শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২

যৌথ খামার



যৌথ খামার
-----------------
বাঁশ বাগানের মাথার উপর
চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো আমার শোলক বলার
কাজলা দিদি কই?

বাঁশবাগান দেখলেই, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর এই কবিতাটি কাছে এসে যায়।

বিষণ্ণতাও জাগে।

কাজলা দিদি কই? কোথায়?

বাঁশ বাগানে মুরগির লাফালাফি।
বাঁশপাতা কেঁপে কেঁপে ওঠে।

বাঁশ বাগানের পাশেই সরু কাঁচা রাস্তায় চলে যাচ্ছে সাইকেল।

কোথায় যাবে কার কাছে যাবে?

বাঁশ-বাগানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে গরু। কার অপেক্ষা করছে?
কে আসবে?

বাঁশ বাগানে দাঁড়িয়ে থাকলেও
বাঁশি বাজে না।

মোহন বাঁশি বাজে না।

কোথায় গেছে রাখাল?

বাঁশের অনেক গল্প আছে।
অনেক কাহিনী।

একা একা একটা বাঁশ বেড়ে ওঠে না। সব সময় একসঙ্গে। আর তাই
আরো অনেককে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।

বাঁশ হলো কুটির শিল্পের উপাদান।
রুটি রুজির উপাদান।
বাঁশ থেকে ঝুড়ি ঝাঁটা।কুলো ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুরুলিয়াতে একসময় বেশ বড় বড় বাঁশের ছাতা তৈরি হয়েছে।
যা মাঠে-ঘাটে কাজ করা মানুষ
ব্যবহার করতো। বাগালরাও বাঁশের ছাতা মাথায় গরু বাগালি করেছে।
সময় পাল্টে গেছে।  বাঁশের ছাতার বদলে আরো কত রকম ছাতা। বাজারে বাজারে।

একসময়ের কুটির শিল্প 
আজ ধুঁকছে। ফলে, কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষও ধুঁকছে।

মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাশাপাশি বাঁশ তার যৌথতা থেকে এক তিল সরে দাঁড়ায়নি।

একটা বাঁশ পুঁতলে অনেক বাঁশের জন্ম। বাঁশ জানে বংশবিস্তার করলেই মনুষ্য বংশের উপকার হবে। যদিও মানুষ জানে না, বাঁশের মত যৌথ সংসার। 

মানব জীবনে অথবা মনুষ্য জগতের কাছেই থাকে এক--একটি বাঁশ বাগান। যেখানে
আলাপ বিস্তার করে পাখিরা।

বাঁশ বাগান থেকে বাঁশিও পাড়ে
একটি মেয়ে। গ্রাম বাংলার মেয়ে।

শুধু কি বাংলা?

আসাম ত্রিপুরায় বাঁশ থেকে
নানারকম ব্যবহৃত দ্রব্য তৈরি হয়ে থাকে। সেইসব রাজ্যে বাঁশ একটি বড় শিল্প।

চিত্রকরের কাছেও বাঁশ একটি শিল্পের উপাদান। কবি ও শিল্পী
শ্যামল বরণ সাহার  তুলিতে 
বাঁশের ছবি বিখ্যাত।

অভিজিৎ মাজীর ক্যামেরাতেও
বাঁশের ছবি। বাঁশ বাগান। 

আমি চেয়ে আছি-------------।

প্রকৃতির ধর্মই হলো যৌথতায় থাকা। সেই যৌথতার চুড়ান্ত রূপ বাঁশের শোভা।

শুকনো বাঁশ পাতার উপরে একটি পোকা চলে গেলেও শুনতে পাবো তার শব্দ।

হাওয়ার শব্দ উঠছে। এবং হাওয়া
বাঁশ বাগান থেকে বাঁশির ভেতরে।
বয়ে যায় সারাদিন।


-------বেলা-----৩---৪৬
-------১৬ বৈশাখ ১৪২৯
-------৩০-----৪-----২০২২..
-------নির্মল হালদার


































ছবি : অভিজিৎ মাজী


















বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২২

গাছের মাথায় তারা জ্বলে



গাছের মাথায় তারা জ্বলে


শ্যাম ভাইয়া----

হ্যাঁ শ্যাম ভাইয়াকে যখন ইচ্ছে ডাকলে সাড়া পাবো এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
সেই নিশ্চিন্ততা থেকে আমাদের বন্ধুত্বের বয়স হয়ে গেল ৪০ বছরের বেশি।

বন্ধুত্বের বুনন সুতোয় বোনা নয়
বলে ছিঁড়ে যায়নি। ধারাবাহিক
আমাদের সম্পর্ক, নিঃশব্দ।

এমনটা নয় যে তার সঙ্গে প্রতিদিন
আড্ডা হয়। কথা হয়। ফোনাফুনি হয়। এমনটা নয় যে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নিয়মিত। তবুও বলতে পারি, একটা অদৃশ্য টান আছে আমাদের মধ্যে। এ কারণেই
হঠাৎ হঠাৎ-----

কেমন আছেন?
অনেকদিন কথা হয়নি।
লেখালিখি চলছে?

লেখালিখির সূত্রেই শ্যাম ভাইয়ার
কাছাকাছি এসেছি আমি ও সৈকত।

শ্যাম ভাইয়া -------পিতৃদত্ত নাম
শ্যাম রাজগড়িয়া। শ্যাম অবিনাশ
নামে কবিতা লেখেন। গল্প লেখেন।
হিন্দি ভাষায় তার দুটি কবিতার বই আছে। দুটি গল্পের বই আছে।
বাংলাতে অনুবাদ প্রকাশিত।
কবিতার বইটির অনুবাদ করেছে
শুকতারা মিত্র।

শ্যাম ভাইয়া হিন্দি সাহিত্যের একজন কবি হলেও বাংলা সাহিত্যের খবর তার কাছে সব সময়। কালীকৃষ্ণ গুহর প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হলে তিনি আগ্রহ দেখান। গৌতম বসুর প্রবন্ধের বই তিনি সংগ্রহ করেন।

কে কোথায় কি লিখছেন এই বাংলায় তার কাছে তো খবর থাকেই তার সঙ্গে দেখা যায়
কোনো তরুণ কবির কবিতার বই তার কাছে।

বরাবর তিনি আড়ালে থাকেন।

আমাদের পুরুলিয়ার অধিকাংশ মানুষ এবং কবি-লেখকরা তাকে চেনেন না।

৭০ দশকের দু চারজন কবি
তাদের কবিতা শ্যাম ভাইয়াকে দিয়ে হিন্দিতে অনুবাদ করিয়েছেন।

এই মানুষটি আগাগোড়া সুভদ্র।
শিল্পসাহিত্য বাদেও ইতিহাস, বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়েও তার অতি উৎসাহ।
তার সঙ্গে আড্ডায় বসলে, কথায় কথায় তিনি বলে ফেলেন, কোন্ সার ফসলের ক্ষতি করে। কোন্ সারে ফসলের লাভ।

আমার লাভ হয়েছে, তার সঙ্গ পাই। মনে মনে। অবিরত। তিনি যেন গ্রীষ্ম দিনের তরমুজ। বাইরে থেকে আঁচ পাওয়া যাবে না ভেতরে কি আছে। অথচ তরমুজকে দুভাগ করলেই, শাঁসালো জল। সুমিষ্ট।
আরেকটা কথা বলা যায়, তার সঙ্গে জল--জঙ্গল--জমির আত্মীয়তা অনুভব করি। সেইসঙ্গে অবশ্যই তিনি একটি পাহাড়ও।
যার কাছে যাওয়া যায়। দাঁড়ানো যায়।

শুধু ঘরে নিয়ে আসা যায় না।

তার সঙ্গে আমার কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে অর্থনীতি নিয়ে অনেক কথা হয়। পুরুলিয়ার জল কষ্ট নিয়ে কথা হয়।

তিনি পুরুলিয়ার সন্তান।

পুরুলিয়ার প্রতি তার অমোঘ টান।

অযোধ্যা পাহাড়ে গাছ কাটা হলে
তিনি কেঁপে ওঠেন। তিলাবনি পাহাড় ভাঙ্গার চক্রান্তে তিনি কষ্ট পেয়ে থাকেন।

এই তো স্বাভাবিক।
তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ। যার বাবা দুর্গা রাজগড়িয়া
তার সন্তানদের বলেছিলেন--------ওষুধের দোকান খুললে কি মনে হয় জানো? মনে হয়, আমরা মানুষের রোগ জ্বালা খুঁজছি, ওষুধ বিক্রি করবো।

সেই দুর্গা রাজগড়িয়ার প্রথম পুত্র সন্তান আমাদের শ্যাম ভাইয়া।
শীতের সময় তাকে বললাম, অমুক নাচনি শিল্পীর জন্য একটা কম্বল দিতে হবে ভাই।
তিনি যথাসময়ে পাঠিয়ে দিলেন।
অথবা তমুক গাঁয়ে দশরথ মাহাতর মেয়ের বিয়েতে আপনাকে সাহায্য করতে হবে।

তিনি "না"করতে জানেন না।
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন।

অনেকবার অনেক সাহিত্য গোষ্ঠী
তাকে সংবর্ধিত করতে চেয়ে হতাশ হয়েছেন।
না, তিনি সামনে যাবেন না। নিজেকে সবসময় আড়ালে রেখে নিজের কাজ করে যাবেন।
তার ভাই সন্তোষ রাজ গড়িয়া
আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে খুবই বিখ্যাত। তার কথা বলতে যতটা আগ্রহী তিনি ততটাই নীরব নিজের বিষয়ে।

আমি তো সবসময় তাকে জ্বালাতন করি। আমার আঙ্গুলে ছুঁচ ফুটলেও শ্যাম ভাইয়াকে জানাই। কেননা আমি জানি, আমার যে কোনো ছোট থেকে বড় বিপদ অব্দি তিনি আমাকে উদ্ধার করবেন।

আমার বড়দি যখন বেঁচে তখন
শ্যাম ভাইয়া বড়দির প্রেসারের
ওষুধ আমাকে জোগান দিয়ে গেছেন। নিয়মিত।

সৃজনশীল অবশ্যই। আর তাই,
তিনি মনেপ্রাণে সজীব। তার সৌন্দর্যের কাছে  সৌরভ পেয়ে থাকি।

তিনি জানেন, লম্ফর তেল ফুরিয়ে গেলে চাঁদ তারার আলো উস্কে দিতে হয়। এবং জ্বালাতে হয় অন্তরের আলো।

তিনি উর্দু সাহিত্য থেকেও রসদ গ্রহণ করেন। এবং ভারতীয় সাহিত্যের বাইরেও তার অবাধ যাতায়াত।

স্তব্ধতার সঙ্গে আমি দেখি।

তার ছেলে তার ভাইপো ফটোগ্রাফিতে নানান পুরস্কারে পুরস্কৃত। কিন্তু তিনি এবং তার পরিবার ঢাক ঢোল পিটিয়ে বেড়ান না। তার ভাইয়ের কথা পশ্চিমবঙ্গ
ও ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সাত সাগর পার। সেই সন্তোষ রাজগড়িয়াও
নিজের বিষয়ে সব সময় মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন।

এদের কাছেও অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন প্রকৃতির কাছ থেকে সবসময় শিক্ষা নিয়ে থাকি।

এই সুভদ্র মানুষটির জীবন যাপনে কোনো আড়ম্বর নেই। তিনি গাছের মাথায় একটি তারা।  
আমি দেখতে না চাইলেও তারাটি আমাকে দেখবে।


-------১৩ বৈশাখ ১৪২৯
------২৭----৪----২০২৯
------নির্মল হালদার






ছবি : আলোক অবিনাশের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে















রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছো দেবতা আমার


        


বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছো দেবতা আমার

-------------------
নির্মল হালদার 
-------------------

মালথোড় বেলমা পিঠাজোড় 
ডুমুরশোল চিপিদা পানিপাথর সুজানডি নাকি ডাকাকেঁদু থেকে এসেছিল?
যে গ্রাম থেকেই আসুক তার নাম? যে নামই হোক, সে কোনোদিনই পাখি মারে নাই।

লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে গরু বাগালি করলেও সে কখনো
গরুর গায়ে হাত তুলে নাই।

কাঁধে কখনোই থাকে না তীর ধনুক। হাতে কখনোই থাকে না গুলতি। তার কাছে শুধু বই।

আজ শুধু অঙ্কের বই।


অঙ্ক করতে করতে সে দেখে
পাখির মুখে আহার বাটছে 
আরেকটা পাখি।

আজ সকাল বেলায় দেখছিল
একটা কাঠবিড়ালি ঘরের দুয়ারে এসে হতাশ হয়ে ফিরে গেল।

কোনো খাদ্য নেই।

সেই মুহুর্তেই তার মনে হয়েছিল,
তরমুজ ক্ষেত থেকে একটা পাকা তরমুজ তুলে নিয়ে আসতে।

তরমুজটা ভেঙে দিলে, লাফাতে লাফাতে কাঠবিড়ালিটা খেতে পারতো। জলতেষ্টাও মিটে যেত তার।

কাঠবিড়ালিদের জন্য পাখপাখালির জন্য জলের ব্যবস্থা থাকা দরকার বৈকি।

এখনো তাদের গ্রামে দু তিনটে বাঁধ আছে। আর তাই গাই গরুর দল বাঁধে নেমে জল খায়।

কাঠবিড়ালি কোথায় যাবে?

পাখিরা কোথায় যাবে?

এই ঝাঁ ঝাঁ করা রোদে গাইগরুকে নিয়ে মাঠে যেতে ইচ্ছে করে না তার। কেননা, মাঠে ঘাস নেই। মিছিমিছি রোদে রোদে পুড়বে কেন তারা?

সেদিন টিউশন থেকে ফিরতেই,
তার মা বললো, যা গরু গিলাকে
ঘুরায় লিয়ে আয়-------।

সে কিছু না বলে, কুলির দোকানে গিয়ে মটর ভাজা কিনে চিবোতে থাকে। তার মনে হয়, আজ অন্তত
রোদ থেকে গরু গুলোকে বাঁচাতে পারলো।

সে নিজেও অবশ্য দু কিলোমিটার
সাইকেল চালিয়ে এসেছে। টিউশনি থেকে।
তাদের গ্রামে অঙ্কের কোনো 
টিচার নেই। তাকে যেতে হয় বাধ্য হয়ে দূরের গ্রাম।

এই সেদিন গাজনের মেলায় 
সারা রাত জুড়ে ছো--নাচ হলো।
দিনের বেলা মুরগা লড়াই হলো।
সে মুরগা লড়াইয়ের মাঠ থেকে
ছুটে চলে এসেছিল  ঘরে।

হিংসার লড়াই রক্তারক্তির লড়াই
সে দু চোখে দেখতে পারেনি। তার মনেও হয়েছে, মানুষ অহিংসায় থাকতে পারেনা বলে, গরাম থানেও মুরগা বলি। কালীর থানেও ছাগল বলি।

এত রক্ত!

সইতে পারে না সে।

তার বন্ধুকে বলছিল একদিন,
জানিস----কাকতাড়ুয়াকে আমার ভাল্লাগেনা। কাকতাড়ুয়ার জন্য
শাকসবজির ক্ষেতে পাখিরা আসতে ভয় করে।

অঙ্ক যখন মেলেনা সে খাতায় আঁকতে থাকে পাখি আর পাখি।
সেও পাখির সঙ্গে একদিন উড়তে উড়তে চলে যাবে দিগন্তের কাছে।

কবে যাবে?

অঙ্ক তার পিছু ছাড়ছে না। আবার
মা বাবার কথা না শুনলে তার কষ্ট হয়। সে বিপন্ন বোধ করে।

সে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।

বাঁধনা পরবের গরুর লড়াই
সে কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারে না। গাঁয়ে গাঁয়ে আজকাল যে কাড়া লড়াইয়ের নামে হিংসার পরে হিংসা রচিত হয় সে পছন্দ করে না একদম।
সে সব থেকে  অনেক দূরের একটা গাছের ডালে সে শুয়ে থাকে। চুপচাপ।
এবং সেই গাছের পাতারা তাকে শুশ্রূষা জোগায়।
গাছের পোকারা ডালে ডালে
হেঁটে বেড়ালেও তার পায়ে , হাতে ,
গায়ে একবারের জন্যেও ওঠে না।
তারা মনে করে, এই পৃথিবী সুন্দর হোক। সুসভ্য হোক। কেউ কাউকেই কামড়াকামড়ি আঁচড়াআঁচড়ি করবে না।

সেও যে অশথ পাতার বাঁশি বাজায়। সেও যে রাগিনীকে বলেছে, হরিণের শিঙে লটকে চাঁদ হাসবেই। 

সে কিরাত। সে আমার বন্ধু।

বহু যুগের ওপার হতে এসেছে সে।
তাকে আমি চিনতে পারি।

তাকে আমি চিনতে পারিনা।


------১০ বৈশাখ ১৪২৯
-----২৪----৪----২০২২
-----বেলা---৪---৪৬





                  ছবি : অসিত মাহাত





















শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২

নিজস্ব আলোর কিরণে//


বাংলাবাজারের তোয়াক্কা না করে,
পাঠকের দিকে না তাকিয়ে,
একটার পর একটা বই,
গল্পের বই, উপন্যাস প্রকাশ করে চলেছেন স্বপন চক্রবর্ত্তী।

স্বপন আদ্যোপান্ত এক সাধারণ মানুষ। আসলে অসাধারণ মানুষ।
আর তাই তার কাছে দাঁড়াতে কোনো জড়তা কাজ করে না।

যে কোনো বিষয়ে অথবা বিপদে
স্বপন চক্রবর্ত্তী। তিনি আছেন।
ভরসা দেবেন বলেই, সব সময় আছেন।

প্রকাশ্যে নয় আড়ালে আছেন।

আড়ালে থাকতেই ভালোবাসেন।

নিজের লেখালেখি নিয়ে কোথাও কোনো দিন তাকে সোচ্চার হতে দেখিনি। কোনো প্রকাশকের কাছে গিয়ে দরবার করেননি যে
আমার বইটা প্রকাশ করুন।

তিনি নিঃশব্দ।

নীরবে তার সৃজন কাজ। নিভৃতে
লেখালিখি। যা নিয়ে কখনো কোনোদিন বাংলাবাজারের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার দিকে
ছুটে যেতে দেখিনি তাকে।

শুধু কি বাণিজ্যিক কাগজ?

ছোট কাগজের সংকীর্ণতার দিকে
অথবা রাজনীতির দিকেও তিনি ছিলেন না কখনো। আজও নেই।

তিনি বিশ্বাস করেন, অবশ্যই আমার মনে হয় , নীরবে নিজের কাজ করে যাওয়া। এবং সেই তো প্রকৃত কাজ। প্রধান কাজ।

সেইতো সাধনা।

যিনি রবীন্দ্রনাথের গানে সাবলীল।
যিনি রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান
নিজের অন্তরে গেঁথে এবং গান গাইতে গাইতে সুরের সৌরভ ছড়িয়ে থাকেন।

তিনি স্বপন চক্রবর্ত্তী।

তার গদ্য শৈলীর কথা নাই বা বললাম, তার গল্প উপন্যাস পড়তে পড়তে কখনো কখনো মনে হয়েছে কবিতা পড়ছি।

তার উদারতার কাছে একটি আকাশ সব সময়। তার উদারতার কাছে এক ভিখারিও সব সময় ।
তিনি ফিরিয়ে দেন না।

আমার মনে হয়, তিনি যখন
কারোর হাতে দান করেন একটি পয়সা, তিনি তখন জানেন 
বিনিময়ে ফেরৎ পাবেন  একটি 
আনন্দময় হাসি। অথবা উজ্জ্বল মুখ।

সে কাজও তো অনুচ্চারিত থাকে।

পুজোর সময় আত্মীয় স্বজন থেকে আরম্ভ করে কাগজের হকার , সবজিওয়ালা মাছওয়ালাকেও নতুন জামা কাপড়ের জন্য সবাইকে কিছু না কিছু অর্থ দিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র
সবার হাসিটুকু দেখবেন বলেই।

প্রত্যাশা করেন না।

পাখিতো চেনেন। অনেক অনেক গাছপালা চেনেন। তিথি নক্ষত্র চেনেন। জীবজন্তু কীটপতঙ্গের প্রতিও তার টান লক্ষ্য করেছি।

সবাই ভালো থাকুক তার এই মনোভাব তাকে  আরো ঐশ্বর্যবান করেছে। তিনি যে তাকিয়ে থাকেন
প্রকৃতির দিকে।

তার প্রিয় ঋতু গ্রীষ্ম।

পুরুলিয়ার প্রতি সব সময় তিনি আকর্ষণ বোধ করেন।
একসময় পুরুলিয়াতে চাকরি করতে এসে তিনি হয়ে গেলেন পুরুলিয়া প্রেমী।
পুরুলিয়াকে নিজেতো ভালবাসেন
সেই সঙ্গে আরো অনেক বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনকে
পুরুলিয়াতে নিয়ে এসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরুলিয়া দেখান। পুরুলিয়ার প্রকৃতি দেখান।

এক এক সময় মনে হয়েছে,
স্বপন চক্রবর্ত্তী নিজেও এক প্রকৃতি। শুধু দিতেই ভালোবাসেন।
আমাকে যে কত বই দিয়েছেন।
আমি নিজেও তার কাছে কত বই খুঁজেছি। পেয়েও গেছি।
আবার যে সমস্ত বই পড়া হয়নি আমার তা তিনি পড়িয়েছেন।
যেমন সতীনাথ ভাদুড়ীর অচিন রাগিনী। তারাশঙ্করের কবি'। আরো কত বই সব নাম মনে পড়ছে না।
সম্প্রতিকালে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন বিষয়ে অনেক বই তার কাছ থেকেই আমার পাওয়া।

আমি নিজে তাকে কিছুই দিতে পারিনি। কেবল নিয়ে থাকি।  
তার প্রতি নির্ভর করে থাকি।

হাঁসগুলি করে কোলাহল মনে পড়লেও মনে পড়ছে না প্রথম লাইনটি। স্বপনকে ফোন।
আমি জানি তিনি বলতে পারবেন।
সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ কবিতাটির ছবি
আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিলেন।

উদাহরণ ঢের ঢের।

একটা কথা তো বলতেই হবে, তিনি যখন পুরুলিয়াতে চাকরি
করছেন তখন আমার দিদি বেঁচে।
দিদি স্বপনের কাছে আব্দার করতো, কলকাতা থেকে গঙ্গা জল এনে দিতে হবে।

স্বপন যে কতবার এনে দিয়েছেন।

মনে পড়ে আজ।

তিনি গঙ্গার মতোই বহতা।

দুপারের জনপদ দুপারের ফসল
এবং তার শব্দ চেনেন।  পিপাসাও
চেনেন।

সহজেই তার কাছে বলে ওঠা যায় : জল দাও---জল দাও--


------৯ বৈশাখ ১৪২৯
-----২৩----৪----২০২২
------বেলা: ৩---৩৫
------নির্মল হালদার
















ছবি : সন্দীপ কুমার

















বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২

শাল গাছ গুলি আছে


শাল গাছ গুলি আছে
-----------------------------

কালীদা,
আপনি একসময় উচ্চারণ করেছিলেন কবিতার এই পংক্তি।
কবিতার পংক্তি নাকি এক বাণী?

হ্যাঁ কালীদা, চারদিকের ধ্বংসাত্মক এই সময়েও শাল গাছ গুলি আছে--------আমাদের একমাত্র ভরসা।
ভরসা আপনিও আমাদের কারো কারো কাছে।
ভরসা বলুন আশ্রয় বলুন আমার যৌবন থেকে আজও আপনি আমার কাছে।

আমার মত এক মফস্বলী যুবক
নানা দিক থেকে আপনার কাছে
প্রশ্রয় পেয়েছে। আর তাই, নাগরিক মননের কাছে কলকাতার পথে পথে হেঁটেছি।

আপনার সঙ্গে চলে গেছি আলোক সরকারের কাছে। তাঁকে
দেখেই মনে হয়েছে, তিনি এক তাপস।

সাধক। চিরজীবী।

আপনাকে কাছে পেয়েই আপনার জন্য কাছে পেলাম------গীতবিতান।
আপনি বললেন, রবীন্দ্রনাথের গান যখন শুনবে, গীতবিতান টা কাছে রেখো। গানটা শুনতে শুনতে গানটা খুলে দেখবে অবশ্যই।

অনির্বাণ কে বলতেই আমাকে উপহার দিলো গীতবিতান।
নন্দিনী উপহার দিলো , রেডিও।

আপনি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলেও কোনোদিন শুনতে ভুল করেন না সকালবেলার রেডিও থেকে রবীন্দ্র সংগীত।

আপনি নিজেও একজন রবীন্দ্র জিজ্ঞাসু। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে
আপনার আগ্রহ আপনার উন্মাদনা থেকে আপনি লিখেছেন
রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কত কিছু।

ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়েও আপনার আগ্রহ আমি দেখেছি। আপনার ইচ্ছে ছিল খুব, ধ্রুপদী সঙ্গীতের আমিও যেন চর্চা করি। একবার তো এক আসরে আমাকে নিয়ে গেছলেন।

আমি হতাশ করেছি আপনাকে।

শ্রেষ্ঠ কিছু ধারণ করার মত
আমার যে ক্ষমতা নেই কালীদা।
আমি শুধু নীরবে নিঃশব্দে  আমার জীবন প্রবাহে   শাল গাছ গুলি দেখতে পাই। যা আপনি আমাকে নতুন করে দেখিয়েছেন।
যেমনভাবে দেখিয়েছেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বিষ্ণু দে-কে মাথায় রেখেও আপনি সব সময়
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি
অরুণ কুমার সরকারও
আপনার প্রিয় কবি।

আপনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা থেকে আজকের আধুনিক চিত্রকলার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বলেই, আপনার মাধ্যমে আলাপ হয়েছে সমীর আইচের।

আরো কত চিত্রকর।

যারা শিল্পের পথ প্রশস্ত করে যায়।
প্রতিদিন।

প্রতিদিনের সূর্যোদয়ের মত   আপনার কাছে রবীন্দ্রনাথ। এবং
রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে যারা
যুক্ত হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে একজন শিল্পী এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়।

আপনার হাত ধরে তার কাছেও আমি গেছি।
আপনি একজন তরুণ কবি কে যেমন অনুপ্রাণিত করেন, তেমনি
রবীন্দ্র সংগীত যারা গাইতে আসেন, তাদেরও উদ্দীপ্ত করেন।

বাবলি সাহাকে আপনি সব সময়
 উৎসাহিত করে উজ্জ্বল করেছেন
রবীন্দ্র গানে।

আপনি ঘোষণা করলেও
আমি মানতে নারাজ আপনি নাস্তিক। কেননা, রবীন্দ্রনাথ
আপনার শিরা-উপশিরায়।

শান্তিনিকেতন আপনার প্রিয় মনোভূমি।

কোনোদিন আপনি কোনো
প্রতিষ্ঠানের দিকে গেলেন না।
লোভ ও ঈর্ষার দিকে গেলেন না।

আপনার কাছ থেকেই শুনেছি
আপনি আপনার ছেলেকে বলছেন-----বেল্ট ছিঁড়ে গেছে তো কি হয়েছে! মশারির দড়ি কোমরে বেঁধে স্কুলে চলে যাও।

এই আপনি কোনো দেখানেপনার
দিকে না গিয়ে  বারবার তরুণদের তাপে উত্তাপে নিজেকে সেঁকে নিতে চাইলেন। এবং
আপনি নিজেকে ৬০ দশকের মধ্যে না আটকে প্রতিটি দশকের
অথবা সময়ের কবি হয়ে উঠলেন।

আপনাকে প্রণাম।

আমি যখনই হতাশ হয়ে আপনাকে চিঠি লিখেছি আমার দুঃখ বেদনার , তখনই আপনি
আমাকে জানিয়েছেন---------
চলে এসো কলকাতা।

আমি কখনো গেছি। কখনো যাইনি। আবার যখন গেলাম
আপনার বেহালার বাড়িতে দিনের পর দিন আমার থেকে যাওয়া।

শুক্লা বৌদির স্নেহ--ভালোবাসা।

আজও আপনাদের আর্থিক সাহায্য আমাকে বাঁচতে সাহায্য করে।
আপনি তো পুরুলিয়ার উত্তম মাহাতকেও স্নেহ করেন। তার শিল্পচর্চার দিকে নজর রাখেন।

কালীদা,
আপনার কবিতা নিয়ে চুলচেরা
তাত্ত্বিক বিচার করবেন পণ্ডিতরা।
আমি শুধু আমার দু-একটা কথা
নিবেদন করলাম ।

আজ মনে হলো, আপনার সঙ্গে দু একটা কথা বলি এ কারণেই, শাল গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি, নতুন পাতা এসেছে। তার কচি রঙে  আপনার একটি কবিতা  লিখি------


ভাইবোন
--------------

ভাইয়ের বাড়ি থেকে
ফিরছে যে--বোন একা
দূর বিদেশের পথে
তার সাথে হয় দেখা।

নদীর পারে বাড়ি
কালী নগর গ্রাম
দগ্ধ যৌবন
আহত বিশ্রাম।

বাপ মরেছে রোগে
পক্ষাঘাতে মা
শরৎ কালের আলো
শুধুই কান্না ‌।

বাস চলেছে দ্রুত
শীতল ছায়ার মাঠ
ভাইয়ের মুখের কথা
বলছে রাস্তাঘাট।

আকাশ রেখা জুড়ে
ঘনায় অন্ধকার
অন্ধকারের নদী
কান্না যে হয় পার।


-----------------------------
 ঋণ : স্বপন চক্রবর্ত্তী
-----------------------------

------৭ বৈশাখ ১৪২৯
-----২১----৪----২০২২
--------নির্মল হালদার




















ছবি : সন্দীপ কুমার















কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ