এ বোঝা তুমি নামাও বন্ধু নামাও
----------------------------------------
৭/৮ কিমি দূর থেকে আসছে পায়ে হেঁটে। মাথায় সবজির ঝুড়ি। বেশ ভারী।
ঘরে বড় নুনু মাথায় তুলে দিয়েছে।
রাস্তায় একবার নামাবে ভেবেও নামাতে পারেনি। কে আবার তুলে দেবে মাথায়?
সরুবালির জল তেষ্টা পেতেই
মনে পড়লো, জলের বোতল ঝুড়ির মাথায়। হাত পৌঁছলেও
জলের বোতলের নাগাল পায়না।
সে হাঁটে।
বয়স হয়েছে অনেকটাই। হাঁটু টনটন করে। ঘরে বসে থাকতেও পারে না। কাঁচা পয়সা তো লাগবে। নুন তেলের খরচ। ওষুধপত্রের খরচ। বছরে দু একবার জামাকাপড়। কুটমালি
করতেও খরচ আছে। একটা বিহা ঘরের নিমন্ত্রণ এলেই মাথায় হাত।
সরুবালির দু বেটা। এক বেটা শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও রোজ করেনা। আর ছোট ব্যাটা?
কলেজে পড়ছিল। ছেড়ে দিয়েছে।
এখন কখনো কখনো বাড়ির শাকসবজি বাজারে বিক্রি করতে যায়। যেদিন যায় না সেদিন গাঁয়ের মাঠে ক্রিকেট।
বাপে বকাঝকা করলে দাদার সাথে দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে যায়।
টাকা লাগেই।
বাড়ির শাকসবজি ফুরিয়ে আসছে। তখন যে কি করবে তারা, এখন থেকেই কুলকিনারা পায় না।
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠতে শুশনি শাক গিমা শাক বাজারে বিকে দু চার পয়সা নিয়ে এসেছে।
সংসারের ভার বড় ভার।
নুনুর বাপ ইঁট ভাঁটায় কাজ করলেও বারো মাস কাজ থাকে না। ঘরে যতই চাল ধান থাকুক, টাকা লাগবেই।
বড় নুনুটা শহরে কাজ করতে গেলেই মদ খেয়ে ঘরে ফেরে। বারণ করলেও শোনেনা।
কপালে যে কি আছে কে জানে।
হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে উঠছে সরুবালি। আষাঢ়ের রোদেও তেজ আছে। এবছর বৃষ্টিও নেই।
ধানের চারাও মরে যাবে বোধ হয়।
চারদিকে শুধু ঘাসের সবুজ।
সরুবালির শ্বশুরের ভিটা লুশাবেড়া অনেক পুরনো গ্রাম। মাহাতরা যেমন আছে তেমনি সিং সর্দারও আছে। সবাই চাষবাস করেই খায়। নদীটা কাছে বলেই টুকু চাষবাস হয়। অনেক সময় নদী থেকে জল তুলতে পাম্প বসানো জরুরী হয়ে ওঠে।
আর পাম্প লাগালেই তেল।
এক লিটার কেরোসিনের দাম ৮৫ টাকা।
কত রকম যে ভার! মাথা থেকে বুক থেকে নামে না। কোনো কোনো ভার অবশ্যই খুশির।
যখন সরুবালি বিকেকিনে বাজার থেকে ঘরে ফেরার সময় নাতি-নাতনির জন্য ছেলে ভুলানো পোকড়ি ও গজা নিয়ে যায়। কখনো কোনো দিন বুট ভাজা মটর ভাজা বাদাম ভাজা।
একদিন পাউরুটি নিয়ে গেছলো।
শুকনো বলে নাতি-নাতনি খায়নি।
অনিল, অনিল সিং সর্দার সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বাজারে যাচ্ছে। তার সাইকেলের পিছনে
এক বস্তা ভেন্ডি।
সরুবালির সঙ্গে দেখা হতেই , দুজন দুজনকে বলে--------- আর পাচ্ছি নাইগো-----।
মনের ও শরীরের গোপন বেদনা বাতাসে কিছু উড়ে গেল। কিছু কিছু মাটিতে। ধূলায়।
যতদিন শরীরে প্রাণ আছে খেটে যেতে হবেই। নইলে দুখের ভাত সুখ করে খাওয়া যাবেনা।
কুদরুং ফলের মত লাল লাল সুখ শুধু আঘন মাসে।কুদরুং খেতে গেলে টক টক লাগে। আবার কুদরুংয়ের ঝাড় জ্বালানীতেও।
সরুবালিদের জমিতেও কুদরুং হয়ে থাকে।তার নাতি--নাতনি ছুটে যায় ফলের লোভে।গাছ শুকিয়ে গেলে ঘরে নিয়ে চলো।
চুলাতে গুঁজবে।
মাথার ঝুড়ি একবার নামাতেই হবে। এক সাইকেল যুবককে দেখে সরুবালি ইশারায় ডাকে।
যুবক কাছে আসতেই বলে-----
দে বাবা একটু নামায়---- আর পাচ্ছিনা।
ক্ষনিকের বিশ্রাম পেলেও মাথায় তুলতে হবে আবার। বোঝা ওঠাও। বোঝা নামাও। এই চলবে।
এই মুহূর্তে সরুবালির কাছে স্বপ্নের মতো দৌড়ে আসে তার নাতি--নাতনি। তার দুচোখ ভিজে ওঠে।
------২৩ আষাঢ় ১৪২৯
------৮---৭----২০২২
-----নির্মল হালদার
ছবি : অভিজিৎ মাজী









কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন