পুকুর আমাদের
সমাজ জীবনের এক প্রধান সদস্য।
-----------------------
পুন্যি পুকুর পুষ্প মালা
কে পূজেরে দুপুরবেলা!
আমি সতী লীলাবতী,
সাত ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী।
হবে পুত্র, মরবে না
ধান সে গোলায় ধরবে না।
পুত্র তুলে স্বামীর কোলে
আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গা জলে।
এই ছড়া বলতে বলতে গ্রাম বাংলার কুমারী মেয়েরা পুণ্যিপুকুর ব্রত পালন করে।
চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে
বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত
এই ব্রত পালন করা হয়।
চৈত্র মাস থেকেই গ্রাম বাংলার নদী নালা পুকুর শুকিয়ে ওঠে। দেখা যায় জলের অভাব। তখনই পুন্যি পুকুর ব্রত।
ছোটবেলায় আমিও দেখেছি,
আমার ছোড়দি' এই ব্রত পালন করতো।
ব্রত পালন করে কি আর হলো?
শহর ও গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে পুকুর। আমাদের শহরেই এক সময় অনেক পুকুর ছিল। বর্তমানে মাত্র কয়েকটি টিঁকে আছে।
পুকুর ও ডোবা বুজিয়ে বহুতল।
শপিং মল। কোথাও কোথাও শিশু উদ্যান।
এসবই ঘটতে থাকে কখনো কখনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেক পরিবার অনেক পাড়া। যাদের পুকুর ছাড়া আর কোনো অবলম্বন নেই। গতি নেই।
আমাদের ঘরের কাছে " পোকা বাঁধ "। আমি নিজে পোকা বাঁধে স্নান করে বড় হয়েছি। গ্রীষ্মকালে কোনো কোনো বছর জল শুকিয়ে গেলে পাশেই পদ্ম বাঁধ। স্নান করতে নেমে গেছি।
আরো একটু বড় হয়ে পোকা বাঁধের ঘাটে বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি সন্ধ্যেবেলা।
পুরুলিয়া শহর থেকে তুলিনে পড়তে গিয়ে পেয়েছি "মাহাত বাঁধ"। " লায়েক বাঁধ "।
সুবর্ণরেখা নদী তো ছিলই।
ছোটোখাটো ডোবা তো ছিলই অনেক। এখন কি আছে আর?
সময় পাল্টাতে পাল্টাতে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যখন ভয় করে-----সমুদ্র বুঝি উধাও হয়ে যাবে।
নদীতে বাঁধ দিতে দিতে বন্ধ করে ফেলছে নদীর উৎসমুখ।
মানুষের সহজ-সাবলীল নিঃশ্বাস
কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমাদের সমাজ জীবনে পুকুরের
এক ভূমিকা আছে। ভূমিকাটি
পার্শ্বচরিত্র নয়। একেবারে প্রধান ভূমিকা।
প্রতিটি মুহূর্তে তাকে চাই।
জল ছাড়া যে অচল জীবন।
পুকুরের স্নানের ঘাট একটি মিলনকেন্দ্র। শুধু কাপড় জামা কাচাকাচি নয় শুধু স্নান নয়। মেয়েদের সুখ-দুঃখ বিনিময়ের এক ঠাঁই।
মেয়েদের চোখের জল পুকুরের জলে মিলেমিশে আটকে যায় শ্যাওলাতে।
কেউ দেখতে পায় না।
পুকুরের আরও ভূমিকা সে সাপ ব্যাঙ নানারকম পোকাকেও বাঁচতে সাহায্য করে। এবং পুকুর পাড়ের ঝোপঝাড়ে প্রজাপতি ফড়িং এসে নিজেদের রসদ খুঁজে নেয়।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে পুকুর সংস্কারের নামে চারদিক ইঁট--পাথর--সিমেন্টে বাঁধানো চলছে। পালিয়ে যাচ্ছে সাপ ব্যাঙ।
মাটির পাড় থাকছে না বলে, সাফ
হয়ে যাচ্ছে ঝোপ-ঝাড়।
ফড়িং আসছে না আর। প্রজাপতি আসছে না আর।
গ্রামে গ্রামে দেখা যায় অনেক পরিবারে কোনো জলের ব্যবস্থা নেই। তাদের ভরসা একমাত্র পুকুর। প্রাতঃকৃত্য থেকে স্নান কাচাকাচি তো আছেই। তার সঙ্গে বাসনপত্র ধোওয়াধুয়িও পুকুরে।
আমাদের সমাজ জীবনে পুকুর এক সদস্য। যে সর্বদাই উপকার করে । যে পুকুরকে অবহেলা অবজ্ঞা করে মানুষের বিপদ ডেকে আনছি।
আমাদের পুরুলিয়া জেলায়
একটা শ্রেণি ছিল যারা "মুদি "
সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। যাদের কাজ ছিল পুকুর খননের। যারা জানতো কোন্ মাটিতে কোথায় পুকুর খুঁড়লে পুকুরের জল বিশুদ্ধ থাকবে। এবং বয়ে যাবে না জল। এ বিষয়ে অর্থাৎ পুকুর নিয়ে কাজ করেছেন দিল্লী নিবাসী অনুপম মিশ্র। তাঁর বই আছে পুকুর সংক্রান্ত। আমি তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে অন্য কোনোদিন লিখবো। এখন আরেকটা কথা জানাই, যে মুদি সম্প্রদায় পুরুলিয়াতে পুকুর খনন বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিল, তারা আজ কী করছে, কোথায় , আমরা খোঁজ করি না।
আমার ছোটবেলায় " পোকা বাঁধ "
ছিল বলেই, পুকুরের মর্ম বুঝেছি।
আর "সাহেব বাঁধ "ছিল বলে জেনেছি, পুকুরের জল খাওয়া যায়।
পুকুর না থাকলে গাই-গরুর গা
ধোয়াবে কোথায়? কাড়াকে তো
এক বেলা স্নান করাতেই হবে।
গাই--গরুর দল মাঠে চরে বেড়াতে বেড়াতে পুকুর বা ডোবাতে জল খেতে নামে।
এ ছবি তো নিত্যদিনের। এই বাংলায়।
কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারিনা পুকুরের উজ্জ্বল ভূমিকা।
সেই ভূমিকাকে উজ্জ্বল ও নির্মল করার জন্য মহামান্য সরকার এগিয়ে এলে ধুঁকতে থাকা বাঁধ ও ডোবা গুলি বাঁচবে। বেঁচে উঠবে
গ্রামের পর গ্রাম। শহরের বস্তি অঞ্চল। বিভিন্ন পাড়া।
পুকুরেই তো পদ্মের শোভা। শালুকের ফুটে ওঠা রঙ। পানা ফুলের গৌরব।
পুকুরেই তো দেখা হবে নন্দ জেলের সঙ্গে। ভোররাতে এসেছে মাছ ধরতে। তার মাছধরা জালে ঢুকে পড়ছে প্রথম সূর্যের কিরণ।
------ ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------১৮ ----৫----২০২২
-------নির্মল হালদার
এই লেখার জন্য আমাকে সহযোগিতা করেছেন হিন্দিভাষী কবি শ্যাম অবিনাশ । এবং দুর্গা দত্ত।
ছবি : অভিজিৎ মাজী।





















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন