মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২

পালক আমার পিতা



আমার ছোট্ট বন্ধু পালক।

বাজারে গেলেই আমার সঙ্গে।
নানা রকম বায়না।
হাঁটতে না পারলে, কোলে নাও।

আমি পেরে উঠি বা না উঠি
আমি তাকে কোলে তুলি।

এক এক সময় মনে হয়, পালককে কাঁধে চড়িয়ে মেলা দেখাতে নিয়ে যাব।

মেলাতো যাই।
ঘরের নিকটে রাস মেলা।
কার্তিক অগ্রহায়ণ।

সকাল হলেই পালক আমাকে বলবে----ডোডো দাদু আজ রাস মেলাতে আমাকে হেলিকপ্টার কিনে দেবে।
আমি জানতে চাই-----হেলিকপ্টার কেন?
সে বলে----খেলবো।
পরের দিন সকালে ----ডোডো দাদু
আমাকে বন্দুক কিনে দেবে আজ।
আমি জানতে চাই----বন্দুক কেন? আমার খুব ভয় করে।
পালক বলে----আমরা তো খেলব।
আমি তখন বলি---খেলতে খেলতে আমাকে মারবে না তো?

সে চুপ থাকে।

সবজি বাজারে যাই।

পালকের হাত ধরেছি।

যাদের আমি মাসি মাসি বলি, তাদের কাছে দাঁড় করিয়ে পালকের সঙ্গে পরিচয়।

পালকের তো দিদিমা নেই। ঠাকুমা নেই। পিসি নেই মাসি নেই। তাই, বাজারের সবজি বিক্রেতাদের কাছে নিয়ে এসে, কেউ কাকু কেউ জেঠু। কেউ দিদা। কেউ ঠাকুমা।
কেউ কেউ পিসি মাসি। 
একটা সম্পর্কের সেতু তৈরি।

মা-বাবার বাইরেও আরো যে কত সম্পর্ক আছে পালক জানুক।
যে মহিলা পেয়ারা বিক্রি করছে, সে পালকের হাতে ধরিয়ে দেয় একটি পেয়ারা।
পালক খুব খুশি হয়।

কোনো কোনো সবজি বিক্রেতাকে সেই দাম দেবে।
আমি তার হাতে ধরিয়ে দিই দামের টাকা।

এবার হয়তো দেখেছে, কোনো
মনোহারি দোকানে পুতুল ঝুলছে।
তাকে কিনে দিতেই হবে।
অনেক বুঝিয়ে সুুঝিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসি।

সেই পালক আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। সে এখন পাঁচ বছর চার মাসের এক শিশু।

সকাল হলেই স্কুলে যায়।

বাড়িতে এসে মেজাজ ফুরফুরে থাকলে ছবি আঁকে। এবং যখন তখন আমার কাছে এসে বায়না করবে-----আমাকে ওয়াটার কালার কিনে দাও। আমাকে পেন্সিল কিনে দাও। আমাকে রাবার কিনে দাও।

না কিনে দিলেই কান্না।

যেকোনো কান্না সইতে পারা কঠিন। তারপরে আবার শিশুর কান্না। তাকে অনেক সময় গল্প কথা শোনাবার চেষ্টা করেছি।
সে শোনে। মন দিয়ে শোনে। কিন্তু
একটি শিশুকে গল্প শোনাবার মত আমার ধৈর্যে কুলোয় না। এ কারণেই, তাকে শোনানো হয়নি পঙ্খীরাজের গল্প। রাক্ষস রাক্ষসীর গল্প।
অথবা পাখিদের গল্প।
আর যদি শোনাতে চাই সে শুনবে বলে মনে হয় না। তার মা বাবা তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মোবাইল।

মোবাইল থেকে খেলা খেলে।
হার-জিতের খেলা।

আমি দেখতে পাই, আমার আলো আঁধারের গলিতে আমি এক্কাদোক্কা খেলছি। চোর পুলিশ খেলছি।
আমি ধুলো খেলা খেলছি রাস্তায়।

পালক বড় হয়ে উঠছে ক্রমশ।

আমার ঘরে হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পড়ে। আলমারি খুলে খুঁজে বেড়ায় তার মনোমত সামগ্রী।
নতুন কলম দেখলেই সে নিয়ে পালাবেই।

আমি বারণ করি না।

কখনো কোনো দিন আমার জন্য রাতের খাবার নিয়ে আসে। সিঁড়ির গেটের বাইরে থেকে ডাকবে---ডোডো দাদু ডোডো দাদু ------

প্রথম যেদিন নিয়ে এসেছিল
আমি ঘরে ঢুকে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল----পালক আমার পিতা।

সকালে যখন বাজার করতে যাই,
পালক ঘরে থাকলে তার কাছে জেনে নিই, তার জন্য কী আনতে হবে?

আজ যেমন বললো----কিছু আনতে হবে না।
আমি এক মুহূর্তের জন্য মুষড়ে
গেলাম। পালকের জন্য সকালবেলা কেক চকলেট লজেন্স নিয়ে আসা আমার প্রতিদিনের অভ্যেস।
আমি বারবার জানতে চাই---
বলো কী নিয়ে আসবো বলো?
সেও বারবার " না " করে যায়।

পালক ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে।

তাকে একদিন বলেছিলাম---
তোমার জন্য নিয়ে আসবো রাজকন্যা।
তবে কি আর আনতে হবে না?

পালক আমার পিতা।

পিতার জন্য কিছু নিয়ে আসতে নেই? পিতার কাছে কিছু চাইতে নেই?

পালকের কাছে দিয়ে যেতেই হবে একটি শাল গাছ।
তার পছন্দ না হলে একটি শিমুল গাছ। তাও পছন্দ না হলে একটি করে আমজামের গাছ।

কবে দেবো কবে?


বেলা---১--৩৮
-----১৩ ভাদ্র ১৪২৯
-----৩০---৮----২০২২
------নির্মল হালদার



























মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০২২

বন্ধুতা ও আত্মীয়তা



একরামের সঙ্গে আলাপের পর আমি তাকে আলি সাহেব সম্মোধন করেছি। অনেকদিন পর্যন্ত। তারপর সেই আমাকে একদিন বললো-----আলি সাহেব না বলে, তুমি আমাকে একরাম বলবে।

একরামের সঙ্গে কখন কবে কোথায় আলাপ হয়েছিল, কে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আজ আর মনে পড়ে না।

অনেক অনেক দিনরাত্রি পার হয়ে গেল। অনেক অনেক তারা ফুটে উঠে ঝরেও গেছে। অনেক অনেক পাতা গাছে এসে সবুজ হয়েছে এই চরাচরে।

একরামের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বে
মাঝেমধ্যে ধুলো পড়লেও একরাম কিংবা আমি ফুঁ দিয়ে ধুলো ওড়াই।

নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প করি।
কুশল বিনিময় করি। এবং গল্পে গল্পে সে চলে আসে পুরুলিয়া। আমি চলে যাই বীরভূম।

বাস থেকে নেমে পড়েছি পুরন্দরপুরে। একরাম তখন পুরন্দরপুরে ঔষধের দোকান।
আমাকে দেখে তড়িঘড়ি ঝাঁপ ফেলে আমাকে নিয়ে চললো তার বাড়ি। বিকেল হতে হতেই আবার সদর রাস্তায় এসে বাসে উঠে সিউড়ি। বাবলিদি ও প্রভাতদার কাছে।

সারারাত গান কবিতা আড্ডা।

কথায় কথায় একরামের রসিকতা। আমরা হেসে কুটি কুটি।

এখনো তাই। পাঁচটা কথার মধ্যে
তিনটে কথা মজা করেই একরাম বলে। আশ্চর্য হই, নানারকম টানাপোড়েনের মধ্যেও সে কখনো
মানসিক পীড়নের কথা বলে না।
চাপে থাকলেও মুখ ফুটে বলে না।
এ বিষয়ে আরেকজনের কথা বলতে পারি, তিনি হলেন স্বপন চক্রবর্তী। কোনোদিন দুঃখ বেদনার কথা বলবেন না। চাপের কথা বলবেন না । তার বোন হার্টের সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি।
সেই তখন আমি ফোন করেছি। কিন্তু একবারের জন্যেও বোনের অসুস্থতার কথা বললেন না। 
পরে আরেক বন্ধুর কাছ থেকে জেনে, আমি স্বপনকে ফোন করলাম।

একরামও তাই।

সম্প্রতিকালে একরামের অসুস্থতার খবর 
অন্যের কাছ থেকে পাই। আমি ভিতরে ভিতরে বিচলিত হয়েছি তার কাছ থেকে সরাসরি কোনো খবর নিতে পাচ্ছি না।

প্রভাতদা ও বাবলিদির কাছ থেকে খবর নিয়েছি। তাদের কাছ থেকে একরামের খবর এখনো পাই।

আমাদের এই বন্ধুতা ও আত্মীয়তা আজও বহমান।

সে কথা বললে, প্রাণে বাতাস বয়ে যায়। ঢেউ ওঠে। তরঙ্গে তরঙ্গে জেগে ওঠা।

একরাম যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মহাত্মা গান্ধী রোডের প্যারামাউন্ট বোডিং হাউসে থাকছে, আমি তখন তার কাছে নিয়মিত থাকছি।

কলকাতায় তো আমার একটা বাসা ছিল না, উত্তর থেকে দক্ষিণ নানান ঘর নানান দুয়ার।
তবে উত্তরে থাকতেই, পছন্দ করতাম বেশি।

একরামের সঙ্গেই গেছলাম,অরণিদার বিয়ের বৌভাতে। একবার কি একটা সমস্যা হয়েছিল, সে আমাকে বললো----চলো সমরেন্দ্রর বাড়ি।

সমরেন্দ্ররদার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে দু চার দিন। কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি।
 কেন হয়নি, আজ আর বলতে পারবো না।

আজকাল দৈনিকের রবিবারের পাতায় একরাম যখন তার স্মৃতিকথা " ধুলো পায়ে " লিখছে আমি তখন তার নিয়মিত পাঠক।
মুগ্ধ পাঠক। ধারাবাহিক।

প্রতি রবিবার সেই লেখা নিয়ে তার সঙ্গে কথা।
একরাম, তোমার মনে আছে?

তোমার মনে আছে, শৌনকের জন্মদিনে তার বাড়িতে আমাদের মোচ্ছব?
আমি বোধহয় সেই প্রথম খুব পান করেছিলাম?

তখন সেই জীবনে কাব্য কবিতার
মাতলামিতে আমাদের দিন।
তখন পার্থদা(পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল) র সঙ্গে একরামের প্রগাঢ় সম্পর্ক। তখন একরামের কাছেই শুনেছি, পার্থদা সম্পর্কিত অনেক গল্পগাছা।

একরাম প্রসূন স্বপন কান্তির সঙ্গেও পুনর্বসু একটা কাগজে
আমি ছিলাম। এবং সেই কাগজের টাকার জন্য স্বপনের কাছে প্যাটেল নগর ছুটে যাওয়া।

তখন সমিদুল। অমরদা ইত্যাদি ইত্যাদি বন্ধু সিউড়িতে। তুমুল আড্ডা।
হোটেল থেকে বাবলিদি ও প্রভাতদার বাড়িতেও আড্ডা।

শতজল ঝর্নার ধ্বনি উত্তরবঙ্গে করবো এই প্রস্তাব দিতে প্রসূন একরাম ও আমি সমর রায় চৌধুরীর কাছে জলপাইগুড়ি।
ফেরার পথে অশ্রু কুমার শিকদারের কাছে টাকা নিতে যাওয়া।

মনে পড়ে একরাম?

আমার প্রথম দুটো বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। তৃতীয় কবিতার বই
" সীতা "প্রকাশের পর একরাম আমাকে একটা পোস্ট কার্ড পাঠিয়েছিল।

কোথায় যে হারিয়ে গেল!

সেই পোস্ট কার্ডের রাস্তা ধরেই
একরামের সঙ্গে আমার নিবিড়তা
শুরু হলো।
আমাদের কবিতার পথ আলাদা হলেও বন্ধুতার পথ একটাই----- ভালোবাসা।


যে ভালবাসা থেকে একরামের
তেঘরিয়া--দমদমার লাল ধুলো
উড়ে এসে আমার গায়ে লাগে।
আমি সেই ধুলো পুরুলিয়ার মাটিতে মেশাই।

বীরভূম ও পুরুলিয়া এক হয়ে
একই বাতাস আমাদের দুজন বন্ধুকে লালন করে।

ময়ূরাক্ষী ও বক্রেশ্বর আমাদের কাঁসাইয়ের সঙ্গে কথা বলে। বীরভূম ও পুরুলিয়া এক হয়ে একই বাতাস আমাদের দুজন বন্ধুকে লালন করে।

একরাম কি আজও কলকাতায় বসবাস করে! নাকি কলকাতায় শরীর থাকে তার ? আর মন থাকে
বীরভূমের মাটিতে?

এই প্রশ্ন বা আমার জিজ্ঞাসা দুলতে দুলতে একরামের কাছে পৌঁছলেও হয়তো একরাম নীরব থাকবে।
 অথবা আমার দিকে চেয়ে একটা দুষ্টু হাসি।

একরামের হাসি ধরে ধরে এই মুহূর্তে বলতে চাই-----একরাম ভালো থাকুক। ভালো রাখুক তার চারপাশ। তার কবিতা গল্প প্রবন্ধ
বিষয়ে সমালোচকেরা কথা বলবেন। আর আমি বলবো------
একরাম হাঁড়ি বাঁধতে থাকুক
তাল গাছের গলায়। খেজুর গাছের গলায়।

------৩০ শ্রাবণ ১৪২৯
-------১৭----৮----২০২২
------- নির্মল হালদার




Poem
Atijeebito [অতিজীবিত] (1983).
Ghanakrishna Aalo [ঘনকৃষ্ণ আলো] (1988) and (sristi edition:2000) ISBN 81-7870-129-4.
Aandhar Taranga [আঁধারতরঙ্গ] (1991).
Baanraajpur [বাণরাজপুর] (2000) ISBN 978-81-85479-79-8.
Ekram Alir Kobita [একরাম আলির কবিতা] (2001).
Ekram Alir Shreshtha Kobita [একরাম আলির শ্রেষ্ঠ কবিতা] (2008) ISBN 978-81-295-0778-5.
Pralaykatha [প্রলয়কথা] (2009).
Andhar poridhi [আঁধার পরিধি] (2013).
Bautir kobita [বাউটির কবিতা] (2014).
Kobita sangraha [কবিতা সংগ্রহ] (2017) ISBN 978-93-82879-87-9.
bipanna Granthipunja [বিপন্ন গ্রন্থিপুঞ্জ] (2017).
Pora Matir Ghori [পোড়া মাটির ঘড়ি] (2020).

Memoir
Dhulopaye [ধুলোপায়ে] (2015, 2019) ISBN 978-93-88351-56-0
Harrison Road [হ্যারিসন রোড] (2020) ISBN 978-93-89377-92-7

Novel
Digonter Ektu Age [দিগন্তের একটু আগে] (2015) ISBN 978-81-295-2425-6

Essays
Musalman Bangalir Lokachar [মুসলমান বাঙালির লোকাচার] (2006).
Apollor paakhi [অ্যাপোলোর পাখি] (2008) ISBN 978-81-7990-080-2.
Bedonatur Alokrekha [বেদনাতুর আলোকরেখা] (2020) ISBN 978-93-89377-86-6.

Biography
Atish Dipankar [অতীশ দীপংকর] (1997

Awards
Birendra Puraskar for 'Ghanakrishna Alo' in 1990.
Paschim Banga Bangla Academy Award for 'Dulopaye' in 2016.


































শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০২২

পায়েসের আলো



পায়েসের আলো
-------------------------

দোকান থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাবা এসে মায়ের কাছে জানতে চায়---- কি করছো গো ছোট বউ?
মা উত্তরে বলে----কি আর করবো
এইতো ঠাকুর পূজা করে উঠলাম।

বাবা আরো জানতে চায়----কি রান্না করবে তুমি?
মা বলে---আগে উনুনটা ধরাই।
তারপর ভাববো, ঝোল হবে না ঝাল হবে। নাকি শুধু ভাত ডাল পোস্ত?

মায়ের কথাবার্তা বাবার পছন্দ হলো না। বাবা চলে গেল দোকান দিকে। দোকানে খদ্দের দেখছে, আমার বড়দা।

বেলা ঢের হয়েছে।

শ্রাবণের দিন। সকাল দিকে বৃষ্টি ছিল। এখন গনগনে রোদ। বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। ঘাম জমছে খুব।

বাবার গায়ের গেঞ্জি ভিজে গেছে।

বাবা হঠাৎ ভাবলো, আর দুটো ছেলে কোথায়? স্কুল গেছে তো?
বড় ছেলে নারানকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে দোকানে ঢোকাতে হলো।
বাবা আর একা একা পেরে উঠছিল না।

চারটে মেয়ের মধ্যে তিনটে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছে। ছোট মেয়েটা এখন বেশ ছোট।

আর আমি বেশ ছোট হলেও 
আমাদের ঘরের সব দেখতে পাই।
সব শুনতে পাই।

মা কখনো কখনো লুকিয়ে কাঁদে।
আমি দেখতে পাই। কিন্তু কান্নার কারণ বুঝে উঠতে পারি না।

আমি তো পাড়ার এক স্কুলেই পড়ি। প্রতিদিন সকালবেলা।

বাবা আবার দোকান থেকে হড়বড়িয়ে ঘরে ঢুকে এক থলি সবজি মেঝেতে ঢেলে দেয়। আর মাকে ডেকে বলে---আজ সাত তরকারি রান্না করবে।

মা রাগের সুরে বলে----একহাতে অত রান্না করতে পারবো না। বাবা বলে----বড় বৌমা তো আছে, তোমাকে সাহায্য করবে।
মা এবার বেশ জোর গলায় বাবাকে জানায়---কয়লা নয় সব পাথর। উনুন ধরবে কিসে?
ডাল ভাতটা হয় কিনা দেখো?

কি কথা বলছো তুমি?
এই কথা বলে বাবা চলে যায় চৌকাঠের বাইরে। 
উনুনে পাখার হাওয়া দিতে দিতে
বৌদির চোখে ধোঁয়ার জল। দাদা দোকান থেকে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানতে চায়----অনেক বেলা হল গো---আমাকে কেউ দুটি মুড়ি দিলে না?
মুড়ি খেয়ে বাজার যেতে হবে একবার। বাবা বলেছে, মাছ নিয়ে আসতে।
মাছ তো আমি রোজ নিয়ে আসি।
বাবা জানে। তারপরও কেন বললো আজ মাছ আনতে? বেশি করে আনতে বলেছে। বেশি করে কেন? মা তুমি জানো?

মা ঘুঁটে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বৌদির হাতে দিয়ে বলে----আমি জানি না। আজ কি পরব।

উনুন ধরছেনা বলে, বৌদি উনুনে ঘুঁটে 
গুঁজতে থাকে। তার সঙ্গে কাঠের কুচো।

ছোটমামা এসে গেছে। সঙ্গে এক থলি মাছ। অন্যদিন মামা দুধ নিয়ে আসে। প্রতিদিন নিয়ে আসে। আজ দুধ নেই।

আমার ছোট মামা বাসের ড্রাইভার। মানবাজার থেকে পুরুলিয়ার বাস নিয়ে আসে।
আমাদের ঘরেও রোজ এসে মুড়ি খেয়ে যায়।
আমি খুব ছোট হলেও সব দেখতে পাই। সব শুনতে পাই।

বাবা একদিন বলছিল----ভাগ চাষী আর ভাগের ধান দিচ্ছে না।
ধান বিক্রি করে যে  আরো কিছু করতে পারবো, তার কোনো দিশা নেই।

তিন মেয়ের বিয়ের পণ দিতে দিতে যেটুকু জমানো ছিল শেষ হয়ে গেছে। দোকানেও তেমন পুঁজি পাটা নেই। 

মা গজগজ করে। বলে----তোমার ঘরে কুটুমের আনাগোনাও তো লেগে আছে। 
বাবা বলে----সে তো ভালো গো।
তুমি যদি তোমার রাঁধা ভাত কুটুমকে খাওয়াতে পারো পুণ্য হবে গো। পুণ্য।

মা বাবার কথার জবাব দেয়------
আজ কি দরকার ছিল এত শাকসবজির। এতেও তো বেশ পয়সা চলে যায়।
বাবা এবার হাসতে হাসতে বলে--
তুমি ভুলেই গেছো ছোট বউ, আজ তোমার ছোট বেটার জন্মদিন। আজ ২১ শ্রাবণ।

মায়ের গালে হাত। ওমা---এই দেখো আমি ভুলেই গেছি। সকালবেলায় বলবে তো, মন্দিরে পুজো দিতাম। সে হয় দিলাম না।
কিন্ত পায়েস তো করতে হবে। আজ দুধ নেওয়া হয়নি। বাছুরে সব দুধ খেয়ে ফেলেছে।

বাবা আবার হাসতে হাসতে বলে--
দাঁড়াও দেখছি। আমি বাজারে যাই।

আমি জানি, বাবা দুধ পাবে না।
এ সময় ময়রা দোকানেও মিষ্টির কাজ শেষ হয়ে যায়।

আমি ছোট হলেও সব জানি।

আমি শুধু মাকে বলতে পারলাম না, পায়েস ছাড়াই আজ ভাত খাব। তুমি শুধু ছোটবেলার মতো আমার কপালে চাঁদের টিপ দিয়ে দিও।
  
সারা ঘরে পায়েসের গন্ধ ছড়াবে।


----১৯ শ্রাবণ ১৪২৯
-----৫---৮----২০২২
------নির্মল হালদার




আরও পড়ুন












































বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০২২

কটা লাইক পড়লো?



কটা লাইক পড়লো?
----------------------------

ফেসবুকে নানা ছবি। নানা রঙ। নানা মুখের নানান আঁকিবুকি।
নিত্যনতুন নিজের মুখের প্রচার।

নিত্য নতুন বিজ্ঞাপন।

নিজের বিজ্ঞাপন।

ঘরে আমি মাছ কুটছি ------
এই বিজ্ঞাপন যেমন নিজের ফেসবুকে পোস্ট করছি তেমনি
আমি রেস্তোরায় বিরিয়ানির সামনে, সেই বিজ্ঞাপনও
নিজের ফেসবুকে।

শাড়ি জামা কাপড় ফেসবুকে।

ঘুম থেকে উঠেই সকালবেলা ফেসবুক খুলে দেখতেই হবে,
কাল রাত্রে দেওয়া আমার ফেসবুক পোস্টে ক ' টা লাইক পড়লো। 

লাইক যদি কম পড়ে সকালের আলোতেই অন্ধকার হয়ে আসে মুখ। দাঁত মাজতেও মন লাগেনা।

সকালের চা বিস্বাদ লাগে।

বেলা বাড়লেও কাজে মন নেই। অস্থির অস্থির লাগে। ফেসবুক কর্তা কাজের ফাঁকে চেষ্টা করে নতুন কোনো খবর দেবার জন্য। 
নতুন কোনো ছবি দেবার জন্য।
যদি লাইক পড়ে! যদি কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়।

ঝগড়া ঝাটিও চলে। তর্ক বিতর্ক চলে।

আমাদের ফেসবুক। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া। 

এই সামাজিক মাধ্যম থেকে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পায় যেমন, 
তেমনি কোনো সামাজিক সংস্কারের কাজে জনসাধারণের সামনে ভিডিওর মাধ্যমে সামনে আসা যায়। বক্তব্য রাখা যায়।

যদি এই মাধ্যমে প্রতিদিন একটি করে গাছের ছবি এবং তার পরিচয়, উপকারিতার কথা লেখা যায়?
আমার মনে হয়, মানুষের কাজে লাগবে।

শুধু তাই নয়, এখন বাংলা কোন্
মাস চলছে, কি তিথি চলছে ফেসবুকে পোস্ট করলে অনেকে জানতে পারবে। কারণ, বাংলা মাস ও বছরের অধিকাংশ মানুষ খবর রাখে না।

কিন্তু ফেসবুক তো অন্য কথা বলে। কেউ কেউ আছেন, কোনো একটি বিষয়ে বিতর্ক তুলে দেয়।

তাহলে, সেই বিতর্কে অনেকে যোগ দেবে।আর যোগ দিলেই, উল্লাস।


দুই বন্ধু পাশাপাশি। কথা বলছে না। দুজনেই ঘাঁটাঘাঁটি করছে মোবাইল। 
একজন হাসছে একা একা। আরেকজন চুপচাপ।

শুধু তো ফেসবুক নয়। হোয়াটসঅ্যাপ আছে। টুইটার আছে। ইনস্টাগ্রাম।
কার কত ফলোয়ার বাড়ছে কমছে দেখা যাবে। সাধারণ মানুষ যদিও টুইটার ইনস্টাগ্রামে নেই।
তাদের শুধু ফেসবুক।

বাইক কিনেছে। ফেসবুকে ছবি দাও। নতুন মডেলের সাইকেল কিনেছে। ছবি দাও।

কখনো কখনো বাড়িতে ফুটে উঠা
কোনো ফুলের ছবি। শিশুর হাসির ছবি।
ভুলেও কেউ দেবেনা , বৃষ্টিহীন শ্রাবণের ফুটি ফাটা মাঠ। 

খরার অজানা আতঙ্কের কথা বলবে না কেউ।
সবাই তো নিজের নিজের বিজ্ঞাপন করতে সদা ব্যস্ত।

অনাহারের ছবি দিয়ে কেউ কেউ গৌরব বোধ করে। মনে করে, একদম নতুন একটা ছবি দিলাম। বা নতুন সংবাদ।

একদম ছক্কা।

অথচ এই মাধ্যমটিকে সঠিক ব্যবহার করতে পারলে, যে যার 
সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা আরো অনেকের কাছে ভাগ করতে পারবে।
যে অভিজ্ঞতা গুলি অন্যের কাজে লাগবে।

কেন্দ্র ও রাজ্যের দুর্নীতির কথাও তো বলা যায়। চোখ খুলে দেওয়া যায় আম জনতার। অথচ একজন যুবক ডিজের তালে তালে নাচানাচি করছে, তার ভিডিও ফেসবুক। হোয়াটসঅ্যাপে।

ইট ভাটায় সন্তানকে মাটিতে শুইয়ে মা মাথায় নিয়ে আসছে ইট। তার যে করুণ অবস্থা, তা নিয়ে দু কথা লিখলো না কেউ।

বৃষ্টির অভাবে ধানের চারা মরে গেল। তার জন্য উদ্বেগ অথবা বিচলনের ভাষা দেখতে পেলাম না।

অজস্র শিক্ষিত ছেলেরা বেকার হয়ে সরকারের দুয়ারে অনশন করেও সমস্যার সমাধান করতে পারে না, তার যে সংকট
ক' জনের  সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখতে পাই?

দেখতে পাই, শুনতে পাই-------
আজ আমি এই এতগুলো লাইক পেলাম।
আবার এও হয়ে থাকে, অন্য কারোর একটি পোস্ট না বুঝে না পড়ে একটা লাইক। অর্থাৎ একটি চিহ্ন।

সব সময় প্রচারে থাকা।

সব সময় নিজের অস্তিত্বের প্রচার। অথবা বিজ্ঞাপন। যেন বা নিজেই সে একটি বিপনী।

আমি আছি আমি আছি ------
এই ঢাক বাজাতে বাজাতে বাজারে থাকা।

বাজারে যে শিশু চায়ের গ্লাস ধুতে ধুতে ঘুমিয়ে পড়ছে, মোবাইল থেকে মুখ তুলে কবে দেখবো?

নিজের জন্মদিনের প্রচার করার পর আমার ভাবনা, মৃত্যুর আগে
সমাজ মাধ্যমে লিখে যেতে পারবো তো, ভাই আমার বিদায় দ্বার খুলে গেছে। 



------১৮ শ্রাবণ ১৪২৯
------৪----৮----২০২২
------নির্মল হালদার


























কবি নির্মল হালদারের বিভিন্ন সময়ের ছবি

পড়ুন "ঘর গেরস্থের শিল্প"

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ