সকাল হলেই পুকুরে যাওয়া।
কোনো পায়খানা বা বাথরুম নেই।
মনোতোষের অভ্যাস ছিল না
ফাঁকা মাঠে প্রাতঃকৃত্য করবে।
তাদের বাড়িতে বেশ বড় বড় বাথরুম। পায়খানা।
এই আশ্রমে কিংবা বিদ্যালয়ে এসে সে দেখে, শুধু থাকার ব্যবস্থা। একটুখানি শোবার জায়গা।
সব ছেলেকেই সকালবেলা
মাঠে যেতে হয়। খালি পায়ে।
মনোতোষের মায়ের ইচ্ছে ছিল না,
কলকাতা থেকে এত দূরে ছেলেকে পড়তে পাঠানো। তার বাবাকে গুরুদেব নাকি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর আশ্রমে পাঠানোর জন্য।
স্কুল কলেজের পড়াশোনাতো
এদেশে একটা বদ্ধ ঘরে। এখানে কিন্তু এই শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক পরিবেশ। খোলামেলা হাওয়ায় আকাশের নিচে গাছ তলায় পড়াশোনা।
তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।
মনোতোষকে আসতেই হয়েছে বাবার জন্য।
প্রথম প্রথম তার কষ্ট হয়েছে খুব।
ঘরে আলো নেই হাওয়া নেই।
লন্ঠন জ্বালাতে হয়। আরো কষ্ট হয়, ভোরে ওঠা। সকাল হলেই ছুটে যাওয়া।
গাছ তলে লেখাপড়া।
তাদের ক্লাস নিতে গুরুদেব কখনো কখনো। তিনি যেভাবে পড়ান, বুঝতে অসুবিধে হয়না।
বিশেষ করে কবিতা যখন পড়ান,
তাঁর কন্ঠ থেকে শুনতে ভালো লাগে খুব।
ইংরেজি কবিতাও পড়িয়ে থাকেন।
মনোতোষ ইংরেজিতে কাঁচা ছিল।
আশ্রমে এসে তার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।
তিনি একদিন ছেলেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কে কে কবিতা লেখো? কে ছড়া লেখো?
সব ছেলেরাই চুপচাপ ছিল।
কয়েকদিন বাদে মনোতোষ
'তালপুকুর' নামে একটি পদ্য লিখে নিয়ে গেছলো। তা দেখে গুরুদেব খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন------তোর এই কবিতা চর্চা ছাড়িস না।
মনোতোষ নিজেদের বাড়িতে থাকতেই শুরু করেছিল লেখালেখি। ছড়া লিখতে পছন্দ করে খুব। তাল পুকুরে গেলেই
কত যে কবিতা মনে পড়ে যায়।
তালপুকুরেইতো হাঁস গুলি করে কোলাহল।তার নিজেরও ইচ্ছে করে হাঁসের সঙ্গে সাঁতার কাটতে।
আশ্রমে এসে মনোতোষ গাছে ওঠা শিখেছে। একটু - আধটু সাঁতার। চিনতেও শিখেছে ফুল ফল। পোকামাকড়। কীটপতঙ্গ।
গাছপালা।
আশ্রমে একজন মাস্টারমশাই আছেন বিকেল হলেই তিনি ছাত্রদের নিয়ে বেড়াতে বেরোন।
বেড়াতে বেড়াতেই তিনি গাছপালা চেনান। আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দেন কাঠবিড়ালির লাফালাফি।
আরেক মাস্টারমশাই আছেন তিনি গুরুদেবের গান শেখান।
মনোতোষের প্রিয় গান-----------
আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ
সে যখন তখন যেখানে সেখানে
মনে মনে গেয়ে ওঠে। বাড়িতে একবার মায়ের কাছে শুনিয়েছিল গানটি। আড়াল থেকে শুনে
ফেলেছিলেন তার বাবা। তারপরেই তার বাবা মনে করেন,
ছেলেকে ঠিক জায়গায় পাঠিয়েছেন।
ছেলে বড় হয়ে উঠছে ভরা প্রকৃতির মধ্যে। আলো বাতাসের মধ্যে। তার সঙ্গে গুরুদেবের স্নেহ মমতা।
মনোতোষরা সবাই একসঙ্গে ফুটবল খেলায় জিতে গুরুদেব কে প্রণাম করতে গিয়েছিল। তিনি সবার হাতে লজেন্স দিয়েছিলেন।
মনোতোষকে বলেছিলেন, ফুটবল নিয়ে একটা কবিতা লিখতে হবে।
মনোতোষ লিখতে পারেনি। সে বরং লিখেছিল গরুর গাড়ি নিয়ে।
তাকে নিয়ে তার বাবা যখন প্রথম
বোলপুর স্টেশনে নেমে গরুর গাড়িতে ওঠেন।
মনোতোষের মনে দোলা লেগেছিল।
সেই থেকেই গরুর গাড়ির প্রতি
তার দুর্বলতা। কেমন ধীরে ধীরে চলে ----------ঢিকির -----ঢিকির-------।
ছন্দের মতো শুনতে লাগে।
গরুর চোখের দিকে তাকালে
মনোতোষের মন খারাপ হয়।
গরুর চোখ কী করুণ।
ভুবন ডাঙ্গায় চরে বেড়ায় গরু।
গ্রীষ্মকালে গরুরা জল পান করে
ভুবন সায়রে।সেও কখনো কখনো সায়রের দিকে চলে যায়।
সায়রের জলে মসজিদের ছায়া।
মনোতোষ খুঁজে বেড়ায় মাছ।
মাছের চঞ্চল খেলা ভারী ভালো লাগে তার।
ফুটবল খেলাও খুব প্রিয়। খেলতে খেলতে সে একবার চোট পেয়েছিল হাঁটুতে। খবর পেয়ে
তার বাবা নিয়ে চলে গেছলেন
বাড়িতে।
মনোতোষের মন ছটফট করছিল
আশ্রমের জন্য।
কলকাতায় ভিড় খুব। সব সময় চিৎকার চেঁচামেচি।
আজকাল আর মনোতোষের মন
টেঁকেনা।
আশ্রমে থাকলে লেখাপড়ার পাশাপাশি গাছের ছায়া জড়াজড়ি করে থাকা। বন্ধুদের সঙ্গে থাকা।
প্রজাপতির পিছনে পিছনে থাকা।
হঠাৎ হঠাৎ গানের সুর ভেসে এলে
মনোতোষ সুরের হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে বেড়াতে কোনো গাছের নিচে দাঁড়ায়।
নিজেকে মনে হয় ডাকঘরের অমল।
গুরুদেব একদিন তাদের পড়াতে এসে অমলের কথা বলছিলেন। তারপর তো আরেকদিন, গুরুদেব নিজে ডাকঘর পড়ে শুনিয়েছিলেন।
মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে মনোতোষ রাস্তায় দেখছিল, তিন-চারটে ছাগ শিশু ছাগলের দুধ পান করছে।
আস্তে আস্তে উঠে পড়ছে সূর্য।
------৬ বৈশাখ ১৪২৯
------২০----৪----২০২২
হাতি পুকুর//
বুধবার ছুটির দিন।
দেবাঞ্জন হোস্টেল থেকে বাইরে এসে ঘুরে বেড়ায়। যদিও তাদের ছোটদের জন্য নানারকম বিধি নিষেধ, তবু সে স্কুলের চৌহদ্দীর মধ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে।
আজও দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে সে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা টগর গাছের কাছে দাঁড়ায়।
একটাও ফুল নেই।
টগরের আঁকাবাঁকা ডালে, শুকনো ডালে উঠে বসলে কেমন হয়?
দেবাঞ্জনের ইচ্ছে করলেও সে আর টগর তলায় দাঁড়ালো না। সে
গাঁদা ফুলের গাছ খুঁজছে।
তার প্রিয় ফুল।
গ্রামের বাড়িতে থাকলে সে প্রতিদিন মায়ের পুজোর জন্য
ফুল তুলে দেয়। আর তাদের ঘরের উঠোনে দেদার গাঁদা ফুল।
তার মা কি সুন্দর মালা গাঁথে।
পরশু শুক্রবার তার জন্মদিন।
মা-বাবা দুজনেই পোস্টকার্ডে
লিখেছে------- বাবুসোনা,
জন্মদিনে এসো। তোমার জন্য পায়েস রাঁধবো।
কী করে যাবে সে! তার যে পরীক্ষা।
ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পড়েছে
হাতি পুকুরে। সে যতবার এখানে আসে ততবার ভাবে, হাতি টা কোত্থেকে এসেছিল? কী করে
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?
এই যে এখন হাতির পিঠে একটা কাক। কেবল সামনের দিকে পিছনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কি যেন দেখে। সেওকি হাতির পিঠে চড়ে কোনো দূর দেশে চলে যাবে?
হাতির শুঁড়ে লটকে আছে শুকনো পাতা। পুকুর জলে ভেসে ভেসে যায় পাতারা।
হাতি সব দেখে। কাউকেই কিছু বলেনা। দেবাঞ্জনের মনে সাধ জাগে , সেও হাতির পিঠে চড়ে
মায়ের কাছে যাবে।
অবাক হয়ে যাবে মা।
বন্ধুদের ডেকে ডেকে হাতির পিঠে চড়তে বলবে। সে হাতিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে------
আমার বন্ধুদের পিঠে নেবে তো?
ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন এসে
দেবাঞ্জনকে দেখে জানতে চান,
এই দুপুর বেলা কি করছে সে?
দেবাঞ্জন চুপচাপ থাকে।
ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন তাকে চুপচাপ দেখে তার কান ধরে বলেন-------চল তোকে অফিস ঘরে নিয়ে যাবো। তখনই একজন সুদর্শন ব্যক্তি এসে দাঁড়ান হাতি পুকুরে। তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা
একজনকে বলেন------শিশুর কান ধরবেন না। বরং কান না ধরে
তার বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করুন।
দেবাঞ্জন এই সুদর্শন ব্যক্তিকে চেনে। মাঝে মাঝে তাদের ক্লাস নিতে গাছ তলায় হাজির হয়ে থাকেন।
দেবাঞ্জনের সাহস এলো মনে। সে
সুদর্শন ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে
বলে উঠলো--------তুমি আর আমি চলো----হাতির পিঠে চড়ে বসি--------
সুদর্শন ব্যক্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো পুকুরের জলে। নড়েচড়ে উঠলো শ্যাওলার দল।
পানাফুল।
------১১ বৈশাখ ১৪২৯
-----২৫---৪-----২০২২
------নির্মল হালদার
আরও পড়ুন

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন