লবঙ্গ লতায় জড়িয়ে
--------------------------
সে তখন ছিল লাহিড়ী। অনির্বাণ লাহিড়ী।
এক রূপবান যুবক। প্রেসিডেন্সির ছাত্র।
আমার সঙ্গে খুব মাখোমাখো সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্কটা হলো অনেক পরে ৮০ র দশকে। গৌতম বসুর মাধ্যমে।
অনির্বাণের সঙ্গে চেনা জানা ছিল আলাপ ছিল এটুকুই। কাছাকাছি যাইনি কখনো। ওর সম্পর্কে প্রসুনদের কাছ থেকে গল্প শুনেছি। নানা রঙের।
অনির্বাণ আমাকে একবার গল্পের ছলে একটা কথা বলেছিল--------আলোর চর্চা করতে হয়। আলোর চর্চা না করলে, অন্তরের অন্ধকার দূর করা যাবে না।
আমি আর পাল্টা কোনো প্রশ্ন করিনি। কিন্তু তার কথাটা মনে আছে। আর মনে আছে বলেই, আমিও অনেককে বলে থাকি,
আলোর চর্চা করো।
আলো এক কঠিন বিষয়। আলোর দিকে যাওয়া আরো কঠিন। অনির্বাণ কতটা পেরেছে আমার জানা নেই।
আমার সঙ্গে দেখা নেই দীর্ঘ দীর্ঘদিন। যোগাযোগ নেই। ফলে বলতেও পারবো না, তার আলোর অভিমুখ কতটা সহজ হলো।
আলো যদি তার অন্তরে স্থাপিত হয়ে থাকে আমি সেই আলোর কাছে নতজানু হতে চাই।
নতজানু হয়েছি কৃষকের কাছে।
যে ফসলের আলো থেকে মানুষের
ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করে।
অনির্বাণ আমার অনেক খিদে মিটিয়েছে। যেমন বাকি অনেক বন্ধুই আমার খিদে মেটায়।
ভালোবাসা থেকে ভালোবাসা আমার কাছে বর্ষিত হয়েছে।
প্রশ্রয় পেয়েছি বন্ধুদের কাছ থেকেই। এবং সমর্থন পেয়েছি কবিতা লেখার।
গৌতম বসু অনির্বাণ কালীদা আমাকে যথেষ্ট ভালোবেসে আমার কবিতার পাশে থেকেছেন।
অনির্বাণ গৌতম পার্থদার সৌজন্যে সীতা কাব্য পুস্তিকাটি প্রকাশের পর , অনির্বাণ নিজের উদ্যোগে মৃত্যুঞ্জয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল। তারপরেই, তমোঘ্ন।
তমোঘ্ন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরে কলকাতা বইমেলায় সমস্ত কপি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমারই চোখের সামনে।
মনে আছে, আমি মুষড়ে পড়েছিলাম। এবং কাউকে কিছু না-বলে মেলা থেকে বেরিয়ে সোজা দেবাশিস চন্দের বাড়ি। জোকা।
সারা মেলার মাঠ জুড়ে অদ্রিশ আমাকে খুঁজে ছিল।
অনির্বাণের আফসোস ছিল, বইটা কাউকে দেওয়া গেল না।
আমাকে গড়ে তুলতে কালীদা গৌতম বসুর একটা প্রয়াস ছিল। সঙ্গে ছিল অনির্বাণের।
আমার জীবনে এই তিনজনের ভূমিকা আকাশ সমান। বানান থেকে বাক্য থেকে এবং চরিত্র বিষয়ে আমাকে সব সময় পরামর্শ।
অনির্বাণ পরের দিকে আমাকে বলেছিল আঙ্গিক পাল্টাতে। আঙ্গিক আবার কি? আমি তাকে প্রশ্ন করিনি।
অনেক সময় অনেকের কাছেই আমার প্রশ্ন থাকে। প্রশ্ন করিও। কোথাও কোথাও প্রশ্ন করতে গেলে সংশয় জাগে। আমার প্রশ্নটা সঠিক হচ্ছে তো?
কালীদা ও গৌতম বসুকে ভয় না করলেও কখনো কখনো অনির্বাণকে ভয় পেয়েছি। তবে এটাও ঠিক অনির্বানের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়েছি অনেক।
শুধু তার কাছ থেকে নয় তার মায়ের কাছ থেকেও স্নেহের প্রশ্রয়।
আমি দক্ষিণেশ্বর দেখিনি বলে,
মাসিমা আমাকে একবার নিয়ে গেছলেন। অপাবৃতা আমাকে গীতবিতান উপহার দিয়েছিল।
চমৎকার কবিতা লিখতো সে।
কেমন আছে অপাবৃতা?
অনির্বাণের মনে আছে কিনা জানি না, তার ধর্মতলার স্টেট ব্যাংক অফিসে হঠাৎ হঠাৎ চলে গেছি। আড্ডা হয়েছে। তার বাড়িতে তো অবাধ যাতায়াত ছিল আমার।
প্রসূনদের বাগবাজারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গৌতম বসুর কাছে। বেলগাছিয়া। তারপর অনির্বাণ।
তখন তো কবিতা ছাড়া মাথায় কিছু ঘুরতো না। যে বন্ধুর কাছেই যাই, কবিতা আর কবিতা। আমার নিজের বেকারত্ব নিয়ে
ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা করিনি কখনো। অন্তত সে সময়।
অনির্বাণ কবি হলেও সে একজন কাব্য আলোচক। তত্ত্বজ্ঞানে সে গভীরও খুব। দেশ-বিদেশের কবিতা বিষয়ে আমাকে গল্প শুনিয়েছে।
আমার কাছে শোনানোর মত কিছু নেই। তাই, অনির্বাণের কবিতা নিয়ে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়।
কারোর কবিতা নিয়েই বলতে আমি অক্ষম। বরং বলে রাখি, অনির্বানের বিয়েতে আমি ছিলাম।
অনির্বাণ যখন স্থির করলো, পদবী বর্জন করবে অনেকের মধ্যে আমিও সমর্থন করেছিলাম।
যদিও আমি নিজে আমার পদবীতেই আছি এখনো।
সে লাহিড়ি থেকে ধরিত্রী পুত্র হলো। সে একা নয়। তার বোনও বর্জন করেছিল পদবী।
সেও এক বিপ্লব বৈকি।
পরবর্তীকালে দেখা গেল অনেক কবি পদবী ব্যবহার করেন না। আমার মনে হয়, অনির্বাণের সেই ধারাকে অনেকেই বহন করছেন আজ।
আমার সমস্ত বন্ধুর সঙ্গেই চিঠি বিনিময় হয়েছে। অনির্বাণও আমাকে লিখেছে চিঠি। নিয়মিত। আজও সেই চিঠির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম : আলো বিষয়ে তোমার বক্তব্য আমাকে বলো।
দেখা তো হয় না। যদি চিঠি পত্রের মাধ্যমে জানা যেতো----আলোর দিকে আমিও যেতে চাই। আলো নিয়ে আমার এক রকম আচ্ছন্নতা আছে। যেমন, ঘুম পেলেও ঘুমোতে চাই না। কারণ, ঘুমোলেই অন্ধকার। কথা বলা যাবে না। আকাশ ও মাটি দেখা যাবে না।
কিন্তু আমার মনে হয়, অনির্বাণের কাছে আলোর অর্থ আরো কোনো কিছু। যেখানে আমি প্রবেশ করতে পারবো কিনা সন্দেহ। আলো শুধু একটি বিন্দু নয়। অথবা আলো শুধু সূর্য নয় চন্দ্র নয়। বরং আলো এক শিশুর হাসি।
অনির্বাণ কি বলবে জানি না। তার কাছে নিশ্চয়ই আলো বিষয়ে কোনো তত্ত্ব আছে।
তত্ত্ব বাদ দিয়ে আমার একটি গল্প এখানে বলে রাখছি-----এক সবজি বিক্রেতা মহিলাকে প্রতিদিন আমি কিছু না কিছু জলখাবার দিয়ে থাকি । আজ দিতে ভুলে গেছলাম। যখন মনে পড়ছে, তখন বেলা হয়ে গেছে ঢের। তবুও আমি এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে তার জায়গার কাছে ছুটে গেলাম। দেখতে পেলাম, আছে এখনো।
আমি স্বস্তি পেলাম।
তার হাতে বিস্কুট প্যাকেটটি দিয়ে
আমার তৃপ্তি হলো।
অনির্বাণ, একে তুমি কি বলবে?
-------------------------------------------------------
অনির্বাণ,
আমার এই লেখা মনে হচ্ছে স্মৃতিকথাও হলো না। স্মৃতিরা সব হারিয়ে গেছে। আর তুমি তো জানো, কাব্য আলোচনাতেও আমি অপারগ।
এই লেখা আমাদের বন্ধুতার উদযাপন। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে হরিতকী বহেড়া আমলকি। যেখানে ছড়ানো হচ্ছে, তেজপাতার গন্ধ। আর লবঙ্গ লতায় জড়িয়ে আমাদের বন্ধুতা সৃজন করে যায়-----আলোবাসা।
-------৭ শ্রাবণ ১৪২৯
------২৪----৭----২০২২
-------নির্মল হালদার
ছবি : সংগৃহীত







কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন