চন্দন গাছের হাওয়া
-------------------------
"স্বাগত বিদায় "
এই বাড়িতে থাকবো?
"স্বাগত বিদায় "কবি বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি। শান্তিনিকেতন পূর্ব পল্লীতে।
এই বাড়িতে থাকলে আমার পুণ্য।
এই বাড়িতেই থাকে আমাদের বাবলিদি। প্রভাতদা।
বুদ্ধদেব বসু নিজের বাসগৃহের পাশেই একটা মাটির ঘর করেছিলেন। সেই ঘরেই বাবলিদি ও প্রভাতদার সুরের রচনা।
৮০---৮২ সাল থেকে আমার শান্তিনিকেতন আসা যাওয়া।
ভালোবাসার টানে যাওয়া।
মাথা গুঁজবো কোথায়?
আছেই তো বাবলিদি প্রভাতদার স্বাগত বিদায়।
তখন স্বাগত বিদায় আমাদের অনেকের কাছেই বাবলিদি প্রভাতদার বাড়ি।
মনে মনে শান্তি পাই।
বাবলিদি তখন সঙ্গীত ভবনের ছাত্রী। এক শিক্ষিত তরুণী।
কবি কালীকৃষ্ণ গুহর ভাষাতে বলতে পারি, বাবলিদির মধ্যে কোনো দেখানেপনা ছিল না। অত্যন্ত মার্জিত। শিক্ষিত। এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিশুদ্ধ ধারার এক শিল্পী।
বাবলি সাহা মঞ্চসফল গানের দিকে যাননি কখনো।
বাবলিদি নীলিমা সেনের ছাত্রী।
এই বাবলিদি আমাদের বন্ধু। কাছের মানুষ। মনে আছে, বাবলিদি সব সময় আতপ চাল অথবা গোবিন্দভোগ চালের ভাত রান্না করতেন।
মনের সুখে গ্রহণ করেছি। বলতে পারি, খেয়েছি অন্নভোগ।
আমি শান্তিনিকেতন গেলেই, একরাম চলে আসতো তার বাড়ি থেকে। ক'টা দিন গান ও কবিতায় আমাদের কেটে যেত।
প্রভাতদা আপাদমস্তক সুভদ্র মানুষ। তার কবিতার মতোই সুন্দর। মৃদুভাষী। শান্ত।
আমাদের বন্ধু। বাবলিদি ও প্রভাতদা দুজনেই
আমাদের সময়ের অনেকের বন্ধু। বাবলিদির গানের অনুরাগী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আরো অনেক বিখ্যাত মানুষ। অনেক চিত্রকর।
কবি উৎপল কুমার বসুর কাছেও শুনেছি বাবলিদির সুখ্যাতি। প্রকাশদা, মানে প্রকাশ কর্মকার বাবলিদির ভক্ত ছিলেন।
বাবলিদি রীতিমতো সুন্দরীও ছিলেন। এবং শাল গাছের মতো ঋজু।
আজও সেই সৌন্দর্য প্রভাতদা ও আনন্দীকে আগলে রাখে। প্রেম ও ভালোবাসায়।
বাবলিদি ও প্রভাতদার সিউড়ির বাড়িতেও আমি হঠাৎ হঠাৎ চলে গেছি। তখন তো সারা বাংলায় আমি ছুটে বেড়াই। বিশেষ করে
মাসে একবার যাবই সিউড়ি। স্বপনকান্তিও চলে আসতো আড্ডা দেবার জন্য।
অনেক রাত অবধি অনেক কথা। কবিতা। এবং বাবলিদির গান। কখনো খালি গলায়। কখনো তানপুরা নিয়ে।
বাবলিদি আমাদের পুরুলিয়ার অনুষ্ঠানেও গান গেয়ে গেছেন। তখন কালীদা সব সময় বলতেন, বাবলির গান থাকলে আর কিছু লাগে না।
একবার বসন্ত উৎসবে বাবলিদির সঙ্গে শান্তিদেব ঘোষের বাড়িতে গেলাম। তিনি তখন প্রতিবছর বসন্ত উৎসবের সময় নিজের বাড়িতে একটি গানের অনুষ্ঠান করতেন।
সঙ্গীত ভবনের ছাত্রী হিসেবে বাবলিদির অন্যরকম একটা পরিচিতি ছিল। সহজেই অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল।
আমি সেই প্রথম শান্তিদেব ঘোষের গান সামনাসামনি শুনেছি। বসন্ত উৎসবের ভিড়েও বাবলিদের জন্য মঞ্চের কাছাকাছি বসে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ আমার ছিল।
দিন পার হয়ে যায়।
পলাশ ফুল আসে পলাশ ফুল চলে যায়। আবারো চাঁদ ওঠে---বাবলিদি পূর্বপল্লীর খোলা বারান্দায় গাইছেন--------
ও আমার চাঁদের আলো-------
তখন আমার এক বন্ধু ছিল স্বরূপ হালদার। তাকে নিয়ে আমি শান্তিনিকেতন অনেকবার গেছি। সেও ছিল বাবলিদির গানের চরম ভক্ত।
স্বরূপের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। বাবলিদি ও প্রভাতদার সঙ্গে কমবেশি যোগাযোগ। এখনো।
অভি যখন দৈনিক কাগজের কাজে প্রথম সিউড়ি থেকেই শুরু করলো, তখন আমি একটাই ঠিকানা দিয়েছিলাম-----
বাবলিদি ও প্রভাতদা।
অভিকে বলেছিলাম, বিপদে-আপদে মনে রাখিস এই দম্পতিকে। এরা সবসময় সহযোগিতা করবে।
রামকুমার যখন ওই একই কাজে
সিউড়িতে গেল, তাকেও বলেছিলাম , বাবলিদি প্রভাতদার কথা।
আসলে ওরা তো একটা আশ্রয়।
এক নির্ভরতাও।
রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই এক সুর। যে সুরের ধারায় আশ্রয় থাকে। আলো থাকে। ভালোবাসা থাকে। সেই ভালোবাসা আজ অভিমন্যু মাহাত ও রামকুমার আচার্য ভুলে গেলে তাদের দুর্ভাগ্য।
আমি দেখিয়ে ছিলাম, দেখো ভাই ভালোবাসা কাকে বলে।
বাবলিদি প্রতিবছর অভিকে ভাই ফোঁটা দিয়েছে। রামের কপালেও পড়েছে বাবলিদির চন্দনের ফোঁটা।
চন্দনের গন্ধ বাবলিদির কাছ থেকে পাই। যেন বা এক নারী তার অন্তর থেকে উজাড় করে দিচ্ছে চন্দন গাছের হাওয়া। এই মানুষই আমাদের দিয়ে যায় লবঙ্গ এলাচের ছায়া।
কখনো কখনো মনে হয়েছে, বাবলিদি হলো, শাল গাছের ফুল। যে ফুল ফুটলেই আদিবাসীদের উৎসব। শাহরুল।
সৌন্দর্যের প্রধানতম সংজ্ঞা।
দিন যায়।
তারপরও বাবলিদি তানপুরা থেকে ধুলো উড়িয়ে গান গাইছেন।
সামনে নীরব প্রভাতদা। আনন্দীও আছে।
আমি দরজা ফাঁক করে দেখতে পাই। কোনো শব্দ করি না। যে কোনো শব্দ নদীর সুরের ধারাকে আঘাত করে।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।
অনন্তকালের নক্ষত্রেরা নিঃশব্দে নেমে আসে বাবলিদির গান শুনতে।
-----১২ আষাঢ় ১৪২৯
-----২৭----৬--২০২২
------নির্মল হালদার
ছবি : সংগৃহীত












কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন