শুক্রবার, ১৩ মে, ২০২২

মাটির গন্ধ আকাশের বিস্তার



মাটির গন্ধ আকাশের বিস্তার
-------------------------------------

দেবদাসদাকে দেখার আগেই দেখেছি "ভাইরাস"।
দেবদাসদা সম্পাদনা করতেন
"ভাইরাস"নামে চার পাতার এই কাগজটি।
নিউজপ্রিন্টের এই লিটল ম্যাগাজিনটি প্রতি মাসেই ছড়িয়ে পড়তো সারা বাংলায়।

অপেক্ষা করে থাকতাম, কবে আসবে কাগজটা।
কিছুই তো থাকত না কিংবা বলা যায় ওই ছোট কাগজে অনেক কিছুই থাকত। প্রথম পাতায় কোনো তরুণ কবির একগুচ্ছ কবিতা। দ্বিতীয় পাতায় দেবদাসদার একটি গদ্য। তৃতীয় ও চতুর্থ পাতায় একটি দুটি করে তরুণ কবিদের কবিতা।

ভাইরাসে আমিও লিখেছি। তবে গুচ্ছ কবিতা নয়। হয়তোবা তখন একটি পত্রিকায় গুচ্ছ লেখার মত আমার কবিতার মান উঁচু হয়নি।

এখনো উঁচু হয়নি।

"ভাইরাস" অবশ্যই উঁচু একটি কাগজ ছিল । আমাদের এই গরীব বাংলায় প্রকৃত অর্থেই
ছোটকাগজ।

তরুণ কবিদের প্ল্যাটফর্ম।

তখনই "ভাইরাস"---এ বিজ্ঞাপন চলছে প্রকাশিত হবে দেবদাস আচার্যর কবিতার বই "মানুষের মূর্তি"।

সময়টা সম্ভবত ৮০ দশকের প্রথমদিকে। আমি দেবদাসদার বাড়ি গিয়ে দেবদাসদার স্বাক্ষরযুক্ত "মানুষের মূর্তি" পাই।

বইটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছিল এই নিরাভরণ কবিতাই আজকের বাংলা কবিতা।

বাংলা কবিতার মুক্তি।

কবিতার গা থেকে যাবতীয় অলংকার ফেলে মানুষের মূর্তির রথ এগিয়ে চললো।

ওড়ালো নিশান।

সেই নিশান শিকড়ের ডানা থেকে
ডানার শিকড়।

মাটির গন্ধ পাই। কাছে পাই আকাশের বিস্তার।

আমি চললাম দেবদাসদার কাছে।

পুরুলিয়া থেকে সৈকত চলে যাওয়ার পর আমাদের পত্রিকা
"আমরা সত্তরের যীশু" বন্ধ হয়ে গেছে।
আমি  টো টো করে বেড়াই। কোনো একজন শুভাকাঙ্ক্ষী 
পরামর্শ দিলেন আবার "আমরা সত্তের যীশু" প্রকাশ করতে। তবে এবার ছোট করে। প্রতিমাসে।

তখন পুরুলিয়াতে প্রেসের অভাব।

আমি দেবদাসদার কাছে সহযোগিতা চাইলাম। উনি যদি
কৃষ্ণনগরের প্রেস থেকে ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন। যদি
প্রুফ দেখে দেন।
দেবদাস দা " হ্যাঁ "করতেই ডাকযোগে পত্রিকার পান্ডুলিপি
পাঠিয়ে দিলাম।

প্রতিমাসে একইরকমভাবে পাঠানো হতো। পত্রিকাও প্রতিমাসে আমার কাছে  চলে আসতো সহজেই।

কখনো কোনো মাসে আমি চলে গেছি কৃষ্ণনগর। কলকাতায় কোনো বন্ধুর বাড়িতে আমার
পোটলা পুঁটলি নামিয়ে শিয়ালদা থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল।

তখন দেবদাসদাদের যৌথ পরিবার। একঘর লোকজন। সেই সঙ্গে নারকেল গাছের মতো কয়েকজন সদস্য। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো।

আমি পেট রোগা বলে বৌদি আমার জন্য জল ফুটিয়ে রাখতেন। এবং যেতে যেতেই নারকেল কোরা ও মুড়ি।

এই আপ্যায়ন যতদিন বেঁচে আছি ভুলে যাবো না।

সন্ধে হলেই দেবদাসদার কাছে পড়ে শুনিয়েছি আমার নতুন কবিতা।

তাঁর  কাছে শুনেছি কবিতার ইতিহাস। তখনই তো বাংলা কবিতার বাঁক বদল ঘটছে।
লেখা হচ্ছে নিম্নবর্গের ইতিহাস।
এবং কবিতায় ছাপ ফেলছে
নিম্নবর্গীয়রা।

ততদিনে " মানুষের মূর্তি "দিকে দিকে প্রভাব ফেলছে। নিঃশব্দে।

দেবদাসদা নীরবে প্রবেশ করলেন
বৃহত্তর বাংলা কবিতার মানচিত্রে।
তাঁকে জমি জায়গা ছেড়ে দিতেই হলো। তাঁর সঙ্গে আরো অনেককে। যেমন বীতশোক ভট্টাচার্য শ্যামলকান্তি দাশ জয় গোস্বামী সুবোধ সরকার ইত্যাদিদের। তখন এসেও গেছেন আসাম থেকে রণজিৎ দাশ।

অন্যদিকে মণীন্দ্র গুপ্ত লক্ষ্য করছেন গ্রামবাংলা থেকে কে এলো। কারা কারা এলো।

কবিতা থেকে গল্প উপন্যাসে এক ঝাঁক তরুণ মুখ। সৈকত রক্ষিত তাদের মধ্যে একজন। 

কলকাতা থেকেই অন্যরকম কাগজ করছেন মণীন্দ্র গুপ্ত রঞ্জিত সিংহ-------পরমা।

এই তরুণ কবি সাহিত্যিকদের
সমর্থন জানাচ্ছেন কবি কালীকৃষ্ণ গুহ। তিনি আমার হাত ধরেছেন।

দেবদাসদাও আমার হাত ধরে ছিলেন বলে, আমি সাহস পেয়েছি পথ চলার ।

" মানুষের মূর্তি "র পরে দেবদাসদার অনেক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার পাঠকরা জেনেছে, বাজার চলতি কবিতাই কবিতা নয়। বাজারের হাঁ করা মুখ থেকে  প্রকাশিত কবিতাই কবিতা নয়।

প্রচার সর্বস্ব লেখালিখি থেকে
দূরে থাকাই কবিদের কাজ।
আর এই কাজটি নীরবে করে গেছেন, আজও করে যাচ্ছেন দেবদাস আচার্য।

তাঁকে আমার প্রণাম। 

পা ছুঁয়ে ফেললে শিকড়কে ছোঁয়া যায়।

দেবদাসদা সম্প্রতিকালের বাংলা কবিতার শিকড়।


------২৯ বৈশাখ ১৪২৯
------১৩----৫----২০২২
------নির্মল হালদার







ছবি : সন্দীপ কুমার







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ