বুধবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৩

আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--২০



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--২০
-------------------------------------------------------

ঘর বাইরে যাবে। বাহিরও ঘরে আসবে। এতো সুখের কথা। গৌরবের কথাও। যদি দেখা যায় পর হয়ে যাচ্ছে আপন, আপন হয়ে যাচ্ছে পর? এতো দুঃখের কথা। অভিমানের কথাও।

নিম গাছের শিকড় ছিন্ন হয়ে গেলে, নতুন করে নিমাইকে পাবো না। ওক গাছের তলায় কোন্ নবজাতকের মুখ দেখবো?

এই বেহুলা বাংলায় কলার ভেলা ভাসবে না আর।লখিন্দরের আয়ু ফুরিয়ে গেলে আম জাম কাঁঠাল শেষ হয়ে যাবে।

চাঁদ বেনে সওদাগর একা হয়ে যাবে আরো। অভিমানে অভিমানে কালো হয়ে যাবে আকাশ।

নক্ষত্র ফুটবে?

নয়নে কাজল দেখে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিমান আর কি দেখা যাবে?

বৈষ্ণব পদাবলীর কবিরা হারিয়ে গেলে ? শাক্ত পদাবলীর কবিরা হারিয়ে গেলে?

ললাট থেকে মুছে যাবে ধূলা-মাটির দাগ। জমি থেকে মুছে যাবে লাঙ্গলের দাগ।

সীতাও উঠবে না আর।

সরলা বাগদি দ্রৌপদী মেঝেন পূর্ণিমা মুর্মু পশুপতি মাহাত চন্ডি কর্মকারের জীবনের ধারা এসে মিলবে না সম্প্রতি কালের রচনায়।

ওরা ওদের শিকড়েই আছে, শুধু আমরাই শিক্ষিত-অশিক্ষিত বাঙালি ভুলে যাচ্ছি কালিদাসের কাব্য। ঋকবেদের কবিতা।

ঋকবেদেই তো পেয়েছি রাত্রি ও ঊষা দুই বোনের ভূমিকা। যারা সহজেই হয়ে যায় আমাদেরও বোন।আমি তাদের কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি পালক না হলেও পিতা হয়েছি। এই কারণেই , রাত্রি ও ঊষা আমার ঘরে বিচরণ করে।

শালুক ও পদ্মের এই বাংলায় পানা ফুলের রঙে আমার চিঠি লিখি , একা একা লিখি আমার শিরা উপশিরায়। যা গোপন থাকে। শান্ত হয়ে থাকে।

শান্ত হয়ে থাকে আমার নিজস্ব ভাষা।

মায়ের ভাষাতো ভুলে যাচ্ছি ক্রমশ। চোখের জলের ভাষাও ভুলে যাবো বোধ হয়। কান্না থেকেও শিল্প গড়ে ওঠে, হাহাকার থেকেও। সোমনাথ হোড়ের শিল্পকর্ম ও লেখা উদাহরণ হয়ে আছে। চিত্ত প্রসাদের ছবিও তার প্রমাণ। মীরা মুখোপাধ্যায়কে জানি, যিনি ঢোকরা শিল্পীদের আঁতুড়ে গিয়ে কাজ শিখেছেন। রবীন্দ্র ছায়ায় থেকে অবনীন্দ্রনাথ নন্দলালের ছায়ায় থেকে আদিবাসীদের দিকেই শিল্প-দৃষ্টি ছিল রামকিঙ্করের।

যেন ভুলে না যাই। 

যেন গরাম থানের প্রার্থনা, আমাদের সিনেমা থিয়েটারে, কাব্য কবিতায়, গল্প উপন্যাসে, চিত্রকলায় গান হয়ে ওঠে।

সকলের গান হয়ে ওঠে।

----৩ অঘ্রাণ ১৪২৯
---২০---১১--২০২২
----সন্ধে --৬--২২
----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৯



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৯
--------------------------------------------------------

কোনো গাছ না থাকলেও তুলসী গাছ থাকবেই ঘরের উঠোনে। ঘরের মা কাকিমারাও স্নান করে প্রথমেই তুলসী গাছে জল। তারপর নিজে জল গ্রহণ করবে।

তুলসী মঞ্চ কিংবা তুলসী থান যে কোনো পরিবারেই একটি বিশেষ জায়গা। সন্ধে হলেই তুলসী থানে একটি প্রদীপ। কেউ কেউ প্রদীপ না দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে দেয়।

বিশেষ করে গ্রামীন এলাকায় এই ছবি। প্রতিদিন। নগর জীবন থেকে দূরে চলে গেলেও তুলসী গাছ আছে। থাকবেও। বাঙালি মননে। বাঙালির ঘরে ঘরে।

নিম্নবর্গ বাঙালির ঘরেও তুলসী গাছ অবশ্যই। মাহাত ঘরে কোনো বিগ্রহ নেই। পূজা পাঠের আড়ম্বর নেই।কিন্তু তুলসী গাছ আছে। তুলসী থানের কাছেই মাহাতরা মনসা পূজায় হাঁস বলি দিয়ে থাকে।

অনেক পরিবারেই উঠোন নেই। তুলসী মঞ্চ নেই। অথচ তুলসী গাছ আছে একটি মাটির পাত্রে অথবা একটি ভাঙ্গা বালটিতে।

তুলসী গাছ বাংলার ঘরে ঘরে কী ভাবে প্রবেশ করলো, তুলসী গাছ কোন্ সংস্কৃতির ফসল আমি ইতিহাস ঘাঁটতে চাইনা। শুধু বলবো, উল্লেখ করতেও চাই------ তুলসী গাছ একটি ভেষজ গাছ। কোনো শিশু সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হলে তুলসী পাতা মেড়ে মধু মিশিয়ে শিশুকে খাওয়ালে, নিরাময় আসে।

আমাদের সমস্ত পূজাতে, শুভ অনুষ্ঠানেও তুলসী পাতা লাগবেই। তুলসী পাতা ছাড়া পূজা হবে না। তার ধর্মীয় ব্যাখ্যা থাকতে পারে, আমি সেদিকে যাবোনা। আমি শুধু তুলসী গাছের কাছেই থাকতে চাই। যে গাছ সম্পর্কে আমার মায়ের একটি কথা মনে পড়ে। মা বলতো-----তুলসী গাছ ছোট হলেও গাছ।

হ্যাঁ , গাছটি ছোট হলেও মনোরম। নিজের মতো করে একা একা থাকে।কোনো গাছের পাতা কালো। যার নাম , কৃষ্ণ তুলসী। যে গাছের পাতা সবুজ, সে হলো,
রাধা।

একসঙ্গে দুটি তুলসী গাছ কোনো উঠোনেই দেখা যায় না। যেকোনো একটি, রাধা কিংবা কৃষ্ণ।

বিরহে থাকতেই হবে।

বিরহ মানুষের কাছে প্রিয় একটি বিষয়। তুলসী গাছ গল্প উপন্যাসেরও বিষয়। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর একটি উপন্যাস----তুলসী গাছ।

আলোক সরকারের কাছ থেকে পেয়েছি একটি কবিতাও। কবিতাটি এই-----

ও তুলসী গাছ, ও তুলসী গাছ, শুনছ
আমরা এবার চলে যাচ্ছি। মালঞ্চ
কত দুঃখে কষ্টে ভরা
তুমি একা কী করে থাকবে খরা
বৃষ্টির দিনে? ও তুলসী গাছ, তুলসী গাছ।

হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কবিতাও পড়ে নিতে পারি-----

অন্ধকারকে জাগালো
তুলসী তলার আলো।

অনঘ হাওয়ায়
উড়ে চলে যায়
মরণের স্তব্ধ উত্তরীয়।

এই আলো , রমণীর,
তাই, সন্ধ্যা রমনীয়।

বাঙলা কবিতার মানচিত্র বটগাছ। বাংলা কবিতার মানচিত্র তুলসীগাছও। তুলসী গাছের ছোট ছোট হাওয়া বাঙালি জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখ। নিকটেই আছে। স্পর্শ পেয়েও টের পাই না। হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত বলতে পারি-----

অন্ধকারকে জাগালো
তুলসীতলার আলো।

ওই আলো হৃদয় থেকে জেগে ওঠা আলো। জেগে ওঠা প্রার্থনা।

------২ অঘ্রান ১৪২৯
-----১৯---১১---২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৮



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৮
---------------------------------------------------------

এক সময় অধিকাংশ বাঙালি ঘরেই পাঁজির একটা ভূমিকা ছিল। আজকের আধুনিক পরিবার গুলি পাঁজি--পুঁথি না--মানলেও পাঁজি রয়ে গেছে নিজের জায়গায়। পাঁজি দেখেইতো নির্দিষ্ট করা হবে বিবাহের দিন। শুধু বিবাহ নয়, গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশন। সাধ ভক্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজও বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা, গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা বাজারে দেখা যায়। এইসব পঞ্জিকা বছর শেষের চৈত্র মাসে চলে আসে।মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বাঙালি, কোনো কোনো বাঙালি সংগ্রহ করে। মাথায় ঠেকিয়ে ঘরে রাখে।

মনে আছে, পরিবারের কোনো বয়স্ক মানুষ পাঁজিটা এগিয়ে দিয়ে বলতো----পাঁজি দেখতে জানিস? দেখ তো, পরের মাসে শুভ দিন আছে কিনা। "পারি" শ্বশুর বাড়ি যাবে।

সময়ে অসময়ে আমিও পাঁজির পাতা উল্টে উল্টে দেখেছি। আমাকে খুব টানতো পাঁজির বিজ্ঞাপন। লম্বা চওড়া রাঙা মুলো নধর বাঁধা কপির চেহারা। সেইসব সবজির বীজ কম দামে কোথায় পাওয়া যায় তার‌ বিজ্ঞাপন পাঁজির পাতায়। বড় বড় করে।

পাঁজি ঝকঝকে রঙিন ছিল না।

আজকের চেহারা কেমন?

পাঁজি পাঁজি করতে করতে যে কথা বলতে চাই---- পাঁজি খুব রহস্যময়। গভীর। কোথায় কোন্ তিথি নক্ষত্র আছে দীক্ষিত না হলে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। একই কথা কবিতার ক্ষেত্রেও। দীক্ষিত পাঠক না হলে কবিতার রহস্য উন্মোচন করা যায় না।

পাঁজি সহজ নয়। জটিল নয়।

কবিতার ক্ষেত্রে দেখেছি, কোনো সমালোচক কিংবা কোনো কবি--পাঠক অথবা পাঠক কারোর কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করলেন---অমুকের কবিতা খুব সহজ। তার মানে জটিল কবিতা আছে। আমার প্রশ্ন, জটিলতা কাকে বলে? সহজতাই বা কী?

পাঁজিতে দেখা যায় সাংকেতিক ভাষা। সেই সংকেতকে ধরতে হবে,কী বলছে।

কবিতা আবার শুধু সংকেত নয় কবিতা একটি ইশারা। কবিতা নীরবতাও। ইশারার কাছে যেতে হলে, নীরবতার কাছে যেতে হলে, সারস্বত সাধনা চাই।

কবিতা যেমন হেলাফেলা নয় তেমনি পাঁজিও হেলাফেলা নয়। যারা পাঁজি রচয়িতা তারা নক্ষত্রের হিসেব অথবা অঙ্ক জানেন বলেই, মানুষের মঙ্গল কর্মে নিযুক্ত হয়ে থাকেন। তারা আড়ালেই থাকেন।

যে কোনো কল্যাণ কর্মী আড়ালেই থাকেন।

কবিও একজন কল্যাণ কর্মী।

-----১ অগ্রহায়ণ ১৪২৯
-----১৮---১১---২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৭



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৭
---------------------------------------------------------

আমি তাকে ভালোবাসি।
এও তো এক গল্প।
শিশিরে শিশিরে ছেয়ে গেছে মাঠ।
এও তো এক গল্প।
গাছে গাছে পেকে উঠছে বেল।
এও তো এক গল্প।

এও তো এক কবিতাও।

গল্প থাকলে , কবিতায় গল্প থাকলে কবিতা হবে না-------- একসময় বলেছিলেন এক কবি। আরো বলেছিলেন, প্রায় ব্যঙ্গের সুরে বলেছিলেন----কবিতায় গল্প থাকলে সিরিয়ালের দিকে চলে যায়।

আমার প্রশ্ন, মেঘনাদ বধ কাব্য তাহলে কী? পুরাতন ভৃত্য তাহলে কী? হাট তাহলে কী? লিচু চোর তাহলে কী?

নকশি কাঁথার মাঠ কবিতা থেকে গল্প হয়ে, গল্প থেকে কবিতা হয়ে হৃদয়ে যাতায়াত করে।

বিভূতিভূষণের গল্প উপন্যাসের অনেক অংশই কবিতা।

নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
জগদীশ চন্দ্রের এই বাক্য কবিতা হয়েই ঘুরছে আজও।

পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?
বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা থেকে এই বাক্যটি আমি কবিতা হিসেবেই কাছে রাখি। অথবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথায় সেই যে শশী বলছে---- শরীর শরীর তোমার মন নাই কুসুম।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে গল্প উপন্যাসের অনেক পংক্তি শ্লোক হয়ে সঙ্গে থাকে। আমরা প্রয়োগ করি কোনো কোনো ক্ষেত্রে।

কবিতায় গল্প থাকলে কবিতা টিভির পর্দায় সিরিয়ালের দিকে চলে যাবে এই নিদান তো শাসকের। কোনো কবির কাছ থেকে শুনলে কেঁপে উঠি। কোথায় দাঁড়াবো, এই প্রশ্নে ঘুরপাক খেতে খেতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক থেকে একটি সংলাপ উচ্চারণ করতে হচ্ছে----সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!

কত বাঁধাধরা ছক। মৌলবাদী ধ্যান ধারণা। রক্তচক্ষু নিষেধ তো আছেই ঘর থেকে বাইরে।

একজন মানুষ তার নিজস্ব জায়গায় সৃষ্টির আনন্দে ডুবে থাকতে চাইলেও তাকেও শুনতে হয়, কাঁচির কাঁটা ছেঁড়া। আজ যদি রবীন্দ্রনাথকে শুনতে হয়, তাঁর অনেক কবিতা গল্প হয়ে গেছে, তিনি কি করবেন?
আমি তো বলছি , বলতে চাই----- আমার অনুভব আমার গল্প।

এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য। আর দৃশ্যই তো গল্পের দিকে নিয়ে যায়।

যে দৃশ্য সুন্দরতাকে কবিরা বলছেন, চিত্রকল্প। কবিতা তো তাই, চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প।

কবিতার সৌন্দর্য।

সেই সৌন্দর্যের বিভা গল্প কাহিনীতেও থাকে। রামায়ণ মহাভারতেও আছে। গীতায় আছে।

কথামৃত রামকৃষ্ণের বাণী নয়। একটি কাব্যগ্রন্থ। ওই গ্রন্থ থেকেই অমোঘ একটি পংক্তি------ যত মত তত পথ।

এখানে পন্ডিত ও সমালোচকের দৃষ্টিকে, কোন কোন কবির দৃষ্টিকেও করুণা করতে ইচ্ছে করে। এঁরা মহাজীবনের দিকে তাকিয়ে বলতে পারলেন না----- জীবন এত ছোট ক্যানে?


-----২৯ কার্তিক ১৪২৯
----১৭---১১---২০২২
----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৬



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৬
---------------------------------------------------------

মুখের ভাষা হোক কবিতার ভাষা
একথা বলতে বলতেই
আমার বন্ধু রামানুজ মুখোপাধ্যায় বললেন-----
মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে এলেই,
কবিতার ভাষা। কবির ভাষা।

কবি যখনই কোনো ভাষা ব্যবহার করছেন তখনই কি তা কবিতার ভাষা?

তর্ক বিতর্ক চলতে থাকুক।

আমিও দিতে থাকবো পন্ডিতি প্রশ্নের মূর্খ উত্তর।

৮০ দশকে শান্তিনিকেতনে শিবনারায়ণ রায় একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করেছিলেন--সেই অনুষ্ঠানে সৈকত রক্ষিত আমন্ত্রিত ছিলেন। এবং তিনি মঞ্চ থেকে অনেক কিছু বলার পর 
ঘোষণা করেছিলেন---মূর্খের ভাষা হোক সাহিত্যের ভাষা।

সেই ভাষা কেমন ভাষা?

মানব পৃথিবীর বাইরেও আছে পশুপাখি কীট পতঙ্গের ভাষা। গাছপালার ভাষা। জল ঝড়ের ভাষা। পাহাড়ের ভাষা, সেও তো আমাদের।

কাছে যাবোনা?।

নিকটে যাবার বেলা বয়ে যায়।

দূরে দূরে থাকলে নদীসমুদ্রকে জানা যাবে না। দূরত্ব থেকে চেনা যাবে না ঝর্নার রূপ।

যদিও সমস্ত ভাষা ধরে থাকা সম্ভব নয়। জানাও সম্ভব নয়। তারপরও বলবো, কাছে যেতে হবে। বহমান প্রাণের সুখ দুঃখের কাছে যেতে হবে।

বৃষ্টি পড়ার শব্দে উল্লাস করি। মুগ্ধ হই। কিন্তু কান পেতে শুনি না, বৃষ্টির ভাষা। বহু যুগের ওপার হতে যে বৃষ্টি এসে আমাদের ভেজায় তার কাছে না গেলে প্রকৃতির আরেক রূপ জানা যাবে না।

আমার বন্ধু স্বপন চক্রবর্তীর প্রিয় ঋতু গ্রীষ্ম। আমি তাকে না বললেও মনে মনে জেনেছি, তিনি নিশ্চয়ই , গ্রীষ্মের দাবদাহ , তৃষ্ণা,
মরীচিকা, জল কষ্টের পরেও গ্রীষ্ম দিনের আলো দেখতে পেয়েছেন। আর তাই, ভালোবাসেন গ্রীষ্মকে।তার মতো করে প্রকৃতির একটি ঋতুকেও আমি অন্তত ভালোবাসতে পারিনি। তিনি আরেকটি কথা বলেন----
প্রকৃতি সব সময় অন্তরে বিরাজ করবে।

বাড়ির বাইরে না গিয়েও আমি টের পাবো, পলাশ ফুটেছে মাঠ প্রান্তরে।
স্বপন চক্রবর্তীর এই কথা অথবা বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি, তিনি প্রকৃতির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

মনে তো হয় আজকের অধিকাংশ কবিতার ভাষা কৃত্রিম ভাষা।

হোঁচট খাই।

ক্ষুধার্তের ভাষা শুনতে গিয়ে যদি
হোঁচট খেতে হয়, চারদিক অন্ধকার লাগবেই।
আসবে হতাশা।
এখানে একটা কথা, ক্ষুধার্তের ভাষা না জানা থাকলে, খিদে কি জানা যাবে না।

কবির কাছে প্রধান বিষয় ভাষা।

কবিও স্থির করবেন কোন্ ভাষায় লিখবেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের "সহজ পাঠ "একটি ভাষা-----

এত রাত্রে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কে? কেউ না, বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে। এখন অনেক রাত্রি। উল্লা পাড়ার মাঠে শেয়াল ডাকছে---হুক্কাহুয়া। রাস্তায় ও কি এক্কা--গাড়ি গাড়ির শব্দ? না, মেঘ গুরু্ গুর্ করছে।

" সহজ পাঠ " এর এই অংশটিও
আমার কাছে কবিতার ভাষা।

------২৮ কার্তিক ১৪২৯
------১৬---১১--২০
-----নির্মল হালদার




আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৫



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৫
--------------------------------------------------------

পাখির ঠোঁটে উড়ে যাওয়া একটি খড়। কবিতা নিশ্চয়ই। পাখির পায়ে লেগে থাকা শিশির বিন্দু। কবিতা নিশ্চয়ই।

মানুষের হাসি কান্না দুঃখ, কবিতা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ জানেনা বলে মানুষের কাছে এসে দাঁড়ায় একটি ভোর।

ভোরের স্নিগ্ধতায় মানুষ অনেক কিছু দেখতে পারে।যদি দেখার মত দৃষ্টি থাকে। যদি হৃদয় থাকে।

ভোর নিজেও একটি কবিতা।

সেই কবিতাই তো সারাদিন সুরের লতা ছড়িয়ে দিতে দিতে মানুষকে নিঃশ্বাস দেয়। ভরসা দেয়।

আনন্দ অবশ্যই দেয়।

ভোরে উঠেই কুকুর মা তার ছানাদের দুধ দিয়ে থাকে।ছাগ-শিশুও তার মায়ের স্তন্যপান করে। ভোরবেলা।

ভোরের কাব্য রস ফসলের ক্ষেতে। পত্র পল্লবে। গাছের গোড়ায়। ভোরের কাব্যরস থেকেই, সূর্য সারাদিন সৃষ্টি করে একটা কবিতার পর আরেকটি কবিতা।

দিনমজুরদের কথা জানি, বিশেষ করে যারা গ্রামে থাকে, তারা বারো মাস চারটের সময় উঠে পড়ে।আমাদের এক কবি বন্ধু চারটের সময় ওঠে। এবং সারস্বত চর্চায় মন রাখে।

কবিতাকে খুঁজতে হয় না, কবিতা আছেই সর্বত্র।

কাক যখন ডাকছে, সেও তো কবিতা। কবিতার জন্য রাজ দরবারে যেতে হয় না। সভাকবি না হলেও দেখতে পাবে পালং পাতায় রোদ পড়েছে।

হেমন্তের শীতেও কাঁপছে অশ্বত্থ গাছের পাতা। এখানে অন্ত্যমিল পয়ার এবং আঙ্গিক খুঁজতে গেলে হতাশা আর হতাশা। ঠকে যেতেও হয়। নিসর্গ প্রকৃতির কাছে বাঁধা ধরা কোনো অঙ্ক নেই। ছন্দ আছে। নিজের মতো করে একটা ছন্দ প্রকৃতি বহন করে। সেই ছন্দের শুরু ভোর থেকেই। ভোর, একটি গ্রন্থ। মহাগ্রন্থ।

"ভোরের কাব্য " সকলের কাছেই প্রতিদিন।

সেই কবে নজরুল বলে গেছেন---

ভোর হলো দোর খোলো----

----বিকেল--৪--৫২
----২৭ কার্তিক ১৪২৯
----১৪---১১---২০২২
----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন




আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৪



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১৪
--------------------------------------------------------

ঘোরতর সংসারি মহিলা ছিল আমার মা। নিরক্ষর ছিল আমার মা। ভেতরে ভেতরে কবিও ছিল আমার মা।

কেমন কবি ছিল? মুখে মুখে রচনা কি করতো? না, সেরকম কিছুই না। তবে কাব্যবোধ ছিল প্রখর। আমাদের পরিবারে আমার বড়দার প্রথম পুত্র সন্তান যখন এলো, তখন আমার মা পুত্র সন্তানের নামকরণ করেছিল---নুপুর। নুপুর নামকরণের পিছনে মায়ের ব্যাখ্যা ছিল, ভগবানের পায়ে নুপুর হয়ে থাকবে।
ভগবানের পায়ে নুপুর হয়ে থাকলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না। এই ভাবনা কিম্বা শুভ বোধ থেকে আমার মায়ের এই নামকরণ, আজও আমাকে  শুভ চিন্তার দিকে নিয়ে যায়। শুভকামনার দিকেও আমি যাত্রা করি।

আমার এই মা আমাকে একবার কলম উপহার দিয়েছিল। আসলে উপহার তো নয়, আশীর্বাদ। যে মা একদিন আমাকে ধমকের সুরে বলেছিল----লিখতে লিখতে ঠুঁটো হয়ে যাবি। বাক্যটি অভিশাপের মতো শোনালেও অভিশাপ ছিল না। মা কখনো সন্তানকে অভিশাপ দিতে পারে না। আমার আজ মনে হয়, মা আমাকে লেখালেখি করার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কলম দিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ মনে পড়ে-----কুসন্তান যদিও হয় কুমাতা কখনো নয়।

আমাদের এই সুজলাং সুফলাং বাংলায় যে সমস্ত প্রবাদ গুলি ছড়িয়ে আছে তা কাব্য সুষমায় জেগে আছে এখনো।

প্রবাদ আছে অনেক। মেয়েরা কথায় কথায় ব্যবহার করে। যেমন ছেলে বিয়েতে রাজি হচ্ছে না দেখে মা বলছে-----আমার ছেলে "ধনুক ভাঙ্গা পণ " করেছে। বিয়ে করবেনা। আরো একটি উদাহরণ----কোনো ঘরনী রেগে মেগে বলছে---সংসারের হাঁড়ি ঠেলতে ঠেলতে আমার হলো " হাড়ে হলুদ "।

আমাদের সংসারের মেয়েরাও কবি। তাদের অন্তরেও কাব্যবোধ থাকে তার অজস্র উদাহরণ দিনরাত্রি মেয়েদের নানা কাজে শোনা যায়। সময়ে। অসময়ে।
কারোর প্রেম বিষয়ে বলতে গিয়ে সেদিন একটি মেয়ে আমাকে বললো---উয়ার পিরিত "বালির পিরিত "। উয়ার সঙে আমি নাই।

প্রবাদ প্রবচন এক রকমের কবিতা। শব্দ ব্যবহারেও কবিতার কণা দেখতে পাই।

এক সকাল বেলা আমার মা ঘর ঝাঁট দিতে দিতে যেন বা নিজেকে শুনিয়ে বলছে-----আর কি পারিরে বাবা 
গায়ের চামড়া লোল হয়ে গেল। আমার তখন জানা ছিল না "লোল "শব্দটির অর্থ। অনেক অনেক পরে জেনে  মায়ের কাছে নত হয়েছি। মনে মনে।

অনেক প্রবাদে হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ থাকে। অপমান থাকে। সেইসব প্রবাদের দিকে আমি যাচ্ছি না। "গোবরে পদ্মফুল ফোটে "এওতো এক রকমের বিদ্রুপ। অথবা "দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো "অশুভ এই প্রবাদ আমার পছন্দ নয়। আমরা কি সন্তান দুষ্টু হলে সন্তানকে বর্জন করি? 

ভাঁড়ারে খুঁজলে পাওয়া যাবে,"পেটে খিদা মুখে লাজ "। পাওয়া যাবে সমাজ জীবনের অনেক ছবি।যেমন ---"খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল এঁড়ে গরু কিনে"।

কালে কালে প্রবাদ প্রবচন লুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ প্রবাদ প্রবচন থেকেও আমরা পাই  জাতি গোষ্ঠী ধর্ম
ও সময়ের ছবি। 

ভয় করে, কাব্যশিল্প থেকেও আমরা যদি দূরে চলে যাই? আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি থেকেও যদি দূরে চলে যাই?

"পরের ধনে পোদ্দারি " করতে করতে আমাদের সময় যে চলে যাচ্ছে। আমরা ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে নিজের মাটিকে ভুলে যাচ্ছি।

----২৬ কার্তিক ১৪২৯
----১৩--১১--২০২২
----নির্মল হালদার




আরও পড়ুন


আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--১৩



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--১৩
-------------------------------------------------------

সকালে উঠিয়া আমি
মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন
ভালো হয়ে চলি।

মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ভুলে গেলেও বাঙালি জীবনের এই ছড়াটি নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। আর ভুলে যাইনি বলেই, সময় থেকে সময় ছড়াটি আজও আছে।

আমার কাছে শিকড় হয়ে আছে।

এই শিকড় থেকেই বলছি, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের আরেকটি ছড়া---

পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুম কলি, সকলি ফুটিল।।
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন, নিজ নিজ পাঠে।।
ফুটিল মালতী ফুল, সৌরভ ছুটিল।
পরিমল লোভে অলি, আসিয়া জুটিল।।

এই ছড়া প্রবাদ হয়ে আছে বাঙালির ঘরে ঘরে। এবং এখনো এই সমস্ত ছড়া ভালবাসতে শেখায় জীবন ও জীবনের চারপাশ। আরেকটা কথা বলতেই হয়, এই ছড়াগুলিতে লুকিয়ে আছে নীতিকথা। যদিও তা উপদেশের মত মনে হয় না।  

ছোটবেলার সেই যে মজার ছড়া--

আয়রে আয় টিয়ে
নায়ে ভরা দিয়ে।
না' নিয়ে গেল বোয়াল মাছে,
তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে।
ওরে ভোঁদড় ফিরে চা,
খোকার নাচন দেখে যা।।

শিশুদের কান্না থামাতে নিরক্ষর মায়েরাও এক সময় এই ছড়া আবৃত্তি করতো। প্রচলিত এই ছড়া প্রবাদ হয়ে আছে।

এখান থেকে পালাতে চাইলে, পালানো যায় না। এমনও হতে পারে এই ছড়ার কাছে কিংবা মূলের কাছে, মূল কবিতার কাছে এখনো অনেকে আসতেই পারেনি।

কি করে ভুলে যাই --------

আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া
ওরে বিবি সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া।

এই ছড়ার শেষ দুটি পংক্তি আমাদের ছোটবেলায় ছিল সঙ্গীর মতো------

অল রাইট ভেরি গুড
মেম খায় চা বিস্কুট।।

খুব মজার ছলে বলতে বলতে আমরা অনেক খেলা খেলেছি। আজকের খেলা যখন মোবাইলের গেম, তখন এই প্রবাদ হয়ে যাওয়া ছড়া বন্ধুর মতো এসে দাঁড়ায়।

মন খারাপ করে।

মন খারাপ আনন্দের এক দিক। আমি বহন করছি আজও। বহন তো করতেই হয়, আমাদের বাংলা ছড়াতে আমাদের মেয়েও যে আছে, সেই যে সেই ছড়াটি---

আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, সূয্যি গেছে পাটে----
খুকু গেছে জল আনতে পদ্ম দীঘির ঘাটে।
পদ্ম দীঘির কালো জলে হরেক রকম ফুল,
হাঁটুর নিচে দুলছে খুকুর গোছা ভরা চুল।

এই বাংলার এই ছবিটি পুরনো হয়েও নতুন হয়ে আছে বাঙালির জীবন ধারায়। এইসব ছড়া থেকে আরেকটি বিষয় আমরা পাই তা হলো, প্রবাদ হয়ে যাওয়া ছড়াগুলিতে শুধু শিশু পুত্র নেই, আছে কন্যা সন্তানও।দুজনেই সমান আদরনীয় কবিদের কবিতায়। সেই কবিরা কোথায়? যাদের কবিতা থেকে ছড়া থেকে প্রাণ পাই। এখনও।

বাংলায় এত ঐশ্বর্য এত আলো হারিয়ে ফেললে আমাদেরই ক্ষতি। সমাজের ক্ষতি। গল্প কবিতা ছড়া 
সমাজেরই অংশ। খুঁটিও বলা যেতে পারে। খুঁটির উপরেই ঘরের চালা। আমাদের আশ্রয়।

আজ আমরা যদি আশ্রয়হীন হয়ে পড়ি, বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বো। এ কথা যেন না ভুলি ।

অনেক কিছুই ভুলে গেছি এবার যদি বট গাছ ভুলে যাই, আম জাম কাঁঠাল ভুলে যাই কী নিয়ে থাকবো আমরা?

আধুনিক দৈত্য এসে দাঁড়িয়ে আছে দুয়ারে। টাঙানো ছিল আম পল্লব ছিঁড়ে গেছে।

-----২৫ কার্তিক ১৪২৯
----১২---১১--২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--১২



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--১২
-------------------------------------------------------

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।

বন্দে আলী মিঞার এই কবিতার প্রথম দুই পংক্তি আজ উল্টে পাল্টে গেলেও সেই সময় কবি যা দেখেছিলেন, লিখে গেছেন সহজ ভাষায়।

সহজ কথা তো সহজ নয়, কবি সহজকে পেয়েছিলেন অন্তর থেকেই, এজন্যেই লিখতে পেরেছিলেন "আমাদের গ্রাম " এর মতো একটি কবিতা। যদিও কবিতাটিতে যে ছবি আমরা দেখতে পাই, তা একদিন স্বাভাবিক ও সুন্দর ছিল বলেই,
কবিতাটিও সুন্দর।

আজকের মানুষ সেই অতীতকে দেখেও যদি সত্যের কাছে সহজের কাছে যেতে পারে, আমাদের সমাজের চেহারাটাই পাল্টে যাবে নতুন করে।

এখানে সুনির্মল বসুর একটি কবিতার উল্লেখ করতে পারি। যে সময় তিনি বলছেন----

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাইরে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি,
বায়ুর কাছে পাইরে।

মানুষ তো মানুষের কাছে শিক্ষা নিয়ে থাকে। যা বাস্তব। এখানে তিনি আকাশের কাছে, বায়ুর কাছে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছেন। অর্থাৎ পাঠ নিতে বলছেন প্রকৃতির কাছে। কেন না, মানুষ তো প্রকৃতির একটি অংশ।

এও বলা যায়, কবিরা নিজেই প্রকৃতি। সেই উপলব্ধি হয়নি বলেই, এত হিংসা হানাহানি।
প্রতিযোগিতা।

কবিও প্রতিযোগি। এগিয়ে যেতেই হবে। ধ্যান নয় সাধনা নয় কেবল প্রতিযোগিতা। প্রতিদিন খবরে থাকতে হবে। প্রতিদিন বিখ্যাত হয়ে থাকতে হবে।

প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যেস কোনো ভাবেই রপ্ত করতে পারেনি। এই কবিরা কিংবা কবিতা লেখকরা পাঠকদের কাছে কী স্বপ্ন হাজির করবেন?

আজকের কবিদের প্রকৃতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এই কারণেই, কবিতার ভাষাও সহজ হয়ে আসেনি।

কঠিন কি হতে পেরেছে?

কঠিন হতে গেলেও সাধনা লাগে।

যে কঠিন সে কোমলও।

মাটির কাছে পাঠ নিতে গেলে, সোনা রূপা লোহা তামার কাছেও পাঠ নিতে হয়।

স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিতে নিতে ও সাধারণ মানুষের কাছেও শিক্ষা । আবশ্যিক।
সবজিওয়ালা ফলওয়ালা, মুটে মজুরের কাছেও অনেক কিছু শেখার থাকে। এক একটি জীবন এক একটি ইতিহাস। উপেক্ষা করলে, অসম্পূর্ণ থেকে যাবে কবিতার ভূমি।

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
সবার আমি ছাত্র----

এই বোধের কাছে পৌঁছতে না পারলে, একটি থালা থালাই থেকে যাবে, কোনোদিন ঝকঝকে হবেনা।থালাটিকে ঝকঝকে রাখতে হলে তার সঙ্গে সম্পর্ক করা আগে দরকার। তবেই, থালাতে আসবে ধোঁয়া ওঠা ভাত। এবং যে হাঁড়িতে ভাত ফুটছে, তার ব্যবহার তার ধর্ম জানাটাও দরকার বৈকি।

কবিতা লেখা নয়, কবিতার চর্চা।
কবিতা লেখা নয়, কাব্য সাধনা।
কাব্য সাধনার অর্থ সহজ জ্ঞান।

সহজের কাছে যাওয়া।

------২৪ কার্তিক ১৪২৯
-----১১--১১---২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন

আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--১১



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--১১
-------------------------------------------------------

তুলসী গাছের সঙ্গেই বড় হয়েছি।

ছোটবেলায় ঘুরতে ফিরতে একটা তুলসী গাছ। আমি না দেখলেও
আমাকে দেখেছে। আমাকে দেখতো।

সন্ধ্যে হলেই তুলসী খানে সন্ধ্যা প্রদীপ। আমাকে দেখেছে। আমাকে দেখতো।

তুলসী গাছও আমাকে বড় করেছে। আমি না বুঝলেও তুলসী গাছের ছোট ছোট হাওয়া
আমাকে মানুষ করেছে। মায়ের মতই।

ঘরের চালায় এসে কাক আমাকে দেখেছে। আমাকে দেখতো। সেই দেখাটাও লালন পালনের মত। পায়রা এসেও
আমাকে দেখেছে। আমাকে দেখতো। সেই দেখাটাও যে লালন পালন।
রাস্তা থেকে কুকুর এসে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দুয়ারে। আমার এঁটো খাবার আমি তাকে না দিলেও সে আমার দিকে চেয়ে আমার মঙ্গল কামনা করেছে।

এরাই তো পরিবারের সদস্য।
নীরব থেকে আমাদের কল্যাণে
সব সময়। আজও।

এরাও আমার কবিতা।

ভাঙ্গা পাঁচিল থেকে যে তক্ষকটি
আমাকে দেখে প্রতিদিন , তাকে
আত্মীয় বলবো না? ঘুরঘুর করতে থাকা টিকটিকির প্রতি বিরক্ত হয়েও তাকে তাড়িয়ে দিতে পারলাম কই?
যতই ঝাড়াঝাড়ি করি মাকড়সা থাকবেই ঘরের কোণে কোণে।

আসলে, কোনো না কোনোভাবে
ওদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমার নিঃশ্বাস মিলেমিশে আমাকে সাহায্য করে বাঁচার জন্য। এই বাঁচা কবিতা বৈকি।

কয়েকটা শব্দ অক্ষর ধ্বনি ও ছন্দ
কবিতা নয়। কবিতা যে পায়ে পায়ে ধুলো। পায়ে পায়ে এই রাস্তা থেকে ওই রাস্তা।

নিম গাছের তলে একটু ছায়া।
জিরিয়ে নিতে নিতে মাথায় পড়বে
নিম ফল।

নিম ফলের মধু পান করেছো?

ঘরে গরুটিও আছে। সুখে দুঃখে সারাদিন। তাকে পরিবারের প্রধান না বললেও সে প্রধান। তার করুণ চোখের দৃষ্টি থেকে যে আলো প্রকাশিত হয়ে থাকে, সেও তো আমাকে বড় করেছে। ছোট থেকে বড় করেছে।

গরুর দুধও সংসারের সামগ্রী।

বাইরের দিকে তাকিয়ে ঘরের দিকে না তাকালে, অন্ধকার জড়োসড়ো হয়ে ঘরে থেকে যায়।

নজর এড়িয়ে যাবে তিনটে শালিখ। তিনটে শালিখ এসেছিল একটু আগেই রান্না ঘরের চালে।

চড়ুই এসেছিল চালের দানার খোঁজে। পিঁপড়ে এসে খুঁজছিল চিনির দানা। 
একটি মুড়ির দানাও নিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে।

সম্পর্ক থেকেই নজরুল লিখে গেছেন---

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি? পেয়ারা তুমি খাও? গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?

----২০ কার্তিক ১৪২৯
----৭---১১---২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১০



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---১০
--------------------------------------------------------

"রাখাল ছেলে, রাখাল ছেলে, বারেক ফিরে চাও।
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও।"

রাখাল ছেলে আমাদের পুরুলিয়াতে বাগাল ছেলে। গরু চরানো যাদের পেশা। যে জীবিকা থেকে দিনাতিপাত। ক্রমশ যে জীবিকাও অবলুপ্তির পথে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকাও পাল্টে পাল্টে যায়।জানি। প্রশ্নটা হলো এই, যাদের জীবিকা পাল্টে যাচ্ছে তাদের বিকল্প কী দিতে পাচ্ছি?
আজ যখন বাগালি পেশাও লুপ্ত হওয়ার মুখে , তখন উপরে উল্লেখিত জসীমউদ্দীনের কবিতাটি আমার মনে পড়ে। মনে হয়, কোনো নির্জন মাঠে ছুটে যাই। দেখি, কোনো বাগাল ছেলে গাছ তলায় শুয়ে আছে কিনা।

শিল্প এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, জানি। সেও পাল্টাতে পাল্টাতে অনেক রূপ ধারণ করে।

রূপ যদি বিকৃত হয়?

জীবিকা হারানো বাগাল ছেলের কাছে অভাব অনটন যদি এসে দাঁড়ায় আমরা তার সমস্যা সমাধান করতে পারবো?

শিল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা, শিল্প যদি তার নিজস্ব রূপ হারিয়ে কংকাল হয়ে ওঠে, আমরা কোন্ দিকে চেয়ে থাকবো?

কোথায় পাবো শান্তি ও স্বস্তি?

একটা সময় তো ছিল যখন মাঠে-ঘাটে ঝুমুর হাঁকাতো বাগাল ছেলেরা। মুখে মুখে রচনা করতো ঝুমুরের পদ।

সারাদিন রোদে জলে হাওয়ায় মাঠে মাঠে গরু চরানোর একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি ছিল বাঁশি বাজানোর মধ্যেও।

এই রূপ তো আমরা দেখেছি শ্রীকৃষ্ণের । তিনিও তো গরু চরানো এক যুবক ছিলেন। প্রেম করেছেন রাধার সঙ্গে।

রাধা কৃষ্ণের প্রেম পুরনো হয়ে যায়নি তো? বাতিল হয়ে যায়নি তো তাদের প্রেমলীলা? 

বৈষ্ণব পদাবলী আমাদেরই এক গ্রন্থ। ভুলে গেলে , আমাদেরই ক্ষয়ক্ষতি।

জসীমউদ্দীনকে মনে পড়ে তো?
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত? কালিদাস রায়?

বিহারীলাল চক্রবর্তীকে কজন মনে রেখেছি? 

কবিরা নিশ্চয়ই কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাসের কাছেও আছেন। এই আশা থেকেই আমার প্রশ্ন, অদ্বৈত মল্লবর্মণের খোঁজ করেন তো? জগদীশ গুপ্তের খোঁজ আছে আপনাদের কাছে?

শিল্পের বিভিন্ন শাখায় আসা-যাওয়া করলেই ঋদ্ধ হয়ে ওঠা যায়। নন্দলালের ছবি দেখতে দেখতেই প্রকাশ কর্মকারের চিত্রকলা। অবন ঠাকুর থেকে যামিনী রায়। গগনেন্দ্র নাথ ঠাকুর থেকে বিনোদ বিহারী।

যোগেন চৌধুরীর চিত্রপটের কাছে দাঁড়িয়ে খোঁজ করবো সমীর আইচের।

অনেকদিন দেখতে পাচ্ছি না মনোজ দত্তকে। যে বাংলার লোকশিল্পের বীজ নিয়ে ছবি আঁকে।

ভাস্কর্য শিল্পে কারা আছেন?

খোঁজ করতে করতে আশা করি দেখতে পাবো নতুন উজ্জ্বল মুখ।

ভরসার জায়গা।

শুধু চমক আর অন্ত্যমিলে কবিতা কী হয়? যদি বুকের পাঁজরে ধাক্কা না মারে কবিতার বিষয়?

বিষয় তো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। নিজের ঘরের কোণে কোণে মাকড়সার ঝুল। অথবা খসে পড়ছে দেয়ালের রঙ। ইঁদুরের লাফ-ঝাঁপ। উল্টে গেছে জলের গ্লাস।

আকাশ ও মাটিতেও কত রঙ কত বিন্যাস। একটা ডালে ফুল।অন্য একটি ডালে ধরে আছে ফল।আরেকটা ডাল পত্র পল্লবহীন।

মাটি কোথাও নরম হয়ে আছে। মাটি কোথাও কঠিন হয়ে আছে। আকাশে আকাশে হাতি ঘোড়া। খরগোশ। পরীও আছে ডানা মেলে।

কিঞ্চিৎ মন খারাপও আছে। ঘরের মেঝেতে চায়ের কাপের দাগ। দু-একটা মুড়ির দানা পায়ের তলে পড়ে চ্যাপ্টা।

বাঙলা কবিতা চ্যাপ্টা হয়ে গেলে গাছে গাছে আর পাবোনা ফলের সুবাস। ফুলের বর্ণচ্ছটা।

আমাদের ছোট নদীই তো আমাদের অববাহিকা। ছোট বোনের মতোই আদুরে। তাকে ছেড়ে থাকার কথা কল্পনা করতেই পারি না। বৈশাখ মাসে তার যতই হাঁটু জল থাকুক, সেই তো আমাদের একমাত্র বোন। দিদিও। তাকে আমি "বুড়ি "বলে থাকি। যে বুড়ির মুখে শুনেছি আমার সেই ছোটবেলায়---


মৌমাছি মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই

আমি তো দাঁড়িয়েই গেছি, ভয় করছে এগিয়ে আর রাস্তা পাবো তো? মৃদু কন্ঠের এক স্বর আমারই দিকে----

আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি
যদু মাস্টার শ্বশুর বাড়ি
রেল কম্ ঝমাঝম
পা পিছলে আলুর দম।

আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে।

যেতেই হবে।

শিকড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
আমি যাই----

আমি যে জানি----

কাননে কুসুম কলি, সকলি ফুটিল।।

----১৯ কার্তিক ১৪২৯
----৬---১১---২০২২
----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৯



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৯
-----------------------------------------------------

ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে এক কিশোরী। পাড় দেবার শব্দ উঠছে। কিশোরীর পায়ে নূপুরও শব্দ করছে।

পাড় দেবার শব্দ নূপুরের শব্দ এক হয়ে একটি আবহ।

একটি ছবি।

হাঁড়িতে চাল ফেলার আগে কুলা থেকে চাল ঝাড়ে আমার মা। এবং চাল ঝাড়ার শব্দ আছড়ে পড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায়।

টিনের পাতে বিরির ডালের বড়ি দিচ্ছে আমার খুড়ি। সারি সারি। এই সারি সারি বড়ির মাঝখানে ক্ষুদ্র এক রাস্তা। কোনো একটি পোকা ঢুকে পড়লে ছায়া পাবে।

আমার বৌদি পুরনো শিল--নোড়াতে হলুদ বাটছে। শব্দ যায় রান্নাঘর থেকে উঠোন। হলুদ ছিটকেও পড়ছে। কুচি কুচি।

এ সবই বাংলার ছবি। গ্রাম বাংলার ছবি। স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমাজ জীবনের ছবি। স্পষ্ট হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক কাঠামো।

ছাদে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে তার স্নানের জল মাথা থেকে ঝাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জলের কণা। অথবা এই ছবিটি, ধানের চারা লাগিয়ে চাষী বউ ঘরে ফিরছে। সাঁঝ বেলা।

কাদামাটি পা। ফাটা ফুটো পা।

আমার দেশের নিজস্ব ছবি।

কবিতায় আসবে না?

ধানক্ষেতের আল পথে দুটি খেজুর গাছ যুগল রূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

কিছু তো বলতেও চাইছে।

শুনবো না?

একটা কাক একটা কাকের মুখে আহার বাটলে একটা দিন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। মনে হয়, আমার সকল খিদে মিটে গেল।

এই অনুভূতির প্রকাশ কবিতায় থাকবে না?

ফুটে ওঠার আবেগ ছড়ানোর পরও জবা ফুলের মঞ্জরি দুলে দুলে কথা বলছে।

কার সঙ্গে কথা বলছে?

মন শুনবে না?

ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুললেও গরুর গাড়ি আজও আমাদের। গরুর গাড়ি নিয়ে যাওয়া-আসা। হাটঘাট। নতুন বউ তো গরুর গাড়িতেই আসবে। আবার ধান বোঝাই গরুর গাড়ি থেকে শালিকের ঝাঁক খুঁটে খাবে ধান।

এই দৃশ্য জীর্ণ হয়ে যায়নি আজও। গরুর গাড়ির গাড়োয়ান পরিবারের ছোটদের কাছে, "কাকা "। তার ছেলেমেয়েও বামুন ঘরের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করে।

প্রযুক্তির কল্যাণে সমাজের কিছু কিছু বিষয় পাল্টে গেলেও সমস্ত কিছু কি পাল্টেছে?

নদী থেকে চুঁয়া খুঁড়ে জলের সন্ধান করে পুরুলিয়ার কোনো কোনো গ্রামের মানুষ। সন্ধান করতে করতে জেনে গেছে, নদী কোথায় লুকিয়ে রেখেছে জল।

নিরণ দিনে জল যে একমাত্র সহায় সম্বল। সেই জলের অভাব ও হাহাকার বাংলা কবিতা থেকে ছড়িয়ে পড়বে না সারা বাংলায়?

বাঙালির ঘর থেকেই তো আলপনার শুরু। শুধু পূজা পার্বণে নয়, বিবাহ অনুষ্ঠানেও আলপনা।

ঘরের মেয়েদের সুচারু আঙুল তুলির চেয়েও বেশি নান্দনিক হয়ে ওঠে। আমার এ কথা সমর্থন না পেলেও আমি বলতে চাই, বাংলার ও বাঙালির আলপনা আজও নতুন।

সারা বাংলার শহর ও গ্রামে কত ধরনের যে আলপনা চেয়ে চেয়ে দেখতে হয় শুধু। আজও বৃহস্পতিবার এলে, অভাবী ঘরেও চৌকাঠে আলপনা।

ভাবে ও ভাষায় গরিব হলে তো দেখা যাবে না, শাড়ির পাড় থেকেও জল ঝরছে। স্নান করে ফিরছে ঘরের বউ।

ও বউ, তোমার দিকে চেয়ে বলছি----
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ভাষায়,

ভাষায় কবে ভাবের কুঁড়ি ফুটূবে ফুলের মতন----
আশায় তারি আছি

----১৮ কার্তিক ১৪২৯
----৫---১১---২০২২
----রাত্রি ৭--৫৯
----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন 




আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ - ৮



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ - ৮
-------------------------------------------------------

একটি পাতা খসে পড়লো।
আরো একটি পাতা খসে পড়লো।
আরো একটি পাতা।

পাতা পড়ছে ছন্দে ছন্দে।

হাঁসগুলি ভেসে ভেসে কোলাহল করলেও হাঁসের সাঁতার ছন্দে ছন্দে।

পায়রার বকম বকম সুরে সুরে। ছন্দে গাঁথা।

পায়ে পায়ে তৈরি হয়েছে পথ।
আসলে ছন্দে ছন্দে তৈরি হয়েছে পথ।

বৃষ্টির শব্দ ছন্দে লেখা।

কোন্ ছন্দ কত মাত্রার ছন্দ? কোথাও কোনো লিপিবদ্ধ নেই। পাখি ডাকলে আমি নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবোনা কত মাত্রায় ডাকছে? ঝরনার কাছে দাঁড়িয়ে আমি বলতে চাই না, ঝরণার শব্দ সাত মাত্রার। কিংবা বলবো না, পয়ারে রচিত ঝরনার এই বয়ে যাওয়া।

প্রথাগত ছন্দ আমার জানা নেই।

আমি জানি, একটা কাক উড়ে গেলে মৃদু এক শব্দ হয়। ঘুম ভাঙলেও সূক্ষ্ম এক শব্দ হয়। প্রতিটি শব্দের ওজন আছে। প্রতিটি শব্দেই ছন্দ।

শিশু হেসে উঠলে চারদিকেই ছন্দের রেখা। শাদা মেঘের চলাচল। এই ছন্দ প্রকৃতি থেকে জন্ম নিয়েছে। এই ছন্দ দুই দুই চার নয়। এই ছন্দ হিসেবের বাইরের ছন্দ। হিসেবের বাইরের ছন্দ, মুটে মজুর রিক্সাওয়ালার ভাষা। কুলি কামিনের ভাষা। আমার ভাষা। আমার কবিতা।
 
আমার কবিতা নক্ষত্রের পাশে নীরব কবিতা। আমার কবিতা ধুলো থেকে ধুলো হয়ে সজনে পাতায়।

আমার কবিতা তোমার নখে রক্তের আভা। আমার কবিতা ভাতের থানায় একটু নুন। প্রয়োজন পড়লে তুমি নাও। প্রয়োজন না পড়লে, ছুঁয়েও দেখতে হবে না। আমার কবিতা বকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক অপেক্ষা। তুমি লক্ষ্য না করলেও আমারই অপেক্ষা।
আমার কবিতা আমার পালকের কাছে একটি ভোর। পায়রা এসে ডাকছে। কাক এসে খুঁজছে বাসি রুটির স্বাদ।

আমার কবিতা তুলসী গাছের ছোট ছোট হাওয়া।বটতলায় জ্বলতে থাকা প্রদীপ।

আমার গোপন প্রেমের নিঃশব্দ চরণ।

এক গলা জলে দাঁড়িয়ে থাকা শালুক ফুলের চেয়ে থাকাও একটি কবিতা। এই বাংলার কবিতা। বাংলা ভাষার কবিতা। 

আমার কবিতা ক্ষুধার্তের পাশে ক্ষুধার্ত।

আধুনিকতা, ছদ্ম আধুনিকতা আমাদের ক্ষতি করেছে চারদিক থেকেই। নীতি নৈতিকতা আদর্শ মূল্যবোধ প্রেম ভালবাসাও ক্ষয়ের দিকে। সর্বনাশের দিকে। এখানে কবিতাও সর্বনাশের দিকে।

প্রতিরোধ? কে করবে প্রতিরোধ?

দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি
মাঝে একখানি হাট।
সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ
প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট।

আমাদের জীবনের ক্ষেত্রে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্তের কবিতার মতোই ব্রাত্য হয়ে পড়ছে আমাদের প্রকৃত বাংলা কবিতা। যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্তের নাম আজকের বাংলা কবিরা ক'জন জানে?

মনের অঙ্গনে অঙ্গনে ধুলো জমছে। আবর্জনা। ঝাঁট দেবার মত সময় নেই। খোঁজ করার মত মন নেই। আর তাই, পীতাম্বর দাস আড়ালে পড়ে গেছেন। যিনি ছিলেন বাঁকুড়ার মানুষ। যার কলম থেকে আমরা পেয়েছি কালজয়ী একটি গান। অথবা কবিতা-----

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি--

১৭ কার্তিক ১৪২৯
৪---১১---২০২২
নির্মল হালদার




আরও পড়ুন




আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---৭



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---৭
------------------------------------------------------

প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা অংশ। তাদের নির্দেশে শিক্ষা সংস্কৃতি রাজনীতি খেলাধূলা। তাদের নির্দেশেই আহার নিদ্রা মৈথুন। তাদের নির্দেশে আমাদের পাঠাভ্যাসও তৈরি হয়ে ওঠে।

আমরা আকবর পড়বো না বাবর পড়বো, প্রতিষ্ঠান স্থির করবে। কাল যদি আমাদের পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথ বাদ চলে যায়, আশ্চর্যের বিষয় নয়।

প্রতিষ্ঠানতো স্থির করবে ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রী অরবিন্দর আধ্যাত্বিক জীবন পড়বে। কখনোই পড়বে না বিপ্লবী জীবন।

দেশের জনসাধারণ প্রথমে বাদ-প্রতিবাদ করলেও পরে তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। স্তব্ধ করে দেবার মত প্রতিষ্ঠানের অনেক রকম অঙ্ক থাকে।

সেই অঙ্ক জনসাধারণের পক্ষে সব সময় জানা সম্ভব নয়। নাগরিকদের কেউ কেউ জানলেও প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। নাগরিকদের মধ্যে যে দু-একজন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেখা লিখি করে পত্রপত্রিকায়, সেও রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে পড়ে। তাকে সম্প্রতিককালের ভাষায় " মাওবাদী "হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চিহ্নিত করা হবে "আরবান নকশাল "হিসেবেও।

আমার তো মনে হয়, আমাদের এই বাংলার ছেলে ভুলানো ছড়াগুলিও বেশি বেশি করে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হলে ছাত্রছাত্রীরা জানবে, একটা সময় মুখে মুখে সৃষ্টি হয়েছে এইসব ছড়া।

সরল সহজ ছড়াগুলি জীবনকে নিয়ে যাবে সহজ ছন্দের দিকেই। যে ছড়াগুলি স্নেহ ভালবাসা থেকে
হৃদয় থেকে উচ্চারিত হয়েছে।

বাঙালি জীবনে ব্রত কথাও আছে অনেক। সেও তো কবিতা। মন্ত্র এক রকমের কবিতা।

এড়িয়ে না গিয়ে মন্ত্র ও ব্রতকথার ভিতরে প্রবেশ করলে দেশ ও দশের হৃদয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে। আড়াল না করে গ্রামীণ জীবন থেকে খুঁজে নিয়ে আসা প্রয়োজন খেলাধুলোর ছড়া। সেও মুখে মুখে রচিত। যা অবলুপ্তির পথে।

আদিবাসীরা গাছপালার আরাধনা করে। কান পেতে শুনলে শোনা যাবে আরাধনার মন্ত্র। অথবা গান। কিম্বা আরাধনার কথাগুলি।

আধুনিকতা আড়াল করছে যে সমস্ত গান যে সমস্ত জীবন। যে সমস্ত চরাচর।

এক সময় তো ছিল মাছ ধরাদের গান। ধান রোয়ার গান। ধান কাটার গান। ছাদ পেটার গান। সেই সব গান আমাদের হৃদয়কেও স্পন্দিত করেছে। আমরা জেগে থেকেছি।

আজ শুধু ঘুম। অনেক দূর ঘুম।

বুলবুলিতে ধান খেয়ে গেলেও বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছি।
ঘুমপাড়ানি নেশায় আমরা আচ্ছন্ন। আমাদের কাছে নেই আর ঘুমপাড়ানি সুর।

আধুনিকতা নির্দেশ করে, চাহিদার দিকে যাও। আধুনিকতাই হচ্ছে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। আধুনিকতার ইশারা মান্য করে চললে, সুখের সীমা থাকবে না।

অতুলপ্রসাদ রজনীকান্তের গান কতটুকু শোনা যায়? নজরুলের শ্যামা সংগীত কতটুকু শুনতে পায় সংগীত প্রিয় মানুষ?

কোনো না কোনোভাবে চোরাগোপ্তা ভাবে হলেও নির্দেশ আসছে , একে রাখো তাকে ফেলে দাও। তাকে রাখো একে ফেলে দাও।

শিল্প সাহিত্য সমাজ জীবনের এক রূপ। সেই রূপ বিকৃত করে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ছলাকলা।

রাষ্ট্রযন্ত্রের থাবা। এবং হাঁ- মুখ।

হাঁ-মুখের ভিতরে প্রবেশ করলেই, রাজ কবি। সভাকবি। অথবা জীবন যাপনে স্বচ্ছন্দ এক নাগরিক।

চাষাভূষো কুলি কামিনরাতো নাগরিক নয়। তারা শুধু কলের কথা শুনবে। কলের কবিতা শুনবে। না শুনলেই নাকখৎ দাও। চাবুক খাও। 

হে প্রভু, এই তো পিঠ পেতেছি।

----১৬ কার্তিক ১৪২৯
----৩---১১---২০২২
-----নির্মল হালদার




আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৬



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৬
-----------------------------------------------------

সাঁঝে ফুটে ঝিঙা ফুল বিহানে মলিন গো---

মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে অনেক কাল হয়ে গেল। এই পঙক্তির রচয়িতা কে? কত সালে লিখিত হয়েছিল?

কোনো ইতিহাস নেই।

আরেকটি পঙক্তির উল্লেখ করছি এখানে,

মাগো আমার মন কেমন করে
যেমন শোল মাছে উফাল মারে।

মেয়েদের চিরকালীন বেদনার আর্তি এই গানের কথার মধ্যে দেখতে পাই।

শুধু গান বলবো কবিতা বলবো না? তাহলে কবিতা কী? এইখানে আরো দু একটি পংক্তি উদ্ধার করছি-----যেমন,

এত বড় পোষ পরবে
রাখলি মা পরের ঘরে।
পরের মা কি বেদন জানে
জ্বালায় গো আমার প্রাণে।

বাংলা কবিতার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় এই কবিতার রস। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, বাংলা কবিতার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় এই কবিতার ওজন। অথচ এই সমস্ত কবিতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে লোক কবিতা হিসেবে। কে চিহ্নিত করলেন? কারা চিহ্নিত করলেন?

বাংলা কবিতার সংবিধান আছে নাকি? সেই সংবিধানের লেখক কে? কোন্ সাহসে কাদের নির্দেশে
বর্জন করা হয়েছে এই কবিতাগুলি?

আরেকটি কবিতার কথা বলি--

উড়ুক ধূলা লাগুক কাপড়ে
কাপড় কাচব লো ফুল সাবনে।

আধুনিকতা আধুনিকতা চিৎকার চেঁচামেচি করে হেম চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা নিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয় চন্দ্র বড়াল, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ইত্যাদি কবিরা বাদ চলে গেছেন ধারাবাহিক বাংলা কবিতা থেকে।

এখানেও রাজনীতি আছে, কতিপয় আধুনিক পন্ডিত বা কবিদের অঙ্গুলী হেলনে বাংলা কবিতার চলাচল। পরিচালক কে বা কারা? সচেতন পাঠক-সমাজ জেনে যাবে একদিন। এই যে এখানে উল্লেখ করছি আরেকটি কবিতা। যা গান হয়ে মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় আজও। যা লেখা হয়েছে অনেক অনেক কাল আগে। এবং লিখেছেন কোনো নিরক্ষর মানুষ। পুরুলিয়ার মাঠে মাঠে গরু চরাতে চরাতেও নিরক্ষর বাগালরা মুখে মুখে রচনা করে গেছে এই সমস্ত গানের পংক্তি----

আয় পুরুল্যা যায় পুরুল্যা
পুরুল্যায় তোর কে আছে?
পুরুল্যারই বাংলা ঘরে
পান খিলি গুঁজা আছে।

 এও তো আমাদের বাংলা কবিতা।ধূলা মাটি জল হাওয়ার কবিতা। বাংলার কবিতা। বাংলা কবিতা। রাজনীতির কারণেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত বাংলা কবিতা। মানুষের কবিতা।

আজকের কবিতা ক'জন পড়েন? কবিরাও কি কবিতা পড়েন?

আমাদের বাঙালি কবিরা চামু কর্মকারের নাম শুনেছেন? সৃষ্টিধর কাটিহার, বরজুরাম দাস, উদয় কর্মকারকে ক'জন জানেন? পুরুলিয়াতেই জন্মেছিলেন কৃত্তিবাস কর্মকার। যার কলম থেকে আমরা পেয়েছি-----

যৌবনের জ্বালা
যেমন শরাবনের বহি-----

স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি, সম্পূর্ণ করতে না পেরে আমি ক্ষমা প্রার্থী।

এখানে আরেকটি কথা বলতে চাই,
বাড়ি আমার ভাঙ্গন ধরা অজয় নদীর বাঁকে
জল সেখানে সোহাগ করে স্থলকে ঘিরে রাখে।


আমি কাঁসাই পারের সন্তান হলেও 
আমি অজয় পাড়েরও এক সন্তান। আমার দেশ নেই কাল নেই, আমার কোনো সাল--তারিখ নেই। আমি বহমান। প্রবহমান।

-----১৫ কার্তিক ১৪২৯
-----২---১১---২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন


আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৫



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৫
-----------------------------------------------------

আমি ছন্দ জানি। আমি ছন্দ ভাঙতে জানি। আমি দীর্ঘ কবিতা লিখতে পারি। আমি ছোট কবিতাও লিখতে পারি-------

এরকম আস্ফালনের জায়গা যে নয়। ক্ষমতা দেখানোর জায়গা যে নয় কবিতা। কবিতা, হৃদয় থেকে
যা আসবে। অনুভব থেকে যা আসবে। অভিজ্ঞতা থেকে যা আসবে। সেই আমার কবিতা।

কবিতা ধ্যানের জায়গা।

এককের জায়গা।

কবিতা যন্ত্রণার জায়গা।

প্রেম ও বিরহের জায়গা।

এবং আমার চারপাশের সময়,
জনপদ, মানুষের পায়ের শব্দ
আমার শিল্প। তার সঙ্গে সঙ্গে আমার গড়ে ওঠা।

কবিতা কোনো পাণ্ডিত্যের জায়গা নয়। কবিতা শোনার জায়গা। ঝিঁঝি পোকা ডাকলে কান পেতে শুনতে হয়। পাখি ডাকলে কান পেতে শুনতে হয়। এবং শুনতে গেলে, পন্ডিত হতে হয় না। অন্তরকে প্রসারিত করলেই শোনা যাবে ধান পেকে ওঠার শব্দ।


একটা কাঠবিড়ালি এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে
ক্ষমতা দেখায় না।

কবিতা কোনো ক্ষমতা দেখানোর
জায়গা নয়। কবিও কাঠবিড়ালি।
পাতার আড়ালে থাকা কাঁচা পাকা ফলকেও চেনে।

একটি পাথর জলের ঘর্ষণে ঘর্ষণে
নুড়ি পাথর হয়ে গেছে, কবি লক্ষ্য করবেই।কবির দৃষ্টি যে নদীর পাথরে পাথরে জড়িয়ে থাকা শ্যাওলার দিকেও।

কখনো কখনো ভয় থেকে মাছেরা
চুপ করে বসে থাকে ওই শ্যাওলা জড়ানো পাথরে।

কবি দেখবে বৈকি।

চাষিরা চাষ করে আনন্দে-----তাদের পায়ে পায়ে
জল কাদা মাটি। তাদের পায়ে পায়ে ফাটল।

কখনো কখনো কোথাও মাটিতেও
ফাটল ধরে। তার পাশেই জেগে থাকে উইঢিবি। ইঁদুরের বাসা। সাপের গর্ত।

তার একটু দূরে ঘাসের সবুজ।
ফড়িং এসে ঘুরে বেড়ায়। খুদে খুদে পোকারাও বিন বিন করে।

প্রাণের স্পন্দন।

যে কেউ এই স্পন্দন থেকে খুঁজে পাবে উৎসাহ। উজ্জীবন। আলো অন্ধকারের মায়া।

সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়,
তারপরও ভাবতে হবে, কী ভাবে সহজ হয়ে আসবে কবিতা-------

আমি তো পড়েছি আমি আরো পড়তে চাই-----
দোল দোল দুলুনি
রাঙা মাথায় চিরুনি।

----১৪ কার্তিক ১৪২৯
----১--১১--২০২২
-----নির্মল হালদার





আরও পড়ুন


আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৪



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ--৪
-----------------------------------------------------

আমার সঙ্গে কথামৃত ও গীতবিতান ছিল হাসপাতালে।
একবার।

আমাকে ভরসা ও সাহস দিয়েছিল। আমাকে শুশ্রষা দিয়েছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে
একটা তালগাছ। যেভাবে আমার স্মৃতি আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে আমাকে শোনায়:
এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে-----

যেভাবে আমি আমার স্মৃতি থেকে
আজও খুঁজে পাই, আমাদের ছোট নদী। তারপরেই, ওই যে গাঁ-টি যাচ্ছে দেখা------

সরল সোজা ও সহজ কবিতা গুলি আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়নি আজও। এই কবিতাগুলি যদি কাব্য সমালোচকরা, বাতিল করে দিলেও আমার মতো পাঠকের কাছে থাকবেই। আমি যে এই কবিতার কাছেই নিবেদিত।
আমি যে, কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ির সঙ্গে আজীবন সম্পর্কিত হয়ে আছি। আমি যে দেখতে পাই,
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-----

শোলোক বলার কাজলা দিদিরাও আছে আমাদের গ্রামে গঞ্জে। এবং তারাই যে এক একটি কবিতা, মহা জীবনের কবিতা আমি মনে রাখি।

তত্ত্বকথা থাকবে। আধুনিকতা উত্তর আধুনিকতার তর্ক চলবে,
ধারাবাহিক। আরো কোনো নতুন 
তত্ত্ব, নতুন তর্ক এসে দাঁড়াবে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। তারপরও থাকবে, সহজ পাঠের মত বই। কারো কারো কাছে। মনেও থাকবে: আজ মঙ্গলবার।
পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন।

পুরনো হয়নি। জীর্ণ হয়ে যায়নি
এই পংক্তি। বরং আমাদের সমাজ
জীর্ণ হয়ে গেছে।
পাড়ার জঙ্গল সাফ করতে এগিয়ে আসে না কেউ।


শিল্প সাহিত্যেও ধুলো জমছে। সাফ করার মত কে আছে? কেবল বইয়ের পরে বই পাহাড় হয়ে উঠছে।
কোন্ বইটা আমার বই আমি নির্বাচন করতে এগিয়ে যেতে পারি না। কোথায় দাঁড়াবো কার কাছে দাঁড়াবো?
অঞ্জনা--নদী --তীরে চন্দনী গাঁয়ে
প্রদীপ জ্বলছে। হ্যারিকেন ও লম্ফ
জ্বালানোর মতো  কেরোসিন নেই।

কবি তো অনেক। মানুষ কই?

----১৪ কার্তিক ১৪২৯
----১---১১---২০২২
----নির্মল হালদার




আরও পড়ুন





আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---৩



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ---৩
------------------------------------------------------

রামপ্রসাদের লেখা গানগুলি
কবিতা নিশ্চয়ই। একথা উচ্চারণ করার পরেও আমি বলছি না,
কি চমৎকার আঙ্গিকে লেখা। নতুন এক ছন্দের লেখা।

রামপ্রসাদী গানগুলি মনে মনে শুধু অনুভব করার চেষ্টা করছি।

ছন্দ নিয়ে প্রকরণ নিয়ে আজকের পাঠকরা যতই চেঁচামেচি করুক, কালের বিচারে ছন্দ ও প্রকরণ 
থাকেনা। থাকে শুধু, আমার উচ্চারণ। আমার ব্যথা ও বেদনা।
আমার বিরহ। আমার আর্তি।

আমার বেঁচে থাকার ভাষা।

আমার বাংলা ভাষা তো দরিদ্র নয়, আমার ভাষাতেই আমার অভিজ্ঞতা আমার উপলব্ধি প্রকাশ করে যাচ্ছি , তা যদি কবিতা হয়
তবে কবিতাই। তা যদি গদ্য হয়
তবে গদ্যই।

আমি আমার সততা থেকে সত্যকে রেখে যাচ্ছি আগামী দিনের জন্য।

আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ
স্বাভাবিক এবং সুন্দর। এই সৌন্দর্যকে ব্যাহত করেনি কোনো
কৃত্রিমতা।

শিল্প গড়ে ওঠে জীবনকে কেন্দ্র করেই। এজন্যেই রামকিঙ্করের সাঁওতাল পরিবার নিত্য নতুন হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান
প্রতিদিন  নতুন নতুন করে ধরা
দেয় বলেই,গীতবিতানের কথা
শ্লোক হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।

শিল্প তো শক্তিরও প্রকাশ।

-------১৩ কার্তিক ১৪২৯
------৩১----১০---২০২২
-------নির্মল হালদার




আরও পড়ুন 

আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ - ২



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ - ২


কবিতা অথবা শিল্প কোনো ধর্মীয় বাদ গ্রহণ করবে না। রাজনৈতিক বাদ থেকেও দূরে থাকবে।

মানুষ থেকে দূরে থাকবে না কখনোই। জীবজগৎ থেকেও দূরে থাকবেনা।

পুকুর ঘাটের পাথরটি শুধু রোদ জলে ক্ষয়ে যায়নি। পুকুরে স্নান করতে আসা মানুষজন পাথরে পা ঘষতে ঘষতে পাথরের ক্ষয় নিয়ে এসেছে আরো।

এই ক্ষয় শিল্পের দিকে যায়।

টিয়া পাখি উড়লেই তার ঠোঁটের রক্তিম আভা ঝরে পড়ে। যদি মুঠোয় ধরতে পারি, তোমাকে দেবো । তোমার ঠোঁট যে কালি হয়ে গেছে।

তোমাকে ধরে দিতে না পারলেও
ভ্রমর ভ্রমরার গুন গুনানি তোমাকে শোনাবো সকালবেলায়।

একটু পদ্ম বনের দিকে যেতে হবে। পদ্মের মধু নিয়ে ভ্রমর ভ্রমরা
পদ্ম পাতায় চুপ করে গোপন কথা বলে দুজন দুজনকে।

এখান থেকেও একটি কবিতার জন্ম। অথবা শিল্পের জন্ম। যে শিল্প বন্ধ কারখানা খুলতে না পারলেও মানুষের পাশে দাঁড়ায়।

শিল্প তখন শিরদাঁড়া।

কাজ চলে যাওয়া শ্রমিকদের সাহস জোগাবে। যদি শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়াতে পারে, শিল্প শিল্পের জায়গাতেই থাকবে। অবিরাম।

মাথায় কাঠের বোঝা পাহাড় থেকে নেমে আসছে নারী ও পুরুষের দল।
এই ছবিটি একজন আঁকছেন
রঙে ও রেখায়। আরেকজন চেষ্টা করছেন কবিতায় ধরতে। অথচ ধরতে পারছেন না। এই ব্যর্থতা
কাগজে কলমে রূপ না পেলেও
অন্তরে বেদনা বোধ। যা কবিতা।

যা শিল্প।

কাঠবিড়ালি লাফাতে লাফাতে পেয়ারা গাছের ডালে। ছাদেও এলো পায়রার সঙ্গে মুড়ি খেতে।

যৌথতার একটি ছবি একটি কবিতা।

আঙ্গিক নেই। ছন্দ নেই। কোনো
চমক নেই কেবল জীবন প্রবাহ।

চিরকালীন শিল্পের দিকে।

----১২ কার্তিক ১৪২৯
----৩০---১০--২০২২
----রাত্রি-৮--৪৭
-----নির্মল হালদার




আরও পড়ুন



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ - ১



আমার কবিতা : কাঠবিড়ালির লাফ - ১


কবিতা কোনো তত্ত্বের কথা বলবেনা। নিজের কবিতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অমুক কবি এই বলেছেন, তমুক কবি সেই বলেছেন, অতএব আমার কবিতা এই, উদাহরণ এই, বলার প্রয়োজন মনে করি না।

এই মুহূর্তে আমার অনুভবে নদী।
আমি নদীর কথা বলবো। এই মুহূর্তে আমার অনুভবে একটি পুকুর। আমি পুকুরের কথা বলবো। পুকুরের কথা বলতে বলতে নালার কথাও বলতে পারি। নালার পোকাদের কথাও আসবে। আসতেই পারে, শুঁয়ো পোকার কথা। তারপরেই হয়তো
ঈশ্বর এলেন। শয়তান এলেন।

যুদ্ধ হলো।

যুদ্ধ শেষে আমি আল পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একটি খেজুর গাছের দেখা পেলাম। আমার চাই আমার চাই তখুনি একটি মাটির ভাঁড়।

খেজুর রস চাই।

কবিতা বিশেষ কোনো দর্শনের কথা বলবেনা। আনন্দের কথা বলতে বলতে বিষাদের কথাও বলবে। একাকিত্বের কথা বলবে।

কখনো কোথাও ছাঁচে ঢালা কথা বলবে না।

শুভ চিন্তার কথা বলতে গিয়ে
অশুভকে দেখাতে হবে বৈকি।
অশুভকে চেনাতে হবে বৈকি।

সজনে ডাঁটা কবিতার বিষয় হলে,
বাঁশের কঞ্চিও একটি বিষয়। বাঁশিও একটি বিষয়। যা পুরাতন হয়েও প্রতিদিন নতুন।

মানুষ প্রতিদিন নতুন।

নতুন বলেই সে সুন্দর। রহস্যময়।

----১১ কার্তিক ১৪২৯
-----২৯---১০---২০২২
-----রাত্রি-৮--৪০
------নির্মল হালদার




আরও পড়ুন


কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ