মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২

জলের ভার বইতে বইতে



জলের ভার বইতে বইতে
-------------------------------

এ্যাই শম্ভু জল দিয়ে যাবি।

শম্ভু শম্ভু আমাকে আজ দু' ভার
জল দিয়ে যাবি।

ও শম্ভু আমাকে জল দিতে ভুলবি না। কাল রাত থেকে জল নেই।

কইরে শম্ভু, কখন জল দিবি?
বেলা তো হলো------

এরকম অনেক সংলাপ সকালবেলা। চকবাজারের এদিক ওদিক।

শম্ভু আসে চাকড়া গ্রাম থেকে। পুরুলিয়া শহর থেকে ১০/১২ কিলোমিটার সম্ভবত। সাড়ে ছটার সময় সে চক বাজারের গলিতে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ এর ওর সঙ্গে গল্পগাছা করে
জল দেবার কাজ শুরু।

দু' টিন জল ১০ টাকা।

প্রতিবছর গরমের সময় জলের দাম  বাড়ে। প্রথমে ছিল ৩ টাকা।
তারপর হল  ৫ টাকা। তারপর ৬ টাকা। এবছর ১০ হয়ে গেছে।

পুরুলিয়াতে জলের অভাব দিনের পর দিন।  শহর ও গ্রামে। পুকুর শুকিয়ে যায়। একটিমাত্র নদী কাঁসাইয়ে শরৎকাল থেকেই জল থাকে না।

সরকারি প্রতিশ্রুতি শোনা যায়----
ঘরে ঘরে জল দেবে। দেখা যায়,
প্রতিশ্রুতি নর্দমার জলে। রাস্তার টাইম কলে জলের জন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর কলহ।

টাইম কল থেকে দু' চার কলসি জল, দু' বালতি জল পেলেও সংসার চলে না সারা দিন। অতএব, সংগ্রহ করতে হয় জল।

একসময় যাদের ঘরে কুয়ো ছিল
এখন নেই। এখন বরং যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করে।

কজনের আছে আর্থিক ক্ষমতা?

রাস্তায় রাস্তায় টিউকল থাকলেও
বেশিরভাগ জায়গা থেকে জল ওঠে না। অথবা অকেজো টিউকল।

যে দু' একটা পুকুর দেখা যায়
কিম্বা এখনো আছে, অধিকাংশ পরিবার পুকুরের জল ব্যবহার করে না।

জল জোগাড় করতেই হয়।

জল ছাড়া অচল সবকিছু।

জোগাড় কোত্থেকে করবে?
শহরকে বাঁচাতে গ্ৰাম থেকে শম্ভু পরামানিকদের আসতেই হয়।

মহিলাদের পক্ষে টিউকল থেকে পাম্প করে জল নিয়ে আসা বেশ কষ্টের। ঘরের পুরুষরা সব নিজের নিজের চাকরি। ব্যবসাতে ব্যস্ত।

শম্ভুর কাছে জল কিনতেই হবে।

জলের পাত্র অনেকগুলি রাখতে হয়। শম্ভু বেলা দুটোর পর ঘর চলে যাবে। এবং চেষ্টা করতে হবে
শম্ভুর জল নিতে হলে, একই সময়ে একসঙ্গে জল ভরে নেওয়া।

শম্ভু ছাড়াও দুমদমি গ্রাম থেকে
পরীক্ষিত পরামানিক ও অমৃত পরামানিক দু' ভাই পুরুলিয়া শহরে আসে জলের কাজ করতে।

শহরের অন্যান্য পাড়ায় কিভাবে কোত্থেকে জল জোগাড় করে মানুষ, আমার জানা নেই। তবে বলতে পারি, সারা শহরেই জলের অভাব।

পুরুলিয়া মিউনিসিপ্যালিটির কোনো সুচারু পরিকল্পনা নেই। ফলে, জল যন্ত্রণা বাড়তেই থাকে প্রতিদিন। দুর্ভোগ বাড়তেই থাকে প্রতিদিন।

রাত পোহাতে পোহাতে শম্ভুদের জন্য অপেক্ষা। সে এলে জল দেবার পর সকালের নানান কাজ।

জলের জন্য দুর্ভোগ সইতে হয়েছে
আমাদের পরিবারকেও। দিনের পর দিন।
বছরের পর বছর। সবার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিলনা। প্রতিদিন ১০০ টাকা জল কেনার মত ক্ষমতাও ছিল না। মেয়েরাই বা কত জল ভরে ভরে  রাখবে। কোত্থেকে ভরে রাখবে?

শম্ভুরাও পরিশ্রম করে খুব। বিশেষ করে গরমকালে টিউকল থেকে পাম্প করে জল নিয়ে আসা ,
তাদের সারা শরীর থেকে ঘাম বইতে থাকে।

পরিশ্রম  যা করে সেই তুলনায়
মজুরিতে তাদের পোষায় না। তারা একথাও বলে-------তাদের ছেলেপুলেরা তাদের মতো আর কাজ করবে না।

শম্ভুর বাপ ঠাকুরদা ঘরে ঘরে জল দেবার কাজ শুরু করেছিল।
শম্ভু বলে, সে শুনেছে তার বাবার কাছে যে , তখনকার দিনে জল যেমন দিতো, 
তেমনি আদর-আপ্যায়ন পেয়েছে সবার ঘর থেকে। 
অনেক ঘর থেকেই চা রুটি। চা মুড়ি।
যেকোনো ভোজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ।

দিনকাল পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চা রুটি বা জলখাবার নেই শম্ভুদের জন্য। কেবল দেনা পাওনা। 
আত্মীয়তা নেই।

সরস্বতী পুজোর সময় কোনো কোনো পরিবার বাসি ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য শম্ভুদের বলে।

বছর তিন আগেও এক মাহাত ছিল । আমার ঘরে জল দিয়ে যেতো। সে আমার ঘরে জল মুড়ি খেয়ে  বিড়িতে টান দিতে দিতে আবার কাঁধে ভার।

জলের ভার।

জলও খুব ভারী। জলের ভার বইতে বইতে শম্ভুদের কাঁধে দাগ পড়ে গেছে।

কারোর চোখে পড়ে না।

গরমকালেই টিউকল থেকে জল ভরে হাঁপাতে হাঁপাতে একটা তেলেভাজার দোকানে বসে বসে
শুয়ে পড়লো যেই , মারা গেল মাহাত।
 
সেদিন আমার দু'চোখের দুফোঁটা জল ছাড়া তাকে কিছুই দিতে পারিনি।

কাঁধে জলের বাঁক নিয়ে শম্ভু যখন
কারো ঘরে আসে তখন সাবধানী হয়ে ওঠে-------জল যেন ছলকে না পড়ে। জলের দাম তো পাচ্ছে, জল কেন কম দেবে।  এরকম কথাই শম্ভু অন্তত বলে।

কাঁধে জলের বাঁক নিয়ে যখন চলে তখন শম্ভুর গায়ের ঘাম রাস্তায় পড়তে পড়তে আসে।

তার দাম কোনোদিন কেউ কি দেবে?


--------৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
--------১৪-----৬----২০২২
--------নির্মল হালদার















ছবি : বাপি কর্মকার










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ