রবিবার, ২৭ জুন, ২০২১

রু / নির্মল হালদার

রু / নির্মল হালদার


সকাল হলেই ছাগলটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সকাল হলেই, এই একটা কাজ------অন্তত দু' কিলোমিটার ছাগলটাকে নিয়ে ঘোরে।
ডান হাতে ছাগলের গলায় বাঁধা দড়ি ধরে রু হাঁটতে থাকে।

অনেক লোক চেন বাঁধা কুকুর নিয়ে প্রাতঃভ্রমণ করে। সেখানে রু দড়ি বাঁধা ছাগল নিয়ে। লোকের কাছ থেকে বিদ্রুপের হাসি শুনতে হয়। কেউ কেউ আছে যারা সরাসরি ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। অশ্লীল ভাষায় বলে, দেখ দেখ ছাগলটাকে দেখ------
ভালোই খেতে লাগবে। একদম কচি আছে। এখনো।

তখন ছিল ছাগ শিশু। যখন হারিয়ে গেছলো ঘরের পথ। যখন হারিয়ে গেছলো তার মাকে।
এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। 

একদিন হঠাৎ মা'কে হারিয়ে ছাগ শিশুটি ঢুকে পড়েছিলো রু দের ঘরে এবং ছাগ শিশুর করুণ মুখ দেখে রু বেঁধে রেখেছিলো। মনে করেছিলো যদি কেউ খোঁজ খবর করে ছাগ শিশুকে ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ খোঁজ খবর করেনি। তারপর থেকেই ছাগ শিশু রু দের ঘরে বড়ো হয়ে উঠছে।

রুতো চরাতে যেতে পারেনা। তাই
সকাল বেলাটা এক পাক ঘুরিয়ে 
ছাগলের গায়ে হাওয়া লাগায়। এবং তার নিজের গায়েও হাওয়া লাগে।

বেচারী সারাদিন বাঁধা থাকে ঘরে।

ভাগ্যিস রুয়ের মা আছেন। সময়ে সময়ে মুখের সামনে খাবার দিয়ে যায়। আর রু বাজার থেকে অশথ পাতা কিনে এনে দেয়। রু শহর বাজারে থাকে বলে, ছাগলটা নিয়ে ঘুরতে পারে না। শুধুমাত্র ভোর থেকে সকাল অবধি পারুলডাঙার দিকে। এখনো যেদিকে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়নি। এখনো কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা আছে।
একদিন এক যুবক রুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল, ছাগল নিয়ে ঘুরলে হবে না। গাছে উঠতে হবে।
পাতপালা পেড়ে দিতে হবে। রু শুনেও শোনে না। 
গাছে উঠে কি বিপদ করবে! হাত পা ভাঙলে সোজা বিছানায়।

ছাগলটাকে দেখবে কে?

আজ রু ছাগলটার কাছে একমাত্র আশ্রয়। রু ছাগলটার কাছে মা।

হ্যাঁ------মা বৈকি।

যদিও রুয়ের মা--ও ছাগলটাকে আদর-যত্ন করেন। কিন্তু কথা তো বলে রু। কোলে তো নেয় রু। আর
ছাগলটাকে দেখলে জ্বলে পুড়ে যায় সোনাই।

সোনাই রুয়ের বান্ধবী।

সেই শুধু বলবে------দাঁড়া দাঁড়া
তোর ছাগলটাকে একদিন বিক্রি করে দিয়ে আসবো। এবং সেই বিক্রির টাকায় তোকে খাওয়াবো পাঁঠার মাংস।

সোনাই ঈর্ষাও করে। তার মনে হয় রুয়ের সমস্ত প্রেম-ভালোবাসা ছাগলটার প্রতি। তার দিকে নজর নেই।  সে অনেক সময় ছাগলটার পিঠে চড় থাপ্পড় মারে। ছাগলটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সোনাইয়ের দিকে। অবলা প্রাণী কিছুই বলতে পারে না। শুধু বেঁধে রাখা খুঁটির চারপাশে ঘুরতে থাকে।

ভয় করে।

সে তার অনুভূতি থেকে দেখে, মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে মাঠে।
ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। ঘাস খাচ্ছে। পাতাপুতা খাচ্ছে। আর ছোট ছোট গাছে উঠে পড়ছে।

কোথায় মা?

ছাগলটাকে শুধু ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। যদি রু ঘরে না ফেরে? আদর করবে কে? কেইবা
খবর নেবে-----জোতিয়া খেয়েছিস তো? অথবা বলবে রু------শীত আসছে। জোতিয়া
তোর জন্য একটা গরমের জামা বানাতে হবে।
রাতের সময় শীত করবে না তোর।
তুই আমার বিছানাতেই থাকবি। মা কিছু বললে, আমি ম্যানেজ করবো।

দিনের বেলা  রু চাকরিতে যায়। 
 তার মন পড়ে থাকে জোতিয়ার দিকে।জোতিয়াও তার অনুভবে দেখে, বাইক নিয়ে ছুটছে রু। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। এই তার কাজ। সময়ে খাওয়া হচ্ছে না তার।
দুজন দুজনের জন্য । মন নিয়ে টানাপোড়েনে থাকে।
রু জানে মা খাবার-দাবার ঠিকই দেবে। তবু তার মন ছুটে যেতে চায় বাড়ির দিকে। জোতিয়ার দিকে।

এই জোতিয়াকে নিয়ে ভোর বা সকালবেলা পারুলডাঙ্গার দিকে গেলে কুকুরের চিৎকার। যেন বা
কুকুরের দল রুয়ের হাত থেকে ছিনিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে জোতিয়াকে। রুয়ের বুক কাঁপতে থাকে। সে জানে তাকে কেউ বাঁচাতে সাহায্য করবে না।

রু শক্ত হাতে জোতিয়ার গলার দড়ি ধরে থাকে।
সে মনে করে , আমার হাত থেকে কেউ কখনও ছিনিয়ে নিতে পারবে না। যদিও তার মা মাঝেমধ্যে বিরক্তি প্রকাশ করে----
এ্যাই শোন্-----ছাগলটাকে এবার
বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয়। আমি আর ছাগল নাদি পরিষ্কার করতে পারছিনা।

রুয়ের মন খারাপ হয়ে যায় জোতিয়ার জন্য। তাকে ছাড়া জোতিয়াই বা থাকবে কি করে!
তারতো কেউ নেই। 
জোতিয়াতো চিনলো না ছাগলের পাল। তাদের চলাফেরা। মায়ের দুধ কেমন একেবারেই জানলো না। সে শুধু রুয়ের কাছে বড় হয়ে উঠলো।

আজ রুয়ের অফিসে ঝামেলা হয়েছে অনেক। কথা কাটাকাটি।
সে রাগ থেকে বলেও ফেলেছে,
চাকরি ছেড়ে দেবে।

ঘরে ফিরে মায়ের সঙ্গে কোনো কথা না বলে, জোতিয়াকে না দেখে শুয়ে পড়লো।
তার মা ডাকাডাকি করলেন অনেকবার । রু খেতেও উঠলো না। মাঝ রাতে যখন ঘুম ভাঙছে,
তখন আগে মনে পড়লো তার ----
জোতিয়া কোথায়?
সে ধড়পড় করে উঠে বাইরে আসে।দেখে জোতিয়া ঘুমিয়ে গেছে। সারা শরীর শিশির ভেজা।

রু গলার দড়ি খুলে তার নিজের ঘরে নিয়ে যায়। বুকে চাপা কষ্ট চোখে যে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে, রু বুঝতে পারেনি। সে বিড়বিড় করে------তোকে নিয়ে আমি আর থাকব না। তোকে ছেড়ে দিয়ে আসবো রাস্তায়। তুই নিশ্চয়ই খুঁজে পাবি  তোর আত্মীয়স্বজনকে।

রু দু চোখ মুছতে থাকে।


-----১২ আষাঢ়১৪২৮
-----২৬----৬----২০২১
-----নির্মল হালদার







বাগাল / নির্মল হালদার

বাগাল / নির্মল হালদার


গরু ছাগল চরালেও ভেড়াও
সঙ্গে থাকে। গদাই সবাইকে সামলায়।
অনেক সময় ছাগল ও ভেড়ার
ঢুসোঢুসি হলে দু'পক্ষকেই সে
লাঠি দেখায়। কাজ না হলে, দু চার লাঠি পিঠে বসিয়ে শান্ত করে।

এখন মহুল তলায় শুয়ে আছে গদাই। পাশে রাখা আছে লাঠি।
গাই--গরু ছাগল ভেড়া আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে।

মাঠে কোথাও ঘাস আছে কোথাও নেই। মাঠ থেকে কাছেই পলাশের জঙ্গল। একটা মোষ একা কি যেন খুঁজছে। তাকে দেখছে একটা শালিক। পলাশের ডালে বসে। সেও একা।

একটা মেষশাবক তার মায়ের পিছনে ছুটছে। মা--ও ছুটছে। একটা বাছুর তার মায়ের কোল
ঘেঁষে শুয়ে আছে।

গদাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতেই তার মনে পড়লো,সে
স্বপ্ন দেখছিল একটা। স্বপ্নটা অদ্ভুত--------সে যেন গরু ছাগল ভেড়া নিয়ে আকাশে উঠেছে।
আকাশটাই মাঠ। ঘাসে ঘাসে ভর্তি। পুকুরও আছে। মেঘের পুকুর। টলটল করছে জল।

গদাই নিজে একবার আঁজলায়
জল ধরতে গিয়েছিল। উঠে এসেছিল মেঘ। আর তখনই ঘুম ভেঙে গেলো তার।

সে দেখতে পায়,একটা মোষ
গরুর দলে ঢুকে পড়েছে। একা।
কোত্থেকে এলো? কাদের বাড়ির মোষ?
গদাই কাছে গেলেও চিনতে পারেনা। সে মোষের পিঠে স্নেহের হাত রাখে। মনে মনে বলে, তোর ভয় নেই। 

গদাইয়ের খিদে পেয়েছে।
সূর্য মধ্যগগনে। সে গরু-ছাগল ছেড়ে ঘরের দিকে যেতে পারে না।
একটা গরু বা ছাগল বা ভেড়া কেউ টেনে নিয়ে গেলে কাজ চলে যাবে তার। তখনই তার সামনে এসে দাঁড়ায় এক যুবক। সে বলে,
আমি জানি তোমার খিদে পেয়েছে। এই নাও--------বলে,
সে গামছা থেকে খুলে গদাইকে দেয় দুটো রুটি ও পেঁয়াজ।
গদাই দেখে থ মেরে গেছে। এই যুবককে সে আগে দেখেনি। এই যুবক গ্রামেও থাকেনা। সে প্রশ্ন করে বসলো----তুমি কোথায় থাকো? আগে তো দেখিনি। যুবক বলে, আজই তো এলাম তোমাদের দেশে। তুমি এখন রুটি খাও। আমি চারদিকটা ঘুরে ফিরে দেখি।
গদাইয়ের জানতে ইচ্ছে করছিল, যুবক খাবে কিনা। ততক্ষণে যুবক অনেকটা এগিয়ে গেছে। তার পিছনে পিছনে ভেড়ার দল। গদাই খাবার ছেড়ে দৌড়ে যায়। সে চেষ্টা করে ভেড়াদের গরু-ছাগলের দিকে নিয়ে আসতে। যুবক হাসে।
সে বলে, তোমার ভয় নেই। এরা
আমার সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসবে তোমার কাছে।

গদাইয়ের সন্দেহ হলেও আর কিছু বলতে পারেনা। সে মহুল তলায় এসে রুটি চিবোতে থাকে।

মাঠের দিকে চেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হয়ে থেকে গেছে। তাই এখন কোথাও কোথাও ঘাস। গরু ছাগলরা মনের সুখে আছে।

বেলা পড়ে আসছে।

এবার গদাইয়ের কাজ, সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করা। সবাইকে ঘরে ফেরানো। কিন্তু তার মনে হচ্ছে, একটি ভেড়ার ছানা যেন নেই। তার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়।

কোথায় গেল?

কেউ চুপি চুপি চুরি করে নিয়ে পালালো না তো?

গদাই মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজে বেড়ালেও কোথাও নেই ছানাটি। সে ঢুকে গেল পলাশ জঙ্গলে। সেখানেও নেই।

গোধূলির আলো এসে পড়ছে মাঠে। গদাই ভাবছে কি করবে?
তার মুখে বিষাদের ছায়া।

সেই যুবক গদাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। যুবকের কোলে ভেড়ার ছানা। বলে,এই নাও তোমার ছানা। বলে, তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। তুমি জানোনা, ছানাটি আমার সঙ্গে ছিল। ওকে তো আমি অনেক অনেক বছর ধরে চিনি। ছানাটিও আমাকে চেনে। তাই আমাকে ছাড়তে চাইছিল না।
গদাই  এবার না থাকতে পেরে প্রশ্ন করে----তুমি কোথায় থাকো?
কি করো? আগে তো তোমাকে দেখিনি?

দেখেছো।
আমাকে দেখেছো তুমি অনেক অনেক যুগ আগে। তোমার মনে পড়ছে না।
যুবকের কথা গদাইয়ের কাছে হেঁয়ালি মনে হয়। তবু সে বলে, আজ তুমি আমাদের বাড়ি চলো।
আমরা একইসঙ্গে আজ খাওয়া-দাওয়া করবো। চলো----

যুবক বলে, আজ নয় অন্য কোনদিন। হয়তোবা শীতের সময়।
যখন তুমি আর আমি মেষশাবক কোলে নিয়ে ঠান্ডা কাটাবো-------
বলেই যুবক হাসতে থাকে।


----১০আষাঢ়১৪২৮
----২৪---৬---২০২১
----নির্মল হালদার






খালি পায়ে / নির্মল হালদার

খালি পায়ে / নির্মল হালদার


বিরসা সবসময় লোকের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অভ্যেসটা তার নতুন নয়। অনেকদিন থেকেই স্বভাবে ঢুকে গেছে। কাছ থেকে দূর থেকেও সে লক্ষ্য করে পা। আর পায়ে যদি জুতো দেখতে পায়, তার মন ছটফট করে। মনে করে, পায়ে জুতো থাকলে মানুষ কিভাবে হাঁটে। কি করে চলাফেরা করে!
বিরসার মনে হয়, জুতো পরা লোকটির কাছে গিয়ে বলবে, পায়ের জুতো ফেলে দিন। খালি পায়ে হাঁটুন।

রাস্তায় জুতো পড়ে থাকতে দেখলে বিরসার আনন্দ হয়। সে মনে করে, লোকে জুতো ফেলে গেছে-----এইতো। লোকে বুঝতে পারছে, জুতোর অপকারিতা।

বিরসা তার মা--বাবাকেও অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে, যেন তারা জুতো না পরে। শুধু সে এলাচিকে বলতে পারেনা। কারণ, এলাচির পায়ে নিত্য নতুন জুতো দেখতে পায়। তাকে বলে লাভ নেই।সে বিরসার কথা একেবারেই শোনে না।

দুজনে একবার কোনো নিমন্ত্রণ বাড়িতে গিয়েছিল।বিরসা খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে এলাচির জুতো দিয়েছিল  লুকিয়ে। এলাচি জানে কার কান্ড। সে বিরসার দিকে বড় বড় চোখ করতেই, বিরসা লুকানো জুতো বের করে দিয়েছিল। 

সে মাঝেমধ্যেই, তার মা --বাবার জুতো লুকিয়ে রাখে। খুঁজে খুঁজে মা--বাবা তখন হাঁক পাড়ে------
বিরসা এমন করেনা বাবা-------
তখন সে বলে, কি জুতো পরে
থাকো! তোমাদের পায়ের কষ্ট হয়
তা বুঝতে পারো! পা বদ্ধ থাকলে পায়ের কষ্ট।

সে নিজেও জুতো না পরার চেষ্টা করে। যেখানে উপায় নেই, পরে যায়। বিশেষ করে এলাচি সঙ্গে থাকলে।

কলেজে যখন পড়তো, বিরসা ক্লাসে জুতো খুলে রাখতো। এবং
পুরো ক্লাস সে খালি পায়ে চলাফেরা। বন্ধুরা হাসতো খুব।
অনেকদিন দেখা গেছে, সে যখন
কলেজ থেকে বাড়ি যাবে, তখন
জুতো আর নেই।
সেও চেঁচিয়ে উঠতো-----কুছ পরোয়া নেহি-----।

জুতো না পরার জন্য বিরসার পায়ে কাঁটা ফুটেছে অনেকবার।
পেরেক ফুটেছে কত।

সে একবার চুড়ান্ত  করেছিল, সন্ধ্যেবেলা সদর রাস্তায়। দুটি ছেলে মেয়ে হাঁটছিল। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে। হঠাৎ বিরসা ছেলে মেয়েটির কাছে গিয়ে বলে-------তোমরা জুতো খুলে দাও। খালি পায়ে হেঁটে যাও খালি পায়ের কাছে।
 ছেলে মেয়ে দুটি বিরসা কে পাগল ভেবে চিৎকার করতে থাকে। লোকজন জড়ো হয়। কেউ কেউ তাকে চড় থাপ্পড় দেয়। বিরসা চুপচাপ বাড়ি চলে আসে।

কাউকে কিছু বলে না।

তার মা বুঝতে পারে, ছেলের কিছু হয়েছে। বিরসার কাছে জানতে চায়------কী হয়েছে?
বিরসা সমস্ত বলে। মা শুনে  তার বাবার কাছে বলে, ছেলেকে ডাক্তার দেখানো দরকার। নইলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে তাদের ছেলে পাগল হয়ে গেছে। হ্যাঁ  এই ছেলেই তো পুজোর জুতো একদিন না পরেই, রাস্তায় ফেলে এসেছিল।

বিরসার এক দাদা ও বন্ধু বলেছিল------আমরা কোন কিছুই ত্যাগ করতে পারি না। তুই তো তাও নিজের পায়ের জুতো রাস্তায় ফেলে আসিস। তোকে কেউ বুঝবে না। তোর জন্য আমার ভালোবাসা সব সময়।

বিরসা বলে, কত কত মানুষ জুতো পরেনা। কই, তাদের তো কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়না। বরং তাদের পা বেশ আরামেই আছে।


বিরসার কথা কে শুনবে?  

সে জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছলো।খালি পায়ে। বকুনি খেয়ে ছিল দেদার। সে ডাক্তারকে বলেও ছিল একটা কথা-------জুতো পরলে, মাটির তাপ পাওয়া যায় না। আমি মাটির তাপ--উত্তাপে
থাকতে চাই। ঘাসের কোমলতা
জানতে চাই।

আমি জুতো পরবো না।

বিরসার পায়ের দিকে তাকিয়ে আমিও জুতো না পরার চেষ্টা করি। কেন না, আমিও সবসময় মাটি থেকে দূরে থাকি।


-----৭ আষাঢ়১৪২৮
-----২২----৬---২০২১
-----নির্মল হালদার





পালকের গল্প / নির্মল হালদার

পালকের গল্প / নির্মল হালদার


পালক এসে আবদার করে, আমাকে ফড়িং এনে দাও।
দিলাম।
ফড়িঙের সঙ্গে ওড়াউড়ি করতে করতে আরো আব্দার করে,
আমাকে প্রজাপতি এনে দাও।
দিলাম।

ফড়িং ও প্রজাপতির সঙ্গে ওড়াউড়ি করতে করতে সে
আরো আব্দার করে,
একটা পাখি এনে দাও।
দিলাম।

পাখি প্রজাপতি ও ফড়িঙের সঙ্গে
ওড়াউড়ি করতে করতে আরো আব্দার করে সে, আমি ছবি আঁকবো

সে এবার কি আঁকবে আমাকে বলে দিতে হবে। আমি বললাম,
তুমি একটা নদী আঁকো।
সে জানতে চাইলো, নদী কি? নদী কেমন?
আমি তাকে নদীর রূপ বোঝাতে পারিনা। সত্যিই তো, সেই বা কেমন করে বুঝবে নদীর চেহারা।
সে তো নদী দেখেনি।

আমার মনে হলো হঠাৎ, ঘরের মেঝেয় এক মগ জল ঢেলে যদি
বোঝানো যায়। কিন্তু বোঝাতে গেলাম না। বরং বললাম তাকে,
তুমি একটা ফুল আঁকো। সে জিজ্ঞেস করলো, কি রঙের ফুল?
আমি বললাম, লাল রঙের ফুল।
পালক এবার লাল রঙের পেন্সিল খোঁজে। অথচ আমার কাছে কোনো রঙের পেন্সিল নেই। তাকে বললাম, কালকে তোমায় পেন্সিল
এনে দেবো।এখন যা আঁকবে
কলমে আঁকো। সে নাছোড়বান্দা।
পেন্সিল চাই। পেন্সিল বক্স চাই।

দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
সে শোনে না। সে বোঝে না। তার
পেন্সিল বক্স লাগবেই।
আমি তখন তাকে জানাই, কাল তোমাকে একটা ঘোড়া এনে দেবো। তুমি ঘোড়ার পিঠে চড়ে
ঘুরে বেড়াবে।

পালক ঘোড়ার কথা শুনে শান্ত হয়।


কথা রাখতেই হবে।

চার বছরের শিশুকে কথা দিয়েছি
কথা রাখতেই হবে।
আমি আমার জঙ্গলে গেলাম। একটা ঘোড়া ধরে নিয়েও এসেছি।

একদম শাদা ঘোড়া।

পালক দেখে খুব খুশি। তারপরই সে বলে, ঘোড়ার পাখা কই? এই ঘোড়া তার পছন্দের নয়। সে ঘোড়ায় উঠে উড়ে বেড়াবে।
পাখা কই?

আমি খুব মুশকিলে পড়লাম।
তাকে বলি, পাখাওলা ঘোড়া কাল এনে দেবো। সে শোনে না। সে 
কাঁদতে কাঁদতে এবার বলে, আমাকে একটা হাতি এনে দাও।
আচ্ছা দেবো----দেবো-----তুমি অপেক্ষা করো।

আমার জঙ্গলে একটাও হাতি নেই। সব হাতি অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


আমাকে যেতেই হলো অযোধ্যা। 
হাতিরা যেখানে থাকে সেই জায়গায় গেলাম। তাদের  বড় কর্তাকে বললাম, আমাকে একটা হাতি দাও-----। অন্তত একটা হস্তিশাবক। পালক খেলা করবে তার সঙ্গে।
কর্তা বলে, হাতি ছানা যাবেনা একা। সঙ্গে মাকে নিয়ে যেতে হবে।

আমি মনে মনে ভাবছি, সে না হয়
মা ও ছেলেকে একসঙ্গে নিয়ে গেলাম। থাকতে দেবো কোথায়?
আমাদের তো মাত্র দুটো ঘর।
আমার জঙ্গলে থাকবে কি হাতি ও
হাতির ছানা?
ঘোড়ারা থাকতে দেবে কি? 

কি করবো কি করবোনা ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই মাটির একটা হাতি বানাই। পুরোপুরি তৈরি হতেই দেখা গেল, মস্ত একটা হাতি হয়ে গেছে। একেবারে জলজ্যান্ত।

আমি খুব খুশি।

গাছের ডালপালা খাওয়াতে খাওয়াতে হাতিকে ঘরে এনে পালককে দিই।
সে সঙ্গে সঙ্গে হাতির পিঠে উঠে
হাতিকে উড়তে বলে।

হাতিও ওড়ে।


----৬ আষাঢ় ১৪২৮
----২১---৬---২০২১



পালকের গল্প (দুই)


আমি নাকি জিরাফ চিনি না। আমি নাকি জেব্রা চিনি না।
পালক তাই আমার মোবাইল থেকে আমাকে জিরাফ চেনাবে।
জেব্রা চেনাবে।

তো, পালককে বললাম আমি উট
চিনি না। আমাকে চিনিয়ে দেবে?
পালক হাসতে হাসতে বলে------
দাঁড়াও দাঁড়াও উট বের করছি।
এবং সত্যি সত্যি উট মোবাইলের বাইরে এসে আমার কাছে দাঁড়ায়।
আমি উট দেখে আত্মহারা হয়ে
উটের পিঠে চড়ে বসি।

আমি মরুভূমি দেখতে পাই।

আমার তৃষ্ণা আসে।

আমি পালককে বলি, তুমি জল
দেখাতে পারবে?সে আমার দিকে চেয়ে থাকে।আর আমি এক গেলাস জল তার সামনে রেখে বলি------এইতো জল।
সে হেসে ওঠে। 

জিরাফের কাছে চাই,একটা ফল।
উঁচু ডালের কাছে আমার হাত 
পৌছোবে না।তখন পালক বলে,তার জন্যেও লাগবে একটা ফল।পাকা।

জিরাফ বলে,পাকা ফল একটাও নেই।শুধু কাঁচা।উট বলে,এসো
আমার পিঠে উঠে যাও------
পাতার আড়ালে আছে পাকা পাকা ফল। তোমরা পেড়ে নিতে
পারবে।

পালক উঠে গেল উটের পিঠে।

আমি জেব্রার কাছে দাঁড়াই। সে আমাকে জঙ্গলে নিয়ে যাবে। 
আমাকে ফল খাওয়াবে নানা রকমের।

আমি পালককে ছেড়ে কী করে যাই!আমি বললাম------সবাই চলো আমাদের বাড়ি। একসঙ্গে
সবাই আম খাবো। আমাদের একটা গাছ আছে। আম ফলেছে খুব।

সবাই একসঙ্গে বললো,না না আম খাবো না।ডাল ভাত খাওয়ালে যেতে পারি।

পালক হাততালি দিয়ে উঠলো।
খুব মজা হবে।খুব।মা আমাদের
আলু পোস্ত খাওয়াবে।

তোমরা পোস্ত খাও তো?

জিরাফ জেব্রা ও উট একই সুরে বললো-----খাই খাই।সব খাই।
আমরা খুশিও খাই।

চলো চলো-------


------৮আষাঢ়১৪২৮
-----২৩----৩----২০২১
-----নির্মল হালদার







রঙ তুলি / নির্মল হালদার

রঙ তুলি / নির্মল হালদার



সংবেদ ছবি আঁকে। ছিঁড়ে ফেলে।
সংবেদ রঙ তুলি কখন কোথায় যে রাখে নিজেই জানে না। তার মা একবার রান্নাঘর থেকে রঙ তুলি এনে বলেছিলেন: আমি কি রঙ দিয়ে রান্না করব আজ? তোর পাগলামি আর নিতে পারছি না খোকন।

খোকন হাসে শুধু।

সংবেদ অথবা খোকন
রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে আসে গরু।
রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে আসে কুকুর। তাদের গায়ে ছবি আঁকবে।
তার মা-বাবা রে রে করে উঠলে
সে জবাব দেয়------তোমরা বুঝবে না এসব। গরু কুকুরের গায়ে ছবি আঁকলে শিল্প হবে চলমান। আমি চলমান শিল্পের পক্ষে।

সংবেদের ইচ্ছে , বাসে ট্রেনে
ছবি আঁকবে। রাস্তায় রাস্তায় ছবি আঁকবে। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকবে। কিন্তু টাকা নেই।
রঙের খরচ যে অনেক। বাবার কাছে হাত পাতবে কত আর।

আগে আঁকার টিউশান করতো।
কামাই করার জন্য সেও গেছে। সে রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে থাকে। পরের দিন ১১টায় উঠবে।
টিউশনি কি আর থাকে। দুপুরেও ঘুমোবে।

বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে সংবেদ বলে, তোমাদের জামা কাপড় পেলে ছবি এঁকে দেবো।
আমাকে দেবে?
তার মা রেগেমেগে বলেছিল----
আমাদের ভাতের হাঁড়িতে ছবি আঁক। ডালের কড়াইয়ে ছবি আঁক। আমি বাধা দেবোনা। দোহাই তোকে, আত্মীয়স্বজনকে
ছবি আঁকার কথা বলবি না।
তারা তোকে পাগল বলে। এ আমি
সইতে পারিনা।

ইদানিং সংবেদ সন্ধে হলেই
একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা বিড়ি টানে।
তারপর আবার চলে আসে।

দরজা-জানালায় কোনো মুখ সে দেখতে চায় না। সে শুধু বাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। কিছুক্ষণ দেখবে। আর চলে আসবে। দিনের বেলা বাড়িটার কাছে দাঁড়াবে না।
কেবল সন্ধ্যের সময়।

লোকজন তাকে সন্দেহ করে।

বাড়ির মালিক একদিন ধমক দিয়েছিল। ভেবেছিল কোনো রংবাজ ছেলে।তার মেয়ের জন্য আসছে।
কিন্তু না। এই বাড়ির স্থাপত্যের
মধ্যে এক প্রাচীনতা আছে। যা সংবেদকে আকর্ষণ করে। এই বাড়ির নকশা সে ছবিতে ব্যবহার করতে চায়। ব্যবহার না করলেও
মনে রাখতে চায়।

যা কিছু সুন্দর মনের মধ্যে রেখে দিলেও সুন্দর। এবং মনও সুন্দর হয়ে থাকে।

সংবেদের আশ্চর্য লাগে, এই বাড়ির দরজা জানলা সব সময় বন্ধ থাকে। বিশেষ কাউকে দেখা যায় না। একদিন শুধু বাড়ির মালিক ধমক দিয়েছিল তাকে। তারপর আর নয়।

পাড়ার লোকজন ভাবে, ছেলেটি
এই বাড়ির কোনো মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

ভাবাটাই স্বাভাবিক। কেননা
সংবেদ প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা
বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেই।

সংবেদ একদিন মোড়ের মাথা থেকে দু'হাতে দুকাপ চা নিয়ে বাড়িটার সামনে দাঁড়ায়।

দু'কাপ চা মানে অনেকটা সময়।
অনেকটা সময় সে বাড়িটাকে
দেখার সুযোগ পাবে।

বাড়িটাকে দেখতে দেখতে সে
বাড়িটার প্রেমে পড়ে গেছে। মনে মনে বাড়িটাকে সে সাজাতে থাকে। যেন তার প্রেমিকা। কয়েক হাজার বছর আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।

সহসা সংবেদ এক কাপ চা
রাস্তায় ঢেলে দেয়। গড়ানো চায়ের উপরে সে ঢেলে দেয় রঙ।

সংবেদ তুলি চালাতে থাকে।

তখনই সেই বাড়ি থেকে এক তরুণী তার কাছে এসে বলে, তুমি আমাকে ভালোবাসবে?

এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে
সংবেদ পাল্টা প্রশ্ন করে তরুণীকে------ভালোবাসবো?
ভালোবাসা কি? আমি তো রঙ
ভালোবাসি। তুমি যদি চাও
তোমার গায়ে ছবি আঁকতে পারি।
এই আমার ভালোবাসা।

তরুণী খিলখিলিয়ে হাসে। আর সংবেদের হাত থেকে রঙ তুলি নিয়ে গায়ে ছিটিয়ে দেয়।

সংবেদ বাড়ির দিকে দৌড়োতে থাকে। তরুণী পাগল পাগল বলে চিৎকার করে।


-----৫ আষাঢ়১৪২৮
-----২০---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার






জন্মদিন / নির্মল হালদার

জন্মদিন / নির্মল হালদার


প্রতিদিন ফুল কুড়াতে যায়।

ভোর হলেই ফুল কুড়াতে যায়।

ইয়ালা ঘুম থেকে উঠেই মাকে ওঠায়: মা ওঠো ওঠো-------
আলো আসছে। মা উঠে যাও
আলো আসছে-------
মা নড়েচড়ে।ওঠেনা।

ইয়ালা একা একা
ঘরের দরজা খুলে বাগানে যায়।
ফুল দেখতে না পেলে, সে চলে যায় ভুবন ডাঙা।
অসংখ্য ফুলের গাছ। টগর ফুলের গাছ। শাদা শাদা ফুল।মন মেলে চেয়ে আছে। মাটিতে পড়ে আছে।

যে গাছগুলি উঁচু উঁচু------ইয়ালার
হাত যায়না। সেই গাছের ফুল হাসে। হাসতে হাসতে মাটিতে ঝরে যায়। আর তখনই ইয়ালা ফুল কুড়ায়।
এক সাজি ফুল নিয়ে ঘরে গিয়ে
তার পড়ার টেবিলে রাখে।

ইয়ালা স্কুলে যায়। সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার কয়েকজন বন্ধু হয়েছে। তারা একই সঙ্গে স্কুলে যায়। একই পাড়াতে থাকে।
আর বন্ধু হয়েছে ফুল কাকু।

প্রায় দিন ফুল কাকুর সঙ্গে
ইয়ালার দেখা হয় ভুবন ডাঙ্গাতে।
ফুল কাকুও ফুল তুলতে আসে।

কখনো কোনো দিন ফুল কাকু
ইয়ালাকে বিস্কুট ও লজেন্স দিয়ে থাকে। আদর জানায়।বলে, তোমাদের বাড়ি যাবো একদিন।
ইয়ালা কী খাওয়াবে? ইয়ালা বলে, মিষ্টি খাওয়াবো।
ফুল কাকু বলে, আমিতো মিষ্টি খাই না।ইয়ালা আর কি বলবে।
শুধু বলে, তুমি দুধ মুড়ি খাবে।
ফুল কাকু হাসে।

আজ ফুল কাকু তাদের বাড়িতে আসবে। ইয়ালার মা আসতে
বলেছেন। আজ ইয়ালার জন্মদিন। আজকেও ফুল তুলতে গিয়ে ছিল ইয়ালা। ফুল কাকুও।
তখন ইয়ালা ফুল কাকুকে তাদের বাড়ির একটি গোলাপ উপহার দিয়েছে। ফুল কাকু বলেছে, আজ তোমাদের বাড়িতে যাব। তখন দেখবো, তোমার গাঁথা মালা।
তুমি মালা গাঁথতে পারবে?
আমি কোনদিন গাঁথিনি------আজ
তোমার জন্য মায়ের কাছে শিখবো।

ফুল সংগ্রহ করেছে অনেক।
ইয়ালা মালা গাঁথবে। মায়ের কাছ
থেকে ছুঁচ--সুতো এনে ফুল গাঁথবে। কিন্তু সে ছুঁচে সুতো পার করতে পারছেনা। বারবার চেষ্টা করেও সে বিফল হয়ে পড়ছে।
সে মাকে বলে। মা জানায়-------
ঘরের কাজকর্ম সারা হয়ে গেলে
মালা গেঁথে দেবে। কিন্তু ইয়ালা
চাইছে,সে নিজে গাঁথবে।
বারবার চেষ্টা করে সে নষ্ট করছে সুতো। তখন সে, একটি একটি করে ফুল টেবিলে সাজায়। মালার মতো সাজায়।
নিজেই হাততালি দেয়। এইতো
এইতো মালা------এই মালাই
তার ফুল কাকুকে আজ দেবে।আজ------শুধু আমার জন্মদিন নয়। সবার জন্মদিন।



-----৪ আষাঢ়১৪২৮
----১৯---৬----২০২১
----নির্মল হালদার




কবিতা / নির্মল হালদার






কবিতা / নির্মল হালদার


১২০.
যে কোনো ফুল শব্দ করে
আমি ফুলের দিকে যাই।
যে কোনো ফুল কলরব করে
আমি কলরবে যাই।

আমি ঘরের দিকে যাই।

আমার ঘর আমারই স্বর
মাটিতে বসত করে।


১২১.
অনেক দিন আগে আমার একটা ঘর ছিল।
ঘরের দরজা জানলাও কথা বলে উঠতো।
ঘরের দেয়াল ঘরময় হেঁটে বেড়াতো,
আমারই সঙ্গে।

আমি একা হয়েও একা ছিলাম না।

সম্পূর্ণ ঘরটাই আমার সঙ্গে বেড়াতে যেতো,
শহরে গ্রামে। আমার স্পর্শে,আমার বন্ধুতায় 
সে ছিল প্রকৃত ঘর।
সে নক্ষত্র দেখেছিল।

নক্ষত্র সকলের চোখে ধরা পড়ে না

আমার ঘরের চোখ ছিল। চোখের আলোতে ছিল
একটা ঠিকানা, নক্ষত্রের বসতি।
ওরা হেঁটে বেড়ায়। শব্দ করে। ওদেরও আছে তৃষ্ণা
মাটিতে নেমে হাত রাখবে আমার কাঁধে।

অনেক দিন আগে আমার চওড়া কাঁধ ছিল

পাহাড়কে জায়গা দিয়েছি।


----৪ আষাঢ়১৪২৮
----১৯----৬----২০২১


১২২.
গাছ থেকে জাম পড়ে পড়ে চারদিক কালো।
আষাঢ়ের অন্ধকারে কালো আরো গভীর। মন টানে।
মনে হয়, এই অন্ধকার আমার পরিধেয়।

আমি আলোর দিকে যাবো।

মাটি ভক্ষণ করে ফল। বালক বালিকারাও জাম কুড়াবে।

আমিও কুড়াবো বৈকি।

সূর্যের বোঁটা ছেঁড়ার আগেই জাম--কালো অন্ধকার

আমারই।


----৫ আষাঢ়১৪২৮
----২০--৬--২০২১


১২৩.
আকাশে ছড়ানো বীজ আমারই রচনা।
কালিকলম তো ছিল না, ছিল আমার মন।
আকাশে ছড়ানো মন আমারই রচনা।

এক একটি রচনা এক একটি বিপন্নতা

কে পাঠ করবে গোপনে? প্রকাশ্য আলোয়?

পাঠক তো পাহাড়ের মত জ্যান্ত
আমাকে দেখাবে কি আমার পরাণ?



১২৪.
জাম রঙের আকাশ পাড়লে
জাম পাড়বোনা।আজ আকাশই
নুনে মাখামাখি হয়ে আমার সঙ্গী।

আমার ছোটবেলা।

আমার ছোটবেলায় তুইতো ছিলিনা
তোকে আজ ডাকছি। তুই আমার
এই আষাঢ় বেলার গোপন ইচ্ছা গুলি।


----৬ আষাঢ়১৪২৮
-----২১---৬---২০২১


১২৫.
কথা বলবে বলো
মাটি না জল, জল না মাটি
কার সঙ্গে কথা বলবে?

কথা বলবে বলো
আলো না হাওয়া, হাওয়া না আলো
কার সঙ্গে কথা বলবে?

ধুলোবালিও কথা বলে

দুঃখ এসে দাঁড়ালেও কথা বলবে
সুখ এসে দাঁড়ালেও কথা বলবে
কার সঙ্গে কথা বলবে?

মাটির তলে মাটি কথা বলে।
জলের উপর জল কথা বলে।
কার সঙ্গে কথা বলবে?

তুমি নিজেই এক ভূখণ্ড।


-----৭ আষাঢ়১৪২৮
----২২---৬---২০২১


১২৬.
ছোট রাস্তা বড় রাস্তা মানে
বড় খিদে ছোট খিদের মতই।
কখনো আলো
কখনো আগুন দেখতে পাই।

কখনো
তারার আগুনের চেয়েও তীব্র,
সৌন্দর্যমুখী----একই পঙক্তিতে 
ভোজন করি ছোট বড় সবাই



১২৭.
জল জঙ্গল জমির সমগ্রতা
মানুষের সমগ্র। মানুষের এই সম্পদের কাছে
বাতাস ছড়ায় স্বর্ণরেণু

নদী থেকে সোনা সংগ্রহ করে মানুষ
মাটি থেকে সোনা সংগ্রহ করে মানুষ
ধারাবাহিক এই জীবনের কাছে
আমিও হাতে হাত রাখি

অশেষ মানুষের স্পর্শ পাই।


-----১০আষাঢ়১৪২৮
-----২৪---৬---২০২১


১২৮.
নদীর সঙ্গে একটা মানুষ থাকলে মানিয়ে যায়।

মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস বইবে
নদীর জলও বইবে।

সুখ দুঃখের মতো আলো অন্ধকার বইবে।

নদীর সঙ্গে একটা নৌকা থাকলে মানিয়ে যায়। কানা কড়িতে পার হয়ে যাবো

এপার থেকে ওপার।



১২৯.
আমি শুধু মানুষ দেখি
মানুষের সংখ্যা দেখিনা। আমি বাড়ি দেখলে
দেশ দেখতে চাই। দেশ বাড়ি
প্রকৃত ঠিকানা।

আমার ঠিকানা এই, দাঁড়িয়ে আছি গাছ তলায়

গাছের পাতা গুনি না।


-----১১ আষাঢ়১৪২৮
----২৫---৬---২০২১
----নির্মল হালদার






শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১

ছাতা / নির্মল হালদার

ছাতা / নির্মল হালদার



কখন যে বৃষ্টি আসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। গত বছর দু-দুটো ছাতা কেনার পর ডুলুঙ হারিয়ে ফেলেছে। এ বছরও ছাতা কেনার প্রয়োজন।

সে দাঁড়িয়ে আছে সাঁওতাল পরিবারের কাছে। মুলানের সঙ্গে দেখা হবে এখানে।
তারপর দুজনে যাবে বোলপুর।

রামকিঙ্করের সাঁওতাল পরিবার
দেখা-সাক্ষাতের একটি ঠিকানা।
ডুলুঙের কাছে এই সাঁওতাল পরিবার, তাদের বাড়ি সীমান্ত পল্লী থেকে বেশি দূরে নয়। মুলান আসবে নন্দ সদন থেকে। সে কলাভবনের ছাত্র।
আর ডুলুঙ সংগীত ভবন।
দুজনের বন্ধুতায় গান ও ছবি।
ছবি ও গান।
ডুলুঙ গান করলে মুলানের রং তুলি গতি পায়। ডুলুঙ গানে স্রোত পেয়ে থাকে।
আজ দুজনেই যাবে ছাতা কিনতে।
ডুলুঙ অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ।
মুলান আসছে না।
দেরি করা তার অভ্যেস।

ছাতাটা আজ কিনতেই হবে।

-----জানি জানি
ছাতাটা আজ কিনতেই হবে-----
মুলান এসে যখন ডুলুঙকে বলে
তখন তার মুখ ভারি।মুলান বলে,রাগ করিসনা।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল।
----প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল আমার-----৯টা বেজে পার হয়ে গেছে। টিফিন করে আসিনি।
খিদেও পাচ্ছে।
----চল্ তাহলে, কলাভবন ক্যান্টিনে যাই।
আমিও তো খাব।
----দরকার নেই।
তাড়াতাড়ি চল। আজ ছাতা একটা কিনতেই হবে।

দুজনেই সাইকেলে উঠে পড়ে।

আষাঢ়ের দিন।রোদ বেশ তেতে আছে। গরম লাগছে খুব। তখনই ডুলুঙ দেখতে পায়
----------ছাতা ভাসছে হাওয়ায় হাওয়ায়।
বড় ছাতা।
ছোট ছাতা।
মেজ ছাতা।
সেজ ছাতা।

রঙিন ছাতা। কালো ছাতা।

হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে। কে কোথায় যে যাচ্ছে ঠিক ঠিকানা নেই।
ডুলুঙ সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে ছাতা ধরতে যাবে যেই, সাইকেল থেকে পড়ে গেল। মুলান বুঝে উঠতে পারেনা কি হলো।কি করে হলো।
মুলান সাইকেল থেকে নেমে ডুলুঙকে উঠতে সাহায্য করে।
মুলান বলে,এ কিরে শুকনো
রাস্তায় পড়ে গেলি! তখনো ডুলুঙ
দেখছে, ছাতা ভাসছে হাওয়ায়
হাওয়ায়।সে কোনো কথাই বলতে
পাচ্ছেনা।
আগেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে ডুলুঙের কাছে অথবা জীবনে।
সে দিনরাত যখন হোক স্বপ্ন দেখে।
একবার সে আম পাড়তে পারেনি বলে, পূর্ব পল্লী থেকে একটা আম গাছ কোলে নিয়ে এসেছিল ঘরে।

সেই গল্প যাদের শোনাতে গেছে,সবাই বলেছে ------পাগলি!
পাগলি কোথাকার।

সারা রাস্তা দুজনের কোনো কথা হলোনা। হঠাৎ ডুলুঙ বলে,ছাতা কিনবো না চল্-------
----কেন?
----কেনর কোনো উত্তর নেই। চল্ বাড়ির দিকে।

মুলান চুপচাপ সাইকেলের গতি পথ পাল্টে নেয়। অথচ দেখে ডুলুঙের সাইকেল ক্যানেল পাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মুলান আর অবাক হয়না।সে জানে ডুলুঙ এরকমই। এবার ডুলুঙ বলে,খিদেটা সত্যি সত্যি পেয়েছে রে।চল্------এক প্যাকেট
বিস্কুট নি-------।

ক্যানেল পাড়ের কাছে এসে দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ে। এবং
ডুলুঙ চেঁচিয়ে ওঠে: ওইতো ওইতো ছাতা।সব বাড়ি নিয়ে যাবো।
ক্যানেল পাড়ের ধারে ধারে অনেক ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে। মুলান ডুলুঙের এই কান্ড দেখে বলে,
পাগলিটাকে নিয়ে আর পারলামনা।

------২আষাঢ়১৪২৮
------১৭----৬----২০২১
------নির্মল হালদার






১লা আষাঢ় / নির্মল হালদার

১লা আষাঢ় / নির্মল হালদার



মা অনেকবার বলেছিল, বাড়ি যাওয়ার জন্য। মৃত্তিকা বলেছিল, বাড়ি যাওয়ার জন্য।

ফোনের পর ফোন এসেছে। কাল রাতেও মা ফোন করেছিল। যেন সকালের বাসে চলে যায় পালং।

সে গেল না।

কলেজে পরীক্ষা আছে। তারপর
নিজেই সে ঠিক করেছে, কোপাইয়ের দিকে একা একা গাছ লাগাবে। রাতের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া। বাড়ি চলে গেলে কথার খেলাপ হবে।

গাছেরাও কী মনে করবে?

মাটিও কী মনে করবে?

পালং যে নিজের কাছেও কথা দিয়েছে, আজ গাছ লাগাবে। গাছ না লাগালে, বৃথা যাবে দিন।

রাত থেকেই বৃষ্টি চলছে। সকালেও বৃষ্টি। অবিরত।

কোপাইয়ের দিকে যাবে কি করে?
বৃষ্টি আটকাবে না ছাতায়। হেঁটে গেলে বা সাইকেলে গেলেও ভিজতে হবে।

সঙ্গে থাকবে গাছের চারা।

আম আর জাম।
কাল একটা নার্সারি থেকে
কেনা হয়েছে। বন্ধুরা বলছিল
বট অশথ কেনার জন্য। ফরেস্ট থেকে পাওয়া যায়।
পালং বলে, বট অশথ থেকে ছায়া পাওয়া যায়। আর আম জাম থেকে শুধু ছায়া নয়------
ফল পাবে মানুষ।

বন্ধুরাও বলেছিল, তার সঙ্গে যাবে গাছ লাগাতে। কিন্তু এত বৃষ্টি ।কেউ ফোন ধরছেনা। সবাই বোধ হয় ঘুমোচ্ছে।
পৃথা ফোন করেছিল। সে এই বৃষ্টির মধ্যেই যেতে রাজি। পালং তাকে নিয়ে যাবে না।

একবার বৃষ্টির মধ্যে খোয়াইয়ের দিকে পালংকে জড়িয়ে ধরেছিল।
পালং উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ঝাঁপ দিয়েছিল খোয়াইয়ের জলে। বৃষ্টির জলে।
সে তাই খানিক ভয় করে পৃথাকে।

মনেপ্রাণে জড়িয়ে গেলে, মৃত্তিকাকে প্রতারণা করা হবে।

দূরে দূরেই থাকতে চায় পালং।

মেসবাড়ির বাকি তিন বন্ধু ঘুমোচ্ছে। সে হিটার জ্বালিয়ে
নিজের জন্য চা বানালো। চা খাওয়ার আগে মনে মনে প্রণাম জানালো মাকে। প্রতিদিনের মতোই। এইটে তার অভ্যেস। এই অভ্যেস থেকে পালং কোথাও যেতে চায় না।
সারাদিন তো আর মাকে মনে পড়ে না। অন্তত সকালবেলায় একবার। যে মা তাকে মানুষ করেছে একা একা।

বাবা চাকরিসূত্রে বাইরে বাইরে কাটিয়ে দিলেন। মাকে বহন করতে হয় সংসারের বাকি কাজ কর্ম। এমনকি পালংকে টাকা পাঠায় মা। বাবা দশেমাসে ফোন করেন।

বেলা হয়ে গেল।

পালং একটা ব্যাগের মধ্যে গাছের চারা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

শান্তিনিকেতন এমনিতেই নিরিবিলি খুব। শান্ত। এই বৃষ্টির মধ্যে আর লোকজন দেখা যাচ্ছে না। কেবল কোপারেটিভ মোড়ে একটা টি স্টল খোলা আছে।
খবরের কাগজ বৃষ্টির জলে ভিজছে।

পালঙংয়ের ইচ্ছে হলো আরেক কাপ চা। ইচ্ছেটাকে দমন করে সাইকেলে জোর লাগালো।বাঁ হাতে ছাতা। ডান হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল।

বৃষ্টির হাওয়া এসে উড়িয়ে দিতে চায় সবকিছু। আকাশেও ঘন মেঘ। বৃষ্টির বিরাম নেই। মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টিকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।

শ্যামবাটিতে এসে পালংয়ের মনে হলো, এখানেও কিছু গাছ লাগালে ছায়া হবে। ভাবতে হবে ভবিষ্যতের জন্য।
ভবিষ্যৎ?

নিজের কি ভবিষ্যৎ আছে? মাঝেমধ্যেই পালং নিরাশ হয়ে ওঠে। মুষড়ে যায়।

যদিও সে স্বপ্ন দেখে শান্তিনিকেতনেই থেকে যাবে।
কোনো চাকরি না পেলে আদিবাসী গ্রামের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে।

একটা ঝুপড়ি ঘর কি ভাড়া পাবেনা সে? টিউশন করবে। সেইসঙ্গে আদিবাসী গ্রাম।

এই শান্তিনিকেতন থেকেই তো কত মানুষ কতকিছু হয়েছেন। কত কিছু করেছেন। সেও পারবে নিশ্চয়ই।


কোপাইয়ের কাছে এসে পালং দেখে পুরোটাই সে ভিজে গেছে।
সে মনে করলো, আজকের ভিজে যাওয়াটা অবশ্যই আনন্দের।

কোপাইয়ের চায়ের ঝুপড়ি খোলা আছে। এক বুড়ো বাউল একা একা একমনে গান গাইছে। পাশে এক যুবক টান মারছে গাঁজায়।
পালং এক কাপ চা খেয়ে
শুরু করলো কাজ করতে।

কোপাই ব্রীজের এদিকে ৫টা আম
৫টা জাম। ওদিকেও একইরকম ভাবে লাগিয়ে ফেললো গাছের চারা। এবং কাজটা করতে করতে
বেলা হয়ে গেছে। মেঘ ছেঁড়া আলো তার মুখে এসে পড়ছে।খিদেও পেয়ে গেছে তার।

পালং কোপাইয়ের জলে হাত--মুখ ধুয়ে ব্রিজে উঠে দেখতে পায় দূরের এক গাছ তলায় এক বৃদ্ধা উনুন জ্বালিয়েছে। নিশ্চয়ই রান্না করবে।
তার মনে হলো, আজ সে যদি ওই
বৃদ্ধার কাছে দুটি ভাত চেয়ে নেয়?
কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না নিশ্চয়ই। বরং সে মনে করবে, আজ এখানেই তার জন্মদিন উদযাপন করা হলো। মাকেও বলতে পারবে গল্পটা। বলতে পারবে বন্ধুদের, জানিস-----,
আজ আমার এই জন্মদিনে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে এসেছি।

বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় পালংয়ের শুকনো মুখে হাসির রেখা।

-----১ আষাঢ় ১৪২৮
----১৬---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার






নিছক একটি গল্প / নির্মল হালদার

নিছক একটি গল্প / নির্মল হালদার



গায়ে কি একটা যেন উঠেছে।
শিরশির করছে। অন্ধকারেই
দু হাত দিয়ে খুঁজছি। পাইনা।
আলো জ্বালি। দেখতে পাচ্ছি না কিছুই। গেঞ্জি খুলে দি। আঁতি পাঁতি খুঁজি।
গায়ে কিছু নেই।
আলো নিভিয়ে দি। শুয়ে পড়ি।
আবার পেটের কাছে কি একটা শিরশির করছে। আমার অস্বস্তি
বেড়েই চলেছে।
ঘুমটা গেল। মোবাইল দেখি। ১----২০।

আবারও আলো জ্বালি।গায়ে কিছু নেই। তবে কি গায়ে উঠেই পোকারা চলে যাচ্ছে? আমাকে ভয় দেখিয়ে চলে যাচ্ছে?

গা চুলকাচ্ছে খুব।
ঘর অন্ধকার হলেই জ্বালাতন করছে ।
যদি আলো জ্বেলে ঘুমোই?

কোনো পোকা গায়ে উঠছে নিশ্চয়ই। কোনো পোকা আমাকে খেয়ে ফেলবে নিশ্চয়ই।
আমার ভয় করছে।

রাত যদি এ ভাবে কাটে
কাল শরীরটা ভালো যাবেনা।
কী করবো এখন?
আজ সন্ধের সময় কার অপেক্ষায়
যেন দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হলো,
আমার পাশ দিয়ে একটা ছায়া চলে গেল। হঠাৎ।
আমি এদিক ওদিক চেয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই। শুধু সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠছে।

ব্যাংক থেকে ফেরার পর ঘরের তালা খুলেছি যেই, মনে হলো, কেউ একজন বেরিয়ে গেল। কে
বেরিয়ে গেল? কে ছিল ভিতরে?

কেউ যে ছিল না, আমি জানি। তারপরেও মনের এই অবস্থা মনকে স্থির হতে দেয় না। সারাক্ষণ বিচলিত হয়ে থাকি।
মনে হয়, এই বুঝি বিপদ এলো।
এই বুঝি বিপদ এলো।
যেমন আজ মনে হলো,২০০টাকা
পাবো। শর্মা আমাকে দিয়ে যাবে।
আগে থেকে কোনো কথা নেই যে
টাকা দিয়ে যাবেই। তবুও মনে হলো, শর্মা আজ আসবে আমার কাছে। আমাকে দিয়ে যাবে টাকা।
এবং সত্যি সত্যি দিয়ে গেল। ২০০
নয়৩০০টাকা।আজ বিনোদন আসবে রাত্রিবেলা। থাকবে আমার কাছেই। এসেছিল। আড্ডা হয়েছিল খুব।
এরকম ঘটনা ঘটলে সুখের কথা।
কিন্তু যদি মনে হয়, রাস্তায় হোঁচট খাবো। শুরু হয়ে যায় আবোল তাবোল চিন্তা। উদ্বেগ। চোখে মুখে
প্রকাশ পেয়েও থাকে।
আজ ঠিক করলাম, দেয়ালে টাঙানো ছবি সমস্তই ফেলে দেবো। যদি ছবির পেছনে পোকারা আত্মগোপন করছে। এবং রাত্রি হলেই আক্রমণ করতে আসছে আমাকে। যেই ভেবেছি কাজ সঙ্গে সঙ্গে। সব ছবি খূলে ফেললাম।

একটিও পোকা নেই।

আজ দেবায়নের খবর পাবো।
সে আসছে ১০ তারিখ। আজ নিজের কাছে নিজের খুশি। পরে দেখলাম, দেবায়ন আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করলোনা।ফোন করেই জানালো, ১০ তারিখ নয়
------সে গুজরাট থেকে ১২ তারিখ পৌঁছোবে আমার কাছে। তাতানও আসবে কলকাতা থেকে।
এসমস্ত সুসংবাদের কাছে নিদ্রাহীনতা। সঙ্গে পোকার কামড়। অথবা সব সময় সন্দেহ
পোকারা লুকিয়ে আছে বইয়ের পাতায়। ডাইরির পাতায়।

ডাইরিটা আমার কাছেই এসেছে।
আর ছত্রে ছত্রে দেখতে পেলাম
শিমুলের ভয়। যে শিমুল আমার বন্ধু। যে শিমুল
বর্তমানে গ্রামে থাকে। নিজে একটা স্কুল করেছে।
নাম: জোনাকি।

সেও তো বছর পাঁচ হয়ে গেল।

এইটে শিমুলের পুরনো বাড়ি।
আমাকে পাঠিয়েছে গীতবিতান
নিয়ে যাওয়ার জন্য।
স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে।
সে গাইবে রবীন্দ্রনাথের গান। কোরাসে।
ছেলেদের শেখানো হয়েছে। তালিম দিয়েছে সেই।

আমিও সেই স্কুলে।

আমরা দু'জন কেবল স্থায়ী শিক্ষক। আমরাই ছেলেপুলেদের হোস্টেল সামলাই। রান্নাও করি।

গীতবিতান খুঁজতে এসে শিমুলের এই ডাইরি। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখি এক জায়গায় লিখেছে: নেগেটিভ কিছু ভাবতে নেই। নেগেটিভ কিছু ভাববো না। অথচ সে অনেক জায়গাতেই, নেগেটিভ পজেটিভ দুই।

এক জায়গায় লিখছে--------
প্রজাপতিরাই উড়ে বেড়াবে হাওয়ার সঙ্গে। ফড়িং এসে গল্প করবে। গান করবে পাখিরা।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত শিশুদের কলরব সুন্দর করবে চরাচর।
আমিও এই চরাচরের বাসিন্দা।
আমি আত্মহত্যা করবো না কখনো।

আত্মহত্যা?

শিমুল কী তবে কোনোদিন আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছিল?
কেন করেছিল?

ডাইরির আরেক জায়গায় লিখছে সে-------কেন যে দেখা হয়ে গেল বিন্দিয়ার সঙ্গে? কেন যে মুখোমুখি হয়েছিলাম? জীবন একবার যা ছেড়ে দিয়ে আসে, তার দিকে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়।
আমাকে পালাতে হবে। শহর ছেড়ে পালাতে হবে। আমাকে লাগাতে হবে অনেক গাছ। আমাকে রোপণ করতে হবে খুশি আর আনন্দ। আনন্দ আর খুশি।
কোনো পোকামাকড় আমাকে আক্রমন করতেই পারবে না। আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। যে কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাবে, আমার সৃষ্টি।

ঐ তো একটা ব্যাঙ আসছে------কত মেঘ তার পিঠে।

চলো সবাই মেঘ নামিয়ে নেচে ওঠো চলো। চলো------আজ বৃষ্টিতে ভেজার দিন।

------৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৫----৬----২০২১
-----নির্মল হালদার






একটি তারার দিকে চেয়ে / নির্মল হালদার

একটি তারার দিকে চেয়ে / নির্মল হালদার



ঘুম আসছেনা।
কেবল এপাশ-ওপাশ।
মোবাইল দেখলো এখন----রাত ---১---১০-----।

বিছানা থেকে উঠে পড়লো জন।
একটা বই টেনে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখতে পায় একটা ছবি।
মনীষার ছবি।

ছবিটা দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল জনের সেদিন মনীষার জন্মদিন ছিল। সেদিন জন ও মনীষা কলেজে ঢুকেই বেরিয়ে গেছিল জন্মদিন উদযাপন করবে।
নদীর দিকে।

সেদিনই ছবিটা দিয়েছিল ।

বই থেকে গোলাপ ফুল টা কবে ঝরে গেছে মনে পড়ে না জনের।
সরু ডালটা নিয়ে জন তার দু গালে স্পর্শ নিতে থাকে। যেনবা
মনীষার আঙুল।

মনীষা মনীষা------একটা অস্ফুট ডাক জানলা থেকে বাইরে যায়। আর সেই ডাক তারায় তারায় লাগে। একটি তারা এসে জনের
জানলাতে দাঁড়ায়।জন হাতে নিয়ে
বিছানাতে।
জন বলে, তুমি মনীষা নও। আমি জানি। তুমি কে? তোমার নামটা বলো।
তারা বলে, স্বাতী।
জন বলে, তুমি স্রোতস্বিনী।
তারার উজ্জ্বল হাসিতে জনের ঘর
আরো আলোকিত হয়ে ওঠে। তারা হাসতে হাসতে জানতে চায়, বলো কি কথা বলতে চাও।
জন জিজ্ঞেস করে, আকাশে তোমরা অনেকে অনেকে থাকো, তুমি না হয় আমার কাছে থাকবে।
আমার তো কথা বলার কেউ নেই।
তোমার সঙ্গে কথা বললে, আমি সঙ্গ পাবো। তুমি থাকবে তো?
হ্যাঁ থাকবো। প্রতিদিন রাত্রি বেলা।
তারার এই কথায় জন লাফিয়ে ওঠে বিছানাতে।
তারা তখন বলে, তোমার ঘুম নষ্ট হবে কিন্তু। পারবে তো রাত জাগতে?
জন বলে, অবশ্যই পারবো। চেষ্টা করতে হবে দিনের বেলা ঘুম।
তারা বলে, অফিস করবে না?
তা করতে হবে। তা করলেও
রাত জাগতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি রাত করে ঘুমোই।
তারা আবার হাসে। বলে, আমি তো ভোরের আগে অবধি থাকবো। কী করবে তুমি?
তোমার সঙ্গে ভোর অবধি
কাটিয়ে দেবো। কথা বলতে
আমার খুব ভালো লাগে।
তারা জানতে চায়------কি কথা?
জন বলে, এলোমেলো কথা। হয়তোবা হাতি ঘোড়া থেকে আমার মন। হয়তোবা আমার খিদে থেকে আমার আকাশ।
তারা হাসে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, আমার কথা তোমার জানতে ইচ্ছে করবে না?
ইচ্ছে তো করবে, কিন্তু কি কথা তোমার কাছে জানতে চাইবো? তুমি না হয় তোমার গল্প বলবে
আমি শুনবো। এই কথার পর
হঠাৎ জন তারার কাছে জানতে চায়-----তোমার কি জল তেষ্টা পাচ্ছে?
তারা বলে, আমাদের জলতেষ্টা নেই। তোমার যদি ইচ্ছে করছে তুমি খাও।

না খাবোনা।
তুমি যে বললে জলের কথা।
আমার তেষ্টা ফুরিয়ে গেছে।
কেন?
এইযে তুমি কাছে আছো-----তাই।

অন্ধকার ফুরিয়ে আসছে দেখে
জন বলে,এই তোমাকে কিন্তু রোজ আসতে হবে। রোজ । আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
তারা বলে, যদি না আসি?
এমন কথা বোলোনা। আমার তো বন্ধু নেই।আজ যখন তুমি এলে
আমার বন্ধু হয়ে যাও। প্রতিদিনের।
আমি অপেক্ষা করবো।
তারা বলে, মেঘে ঢাকা পড়লে
আমি আসতে পারবো না।
ও তুমি জানো না , আমি দুই হাত দিয়ে মেঘ সরাতে পারি। মেঘ ছেঁড়া আলো কতবার যে নিয়ে এসেছি আমি।
আচ্ছা আচ্ছা আমি তো ভুলে গেছিলাম, তুমি আছো কত আলো আমার ঘরে। ইলেকট্রিক
সব নিভিয়ে দিই------বলো!
জন ঘরের আলো সব নিভিয়ে দেয়।

জানলা দিয়ে হাওয়া আসে। চারটে জানলা থেকে হাওয়া আসে।ফুরফুরে হাওয়ায় প্রবেশ করে তারা চলে যায় নিজের জায়গায়।

জন দেখে আধো আধো আলোয়
দেখে তারা নেই। সে জানলার দিকে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে শুকতারা হাসছে।

তার স্রোতস্বিনী কোথায় গেল?

সে ছাদে এসে আকাশে তন্ন তন্ন করে খোঁজে।কোথাও নেই। ঊষার আলো ক্রমশ এসে পড়ছে তার কপালে।

-----৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৪---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার





লোকটা / নির্মল হালদার

লোকটা / নির্মল হালদার



কোথায় গেল রে বাবা লোকটা?
টিভি চলছে। অথচ ঘরে নেই।
কোথায় গেল?

এদিক ওদিক চেয়ে দেখি।
চেঁচিয়ে ডাক দি------ ও মোহন দা
ও মোহন দা-----।কোনো সাড়াশব্দ পাইনা।

কোথায় গেল রে বাবা?

সকালেই আসতে বলেছিল আমাকে। আমিও ঠিক সময়ে এসেছি। অথচ নিজে লোকটা নেই।
বেশি দূরে তো যাবে না নিশ্চয়ই।
কাছাকাছি আছে। তাই হয়তো, টিভি চালিয়ে চলে গেছে।

বিল তো উঠবেই। লোকটা কি আর জানে না! জিজ্ঞেস করতে হবে। সঠিক উত্তর পাবো কি?

লোকটা আগে আসুক।

দরজা খুলে ঘরের ভেতরে বসি।
দেখতে পাই, খোলা আছে খবরের কাগজ। ৩ নাম্বার পাতায় একটা কলম রাখা আছে। তার মানে, একটু আগেই ছিল। কোনো কাজে উঠে গেছে। পড়ে আছে চায়ের কাপ। অর্ধেক খালি। এস্ট্রে আছে।
পোড়া সিগারেট বিড়ি নেই।

লোকটা আছে। এখুনি এসে হাসতে হাসতে বলবে, রাগ করিস না। দেরি হয়ে গেল।

লোকটা এলো।
এবং আমি যা ভাবছিলাম, তাই বললো, রাগ করিস না।
আমি বললাম রাগ করছি অন্য একটা কারণে। তুমি নেই আর
ঘরে টিভি চলছে। কী ব্যাপার?
লোকটা জানালো, টিভি না চললে
তুই আমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করতিস না। এতদিন আসছিস, কিছুই তো বুঝলি না । আমার দরজা ভেজানো থাকে। তালা চাবি থাকে কী? কারণ ঐ একটাই, আমি আছি। একটা সময় ছিল যখন, দু হাট করে আমার দরজা খোলা থাকত সবসময়। তার ফল ভুগেছি। চুরি হয়েছে অনেক কিছুই। এখন দরজা ভেজানো থাকে। শুধু। এখনো চুরি হতে পারে।

আমি বললাম, দাঁড়াও-------আমি একবার চুপি চুপি তোমার ঘরে যা আছে যেটুকু আছে নিয়ে যাবো। চুরি করে নিয়ে যাবো।

লোকটা বললো, কি আর আছে! একটা সময় সংগ্রহ করেছিলাম, রবীন্দ্র রচনাবলী।রমেনকে দিয়ে
দিয়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী পেয়েছিলাম। দিয়ে দিয়েছি।
তা বাদে আর কিছু নেই। এখন বই
কেনা ছেড়ে দিয়েছি। সংগ্রহ করা ছেড়ে দিয়েছি। যেহেতু লেখাপড়া করি না আর।

অনেকক্ষণ পর লোকটা বললো,
চল্-----চা খেয়ে আসি। লক্ষ্য করলাম, লোকটা পায়ে চটি না গলিয়ে আমার সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে। আমি বললাম, জুতো পরবেনা? লোকটা উত্তরে বললো,
কেউ যদি এসে আমাকে দেখতে না পায়? আমার ঘরে তো কেউ নেই যে জানান দেবে আমার খবর।
তুমি আশ্চর্য লোক তো। যার দরকার তোমাকে খুঁজে নেবে। তুমি জুতোটা পরো।
আমার কথা না শুনে খালি পায়েই বাইরে চললো।
আমি বললাম, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না।

লোকটা হাসলো।

আমার মনে পড়ে গেল, সুবোধ আমাকে একদিন বলছিল, লোকটা নাকি প্রায় দিন সন্ধ্যেবেলা ঘুমোয়। এদিকে চলতে থাকে টিভি। সুবোধ ঘুম থেকে তুলে প্রথমেই লোকটাকে বলেছিল, টিভিটা বন্ধ করো। বুঝতে পারছি, তোমার অনেক পয়সা হয়েছে। ইলেকট্রিক বিল যা খুশি হবে দিতে পারবে তুমি।

সুবোধ উত্তরে জেনেছিল, ঘরে যে কেউ আছে , লোকটা বাদেও কেউ আছে এটা জানান দিতেই, এই পদ্ধতি।
একটা ঘর। সে কি শুধু চুপচাপ থাকবে? একটা ঘর সেতো বোবা নয়। শব্দ চলতে থাকুক। সুবোধ
তারপর বলেছিল, গান চলতে পারে। মন্দ লাগবে না। তুমি ঘুমিয়ে গেলেও গান চলবে। গান চলতে পারে। গান , ঘুমের জন্য
শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা।
মোহন দা, তুমি একটা মিউজিক সিস্টেম কিনে নাও। গান চালিয়ে
নিজেকে ঘুম পাড়াবে।

লোকটা নাকি হেসেছিল খুব।
লোকটা এও বলেছিল, আমি কি বিপদ করবো। গানে আমার ঘুম আসেনা। কান্না আসে।

সুবোধ আর কি বলবে চুপচাপ ছিল।

মোহনদার সঙ্গে একদিন বাজারে দেখা। লক্ষ্য করলাম, মাথার চুল উস্কোখুস্কো। জামাকাপড় মলিন।
আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার? তোমাকে অন্যরকম লাগছে?

মোহনদা আমাকে বলে, আমি তো এটাই চাইছিলাম। খুব ধোপ দুরস্ত
হয়ে থাকলে, তুই কাছে দাঁড়াতিস না। কথা বলতে বলতে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতিস। এই যে তুই দু'দণ্ড দাঁড়ালি এটাই আমি চাইছিলাম। তোর কাছ থেকে। এখন তো আমরা কেউ কারোর কাছে দাঁড়াই না।
আমারও যে অস্তিত্ব আছে, এইটে
আমাকে বলতে হবে কেন? যদিও
বলতেই হচ্ছে, আচার-আচরণে।
পোশাকে আশাকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখি, যেন কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করি। দুর্ব্যবহার থেকে প্রমাণ হয় না, আমি আছি।

আরেকদিন সন্ধ্যেবেলা, মোহন দার বাড়িতে বন্ধুরা সবাই আসবে।
আমারও নিমন্ত্রণ। তো গিয়ে দেখি, তখনো কেউ আসেনি। ঘর
লাগোয়া ছাদের দেয়ালে একটা জামা ঝুলছে। এবং জামার পকেট থেকে উকি দিচ্ছে একটা নোটিশ। বিষয়: আমি না থাকলে
দরজা খুলে বসে পড়ো।

মনে পড়ে গেছলো, মোহনদার
আরেকটা কথা: ঘর মানে ঘর নয়। মানুষজন না থাকলে ঘরের
কোনো অর্থ নেই। অস্তিত্ব নেই।

আমি বলেছিলাম, তোমার অস্তিত্ব কি থাকবে মৃত্যুর পরে? মোহন দা
তার স্বভাবসুলভ হাসিতে জানিয়েছিল, না থাকবে না। আমার মৃত্যুর পরে আমার অস্তিত্ব নিয়ে আমার টানাপোড়েন থাকবে না। কিন্তু যতক্ষণ আছি, অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতেই হয়।
বলেছিল, এই যে আমি প্রেম প্রেম করি তার কারণ একটাই, আমার অস্তিত্বকে জাগিয়ে রাখা। আমার যৌনতাকে জাগিয়ে রাখা।

আমি মোহনদার সব কথা বুঝতে পারি না বলে, তর্ক করি না। আজ
যেমন আমাকে বললো, মানুষের
স্বপ্ন ও কল্পনা মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। আর মানুষও অনেক দূর যেতে ভালোবাসে। কেননা, সে যত দূর যাবে ততদূর তার অস্তিত্ব। তার বেঁচে থাকা।

আপাতত এই মদের আড্ডায়
ভারি ভারি কথা না হলেই ভাল লাগবে মোহন দা। তুমি বরং
তোমার ছোটবেলার কথা বলো‌।
আমি শুনবো।

আর একটু রাত হোক। তোকে নিয়ে নদীর কাছে যাবো।নদীও
শুনবে আমার ছোটবেলার গল্প।
জলধারায় বয়ে যাবে অতীত। আর আমি বর্তমান জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে
স্নান করবো এই অমাবস্যার রাতে।

কী রাজি তো?

আমি চুপচাপ।

----২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১৩----৬----২০২১
----নির্মল হালদার





কবিতা / নির্মল হালদার






কবিতা / নির্মল হালদার


১০৯.
সূর্যের প্রথম কিরণ নবজাতকের মতো
আমার কোলে এসে হেসে-কেঁদে ওঠে।
হাসি-কান্নার কোমলতায় পশুপাখির যাত্রা শুরু।
কীটপতঙ্গের যাত্রা শুরু।

খাদ্য সন্ধানে যাবে।

আমিও হাসি কান্নার আলোয় চোখ ধুই।
আমার মনের কালিমা ধুই।

আমিও সন্ধান করবো, কোথায় পড়েছে 
তোর পায়ের ছাপ।


১১০.
পাখির সুর ধরে ধরে
আমিও পাখিদের সঙ্গে
সকালবেলা।
যদি সুরের মতো আহার খুঁজে পাই

আমার মুক্তি পাই

আমার মুক্তি মানুষের কাছেও।

মানুষের হাত ধরে ধরে
আমিও মানুষের সঙ্গে
সারাদিন।
যদি মানুষের মত মানুষ খুঁজে পাই

আমার মুক্তি পাই।


-----২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----২৯----৬----২০২১


১১১.
সারাদিন মাটিতে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে হাত বাড়াই

মাটি বিধ্বস্ত মাটি বিষণ্ণ
মাটি আক্রান্ত

এক বিঘা জমি কি আমার মাটি?
দু বিঘা জমি কি আমার মাটি?

শুধু পায়ের তলার মাটি আমার মাটি
আমার দেশ

একই হাঁড়িতে ফুটছি সবাই।



১১২.
আজ ফুটেছে ফুল চারদিকে---সোঁদা গন্ধ।

আবার এসেছে আষাঢ়

আবার আসবি না তুই?

বৃষ্টির ফোঁটা ধরে ধরে
আবার আসবি না তুই? তুই যে নিজেই মাটি
বৃক্ষরোপণের মত রোপন করবি আমাকে

আমার বিরহ বর্ষায়।


----৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৪---৬---২০২১



১১৩.
ওইখানে এক পাথর পড়ে আছে।

পাথরের কী বয়স কী নাম
আমার জানা নেই। পাথর কী বলতে চায়
আমার জানা নেই। আমি শুধু দেখছি,
ওইখানে এক পাথর পড়ে আছে। একা।

আমি পাথরের কাছে দু'দণ্ড দাঁড়াই।


১১৪.
একটা চড়ুই এসেছে।

আমার শৈশব এসেছে।

কে দেখবে আমার শৈশব?
কে আদর করবে আমার চঞ্চলতা?

একটা চড়ুই এসেছে।

আজ আর দুধ জল নেই। শুধু
মাড় পানি। আজ আর খেলা নেই। শুধু
মেঘের পরে মেঘ

আমি মেঘের ভিতরে যাই 
শৈশবের কান্না খুঁজতে।


-----৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১৫----৬----২০২১


১১৫.
আকাশ জুড়ে আষাঢ় এসেছে।

আকাশ জুড়ে আমার আত্মীয়তা।

আকাশ জুড়ে ভিজছে আমার আত্মীয়তা
আমার মন
আমার জন্মের এই সকাল


আষাঢ়েও জন্ম আমার
শ্রাবণেও জন্মদিন।
একটি ভেজা কাকের কাছেও আমার জন্ম কথা

আকাশ জুড়ে মেঘের ডাক

আমি যাই।


----১ আষাঢ় ১৪২৮
----১৬---৬----২০২১


১১৬.
কেন যে ওইখানেই একটা গাছ
কেউ বলতে পারে না।
কেন যে গাছ তলায় উই ঢিবি
কেউ বলতে পারে না। কেবল
বাঁশ বনের পথে চলে যায় সবাই।

ধুলোমাখা শিশু হেসে উঠছে।



১১৭.
দু' পায়ে ধরা আছে একটি ডুমুর
চেয়ে আছে কাঠবিড়ালি।

কে প্রেম ডুমুর না কাঠবিড়ালি?

ডুমুর মাটিতে পড়লে কে নিয়ে যাবে?

ডুমুর ফেটে পড়লে অজস্র বীজ
অজস্র মুখের আলো

আমারই বংশের ধারা

প্রবহমান।


-----২ আষাঢ়১৪২৮
-----১৭----৬----২০২১



১১৮.
প্রজাপতির সঙ্গে রঙের বিনিময় করি

আমার গায়ের রঙ কালো

আমার মন ছিটিয়ে দিই।
আমার মন রঙে রঙে ভরপুর। উজ্জ্বল।

আমার উজ্জ্বলতা ছিটিয়ে দিই
আমার উদ্দীপনাও

যা আমি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি।



১১৯.
আমার বাড়ি যে সকলের বাড়ি
এ কথা বলতে দেরি হয়ে গেল।
সূর্যোদয়ের পরেই আমি যে এসেছি
এ কথা বলতেও দেরি হয়ে যায়।

সকলের মাঝে আমার ঠিকানা
কবে আর বলবো। কবে আর কাছে যাব
ওই যে পড়ে আছে ভাঙ্গা প্রদীপ
জোড়া লাগাতে হবে। জ্বালতেই হবে,

বিরহ বর্তিকা।


-----৩ আষাঢ় ১৪২৮
-----১৮/৬/২০২১
-----নির্মল হালদার







ছবি : তপন পাত্র

শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

পাশের ঘর / নির্মল হালদার

পাশের ঘর//


চা দিয়ে এসেছি কিনা মনে পড়ছে না। জিজ্ঞেস করলেই হবে। এই মুহূর্তে আর যাবো না। আমার ঘরের দিকে এলে, জেনে নিতে পারবো
চা দিয়েছি কিনা।
ওর সঙ্গে একটা কথাও ছিল।
কী কথা? এখন আর মনে পড়ছে না। ও আমার কাছে এলে মনে পড়ে যাবে, কি কথা বলতে চাইছিলাম।


সকাল থেকেই মাথাটা ধরেছে খুব। ওকে কি বলবো, একটা পেইনকিলার এনে দিতে? না না
ওকে অযথা বিরক্ত করে লাভ নেই। বরং দুপুরে খেতে বসে বলা যাবে, আজ রাতের খাবারটা আমরা বাইরে খাবো। ও যদি রাজি হয় বেশ ভালো হবে। কেননা অনেকদিন কোনো রেস্টুরেন্টে খাই নি। আমি অবশ্য
তেল--ঝালে যাবোনা। একটা ধোসা নিলেই হবে। ও যা ইচ্ছে খাবে। ওতো খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে রসিক খুব।
একদিন মনে হয় বলছিল, পাকা কলা বেসন দিয়ে ভেজে খাবে। আমারতো শুনেই ভয় করছিল।
একেতো কলা, তারপরে আবার বেসনে ভাজা।
সে যাই হোক, ওর সঙ্গে কিছু কথা আছে। এখুনি বলবো? যদি ওর
লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে? যদি
বিরক্ত হয়? থাক------দরকার নেই।
সারাদিনই আছে তো। সারাক্ষণ আছে। যখন হোক বললেই হবে।
আপাতত শতভিষার সঙ্গে কথা বলা যাক। সে আবার ব্যস্ত নেইতো?
শতভিষার সঙ্গে কতদিন যে দেখা হয়না। সে স্কুল নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, কথা বলার ফুরসত নেই।
আমি তো সবসময়ই কথা বলতে চাই। কিন্তু কি কথা? কার সঙ্গে কথা বলতে চাই?
সবার সঙ্গে কি কথা বলা যায়?
আমার মাথায় গিজগিজ করে কথার পরে কথা।
কাকে কোন্ কথাটা বলবো, স্থির করতে পারিনা।
এই মনে হলো,আয়ানের সঙ্গে কথা বলি। এই মনে হলো, রহমানের সঙ্গে কথা বলি। অথচ
কারোর সঙ্গেই ফোনে কথা হয় না। ওদের আমার সামনে বসিয়ে
একা একা কথা বলি।
এতে মজাও আছে খুব। রসিদ
কিংবা রাণা আমার সঙ্গে একটিও কথা বলে না। আমি একা বকবক
করে যাই।কোনো তর্ক বিতর্ক হয় না। ঝগড়া বিবাদ হয় না। তাই
হয়ত ওকেও কাছে ডেকে কথা বলি না একটাও।
কাছে ডাকার দরকার ই বা কি!
আমার পাশেই তো ঘর, ঢুকলেই হবে। কথা শুরু করলেই হবে।কোনো ভূমিকা না করে, আজ যদি প্রশ্ন করি, তাল গাছ কত
ফুটের হয়?
তারপর এই গাছ সেই গাছ থেকে
অন্যান্য গাছের লম্বা-চওড়া কি হয় না হয়, আলোচনা করা যায়।

ও যদি উৎসাহী না হয়? ও যদি
শাহরুখ খানের কাজ নিয়ে কথা বলতে চায়? আমি কি উৎসাহ দেখাবো?
যদিও আমার শাহরুখ সম্পর্কে
অতিমাত্রায় আবেগ আছে। আমি
যোগ করতেই পারি একটা বিষয় যে শাহরুখ নিয়ে আমি একটা প্রজেক্ট ভেবেছি। তারপর সেই প্রজেক্ট নিয়ে লম্বা লম্বা স্বপ্ন। আর স্বপ্নহীনতা।
এ সময় বাপি এলে জমে যাবে আড্ডা।
আড্ডা কি জমবে? কি জানি।
হয়তো দেখা যাবে, আমার নীরব থাকতে ভালো লাগছে। অথবা ইচ্ছে করছে ঘুমোতে।

ঘুম চাইলেও সব সময় ঘুম আসে না। আর ঘুমের শব্দ পেলে নিজের উপর এত রাগ হয়, যে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।
আচ্ছা, রাগে-দুঃখে আমরা তো
বুকের লোম উপড়ে ফেলি না?

মাথার চুল কি সহজ সস্তা?


আস্কারা নামে এক যুবতীর সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল। সে বলছিল, তার নাকি সাঁতারের প্রতি প্রেম। আমার সঙ্গে যখন আলাপ হলো, আমাকেও শিখে নিতে হবে সাঁতার।
আমি বললাম, সাঁতার দিতে পারি
তবে জলে নয়। ধুলোবালিতে।
আস্কারা হাসতে হাসতে আমার বুকে থাপ্পড় রেখেছিল। আমি পুলকিত হয়ে তার হাতে চুমু খেয়েছি কয়েকটা।

সে একটুও রাগ করেনি।

আজ যদি পাশের ঘরেই শুই?
ওর সঙ্গে? তাহলে কি কথা হবে?
রাতের কথাই তো সব সময় গভীর হয়। রাতের কথাই তো সব সময়
অর্থপূর্ণ হয়।

কে বলেছে? যত্তসব মনগড়া কথা। যত্তসব-------

হ্যাঁ এটাও ঠিক , রাত্রির কথা
সকালে আর মনে থাকে না।

ওর কি মনে থাকে? জিজ্ঞেস করতে হবে। ওর কি মনে হয়,
মানুষের জীবনে রাত্রি শুধু মোহময়ী?

রাত্রির আগে একটা সন্ধে থাকে।
তার আগে একটা বিকেল থাকে।
সেই সময় থেকেই আমার শুরু হয় কথা বলা। বেশিরভাগ দিন আয়ানের সঙ্গে কথা হয়। সামনে নয়। ফোনে নয়। আমি নিজেই
আয়ান হই।

কে আর আসবে আমার কাছে?
কাজ ছেড়ে?

পাশের ঘরে যে ও আছে, কই
কথা হচ্ছে আমার? পাশের ঘরে যে ও আছে,
কই ওর সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছি?

সিনেমা দেখতে গেলে আমি সঙ্গী চাই অবিনকে। প্রেম বিষয়ে দু'চারটে কথা বললে, আমি সঙ্গী চাই জুসমানাকে।

আমার যে নানান ফের।

এইতো আরেকবার চা এলো।ওর
কাপটা আমি নিয়ে যাই তাহলে।

দরজা ঠেলে যেই ঢুকেছি, কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই। শুধু
শুকনো এক ঘরের মেঝে। চারটে
শাদা দেওয়াল।

মেঝের এক কোণে ধূপদানি থেকে বেরিয়ে আছে ধূপের কাঠি। নিচে পড়ে আছে ছাই।



-----২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----১২---৬---২০২১
----নির্মল হালদার





অনন্ত কালের স্নান / নির্মল হালদার

অনন্ত কালের স্নান



বৃষ্টির জলে স্নান করবো।
অনন্ত কালের স্নান। আজকেই হবে সেই স্নান।
অবশ্যই একটি স্বপ্নকেও ধুয়ে যেতে দেবো না। শুধু স্নান করবো।
আমার স্নান।

আজ দুপুর থেকেই মেঘ এসে বলছিল, তৈরি হও। তৈরি হও।
বৃষ্টি নিয়ে আসছি। স্নান করবে তুমি।
সেই বার্তা পেয়ে মহুল কে বললাম। সে জানালো, আমার মত আবেগের তার নাকি দরকার নেই।

ভালবাসার দরকার আছে কি?

কি দরকার কি দরকার নেই
আমরা জানি না। আমরা জানি না, ইঁট চাপা ঘাসের বেদনা। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ইঁট টি তুলে ঘাসকে প্রাণের দিকে এগিয়ে দেয়।

কী দরকার?
ঘাসের থাকা না থাকা নিয়ে কি যায় আসে! তবু তো কেউ একজন ঘাসের ব্যথা থেকে ব্যথিত হয়ে ঘাস কে বাঁচায়।

বাঁচানো টা খুব দরকার?

অথচ মহুল রাস্তায় পড়ে থাকা
অর্ধমৃত মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল। মহুল পথশিশুদের জন্য লেখাপড়ার
ব্যবস্থা করেছে। আজ সেই বলছে,
কি দরকার?

একজনের স্নানের সঙ্গে আরেকজন স্নান করলে চরাচরে জেগে ওঠে চন্দ্র সূর্য। একইসঙ্গে।

যুগল রূপ মিলনের রূপ।

একা একা কি আর মিলন হয়?
একা একা কি উদযাপন করা যাবে বৃষ্টির আনন্দ?

কবুতর আসবি তুই?
আমরা একই সঙ্গে স্নান করবো।
আমাদের ছাদটা পছন্দ না হলে
আমরা মাঠে চলে যাব।

আয় না রে চলে আয়।

একটার পর একটা ফোন বন্ধুদের কাছে। অপরপ্রান্ত থেকে অবিন কেবল শুনতে পায় , তার পাগলামিতে কেউ নেই। কেউ থাকতেই পারে না।

সে মহুলকে আরেকবার চেষ্টা করে। যদি সে আসে। সেই হবে একমাত্র স্নানের সঙ্গী।
এইবার সে বললো, যেতে পারি
তোর সঙ্গে কথা বলতে। স্নান করবো না।

আসবার দরকার নেই তোর-----
অবিন জানিয়ে দিলো। সে
বাড়ি থেকে বাইরে এসে , রাধাচূড়া
গাছটার নিচে দাঁড়ালো।

বৃষ্টি চলছেই।

অন্ধকার বৃষ্টি।

কেউ কোথাও নেই। শুধু বৃষ্টির ধারা। অবিন রাধাচূড়া কে জড়িয়ে
ভিজছে। একা একা।



-----নির্মল হালদার
----১০--৬---২০২১





কবিতা / নির্মল হালদার







কবিতা / নির্মল হালদার


১০৪.
ফুলে থাকো আর ফলে থাকো
তুমি একটা বিষয়
দেশে আর দশে

ভুখে থাকো আর ভালোবাসায় থাকো
তুমি একটা বিষয়
দেশে আর দশে

তুমি একটা বিষয়
কেননা,
তুমি আলো তুমি অন্ধকার

তুমি এক স্বর

তুমিই সমাজ।


----২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১০---৬----২০২১


১০৫.
সম্পর্কে তুই আমার পাহাড় হলে
পাহাড়ের স্তব্ধতা আমার আত্মীয়।

জলে-স্থলে আত্মীয়তা।
আত্মীয়তা এককে। সমগ্রে। অংশেও।

আমি নিকটে যাই।

নৈকট্য আমার প্রিয়।

আমি নত হয়ে কুড়াই আমার আলো।


১০৬.
আমি নিরাপদে আছি তো?
সন্দেহ করছি।
আমার নিরাপত্তা আছে তো?
সন্দেহ করছি।

ইঁটে লাথি মেরে
আমি ছুটে বেড়াই।
বুকের লোম উপড়ে
আমি ছুটে বেড়াই।

আমার সন্দেহ, আমি বেঁচে আছি তো?


----২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১১----৬----২০২১


১০৭.
এত আলো অন্ধকার লাগছে।
কেউ কাছে থেকেও কাছে নেই।
শব্দ নেই। এত আলো
চোখে সইছে না।

নিজের হাত পা কই?

এত আলো অন্ধকার লাগছে।
একফোঁটা হাওয়া নেই।
হাওয়ার কথা নেই, অন্ধকার লাগছে

আলো জ্বালাও আলো জ্বালাও


১০৮.
হাওয়া ছুঁয়েই আছি

আমি চাই বা না চাই
হাওয়া আমাকে ছুঁয়েই আছে

যত দূরেই যাই
যত কাছেই থাকি
হাওয়া আমার সঙ্গে

কে হাওয়া?

আমার জন্মের সঙ্গে কি সম্পর্ক
আমার বিরহ ব্যথায়
কে হাওয়া?


----২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১২---৬---২০২১
----নির্মল হালদার





বুধবার, ৯ জুন, ২০২১

যাপনের একদিক / নির্মল হালদার

যাপনের একদিক
-----------------------


কে ঠেলছে আমাকে?
আমিতো হুমড়ি খেয়ে পড়বো।
হঠাৎ কে ঠেলছে আমাকে?

ছো পিছনে ফিরে দেখে কেউ কোথাও নেই। রাস্তাও জনশূন্য।
তাহলে কে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে গেল?
চারদিকটা ঘুরেফিরে দেখতে থাকে ছো।
কেউ তো নেই। সন্ধের অন্ধকার
রাস্তার আলো ছাড়া কিছু নেই।
কোথাও নেই।

সেদিনও মনে হয়েছিল এইরকম,
ছো বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তার, পিঠে কেউ চিমটি কেটে চলে গেল।
সে বাইক দাঁড় করিয়ে একটা পান দোকানের সামনে দাঁড়ায়। সামনে-পিছনে দেখে। ডাইনে-বাঁয়ে দেখে------দেখে
কেউ নেই।
চিমটিটা এত জোর ছিল যে
বাইক দাঁড় করাতে বাধ্য করলো।

তার পিছনে কি কোনো বাইক ছিল?

আরেকদিন হাঁটতে হাঁটতে সে
যাচ্ছিলো মেডিকেল দোকানে।
প্রেসক্রিপশন পড়তে পড়তে।
তার ঠাকুমা খুব অসুস্থ।
ছোয়ের মন ভালো নেই।


রাস্তায় লোকজন বিস্তর। যানবাহনের চলাচল।
ছো মেডিক্যাল দোকানে গিয়ে দেখে হাতে প্রেসক্রিপশন নেই।
সে ঘাবড়ে যায়।

হাওয়া এসে তো উড়িয়ে নিয়ে যায়নি? কোথায় গেল প্রেসক্রিপশন? তার মাথা ঘুরতে থাকে।
ওষুধগুলো না নিয়ে গেলে
ঠাকুমার চিকিৎসা শুরু হবে না।
সে পাগলের মত রাস্তায় এসে খুঁজতে থাকে। দেখতে পায়,কলার খোসার সঙ্গে লটকে আছে।

ছো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

বেশ কিছুদিন ধরেই, এই সমস্ত ঘটনা তার জীবনে ঘটছে। এবং সে কেঁপে উঠছে ভেতরে ভেতরে।

ছো হোঁচট খেলেও মনে করছে,
তাকে কেউ পিছন থেকে ঠেলে দিয়েছে। তাকে কেউ বিপদে ফেলতে চায়।

সে কে?

নানা ঘটনার কারণেই ইদানিং
ছো অন্যমনস্ক থাকে। মন মরা হয়ে থাকে। কাকেই বা বলবে,
ঘটনার কথা?

চড়ুইকে বলতে গিয়েছিল।
কিন্তু চড়ুই সমস্ত না শুনেই বলেছিল, তুই ডাক্তার দেখাবি যা।

ডাক্তার?
ছো আৎকে উঠেছিল।

ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানে তো
নানা প্রশ্ন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এবং একগাদা গম্ভীর ট্যাবলেট।

ছো ভয় পায়।

চড়ুই হাসতে হাসতে বলেছিল,
এবার তুই গান শুনলে মনে করবি
অন্য কেউ গান করছে।
যা যা গল্প-উপন্যাস পড়বি। যা আরো কবিতা পড়বি। এবার নিত্য নতুন ভাবে উড়তে উড়তে চলে যা কোথাও। সুস্থ হয়ে যাবি।

ছো বলতে চায়,তার কোনো অসুখ নেই। অথচ কালকেই তার মনে হয়েছে, সে ভেতরে ভেতরে রেগে উঠছে। কিন্তু রাগের কোনো কারণ সে দেখতে পাচ্ছে না। তবে কি, তার জীবনের ঘটনা বা দুর্ঘটনা থেকে তার রাগ আসছে?
কার ওপরে রাগ?

বাদামের ঠোঙা ছোয়ের হাত থেকে কেউ তুলে নিয়ে গেলে,ছো কি করবে?
এই যে এখন সে মাঠে একা একা বাদামের ঠোঙা নিয়ে সময় কাটাতে এসেছে। যদি ছোঁ মেরে ঠোঙাটা
কেউ নিয়ে যায়?

মাথাটা ঝনঝন করে তার। উড়ে আসে শুকনো পাতা। ছেঁড়া কাগজ। সে ভয় পেয়ে উঠে পড়ে
ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে।

বাড়ি?

ছো দাঁড়িয়ে যায় পথে।

বাড়িটা কোন্ দিকে?

সে রাস্তার মধ্যে বসে পড়ে।
পথ চলতি লোক তাকিয়ে ভাবছে,
ছেলেটির কী হলো?

চড়ুই ফিরছিল কলেজে থেকে।
সাইকেলে। রাস্তার মধ্যে ছোকে
বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে যায়।
সে বুঝতে পারে, ছোয়ের কিছু একটা হয়েছে। যাইহোক,চড়ুই
এখন ছোকে উঠিয়ে সাইকেলের পিছনে বসায়। সোজা চলে যায় কুঞ্জ বনে।

দুজনে বসে পড়ে মহুল গাছের নিচে। চড়ুই ছোয়ের কাছে জানতে চায় তার কি হয়েছে? মুখ থমথম করছে কেন?

ছো কিছুই বলতে না পেরে, চড়ুইয়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে থাকে।

আকাশে উড়ছে বক।



----২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৮---৬---২০২১
------নির্মল হালদার



চাল-বুড়ি / নির্মল হালদার

চাল- বুড়ি//

ভোরের আঁধার থাকতে থাকতেই
চলে আসে। বাজারে যে সমস্ত দোকানপাট আছে, তার বাইরেটা ঝাঁট দিতে থাকে বুড়ি।

দোকান তো খুলবে বেলা আটটার পর। তার আগে সাফ-- সুতরো করে রাখে। দোকানি যেন এসেই দেখতে পায়, তার দোকান দুয়ারটা
পরিষ্কার হয়ে আছে। দোকানির
মন ভালো হয়ে যাবেই। এই মন
ভালো করার কাজটা বুড়ি করে। প্রতিদিন।

বুড়ির স্বামী অকালে মারা গেছে।
ছেলেপুলে নেই। আত্মীয়রাও দেখভাল করে না। অল্প বয়সে লোকের বাড়িতে কাজ করতো।
এখন আর পেরে ওঠেনা। শুধুমাত্র
ঝাঁট দেবার কাজ করতে পারে।
এ কারণেই, বাজারের দিকে।

ভোরের আঁধারে।

চাল দোকানের বাইরে অনেক চাল পড়ে থাকে। গোটা চাল ভাঙ্গা চাল। ধুলো চাল। ময়লা চাল।
ঝাঁট দিয়ে দিয়ে বুড়ি আঁচলে বাঁধে। এ জন্যই অন্ধকার থাকতে-থাকতে চলে আসা। যেটুকু চাল পাওয়া যায়, সেটুকুই লাভ।

সমস্ত চাল জড়ো করে বুড়ি
একটা থলিতে রাখে। তারপর সেই থলি শিব মন্দিরে লুকিয়ে রাখে।
ঘরে ফেরার সময় নিয়ে যাওয়া।

দোকানিরা জানে, দোকান দুয়ার
কে ঝাঁট দেয়। তাই তারা বুড়িকে
দু চার পয়সা দিতে কার্পণ্য করেনা।
তাকে সবাই চাল--বুড়ি বললেও
সে মিষ্টি দোকানেও ঝাঁট দিয়ে থাকে। কিন্তু মিষ্টি দোকান থেকে কোনোদিনই মিষ্টি নেয় না।
কে মিষ্টি খাবে!
পয়সা নিলে নুন-তেলটা হবে।

একদিন বন্ধ মনোহারী দোকানের বাইরে দু-তিন প্যাকেট সাবান পেয়ে যায় বুড়ি। দোকান খুলতেই
দোকানিকে ফেরত দেয় । দোকানি তাকে পাঁচ টাকা দিয়েছিল।
আরেকদিন দেখে একটা ছিঁচকে চোর একটা চাল দোকানের তালা ভাঙছে। বুড়ি এমন চিৎকার করে
কুকুরের দল তেড়ে আসে। চোর পালিয়ে যায়।
বুড়ি দোকানির ঘরে গিয়ে তালা ভাঙার গল্প বলে আসে। তৎক্ষণাৎ তারা দোকানে এসে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়।
সেই চালদোকানি সেদিন বুড়িকে দিয়েছিল দু কেজি চাল।

এই বুড়ি বেলার দিকে ঘরে যায়। চান করার আগে
চাল বাছে। ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে। কাঠকুটো জ্বালিয়ে উনুন ধরায়। রান্না করে।
এই বুড়ির আজ চালের থলি মন্দির থেকে উধাও।
কে নিয়ে গেল? কে নিয়ে গেল?

থলি রেখে সে গিয়েছিল চাল দোকানেই। যদি দু চার মুঠো চাল পরিষ্কার চাল দোকানি দেয়।

চাল দেবে কিন্তু বেলা হলে।
দোকানি বলে, আগে ভালো করে বৈনি--বাটা করতে দে। পরে আসবি------

বুড়ি মন্দিরে যায়।

আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাবে।
শরীরটা ভালো লাগছেনা। কিন্তু চালের থলিটা নেই। বুড়ি চিৎকার করে। কোথাও খুঁজে পায়না। সে চিৎকার করতে করতে কাঁদে।
কে আমার মত হতভাগির চাল
চুরি করে নিয়ে গেলি রে-----
কে?

লোক জড়ো হয়। নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করে। কিন্তু কেউই বুড়িকে এক কেজি চাল কিনে দেবার জন্য তৎপর হয় না। বুড়ি
কেঁদেই চলে। ইনিয়ে বিনিয়ে
কেঁদে চলে।

শিব মন্দিরের চাতালে মাথা ঠুকতে থাকে। বলে, ও বাবা শিব আমি আজ কি খাব বলো?
তুমি খুঁজে দাও আমার চালের থলি। খুঁজে দাও বাবা------
তোমার পূজা করবো আমি।
খুঁজে দাও। তোমার কাছেই তো প্রতিদিন থলি রেখে কত কাজ করি। কোনোদিন চুরি হলো না।
আজ কে নিয়ে গেল?
কোন্ চোর আমার কপাল ভাঙলো?
বাবাগো-------কি হবে আমার?

কাঁদতে কাঁদতে বুড়ির চোখ ফুলে যাচ্ছে। সে এই অবস্থায় দেখতে পেলো, শিব মন্দিরের সিঁড়িতে
তার চালের থলিটা পড়ে আছে।
ফাঁকা।

বুড়ির কাছে আজ পৃথিবীটা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে, এক কালে সব গেছে তার। এ কালেও কী সব যাবে?

গতর খাটিয়েও লোক কী তাকে বাঁচতে দেবে না?
বুড়ি জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।



----২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৭---৬---২০২১
----নির্মল হালদার




ভাষা / নির্মল হালদার

ভাষা

-------------------


----আরে না না কোথাও যাচ্ছি না। গেছলাম ফিরে এসেছি।
----কোথায় গেছলেন? কোথায়?
-----পাহাড়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছলাম। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে উঠছিল না। অবশেষে আজ
দেখা করে এলাম।
----পাহাড় আছে কেমন?
ওর চূড়াটি অক্ষত আছে তো?
----হ্যাঁ।
----শুনেছিলাম একবার নাকি
চূড়াটি হেলে পড়ছিল ঝড়ের তান্ডবে। এক পাখি এসে পাখা দিয়ে আটকে দেয়। চূড়াটি রক্ষা পায়।
-----এই গল্প আমিও শুনেছি।
আপাতত ভালোই তো আছে মনে হলো। যদিও পাহাড়ের গায়ে যে সমস্ত গাছপালা ছিল, এখন অর্ধেক নেই। তাই, একটু ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছিল।

দুই বন্ধুর এই গল্পের মাঝে ভাষা এসে দাঁড়ায়। ভাষা বলতে চায়-----পাহাড়িয়া গ্রামে আমাদের সবারই ঘর হলে চমৎকার হয়। অথবা পাহাড় যদি
এসে তাদের সঙ্গে বসবাস করে।

দুই বন্ধু ভাষার কথা শুনে হাসাহাসি করে। তারা বলে, এত প্রেম রাখবি কোথায়? আমাদের সঙ্গেই তোর প্রেম জমে উঠলো না। পাহাড়ের সঙ্গে জমবে?

ভাষা সরে দাঁড়ালো।

সে অন্বয়কে নিয়ে পথ চলতে চেয়েছিল। অন্বয় চলে গেল উত্তরবঙ্গ। চাকরি নিয়ে। তারপর থেকেই ভাষা শুধু মন খারাপ করে। মন খারাপের রঙ কালো না নীল?

ভাষা হাঁটতে থাকে।

দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের চূড়া। গোধূলির রঙে মোহময় লাগছে। তার মনে হলো, ওই গোধূলির রঙে সে সেজে উঠবে।
মনে হতেই, এই আমলকির মাঠে
আধো আধো আলোয় সে খুলতে লাগলো তার পোশাক। জনশূন্য এই মাঠে কয়েকটি গাছ ছাড়া
তাকে কেউ দেখছে না। সে সম্পূর্ণ খুলে ফেলে হাঁটতে থাকে পাহাড়ের দিকে। যেনবা পাহাড়ের চূড়ায় রাখা আছে গোধূলির যাবতীয় রঙ।

সেই রঙে সেজে উঠবে ভাষা।

ঘরে ফিরছিল গাই গরুর দল। ভাষাকে দেখে তারা থমকে যায়।
তাদের মনে হয়, ভাষা কোনো দেবী।
মানবীর নগ্ন রূপ আগে কখনো দেখেনি তারা। তারা তাদের বিস্ময় ও অনুভূতি থেকে ভাষার প্রতি নত হয়ে ওঠে।
কয়েকটা গাছ ভাষাকে বলে, দ্রুত যাও-------রঙ ফুরিয়ে আসছে।
আজকের মত ফুরিয়ে যাবে।
তুমি চলো। তোমার মত সেজে উঠবে আজ। আমরা আছি তোমার সঙ্গে।

ভাষা দেখতে পেলো, একদল লোক আসছে হইহই করে। সবাই শুনেছে, গ্রামে নাকি অপদেবতার আবির্ভাব হয়েছে। তাই তারা, আগুন জ্বালিয়ে অপদেবতাকে পুড়িয়ে মারবে।

কাছে আসতে না আসতেই, ভিড়ের লোক আর নেই। কোথায় গেল? কি ভয় কার ভয়ে চলে গেল? যদিও ভাষার কোনো ভয়
করছিল না। সে জানে, যে পাহাড়ে যায় গোধূলির কাছে যায়, তার কাছে কোনো লজ্জা মান ভয় থাকতে নেই।

সে প্রথমে পাহাড় তলায় শুরু করল নাচতে। কেননা, তার নগ্ন নৃত্য পাহাড়কে অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করবে।

পাহাড় স্তব্ধ হয়েও আজ আনন্দিত। মনে হচ্ছে, এখনই খুশির বৃষ্টি নামবে।



-----২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
-----৬----৬----২০২১
-----নির্মল হালদার




জানলা / নির্মল হালদার

জানলা

---------------------------
একটা জানলা চাই।
দরজা যেমন আছে থাক। দরজা বন্ধ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু একটা জানলা চাই।


জানলা ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না। রোদ্দুর যে আসছে, জানলা ছাড়া কে দেখাবে! বৃষ্টি যে আসছে
জানলা ছাড়া কে দেখাবে!

বিহু বলে, ওই যে ছাদে নানা রঙের
জামাকাপড় মেলা আছে, জানলাই তো আমাকে দেখায়।
জানলাই তো দেখিয়েছিল, সেই মেয়েটিকে যে পুতুল নিয়ে খেলা করে। বিকেলবেলা।
বিহু বলে, যে ঘরে জানলা নেই
আমার মনে হয় সেই ঘরে হৃদয়টা নেই।
আমি একবার এক আত্মীয়র বাড়িতে গেছি, আমাকে থাকতে হবে একটা রাত। কিন্তু সেই আত্মীয়দের বলতে পারছিনা,
আমার ঘরে জানলা চাই।

বিহু যখন জানলার কথা বলে
তখন তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে হয়, জানালা দিয়েই সে পৃথিবীর সমস্ত কিছু দেখবে।


শীতের দিনেও বিহুর ঘরের জানলা বন্ধ থাকে না। সে সব সময় জানলা দিয়ে আলো-বাতাস অন্ধকার দেখে। দেখে, অনেক দূর থেকে এক পথিক আসছে। যার পায়ে লেগে আছে প্রাচীনকালের ধুলো। দূর থেকেও বিহু বলে দিতে পারে ধুলোর রঙ কি। দূর থেকেও
বিহু বলে দিতে পারে, মেয়েটির চোখে কেন জল।

বিহুর বন্ধুনী শালিক তাকে রসিকতার সঙ্গে বলেছিল, ফুলসজ্জার দিন জানলা খুলে রাখবি তুই। কি মজা।
বিহু ধ্যাৎ বলে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর বলেছিল, জানলাটা আছে বলেই, হেমন্ত শীত বসন্ত টের পাই। আমরা থাকি তো ঘিঞ্জি শহরে। কোলাহল ছাড়া যার কোন প্রকৃতি নেই। তাই
জানলাটা আছে বলে, দেখতে পাই, রাস্তার ধুলোয় খেলছে এক ন্যাংটো শিশু।

সেই সেদিন বিহু ন্যাংটো শিশুর কাছে পৌছে গেছলো। কিনে দিয়েছিল একটা পাউরুটি। কোলেও নিয়েছিল।
এই বিহু জানলা থেকে রাস্তা দেখতে দেখতে বর্ষা দেখতে পায়।
গুন গুন করে ওঠে তার মন। তার ইচ্ছে করে তার বন্ধুনীরা কেউ একজন এসে তাকে রবীন্দ্রনাথের গান শোনাবে।

কেউ আসে না।

সেই মুহূর্তের মধ্যে চলে যায় এক জঙ্গলে। যেখানে এক হরিণ শাবক খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মাকে।
বিহু হরিণ শাবককে কোলে নিয়ে
খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া মাকে। তখন মনে হয়, সত্যি সত্যি জানলা আমাকে কতকিছু দেয়।

বিহুর ঘর দোতলায়।
জানলা দিয়েই
মেঘ ধরতে পারে। তার মনে হয়,
মেঘ মানেইতো চিঠি। তার মা তাকে লিখেছে। মা কেন যে দূর দেশে চাকরি করতে গেল।
বিহুর খুব মন খারাপ করে। বাবাও চাকরি করে দূর এক গ্রামে।
মা-বাবা দুজনেই মাসে একবার বাড়িতে আসে। সারা মাস বিহু আর দিনুদা বাড়িতে।

বিহুর কলেজ শেষ হয়ে গেছে।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেও
সে নিয়মিত ক্লাস করে না। সে
জানলা থেকে দেখে , দূরে এক কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার সঙ্গে কথা বলছে।

কী কথা?

বিহু কান পাতে। শুনতে পায়,
রাধাচূড়া বলছে, গতরাত্রে ঘুম হয়নি তার। কৃষ্ণচূড়া বলছে, এসো আমার কাঁধে মাথা রেখে
ঘুমিয়ে যাও।

বিহু দেখতে পায়, আবর্জনার স্তূপ থেকে কুকুর ও শুয়োর একইসঙ্গে আহার খুঁজছে।

সে কি ডাকতে পারে না তাদের?

বিহুর বাবা বলেছিলেন, বাড়িতে
নতুন রঙ করাবেন। বিহু জানিয়েছিল, তার ঘরে রঙ করলে করতে পারো------জানলায় রঙ করা চলবে না। তার বাবাকে কারণটা জানায়নি। কারণ শুধু তার কাছে,
রঙ করলে, যদি কিছুই না দেখা যায়।

মা বিহু কে চিঠি না লিখলেও
মেঘ এলেই মায়ের চিঠি পড়ে।
মা লেখে-------
বিহু
আশা করি তুমি ভালো আছো।
আমি এই রবিবার বাড়ি যাচ্ছি না।
অফিসের কাজে আটকে যাব।
তোমার বাবা যাবেন। তিনি তোমাকে দিয়ে আসবেন টাকা।

তুমি দিনুদার কথা শুনবে। খাওয়া-দাওয়া করবে নিয়ম মত।

মা কিন্তু কেমন আছে কোনো চিঠিতেই লেখেনা। বিহু জানে,
মায়েরা ভালো থাকে সবসময়।
তাই বোধ হয়, মা তাকে জানলা সহ একটা ঘর দিয়েছে।

এই জানলা--চোখ বিহু পেয়েছে হাসপাতাল থেকে। সে যখন
ক্লাস টেনে পড়ে তার হয়েছিল কঠিন অসুখ। দিনের পর দিন
চলছে চিকিৎসা, অথচ সুস্থ হয়ে উঠছে না। তখন এক সিস্টার
তার বেড সরিয়ে জানলার কাছে করে দিয়েছিলেন। কি আশ্চর্য, কয়েকদিন পর থেকেই বিহু সুস্থতার দিকে যায়। সে প্রথম হাসপাতালের জানলা থেকে দেখে
হাতির পিঠে উঠে আসছে এক বন্ধু। যে বিহুর সঙ্গে কথা বলতেই আসছে। যে জানে, বিহু এই এক মাস ধরে কারো সঙ্গেই কথা বলতে পারেনি।

হাসপাতালের জানলা থেকেই সে দেখেছিল, বট চারার কিরণ। সে দেখেছিল, ফুলের রেণু। সে পেয়েছিল পাকা কুসুমের গন্ধ। সে পেয়েছিল, পায়ের শব্দ।

হ্যাঁ হ্যাঁ-------পায়ের শব্দ। যে শব্দগুলি বিহুর সঙ্গে কথা বলতে আসে। যে শব্দগুলি বিহুর কুশল রচনা করে।

সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে বিহু
মায়ের কাছে আবদার করেছিল,
একটা জানলা।
সেই আবদারের জানলা এখন দিকে দিকে। সর্বত্র। বিহু দেখতে পায়, তার বন্ধুনী শালিক হাতের পাতায় গমের দানা রেখে পায়রাকে খাওয়াচ্ছে।সেও পায়রাদের সঙ্গে একটি একটি করে গম খুঁটছে।

আহারে--------



-----২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৪---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার




গাছবাড়ি / নির্মল হালদার

গাছবাড়ি


জষ্টি মাসের গরম। খুব বিরক্তিকর। এত জ্বালাতন করে যে ঘুম হয় না একদম।

আজ সকাল থেকেই প্যাচপেচে গরম। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গা থেকে। নিজেকে অস্থির লাগছে।
মন বসছে না কিছুতেই।

ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছাতিম।

হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ গেল ছাতিমের। সামনে গিয়ে আয়নায় মুখ দেখে বুঝতে পারলো, মুখে
রাগের চিহ্ন।

না,কোনো রাগের চিহ্ন থাকবে না।
রাগ বা ক্রোধ এলেই হিংসা আসে।
হিংসা ক্ষতিকর। সে মনে মনে স্থির করলো, আজ থেকে ঘরে নিয়ে আসবে নানান গাছ। গাছ যদি ঘরে থাকে, কোনো ক্রোধ ঢুকতে পারবে না মনে। গাছের শক্তি আছে, মনকে শান্ত করার মত। গাছের শক্তি আছে, মনকে শীতল করার মত।

ঘরের ভেতরে গাছ। ফুল ফলের গাছ। ঘরের ভেতরেই গাছের সঙ্গে সহবাস।

আজ যখন ছাতিম বাজারে পুঁই শাক কিনছিল,তার মনে হয়েছিল,
শাকসবজির চাষ ঘরে করলে, মন সবুজ হয়ে থাকে। সে টাটকা সবুজ দেখবে বলেই, প্রতিদিন সবজি বাজারে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন শাক সবজির সঙ্গে কথা বলে। সবজি বিক্রেতাদের সঙ্গে আলাপ জমায়। হয়ত বা সে শুশনি শাক কিনবেনা, তবুও
যে শুশনি শাক বিক্রি করছে, তার সঙ্গে আলাপ করে গল্প করে। একটি মাত্র কারণ, সে শুশনি শাক দেখবে।

যেকোনো সবুজ চোখের শুশ্রূষা।

ছাতিম আজ প্রথমেই বটগাছ নিয়ে এলো। তারপর কুসুম। শাল
পিয়াল। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়াও নিয়ে এলো। আর জায়গা নেই। সে আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে চেষ্টা করতে থাকে, চারটে দেয়াল কে
যদি ঠেলতে ঠেলতে একটু সরানো যায়, জায়গা অনেকটা পাওয়া যাবে। গাছের জায়গা হবে অবশ্যই।

ছাতিম বট গাছের তলায় খানিক ছায়া জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। সে ধীর স্থির হয়ে ঘর থেকেই এক বন্ধু ভোরাইকে ডাকে।

কোনো ডাক শুনতে পায় না কেউ।
চারদিক তো বন্ধ। ছাতিমের মনের অবস্থা দেখে কৃষ্ণচূড়া বলে, অস্থির হয়োনা। দেখবে, সন্ধ্যে হলেই আসবে তিতলি। সন্ধ্যে হলেই আসবে কোজাগরী। আজ সন্ধ্যে হলেই আসবে জোনাকিরা।

এখন তুমি দরজা খোলো। অন্ধকার হয়ে গেছে। প্রতিদিনের মত নতুন নতুন আলোয় বিকশিত তারা তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

ছাতিম প্রশ্ন করে, কি কথা?
কৃষ্ণচূড়া বলে, তা আমি জানবো কি করে! তবে জানি কথা বলবে।

ছাতিম দরজা খুলে দেখে কোজাগরীর হাতে এক গোছা
ধূপ জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়া ও গন্ধে
ছাতিম কোজাগরীর কপালে চুম্বন আঁকে। বলে, এই সন্ধ্যায় তোকে আর ধন্যবাদ দিলাম না।
চল্, প্রতিটি গাছের তলায় একটা করে ধূপ গেঁথে দিই।চল্, আমরা আজ সারারাত গাছের সঙ্গে কাটাবো।
এই তুই আমাকে প্রতিদিন একটা করে গাছ উপহার দিস। আমি
গাছের সৌন্দর্য নিয়ে সুস্থ ও সুন্দর থাকবো।

কোজাগরী জানতে চায়, কি কি গাছ তোর পছন্দ আমাকে বল -----আমি নিশ্চয়ই জোগাড় করবো। তার আগে তোকে কথা দিতে হবে তুই আর অযথা ঘুরে বেড়াবি না। তুই দেখিস নি তোর চেহারাটা কত খারাপ হয়ে গেছে।
কোজাগরী আরো বলে, আমাদের সব বাড়ি গাছবাড়ি হয়ে উঠবে। এরকম স্বপ্নের দিকে আমাদের যাওয়া।

আয়------দুজনের দুঃখ-বেদনা গুলি, রাগ অভিমান গুলি গাছের পাতায় মুছে নিই।

আয়------কান পেতে শুনি
শিকড়ের স্বর।

ছাতিম বলে, জঙ্গল তৈরি করতে
আমরা পারলাম না। কিন্তু ঘরে ঘরে, ঘরের ভিতরে বাইরে গাছ রাখতেই পারি।

গাছের কাছ থেকে শিখবো, উদারতা ও ধৈর্য। গাছের কাছ থেকে শিখবো, ক্ষমা।

ছাতিম ও কোজাগরীর সঙ্গে
আজ ছুটে বেড়ায় জোনাকিরা।



----১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----৩---৬---২০২১
----নির্মল হালদার




পায়ের শব্দ / নির্মল হালদার

পায়ের শব্দ

নির্মল হালদার


আজকের দুপুর টা খুব খারাপ কাটছে আমার। একটা কাক এসেছিল। ফিরিয়ে দিয়েছি।
কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।

একটা পায়রাও এলো।
ফিরিয়ে দিয়েছি। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।

এই অবধি ডাইরিতে লিখে রঙ্গন
উঠে দাঁড়ায়। জল তেষ্টা পাচ্ছে।
গতকাল সন্ধের মত।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ । আসা যাওয়া করছিল বারবার। অথচ কেউ নেই। কেউ এসে দাঁড়িয়ে একবারও বলছিল না, এইতো এসে গেছি।
সে একবার ঘরের ভিতরে ঢুকে
দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। মনে করছিল, যদি কেউ এসে দরজায় টোকা দেয়? যদি ডাকে?

কিছুই কিছু হচ্ছিল না।

সে রাগে বিরক্তিতে নিজেই সিঁড়িতে ওঠানামা করে। পাশাপাশি আরো একজনের পায়ের শব্দ রঙ্গন শুনতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায়।

কার এই পায়ের শব্দ?

পায়ের শব্দ আছে অথচ মানুষটি নেই। কী হচ্ছে?
গতকালের সেই ঘটনা থেকে রঙ্গনের ঘুম হয়নি সারারাত। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেও
রঙ্গন শুনতে পায়, কেউ আসছে।

কে আসছে?

করোতোয়া আর আসবে না কোনোদিন।
সম্পর্কটা একেবারেই চুকেবুকে গেছে।সেও তো অনেকদিন হয়ে গেল। রঙ্গন শুনেছিল, করোতোয়া
কারো সঙ্গেই বেশিদিন সম্পর্ক রাখতে পারেনা। তার স্বভাবে আছে, নতুন নতুন বন্ধু পাতানো।
নতুন নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পথ চলা। রঙ্গনের পক্ষে যা সম্ভব নয়।
সে তার পুরনো সাইকেলটাকে এখনো ত্যাগ করতে পারেনি। লাল গামছাটা ছিঁড়ে গেলেও
যত্ন করে রেখে দিয়েছে। তো এই
রঙ্গনের করোতোয়ার সম্পর্কে
অনুভূতিগুলো থেকে গেছে বলেই,
সে মাঝে মধ্যে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

তখনই চেষ্টা করে ডাইরি লিখতে।

গতকাল লিখেছিল সকাল দিকে।
যখন মেঘ এসেছিল তার সঙ্গে কথা বলতে। অথচ একটা কথাও বলতে পারেনি।

মেঘ কী বলছিল?
এই একটা বাক্যের পর থেমে গিয়েছিল সে।

কখনো কখনো রঙ্গনের ঘরের চারটে দেয়াল তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। দেয়ালগুলো নড়ে চড়ে ওঠে। রঙ্গন টের পেয়েই, বাইরে চলে যায়। ছাদে পায়চারি করে।

করোতোয়ার সঙ্গে এই ছাদেই পায়চারি করতে করতে গল্প করেছে। দুজনে একই সঙ্গে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা চেনার চেষ্টা করেছে। অন্ধকারে ছাদে শুয়েও পড়েছে দুজন।

এই মুহূর্তে জোর গলায় রঙ্গন
একটা হাঁক দেয়: করোতোয়া-----
ইমলি--------

রঙ্গন করোতোয়াকে ইমলি নামেই
আদর করতো। আদরের ধরনটা এইরকম, রঙ্গন করোতোয়ার পিঠে চিমটি কাটতো শুধু। আর
করোতোয়া কেবল বলতো, এই ছাড়ো বলছি ছাড়ো--------

ছেড়েতো দিতেই হলো বরাবরের জন্য। এখন আবার সিঁড়ির শব্দটা আসছে। এই ভর দুপুরে।

শব্দটা কি করতে চায়?
কাকে আক্রমণ করতে চায়?
শব্দটা থেকে কোনো প্রেমের অনুভূতি জেগে উঠছে না। শব্দটা থেকে কোনো আলো উঠে আসছে না। তবে কেন তবে কেন এই সিঁড়ির শব্দ?

রঙ্গন ডাইরিতে লিখলো-------
যদি শব্দটাকে উপরের দিকে
পাঠানো যায়। কেমন হবে?
যদি শব্দটাকে উপর থেকে উপরে
পাঠানো যায়। কেমন হবে? হয়তো দেখা যাবে এই সিঁড়িটাই আকাশে ওঠার সিঁড়ি। হয়তো দেখা যাবে, এই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
কথা বলা যাচ্ছে সূর্য তারার সঙ্গে।

সেদিন করোতোয়া আসবেই।
একমাত্র তাঁর কাছে। কেননা, রঙ্গনকে সে বলেছিল, একটা সূর্য লকেট কিনে দেবার জন্য। রঙ্গন যদি সত্যি সত্যি একটা সূর্য করোতোয়াকে উপহার দিতে পারে?

রঙ্গন মনে মনে স্থির করে, আজ
সন্ধে বেলা পায়ের শব্দ এলেই, তাকে আকাশের দিকে যেতে অনুরোধ করবে।

আকাশটা তখন আকাশে থাকবে তো?



----১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----২---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার




লকডাউন / নির্মল হালদার


লকডাউন//

কালী মন্দির থেকে হরিমন্দির
এই পাড়াতে। প্রতিদিন কোনো না কোনো মন্দিরে পূজারীদের ভিড় লেগে থাকে।

পূজার দ্রব্য সামগ্রীর দোকানও আছে দেদার। নিত্য পূজার জন্য
সারি সারি ফুলের পসরা।
বেল পাতা থেকে পদ্ম ফুল দুববো ঘাস
সবই পাওয়া যায়। বিক্রি করে প্রধানত মহিলারা।
এরা আসে লাগদা রামনগর ধবঘাটা থেকে। ভোরবেলা। এই ফুল ওয়ালি মহিলাদের স্বামীরা
আগে বাজনা বাজাতো। এখন কদর নেই। এখন সমস্ত জায়গায় ডিজে।
সম্প্রদায় হিসেবে এরা ডোম। এদের পদবী কালিন্দী। কেউ কেউ বাদ্যকর লেখে। আগে এরা বাঁশের কাজ করতো। ঝুড়ি ঝাঁটা তৈরি করতো। বাঁশের দাম বেড়ে যেতে সেই বৃত্তিও চলে গেছে।
বর্তমানে এই পুরুষরা বা ফুল ওয়ালিদের স্বামীরা এতটাই অলস বা অকর্মণ্য যে দিনরাত বাংলা খেয়ে পড়ে থাকে। তাই , মহিলাদের ঘরের বাইরে আসতে হয়েছে রোজগারের জন্য।

ফুল বিক্রি করতে গেলেও পুঁজি লাগে। এখন আবার গাঁদা ফুলের বারো মাস চাষ। অনেকেই গ্রামের
দিকে ফুলের চাষ করে। শহর বাজারে এসে এই ফুল ওয়ালিদের কাছে বিক্রি।

গাঁদা ফুল ১০০/টাকা কে জি।

দু কে জি ফুল কিনে যে বিক্রি করবে তার উপায় নেই। ফুল ওয়ালাও ধারে বিক্রি করে না।
ফুল কত টাকা আর বিক্রি হয়
কত লাভ হয় যে পুঁজি হবে ফুল ওয়ালিদের।

ভবানী বলছিল, আমরা শাগে--মাড়ে থাকি।ঝুপড়িতে থাকি হামদের কে দিবেক পুঁজি।
লকের বাগান থেকে বাড়ি থেকে
ফুল চুরিও করি। তা বাদে বিক্রি বাটা। সোভ দিন সমান নাই বিকায় ফুল।সোভ দিনত লক্ষ্মী বার লয়।
রবিবার ত মাছি তাড়াই।

ভবানীর গলায় দুঃখ দারিদ্রের সুর। যেন বা ফুলে পাতায় শিশিরের মতো লেগে আছে। যেন বা দিন আনি দিন খাই------
সংসারে নাই----নাই------নাই। নাই।
ফুলের রঙ ফুলের সুষমা
ভবানীদের দারিদ্র ঘুচাতে পারে না।

ভবানীরা কী দরিদ্র নাকি দারিদ্র্য রেখার নিচে এদের বসবাস?

আজ রবিবার ।

বেলা বাড়ছে চিড়বিড়িয়ে।
ফুল কেনার লোক নেই। তারপরে আবার লকডাউন চলছে। বিশেষ লোকজন বাইরে আসছে না।
বেলা১০ টার মধ্যে দোকান বাজার বন্ধ হয়ে যাবে। রেখাকে
ছুটতে হবে চালের দোকানে। কিন্তু
ফুল বিক্রি হয়েছে মাত্র ২০টাকা।
আর ৩০ টাকা পাবে কোথায়?
২কে জি চাল লাগবেই।

২ কেজি মোটা চালের দাম ৫০ টাকা। রেখা কালিন্দী বা ডোম বুড়ি ছোটন হালদারের দোকান দিকে ছুটলো। চাল কিনতেই হবে। মাড়ে--জলে বাঁচাতেই হবে বেটাবিটিদের।
২০টাকা মাত্র আছে শুনে ছোটন বলে,নাই হবেক বুড়ি। নাই দিব চাল। আর আমি ধারে নাই বিকি।
বুড়ি তত অনুনয় বিনয় করে-----
তুই না দিলে আজ উপাস দিয়ে মরবো
শুন বেটা-------তকে রোজ
ফুল এনে দিব।কিনতে নাই হবেক।তাও হামকে চাল দে।
বাঁচারে বাঁচা--------- হামদের



-----১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
----১---৬---২০২১
-----নির্মল হালদার




কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ