লোকনৃত্য শিল্পী পস্তু বালা দেবী
---------------------------------------
আমার চার দিদি নেই।
ভাই ফোঁটা পেয়ে থাকি তারপরও।
পস্তু বালা অথবা পস্তুদি আমাকে
প্রতিবছর ভাইফোঁটা দিয়ে থাকে।
পস্তুদির সঙ্গে এই রকমই আমার সম্পর্ক। একদিন কোনো এক বিষয়ে পস্তুদির কাছে দুঃখ প্রকাশ করছিলাম। তো পস্তুদি ও বিজয়
আমাকে বললো, যখনই মন খারাপ করবে চলে আসবেন আমাদের কাছে।
তাদের কথার মধ্যেই ভরসা পেয়ে আমার চোখ ছল ছল করেছিল।
আজকের দিনে ক'জন আর আশ্রয় দিতে পারে! ভরসা দিতে পারে!
একটা সময় পস্তুদির নিজেরই কোনো আশাভরসা ছিল না। আশ্রয় ছিল না। সে শৈশবেই পিতৃহারা।
বাবা ছিল নাচনি---দলের বাজনদার।মনোহর সিং সর্দার।
সেই মনোহর পস্তুদির মা বিমলা
মুদিকে ভালোবেসে ঘরে এনেছিল। তৈরি করেছিল নাচের দল।
সেই মনোহর মারা গেল পস্তুদি
যখন দু-তিন মাসের। মেয়েকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়লো বিমলা। অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে মেয়েকে জ্যাঠা--জেঠির কাছে রেখে বিমলা পালিয়ে গেল।
পস্তুদি লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় বড় হতে থাকে জ্যাঠা--জেঠির আশ্রয়ে। এবং একটু বড় হতেই তাকে তাদের গাঁয়ে কর্মা টাঁড়ে ভিক্ষা করতে হয়েছে। মা বিমলা খবর পেয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়।
এই গল্পের অলিগলির জটিলতায় না গিয়ে
দু'একটি কথা বলার চেষ্টা করছি মাত্র।
কাশীপুরের রাজার বাড়ি থেকে
পুরুলিয়ার লোকনৃত্যের প্রবর্তন ।
পুরুলিয়ার ভাষায়----নাচনি নাচ।
যা রাজা জমিদারদের আমল শেষ হতে মাঠেঘাটে নেমে এলো।
এক কথায় বলা যায়, নাচনি নাচ
হয়ে গেল জনগণের বিনোদন।
পস্তুদি সিন্ধু বালা দেবীর কাছে
শিখেছিল নাচ। সেই নাচ দেখে
আকর্ষিত হয়েছিল বিজয় কর্মকার। বলরামপুর ডুমারি গ্রামের বিজয় কর্মকার ।সে পস্তুদির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললো নিজের জীবন।
পস্তু দির রসিক হয়ে উঠলো
বিজয় কর্মকার। সে হারমোনিয়াম বাজায়। ঝুমুর গান করে। পস্তুদি নাচে। গাঁয়ের পরবে পরবে।
পস্তুদির পায়ের ঘুঙুর থেকে ছড়িয়ে পড়ে পথে পথে না--বলা --কথা।
সেই না--বলা--কথার দিকে
কে চেয়ে থাকে? কারা চেয়ে থাকে?
কলকাতা থেকে দুর্বার সমন্বয় কমিটি পুরুলিয়াতে এসে নাচনিদের সংগঠিত করে একটা কমিটি গঠন করলো। তারাই প্রথম নাচনিদের কন্ঠে জাগিয়ে
তুললো ----দাবিদাওয়া। তারাও লোক শিল্পী। তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে।
পুরুলিয়া শহরের কাছেই সুরুলিয়াতে নিজেদের একটি
দপ্তর নির্মাণ করলো দুর্বার সমন্বয় কমিটি। সেক্রেটারি পদে বসানো হলো পস্তুবালা দেবীকে।
এই পস্তুবালা দেবী তার রসিক
বিজয় কর্মকারকে নিয়ে এই দপ্তরেই থাকে। এখান থেকেই
পুরুলিয়ার নাচনিদের জন্য লড়াই। সরকারের কাছে দাবি আদায়।
বর্তমান সরকার লোক শিল্পীদের
জন্য প্রতিমাসে হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে। হাজার টাকায় কিছুই হয় না, এই ক্ষোভ শিল্পীদের মুখ থেকে শোনা যায়।
সম্প্রতিকালে নাচনি নাচেরও কদর নেই। কেন না, জনগণের বিনোদনের জন্য হরেক কিসিম পসরা সাজানো আছে বাজারে।
ডাক আসে না নাচনিদের কাছে।
গ্রামে গ্রামে নাচনিরা ধুঁকছে।
ভিক্ষা করে জীবনকে টেনে নিয়ে চলেছে অনেক নাচনি।
পুরুলিয়া শহরের কাছেই পস্তুদি
থাকে বলেই, আমি মাঝেমধ্যে তাদের কাছে চলে যাই। পস্তুদি ও বিজয় আমার ডেরাতেও আসে।
আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যায় টাকা।
তাদের অভাব আছে তারপরও
আমার মত অধম দাদাকে ভুলে
যায় না। তারা জানে তাদের দাদাও
হাত পাতে কোথাও কোথাও। তাই
তাদের ভালোবাসা থেকে আমি
আমার চোখের জল মুছি।
পুরুলিয়া জেলায় লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পস্তুবালা দেবী বিশেষ একটি নাম। সেই নাম যেন অক্ষুন্ন থাকে, পুরুলিয়া জেলাবাসী হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে।
তাদের বেঁচে থাকা যেন মসৃণ হয়
এ বিষয়ে মহামান্য সরকারেরও
অবশ্যই দায়িত্ব থাকা দরকার।
পস্তুদি ও বিজয়ের এক চিলতে উঠোনে কুঁদরির লত উঠলে আমি দেখতে পাই, পস্তুদির নাচের শৈলি।
বাতাসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
------২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------১১---৬---২০২২
------নির্মল হালদার
ছবি : সন্দীপ কুমার, অজয় মাহাত










কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন