শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০২২

একটি খোলা চিঠি




একটি খোলা চিঠি 


কালীদা

শ্রাবণের এই দগ্ধ দুপুরে একটি কাকও নেই। আমাদের এই পুরুলিয়াতে মরে যাচ্ছে ধানের চারা। রোদে রোদে।

শ্রাবণের গান অথবা রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান কে গাইছে?

একটা সময় ছিল যখন আমাদের এই মালভূমি অঞ্চলে ধান রোয়ার গান শোনা যেতো।

আমি ছাদ পেটার গানও শুনেছি।

লোক জীবনের গান। শিকড়ের গান। শ্রমজীবী মানুষের নানা অভাব থাকার পরেও গান ছিল রক্তে রক্তে

বিয়ার গানও শুনেছি।

এখনো নিম্নবর্গের ঘরে ঘরে বিয়ার গান হয়ে থাকে।

নিম্নবর্গের অনেক পরবেও গান হয়ে থাকে।  কোরাস গাইছে মেয়েরা।


সমস্ত গানেই সুখ দুঃখের কথা।

সেইসব কথা ও গানকে বাজার এখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। যদিও ঝুমুর গানের কথা লঘু হয়ে যাচ্ছে। নানা দিকে।


গানও যে কাব্যের একদিক, ভুলে যাচ্ছে আজকের ঝুমুর-কবিরা।


সস্তা ও চটুল কথা ও সুরে শ্রোতারা নেচে উঠছে।

এ বড় সুখের সময় নয়। কোনোভাবেই আনন্দের সময় নয়।

একটা নিরক্ষর দেশে অসচেতন মানুষ খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
এবং তাদের নিরক্ষরতা, অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের সর্বময় কর্তারা সঙ্গে মুনাফাবাজের দল জনগণের রক্ত
লুটছে।


অতি সাম্প্রতিক ঘটনা লক্ষ্য করছেন তো?
আশ্চর্যের বিষয়, এই বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

এই মুহূর্তে মেঘ ডাকছে।

বৃষ্টি কি আসবে?

ছোটবেলার বর্ষায় রাত হলেই ব্যাঙের ডাক। আমরা ছোটরা বলেছি, বৃষ্টি আসছে।

আজকাল আর ব্যাঙ দেখতে পাই না।

মানুষ কি দেখতে পাই?

বয়স হয়ে গেলেও বুড়ো বা বুড়িকে বাজারে শাক বিক্রি করতে আসতে হয়। এখানে কারণ একটাই, যেভাবেই হোক দু'পয়সা রোজগার করতে হবে।

ঘরে ধান চাল থাকলেও নুন তেলের পয়সা তো লাগবেই। যে বুড়ো কিংবা বুড়ি বাজারে আসতে পারে না পায়ে হেঁটে, তাদের যেতে হবে গাই গরু নিয়ে মাঠে।

যতই বয়স হোক বিশ্রাম নেই।

তাদের ঘুম আছে কিনা জানতে পারিনি। জানতে পেরেছি, কারো কারো ঘরের তিন তিনটা ছেলেই অন্য রাজ্যে কাজ করতে চলে গেছে।

আমাদের রাজ্যে কাজ নেই।

এই এদের পরিযায়ী শ্রমিক নামে
চিহ্নিত করা হয়েছে। কই, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কাজেও যারা যুক্ত তাদের তো বলা হচ্ছে না পরিযায়ী?

নিষ্পেষণ। যেভাবেই হোক নিষ্পেষণ করা হবে। মেরে ফেলা হবে জনগণের মূল শিকড় এই শ্রমিক সমাজকে।

কৃষক সমাজকে।

দেশের নোংরা রাজনীতির সঙ্গে
বাণিজ্য কর্তাদের মেলবন্ধনে
দেশের যে ভরাডুবি, দেখেও দেখছে না একশ্রেণীর শিক্ষিতরা।
যারা নাটক করে। কবিতা করে।
সিনেমা করে। চিত্রকলার সঙ্গেও
আছে। ছবিও আঁকে।

মনের আঁক মনেই থাকে উড়াল দিতে পারে না।

কোনোদিন দেখা যাবে বকের মুখ থেকে লুট হয়ে যাচ্ছে মাছ। গরুর পায়ের ক্ষুরে ধুলো মাটি নেই।

আমাদের গোধূলি নেই।

গোধূলির মায়ায় যে যুবক যুবতীরা প্রেম করে, তাদের ঠিকানা আর খুঁজে পাচ্ছি না।

কালীদা, কোন্ কবিতা কার কবিতা আমাদের মুক্তি দেবে?

আপনি বলবেন, আমাদের মুক্তির জায়গা রবীন্দ্রনাথের গান। যদি তাই হয় তবে আমি বলবো, রবীন্দ্রনাথের গান মধ্যবিত্ত বাঙালির গান। এরা বাদ দিয়ে অসংখ্য মানুষ যারা রবীন্দ্রনাথের নাম শোনেনি, তারা কোথায় যাবে?

আমার চারপাশে এখনো কয়েকজন যুবক আছে, যাদের মোবাইল যন্ত্র থেকে কেবল শোনা যায়, বুক ধড়পড় গান।

উৎসবে উৎসবে ডি জে।

পাতার মর্মর ধ্বনি শুনবেন?

জল জঙ্গল জমি উচ্ছেদ হয়। মানুষ উচ্ছেদ হয়।

জাতীয় সড়কের নামে গ্রাম থেকে গ্রাম শেষ হয়ে যায়।

গ্রাম পতনের শব্দ অনেক আগেই শুনেছিলেন কবি জীবনানন্দ। সেই শব্দ আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেঁচোর ডিম খেয়ে জীবনধারণ করে অসংখ্য আদিবাসী মানুষ। সেইসব আদিবাসীদের গ্রাম যেতে হলে
পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পাহাড়ে উঠতে হয়।

হাঁটার মতো পা আছে?

প্রতিশ্রুতি আছে।

আর লেলিয়ে দেওয়া প্রতিযোগিতা আছে। যে যার মত কাজ করতে না পারার বেদনা আছে।

সেই বেদনা আপনার অন্তরেও।

এই বঙ্গে কোনো কোনো কবির কলম শোষণের হাতিয়ার। সেই কবিদের পুষে রাখে মিডিয়া।

লিটিল ম্যাগাজিনের জগতও ধোওয়া তুলসী পাতা নয়। তারা খোঁজ রাখে না উত্তম মাহাতর।

যে রাজমিস্ত্রির কাজ করেও সাহিত্য চর্চা করে। ছবি আঁকার চর্চা করে। যার দিনমজুরি চারশো টাকা মাত্র।

যাকে নিজের একটা কবিতার বই
করতে হলে ঋণ করতে হয়।

হায় পোড়া দেশ!

কেমন করে ভালো থাকবেন কালীদা?

সেদিন তিনটি কলেজের ছাত্র
যাদের গ্রামে বাড়ি, শহরে থেকে লেখাপড়া করে, তারা এসে আমাকে বলছিল-----যদি তাদের জন্য কিছু একটা টাকা মাসে মাসে ব্যবস্থা করে দি, তারা উপকৃত হবে।
সেই মুহূর্তে কোনো নাম না পেয়ে
আমি ঝুপপিকে ফোন করে সব কথা জানাই।

সে একজনকে দিতে পারবে
আমাকে জানাতে একজনের মুখ রক্ষা করতে পেরেছি।
বাকি দু'জনের জন্যেও আরেক বান্ধবীকে বলেছি। সে জানিয়েছে, চেষ্টা করবে।

যখন দেশের এই অবস্থা তখন
এই রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘরে
টাকার পাহাড়।

আপনি কোথায় যাবেন? লজ্জাতে মুখ ঢাকবেন কোথায়?

আমার তো মনে হয়, দাঁড়াবার জায়গা নেই আর। যদি কোথাও ব্যাঙ থাকে, তার ছাতার তলাতেই দাঁড়াতে হবে।

কালীদা, অনেক কথা অনেক ব্যথা বেদনা।কাকেই বা বলবো?
আপনি আমাদের এই মুহূর্তে অগ্রজ বন্ধু ও ভরসার ঠাঁই। আপনাকে দু' এক কথা বলতে
হালকা হতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো মন।

ইতি

১২ শ্রাবণ ১৪২৯
২৯---৭----২০২২
নির্মল হালদার




ছবি : কল্পোত্তম























কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ