দুর্গার দুটি হাতের ছায়ায়
-------------------------------
দুর্গার সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের আগে আমি বিবড়দা যাইনি। অথচ যাওয়ার জন্য আমাকে ডেকেছে আমার দিদি।
বিবড়দা আমার জেঠতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদি আমাকে খুবই স্নেহ করতো।
পুরুলিয়াতে এলেই বলতো------
ভাই , একবার যাবি আমার ঘর।
আমার জেঠতুতো দিদিরাও ছিল
আমার ঘর। আমার আশ্রয়।
সোনামুখি মলিয়ান ছোটবেলায় গেছি। কিন্তু বিবড়দা যাইনি। কদমাগড় যাইনি।
দুর্গার সঙ্গে কবে কোথায় আলাপ পরিচয় হয়েছিল আজ আর মনে নেই। এবং আলাপের পর দুজনের সম্পর্কে দীর্ঘ এক বিরতি পড়ে গেছলো। তার কারণটা কি, আমি জানি না।
দুর্গা জানে ?
নতুন করে আমার ও দুর্গার সম্পর্কটা নিবিড় হতেই দেখলাম,
আমি দুর্গার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠছি। সত্যি কথা বলতে কি, নির্ভরশীল না হয়ে উপায় নেই।
দুর্গা ছাড়া কার কাছেই বা জানতে চাইবো------ভ্রুকুটি বানানটা কি ?
অথবা শবর জাতির ইতিহাসটা একটু বলো------। বাঁশেরকেল্লার ইতিহাসটা আমাকে বলবে ছোট করে ?
কিংবা " কচড়া " কীভাবে রান্না করো তুমি ?
অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় তবু
দুর্গার কাছে জানতে চাই--------
শঙ্খবাবু ও মানববাবু কি একই ব্যাচের ?
দুর্গা, দুর্গা দত্ত শঙ্খবাবুর প্রিয় ছাত্র ছিল। যাদবপুরে।
সে বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজ থেকে পাশ করে মাস্টার ডিগ্রী পড়তে গিয়েছিল যাদবপুর।
সেখান থেকেই সে পল্লবিত হয়ে ওঠে । মেধা ও মননে। বিভিন্ন গুণী মানুষের সাহচর্যেও।
দুর্গার সান্নিধ্যেও সুন্দর হয়েছে অনেকে। আমি তো নিজেই তার কাছ থেকে এখনো পথ চলার পাঠ নিয়ে থাকি। কিভাবে কোথায়
কোন্ কথাটা বলব, দুর্গার কাছ থেকে জেনে নিতে আমার কোন দ্বিধা হয় না। সংকোচ হয় না। যেমন রসিক শরাবন কালিন্দীর
কোন্ গাঁয়ে ঘর আমি ভুলে গেছি,
তুমি বলো।
দুর্গা লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বড় ভান্ডার। সেই কারণে মানভূম তথা পুরুলিয়ার লোকজীবন লোকসংস্কৃতি বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান।
পুরুলিয়ার নাচনি-শিল্পীদের নাম ঠিকানা তার মুখস্থ। প্রায় প্রতি বছর সে শীতের সময় পুরুলিয়াতে এসে লোক--শিল্পীদের কম্বল বিতরণ করে। এবং আড়ালেই থাকে। তার
মাধ্যমেই পুরুলিয়ার অনেক লোক শিল্পীদের সঙ্গে আমার পরিচয়।
ঘনিষ্ঠতা।
দুর্গা নিয়মিত কবিতা চর্চা করে। বছর ৩০ আগে প্রমা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম কবিতার বই-----ধৃতরাষ্ট্র উবাচ।
তারপর এতদিন বাদে দশমিক
থেকে প্রকাশিত হবে তার দ্বিতীয় কবিতার বই-----------বৈঠকি ঝুমুরের ধুয়া।
মালায়ালাম ভাষাতে দুর্গা বেশ স্বচ্ছন্দ। মালয়ালাম কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছে আমাদের এই বাংলার ছোট কাগজে কাগজে।
আর নরেন্দ্র প্রসাদের নাটক------
বেললি আড়চার অনুবাদ করেছে
" শুক্রবার " নামে। শূদ্রক নাট্য পত্রে।
নানাগুণের অধিকারী হয়েও
সর্বদাই নিজেকে আড়াল করার
একটা চেষ্টা আমার বন্ধু দুর্গার।
তার এই দিকটাও শিক্ষনীয় বৈকি।
সময় তো নিজেকে প্রকাশ করার
অথবা বলা যায়, দেখানোর।
নিজেকে জাহির করার এই যে একটা সময় বয়ে যায় আমাদের দিকে, সেইখানে দুর্গা, দুর্গা দত্ত
একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র।
দুর্গার সঙ্গিনী শর্মিলার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়নি। যদিও তার কথা শুনেছি অনেক জায়গায়। তিনিও ছিলেন একজন বিদূষী।তার অকাল প্রয়াণে সবার মাঝে থেকেও দুর্গা নিঃসঙ্গ।
এই দুর্গার টানে আমি বিবড়দা দু'তিনবার গেলাম। দিদি বেঁচে থাকাকালীন যেতে পারিনি বলে মর্মে মর্মে ব্যথা ছিল।
প্রথম যখন গেলাম মনে মনে,
আমার দিদির আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
দুর্গা দত্ত একদিকে যেমন কবি
অন্যদিকে লোকসংস্কৃতিবিদ। আরেক দিকে তেমনি আগাগোড়া
পারিবারিক এক মানুষ।
সবার জন্য তার মন উদ্বেলিত হয়।
দুর্গা তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও প্রিয় মাস্টারমশাই। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে তার গুনগ্রাহী ছাত্র-ছাত্রীরা। আত্মীয়স্বজন তো আছেই নানা দিকে।
তার সৌজন্যবোধও শেখার মত।
আমার নাতির ৫ বছরের জন্মদিনে সে টাকা পাঠিয়ে আমাকে জানায়-----পালকের জন্য কিছু কিনে দিও।
দুর্গাকে নিয়ে লিখতে হলে তালগাছকে ডেকে আনতে হবে।
তাল গাছের পাতাতেই মানিয়ে
যাবে তার কথা। কিংবা জীবনী।
কলকাতার মত জটিল ধাঁধায় থেকেও নিজের হৃদয়কে যে রক্ষা করতে পেরেছে এ কম কথা নয়।
দুর্গার পায়ের শব্দ দিগন্ত অবধি ছুঁয়ে থাকে। আমিও তাই ভরসা করে থাকি তার উপরে।
প্রতিদিন সকাল থেকে।
দুর্গার দু'হাতের ছায়া আমার কাছে দশ হাতের ছায়া
--------১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------২৯----৫----২০২২
------নির্মল হালদার