শনিবার, ১৮ জুন, ২০২২

ইতি




ইতি
-----

চিঠি আছে চিঠি?

প্রতিদিন পোস্ট অফিসে যাই, খোঁজ করি-----চিঠি আছে চিঠি? 

চিঠি ছাড়া খবর যে পাবো না,
গোবিন্দ কেমন আছে। চিঠি ছাড়া
খবর যে পাবো না,ছেলে কবে আসবে ঘরে।
মা পোস্টম্যানের কাছে খবর নেয়,
মানি অর্ডার এসেছে?
দুয়ার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বউ,
ছ'মাস হলো স্বামীর কোনো খবর নেই।

যদি চিঠি আসে?

চিঠি ছাড়া কেইবা জানাবে, বাপের বাড়ির দেশে
বৃষ্টি হলো কিনা। চাষবাস হলো কিনা।
মংলি নামে গাইটা বিইয়েছে।

চিঠি সেই আকাশ যেখানে নক্ষত্রের মতো শব্দেরা আলো জ্বালে।

চিঠি আছে?

চিঠি হলো জন্ম মৃত্যু বিবাহ।
চিঠি হলো মান অভিমান বিরহ।
চিঠি হলো লুকানো ব্যথার আসা যাওয়া।

প্রেমিকার চিঠি যে মেয়েটি প্রেমিকের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, সেও জানে চিঠির অসীমতা।

একটা সময় আমি কত চিঠি লিখেছি। পয়সা না থাকলে, আমাকে ধার দিয়েছে পোস্ট অফিস।
একটা সময় পোস্ট অফিস ছিল আমার আত্মীয় ঘর।
একদিন চিঠি না পেলে মন মুষড়ে গেছে।

প্রতিদিন লিখেছি চিঠি।

সেইসব চিঠি কোথায় যে হারিয়ে গেল কোন্ বনে, পায়রা আমাকে বলতে পারে না।

হাতে হাতে চিঠিও স্কুল বেলায় প্রদীপের সঙ্গে। কবিতা বেলায় আমনের সঙ্গে।

সম্পর্কের সেতু প্রেমের সেতু একমাত্র চিঠি।
একমাত্র খাম পোস্টকার্ড ইনল্যান্ড।

স্কুল বেলায় বন্ধুদের হয়ে তাদের প্রেমিকাদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে দিয়েছি। আমার চিঠি ছিল পাখির মত।
ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে আহার বিনিময়।

পাখিরা কোথায় গেল?

আজ একটাও কাক নেই কিরাতের খবর এনে দেবে। আজ একটাও ছোটন নেই আমাকে চিঠিতে গান পাঠাবে।
ছোটনের সব চিঠি শুনতে চাইতো আমার সেজদি।

সেজদি উপরে গিয়ে একটাও চিঠি পায় না কারুর।
আমি কি সেজদিকে চিঠি লিখব আজ?

একটা সময় ছিল যখন একজন আরেকজনের কাছে এসে বলতো, আমার ছেলেকে একটা চিঠি লিখে দেবে?

ইনল্যান্ড লেটারের মত নীল আকাশ আমার পকেটে আর নেই। পোস্টকার্ডে লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও জায়গা খুঁজছি, মায়ের চন্দন কাঠ শেষ হয়ে গেছে। বাড়ি এলে তুমি নিয়ে আসতে ভুলবে না।

দিদিও তো বলছিল আয়না ভেঙে গেছে।

চিরুনির দাঁড়ের ফাঁকে লুকিয়ে আছে আইবুড়ো মেয়ের যন্ত্রণা।

চিঠিতে লুকিয়ে আছে, স্বাধীনতাকামী যুবকের কত সংকেত।

কালীদা জানিয়েছিলেন, মাসের প্রথমেই একগোছা পোস্টকার্ড কিনে রাখতেন। গৌতম বসু আমাকে সব সময় খুদে খুদে অক্ষরে পোস্টকার্ড লিখতেন।

গৌতম চৌধুরীর হাতের লেখা আহা কি সুন্দর। যে দেখতো সেই প্রশংসা করতো খুব। সে বড় চিঠি না লিখলেও চিঠি লিখেছে নিয়মিত। অনির্বাণ অমিতাভ প্রসূন একরাম প্রভাতদা আমি যেমন তাদের চিঠি লিখেছি, তেমনি তারাও আমাকে লিখেছে।

নন্দিনী ঝুপপি পর্ণা অর্পিতাও আমাকে চিঠি লিখেছে। স্বপন চক্রবর্ত্তী আমাকে লিখেছেন।নিয়মিত। হেমন্তের চিঠি কম পেলেও পেয়েছি। পুপু কি আমাকে চিঠি লিখতো?

স্বাতী বৌদি আমাকে চিঠি লিখতেন। শঙ্খ বাবুর চিঠি মানেই কিছু না কিছু শেখা।

চিঠিরা কোথায় গেল?

সোমেন অতনুর চিঠি একবার নয়
দু'তিনবার পড়েছি। মন্থন পীযূষ কম লিখলেও অভি চিঠি লিখতো নিয়ম করে। ‌

একটা চিঠি মানেই একটা দিন সম্পূর্ণ হয়ে গেল।যেন দেখা গেল‌ পেঁপে পেকে উঠেছে।

আমাকে হতাশা থেকে উত্তীর্ণ হতে বলছেন কালীদা। অথবা যেতে বলছেন কলকাতা। কিংবা কোনো কাগজে প্রকাশিত কবিতার প্রশংসা পাঠাচ্ছেন।

চিঠিকে ভুলতে পারি না। চিঠির মত প্রিয়জনকে ভুলতে পারি না।
চিঠি তো সেই পাখি যে আমার কাঁধে বসে থাকে। চিঠি লেখা হলেই ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাবে।

মৃদুল দু' তিনটে চিঠি দিয়েছে আমাকে। বরং শ্যামল বরণ সাহা তার আঁকা ছবি সহ চিঠি পাঠিয়েছেন।

চিঠি নিয়েই স্বপন চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস। অসাধারণ। যা লেখা তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
প্রকাশ কর্মকারের চিঠি মানেই এলাহাবাদের হাওয়া। গঙ্গার হাওয়া। তারপরও তিনি বালির বাড়ি থেকে চিঠি লিখতেন।

দীপঙ্কর রায় আলোক মুখোপাধ্যায়ের চিঠি আমি পেয়েছি। কবি আলোক সরকার পোস্টকার্ড পাঠাতেন।

উত্তম, আমাদের উত্তম মাহাত চিঠি লিখেছে আমাকে।

অসংখ্য চিঠি। অসংখ্য নাম।
অদ্রীশ যে কি সুন্দর লিখতো চিঠি। অনির্বাণ দাস মজা করে লিখতো। নারায়ণদার চিঠি মানে পুরাণ।

আর তুই? তুই লিখতিস না?

সৈকত আমাকে লিখেছে দু'তিনটে চিঠি। দেবাশিস মজুমদারও লিখেছে। দেবুদার কি মনে আছে?

চিঠি এক ইতিহাস।

আমি ধরে রাখতে পারিনি। 

অপূর্ব সাহা বোধহয় একটা চিঠি লিখেছিল আমাকে। আরো অনেকের চিঠি পাইনি আফসোস আছে আমার।

মন ভেজানো চিঠি ক'জন আর লিখতে পারে?

চিঠির সঙ্গে লজেন্স পাঠানো স্কুলবেলা ফুরিয়ে গেছে কবেই। সেই চিঠির প্রাপক প্রদীপ রায় কোথায় আছে? দেখা হবে না?

আমার নিরক্ষর মায়ের কাছে আমি আজকাল প্রতিদিন আকাশে লিখি নক্ষত্রের মতো শব্দ। 
বাবা তো পাশেই থাকে, মাকে পড়ে শুনিয়ে দেয়।


--------- ৩ আষাঢ় ১৪২৯
----------১৮----৬-----২০২২
--------নির্মল হালদার












ছবি : স্বপন চক্রবর্ত্তী, তপন পাত্র
















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ