মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০২২

সূর্যাস্ত এক মায়া



সূর্যাস্ত এক মায়া
---------------------

গরুর পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে।

ঘরে ফিরছে গাই--গরুর দল।

ঘরে ফিরছে সূর্যদেবও।

করুণ আলো ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে। ব্যথা-বেদনা-আনন্দ এক হয়ে পাহাড়ে নদীতে গাছের মাথায় মাথায়।

বকের ডানায়।

এক সৌন্দর্যের শান্তি। শান্তির সৌন্দর্য।

আমি হাঁটছি ওই দিকে।

আমার চলার পথে আমাকে দেখছে কয়েকটা পাখি। যাদের সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। যাদের সঙ্গে কখনো আর দেখা হবেও না।

হয়তো কখনো চেয়েছি পাখির পাখার তলায় আমার নিটোল ঘুম। হয়তো কখনো চেয়েছি , পাখি আমার মুখে গুঁজে দেবে দু' এক দানা।

সূর্যাস্ত কী দেবে আমাকে?

সূর্যাস্ত একটি চরিত্র। আঁধারকে
ডেকে সন্ধ্যাতারাকে নিয়ে আসে।
সন্ধ্যাতারার সঙ্গে কথা বলে ভিখিরি মা।

আজ সারাদিন ভিক্ষে পেলেও
তার সন্তানের জন্য এক ফোঁটা
দুধ পায়নি।

সন্ধ্যাতারা হাসতে হাসতে আরো অনেক তারাকে ডেকে ঝরাতে বলবে------ আলো আলো দুধ।

এই সূর্যাস্ত বেলায় রাস্তার গাছ তলা থেকে উনুনের ধোঁয়া উঠছে। রান্না করবে পথের মানুষ।

রান্নার গন্ধ উঠবে আকাশে আকাশে।

এই সূর্যাস্ত বেলায় হাটুরেরাও ঘরে ফিরছে। সন্তানের মুখ চেয়ে। তাদের পুঁটলিতে বাঁধা আছে মন্ডা মিঠাই।

ঘরের দিকে যাওয়া।

সূর্যাস্তের আরেক অর্থ----------
ঘরের দিকে যাওয়া।

কোনো কোনো কবি
সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহে নিজের অন্তর--আলো জ্বালিয়ে রচনা করেন নতুন এক ব্রহ্মাণ্ড।

সূর্যাস্তের চরিত্র পাল্টে পাল্টে যায়। একেক ঋতুতে একেক রকম। যা দেখার শখ, মাটির টিলার উপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার শখ এ জীবনে শশীর মিটবেও না।

হয়তো বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
শশীর হয়ে বলেছিলেন---------
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে।


------১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------৩১----৫----২০২২
------নির্মল হালদার





















ছবি : অভিজিৎ মাজী

















সোমবার, ৩০ মে, ২০২২

গিমা শাকের গরিমা



গিমা শাকের গরিমা
-------------------------

পালং শাকের চাহিদা আছে। সারাবছর। শীতকালে তো তার রূপ লকলক করে। বাজারি মানুষকে লোভী করে।

শাকের মধ্যে পালং হলো উঁচু জাতের শাক। কদর আছে। দাম আছে। পাশাপাশি পুঁই শাক থাকলেও চাহিদা নেই।কেননা,
পুঁইয়ের সঙ্গে সব সময় অন্য আরেকটা সবজি লাগে। বিশেষ করে পুঁই কুমড়া মানানসই। আর
গিমা শাক?

শহরের অনেক মানুষ চেনেই না।

না--চেনার ই কথা।

গ্রাম থেকে ঝুড়ি মাথায় বাজারে এসেছে। এবং বিক্রি হচ্ছে না কেজি দরে। পাঁচ টাকা ভাগ নিয়ে যাও--------।

কী শাক এত সস্তায় বিক্রি হচ্ছে?
জানার জন্য বেশিরভাগ মানুষের কোনো কৌতুহল নেই।

পালং শাকের বীজ বিক্রি হয়ে থাকে। গিমা শাক নিজের আনন্দে মাটি ফুঁড়ে ওঠে।
বাঁধের ধারে।ডোবার ধারে। ধানক্ষেতেও। এই
গ্রীষ্ম দিনে।

ছোট ছোট পাতা।ছোট ছোট ফুল।
ভুঁইয়ে লুটিয়ে থাকে। যেন জন্ম থেকেই মাটি-ধূলার পায়ে বিনত
হয়ে আছে।

গিমা শাকের বীজ কোথায় লুকিয়ে থাকে? মাটির কত গভীরে?
জলা জায়গায় বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা গিমা শাক তেতো নয়।তিতকুটে বলতে পারি ।

আমাদের ঘরে কুচো কুচো আলুর 
সঙ্গে আদা বাটা আর জিরে গুঁড়োর মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। খেতে বেশ লাগে। শুধু গিমা
শাকের তরকারি দিয়ে অনেকটা ভাত খাওয়া যায়।

ছোট ছোট সুখ দুঃখ নিয়ে গিমা শাক বছরে একবার এলেও চেয়ে থাকতে হয়।

গিমা শাকও সবুজ।

তার আদর নিতে আমরা ভুলে যাই।যেমন ভুলে যাই,সজনে শাকের উপকারিতা।
সজনে শাক সেদ্ধ করা জল খেলে
রক্তচাপ কমে।

আমাদের পুরুলিয়াতে তো  গাঁয়ে গাঁয়ে অধিকাংশ ঘরেই সজনে গাছ। সজনে ডাঁটা সজনে ফুলতো খেয়েই থাকে 
তার সঙ্গে সজনে পাতা বা শাক খাওয়া হয়। ভাতের সঙ্গে।

সজনে পাতার ঝাড়  বিক্রি হয়ে থাকে আমাদের পুরুলিয়া বাজারে।

সজনে ফুলের টুপটাপ শুনতে পায় অনেকে। সজনে পাতার পতন কতজন শোনে?

গিমা শাকের চলে যাওয়া আমরা দেখতে পাই না। তার আসবার শব্দ কে শোনে?

গিমা শাকও থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।  তার কাছে যেতে হবেই। যত জলদি যাওয়া যায় তত কল্যান।

শিশিরে শিশির ভেজা সকালবেলা
আমাদের জুটবে।



------১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------৩০----৫----২০২২
------নির্মল হালদার


















ছবি : বাপি কর্মকার















রবিবার, ২৯ মে, ২০২২

দুর্গার দুটি হাতের ছায়ায়



দুর্গার দুটি হাতের ছায়ায়
-------------------------------

দুর্গার সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের আগে আমি বিবড়দা যাইনি। অথচ যাওয়ার জন্য আমাকে ডেকেছে আমার দিদি।

বিবড়দা আমার জেঠতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি। দিদি আমাকে খুবই স্নেহ করতো।
পুরুলিয়াতে এলেই বলতো------
ভাই , একবার যাবি আমার ঘর।

আমার জেঠতুতো দিদিরাও ছিল
আমার ঘর। আমার আশ্রয়।
সোনামুখি মলিয়ান ছোটবেলায় গেছি। কিন্তু বিবড়দা যাইনি। কদমাগড় যাইনি।

দুর্গার সঙ্গে কবে কোথায় আলাপ পরিচয় হয়েছিল আজ আর মনে নেই। এবং আলাপের পর দুজনের সম্পর্কে  দীর্ঘ এক বিরতি পড়ে গেছলো। তার কারণটা কি, আমি জানি না।

দুর্গা জানে ?

নতুন করে আমার ও দুর্গার সম্পর্কটা নিবিড় হতেই দেখলাম,
আমি দুর্গার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠছি। সত্যি কথা বলতে কি, নির্ভরশীল না হয়ে উপায় নেই।
দুর্গা ছাড়া কার কাছেই বা জানতে চাইবো------ভ্রুকুটি বানানটা কি ?
অথবা শবর জাতির ইতিহাসটা একটু বলো------। বাঁশেরকেল্লার ইতিহাসটা আমাকে বলবে ছোট করে ? 
 কিংবা " কচড়া " কীভাবে রান্না করো তুমি ?
অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় তবু
দুর্গার কাছে জানতে চাই--------
শঙ্খবাবু ও মানববাবু কি একই ব্যাচের ?

দুর্গা, দুর্গা দত্ত শঙ্খবাবুর প্রিয় ছাত্র ছিল। যাদবপুরে।
সে বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজ থেকে পাশ করে মাস্টার ডিগ্রী পড়তে গিয়েছিল যাদবপুর।
 
 সেখান থেকেই সে পল্লবিত হয়ে ওঠে । মেধা ও মননে। বিভিন্ন গুণী মানুষের সাহচর্যেও।   

দুর্গার সান্নিধ্যেও সুন্দর হয়েছে অনেকে। আমি তো নিজেই তার কাছ থেকে এখনো পথ চলার পাঠ নিয়ে থাকি। কিভাবে কোথায়
কোন্ কথাটা বলব, দুর্গার কাছ থেকে জেনে নিতে আমার কোন দ্বিধা হয় না। সংকোচ হয় না। যেমন রসিক  শরাবন কালিন্দীর
কোন্ গাঁয়ে ঘর আমি ভুলে গেছি,
তুমি বলো।

দুর্গা লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে  একটি বড় ভান্ডার। সেই কারণে মানভূম তথা পুরুলিয়ার লোকজীবন লোকসংস্কৃতি বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান। 
পুরুলিয়ার  নাচনি-শিল্পীদের নাম ঠিকানা তার মুখস্থ। প্রায় প্রতি বছর সে শীতের সময় পুরুলিয়াতে এসে লোক--শিল্পীদের কম্বল বিতরণ করে। এবং আড়ালেই থাকে। তার
মাধ্যমেই পুরুলিয়ার অনেক লোক শিল্পীদের সঙ্গে আমার পরিচয়।
ঘনিষ্ঠতা।

দুর্গা নিয়মিত কবিতা চর্চা করে। বছর ৩০ আগে প্রমা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম কবিতার বই-----ধৃতরাষ্ট্র উবাচ।
তারপর এতদিন বাদে দশমিক
থেকে প্রকাশিত হবে তার দ্বিতীয় কবিতার বই-----------বৈঠকি ঝুমুরের ধুয়া।

মালায়ালাম ভাষাতে দুর্গা বেশ স্বচ্ছন্দ। মালয়ালাম কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছে আমাদের এই বাংলার ছোট কাগজে কাগজে।
আর নরেন্দ্র প্রসাদের নাটক------
বেললি আড়চার অনুবাদ করেছে
" শুক্রবার " নামে। শূদ্রক নাট্য পত্রে।

নানাগুণের অধিকারী হয়েও
সর্বদাই নিজেকে আড়াল করার
একটা চেষ্টা আমার বন্ধু দুর্গার।
তার এই দিকটাও শিক্ষনীয় বৈকি।

সময় তো নিজেকে প্রকাশ করার
অথবা বলা যায়, দেখানোর।
নিজেকে জাহির করার এই যে একটা সময় বয়ে যায় আমাদের দিকে, সেইখানে দুর্গা, দুর্গা দত্ত
একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র।

দুর্গার সঙ্গিনী শর্মিলার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়নি। যদিও তার কথা  শুনেছি অনেক জায়গায়। তিনিও ছিলেন একজন বিদূষী।তার অকাল প্রয়াণে সবার মাঝে থেকেও দুর্গা নিঃসঙ্গ।

এই দুর্গার টানে আমি বিবড়দা দু'তিনবার গেলাম। দিদি বেঁচে থাকাকালীন যেতে পারিনি বলে মর্মে মর্মে ব্যথা ছিল।
প্রথম যখন গেলাম মনে মনে,
আমার দিদির আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।

দুর্গা দত্ত একদিকে যেমন কবি
অন্যদিকে লোকসংস্কৃতিবিদ। আরেক দিকে তেমনি আগাগোড়া
পারিবারিক এক মানুষ।

সবার জন্য তার মন উদ্বেলিত হয়।

দুর্গা তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও প্রিয় মাস্টারমশাই। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে তার গুনগ্রাহী ছাত্র-ছাত্রীরা। আত্মীয়স্বজন তো আছেই নানা দিকে।

তার সৌজন্যবোধও শেখার মত।
আমার নাতির ৫ বছরের জন্মদিনে সে টাকা পাঠিয়ে আমাকে জানায়-----পালকের জন্য কিছু কিনে দিও। 

দুর্গাকে নিয়ে লিখতে হলে তালগাছকে ডেকে আনতে হবে।
তাল গাছের পাতাতেই মানিয়ে 
যাবে তার কথা। কিংবা জীবনী।

কলকাতার মত জটিল ধাঁধায় থেকেও  নিজের হৃদয়কে যে রক্ষা করতে পেরেছে এ কম কথা নয়।

দুর্গার পায়ের শব্দ দিগন্ত অবধি ছুঁয়ে থাকে। আমিও তাই ভরসা করে থাকি তার উপরে।

প্রতিদিন সকাল থেকে।

দুর্গার দু'হাতের ছায়া আমার কাছে দশ হাতের ছায়া


--------১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯
------২৯----৫----২০২২
------নির্মল হালদার
















ছবি : সন্দীপ কুমার























কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ