পাহাড়তলীর নির্জনতা
----------------------------
কোনো কোনো নির্জনতাও বিষ হয়ে ওঠে। আমার ভয় করে। কাছে যেতেও ভয় করে।
আমি মিলনের সঙ্গে থাকি।
মিলন একদিন কাঁসাইয়ের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মুখোমুখি দেখা হতেই সে আমার কাছে জানতে চাইলো----কিসের খোঁজ কার খোঁজ করছি আমি?
আমি চুপচাপ থাকি। সে আবারও জানতে চায়----কার খোঁজ কিসের খোঁজ করছি?
এবারে আমি বলি, আমাকে বলতেই হয়-----নির্জনতার খোঁজ করছি।
মিলন বলে, এই তো নির্জনতা। নদীর দুপারে কেউ কোথাও নেই। শুধু শান্ত গাছপালা। এখানেও কি নির্জনতা খুঁজে পাও না?
আমি জানাই, না খুঁজে পাই না। এখানে এসেও আমার একা লাগছে খুব। এই কথা শুনে সে আমাকে নিয়ে যায় সুজানডি। অসিতের কাছে।
অসিত আমাকে দেখে খাবারের ব্যবস্থা করে। আমি বললাম, আমি খাবো না ভাই। মিলন বলে, খেতে তো হবেই।
নির্জনতা কোথায়?
অসিতের আরেক বন্ধু সুজল এসে আমাকে বলে------চলো আমাদের ঘর। পেঁড়রা।
আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, পাহাড় আছে নির্জনতা আছে?
সে উত্তরে জানালো-----বাঁধ আছে। অনেক তালগাছ খেজুর গাছ আছে। আর আছে ফাঁকা ফাঁকা মাঠ।
আমি হতাশ হয়ে বললাম, নারে আমি যাবো না।
আসলে কোথাও যাওয়ার নেই। কোথাও ফেরার নেই। শুধু মন হু হু করে ওঠে।
নেই নেই কেউ কোথাও নেই।
মনে পড়ে, বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মশানে। কোনো এক দিদি আমাকে বললো-----
যা প্রণাম কর।
বাবার সেই শীতল পা দুটি ছুঁয়ে আমি প্রণাম করলাম। এখন মনে হয়, ওই শীতল পা দুটি আমার চির জীবনের নির্জনতা।
বাপি আমাকে প্রস্তাব দেয়,
চলুন ,ফুটিয়ারি যাই। একটা রাত কাটিয়ে এলেও ভালো লাগবে আপনার।
যেতে ইচ্ছে করছে না।
আমার ঘুম আসছে ঘুম।
আমার মনে পড়ছে অবনী ও লাল্টুকে। আমার মনে পড়ছে সীমার মুখ।
সুবর্ণরেখা।
আমার মনে পড়ছে অতনু সজল।
আমার মনে পড়ছে অভি রাধা পীযুষ।
আমার মনে পড়ছে পরিমল। আমার মনে পড়ছে হরি।
কেউ নেই।
আমার একটা রেললাইন ছিল।
এবড়ো খেবড়ো রাস্তা ছিল।
আমার একটা বাদামের ক্ষেত ছিল।
নব কল্লোলের পাতায়
আশাপূর্ণা দেবী ছিল। আজ
কেউ কোথাও নেই। শুধু একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়তলির দিকে।
পাহাড়ের তলায় অনেক ফুল গাছ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মত সারাদিন খেলা করে।
অভিজিৎ বলছিল----যাবেন তো চলুন একদিন। উত্তম কাছেই থাকে, তাকেও আমরা সঙ্গী করবো।
যদি পাহাড়তলির নির্জনতাকে
আমি ভালবাসতে না পারি? যদি সেই নির্জনতা আমার মায়ের মুখ না হয়?
প্রতিদিন ভাতের মুঠো আমার নির্জনতা হলে আমি কি খুঁজে পাবো স্নেহের বন্ধন? আশীর্বাদের ছায়া?
আমার ছোট পিসি আমার বড় পিসি আমার কিঙ্করদা কোথায় যে গেল?
জলে স্থলে কাউকে কোথাও খুঁজে পাইনা। মাটিতে মাথা খুঁড়েও কাউকে কোথাও খুঁজে পাইনা।
কিরাত এসে আমার হাত ধরেছে। তাকেও বলতে পারি না, বুলির খোঁজ কেউ করে না। মুন্নিকে মনে পড়ে। ঝুমুর ও ঝিলমকে মনে পড়ে।
না, আমি নির্জনতার কাছে যাবো না। নির্জন ফুলগুলি যদি বিষ হয়ে ওঠে? যদি ওই নির্জনতা আমাকে গিলতে আসে?
আমি বরং মায়ের শাড়ির পাড় ধরে ধরে হেঁটে যাবো । কোথায় যাবো জানি না।
যদি দেখতে পাই এক বালক
নদী থেকে গামছায় মাছ ধরছে, তার কাছে যাবো।
সেই তো আমার পালক।
আমার নির্জন সুন্দর।
সেই তো আমাকে লালন করে।
আমি কত কত বড় হয়ে গেলাম।
আমার বয়স আমি জানি না।
পালকও জানে না বলে, তার দূরের পাহাড়কে জিজ্ঞেস করেছিল-----আমার বয়স কত?
পাহাড় নীরব ছিল। নির্জন হয়ে ছিল। পালক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। এবং তখনই জানতে চাইলো-----তার জন্য কি নিয়ে এসেছি?
কিছুই নিয়ে আসিনি কারোর জন্য। আমার হাতের হিজিবিজি রেখা থেকে ছিটকে ছিটকে যায় আমার আমলকী।
তারপরও আমি দাঁড়িয়ে থাকি আমলকীর ছায়ায়। আমাকে শান্ত হয়ে ডাকতে হবে আমার ভালবাসাকে।
ভালোবাসা কী গো?
ভালোবাসা যদি পালকের চওড়া কপালে পড়ে থাকা চুল হয়?
ভালোবাসা যদি রঞ্জনের হাতের মুঠি হয়?
ভালোবাসা যদি ভালোবাসার পিঠের চুল হয়?
ভালোবাসার অর্থই হলো নির্জনতা। আর নির্জনতা যদি চিরুনির দাঁড়ের ফাঁক হয়?
আমি আটকে যাবো।
ছটফট করতে করতে কাকে ডাকবো আমাকে উদ্ধার করতে?
কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই।
-------১৫ আষাঢ় ১৪২৯
------৩০----৬----২০২২
------নির্মল হালদার
ছবি : অভিজিৎ মাজী









কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন