আমার বিশ্বকর্মা
--------------------
আগে দূর থেকে দেখতাম।
লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত হাঁটছে।
এই যুবক কে? কাদের বাড়ির ছেলে?
ও দত্ত বাড়ির ছেলে? কার ছেলে?
অনেক অনেক পরে জেনেছি, ছেলেটির নাম ছোটকা। পোশাকি নাম ------বিজয় দত্ত।
এই লাবণ্যময় যুবকের নাম বিজয় কেন হলো? অর্জুন হলে চমৎকার লাগতো। দেখে তো মনে হয়, কাঁধে তুলতে পারবে তীর ধনুক।
যেকোনো সংকটের সমাধান এই
যুবক করতে পারার ক্ষমতা রাখে।
আমার এইসব সাত-পাঁচ কল্পনার মধ্যে সে একদিন হাজির হলো আমার কাছে।
আমার ঘরের বিদ্যুৎ কাজ করছে না। তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে আমার ভাইপো রাজা।তো সে যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে জ্বলে উঠল আলো।
আমার মনে হলো, এই আমার বিশ্বকর্মা। আমার পাড়ার ছেলে।
ক্রমশ বিশ্বকর্মা অথবা ছোটকা আমার বন্ধু হয়ে গেল। তার সঙ্গে আমি বিনিময় করি আমার সুখ দুঃখ। আমিও জেনে যাই, সে অল্প বয়সেই তার বাবাকে হারিয়েছে। তারপর সংকট আর সংকট। যদিও তার এক দিদির বিয়ে তার বাবা দিয়ে গেছলো। বর্তমানে তারা দুই ভাই সংসারটাকে টেনে নিয়ে চলেছে।
বড় ভাই টিউশনি করে। আপাদমস্তক সৎ ও সুন্দর ছেলে।
বাংলাতে মাস্টার ডিগ্রী করার পরেও কোনো চাকরি নেই।
এই বাংলায় কারই বা আছে?
ছোটকা পাড়াতেই ক্যাবেল লাইনে
অপারেটরের চাকরি করে। এবং চাকরি করতে করতেই মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ।
তারপর স্নাতক স্তরেও উত্তীর্ণ।
পাড়ার যে কোনো বিপদে-আপদে
ছোটকার উপস্থিতি অনিবার্য। সে সব ছেড়ে ছুটে আসে।
আমাদের বাড়িতে আলো ও পাখার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা গেলে, ছোটকার কাছে ফোন ছুটে যায়।
সেও আসে।
আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
তার আচরণেও একটা স্বস্তি ও শান্তির আভাস দেখতে পাই। আমি তাকে যেকোনো ভ্রমণের সঙ্গী করতে প্রস্তাব রাখি। যেমন,
রঞ্জন। সে তার সপ্রতিভতায় যেকোনো রকম বিপদকে বা সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়।
মুশকিল হলো, রঞ্জন ও ছোটকা দুজনেই কাজে যুক্ত। আর বাপির তো কোনো ছুটি নেই। কার সঙ্গে যাবো বেড়াতে?
অবিনকে সবসময় পাওয়া যায় না।
শুধু তাদের সঙ্গ পেলেই আমার ভ্রমণ হয়ে থাকে।
টিভির সঙ্গে আমার তেমন বন্ধুতা নেই। সারাদিনে এক-দুবার খুলে থাকি। কখনো কোনো দিন দেখতে পাই, ছবি আসছে না।
ছোটকাকে ফোন।
কিন্তু সে ফোন ধরছেনা। আমি অস্থির হয়ে উঠি। ফোনের পরে ফোন করি। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর হঠাৎ আমার ঘরে এসে দেখা দেয়। আমার মনে হয়, বিশ্বকর্মার দয়া হলো।
সে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায় সময় আসা-যাওয়া করে। কবিতার প্রতিও তার অনুরাগ আড়াল করে না। ফেসবুক বা স্ট্যাটাসে সে দিয়ে থাকে কোনো অজানা অচেনা কবির কবিতা।
ছোটকার একটি সংবেদনশীল মন
আছে। কিন্তু তার নিজেরই এত সমস্যা যে মনকে লুকিয়ে রাখতে হয়। একটা ভদ্রস্থ চাকরি একটা ভদ্রস্থ ঠিকানা বা বাড়ি না থাকার জন্য সে অশান্তিতে থাকে।
আমি তার কাছের মানুষ বলেই
এইসব মনে হয়। মনে হয়, এই তরুণদের বাঁচাবে কারা? কারা দেখাবে দিশা?
এই সমস্ত তরুণ যারা হাতে হাতে
কাজ শিখেছে । যে কাজ কারিগরি শিক্ষাও এক রকমের।
তাদের কেন দেওয়া হবে না উপযুক্ত কাজ? উপযুক্ত সম্মান?
হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বেকার এই দেশে। এবং এই দেশেরই এক অংশে ছোটকার মত এক তরুণ যখন কালো মুখ করে সকালটাকে দেখে তখন এই প্রভাতে ছাদে ওড়া পায়রার মুখও কালো হয়ে যায়।
আমি তাকে কোনো দিক নির্দেশ করতে পারিনা। আমার হাতে নেই কোনো ক্ষমতা। অথচ সে আমাকে মাঝেমধ্যে বলে------একটা ভাল কাজ জুটিয়ে দাও না।
আমি তার কাছে মনে মনে মার্জনা চেয়ে বলে থাকি-----আমাকে লজ্জা দিস না।
তুই একটা খেজুর গাছের তলায় দাঁড়ালেও কিছু পাবি। কিন্তু আমার কাছে যে নেই কিছু নেই।
শুধু ভালবাসা আছে।
আমার ভালবাসার যদি জোর থাকে ছোটকাকে একদিন পায়ের তলায় পোক্ত জমি দেবে নিশ্চয়ই।
সে তো আমার বিশ্বকর্মা। তার
দু' হাতের কাজের জন্য সে চাইবেনা চার হাত। শুধু চাইবে প্রতিদিন একমুঠো ভাত।
দুবেলার নিশ্চিন্তি।
ভাতের গরম গরম ধোঁয়াও আশীর্বাদ।
-------৯ আষাঢ় ১৪২৯
------২৪-----৬----২০২২
-------নির্মল হালদার
ছবি : সংগৃহীত







কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন