শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২

অনির্বাণের বন্ধুতার কাছে



অনির্বাণের বন্ধুতার কাছে
------------------------------------

অনেক অনেকগুলি বছর পার হয়ে গেল। বয়স বেড়ে গেছে আমাদের। তারপরও কোনো গাছের তলায় আমাদের দেখা হলো না।

দেখা যেমন হয় না, কথাও হয় না আমাদের।
তবে কি আমরা দু'জনের প্রতি দু'জন টান অনুভব করি না?

একটা গাছ থেকে আরেকটা গাছ দূরে থাকলেও দু'জন দু'জনকে দু'জনের মনের বাতাস দিয়ে থাকে।

ভেতরে ভেতরে শেকড়ের টান।

দুটো গাছ আলাদা হলেও দু'জনেই
শেকড়ের টান অনুভব করে।

অনির্বাণ, আমাদের অনুভূতিগুলি কি মরে গেছে? নাকি প্রকৃতির এই নিয়ম, চিরদিন সবার সঙ্গে সবাই থাকে না?

আমার কাছে স্পষ্ট হয় না কিছুই।

মাঝেমধ্যেই পিছন ফিরে তাকাই, দেখি------বাস থেকে নেমে আমি তোমাদের বাড়ির দিকে হাঁটছি।

তখন মাসিমা ছিলেন। মেসোমশাই ছিলেন। ছিল আরো দুই বোন। ঘর ভরা আন্তরিকতা।

আজকে তো চারদিকেই আন্তরিকতার অভাব। ফোন করলেও সাড়াশব্দ পাই না অধিকাংশ জনের কাছ থেকে।

পরেও আর ফোন আসে না।

মোবাইল আবিষ্কার হওয়ার পরে কি কি সুবিধা হয়েছে আমাদের, অন্য কেউ বলবে। আমি বলবো, কারো সঙ্গেই কারোর যোগাযোগ বাড়েনি। অথচ যোগাযোগ তো হওয়ার কথা।

সপ্তাহে একটা দিন আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছে ফোন করে জানা যায় তাদের ভালো থাকা মন্দ থাকা।

কিন্তু না কেউ কাউকেই ফোন করে না।

সবাই কি ব্যস্ত থাকে  সব সময়?
প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত? নাকি ব্যস্ততার ছল?

আসলে কি জানো, অন্তরের অভাব। 

অভাব থেকে ভাব আসে।

কই ভাব? কই ভালোবাসা?

এই যে আমি আর তুমি মাঝখানের অনেক অনেকগুলি বছর নীরব থেকে গেলাম, আমি মনে করি কাজটা ঠিক হয়নি।

তবে কি  টান--ভালোবাসা কম পড়েছে?

জল জঙ্গল জমি তো কমেই যাচ্ছে দিন দিন। টান--ভালোবাসাও কমে যাবে?
কিসের জোরে বাঁচবো আমরা?

বন্ধুতাও এক রকমের জল --হাওয়া। সেই জল---হাওয়া থেকে আমরা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, ছিন্ন হয়ে গেছি আমি আমার জীবন দিয়ে অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি।
 
যাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতো না আমার, আজ তাকে ভুলে গেছি। নিজেকেই প্রশ্ন করি, সম্পর্কে কি ভুল ছিল কোথাও?

নিজেকে আরও প্রশ্ন করি, সম্পর্ক বলতে কি বুঝি?

তালগোল পাকিয়ে যায়। অস্থির লাগে। শূন্যতাও টের পাই। দু হাঁটুর মাঝখানে মুখ রেখে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করি।

মুখ তুললেই মন কেমনের অন্ধকার। একটি রজনীগন্ধাও আমাকে চেয়ে দেখে না।

অনির্বাণ, যখন ফোন ছিল না
তখন খাম পোস্ট কার্ড ইনল্যান্ড ছিল। 
আমাদের চিঠিপত্র লেখালেখি ছিল।  
তুমি আমি দু'জনেই কত চিঠি লিখেছি।

সেদিন এক বন্ধুকে বলছিলাম,
অনির্বাণ অফিস ছুটির পর রাস্তায় এসে ফুটপাতের ভিখারিদের কিছু না কিছু টাকা পয়সা দেবার চেষ্টা করতো।

সেও তো হৃদয়ের শব্দ।

বাসে একবার আমার পকেটমারি হয়ে গেল। তোমাকে এসে বলতেই, তুমি জানতে চাইলে কত টাকা?

এখনো মনে আছে আমার ২৫ টাকা পকেটমারি হয়েছিল। সেই আশির দশকে ২৫ টাকা অনেক টাকা।

তুমি বললে----তোমার ২৫ টাকা গেছে, তুমি ১০০ টাকা রাখো। পকেট থেকে বের করে দিলে একটি ১০০ টাকার নোট।

ওই উজ্জীবনের কথা মনে রেখেছি বলেই, আজ অনেক কথা মনে আসছে আমার। অথবা ওই উজ্জীবন আমাকে এখনো পথ চলতে সহযোগিতা করে।

একদিন গৌতম বসু তুমি আর আমি হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলা থেকে পার্ক সার্কাস ময়দান।

তিনজনেই বসে গেলাম মাঠে।
তুমি আমার কাছে জানতে চাইলে, কি বিশ্বাসে বাঁচো? আমি কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিনি।

আজও পারবো না।

তবে জানি, অভাব হবে না আমার। কারোর না কারোর ১০ হাত আমাকে আগলে রেখে 
আমাকে বাঁচাবে।

আমি আজও ভিক্ষুক।

অনেক বন্ধু আছে যারা আমাকে
বাঁচতে সহযোগিতা করে।

বেঁচে থাকার জন্যই তো কবিতা।

কবিতার সঙ্গেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি গোধূলির কাছে।
মাঝখানে অনেকটা সময় চলে গেলেও তোমার দুই সন্তানকে দেখা হলো না আমার।

পিতা তো হতে পারিনি। তুমিতো পিতা হয়েছো, পিতা অনির্বাণের সঙ্গেও দেখা হয়নি কত যুগ।

কাঠবিড়ালিকে বলতেও পারিনি,
একটা সহজ সেতু করতে তুমি এসো-----আমরা বন্ধুরা পারাপার করতে করতে গল্পকথা। হাসি কান্না।

দেখা হোক ভালোবাসা বেদনায় ইচ্ছে করে না তোমার? কাব্য চর্চা কি কেড়ে নিয়েছে আমাদের সরল জীবনকে?

আমি মনে করি, কবিতার চেয়ে অনেক মহৎ জীবন।

যে জীবনের দিকে চেয়ে চন্দ্র সূর্য চাই। আকাশ ভরা নক্ষত্র চাই। গাছপালা ও মাটি চাই।

কীটপতঙ্গ পশু পাখি নদী ও ঝর্ণা, পাহাড় ও সমুদ্র সঙ্গে অবশ্যই মানুষ আর মানুষ-----আমি চাই।

কোলাহল নয় কলহ নয় চলো, যে কোনো রাস্তায় নেমে আমাদের তৃষ্ণাকে খুঁজবো।


ইতি-----
১৩ শ্রাবণ ১৪২৯
৩০----৭-----২০২২
নির্মল হালদার



ছবি : অভিষেক মাহাতো
























শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০২২

একটি খোলা চিঠি




একটি খোলা চিঠি 


কালীদা

শ্রাবণের এই দগ্ধ দুপুরে একটি কাকও নেই। আমাদের এই পুরুলিয়াতে মরে যাচ্ছে ধানের চারা। রোদে রোদে।

শ্রাবণের গান অথবা রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান কে গাইছে?

একটা সময় ছিল যখন আমাদের এই মালভূমি অঞ্চলে ধান রোয়ার গান শোনা যেতো।

আমি ছাদ পেটার গানও শুনেছি।

লোক জীবনের গান। শিকড়ের গান। শ্রমজীবী মানুষের নানা অভাব থাকার পরেও গান ছিল রক্তে রক্তে

বিয়ার গানও শুনেছি।

এখনো নিম্নবর্গের ঘরে ঘরে বিয়ার গান হয়ে থাকে।

নিম্নবর্গের অনেক পরবেও গান হয়ে থাকে।  কোরাস গাইছে মেয়েরা।


সমস্ত গানেই সুখ দুঃখের কথা।

সেইসব কথা ও গানকে বাজার এখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। যদিও ঝুমুর গানের কথা লঘু হয়ে যাচ্ছে। নানা দিকে।


গানও যে কাব্যের একদিক, ভুলে যাচ্ছে আজকের ঝুমুর-কবিরা।


সস্তা ও চটুল কথা ও সুরে শ্রোতারা নেচে উঠছে।

এ বড় সুখের সময় নয়। কোনোভাবেই আনন্দের সময় নয়।

একটা নিরক্ষর দেশে অসচেতন মানুষ খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
এবং তাদের নিরক্ষরতা, অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের সর্বময় কর্তারা সঙ্গে মুনাফাবাজের দল জনগণের রক্ত
লুটছে।


অতি সাম্প্রতিক ঘটনা লক্ষ্য করছেন তো?
আশ্চর্যের বিষয়, এই বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

এই মুহূর্তে মেঘ ডাকছে।

বৃষ্টি কি আসবে?

ছোটবেলার বর্ষায় রাত হলেই ব্যাঙের ডাক। আমরা ছোটরা বলেছি, বৃষ্টি আসছে।

আজকাল আর ব্যাঙ দেখতে পাই না।

মানুষ কি দেখতে পাই?

বয়স হয়ে গেলেও বুড়ো বা বুড়িকে বাজারে শাক বিক্রি করতে আসতে হয়। এখানে কারণ একটাই, যেভাবেই হোক দু'পয়সা রোজগার করতে হবে।

ঘরে ধান চাল থাকলেও নুন তেলের পয়সা তো লাগবেই। যে বুড়ো কিংবা বুড়ি বাজারে আসতে পারে না পায়ে হেঁটে, তাদের যেতে হবে গাই গরু নিয়ে মাঠে।

যতই বয়স হোক বিশ্রাম নেই।

তাদের ঘুম আছে কিনা জানতে পারিনি। জানতে পেরেছি, কারো কারো ঘরের তিন তিনটা ছেলেই অন্য রাজ্যে কাজ করতে চলে গেছে।

আমাদের রাজ্যে কাজ নেই।

এই এদের পরিযায়ী শ্রমিক নামে
চিহ্নিত করা হয়েছে। কই, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কাজেও যারা যুক্ত তাদের তো বলা হচ্ছে না পরিযায়ী?

নিষ্পেষণ। যেভাবেই হোক নিষ্পেষণ করা হবে। মেরে ফেলা হবে জনগণের মূল শিকড় এই শ্রমিক সমাজকে।

কৃষক সমাজকে।

দেশের নোংরা রাজনীতির সঙ্গে
বাণিজ্য কর্তাদের মেলবন্ধনে
দেশের যে ভরাডুবি, দেখেও দেখছে না একশ্রেণীর শিক্ষিতরা।
যারা নাটক করে। কবিতা করে।
সিনেমা করে। চিত্রকলার সঙ্গেও
আছে। ছবিও আঁকে।

মনের আঁক মনেই থাকে উড়াল দিতে পারে না।

কোনোদিন দেখা যাবে বকের মুখ থেকে লুট হয়ে যাচ্ছে মাছ। গরুর পায়ের ক্ষুরে ধুলো মাটি নেই।

আমাদের গোধূলি নেই।

গোধূলির মায়ায় যে যুবক যুবতীরা প্রেম করে, তাদের ঠিকানা আর খুঁজে পাচ্ছি না।

কালীদা, কোন্ কবিতা কার কবিতা আমাদের মুক্তি দেবে?

আপনি বলবেন, আমাদের মুক্তির জায়গা রবীন্দ্রনাথের গান। যদি তাই হয় তবে আমি বলবো, রবীন্দ্রনাথের গান মধ্যবিত্ত বাঙালির গান। এরা বাদ দিয়ে অসংখ্য মানুষ যারা রবীন্দ্রনাথের নাম শোনেনি, তারা কোথায় যাবে?

আমার চারপাশে এখনো কয়েকজন যুবক আছে, যাদের মোবাইল যন্ত্র থেকে কেবল শোনা যায়, বুক ধড়পড় গান।

উৎসবে উৎসবে ডি জে।

পাতার মর্মর ধ্বনি শুনবেন?

জল জঙ্গল জমি উচ্ছেদ হয়। মানুষ উচ্ছেদ হয়।

জাতীয় সড়কের নামে গ্রাম থেকে গ্রাম শেষ হয়ে যায়।

গ্রাম পতনের শব্দ অনেক আগেই শুনেছিলেন কবি জীবনানন্দ। সেই শব্দ আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেঁচোর ডিম খেয়ে জীবনধারণ করে অসংখ্য আদিবাসী মানুষ। সেইসব আদিবাসীদের গ্রাম যেতে হলে
পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পাহাড়ে উঠতে হয়।

হাঁটার মতো পা আছে?

প্রতিশ্রুতি আছে।

আর লেলিয়ে দেওয়া প্রতিযোগিতা আছে। যে যার মত কাজ করতে না পারার বেদনা আছে।

সেই বেদনা আপনার অন্তরেও।

এই বঙ্গে কোনো কোনো কবির কলম শোষণের হাতিয়ার। সেই কবিদের পুষে রাখে মিডিয়া।

লিটিল ম্যাগাজিনের জগতও ধোওয়া তুলসী পাতা নয়। তারা খোঁজ রাখে না উত্তম মাহাতর।

যে রাজমিস্ত্রির কাজ করেও সাহিত্য চর্চা করে। ছবি আঁকার চর্চা করে। যার দিনমজুরি চারশো টাকা মাত্র।

যাকে নিজের একটা কবিতার বই
করতে হলে ঋণ করতে হয়।

হায় পোড়া দেশ!

কেমন করে ভালো থাকবেন কালীদা?

সেদিন তিনটি কলেজের ছাত্র
যাদের গ্রামে বাড়ি, শহরে থেকে লেখাপড়া করে, তারা এসে আমাকে বলছিল-----যদি তাদের জন্য কিছু একটা টাকা মাসে মাসে ব্যবস্থা করে দি, তারা উপকৃত হবে।
সেই মুহূর্তে কোনো নাম না পেয়ে
আমি ঝুপপিকে ফোন করে সব কথা জানাই।

সে একজনকে দিতে পারবে
আমাকে জানাতে একজনের মুখ রক্ষা করতে পেরেছি।
বাকি দু'জনের জন্যেও আরেক বান্ধবীকে বলেছি। সে জানিয়েছে, চেষ্টা করবে।

যখন দেশের এই অবস্থা তখন
এই রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘরে
টাকার পাহাড়।

আপনি কোথায় যাবেন? লজ্জাতে মুখ ঢাকবেন কোথায়?

আমার তো মনে হয়, দাঁড়াবার জায়গা নেই আর। যদি কোথাও ব্যাঙ থাকে, তার ছাতার তলাতেই দাঁড়াতে হবে।

কালীদা, অনেক কথা অনেক ব্যথা বেদনা।কাকেই বা বলবো?
আপনি আমাদের এই মুহূর্তে অগ্রজ বন্ধু ও ভরসার ঠাঁই। আপনাকে দু' এক কথা বলতে
হালকা হতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো মন।

ইতি

১২ শ্রাবণ ১৪২৯
২৯---৭----২০২২
নির্মল হালদার




ছবি : কল্পোত্তম























বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০২২

সুজিত এক আশ্রয়



সুজিত এক আশ্রয়
--------------------------

সুজিত সরকার আমার সতীর্থ। আমার বন্ধু।

সতীর্থ না বন্ধু কোন্ দিকে আমার পাল্লা ভারী? 

কবি সুজিত সরকার স্বতন্ত্র এক ধারা। কারোর কবিতার সঙ্গেই তার কোনো
যোগ নেই। আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, তার কবিতার সঙ্গে অন্য কারোর প্রভাব নেই।

সে কোনোদিকে না তাকিয়ে নিজের কাব্য দর্শনের দিকে হেঁটে যায়।
 
কবি কালীকৃষ্ণ গুহর ভাষায় সুজিত হলো একজন বিশুদ্ধ মানুষ। 

এই বিশুদ্ধ কবি ও মানুষটির সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সখ্য। সে যখন 
কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে,
তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার ও সৈকতের পরিচয়।

সুজিতকে দেখলেই মনে হয়, সে একটি ভরসার জায়গা।

আমি ও সৈকত কলকাতা গেলেই
বিশেষ করে দুপুর দিকে তাকে ইনভারসিটির ক্লাস থেকে ডেকে কলেজ স্ট্রিটে আমাদের আড্ডা। কবিতা। খাওয়া দাওয়া। 

বিকেল হলেই সুজিত বাড়ির দিকে রওনা দিতো। তার বাড়ি হাওড়া। কদমতলা।

সুজিত কলেজে চাকরি পাবার 
পরও তার সঙ্গে যোগাযোগ,
বিশেষ করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল। আমি কলকাতা গেলেই যেকোনো একজন বন্ধুর বাড়িতে আমার ঝোলা রেখে, যত্রতত্র রাত্রি কাটাতাম।

সুজিতের বাড়ি যেদিন যাবো
স্থির করেছি, তার আগের দিন রাত্রে প্রসূনের কাছে থাকা ।
রাত্রিবেলা।
সুবিধে ছিল একটা, বাগবাজার থেকে লঞ্চে হাওড়া। তারপর হাওড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে সুজিতের বাড়ি কদমতলা।

আমি যখন পৌঁছোলাম তার কাছে সে তখন টিউশনিতে ব্যস্ত। আমি অপেক্ষা করেছি।
 
সুজিত আমার কাছে আসবার আগেই মাসিমা আমাকে চা দিয়ে যেতেন। সুজিতের টিউশনি শেষ হলে আমাদের আড্ডা।

চাকরি এবং বিয়ের আগে থেকেই
সুজিতের এই রুটিন।

সুজিতের ছিল রাত্রিকালীন কলেজ। সে তাই দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর কলেজের জন্য রওনা হয়ে যাবে। আমিও তার সঙ্গে বেরিয়ে যাবো।

আমি মনে মনে স্থির করে নিয়েছি,
আজ কোথায় যাবো।
ঝোলা তো পড়ে আছে বাগবাজারে। থাকুক গে। কোনো
এক বন্ধুর কাছে গেলেই হবে।

সবার দুয়ার আমার জন্য অবারিত। 

আমরা দু'জন দুদিকে যাবো
তার আগেই সুজিত আমাকে
কিছু টাকা দিয়েছে। এই টাকা দেবার বিষয়টি সুজিতের বরাবরের অভ্যেস।

জবার সঙ্গে বিয়ের আগে ও পরে
সে একই রকম ছিল। এখানে বলতেই হবে, সুজিতের মা-বাবাও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। তার দাদা বৌদিও ভালোবাসতেন বৈকি। 

না ভালোবাসা পেলে, এতদুর কি হেঁটে আসা যায়? 

সুজিতের প্রথম যৌবনের পত্রিকা
"শোণপাংশু " র আমি নিয়মিত লেখক। এবং"শোণপাংশু"
থেকেই আমার  ও সৈকতের প্রথম বই।
সুজিত খুবই সহযোগিতা করেছিল।
আমার দ্বিতীয় কবিতার বইটিও
সুজিতের সহযোগিতায়
" শোণপাংশু " থেকে প্রকাশিত।

"শোণপাংশু" বন্ধ করে সুজিত নতুন উদ্যমে আরও একটি পত্রিকা  "কবিকৃতি "প্রকাশ করতে থাকে নিয়মিত।

"শোণপাংশু" ছিল ছোটখাটো কাগজ। কবিকৃতি সেই তুলনায় বিপুল। অসম্ভব সুসম্পাদিত একটি পত্রিকা। এখানেও আমি লিখেছি। 

সুজিত প্রথম থেকেই কোনো ভিড়ে ছিল না। কোনো দলেও ছিল না। মুক্ত মনের এই মানুষটির সান্নিধ্য অথবা এই বন্ধুটির সঙ্গসুধা আমাকে ঋদ্ধ করেছে। 

এই সেদিনও কালীদা আমার কাছে তার প্রশংসা করছিলেন।
প্রশংসা করছিল আমাদের আরেক বন্ধু ও সতীর্থ হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।

সুজিতের সঙ্গে গল্প করলে মনে এক আরাম পাওয়া যায়।
"আরাম "শব্দটি না বলে বলা যায়
আশ্রয় পাওয়া যায়।

আমার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ মাঝেমধ্যেই তার কথা মনে পড়ে।
যেমন দৈনন্দিন জীবনে সব ফুলের কথা মনে পড়লেও রক্তকরবীর কথা মনে পড়ে না।

আমি যা বুঝেছি তা হলো,
রক্তকরবী বাজারের নয়। সুজিতের এখানেই জিৎ। 

 " সুভদ্র " শব্দটি সুজিতের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবেই মানানসই।  সে শাল গাছ না হয়েও শাল গাছের ঋজুতা  যা আমাকে আকৃষ্ট করে। 

সুজিতকে দেবার মত আমার কাছে কিছুই নেই। যদি আমার সঞ্চয়ে থাকতো একমুঠো চাল
তাকে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

সুজিত তো  হাত পাতেনি আমার কাছে। আমারই মনে হয়েছে কেবল, সুজিতকে   আমি ভালোবাসাও দিতে পারিনি। কিন্তু আমার ব্যাপারে সে কোনো কার্পণ্য করেনি।কেন না, তার আকাশ যে বড়।

আমি শুধু ঝরা পাতা কুড়িয়ে কুড়িয়ে বলে যাই--------
ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে---


--------১০ শ্রাবণ ১৪২৯
-------২৭----৭----২০২২
------- নির্মল হালদার









ছবি : সংগৃহীত 




















মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২

মানবজমিন




মানবজমিন
-----------------

এই ছবি যদি কবি সমাজের হয়ে থাকে? বছরে একবার আষাঢ় শ্রাবণে এই ছবি যদি কবিদের জন্য হয়?

বছরের বাকি দিনগুলি কবিরা
যেকোনো কাজ করবে ‌। যেকোনো কায়িক পরিশ্রম। অথবা
দেয়ালে হেলান দিয়ে আলস্য করবে। কিন্তু লেখার চাষ করবে না।

লেখালেখি অর্থে ফসল ফলানোর কাজ। একবার বীজ ফেলবে। একবার রুইবে। তার অনেক আগে মাটিতে লাঙ্গল।

মাটিতে কলম।

বছরে একবার মাত্র।

বাকি দিনগুলি রঙ্গ রসিকতা করেও কাটিয়ে দিতে পারে। অথবা চাষবাস সংক্রান্ত পড়াশোনা।

এখানে পড়াশোনা মানে মাটিকে
পড়তে হবে। জানতে হবে মাটির রূপরেখা। মাটির সঙ্গে জানতে হবে বীজের চরিত্র।
কোন্ বীজ কতটা আলো দেয়, কতটা আবেগ প্রবণ, জানার পরে নামতে হবে কাজে। 

কাঁধে হালের ভার ।

কলমের ভার।

বছরে একবার মাত্র।

বীজ রুইতে রুইতে গান। 

কবিদের রচিত গান। কবিদের সুর। গান গাইতে গাইতে কাজটা হলে, কাজের পরিশ্রম , পরিশ্রম মনে হবে না।

সমস্তটাই আনন্দের। সমস্তটাই স্বতঃস্ফূর্ত। গা থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে মানে আলো গড়িয়ে পড়ছে। গড়িয়ে পড়তে পড়তে মাটিতে। 

ফসল ফলবে অনেক গুণ।

একজন কবি তো আসলে একজন কৃষক। বছরে একবার ফসল ফলিয়ে সে  নক্ষত্র বিষয়ে
কাজ করবে ‌ বছরের অন্যান্য দিনগুলি।

অপেক্ষা করবে আষাঢ় শ্রাবণের জন্য।

আপাতত বলতে চাই, এই শ্রাবণেও পুরুলিয়াতে বৃষ্টি নেই।

চাষীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লেও কবিদের মনে কতদূর চিন্তা?


------৯ শ্রাবণ ১৪২৯
-----২৬----৭----২০২২
------নির্মল হালদার






















ছবি : অভিজিৎ ও কল্পোত্তম





















কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ