজকের দিনটা চলবে তো?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একটা প্রবাদ-------এক গাঁ ঘুরলে এক মুঠো চাল। আর সাত গাঁ ঘুরলেও এক মুঠো চাল।
এভাবেই আমার দিন যায়। এখনো।
এখন একটাই রক্ষা অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে। অপমানের স্মৃতি বঞ্চনার স্মৃতি। প্রত্যাখ্যানের স্মৃতি। হারানোর স্মৃতি। বন্ধুত্বের স্মৃতিও হারিয়ে গেছে অনেক।
অনেক অনেক দিন পর, ফোনে ফোনে তোমার সঙ্গে জুড়ে গেছি। সুখ দুঃখের কথাও বলছি তোমাকে। এই সঙ্গে ভাবার চেষ্টা করছি, আমাদের ঐ উত্তাল সময়ে
কতখানি জুড়ে ছিলাম তোমার সঙ্গে।
নেই নেই করে আমার কাছে একটা স্মৃতি------অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে কোনো নাটক দেখতে গেছলাম। নাটক শেষের পর বাইরে গেটের সামনে, তুমি সম্ভবত অনির্বাণের সঙ্গে ছিলে। সেই তোমার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলো। তারপর তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু কখনও আড্ডা হয়নি। তোমাদের আহিরী টোলার বাড়িতেও একবার গেছলাম। মনে হচ্ছে। তবে তোমার সঙ্গে চিঠি বিনিময় হয়েছে। তাই তো? তখন তো পুরুলিয়া থেকে আমি প্রায় সবাইকে চিঠি লিখেছি। হয়তো তোমার কাছে রয়ে গেছে আমার দু' একটা চিঠি।
আমার চিঠি পেয়েও অনেকে অনেক সময় বিরক্তি প্রকাশ করেছে। আমি জানি।
আসলে, আমি সম্পর্ক লালনে বিশ্বাসী। সে কথা কতজনকে আর বলবো। তখন তো ফোন ছিল না। চিঠিতেই যোগাযোগ। সম্পর্ক লালন।
এখানে বলে রাখা ভালো, আমার সমস্ত চিঠির উত্তর লিখতেন কালীদা। খুব ব্যস্ত মানুষ হয়েও
আমার প্রতিটি চিঠির উত্তর লিখতেন শিব বাবু। শিবনারায়ণ রায়। চমৎকার চিঠি লিখতেন শঙ্খ বাবু। গৌতম বসুর কাছ থেকেও সুন্দর সুন্দর চিঠি পেয়েছি।
সেই তখনকার অনির্বাণ লাহিড়ীও
আমাকে চিঠি লিখেছে।
তখন কলকাতায় কালীদা প্রসূন প্রবুদ্ধ গৌতম চৌধুরী একরাম ভিক্টরের সঙ্গেই আড্ডা হয়েছে লাগাতার। অনির্বাণের সঙ্গে কখনোই কফি হাউসে বা কোনো
পানশালায় আড্ডা হয়নি। আমি বরং অনির্বাণের বাড়ি চলে গেছি।
তার বাড়ির সঙ্গেও আমার একটা
ঘরোয়া সম্পর্ক হয়ে গেছলো। আর বাড়ি গেলে আমার কবিতা শোনাতে পারবো। এই ইচ্ছা থেকেই আরো যেতাম তার কাছে।
এমন অনেক দিন হয়েছে, অনির্বাণের বাড়ি গেছি গৌতম বসুকে সঙ্গে নিয়ে।
তোমাকে পাইনি কেন?
আমার মনে হয়, তুমি সব সময়
কোলাহল থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসো। তোমাকে দেখেও মনে হয়েছে বারবার, তুমি শান্ত।
ধ্যানি এক বক।
ঠিক সময়ে ঠিক মাছটি ধরে
ব্যবহার করবে নিজের জন্যে।
তোমার কবিতায় ব্যবহার করবে
সঠিক শব্দটি। এরকমই মনে হয়েছে আমার। এ কারণেই হয়তো বাংলাবাজারের কূটকচালিতে আজো তুমি নেই।
কোনো দৌড়ে তুমি ছিলে না।
আজও তুমি ধীর-স্থির। সন্ধে বেলার শুকতারার মত। নীরবে
আলো দিয়ে যাও।
আজ অব্দি তোমার কবিতার বই
ক'টি হলো, আমি জানি না। এ আমারই দোষ। তোমার সঙ্গে আমার দীর্ঘ নীরবতা, আমাকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে।
এই জ্যৈষ্ঠ দুপুরের রোদের তাপ
আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি
অনির্বাণের অফিসেও চলে গেছি।
শুধুমাত্র আড্ডা দেবার জন্য। আমি গৌতম বসুর অফিসে চলে গেছি, শুধুমাত্র কবিতা শোনাবার জন্য। তারপর তিনি চা--টা খাইয়ে, সিগারেট খাইয়ে আমাকে ছাড়তেন ।
তুমি বোধহয় কোনদিনই সিগারেট
ছুঁয়েও দেখোনি।
কালীদা কোনো কোনো মানুষ সম্পর্কে একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করতেন------বিশুদ্ধ মানুষ।
তুমি তাই ছিলে। এখনো একই রকম। গাছের পাতার বিশুদ্ধতা কিংবা গাছের বিশুদ্ধতা তোমার ভেতরে বাইরে সম্পূর্ণ হয়ে আছে।
কোনো মলিনতা স্পর্শ করবে না তোমাকে। যেমন তোমার কবিতাকেও স্পর্শ করেনি বাইরের কোনো আবর্জনা।
এই মুহূর্তে মেঘ এসে ঘুরঘুর করছে। বৃষ্টি এলে ধুয়ে যাবে আমার ক্লান্তি। আমার দুঃখ বেদনা।
জাম গাছের পাতারা কেঁপে কেঁপে উঠছে। হয় তো মেঘের পুলকে। ওই জাম গাছেই তো পাখিদের বাসা।
চলো, দেখে আসি একদিন।
আমার তো শান্তিনিকেতন যেতেও
ইচ্ছে করছে। ওখানে আমার বন্ধু
রামানুজ মুখোপাধ্যায় আছে। তাকে বলবো তোমার কথা। যে তুমি আলোক বৃত্তে না থেকেই সুন্দর হয়েছো খুব। এই সুন্দরকে রামানুজের পছন্দ হবে অবশ্যই।
সেও কলহ--কোলাহলের কাউকে পছন্দ করে না।
তার সঙ্গে গল্প করতে করতে দেখবো, তার কাছে তোমার কবিতার বই।
সে একজন নিবিড় পাঠক। লেখক তো অবশ্যই। কিন্তু সামনে নেই। সে বীরভূমের মাটির ছেলে, লালমাটি চেনে। রবীন্দ্রনাথকে চেনারও চেষ্টা করে।
আমি তো আমার অভাব চিনতে চিনতে অনেককেই চিনে উঠতে পারলাম না। যদি বা চিনেওছি, ভুল চিনেছি। এবং এই ভুলগুলি
আমাকে আঘাত করেছে। অপমান করেছে।
সোনা চিনতে না পারলে যা হয়।
খাদে পড়তেই হবে। আমার অর্থনৈতিক পরাধীনতাও আমাকে খাদে ফেলেছে। এখনো ফেলছে।
কথা বলার মতো কেউ নেই।
চোখের জল রাখার মত মাটিও নেই।
ফোন করতেও ভয় লাগে আমার।
যদি বিরক্ত হয়?
গত দু'দিন যে তোমাকে ফোন করলাম, ভয়ে ভয়ে করেছি। আমার না হয় কাজ নেই তোমার তো থাকতে পারে।
যদি কাজ নাও থাকে তুমি হয় তো তখন একা একা নিজের সঙ্গে থাকতে চাইছো ফোন ধরতে তোমার ইচ্ছে করছে না। এইসব সাতপাঁচ আমার মাথায় কিলবিল করে। আমাকে সংকুচিত করে।
ঘুমোতে ইচ্ছে করে না আমার।
মনে হয় ঘুমোলেই শেষ হয়ে যাবে দিনটা। কিন্তু ঘুমোতে হয়। আবার ঘুম থেকে উঠেই, মানুষের স্পর্শ চাই।
দূরে থেকেও স্পর্শ পেতে পারি।
আমি দূরে থেকেও তোমার বন্ধুত্বের স্পর্শ অনুভব করি। তোমার কবিতার গন্ধ অনুভব করি।
তোমার কবিতা তো সেই, গাছে ঝুলে থাকা পেয়ারার মতো। নিঃশব্দ। নীরব। মাটির দিকে ঝুঁকে মাটিকে প্রণতি জানায়।
কোনো হিংসা ক্রোধ তোমার
কাছে ঘেঁষতে পারেনি বলে তুমি
রক্ষা পেয়ে গেছো । তুমি থাকতে পারছো শান্ত।
তোমার মধ্যে কি উদাসীনতাও আছে? তুমি কি গায়ে ধুলো উঠলে ঝেড়ে ফেলো না? গায়ে শুকনো পাতা পড়লে তুমি কি চমকে ওঠো না?
জানতে ইচ্ছে করছে খুব।
জানতে ইচ্ছে করছে, কবে দেখা হবে আমাদের?
এখনও আমরা অনেকে ৭০ দশক
আছি। একদিন যদি এক জায়গায় জড়ো হই? কেমন হবে?
গৌ চৌ অধিনায়ক হবে।
আমাদের অঞ্জলিতে খেলা করবে
আলো-বাতাস। কেবল আলো-বাতাস। চেনা-অচেনা নক্ষত্রেরা আমাদের কাছে চাইবে
আমাদের নিঃশ্বাস। যা পুরনো হয়ে গেলেও প্রতিদিন নতুন।
হেমন্ত
বর্ষা আসছে। লাঙ্গল নামবে মাটিতে। নতুন বীজ নতুন ফসলের অপেক্ষায় আমরা দু'জনই। এর সঙ্গে আশা করবো,
বাংলা কবিতায় সংযোজিত হবে
নতুন দিশা।
দেখা হবেই, ততদিন যেন আমরা ভালো থাকি।
ইতি
১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
৩---৫---২০২২
নির্মল হালদার
কবিতাবই : নশ্বর অলীক যাতায়াত (১৯৮২), অসমাপ্ত রূপ (১৯৮৫), ঈশ্বরের বিভা (১৯৮৭), অশ্রুপাবক (১৯৯১), নীলিমাপূরণ (১৯৯৭), কবিতাসংগ্রহ (২০১২), নক্ষত্রবীথিকা (২০১৮)
অনুবাদ : কবির সংহিতা (১৯৯৫), কবিরশতক (২০১৯)
ছবি : সন্দীপ কুমার
আরও পড়ুন






কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন