এ গাঁ থেকে ও গাঁ।
সকাল হলেই , বগলে একটা ছাতা। কাঁধে একটা বড় ঝুলি নিয়ে চললো এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ।
ছাতা মেরামত করবে।
এই মেরামত মিস্ত্রিকে সব গাঁয়ের লোক মেরামত চাচা বলে। আসল নাম কেউ জানে না। কোন্ গাঁয়ে ঘর কেউ জানে না।
ছোট বড় সবাই, মেরামত চাচা বলেই হাঁকডাক করে।
বর্ষার আগে থেকেই মেরামত চাচার গ্রামে গ্রামে আসা-যাওয়া চলে। কেননা, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকেই ঝড়-বৃষ্টি। কালবৈশাখী। বিকেল দিকে।
তার আগে রোদে রোদে তেতে ওঠা।
তবে যতই রোদ থাক গরম থাক,
গাঁয়ের মানুষ ছাতা ব্যবহার করে না। যে বুড়ো বা বুড়ি গরু চরাতে যায় মাঠে, তারা কখনো কখনো
পুরনো ছেঁড়া ছাতা মাথায় নিয়ে যায়।
বৃষ্টি এলে ভরা বর্ষায় ছাতা নিতেই হবে সবাইকে। কিন্তু নতুন ছাতা কিনতে বেশিরভাগ মানুষের সামর্থ্য নেই।
হয়তো অনেক আগে বাপ কাকা জ্যাঠা অথবা দাদু ছাতা কিনেছিল একটা
সেই ছাতাই আজও চলছে।
মেরামতের পর মেরামত করতে করতে। এবং এজন্য তো মেরামত চাচাও আছে। এক বছরের মেরামতি , কেউ কেউ বলে, কেরামতি। তো সেই মেরামতি-কেরামতিতে দু'বছর চলে যায়।
আজ যেমন হরি মাহাতকে মেরামত চাচা বললো--------
হরি হে তোমার এই মান্ধাতা আমলের ছাতাটাকে আমি যতই কেরামতি করি, আর রাখা যাবে না। ফেলে দাও---ফেলে দাও।
শিক গুলাতে জং ধরেছে। ছাতার কাপড়টাকে ধরে রাখতে পারছে না।
মেরামত চাচা প্রায় সব গ্রামের লোকজনের ঘর দুয়ার নাম ধাম সবই জানে।
কোনো কোনো ঘরে
কখনো কখনো দুপুরের ভাতটুকুও
খায়। জল তো খেয়েই থাকে। এ বিষয়ে সে ধর্মের ধার ধারে না।
একবার মনু সহিস মেরামত চাচার কাছে
জানতে চেয়েছিল যে -------
হ্যাঁ ভাই আজ আমার ঘরে মানতের মাংস হয়েছে, তুমি টুকু খাবে নাকি?
মেরামত চাচা সঙ্গে সঙ্গে বলে----
ক্যানে খাবো নাই, সবই তো আল্লার কৃপা। জল খেতে যখন দোষ নাই, মাংস খেতেও দোষ নাই।
কোনো কোনো গাঁয়ের কোনো কোনো ঘরে আত্মীয় হয়ে গেছে এই মেরামত চাচা।
কারোর মেয়ে বা ছেলের বিয়ে হলেও নেমন্তন্ন পেয়ে থাকে।
মেরামত চাচাও টাকা পয়সা বা দান সামগ্রী দিয়ে লৌকিকতা করে।
এ ভাবেই সম্পর্কে বাঁধা পড়ে
এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ। এ কারণেই মেরামত চাচা কারো কারো কাছ থেকে ছাতা সারানোর
মজুরি নিতে পারে না। যদিও তার ঘরেও অভাব আছে। পাঁচটা ছেলে মেয়ে। বউ। বৃদ্ধ বাবা।
জমি জায়গা নেই।
শুধু মাথার উপরে আকাশটা আছে। যা ছিঁড়ে গেছে কবেই।
ধুলো ময়লা কালিতেও ভরে আছে সমস্ত আকাশ।
মেরামত চাচা বলে-------
বুঝলে হরি, তোমার ছাতা মেরামত করে দিলেও উপরওয়ালার ছাতাটা সারাসারি
করতে আমার বাপ ঠাকুরদারও
ক্ষমতা নাই হে, ক্ষমতা নাই-----।
একটা কাক মাথার উপর দিয়ে
উড়ে গেল। বেলা হয়েছে ঢের।
ভাদরের রোদ ছ্যাঁকা মারছে গায়ে।
মেরামত চাচার জল তেষ্টা পেয়েছে। এই গ্রামের টিউকল
অকেজো । তাকে কারোর ঘর থেকে জল চাইতেই হয়। সে
মধু সিং সর্দারকে কাতর স্বরে বললো----
ও মধু মধু দাও না
একটু জল ---- জিভটা বড় শুকায় গেছে----
গাঁয়ে একটা সাইকেল ঢুকলো।
সায়া--ব্লাউজ নিয়ে এসেছে । প্রায় আসে বিক্রি করতে। এই সাইকেলের মানুষ মেরামত চাচার কাছে জানতে চায়----কতক্ষণ ঢুকেছো হে-----?
মধুর ছোট মেয়ে একটা স্টিলের ঘটিতে জল দিয়ে যায়, মেরামত চাচাকে।
আকাশে দেখা যায় শাদা শাদা মেঘ।
-----২২ ভাদ্র ১৪২৯
-----৮---৯---২০২২
-----নির্মল হালদার
ছবি : কল্পোত্তম















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন