বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২

পাহাড়তলীর নির্জনতা



পাহাড়তলীর নির্জনতা
----------------------------

কোনো কোনো নির্জনতাও বিষ হয়ে ওঠে। আমার ভয় করে। কাছে যেতেও ভয় করে।

আমি মিলনের সঙ্গে থাকি।

মিলন একদিন কাঁসাইয়ের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মুখোমুখি দেখা হতেই সে আমার কাছে জানতে চাইলো----কিসের খোঁজ কার খোঁজ করছি আমি?
আমি চুপচাপ থাকি। সে আবারও জানতে চায়----কার খোঁজ কিসের খোঁজ করছি? 
এবারে আমি বলি, আমাকে বলতেই হয়-----নির্জনতার খোঁজ করছি।
মিলন বলে, এই তো নির্জনতা। নদীর দুপারে কেউ কোথাও নেই। শুধু শান্ত গাছপালা। এখানেও কি নির্জনতা খুঁজে পাও না?

আমি জানাই, না খুঁজে পাই না। এখানে এসেও আমার একা লাগছে খুব। এই কথা শুনে সে আমাকে নিয়ে যায় সুজানডি। অসিতের কাছে।

অসিত আমাকে দেখে খাবারের ব্যবস্থা করে। আমি বললাম, আমি খাবো না ভাই। মিলন বলে, খেতে তো হবেই।

নির্জনতা কোথায়?

অসিতের আরেক বন্ধু সুজল এসে আমাকে বলে------চলো আমাদের ঘর। পেঁড়রা।
আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, পাহাড় আছে নির্জনতা আছে?
সে উত্তরে জানালো-----বাঁধ আছে। অনেক তালগাছ খেজুর গাছ আছে। আর আছে ফাঁকা ফাঁকা মাঠ।

আমি হতাশ হয়ে বললাম, নারে আমি যাবো না।

আসলে কোথাও যাওয়ার নেই। কোথাও ফেরার নেই। শুধু মন হু হু করে ওঠে।

নেই নেই কেউ কোথাও নেই।

মনে পড়ে, বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মশানে। কোনো এক দিদি আমাকে বললো-----
যা প্রণাম কর।

বাবার সেই শীতল পা দুটি ছুঁয়ে আমি প্রণাম করলাম। এখন মনে হয়, ওই শীতল পা দুটি আমার চির জীবনের নির্জনতা।

বাপি আমাকে প্রস্তাব দেয়,
চলুন ,ফুটিয়ারি যাই। একটা রাত কাটিয়ে এলেও ভালো লাগবে আপনার।

যেতে ইচ্ছে করছে না।

আমার ঘুম আসছে ঘুম।
আমার মনে পড়ছে অবনী ও লাল্টুকে। আমার মনে পড়ছে সীমার মুখ।

সুবর্ণরেখা।

আমার মনে পড়ছে অতনু সজল।
আমার মনে পড়ছে অভি রাধা পীযুষ।
আমার মনে পড়ছে পরিমল। আমার মনে পড়ছে হরি।

কেউ নেই।

আমার একটা রেললাইন ছিল।
এবড়ো খেবড়ো রাস্তা ছিল।
আমার একটা বাদামের ক্ষেত ছিল।
নব কল্লোলের পাতায়
আশাপূর্ণা দেবী ছিল। আজ
কেউ কোথাও নেই। শুধু একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়তলির দিকে।

পাহাড়ের তলায় অনেক ফুল গাছ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মত সারাদিন খেলা করে।

অভিজিৎ বলছিল----যাবেন তো চলুন একদিন। উত্তম কাছেই থাকে, তাকেও আমরা সঙ্গী করবো।

যদি পাহাড়তলির নির্জনতাকে
আমি ভালবাসতে না পারি? যদি সেই নির্জনতা আমার মায়ের মুখ না হয়?

প্রতিদিন ভাতের মুঠো আমার নির্জনতা হলে আমি কি খুঁজে পাবো স্নেহের বন্ধন? আশীর্বাদের ছায়া?

আমার ছোট পিসি আমার বড় পিসি আমার কিঙ্করদা কোথায় যে গেল?

জলে স্থলে কাউকে কোথাও খুঁজে পাইনা। মাটিতে মাথা খুঁড়েও কাউকে কোথাও খুঁজে পাইনা।

কিরাত এসে আমার হাত ধরেছে। তাকেও বলতে পারি না, বুলির খোঁজ কেউ করে না। মুন্নিকে মনে পড়ে। ঝুমুর ও ঝিলমকে মনে পড়ে।

না, আমি নির্জনতার কাছে যাবো না। নির্জন ফুলগুলি যদি বিষ হয়ে ওঠে? যদি ওই নির্জনতা আমাকে গিলতে আসে?

আমি বরং  মায়ের শাড়ির পাড় ধরে ধরে হেঁটে যাবো । কোথায় যাবো জানি না।
যদি দেখতে পাই এক বালক
নদী থেকে গামছায় মাছ ধরছে, তার কাছে যাবো।

সেই তো আমার পালক।

আমার নির্জন সুন্দর।

সেই তো আমাকে লালন করে।
আমি কত কত বড় হয়ে গেলাম।
আমার বয়স আমি জানি না।
পালকও জানে না বলে, তার দূরের পাহাড়কে জিজ্ঞেস করেছিল-----আমার বয়স কত?

পাহাড় নীরব ছিল। নির্জন হয়ে ছিল। পালক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। এবং তখনই জানতে চাইলো-----তার জন্য কি নিয়ে এসেছি?

কিছুই নিয়ে আসিনি কারোর জন্য। আমার হাতের হিজিবিজি রেখা থেকে ছিটকে ছিটকে যায় আমার আমলকী।

তারপরও আমি দাঁড়িয়ে থাকি আমলকীর ছায়ায়। আমাকে শান্ত হয়ে ডাকতে হবে আমার ভালবাসাকে।

ভালোবাসা কী গো?

ভালোবাসা যদি পালকের চওড়া কপালে পড়ে থাকা চুল হয়?
ভালোবাসা যদি রঞ্জনের হাতের মুঠি হয়?
ভালোবাসা যদি ভালোবাসার পিঠের চুল হয়?

ভালোবাসার অর্থই হলো নির্জনতা। আর নির্জনতা যদি চিরুনির দাঁড়ের ফাঁক হয়?

আমি আটকে যাবো।

ছটফট করতে করতে কাকে ডাকবো আমাকে উদ্ধার করতে?

কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই।


-------১৫ আষাঢ় ১৪২৯
------৩০----৬----২০২২
------নির্মল হালদার










ছবি : অভিজিৎ মাজী














বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

হরিতকীর গর্ভের আলোয়





বসুমতী
-----------

এক ছেলে এক মেয়ে
আমাকে না দিলে না দাও
সিদপুরের মা তুমি আমাকে দাও
একটু ঠাঁই

পেঁপে গাছ দাঁড়িয়ে থাকার মত

একটু ঠাঁই।

আমার পায়ের তলায় ঘাম জমলে
আমি রঞ্জনকে খুঁজে পাবো
দুজনে একসঙ্গে লাগাবো
রক্তকরবীর আলো

আমাদের বসুমতী আমাদের নন্দিনী।


------৮ আষাঢ় ১৪২৯
------২৩----৬----২০২২




রঞ্জন
আজ সকালে এই সকালে
তোর উদ্দেশ্যে লেখা আমার একটি কবিতা তোকে উপহার দিলাম।

তুই গ্রহণ করলে আমি ধন্য হবো।




তির
------
ধনুকে লাগানো আছে তির
সেই ভয়ে পাখিরা গাছের ডালে নেই।
তিরের মুখ ছুঁচলো মুখ
প্রেমের মতই তীব্র

সে খুঁজছে রাঙা চরণ।


চারদিকেই চাষাড়ে পা, ফাটা পা
চারা ফেলার মরশুম, বৃষ্টি নেই
মাটি ফেটে গেছে
কিরাতের গেঞ্জির মতই।




জগতের আলো
----------------------

অশ্বিনী অশ্বিনী
আমাকে সাড়া দেয় শাল গাছ।
অসিত অসিত
আমাকে সাড়া দেয় কুসুম।

ফিরোজ ফিরোজ
সাড়া নেই শব্দ নেই
বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে
সে আকাশ থেকে চিনে নেয়,

নতুন পড়ার জগত।




পুটুশ
-------
রক্তকরবী নেই

পুটুশ ফুল আছে
গ্রামের মতোই গরীব ফুল
আদাড়েবাদাড়ে জন্মায়
যেখানে সেখানে বেড়ে ওঠে।

কারোর পূজায় লাগে না।

খোঁপাতে গুঁজে না মেয়েরা।

মেয়ে আর কে আছে
শুধু আমার মা
আমার মায়ের মতোই
দুখিনী পুটুশ ফুল।


------৮ আষাঢ় ১৪২৯
-------২৩---৬---২০২২




বীজ
-------
দু কেজি ধানের বীজ একশো নব্বই টাকা

বীজ মানেই তো বড়লোক
প্রভাসের বাবার মতই
রুখু মাটিতেও ধান ফলায়

বীজ মানেই তো পশুপতি
ধান নাহলেও জানায় -----
আমার আছে তিনটে ব্যাটা

আমি বড়লোক নই গরিব লোক নই
আমি কুল পলাশের গায়ে
লাক্ষা পোকা।




শিশু
------
শিশু গাছ আমাকে দেখালি

তেজপাতার গাছ দেখাতে না পেরে
আমাকে ভালোবাসা দেখালি

আমাকে দেখালি ডিমে তা দিয়ে
মুরগি ওড়ালো আকাশ।




গরু ঘুরাতে
---------------

অশ্বিনী কাজের শহরে গেলে
কে চরাবে গরু?
হাঁসেরা আপন পথে চলে যাবে পুকুরে
মুরগি লাফাবে উঠানে

আমি যদি যাই গরু ঘোরাতে?

বাছুরের ভাগের দুধ চুরি করবো না।


-------৯ আষাঢ় ১৪২৯
------২৪----৬----২০২২



পায়রার টং
---------------
একটা বাথান পেলে
ধন--মান চাইবো না কিছুই।
একটা মুটরুডি পেলে একটা নদী পাবো।

আর কি চাই!

একটা পিঁড়রা পেলে পায়রার টং

যত ইচ্ছে লুকানো যাবে রাগ অভিমান।




কোদাল--কলম
---------------------

পশুপতির কাছে চেয়েছিলাম
একটা কোদাল।
সে আমাকে দিয়েছে একটা ছেলে।
পশুপতির কাছে চেয়েছিলাম
একটা গাঁইতি।
সে আমাকে দিয়েছে একটা ছেলে।

এই ছেলেটাই কিরাত।

কলম হয়ে আমাকে লেখে
মাটির পাতায়।


-------১০ আষাঢ় ১৪২৯
-------২৫----৬----২০২২



নিসর্গ প্রকৃতি
------------------

মায়ের কোনো নাম থাকেনা
যে কোনো মা মনজুড়া।
নদীর কোনো নাম থাকে না
যে কোনো নদী মন জুড়া।

যে কোনো নিসর্গ প্রকৃতি
আমাদের লীলাবতী
তাল আঁঠি থেকে মন নিংড়ায়।




আর্তি
--------

লীলাবতী গো, একটু জল দেবে?

সারাদিন খাঁ খাঁ করছে পেট।

লীলাবতী গো, জল যদি না দাও
দুটো কথা দেবে?
রুখাশুখা হলেও ক্ষতি নেই আমার

নদীর সঙ্গে দেখা হলে ভিজিয়ে নিতে পারবো।


---------১২ আষাঢ় ১৪২৯
--------২৭----৬----২০২২



আমি একা নই
---------------------

দুয়ারে দাঁড়াতেই,
পরীক্ষিৎ আমাকে দিলো এক আঁটি খড়।
এক আঁটি খড় নিয়ে আমি কি করবো!
আমি ফিরিয়ে দিতেই,
পরীক্ষিৎ আমাকে দিলো একটা গরু।
আমি ফিরিয়ে দিতেই,
পরীক্ষিৎ আমাকে দিলো এক মুঠি চাল।

এবার আমাকে বলতেই হলো,
শুধু চাল নিয়ে আমি কি করবো!
আমার চাই , একটা পায়রা

আমি আহার করবো পায়রার সঙ্গে।




ডাকাকেঁদু
-------------

কি দিতে দিতে কি দিয়ে গেলি আমাকে
আমি তো চাইছি ডাকাকেঁদু।
ডাকাকেঁদু একটি গ্রাম হলেও
ডাকাকেঁদু চোরকাঁটা।

হাঁটতে গেলেই চোরকাঁটা লাগে।

কাঁটা তুলতে তুলতে আমার বেলা বয়ে যায়।

আমার দেখা হয় না ডাকাকেঁদু।

কি দিতে দিতে কি দিয়ে গেলি আমাকে
আমি তো চাইছি জনারের ক্ষেত।
জনারের দানায় দানায় জমে আছে
প্রাচীনকালের দুধ।
আকাশ বাতাসের দুধ

আমি শুধু দেখবো।


------১৪ আষাঢ় ১৪২৯
-----২৯ ---৬----২০২২
------নির্মল হালদার



ছবি : দীপ্তিশিখা দাস









হরিতকীর গর্ভের আলোয়




কিরাত
----------

কিরাত
তুমি পাখির প্রেমিক হলে
তিরের ডগায় লটকে যাবে বৃষ্টির বিন্দু।
কিরাত
তুমি তো জানো,
যেকোনো পায়ের তলায় থাকে পথ
তুমি পথের প্রেমিক হলে

ঘরে ফেরার পথ পাবে সবাই।

কিরাত
তুমি সামনে না থাকলেও
তোমাকে দেখতে পাই
তোমাকে একটুও ভয় না করে বলতে পারি,
লাঙ্গল টা ধরো অথবা আজকেইতো

ধানের চারা ফেলবো দুজনে।



হরিতকী
-----------

তুই জেগে উঠলেই,
পাখিরা ডেকে উঠবে।
তুইতো কিরাত না, তুই কল্যাণ।

তোর সঙ্গেই ছোটবেলা থেকে
জঙ্গলের ডাক শুনছি।
তোর সঙ্গেই ছোটবেলা থেকে,

পশুপাখিদের পায়ের ছাপ চিনেছি।

তুই জেগে উঠলেই, শিকড়ের ডাক।

আমি দেখতে পাবো, হরিতকী ফল।


-------১ আষাঢ় ১৪২৯
------১৬----৬-----২০২২




তিন কন্যা
-------------

তোর বাবা বলেছিল,
হরিতকী বহেড়া আমলকি
তিন কন্যার মতো।
তিনজনকেই একসঙ্গে ঘরে রাখলে
জ্বালাতন করবে না।

আমিও তোর সঙ্গে গাছ চিনতে চিনতে
এই জঙ্গল থেকে ওই জঙ্গল
একটি কন্যাকেও কাছে পেলাম না।


তোর বাবা বলেছিল,
হরিতকী বহেড়া আমলকি নিরাময় করে



আমলকি
-------------

পাহাড়ে উঠতে উঠতে
আমার জলতেষ্টা পেয়েছিল।
গাছ থেকে আমলকি পেড়ে
তুই আমাকে দিয়েছিলি।

আর তুই আমলকির ছায়া কুড়িয়ে
সারা রাস্তায় ছায়া ছড়াতে ছড়াতে
পাহাড়ে ওঠা।
রোদ লাগছিলনা গায়ে।

কবেকার সেই কথা
আমলকি মুখেই আছে, আরেকটা আমলকি 
আমার মুঠোয়

আমি হাঁটছি।




ডিম
------

গাছে উঠেছি।

পাখির বাসায় দেখতে পেলাম
ভাই বোনের মত দুটি ডিম।

তোর ইচ্ছে হলো ঘরে নিয়ে যাবি।

এইতো এদের ঘর, আমি বলেছি।
এখানে এসেই দেখে যাবো,
ফুটে উঠছে ভাইবোনের ভালোবাসা।




শাল গাছ
-------------

জঙ্গল শেষ হয়ে গেলেও
তুই শালগাছ হয়ে উঠবি।
তোর কাঁধে উঠে  ভানু পাড়তে গিয়ে
কানু পাড়বো।


--------২ আষাঢ় ১৪২৯
-------১৭----৬----২০২২



স্বর
-----

বাথানে এক ঠাকুমা আছে।

তোদের গ্রামে কে কে আছে?

তোদের উঠোনে সজনে গাছ থাকলে
আমাকে কি দিবি শুঁয়োপোকা  না প্রজাপতি?
পায়রার নাচ অনেকদিন দেখিনাই
আমাকে দেখাবি?

বাথানের পাহাড় আমাকে শোনায় গাছপালার স্বর।

তোর কণ্ঠস্বরে কে আছে আমাকে দেখাবি?




তেঁতুল কেঁদ অর্জুন
-------------------------

পাথরাবেড়া পানিপাথর লুশাবেড়া
আমাকে দেবে না কেউ।
বাদুড় ঝোলা তেঁতুল গাছ আমার কি জুটবে?

বাদুড় ও এক অন্ধকার কে বলেছিল?

শুকনো অর্জুন ফল ঝুমঝুমি হয়ে বাজে
এক সকালে শুনেছি, আরেক  সকালে
ব্যাঙ এসেছিল।

আমি বলেছিলাম, ছাতা লাগবে না আমার।

আমি চাই জঙ্গলের পথ

গাধাকে ফিরিয়ে দেবো জঙ্গলের আলো ছায়ায়

গাছে গাছে কেঁদ পেকেছে।




কাঁটা
-------

কইরে কিরাত
তোদের গাঁ নিয়ে যাবিনা?
কত কত গাঁ গেলাম
পিঁড়রা চাকিরবন সুজানডি।


তোদের গাঁ নিয়ে যাবিনা?

তোদের গাঁ কতদূর?

বাস চলে? হেঁটে যেতে হয়?

রাস্তায় বট গাছের ছায়া আছে তো?
বাবলা গাছের ছায়া থাকলে
কাঁটা কাঁটা ছায়া

কিরাতরে ,দাঁত দিয়ে তুলতে পারবি কাঁটা?


--------৩ আষাঢ় ১৪২৯
---------১৮----৬----২০২২



হরিতকীর গর্ভের আলোতে
------------------------------------

বুনো তুলসিও শান্ত খুব
আমার ঘরে গেলে ঝিমিয়ে  পড়বে।
যেমন আছে থাক
যজ্ঞি ডুমুরের পাশে থাক।

মেঘে রোদে  থাকতে থাকতে
ফেটে পড়া ডুমুরের বীজ কোলে টেনে
আদর করবে।
আদরে আদরে ঝলমল করবে ডুমুরের পাতা।

আমি আর আদর করবো কাকে?

পাকা ডুমুর গিলে ফেলছে বাঁদর।

তুইও তুলসির পাতা ছিঁড়ে মুখে পুরলি।

আমার বুকে ঢুকে পড়লো বনের হাওয়া।




জনার
--------

কাল রাতের জনার সেদ্ধ আজ সকালে।

জনার পোড়াতে চুলা জ্বলেনি
আজ সকালে ।

জনারের মাথার চুল টেনে ধরলেও
জনারের কান্না শুনতে পাবো না, শুধু
জনারের পুরুষ্ট রসে মুখ ডুবিয়ে চলে যাবে রোদ।

তুই ছাগল তাড়াবি।


-------৪ আষাঢ় ১৪২৯
-------১৯-----৬-----২০২২




ডাকাকেঁদু
--------------

একটা গাছ ছুঁতে যতটুকু সময় লাগে
ততটুকু সময় লাগবে ডাকাকেঁদু যেতে।
কোনো রাস্তা নেই শুধু আলপথ।

আর একটা বন আছে মাটি খুঁড়লেই বুনো ওল
কন্দ মূল, শিকড়ের আত্মীয়তা আর আছে
ঝরা পালক শুকনো পাতা

ভাঙ্গা ডিমের হাহাকার।

গভীর না হলেও বনের লতা পাতা
জড়িয়ে পড়ে গায়ে, পায়ে লাগে সাপের খোলস
গাছের ছালের মত।

গাছে বেদনাও ঝুলে থাকে লাল লাল

নাম জানিনা।




ব্যথা বেদনা
----------------

পুঁটি মাছের চচ্চড়ি
সজনে শাক
ডাল থাকবে না

তোর গায়ের গন্ধটা মেখেই এক থালা ভাত

ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত কার ঘরে?

একদিন তো ঢেঁকির গর্ত থেকে উঠে এসেছিল
গুমরে ওঠা ব্যথা

সেই ব্যথা কি তোর মায়ের কাছে?

আমি দেখতে চাইবো।


-------৫ আষাঢ় ১৪২৯
------২০----৬----২০২২




আলপথ
------------

একটা আলপথ চাইবো?

আলপথ থেকে আলপথ
ফসলের হাওয়া
পায়ে লাগবে কাদা

একটা আলপথ দেবেনা?

ধন তো অনেক আছে
দুই সন্তানের পিতা
একটা গ্রাম

সরু হাসির মতই,

আমাকে একটা আলপথ দেবেনা?



দারুচিনি
------------

লবঙ্গ চিনতে হলে কার কাছে যাবো?
এলাচ চিনতে হলে কার কাছে যাবো?
গোলমরিচ চিনতে হলে কার কাছে যাবো?

চাঁদ সওদাগর অনেক দূর

অনেক কাছে তুই, তুই আমাকে জড়িয়ে ধরলেই,

দারুচিনি গাছ।


-------৬ আষাঢ় ১৪২৯
-------২১----৬-----২০২২



আলপথ
------------

একটা আলপথ চাইবো?

আলপথ থেকে আলপথ
ফসলের হাওয়া
পায়ে লাগবে কাদা

একটা আলপথ দেবেনা?

ধন তো অনেক আছে
দুই সন্তানের পিতা
একটা গ্রাম

সরু হাসির মতই,

আমাকে একটা আলপথ দেবেনা?



দারুচিনি
-------------

লবঙ্গ চিনতে হলে কার কাছে যাবো?
এলাচ চিনতে হলে কার কাছে যাবো?
গোলমরিচ চিনতে হলে কার কাছে যাবো?

চাঁদ সওদাগর অনেক দূর

অনেক কাছে তুই, তুই আমাকে জড়িয়ে ধরলেই,

দারুচিনি গাছ।

-------৬ আষাঢ় ১৪২৯
-------২১----৬-----২০২২




বীজের সঙ্গে
-----------------

তোর বাবার তিনটে ছেলে
তার মধ্যে তুই একজন।
তোকে আমার কাছে দিয়ে দিলে
আমি যতন করে রাখবো।

তোর মা চুলাতে শুকনো পাত গুঁজতে গুঁজতে
আমাকে বলবে কি, চাইতে হলে অন্য কিছু চাও----আমার ছেলে লক্ষ্মী বড়
ঘরেই থাকবে।

তোর বাবাও বলবে মনে হয়,
আমার তিনটে ছেলে, একজন রুইবে ধান
একজন বাঁধবে আল, আরেকজন
ঘরে নিয়ে যাবে।

তোর বাবাও বলবে মনে হয়,
চাইতে হলে অন্য কিছু চাও।
কী যে চাইব আমি, আমি আমাকেই
রেখে যাচ্ছি তোমাদের কাছে

যদি বছর দিনের বীজের সঙ্গে রাখতে পারো।




একটি গ্রাম
---------------

বাথান নামে একটি গ্রাম হাত পেতে চাইছি

একদিন শরবেড়িয়া চেয়েছিলাম।
আরেকদিন হুড়রা চেয়েছিলাম।
আজ হাঁটু গেড়ে চাইছি ডাকা কেঁদু।

মেঘ দুইলে জল পাবো।

পুকুর থেকে মাছ ওঠে
নদী থেকে মাছ ওঠে
আমি দু হাতে ধরবো নক্ষত্র

একটি গ্রামের একটি নক্ষত্র

ধুলো উড়িয়ে হাসে।




ধনী
------

পশুপতি মাহাত ধনী হলেও
আমার চেয়ে ধনী নয়।

আমার যে কিছুই নেই।

পশুপতি মাহাত পিতা হলেও
আমিও পিতা

আমার একটি সন্তানও নেই।



------৭ আষাঢ় ১৪২৯
------২২----৬-----২০২২
------নির্মল হালদার








শ্যাওলাকে ধরতে গেলে আবেগ থাকে না

শ্যাওলাকে ধরতে গেলে আবেগ থাকে না
--------------------------------------------------


কী যে লিখবো!

খুব গরম করছে এই কথা  লেখারও কোনো অর্থ নেই। খুব ঠান্ডা লাগলে বেশ লাগতো এখন,
এই কথা বলারও কোনো মানে নেই।

এই ভরদুপুরে  পুকুরের কাছে দাঁড়িয়ে যদি বলে উঠি-----বাহ! চমৎকার পদ্ম ফুটেছে।


সেও কি মানায়? তবে মানিয়ে যেতে পারে আমি যদি ঝুপ্পির হাতের রান্না লাউ চচ্চড়ি খেয়ে
বলি----আহা কী খেলাম কী খেলাম!
মানিয়ে যাবে।

বছরের অনেকগুলো দিন ঝুপ্পির হাতি বাগানের বাড়িতে আমি। দিনরাত্রি।

অনেক কথা। রাগ দুঃখ অভিমান
ঝুপ্পির কাছে সমর্পণ করি। আমার কান্নাও আমি  সমর্পন করি। 

এক নদীর কাছে সমর্পণ ছাড়া
কিইবা করার থাকে! অথবা নদীতে বয়ে যেতে হয়। সেই বয়ে যেতে যেতে আর অন্য কিছু  আঁকড়ে ধরতে নেই।

বয়ে যেতে যেতে কোনো আতঙ্কে শ্যাওলাকেও  ধরতে গেলে  আবেগটা থাকে না। যদিও আবেগ সবসময় একমুখী থাকে না। কখনো নুড়িপাথর ধরে ফেলে। কখনো ভেসে-যাওয়া গাছের ডাল ধরে ফেলে। কিংবা বড় পাথরে ধাক্কা খায়।

রক্তপাত ঘটে।

এই রক্তপাতের কাছে জড়ো হয়ে থাকে নক্ষত্রেরা। আলো জ্বালিয়ে আলো জ্বালিয়ে  দেখে নিতে চায়, ব্যথা কতদূর?

ব্যথার কোনো সীমানা নেই। সে ঝুপ্পির কাছে গিয়ে থেমে যেতে পারে। সে পর্নার কাছে গিয়ে থেমে যেতে পারে। সে কিরাতের কাছে গিয়ে থেমে যেতেও পারে। থেমে যেতেই পারে এ বিষয়ে জোর গলায় কিছু বলাও যায় না। হঠাৎ করে যখন, পালকের জন্য মন কেমন করে,তখন কাকে কি বলবো? গোধূলির কাছে দাঁড়িয়ে যখন চিৎকার করতে ইচ্ছে করে---বাপি বাপি-----তখন আবেগ তো হাওয়ায় হাওয়ায়
বয়ে চলে।

কিন্তু রোজ রোজ তো কলকাতার হাতিবাগানে থাকা যায় না। থাকতে হয় নিজস্ব এক ঠিকানায়।

পুরুলিয়াতে ঘরে ফিরে আসি।

মন উড়ু উড়ু করে।

তখন মোবাইল নেই। তখন টেলিফোন বুথ।তখন দিন ও রাত্রি টেলিফোন বুথে 
পয়সা দিয়ে ফোন চালাচালি।

যান্ত্রিক তার কত আর কথা নিয়ে যাবে! মানুষের কথা যে আকাশ সমুদ্র ছাড়িয়ে যায়। 

সমস্ত চরাচর জুড়ে কথা আর কথা। কোনো কথা সুখের। কোনো কথা দুঃখ-বেদনার। কোনো কথা শুধুই কথা সমুদ্র ফেনার মত। কোনো কথা ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে বালুতটে।

হাতিবাগানের কথাগুলি মর্মে এসে আমাকে কাঁদায়। আমার কথা গুলি হাতিবাগানে গিয়ে  দাঁড়িয়ে পড়ে বলতে থাকে-------
দোষ কারো নয় গো মা
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।

প্রেম নয় অর্থ নয় সচ্ছলতা নয় শুধু একটা ঠাঁই। 
একটা ঠাঁই পেতেই দীর্ঘশ্বাস জোরে জোরে পড়ে। কোথায় বাঁচবো? কার কাছে বাঁচবো?

মানুষের কাছে তো একটাই আর্তি --------বাঁচতে চাই। বাঁচতে চাই। এবং এই বাঁচার জন্য কত রকমের আপোষ। যা যন্ত্রণাদায়ক।

শিকড় ছেঁড়া মানুষের মতোই 
প্রেম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা হেঁটে চলা সেও তো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।

ঝুপ্পিও এই সমাজ জীবনে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গিয়ে  রাস্তায় পড়ে গেছে। নিজে পড়ে গিয়েও অন্যকে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করেছে।

আজকাল আর দেখা হয় না। কথা হয় কখনো-সখনো। দুরভাষে।
কোথাও যেন কেউ মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে-----সেই ভালো সেই ভালো , আমারে না হয় না জানো।


--------১৪ আষাঢ় ১৪২৯
-------২৯----৬----১৪২৯
-------নির্মল হালদার








ছবি : সংগৃহীত









মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২

পল্লবিত হয়ে ওঠে সুর



পল্লবিত হয়ে ওঠে সুর
---------------------------

সম্ভবত ২০১০ পল্লব এসেছিল পুরুলিয়াতে লোকেশন খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতে আমাকেও পেয়ে গেছলো সে।
দুজনে মিলে পুরুলিয়ার পাহাড় নদী জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে লোকেশন স্থির হয়েছিল পঞ্চকোট পাহাড়ের কাছে। গোবাগের কাছাকাছি গ্রাম।

পল্লবকে সহযোগিতা করেছিল স্থানীয় মানুষ হিসেবে রাজেন টুডু। নিরাময় মুদি। রঘুনাথ মন্ডল।
আমার মনে পড়ছে, পল্লবকে আরেকজন সহযোগিতা করেছিল। সে হলো সাধন মাহাত।

সেই ছবি মুক্তি পেলো ২০১৫ তে।

সেই ছবি "মেঘের মেয়ে "অন্য ধারার একটি ছবি। যেমন অন্য ধারার পরিচালক পল্লব কীর্তনীয়া।

যৌবন থেকেই পল্লব গতানুগতিক পথে হাঁটে না। আশির দশকে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে মেডিকেল কলেজে নতুন পথের নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল।

তখন থেকেই সে কবিতা প্রয়াসী।

গানও লিখছে। সৃষ্টি করছে সুর।

পরিবর্তনের লড়াইয়ে পল্লব সক্রিয় ছিল। যখন দেখলো পরিবর্তনে নামে সেই স্বৈরাচারের মুখ, সে চলে এলো নিজের জায়গায়।

একলা পথেই হাঁটবে।

এবং বর্তমানে একলা পথেই হাঁটছে সে।

নিজের লেখা নিজের সুরের গানকে অবলম্বন করে বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে হোঁচটের পর হোঁচট খায় পল্লব।

শাসকের বিরোধিতা করতে গিয়ে
সে কোনো জায়গা থেকেই গান গাওয়ার জন্য ডাক পায়না। তাকে নতুন করে শুরু করতে হয়েছে চিকিৎসা। হাসপাতালের কাজ।

জীবন জীবিকার টানাপোড়েনে সে মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথের গান তাকে উদ্ধার করে। সাহস পায় সে।

পল্লব রবীন্দ্রভারতী থেকে
রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে মাস্টার্স করেছে। প্রত্যয় জন্মেছে তার।
সেই প্রত্যয় থেকেই আমার সঙ্গে অনিয়মিত হলেও যোগাযোগ।

সে মঞ্চ ক্যামেরা হাততালির দিকে
ছুটে না গিয়ে গান লেখে। নিঃশব্দে। সে সুর করে। নিঃশব্দে।
যেন বা, বাতাসকেও শোনাবেনা তার গান।

নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা সব সময় বজায় থাকে না তার। আমাকে হয়তো নতুন একটি গান
কিংবা গানের লিংক আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয়।
আমি দেখতে পাই, পল্লবের এক মাথা ঝাঁকড়া চুল নড়তে নড়তে
আকাশকে নামিয়ে আনছে নিচে।

পাহাড় টলে উঠছে।

সেই সব রাগ দুঃখের গানে এদেশের মানুষের মুখগুলি দেখা যায়। পাশাপাশি পল্লবের অনেক গান বেদনা বিরহ বাহিত।

মন খারাপ হয়ে যায় আমার।

আমার অনেক বন্ধু ও বন্ধুনী পল্লবের গানের অনুরাগী।

আর আমি তার বন্ধুতার অনুরাগী অবশ্যই। তার বন্ধুতা থেকে আমি খুঁজে পাই আমার মনোবল। আমিও একা হয়ে একা নই। আমার সঙ্গে আছে অজস্র পায়ের ছাপ।

নীরব।

পল্লব, পল্লব কীর্তনীয়ার সঙ্গেও আছে  বুনো গাছ থেকে ফুলের গাছ । রেণু ছড়ায়। আছে বট গাছের ঝুরি।

মাটিকে ছুঁয়ে মাটির গভীরে।

অন্তস্থলে পল্লবিত হয়ে ওঠে সুর।

পল্লব, চলো তোমার গানে বর্ষা নামাই আমাদের রুখাশুখা দেশে।


-------১৩ আষাঢ় ১৪২৯
------২৮---৬--২০২২
-------নির্মল হালদার


ক্যাসেট/ সিডি
১। কোন ভাঙনের পথে , (নিজের গান), প্যান মিউজিক, ১৯৯৪
২। শাওন, (নিজের গান), আশা অডিও, ১৯৯৮  
৩। ধুলোখেলা, (নিজের গান), এইচএমভি, ২০০০ 
৪। নগর নাবিক, (নিজের গান), এইচএমভি, ২০০১ 
৫। মুক্তবেণী (রবীন্দ্র সঙ্গীত),     আশা অডিও, ২০০৩ 
৬। রক্তকরবী (টেলিসিরিয়াল), এইচএমভি, ২০০৬
৭। সিঙ্গুর-কথা নন্দী-গান, (নিজের গান), কসমিক হারমনি,  ২০০৭ 
৮। আলোমানুষ, (নিজের গানের ভিডিও), কসমিক হারমনি, ২০০৮ 
৯। ঘুমের পাতা, (নিজের গান), কসমিক হারমনি, ২০০৮
১০। দোসর যে জন, (রবীন্দ্র সঙ্গীত), কসমিক হারমনি, ২০১০  
 
বই
১। অন্য তুমি ( গানের গদ্য), প্রমা পাব্লিকেশন,  ১৯৯৫
২। ছায়াজল (কবিতা), চতুরঙ্গ প্রকাশনী, ২০১১ 
৩। গানের মাটি ও সোনাই যাই (গানের গদ্য  সঙ্গে স্বকণ্ঠে নিজের কবিতার সিডি), অভিযান পাব্লিসার্স, ২০১১
৪। পাতার পরিজন (অডিও বুক), গাঙচিল প্রকাশনী ২০০৯, অভিযান পাব্লিসার্স সংস্করণ ২০১৩
৫।  পাতার ক্যানভাস (গদ্য),   অভিযান পাব্লিসার্স, ২০১৪
৬। নম্র নদীটি (কাব্য উপন্যাস), অভিযান পাব্লিসার্স, ২০১৮
৯। মেঘের মেয়ে (চিত্র নাট্য),  বইতরনী প্রকাশনা, ২০১৮ 






























ছবি : সংগৃহীত




কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ